♦ ফোটোগ্রাফি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত – এই দুইই ওতপ্রোতভাবে রয়েছে আপনার জীবনে। ফোটোগ্রাফির কথায়তো আসবই। রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্রনাথকে কেমনভাবে পেয়েছেন আপনার অনুভবে?
আসলে রবীন্দ্রনাথতো সবার কাছেই প্রিয়, সে অর্থে বলার কিছুই নেই। তবে এই চোদ্দমাস শুয়ে থাকার সময় আমার একটাই সাথী ছিল – গীতবিতান। আমি চোদ্দমাস কিন্তু আর কিচ্ছু পড়িনি, শুধু গীতবিতান পড়েছি আর সুচিত্রা মিত্র-র কথাটা মিলিয়ে দেখেছি যে এখনও আমরা কিছুই বুঝিনা রবীন্দ্রনাথকে। বড়োজোর বলতে পারি যে লোকটা খুব বাজে ছিল, সব কথা বলে গেছে। আমাদের আর কিছু ভাবনার জায়গা নেই। শুধু তাই নয়, এমনধরণের কথা বলে গেছে, যেটা এখন অসুস্থ হওয়ার পর শুয়ে শুয়ে মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীতে এরকম লোক খুব কমই এসেছিল, আনপ্যারালাল বললে ভুল হবে না। অনেকেই নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন, অনেকেই সাহিত্যিক হিসেবে অনেককিছু করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ধারেকাছে আমার ধারণা কেউ নেই। উনি যা করে গেছেন, যদি উপলব্ধি করা যায়, তাহলে আর কিছু নিয়ে থাকতে হবে না – পেন্টিং, ফোটোগ্রাফি , সিনেমা – কিচ্ছু দরকার নেই, রবীন্দ্রনাথই যথেষ্ট।
♦ আপনি যেসময় ফোটোগ্রাফি চর্চা শুরু করেন সেইসময় খুব কম বাঙালিই ক্রিয়েটিভ ফোটোগ্রাফিকে পুরোদস্তুর পেশা করার কথা ভাবতেন। এই ভাবনাটা আপনার কীভাবে এল? শুরুটাইবা কেমন ছিল?
আমার নিজের এখনও ধারণা, যারা কিছু করতে পারে না তারা হয় ফোটোগ্রাফার নয় মাউন্টেনিয়ার হয়। সেটাই হলুম আর কী...। কিছু করতে পারলামনা, ফোটোগ্রাফার হলাম (প্রাণখোলা হাসি)।
আমি ফোটোগ্রাফিক অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (পি.এ.বি.)-তে ভর্তি হই। একটা এঁচোড়ে পাকা ছেলে, যার বয়স প্রায় বছর তিরিশেক, কিছুই করতে পারেনি, এমনকী একটা চাকরিও করেনা, হাজির হয়েছে ফোটোগ্রাফি শিখতে, তায় সম্বল একটা পেনট্যাক্স ক্যামেরা, কোন বাড়তি লেন্স নেই। প্রথমে আমাকে ভেতরে বসতে দেয়নি, বলেছিল, পাপোষ আছে, পাপোষে বসতে। ন’মাস বাদে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। আমার একটা চ্যালেঞ্জ তখন ছিল যে, আই উইল গো টু দ্য টপ। একদিন আমি যাব, একটাই চেয়ার আছে, সেখানে যেই বসে থাকুকনা কেন, উঠে আমায় বসতে দেবে। আজকে আমি গেলে সেই চেয়ারেই বসি।
বিজ্ঞাপনের জগতেও একসময় কাজ করেছি, তবে ইনডোরে নয়, আউটডোরে। তখন বিজ্ঞাপনে সমর ঘোষ, সাত্যকি ঘোষ, বিবেক দাস এরা কাজ করে – সব নামকরা লোক। ওরা যে খরচা করে স্টুডিও সাজিয়েছে, আমিতো ওদের ধরতেও পারবনা। আউটডোরে বরং কেউ একটা বড় কাজ করতে চায়না। কী লাইট হবে, কোথায় কোথায় ঘুরতে হবে...। আমাকে তো থাকতে হবে এক নম্বরে! (হাসি) আমি গেলাম বিজ্ঞাপনের আউটডোরে – টমসন, বেস্ট শুরু করে যতগুলো বড় কোম্পানি সবার সঙ্গেই আমি কাজ করেছি, এমনকী এখনও তারা যোগাযোগ রেখেছে, আসে।
♦ ল্যান্ডস্কেপ না পোর্ট্রেট – কোনটা বেশি ভালো লাগে?
আমার তোলা ল্যান্ডস্কেপ লোকে ভালো বলে, আমার কিন্তু নিজের পছন্দ ল্যান্ডস্কেপ নয়, মানুষ। একবার পাহাড়ে গেছি – আমাদের টিমের যে ক্যাপ্টেন তার সঙ্গে ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল। আমায় বলে, তখন সেই সানসেটের দুখানা ছবি তুলে ক্যামেরা বন্ধ করে দিলি কেন রে? বললাম লাল হল...আরেকটু লাল হল...তারপরে সানসেটটা হয়ে গেল, তুললামতো, আর কী তুলব? বলল, তাই বলে মেয়েদের পেছনে ছুটতে হবে? বললাম, মেয়েদের পেছনে ছুটছি না, কিন্তু অদ্ভুত দেখতে মেয়েগুলোকে, দেখছি কোনটা ভালো হয়। সানসেট তুলছিসনা, ল্যান্ডস্কেপগুলো বাদ দিচ্ছিস আর নিজেকে বলবি ল্যান্ডস্কেপার! এটা হয় নাকি? আমি বললাম, আশ্চর্য কথা, সানসেট কিন্তু একই টাইমে হয়, এটা সায়েন্স। রোজ আমরা লক্ষ্য করি না, কোথাও বেড়াতে গেলে দেখি। এতে কোন নতুনত্ব নেই। তেমন একটা মেঘ, একটা গাছ এরকম কোন কিছু বেস করে তুলতে পারলে একটা অন্যরকম ছবি হতে পারে। তাছাড়া শুধু একটা সানসেটের মানে কী? কী হবে তুলে? মেয়েটা কিন্তু প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে – রেগে যাচ্ছে, গালাগালি করছে - ছবি তুলবে না, ডোন্ট শুট, তুললে পয়সা দিতে হবে। কখনো কাঁদছে, ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে, বাচ্চাকে নিয়ে খেলছে...। একটা বড় মেয়ে যখন কাঁদে-হাসে, তার যে ব্যাখ্যা, যে মানে সেটা অনেককিছু, অনেক বেশি এফেক্টিভ আমার কাছে। রঁদ্যা থেকে এটা শুরু হয়েছিল। ওরা জেন্টস কাস্টকে অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। পেন্টিং-এ দালি এল, ভ্যানগগ এল তখন আস্তে আস্তে মেল ফিগারটা কমিয়ে নিয়ে এল ফিমেল ফিগার। আগে গ্রীক মূর্তিতে দেখবে ফিমেল ফিগার কম ছিল, বেশিরভাগই মেল ফিগার। পরে মেল ফিগার কমে ফিমেল ফিগার এল তার অন্যতম কারণ, ঠিকঠাক মেল ফিগার করা অনেক ডিফিকাল্ট। আর ফিমেল ফিগারের কন্ট্যুর, লাইট অ্যান্ড শ্যাডোর কিছু পোর্শন – করতে সুবিধা হয়, আঁকতে সুবিধা হয় – একটু ফাঁকিবাজি দিয়েও হয়।(হাসি)
আমি মেয়েদের ভালোবাসি তাই তাদের ছবি তুলি। ছবি তোলার কিছু নিয়ম আছে। এব্যাপারেও আবার রবীন্দ্রনাথের কথায় ফিরে আসি। 'যোগাযোগ' উপন্যাসে রয়েছে – কুমুর ওই ছবিটা যেন দৈবের রচনা। কপালে যে আলোটি পড়লে কুমুর মনের চেহারাটা মুখে প্রকাশ পায়, সেই আলোটিই পড়েছিল – এটাই হল পোর্ট্রেটের লাইটিং। রবীন্দ্রনাথ একটা ছোট্ট কথায় তাকে বুঝিয়ে গেছেন। আবার 'চোখের বালি' উপন্যাসে একজায়গায় আছে, বিনোদিনী শুয়ে পড়েছে - তখন মহেন্দ্র পা টিপে টিপে এসে দেখল বিনোদিনী ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল। মাথার থেকে চুলটা এলো করা। ও আস্তে আস্তে বিনোদিনীকে প্রদক্ষিণ করল। কোনদিক থেকে ছবি তুললে ভালো লাগবে তা দেখতে লাগল। পরে চুলটা একটু সরিয়ে দিল কপালের। ভালো না লাগাতে আবার যা ছিল তাই করে দিল। আশাকে বলল, আস্তে করে লাল শালটা পায়ের দিকে একটু টেনে দাও, মানে ব্যালেন্স করার জন্য। তারপর সে ক্যামেরা নিয়ে এল। তার মানেটা কী? রবীন্দ্রনাথ জানতেন ক্যামেরা কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।
♦ আপনার ছবিতে নীল রঙের গভীরতা দেখা যায়। এটা কি জীবনবোধের প্রতিফলন?
নীল মানে কী বলতো? মিথোলজিকাল একটা মানে হয় আবার সাধারণভাবে আরেকটা মানেও হয়। অন্তহীন – এন্ডলেস – যার শেষ নেই। মহাকাশ সম্বন্ধে যখন ভাবি নীলের পরে নীল, কোনো শেষ নেই, মাথাটা কেমন গুলিয়ে যায়। আবার নীল কিন্তু শিবের রঙ। একটু গাঁজা খাওয়া লোক, অল্পেই সন্তুষ্ট। রেগে গিয়ে দক্ষযজ্ঞ করতে পারে সেতো আলাদা কথা, এমনিতে কিন্তু শান্ত।।
আমার কেন নীল পছন্দ সেটা বলতে গেলে একটা ঘটনার কথা বলতে হয়। একবার শান্তিনিকেতন থেকে সিউড়ি যাচ্ছিলাম। পথে অজয় নদী পড়ে। আর যে বনটা পড়ে অজয়ের আগে, সেটা খুব ঘন ছিল। যেতে যেতে বাসটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। সারানো হবে, আমি চুপ করে বসে আছি। দেখি লোকজন সব টুকটুক করে নেমে পড়ছে – সবাই চলে গেল। ড্রাইভার, খালাসি মিলে একটা চাকা খুললো, কীসব একটু ঠুকঠাক করল, তারপর চলে গেল। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, কেউ নেই। আমার সম্বল বলতে পাঁচটা টাকা আর পেনট্যাক্স ক্যামেরাটা আর মোটে চারটে সিগারেট। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে রুকস্যাকটা নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। খুব ডাকাতের ভয় এখানে। কী করে রাত কাটাব, কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। দূরে অজয় দেখা যাচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে গেলাম। তারপর একটা ঝোপের আড়ালে মশাটশা অগ্রাহ্য করে শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম কোন একটা সময়। হঠাৎ কানে এল স্তোত্রপাঠের আওয়াজ – এরকমতো কালকূটের লেখায় আছে। দেখি 'বল হরি' ডাক দিতে দিতে একদল লোক আসছে। শ্মশান! একটা বাচ্চা মেয়েকে পোড়াতে এসেছে। শ্মশানেই শুয়েছিলাম সারারাত, বুঝতে পারিনি! 'ওঁ জবাকুসুম' সূর্যমন্ত্র কানে আসছে... আর তখন পুরো ব্লু কাস্ট... নীলাভ একটা রঙ, আর কোন রঙ নেই। সেই প্রথম নীল রঙটা চোখে লাগল – জীবন-মৃত্যুর সন্ধিতে দাঁড়িয়ে। জীবনটাকে জানতে আরম্ভ করলাম। তখন থেকে নীলটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
♦ অ্যানালগ আর ডিজিটাল – ফোটো তোলার এই দুই মাধ্যমেই আপনি স্বচ্ছন্দ – কোনটা বেশি ভালো বলে মনে হয়?
'নায়ক' সিনেমায় একটা কথা ছিল, মানিকদারই লেখা – কথাপ্রসঙ্গে একটা জায়গায় উত্তম বলছেন – হ্যাঁ, যেকারণে ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর প্রয়োজন হয়। ডিজিটাল ক্যামেরাতেও সেই ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর প্রয়োজন। মোর প্রোডাকশন অ্যান্ড মোর রাবিশ প্রোডাকশন। পি.এ.বি.-তে প্রচুর ছবি দেখতে হত, তাও কী একেকজনের দু রোল-তিন রোল। আমি একটা এক্সপেডিশনে গেছি, তিনরোল ছবি তোলা মানে একশো আটটা ছবি। এর মধ্যে হয়ত আশি-নব্বইখানা ছবি আমার থাকে লোকজনকে দেখানোর মত। তখন যেসব ছেলেমেয়েরা আমার কাছে ক্লাস করত ওই তিনরোল-চাররোল নিয়ে এল, দেখলাম দু'মিনিট – এই চারটে ছবি ভালো আছে বলে দিলাম। আর এখন তারা ১৬ জিবি ছবি নিয়ে আসে – দু'হাজার ছবি – একটু দেখে দেবেন স্যার! না। আমার কম্পিউটারে ১৬ জিবি জায়গা খালি নেই, আর ১৬ জিবি ছবি দেখতে গেলে আমার মাথা ঘুরে যাবে। ওর থেকে বাছা যায় না। এখন একটা হনুমানের ল্যাজ, তাই তোল – কী যে তুলছে, কী যে আগডুম-বাগডুম হচ্ছে আমি জানি না।
তবে ডিজিটালের অনেক সুবিধাও আছে - শুট করলে, ইরেজ করলে... বলতো এটা কোন সিনেমা? (দুষ্টু হাসিমুখে উঠে গিয়ে 'আবহমান' সিনেমাটা চালালেন। কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল কালিম্পং-এর সকাল - দীপঙ্কর দে আর যীশু সেনগুপ্তের কথোপকথন –
- ল্যাটিচুড মানে বোঝ?
- ল্যাটিচুড? ইমাজিনারি হরাইজোনটাল লাইনস দ্যাট রিভার্স দ্য সারফেস অফ দ্য আর্থ?
- ফিল্মে আমরা যখন ল্যাটিচু্ড বলি..
- রেঞ্জ... স্কোপ... টলারেন্স।
- তুমিতো ভিডিওতে কাজ করেছ?
- সেলুলার ল্যাটিচুড এটার থেকে অনেক বেশি বাবা!
- ভিডিওতে ইরেজ করে আবার যখন রেকর্ড কর সেটা বোঝা যায়?
- তুমি কী ভিডিওতে কাজ করার কথা ভাবছ? তোমার ভালো লাগবেনা বাবা। ডেনসিটি পাবে না, টোন পাবে না, তাছাড়া ফিল্মের লঞ্জিভিটি অনেক বেশি।
- তাতে লাভ? কদিন পরে দেখলে সব কাজটাই মনে হয় কিছু হয়নি। তোমার মনে হয় না?
- এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব...
- বরং এটাইতো ভালো – শুট করলে, ইরেজ করলে, আবার শুট করলে, আবার ইরেজ করলে...পছন্দ হলনা নতুন করে এডিট করলে, আবার ইরেজ করে দিলে...যেকোন মোমেন্টে আবার নতুন করে শুরু করা যায়।)
সিনেমাটা বন্ধ করে হাসিমুখে বলে চলেন, শুট করলে, ইরেজ করলে, আবার শুট করলে, আবার ইরেজ করলে...
♦ আচ্ছা, ফোটোগ্রাফার না হলে অন্য কী হতেন?
সিনেমার পরিচালক হতাম। (হাসতে হাসতে)
♦ একটা সময় বেশ কিছুকাল সত্যজিত রায়ের সংস্পর্শে এসেছিলেন - আপনার ঘরটায় ঢুকলেও যেটা মনে হয় সত্যজিত রায়ের একটা প্রভাব আপনার ওপর ভীষণভাবে রয়েছে – সত্যজিতের শুটিং-এর ছবি, এই যে কম্পিউটারে ওঁর করা মিউজিক বাজছে...এই সব কিছু মিলিয়েই। পরিচালক হওয়ার ইচ্ছেটাও কী তাঁর প্রভাব?
হয়তো। আমার কাছে ফিল্মের শেষ কথা সত্যজিত রায়। মানিকদার বই আমি প্রথম দেখি 'পথের পাঁচালী'। তখন নামটাম জানতাম না, জানার মত আমার বয়সও নয়। বইটা প্রাইজ টাইজ পেল শুনলাম। আবার ইন্দিরা হলে এল। বাবা বলল আবার দেখতে যাবে, মাও তাই, আমি বললাম, আমিও যাব। কেন জানিনা তখনই আমাকে বইটা হন্ট করেছিল। তারপর 'অপরাজিত', 'অপুর সংসার', সত্যজিতের আরও যা যা ছবি রিলিজ করছে, কী কাজ করছেন, না করছেন সব খোঁজ রাখতাম। ৬৩ সালে 'মহানগর' বেরিয়েছে, আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, একটা সমালোচনা লিখে আনন্দবাজারে পাঠিয়েছিলাম, সেটা ছাপাও হয়েছিল। সেইসময় থেকেই মানিকদার ছবিতে আমার আগ্রহটা তৈরি হয়। তখন অবশ্য মানিকদা নয়, সত্যজিত রায়ই বলতাম। পরে আমি বিয়েও করেছিলাম রায় পরিবারেই। সেইসূত্রে আমার যাওয়ার একটা সুযোগও হল। মনে হল, বহুদিনের ইচ্ছাটা মেটাই, যাই তাহলে। সবাই আমাকে বলল, তুমিতো সবে কাজ শুরু করেছ, ভালো কাজও করছ, মানিকদাকে বললে নিশ্চয় তোমাকে কাজ দেবেন। আমি বললাম, না, ছবি দেখাতে পারি, গল্প করতে পারি, কিন্তু কাজ চাইতে পারব না। আমি প্রথম দিনই বললাম, আপনার কী বই আরম্ভ হচ্ছে? বললেন, 'ঘরে বাইরে'-র শুটিং চলছে। বললাম, শুটিং দেখতে যাব। বললেন, হ্যাঁ, এস। ওনার কাছে একটা জিনিস শিখেছিলাম, সেটা হল টাইম মানে টাইম – আড়াইটে মানে আড়াইটেই, দুটো পঁয়ত্রিশ নয়। ওনার বইতে কত সূক্ষ্ম জিনিস থাকে যেটা শেখা যায়। আমি একেকটা বই দেখেছি বোধহয় দুশো-তিনশবার করে, প্রায় মুখস্ত। যেকোনো বইয়ের ডায়লগ বলতে পারব, ইন্টারলুড মিউজিক বলতে পারব। আমি সত্যজিতের মিউজিকের ভীষণ ফ্যান। 'চারুলতা' পরপর তিনদিন দেখি। একদিন হল থেকে বেরোচ্ছি – ওপর থেকে সত্যজিত আর হেমন্ত নামছেন। হেমন্ত বলছেন, আর তো মিউজিক করা যাবে না মানিকদা, আপনি যা করেছেন! সত্যজিত হাসলেন।
♦ আপনার লেখা একটি ভ্রমণকাহিনি সংকলন বেরোচ্ছে শুনলাম। আপনিতো অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন, শুধু ছবি তোলাই নয়, বেড়ানো নিয়ে আপনার প্রচুর লেখাও আছে। অথচ সেভাবে ভ্রমণলেখক হিসেবে আপনাকে পাইনা কেন?
আমার লেখা প্রায় সাত-আটশো আছে। তবে তথাকথিত ভ্রমণকাহিনি – শিলং-এ কী করে যেতে হয়, গৌহাটিতে যাবে না কোথায় যাবে, প্লেনে যাবে না কীসে যাবে, বড়াপানি আছে না শিলং পাহাড়ে কী আছে – এসবতো আমি লিখি না। আমার গোটা পনেরো লেখা নিয়ে একটা সংকলন বার করছে রূপসী। সব কটা কাহিনির মধ্যেই একটা মোচড় আছে। শিলং নিয়ে লেখাটার কথাই বলি – এগারোটা বেজে গেছে। রাত্তিরবেলা, আলোগুলো সব নিভে গেছে। অন্ধকারের মধ্যে আসছি, হট্ করে কয়েকজন লোক আমাকে জাপটে ধরল। 'বস্ দেখতো' - একজন আমার মুখে টর্চ ফেলল। জীবনে সেই প্রথম 'কোল্ড সোয়েট' হল। সেকেন্ডের মধ্যে অদ্ভুত ঠাণ্ডা একটা ঘামের স্রোত ঘাড় থেকে শুরু করে একেবারে প্যান্টের নীচ অবধি চলে গেল। টর্চটা মারবে, দেখবে, দেখে শুট্। বলল, নাঃ। চলে গেল। এই যে ঘটনাটা এটা দিয়েই শুরু করেছি। অনেক প্রশংসা পেলেও লেখাটা কিন্তু কোনদিনই আমার কাছে বড় কিছু নয়, আমার এখনও শখ ছবি বানানো, স্টিল নয়, স্টিলতো বাধ্য হয়ে করেছিলাম।
♦ বেড়ানোর প্রসঙ্গে আসি - ছবি তুলতে গিয়ে বা কর্মসূত্রে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, কোন জায়গাটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে?
ভালোলাগাটা মনের ওপর। যদি মনের ভালোলাগে, তাহলে সবই ভাললাগবে। তখন নিয়মিত ক্যাম্পে যেতাম। একবার একটা শিশুগাছের তলায় ছিল আমার তাঁবুটা। দ্বিতীয় দিন চা-টা খাওয়ার পর বেরোচ্ছি হঠাৎ লক্ষ করলাম গাছ থেকে চারটে পাতা পড়ল। তৃতীয় দিন দেখলাম একটা হাওয়া দিল, আবার চারটে পাতা পড়ল। চতুর্থ দিন থেকে আমার ভালো লাগতে শুরু করল। আমি বসে থাকতাম পাতাটা পড়ার জন্য।
(কথা বলতে বলতে শিবনাথদার তোলা ছবির স্লাইড শো দেখছিলাম আমরা – ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজছিল একটা অচেনা সুর ) - এই যে মিউজিকটা শুনছ – নর্থ ওয়েস্ট আমেরিকাতে কিছু পার্ক আছে, সেখানে বিকেলবেলায় ভিখিরিরা আসে পিয়ানো নিয়ে, টেপরেকর্ডার নিয়ে। ওরা বাজনা শুনিয়ে ১-২ ডলার নেয়। তুমি চাইলে তোমাকে একটা সিডি করে দেবে। কী অদ্ভুত সেই বাজনা। ওই পরিবেশে বসে শুনতে শুনতে একটা অন্যরকম ভালোলাগে। আমার কাছে এরকম নানাধরণের বাজনার সংগ্রহ আছে। আমার জীবনটাই এখন চলে মিউজিকের ওপর বেস করে – হয় রবীন্দ্রনাথের গান, নয়তো মানিকদার মিউজিক, গিটার, অন্যকিছু।
আমরা প্রথমবার দার্জিলিং যাচ্ছি – জীবনে প্রথম পাহাড় দেখব। কিছু ছেলে বলতে শুরু করল, ছোটনাগপুরটাই ভালো ছিল – লাল মাটি, সাঁওতাল, মাদল। দার্জিলিংটা যে কেন মাথায় এল, হিমালয়ে যে কী সুখ আছে কে জানে! আগে থেকেই বলতে আরম্ভ করেছে তাদের দার্জিলিং ভালো লাগেনি। আমার কিন্তু প্রথম থেকেই মনে হয়েছে যে দার্জিলিং আমার ভালো লাগবে। সেভাবে আলাদা করে কিছু নেই তবু আমার ফার্স্ট প্রেফারেন্স দুটো জায়গার নাম বলতে যদি বল, বেনারস আর দার্জিলিং। বেনারসে মানুষ দেখা আর দার্জিলিং-এর ভালোলাগা বলতে গেলেতো অঞ্জন দত্তের মতোই বলতে হয় – কিছু গলি আছে, খাবার জায়গা আছে, ক্যাভেন্ডার আছে। নেপালি মেয়েগুলো কি স্মার্ট বলতো?
♦ শুরুর লড়াইটা পেরোনোর পর একটা সময় এসেছে যখন স্বীকৃতি পাচ্ছেন – নানান পুরস্কার, পত্রপত্রিকায় লেখা-ছবি বেরোচ্ছে, সেই অনুভূতিটা কিরকম?
অবশ্যই ভালোলেগেছে, এখনও ভালোলাগে। তোমাদের যে ছবিগুলো দিলাম ‘আমাদের ছুটি’র অ্যালবামে রাখার জন্য তার অনেকগুলোই তো পুরস্কার পাওয়া। তবে তিরস্কারওতো কম জোটেনি, আর সেটা অকারণেই। তুমি জিজ্ঞাসা করনি, তাও বলছি, বছর কয়েক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একটা বড় ফোটোগ্রাফি কম্পিটিশনের আয়োজন করেছিল, জানো বোধহয়। কম্পিটিশনে কোন প্রাইজ নেই, এটা কিন্তু এন.জি.এম. ডিক্লেয়ার করল অনেক পরে। ওদের বক্তব্য ছিল যে ওরা টেস্ট করে দেখছে ডিজিটাল ছবি কত জমা পড়ে? এক কোটি বাইশ লক্ষ ছবি পড়ল। যেটা ফিজিকালি কোন মানুষের পক্ষে জাজিং করা সম্ভব নয়। লেট অক্টোবরে অ্যানাউন্স করল পিপল’স জাজিং হবে – ফোর্থ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভোট হবে। আমি খুলতাম না, কোনদিন প্রাইজের তোয়াক্কা করিনি – পাঠিয়েছি ব্যস। এন্ড অফ নভেম্বরে আমাকে অন্যরা খবর দিল, তোর ছবিটা কিন্তু উঠেছে, তিরিশে আছে। মানে? ! এক কোটি বাইশ লক্ষ ছবি জমা পড়েছে, কত কোটি কোটি মানুষ ভোট দিচ্ছেন, সেখানে তিরিশ জনের মধ্যে আমার তোলা ছবি আছে!! একদিন খুললাম। তখন দেখাচ্ছে ওটা দশজনের মধ্যে রয়েছে, তিরিশজনও নয়। আমার আগ্রহ হল, দেখতে আরম্ভ করলাম। আমি এক নম্বরে গেলাম। এক্সপেক্টেড ডেটের সাতদিন আগেই – ২৮ নভেম্বর। শেষ সাতদিন রোজই খুলতাম – কী হয় দেখার জন্য। আমিই প্রথম হলাম এক কোটি কত ভোট পেয়ে। ওরা কনগ্রাচুলেট করল, চিঠি দিল। পরে বলল পুরো সাইজের ছবিটা পাঠিয়ে দাও। আমি বললাম সিডিটা আছে, পোস্ট করতে হবে। অত বড় ছবি সরাসরি আপলোড কীভাবে করা যাবে তাতো জানি না। আমি সাতশো টাকা দিয়ে পোস্টে পাঠালাম। ওরা দেখেটেখে বলল যে ওটা জালিয়াতি ছবি। সবচেয়ে বেশি কমপ্লেন গিয়েছিল নাকি কলকাতা থেকেই। আমারই চেনা কিছু মানুষ এর পেছনে ছিল। তাদের মতে আমি ছবিটা জুড়ে দিয়েছি। তারা সবাই লিখল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে - টাইমস-এও বেরোল। আমি শেষকালে ছেড়েই দিলাম, কিছু বললাম না। সারা পৃথিবীর লোক যারা ভোট দিয়েছে তারা যখন সকলেই মূর্খ আর ওরাই শুধু চালাক, তাহলে তাই। লোকেদের মতামত নিতে গেছ কেন? আগেইতো বাদ দিতে পারতে ছবিটা। এন.জি.এম. কিন্তু ছবিটা রিজেক্ট করেনি – পেণ্ডিং অ্যান্ড উইথহেল্ড – ব্যাপারটা সাসপেন্ড করে রেখেছে। তার মানে ওরাও কিন্তু একটা জায়গায় আটকে আছে।
আমি কিন্তু মিরর রিফ্লেকশন, হাফ রিফ্লেকশন, টোটাল রিফ্লেকশনের ব্যাপার-ট্যাপারগুলো জানতাম না, পরে জেনেছি যে জলীয় বাষ্পের মধ্যে যদি ধূলিকণা থাকে তাহলে মিরর রিফ্লেকশন হয়। কিছু না জেনেই একটা ঠিকঠাক মুহূর্ত পেয়েছিলাম, যেটা সহজে পাওয়া যায়না। ছবি তুলেছি, দিয়েছি, ব্যস। আমি ক্লাসেও ছবিটা দেখাই। আশ্চর্য ব্যাপার যে সেটা নিয়ে এখনও লোকে আমাকে ব্যঙ্গ করে! এক্ষেত্রেও সেই রবীন্দ্রনাথের কথাই আবার বলতে হয় – 'চতুরঙ্গ'-এ এক জায়গায় সতীশ বলছে, কিছু লোক আছে যারা নিন্দে করতে ভালোবাসে, নিন্দেকেই সত্য বলে জানে। তারাতো নিন্দা করবেই, ক্ষতি কী হয়েছে?
একবছর পর ২০০৯-এ ব্লগে লিখেছিলাম, শরীর খারাপের ঠিক পরে – আমি হয়তো আর বাঁচব না, কিন্তু মরে যাওয়ার পরে তোমরা যদি বল আমাদের ভুল হয়েছিল, তখনতো আমি আর থাকব না।
♦ এখনও নিয়মিত আলোকচিত্রী তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই যে ফোটো তোলার একটা প্রচন্ড ক্রেজ দেখা যাচ্ছে সর্বত্র – ফ্লিকার-ফেসবুক - এটা আপনার কী মনে হয়?
যাদের অ্যানালগের জ্ঞানটা আছে তারা ভালো তুলছে। যারা শুধুই ডিজিটালের জ্ঞান নিয়ে আসছে তারা কিন্তু হুড়ুমদুড়ুম তুলছে। ছবি তোলার বেসিক ব্যাপারগুলো জানতে হবে আর কোনটা ছবি হতে পারে সেই ধারণাটা পরিস্কার রাখতে হবে। এগুলোই শেখার ব্যাপার। ফেসবুক খুললেই বোঝা যায়, দিনে একটা কী দুটো ছবি ভালো থাকে। বাদবাকীগুলো ছবি নয়, দিচ্ছে, দিচ্ছে। লোকেরা নাইস বলে যাচ্ছে। ফেসবুকটাতো পুরোটাই পিঠ চাপড়ানোর ব্যাপার।
♦ ফেসবুকে আপনার তাজপুর-মন্দারমনির ছবিগুলো দেখছিলাম – ছবিগুলোতো দারুণ, আমার বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু আমার সবথেকে ভালো লেগেছে ক্যাপশনে রবিঠাকুরের গানের ব্যবহার।
চোদ্দমাস ক্যানসারের সঙ্গে লড়াইয়ের পরে ওই বেড়ানোটায় একটা অন্যরকম আনন্দ পেয়েছিলাম। আমরা ষাটোর্ধ তরুণ-তরুণীরা মিলে এনজয় করেছিলাম খুব। আমার অসুস্থতার পুরো সময়টা ধরেই আমার স্ত্রী রূপা আর মেজ বৌদি উমা বসু অবিশ্রান্ত কষ্ট করেছেন, ওনারা না থাকলে আমি এই সুস্থতাতেও হয়তো পৌঁছাতে পারতাম না। তোমাদের এই ছবিটা দিলাম, এটা আমার অনেকদিনের একটা ইচ্ছাপূরণ বলতে পার। কাগজে অনেকদিন আগে একটা ছবি বেরিয়েছিল – শোভা সেন উৎপল দত্তকে চা এগিয়ে দিচ্ছেন। সেটা দেখার পর থেকেই এই ছবিটা তোলার ইচ্ছা হয়েছিল। এবার বেড়াতে গিয়ে তুলে ফেললাম রূপার সাথে।
[আনন্দময় মানুষটির সঙ্গে দীর্ঘ তিনঘন্টার আড্ডার শেষে বেঁচে থাকার অনেকখানি রসদ অনুভবে নিয়ে উঠে আসছি, বললেন যাওয়ার আগে একটা প্রিয় গান শুনে যাও – ইউটিউবে সার্চ দিতে বিক্রম সিং-এর গাঢ় গলায় বেজে উঠল – নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে... ]
সাক্ষাৎকার – দময়ন্তী দাশগুপ্ত