বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com
অতীতের খোঁজে
মার্জিয়া লিপি
লখনউতে সার্ক সাহিত্য সম্মেলনের গোধূলিবেলায় ভাবছিলাম বেশি দূর তো নয় এলাহাবাদ – প্রয়াগকে ঘিরে পুরাণের গল্পকথা কতই শোনা, ঘুরে আসি একবার। পুরাণের বারণাবত, আর্য সময়কালে প্রয়াগ, পরবর্তী যুগে এলাহাবাদ – পুরাণ, ইতিহাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ব ভাবতে সঙ্গী হল আরও তিনজন। তাদের মধ্যে পার্থ পাভেলের গল্প ঠিক যেন রুপোলী পর্দার কোন ঘটনার মতো। সেও এসেছে অতীতের খোঁজে – তার শিকড়ের সন্ধানে। একসময় তার ঠাকুরদাদা বসন্তকুমার তালুকদারের ভিটে বাড়ি ছিল কিডগঞ্জে – ৩৫/৩৭ বিচওয়ালি সড়কে। চাকরি করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। ঠাকুরদাদা মারা যাওয়ার পর ১৯৩৭ সালে বাবা প্রীতিরঞ্জনকে নিয়ে দাদী সুনামগঞ্জে পৈত্রিক বাড়িতে চলে আসেন। তারপরের ঘটনা উপমহাদেশের ইতিহাসের দেশবিভাগের স্বপ্নভঙ্গের মতোই।
২০ মার্চ কাকডাকা ভোরে লখনউ থেকে নরচণ্ডী এক্সপ্রেসে এলাহাবাদের জন্য রওনা দিলাম। প্রয়াগ পেরিয়ে সাত কিলোমিটার দূরে রেলস্টেশন। শিকড়ের টানে বসন্তকুমারের তৃতীয় প্রজন্ম সন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁজে ফেরে এই শহরে নিজেদের এককালের আবাসকে। পার্থর বিস্মিত সর্বভূক দৃষ্টি আমাকেও প্রভাবিত করে; আমিও আবিষ্কারের চোখে খুঁজে ফিরি পৌরাণিক এই শহরকে।
এককালের প্রয়াগের আধুনিকীকরণ ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে। ১৫৮৩ সালে যমুনার পাড়ে গড়ে তোলেন বিশাল দূর্গ যা আকবরের কেল্লা নামে পরিচিত। ইতিহাসের পথ বেয়ে একে একে দেখতে থাকি ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বাসভবন, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মস্থান স্বরাজ ভবন, এলাহাবাদ জাদুঘর, হনুমান মন্দির, হরদুয়ার মুনিকা আশ্রম, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, বিড়লা মন্দির, শঙ্করাচরণ মন্দির – এইসবকিছুই বারবার ছাপিয়ে যাচ্ছিল পার্থর সন্ধানী দৃষ্টি...।
অবশেষে পড়ন্ত বিকেলে এসে স্থির হলাম প্রয়াগের ঘাটে।
গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী – এই তিন নদীর সঙ্গম প্রয়াগ পবিত্র হিন্দু তীর্থ। ত্রিবেণী সঙ্গম নামেও খ্যাত। রামায়ণ, মহাভারত এমনকী অনেক পৌরাণিক গ্রন্থেও উল্লেখ আছে প্রয়াগের। প্রয়াগ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা পৌরাণিক আখ্যান। সৃষ্টির আদিতে দেবতা ও অসুরের সমুদ্রমন্থনে উঠে আসে অমৃত কুম্ভ। অমৃতের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম শুরু হয় দেবতা আর অসুরদের। সেইসময় কুম্ভ থেকে অমৃত চলকে পড়ে মাটিতে। ভারতবর্ষের হরিদ্বার, এলাহাবাদ, নাসিক, উজ্জ্বয়িনী এমনই চারটি পুন্যভূমি যেখানে অমৃত পড়েছিল। তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী প্রতি বার বছর অন্তর ওই চারটি জায়গায় পর্যায়ক্রমে মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রতি ছ'বছর অন্তর বসে অর্ধকুম্ভ। রাজা হর্ষবর্ধন এখানে কুম্ভমেলার প্রবর্তন করেন বলে জানা যায়। সেকালে প্রয়াগ ছিল সংস্কৃতির পীঠস্থান। এই প্রয়াগের জলে স্নান করে হর্ষবর্ধন নিজের সর্বস্ব দান করে দিতেন প্রজাদের নামে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রয়াগে চলবে কুম্ভ মহামেলা। লক্ষ লক্ষ পুন্যার্থীর ভিড়ে এখানকার চেহারাই তখন বদলে যাবে। আজ নির্জনে প্রয়াগ সঙ্গমে মনের মধ্যে শুধু ফিরে ফিরে দেখছি ইতিহাস আর পুরাণের অদেখা ছবি।
নদীর কোলে সন্ধ্যা নেমে আসে...।
লেখিকা ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় স্তরে পরিবেশ পরামর্শক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কর্মরত রয়েছেন। কাজের সূত্রে এবং ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচেকানাচে। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ নিয়ে সেই অনুভূতির ছোঁয়াই ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। প্রকাশিত বই 'আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন'।
বাংলার এক হারিয়ে যাওয়া মন্দিরে
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
ভাঙ্গা মন্দিরের গায়ে গাছ গজিয়েছে, চত্ত্বরটা ঢেকে গেছে ঘাস-জঙ্গলে, টেরাকোটার মূর্তিগুলো অনেক জায়গাতেই নেই, বাকি অংশেও শ্যাওলা পড়ে কালো হয়ে গেছে, তবু যেটুকু দেখা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে, এককথায় অপূর্ব – অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি যে পাশ দিয়ে কত লোক হেঁটে চলে যাচ্ছে তাঁরা ফিরেও তাকাচ্ছেন না মন্দিরের দিকে, বরং আমি যে কেন মন্দিরের সামনে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তাতে আমাকেই ফিরে ফিরে দেখছেন। ভাবছিলাম, আমাদের দেশের, বিশেষতঃ বাংলার মানুষ তাদের অমূল্য সম্পদ সম্পর্কে কতটা উদাসীন।
বর্ধমান জেলার কামারপাড়ায় অনেকগুলি টেরাকোটা সমৃদ্ধ মন্দির রয়েছে বলে অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। মূলতঃ বণিক সম্প্রদায়ের (স্বর্ণবণিক, গন্ধবণিক ইত্যাদি) বাস ওখানে। অনেকে অবশ্য এখন বর্ধমান শহরে থেকে ব্যবসা-চাকরি ইত্যাদি করেন। বর্ধমান থেকে গুসকরা যাওয়ার পথে এটা পড়ে। নিকটবর্তী রেল স্টেশন বনপাস। তবে কামারপাড়া থেকে বনপাস একটু দূরে, ৫-৬ কিলোমিটার হবে। বর্ধমান শহরের তিনকোণিয়া বাসস্ট্যান্ডে কামারপাড়া যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। অনেকদিন ধরেই সুযোগ খুজছিলাম কবে যাওয়া যায়। একদিন বেশ সকাল সকাল বেরিয়ে বাসে করে কামারপাড়া পৌঁছে গেলাম। ঘন্টাখানেক মত সময় লাগল।
বুড়ো শিবতলার একটা মন্দির দেখে সোজা চলে এলাম মিস্ত্রিপাড়ার মোড়ে। রাস্তার ধারে রয়েছে অসাধারণ সুন্দর একটি মন্দির। আর্কিওলজি বিভাগ এটি অধিগ্রহণ করেছে। এই মন্দিরটি সম্পর্কে স্থানীয় মানুষও বেশ সচেতন। মন্দিরটা দেখতে দেখতে কয়েকঘন্টা কীভাবে যেন কেটে গেল তা টের পেলাম না।
রাস্তা ধরে চলতে চলতে হঠাৎ আমার চোখ পড়ে গেল সামান্য দূরের দু্টি মন্দিরের ওপর। মুল পথের বাঁদিকে ছোট গলি রাস্তা; এই গলিপথের ধারে একটু ফাঁকা জায়গা, এক পাশে মন্দির দুটি। রাস্তা থেকে কিছুটা ওপরে। ফাঁকা জায়গাটা ঘাসে ঢাকা। কয়েকটা ছেলে ঘাসের চাপড়া কাটতে ব্যস্ত। মন্দিরের দিকে চোখ পড়তেই পাটা যেন মাটিতে আটকে গেল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম মন্দির চত্ত্বরের দিকে। ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলে ভাব জমিয়ে ফেললাম। তবে এদের কাছে পুরোনো মন্দিরগুলি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না।
মন্দির দুটি দেখছিলাম – ডানদিকের মন্দিরের গায়ে যা কিছু টেরাকোটার মূর্তি ছিল সে সবই অপহৃত হয়েছে। মন্দিরটির দরজাও ভাঙ্গা, ঠিকমত বন্ধ হয় না। বাঁ দিকের মন্দিরটির অবস্থা তুলনায় একটু ভাল। দুটি মন্দিরের ভিতরেই শিবলিঙ্গ বর্তমান। বাম দিকের মন্দিরটিতে এখনও পুরোহিত নিত্য পূজা করেন। তবে দীর্ঘদিন এই মন্দিরগুলির কোন সংস্কার বা রঙ করা হয়নি; সেটা দেখেই বোঝা যায়। মন্দিরগাত্রে জায়গায় জায়গায় কালো ছাপ পড়েছে। বেশ কিছু ছত্রাক আছে যারা কালো পিগমেন্ট তৈরি করে।
বাঁ দিকের শিব মন্দিরটিতে টেরাকোটার মূর্তিগুলি সারিবদ্ধ অবস্থায় সজ্জিত রয়েছে। দরজার ওপরে দুই সারি এবং দরজার দুই পাশে দুটি করে মোট চারটি সারি। ওপরের সারির মাঝখানে শ্বেতপাথরের প্রতিষ্ঠা ফলক রয়েছে। এই ফলকটি পাঠোদ্ধার করে জানা গেল মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল শকাব্দ ১৭৯১ (১৭১৩ খ্রিস্টাব্দ)। এক যাদবেন্দ্র নামী পুরুষ এটির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের ওপরের সারিতে প্রতিষ্ঠাফলকের দুইদিকে চারটি করে আটটি এবং দরজার ঠিক ওপরের সারিতে গণেশের দুই দিকে তিনটি করে ছয়টি টেরাকোটা মূর্তি রয়েছে। দরজার দুইপাশের সারির বাইরের সারিতে ওপর থেকে নীচে ১১টি এবং দরজার ঠিক পাশের সারিতে আটটি করে মূর্তি রয়েছে। মন্দিরে রামসীতা এবং গণেশের মূর্তি বাদে মোট ৫২টি [ ৮ (৪+৪) + ৬ (৩+৩) + ২২ (১১+১১) +১৬ (৮+৮)] টেরাকোটা মূর্তি রয়েছে। এদের বেশ কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সঠিকভাবে বোঝা যায় না সেগুলি কী মূর্তি।
বাঁ দিকের মন্দিরটি দেখতে দেখতে সবে ফটো তুলতে শুরু করেছি, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভাবছিলাম হয়ত কিছু বলবেন। উনি নীরব থেকে আমি কী করছি সেটাই দেখছিলেন। আমি মন্দির থেকে নীচে নেমে এসে ওনার সঙ্গে আলাপ করলাম। জানতে পারলাম এই মন্দিরদুটি ওনাদেরই। কয়েক দশক আগে ওনারা এই মন্দির চত্ত্বরেই বাস করতেন। শিবদুর্গা পূজা হত মূর্তি এনে। বাসগৃহ, নাটমন্দির সবই ভেঙ্গে গেছে। বাস তাই আজ অন্যত্র। ওনার নাম হরেকৃষ্ণ দে। সোনারূপার ব্যবসা। শিব মন্দিরের নিত্য পূজার ব্যবস্থা ওনারাই করেন। পুরোহিত রায়পাড়ায় থাকেন। নীলের সময় এখানে বিশেষ পুজো হয়।
হরেকৃষ্ণবাবু চলে যেতেই বাঁ দিকের মন্দিরটা আবার দেখতে শুরু করলাম। পোড়ামাটির অলঙ্করণে রামায়ণ, মহাভারত, হিন্দু দেবদেবী, শ্রীকৃষ্ণ কাহিনি এবং সমাজচিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যান্য মন্দিরের মত এখানেও রামায়ণকাহিনির প্রাধান্য লক্ষণীয়। দরজার খিলানের মুল চিত্রটিতে রামসীতাকে পারিষদসহ দেখানো হয়েছে। দরজার ঠিক ওপরে রামসীতার মূর্তি, দুইপাশে তাঁদের পরিচর্যাকারী। পাখা হাতে বাতাস করছে একজন, অপরজন ছত্রধারী। নীচে দুজন পাহারাদার বা সৈন্য – হাতে ঢাল-তলোয়ার। রামসীতার ঠিক নীচেই রয়েছে হনুমান। আর একেবারে খিলানের ওপরে স্থান পেয়েছে গণেশের মঙ্গলসূচক একক মূর্তি সঙ্গে বাহন ইঁদুর। অথচ দরজার পাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় মূর্তিগুলির মধ্যে একটিতে স্থান পেয়েছে অর্জুনের লক্ষভেদের দৃশ্য। এখানে অর্জুনকে ধনুকে জ্যা যুক্ত অবস্থায় শর নিঃক্ষেপের পূর্ব মুহূর্তে দেখানো হয়েছে।
পুরাণের কাল থেকেই শ্রী বিষ্ণু প্রধানতম দেবতারূপে পূজিত হয়ে আসছেন। তাঁর বিভিন্ন গুণ এবং ক্রিয়াকর্ম প্রকাশের নিমিত্ত অবতারের সৃষ্টি হয়েছে বলে শ্রী হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য মত প্রকাশ করেছেন [হিন্দুদের দেবদেবীঃ উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, ২য় পর্ব, পৃষ্ঠা ২১৮-২৭৩]। বিষ্ণুর অবতারের সংখ্যাও নির্দিষ্ট নয়, কোথাও দশ, বা কোথাও দ্বাদশ। এমনকী এর বেশী অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। কবি জয়দেব তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ "গীতগোবিন্দম"-এ বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বর্ণনা করেছেন। সেগুলি যথাক্রমে মীন, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, রাম, পরশুরাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি। কামারপাড়ার এই মন্দিরটিতে বিষ্ণুর দশ অবতারের মূর্তি রয়েছে। তবে বুদ্ধের বদলে এখানে জগন্নাথ উপস্থিত।
বংশীধারী কৃষ্ণ ছাড়া নাড়ুগোপাল, কালিয়দমন এবং বকাসুর বধের কাহিনি এখানে স্থান পেয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের হাতে পুতনা রাক্ষসী বধের পর পুতনার সহোদর বকাসুর মথুরাপতি কংসের নির্দেশে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলে শ্রীকৃষ্ণ বকাসুরের দুই ঠোঁট ধরে চিরে হত্যা করেন। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মহাদেবের ওপর আসীন দক্ষিণা কালিকা মূর্তির। তবে যে দুটি কাহিনি মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির অলঙ্করণ হিসাবে অগ্রাধিকার পেয়েছে তা হল রাম-রাবনের যুদ্ধ এবং পুত্রকন্যাসহ দেবী দশভূজা দুর্গা। সমাজচিত্রের একটি সুন্দর নিদর্শন এখানে রয়েছে – এক সাপুড়ে ফনাধারী বিষধর সর্প নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। মন্দিরগাত্রে এই ধরণের দৃশ্য বিরল। যে বিষধর সর্পটি দেখানো হয়েছে সেটি শঙ্খচূড় জাতীয় বলে মনে হয় - ফনাটি তুলনায় বড় এবং লম্বা। দেওয়াল গাত্রে বেশ কিছু মানুষের মুখ স্থান পেয়েছে, সেগুলিতে পাশ্চাত্য প্রভাব চোখে পড়ে।
হরেকৃষ্ণবাবুর এই শিব মন্দিরদুটি দেখে রায়পাড়া যাবার রাস্তা ধরেছিলাম। পথ চলতে চলতে মনটা ভার হয়ে রইল। বার বার হরেকৃষ্ণবাবু্র মুখটা মনে পড়ছিল। বয়স্ক মানুষটি যেভাবে নিঃশব্দে এসেছিলেন সেইভাবেই ফিরে গেছেন। ভাবছিলাম, ছেলেবেলায় মন্দির সংলগ্ন বাসগৃহে ওনারা থাকতেন, প্রতিবছর ঘটা করে শিবপূজা হত। আজ সব অতীত। সেদিনের বাসগৃহ, পূজামন্ডপ, আজ কিছুই নেই। শুধু পড়ে আছে তার ধ্বংশাবশেষ। নিশ্চয় ওনার সেইসব দিনের সুখস্মৃতি আনন্দের সঙ্গে বেদনাও বহন করে আনে। হয়ত সেদিনের স্বচ্ছ্বলতা আর নেই, তাই ধুমধাম করে শিবদুর্গার পুজো আজ হয় না। আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে এইরকম শয়ে শয়ে মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চলেছে। বাঙালি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান, মন্দির-ভাস্কর্য দেখেন অথচ বাংলার গ্রাম-গঞ্জে পোড়ামাটির এত সুন্দর মূর্তি, নক্সা ইত্যাদির সাহায্যে অসংখ্য মন্দির অলঙ্কৃত হয়েছে, সেগুলির খোঁজও রাখেন না। এইভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পোড়ামাটির অনন্যসাধারণ সব ভাস্কর্য যা গ্রাম বাংলার সামাজিক দলিল।
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব-র নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখা।