অচিন্তনীয় চিন্তাফু

মানব চক্রবর্তী

~ চিন্তাফু ট্রেকরুট ম্যাপ ~ চিন্তাফু ট্রেকের আরো ছবি ~

একটাই স্পট থেকে ঈষৎ ডান হাতে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গমালা এবং বামদিকে এভারেস্ট ও তার সতীর্থ শৃঙ্গদল দেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা হল নেপালের চিন্তাফু, তবে সে যে কতটা ভাল এখানে না এলে তা সত্যিই বোঝা যেত না।
২০১২ কোজাগরী পূর্ণিমার আগের রাতে বেরুলাম। সিকিমের পশ্চিম প্রান্তে ডেন্টাম হয়ে উত্তরে। হ্যাঁ, জায়গাটার নামই উত্তরে। এখান থেকে ট্রেক শুরু হবে। চিয়াভঞ্জন, ফালুট হয়ে চিন্তাফুর পথে।
কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা। রামধাক্কা। ট্রেক ক্যানসেল হওয়ার মত অবস্থা। উত্তরের এজেন্সি, গাইড, পোর্টার এবং তাদের নিজস্ব খরচা ইত্যাদি নিয়ে জল এমন ঘুলিয়ে দিল যে একটা গোটা দিন নষ্ট। উত্তরে বসে থাকলে পরের দিনও বেরুতে পারব না। ফলে আমাদের ঠিক করা গাইডের পরামর্শ মেনে নতুন রুটে চিন্তাফু ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা গাঁথলাম সেই রাতেই।
কী সেই রুট? এখান থেকে সোজা যেভাবেই হোক যেতে হবে টংলু। সেখান থেকে জৌবারি-কে ডাইনে রেখে নতুন পথ। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সিসলি, নুনথালা পার হয়ে ইঙ্গাখোলা। ইঙ্গাখোলা পার হয়ে যমুনা। এবার চড়াই পথে মাভু হয়ে টোরকে। সেখান থেকে মাইমাজোয়া। মাঝে একরাত যমুনায় থাকতে হবে। একরাত মাইমাজোয়াতে। পরেরদিন সাত আট ঘন্টার হাঁটাপথে উঠে আসতে হবে গোরুয়ালিভঞ্জন। বিকেলে রেস্ট। গোরুয়ালিভঞ্জনে রাত্রিবাস। পরদিন রাত তিনটের সময় যাকে বলে সামিট মার্চ। পেয়ে যাব সেই ঈপ্সিত ধন। নিসর্গের চূড়ান্ত এক রূপকথা। পাতাগুলো খুলে দেবে প্রথম সূর্যের মায়াবি আলো।
ভাগ্যিস উত্তরের এজেন্সি প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাইতো আমাদের অভিজ্ঞ গাইড ধনকুমারের সাহায্যে এমন সুন্দর একটা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রুট বেরোল। সঙ্গে অতিরিক্ত পাওনা চমৎকার নদী ইঙ্গাখোলার কোলে ভ্যান গগের আঁকা ছবির মত গ্রাম যমুনা এবং পরের দিনে টোরকে ফলস্। অন্ধকারে সূর্যের আলো যেন মাইল মাইল লম্বা স্বর্ণলতার ঝুরি, তার মধ্যে দিয়ে বহু উঁচু থেকে ঝরে পড়ছে সগর্জনে জলধারা।
টোরকে ফলসের সানুদেশের ভেজা ঘাসে টেন্ট পিচ করে একটা রাত্রিযাপন আমার অন্যতম একটা সেরা অভিলাষ। দেখা যাক কবে তা মেটে।
যাই হোক রাতেই প্ল্যান পাকা। পরদিন ভোরেই জিপ ধরে বাই বাই উত্তরে।
লম্বা রাস্তা। সেই ডেনটাম। সেই জোরথাং। তারপর দার্জিলিং, সুখিয়াপোখরি হয়ে মানেভঞ্জন। রাত তখন নটা।
পরদিন ভোরেই সোজা টংলুর পথে। রাতে টংলুর ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে টেন্টে থাকা। চাঁদ তার গোটা কলসী উপুড় করে দিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর। এ শুধু ছবি তোলার রাত। পরদিন হাঁটা শুরু। নতুন পথ। আর জঙ্গল তো চিরনতুন। অজস্র অসংখ্য শতাব্দীপ্রাচীন জঙ্গুলে গাছ, তাদের বড়দা হল রডো, আহা হা... রডোডেনড্রনের ছায়ায় হাজারো গাছের ছোটবড় জট খুলতে খুলতে পথ চলা।
এ পথে ট্রেকাররা যে যায় না তার প্রমাণ পেলাম প্রায় ঘন্টা দুয়েক হেঁটে এক গ্রামবাসীর বিস্ময়াবিস্ট মুখচোখ দেখে। পিঠের স্যাক আর রঙিন পোষাক তাকে মনে হয় তিনজন গ্রহান্তরের মানুষের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
ইঙ্গাখোলার অনর্গল জলপতনে পাহাড়ি নদীতে সারারাত জুবিন মেহতার অর্কেষ্ট্রা, আর আমরা তিনজন যমুনার মাটির ঘরে ছাং আর থুম্বার যৌথ আকর্ষণে এক পরাজগতে বিচরণ করি। রাত কাটে। সকালে হলুদ গাঁ আর হলদেটে চামড়ার নেপালি গ্রাম্যতার মাঝে চোখের জলের ইশারা রেখে পথ হাঁটি।
ক্রমে মাভু। মাভু এক, দুই, তিন, এইভাবে সাতটা গ্রাম, সেই অল্প অল্প চড়াই, এসে পৌঁছাই টোরকে। কাঁধ আলগা দিই। স্যাক নামাই।
রান্না করবে ধনবাহাদুর আর পোর্টার রাজু। আমরা চললাম টোরকে ফলস দেখতে। আধমাইল উজিয়ে তার ইশারাটুকু পাই। ইশারাতেই মস্ত। সামনে সাক্ষাৎ হলে কী হবে! দ্রুত ট্রাভার্স করে নামি। দেড় হাজার ফুট তো বটেই। তারপরেই এক ইস্পাতের তারের অনিন্দ্যকান্তি ঝোলানো সেতু। ব্রিটিশদের তৈরি। অপূর্ব। পা পড়লেই ছড়া কাটে – দোল দোল দুলুনি রাঙ্গা মাথায় চিরুনি।
এগিয়ে যাই আড়াইশো ফুট উঁচু থেকে ঝরে পড়া জলস্রোতের দিকে। ঘাসে শুই। এক আশ্চর্য পৃথিবীর গহীন-গভীর ভার্জিনল্যান্ড।
এখানে একটা জীবন কাটানো যায় পাখির নীড়ের মত চোখের স্বপ্নে।
ফিরে এসে কোয়াস সেদ্ধ। ভাত। লংকা। আহা রামরোচো (খুব ভাল)। বিকেলে পৌঁছাই মাইমাজোয়া। রাতে একটা হোটেলের ঘরে আশ্রয়। দুপাশে পাঁচ-ছটা থাকার জায়গা আছে।
সকালে উঠে ফের চলা। আজ যেতে হবে গোরুয়ালিভঞ্জন। সম্ভব হলে বিকেলেই চিন্তাফু। কিন্তু বেয়াড়া পথ। চড়াই। চড়াই। ফলে ক্ষুধার্ত তিনজন দুপুর পেরিয়ে গোরুয়ালিভঞ্জন।
ঠিক হল রাতে এখানেই থাকা।
গ্রামের মানুষরাই থাকার জায়গা করে দিলেন। ট্রেকার এলে কোনো অসুবিধা নেই। সামান্য টাকাপয়সা বা চালডাল দিলে এরাই রান্না করে দেবে।
আমরা কিন্তু নিজেরাই ওদের কাঠের আগুনে রান্না করলাম। খিচুড়ি। ওদের কাঠ, ওদের আগুন, আমাদের চালডাল – এই হল যথার্থ ফিউশন। ফলে গান হল। নাচ হল। এবং খাওয়া। আমাদের খিচুড়ি ওরাও থালভরে খেয়ে খুব খুশি।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। হাত পায়ের আঙুল জ্বালা করছে। মাইনাসের নীচে ঠাণ্ডা। মুজো গ্লাভসে মানছে না।
রাত তিনটেয় টর্চ নিয়ে ফাইনাল থ্রাস্ট।
তিনজন আমরা, সঙ্গী দুজন, মোট পাঁচ, পাঁচটা টর্চের আলো পাহাড়ে-পাথরে-বোল্ডারে-জঙ্গলে আলোর ধারাপাত খুলে খুলে পথ চলে। এখানে বড্ড চড়াই। চার হাত-পায়ে হামা দিই। এইভাবে আলোর মালা কাছে-দূরে। অবশেষে ঠিক দু'-আড়াই ঘন্টা পরে পৌঁছে গেলাম চিন্তাফু টপে। জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে ওপরে জায়গাটা খানিক সমতল। একটা সরু লম্বাটে জায়গা। পশ্চিমদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি আর প্রবল ঠাণ্ডায় কাঁপছি। অন্ধকার ক্রমশ কেটে যাচ্ছে। সেই ঢালে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার পাশে অন্যান্য শৃঙ্গমালা এবং আন্দাজ তিরিশ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে বাঁদিকে এভারেস্ট লোৎসে। সূর্যের কুসুম আলোয় সে এক অপূর্ব দৃশ্য। একটু পরেই আলোর খেলা শুরু হল দুই শৃঙ্গমালার মাথায়।

একবার ডাইনে তাকাই পরক্ষণেই বাঁয়ে। এত কাছ থেকে দুই মহান শৃঙ্গমালা এভাবে দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্য তো বটেই নইলে আকাশ এত পরিস্কার থাকে! সঙ্গী অভিরূপ তার ক্যামেরায় মুহূর্তগুলি ধরে রয়েছে একের এক। আমরা বিস্ময়াবিস্ট। বহু ছবি তোলা হল। ওই একচিলতে সমতলে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখি দারুণ সুন্দর একটা কাঠের ট্রেকার্স হাট। ভেতরে আগুন জ্বালানোর জায়গাও আছে। ততক্ষণে রাজ আর ধনকুমার কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বেলেছে। নীচে মেঘসমুদ্র। প্রাণভরে এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে আর কিছুসময় আগুন সেঁকে এবারে নীচে নামার পালা।



ফেরার আগে ভালভাবে আগুন নিভিয়ে দিলাম। চোখে পড়ল ট্রেকার্স হাটের কাঠের দেওয়ালে যত্রতত্র নাম লিখে রেখেছে আমাদের আগে আসা অন্য ট্রেকাররা। এই বালখিল্যতা কবে বন্ধ হবে কে জানে!

~ চিন্তাফু ট্রেকরুট ম্যাপ ~ চিন্তাফু ট্রেকের আরো ছবি~

কথাসাহিত্যিক মানব চক্রবর্তীর প্রথম উপন্যাস দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘কুশ’ আবির্ভাবেই জনপ্রিয় হয়েছিল। বেশ কয়েকটি উল্ল্যেখযোগ্য উপন্যাস ছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে মানবের লেখা ছোট গল্পগুলি। কয়েকটি ছোটগল্পের মঞ্চায়নও হয়েছে। তবে শুধু কলমই নয় মানবের ভালোলাগার আরেক নাম ভ্রমণ। মাঝেমধ্যেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতি আর মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছে যেতে। ষাট পেরনো এই যুবক এখনো রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেন ট্রেকিং-এর কথায়। অনেক পাহাড়-সাগর পেরিয়ে তাঁর চরৈবতি ভারতবর্ষের নানান প্রান্তরে আজও অবাধ।

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher