-->
ছোট্ট টুপুরের বড় ট্রেকিং
ঝুমা মুখার্জি
গোমুখ-তপোবন ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি
পরপর দুবার মা-বাবা ছোট্ট টুপুরকে মামারবাড়িতে রেখে গেল পাহাড়ে হাঁটতে। পাহাড়তো বটেই, নদী,ঝরনা,ফুল আরও কতকিছু দেখে ফিরে এসে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্পও বলেছে তাকে। তবু তাতে কি আর সত্যি সত্যি দেখা হয়? বড়রা কিচ্ছু বোঝেনা, খালি ছোটদের ছোটই ভাবে! আট বছরের টুপুর এবার কিন্তু আর মামার বাড়িতে থাকতে রাজি নয়, পুজোর ছুটিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ট্রেকিং করতে সে যাবেই যাবে। বড় হয়নি বুঝি সে!? ভূগোলে পড়েছে নদীর গতিপথ, উৎস, গঙ্গোত্রী হিমবাহর কথা। এবার নিজের চোখে দেখার সুযোগ সে কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। শারীরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও নিজেকে তৈরি করার কাজে চটপট লেগে গেল। প্রতিদিন মা-বাবার সঙ্গে হেঁটে নিজেকে তৈরি করল শারীরিকভাবে আর বাবার মুখে গল্প শুনে, ইন্টারনেটে ছবি দেখে মানসিকভাবেতো আগেই প্রস্তুত। পুজোর ছুটিতে তিনজনে মিলে যাবে গোমুখ-তপোবন। এর আগে সে দেওরিয়াতাল, সান্দাকফু এরকম ছোট ট্রেক করেছে কিন্তু হাই অল্টিচ্যুড ট্রেক কখনও করেনি। মা বেচারি প্রথমে একটু চিন্তাতেই ছিল,কিন্তু মেয়ের উৎসাহ দেখে আর না করতে পারেনি।
বর্ষা যাব যাব করছে, নীল আকাশে সাদা মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের মেজাজ, পাড়ায় পাড়ায় পুজোর প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে, আমরা সেরকম এক সন্ধ্যায় কলকাতা ছাড়লাম, কোলাহল-মানুষের ভীড় থেকে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কটা দিন কাটাব বলে। ২৪শে সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটায় উপাসনা এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু। ন’ ঘন্টা দেরিতে হরিদ্বার পৌঁছল ২৬শে দুপুর দেড়টায়। দুদিন ট্রেনে খেয়ে ঘুমিয়ে, বই পড়ে সময় কাটল। বিহার, ঝাড়খন্ডে প্রচুর বৃষ্টির জন্য সব ট্রেন দেরিতে চলছিল। এমন এক ট্রেনে চেপেছি যাতে জল পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমরা সঙ্গে অনেক খাবার নিয়েছিলাম তাই অন্তত শুকিয়ে মরতে হয়নি। তবে হরিদ্বারে পৌঁছে আমরা রাজকীয় অভ্যথর্না পেলাম। বাতানুকূল গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্য অনলাইন বন্ধু অর্থাৎ ট্যুর পরিচালক অপেক্ষা করছিলেন। সামনাসামনি সাক্ষাৎপর্ব মিটতেই গাড়ি ছাড়ল। ভীষণ গরম আর রোদ দেখে ভুলতে বসেছি মাসটা কী! হাতে সময় কম তাই লাঞ্চ করা হল না,কোল্ড ড্রিংকস,চিপস্ খেতে খেতে চললাম।
১৮০ কিমি রাস্তা যেতে ৬ ঘণ্টা সময় লাগল, চা বিরতি বার দু’এক ছিল অবশ্য। আজকের রাত্রিবাস হোটেল শিবলিঙ্গ। দুদিনের পথশ্রমে আমরা বেশ ক্লান্ত, তাই প্রায় মশলাবিহীন, স্বাদহীন খাবার গলাধঃকরণ করে শুয়ে পড়লাম রাত দশটার মধ্যে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনিতে। দরজা খুলে বাইরে এসে থমকে গেলাম, কী ভীষণ সুন্দর জায়গা। সামনেই নদী আর চারদিক পাহাড়ে ঘেরা। হাল্কা ঠাণ্ডা আর ভোরের নরম রোদ গায়ে মাখতে এ অক্টোবরে যে কী ভালো লাগছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। দূরের মন্দির থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাধ্বনি আর নদীর বয়ে চলার শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। কী অপার্থিব শান্তি! জানিনা কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একে একে মেয়ে ও তার বাবা এসে দাঁড়াল,আমার ঘোর কাটল। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে আমাদের উত্তরকাশী ছাড়তে হবে। তার আগে শহরটা অবশ্যই ঘুরে দেখব। তাই আর দেরি না করে আমরা সাড়ে ন'টায় হোটেল ছাড়লাম। এখানে দর্শনীয় স্থান বলতে নেহেরু মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট আর অসংখ্য মন্দির। পুরাণে কথিত আছে কাশী থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবতারা উত্তরে হিমালয়ে এসে বসতি শুরু করেন,সেই থেকে এই স্থানের নাম উত্তরকাশী হয়েছে। এই কাহিনি শোনালেন বিশ্বনাথ মন্দিরের পূজারী।
ভগবানের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে দুর্গম পথে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে পোর্টার -গাইড সহ চারজন। এখান থেকে গঙ্গোত্রী ১০০ কিমি। ডানদিক দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা,সেইদিকেই চোখ আটকে আছে। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। মেরামতের কাজও চলছে তাই গাড়ির গতিবেগ খুব কম। গাড়িতে গাড়োয়ালি গান শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল টুপুর। ওদিকে অনর্গল কথা বলেও চলেছে। আসলে ও ভীষণ উত্তেজিত, বুঝতে পারছি। ঘন্টাখানেক পর ভাটোয়ারিতে গাড়ি কিছুক্ষণ থামল। তারপর সুখীগাঁও,ঝালা পেরিয়ে ধারালিতে না থেমে পারলাম না। ধারালিতে গাড়ি থামতেই মেয়ের খুশি দেখে কে? গাছ ভর্তি আপেল দেখে সে আনন্দে আত্মহারা। তখন ঘড়িতে ৩টে বাজে, সকালের খাবার কখন হজম হয়ে গেছে, এবার কিছু খেতে হবে। বেশ কিছু দোকানপাট, হোটেল চোখে পড়ল। কিন্তু এসবতো অন্য কথা, আসলে ধারালি অসাধারণ, অবর্ণনীয় - যাকে বলে নামী চিত্রকরের আঁকা ক্যানভাস। গঙ্গা তীব্রবেগে নেমে কয়েকটি ধারায় নিজেকে ভাগ করে হরশিল উপত্যকার সৃষ্টি করেছে। নদীর ধার বরাবর প্রচুর আপেল গাছ,অনেক আপেল হয়ে আছে। মাটি থেকে কুড়িয়ে আপেল খাবার যে কী আনন্দ তা এখানে না এলে সত্যি জানতে পারতাম না। দেখি আপেল কুড়িয়ে টুপুরের হাতেও ধরিয়ে দিয়েছে আমাদের কোন এক সঙ্গী আর সেও খুশিমনে খেতে ব্যস্ত। নদীর জল মাথায় ছিটিয়ে একটু খেলাও হয়ে গেল ওরই ফাঁকে।
ধারালি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। দুটোদিন প্রকৃতি দর্শন করে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সামনে অন্য হাতছানি তাই ঘন্টাখানেকের মধ্যে ছাড়তে হল এ জায়গা। ধীরে ধীরে রাস্তা আরও খারাপ হচ্ছে, এদিকে সন্ধের মধ্যে আমাদের গঙ্গোত্রী পৌঁছতে হবে,তাই আর থামা নয়। কিছুদূর যাবার পর দেখি জাহ্নবী নদী গঙ্গায় মিশেছে। লোহার পুল থেকে নীচে তাকালে গা ছমছম করে। পথে ভৈরবঘাটা মন্দির দর্শন করে ছটা নাগাদ গঙ্গোত্রী পৌঁছে গেলাম।
লাগেজ হোটেলে রেখে সোজা মন্দিরের রাস্তা ধরলাম। এখন প্রায় ফাঁকা, অল্পসংখ্যক পযর্টক চোখে পড়ল, তাও বিদেশি। হাতে গোনা কয়েকটি হোটেল-দোকান খোলা, মাসখানেক পর এগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। বরফে ঢেকে যাবে এই জায়গা, ছ’মাস বন্ধ থাকবে মন্দির। ৩০৪২ মিটার উচ্চে অবস্থিত শ্বেতশুভ্র পাথরে সোনালি শিখর শোভিত গঙ্গা মায়ের মন্দির। কথিত আছে, জলোচ্ছাস থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে মহাদেব এখানে বসেই জটায় রুদ্ররূপী গঙ্গার গতি রুদ্ধ করেন। আরতি শুরু হল মন্দিরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই। মন্দিরের মঙ্গলময় পরিবেশে মন নিবিড় প্রশান্তিতে আপ্লুত, পরমেশ্বরের কাছে হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করি কিন্তু কিছু চাইতে পারি না, সবইতো দিয়েছেন। প্রাপ্তির ঝুলি উপচে পড়ছে - এই অনুভুতি কেন জানিনা হিমালয়ে না এলে হয় না। আজকের রাতটা এখানে বিশ্রাম, কাল থেকে শুরু হবে ট্রেক।
প্রথম দিন সকাল সকাল হাঁটা শুরু করব, এরকম ইচ্ছা ছিল। কারণ প্রথম দিন হাঁটার গতি কমই থাকে, তাছাড়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তেজ বেড়ে গেলে ক্লান্তিকর হয় হাঁটা। কিন্তু আমরা তৈরি হয়ে গেলেও সঙ্গীদের জন্য দেরি হল। শরতের নির্মেঘ আকাশ আর শ্বেতশুভ্র তুষারশৃঙ্গ হাতছানি দিচ্ছে অনেকক্ষণ। সাড়ে দশটায় আমরা মন্দির দর্শন করে পা বাড়ালাম। মন্দিরকে পিছনে রেখে বরফের টুপি মাথায় সুদর্শন পর্বতকে সামনে দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। টুপুরের সঙ্গে ইতিমধ্যেই গাইড আঙ্কলের বেশ ভাব হয়ে গেছে। সবার আগে আঙ্কলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছে। আজ প্রথমদিন হাঁটায় ওর উৎসাহের মাত্রাটা একটু বেশি। শেষ ট্রেকিং-এ গেছে দু’বছর আগে সান্দাকফুতে।
প্রায় ১ কিলোমিটার হাঁটার পর গঙ্গোত্রী স্যাংচুয়ারিতে প্রবেশের অনুমতি নিতে হল। এখানে পরিমাণমতো অর্থ দান করে তবেই ছাড়পত্র পাওয়া যায়। দূষণের হাত থেকে হিমবাহ,অরণ্য,অরণ্যের বাসিন্দাদের বাঁচানোর জন্যই এই প্রয়াস। প্লাস্টিক বর্জিত এ জায়গা। তবুও যত্রতত্র বোতল,টফি,বিস্কুট ইত্যাদির মোড়ক পড়ে। মনে হল, যে প্রকৃতিকে দেখার জন্য আমাদের মত অনেক মানুষ ছুটে আসে কেন তারা এটুকু বোঝে না ধ্বংসের কবল থেকে প্রাকৃতিক এই সম্পদকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। দু কিলোমিটার হাঁটার পর বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড রোদে হাঁটতে টুপুরের বেশ কষ্ট হচ্ছে। রোদের খুব তেজ,আর জায়গাটাও ভীষণ রুক্ষ, বর্ষা বিদায় নেবার পর অনেকদিন বৃষ্টি নেই তাই গরম বেশ। শুধু টুপুর কেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি আমরাও। প্রচুর জল আর লজেন্স, ড্রাই ফ্রুটস খেতে আর খাওয়াতে শুরু করলাম।লম্বা রাস্তা হাঁটতে হবে, ক্লান্ত হয়ে পড়লে চলবে না। পালা করে নানারকম গল্প শোনাতে শোনাতে, টুপুরের বিভিন্ন প্রশ্নের ক্রমাগত উত্তর দিতে দিতে আর কিছুক্ষণ পর পরই গলা ভেজাতে ভেজাতে আমরা হাঁটছি। আমাদের পাশে পাশে সশব্দে গঙ্গা বয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝরনা পথ আটকাচ্ছে,ঠাণ্ডা জল মুখ -চোখে দিচ্ছি।
গঙ্গোত্রী থেকে ভুজবাসা ১৪ কিমি দূরে। তাই আজ সারাদিন হেঁটে যেতে হবে। তবে দলের কনিষ্ঠ সদস্য যদি না পারে তবে ৯ কিমি দূরে চিরবাসাতে ক্যাম্পিং করতে হবে। কিছু দূর অন্তর অন্তর পাথরে লেখা 'রক ফল এরিয়া' - একদিকে যেমন বিপদের সাবধানবাণী অন্যদিকে তেমনি হিমালয়ের অকৃত্রিম রূপের হাতছানি। পথে কোন চায়ের দোকানও নেই বিশ্রামের জন্য,ঘন্টা দুয়েক হাঁটার পর আমরা বসে বিস্কুট,ফল,চানাচুর খেয়ে আবার চলা শুরু করলাম। দূরে চিরবাসা দেখা যাচ্ছে,এখন ২ কিমি যেতে হবে,ওখানে চা-ম্যাগি খাওয়া হবে।
চিরবাসা আসার পর সবুজের সান্নিধ্যে মনটা তাজা হল। চীর গাছে ঘেরা এস্থান মরুদ্যানের মত। চিরবাসায় পৌঁছে একটি বাঙালি দলের সঙ্গে দেখা হল। বেশিরভাগ যাত্রী ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন। দলের বয়স্ক একজন সদস্য শ্বাসকষ্টে কথা বলতে পারছেন না। আমরা লজেন্স- ড্রাই ফ্রুটস দিলাম আর প্রচুর জল খাবার পরামর্শ দিলাম। আমাদের দলের ছোট্ট ট্রেকারকে দেখে এঁরা বেশ অবাক হয়েছেন। আমাদেরও দুদণ্ড জিরিয়ে নিতে মন চাইছিল। কিন্তু এখানে অস্থায়ী চায়ের দোকান বন্ধ আর আমাদের কুক স্টোভ জ্বালাতে ব্যর্থ হলেন। তাই আর সময় নষ্ট না করে হাঁটা শুরু করলাম। এখনও ৫ কিলোমিটার যেতে হবে। ধীরে ধীরে সূর্যের তেজ কমে আসছে,আর আমাদের হাঁটার ক্ষমতাও। শেষের দিকে রাস্তাও খারাপ হচ্ছে,মাঝে মাঝে পাথর গড়িয়ে পড়ছে ওপর থেকে। সূর্যাস্তের পর এই রাস্তায় হাঁটা বিপজ্জনক,তাই একটু পা চালিয়ে যেতে হবে। এদিকে খিদে ক্লান্তিতে পা অবশ হয়ে আসছে। ঈশ্বরকে স্মরণ করতে করতে সন্ধের ঠিক আগে ভুজবাসা পৌঁছে গেলাম। অনেক আগে এখানে প্রচুর ভূর্জ গাছ ছিল তাই এজায়গার এই নামকরণ, তবে আজ তার কোন চিহ্ন নেই। আমাদের সঙ্গীরা ততক্ষণে তাঁবু খাটিয়ে গরম স্যুপ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এখানে থাকার জন্য লালবাবার আশ্রমও আছে,সেখানে আহার আশ্রয় দুইই মেলে। কনকনে ঠাণ্ডার দাপটে তাঁবুতে ঢুকতে বাধ্য হলাম । উচ্চতাজনিত কারণে কিছুই খেতে ইচ্ছে করলনা। টুপুরকেও রাতে কিছু খাওয়াতে পারলাম না, কোন খাবারই পেটে থাকছে না। তাঁবুতে থাকার অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনের থাকলেও মেয়ের ছিলনা। তাই রাতটা বেশ উৎকণ্ঠায় প্রায় জেগেই কাটল।
সকালে বাইরে এসে চায়ে চুমুক দিতেই রাতের ক্লান্তি নিমেষে উধাও। রোজকার জীবনে দিনের শুরু থেকেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়,ঘড়ির গতির সাথে তাল রেখে ছুটতে হয়। তাই সকাল-দুপুর- সন্ধ্যা হয় - দেখা হয়না কিছুই। প্রকৃতিও যে আলাদা আলাদা রঙে সাজতে পারে তা আমরা ভুলে যাই। সকালের ভুজবাসাকে নতুন রূপে দেখলাম। কাল অন্ধকারে চারপাশ দেখা হয়নি। দূর থেকে দেখা পাহাড়গুলো যেন হাতের নাগালে,আর তারই চূড়ায় সূর্যের আলোকপাত মনকে উদাস করে দেয়। সকালে রোদ ঝলমলে প্রকৃতি দেখে টুপুরতো খুব খুশি। ব্রেকফাস্ট করে সবার আগে তৈরি হাঁটার জন্য। ভাগীরথী পর্বতমালার ১,২,৩ শৃঙ্গ আর শিবলিঙ্গ আগামী পথের সঙ্গী। স্যাক নিয়ে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়ার ডাক আসে। আর অপেক্ষা নয়, ভুজবাসার স্মৃতি ক্যামেরা বন্দি করে যাত্রা শুরু করি।
আজকের পথ কিলোমিটার হিসাবে কম কিন্তু কঠিন। মেয়েকে নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম, আদৌ তপোবন যেতে পারব কিনা জানিনা। পাঁচ কিলোমিটার পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে গোমুখ যাব, এখানে ক্যাম্প করা যায় না। তাই তপোবন যেতে না পারলে আমাদের আবার ভুজবাসা ফিরে আসতে হবে। অনেকেই ক্ষুদে ট্রেকারকে দেখছে, কেউ কেঊ উৎসাহ দিচ্ছে। আজ প্রায় পুরো রাস্তা বোল্ডারের ওপর দিয়ে হাঁটা আমাদের হাত ধরে। ঘন্টা দুয়েক পর আমরা গোমুখ এসে পৌঁছলাম, দূর থেকে স্নাউট দেখতে পেলাম, কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেছিলাম ছোটবেলার ভূগোল ক্লাসে। স্নাউট দেখে টুপুরও বেশ উত্তেজিত।
৪০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গঙ্গা মার মন্দিরে পুজো দিয়ে তপোবনের রাস্তা ধরলাম। এবারই আসল পরীক্ষা। হিমবাহকে ডানদিকে রেখে বাঁদিকের চড়াই পেরিয়ে ৫ কিমি দুর্গম পথ অতিক্রম করলে তবেই আজকের গন্তব্যে পা রাখতে পারব। আলগা পাথর আর মাটিতে পা রাখা যাচ্ছে না,মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাব। কোনরকমে ওপরে উঠে এলাম। এবার ক্রিভাস অর্থাৎ বরফের ফাটল দেখা যাচ্ছে সর্বত্র, চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ, এ যেন বরফের দুনিয়া। ধূসর, রুক্ষ, প্রায় জনমানবহীন বরফরাজ্যে ক্ষুদে ট্রেকারও বাকরুদ্ধ।
এই বরফ মাড়িয়েই আমাদের যেতে হবে। অতি সাবধানে, প্রতি পদক্ষেপে বিপদের আশঙ্কা। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারনে হিমবাহ দ্রুত গলে যাচ্ছে আর তপোবন যাবার রাস্তাও খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ক্রমশ। প্রতিদিন রাস্তা বদলে যাচ্ছে, ৩/৪ দিন আগে যে রাস্তা দিয়ে কোন দল গেছে আজ সেখানে রাস্তা নেই। তাই ক্লান্ত হয়ে বসার উপায় নেই গাইড এগিয়ে গেলে আমার সেখানেই বসে থাকা ছাড়া আর কোন কিছু করার থাকবে না। ওপর থেকে নীচে বরফের চাঁই গলে পড়ছে। ভীষণ ভয় পেয়েছি,আতঙ্কে মুখ বন্ধ সবার। যে রাস্তায় আমি নিজেই ভয়ে ভয়ে হাঁটছি সেখানে মেয়েকে নিয়ে হাঁটি কি করে? তাই এই পথ গাইড আঙ্কলের হাত ধরে, যেখানে পারছে না কোলে করে টুপুর চলে। আবার দেখছি এই পথেই সাধু-সন্ন্যাসীর দল খালি পায়ে হাসি মুখে হেঁটে চলেছেন। মনে জোর এনে আমরাও প্রাথমিক ভয় কাটিয়ে গাইডকে অনুসরণ করে চলি। কোন বিরতি ছাড়া তপোবনের ঠিক নীচে থামলাম। আর ১ কিলোমিটার খাড়া চড়াই উঠতে হবে ১০০০ ফুট। উঠতে গিয়ে পা যেন আর চলছে না, চড়াইয়ের প্রথম ধাপ পেরিয়ে থামলাম,পথ আটকেছে আকাশগঙ্গা ঝরনা। জলে জুতো গেল ভিজে।
বাকি পথ পার হয়ে তপোবনে পৌঁছে স্তম্ভিত হই,এ যে স্বর্গ! কষ্ট সার্থক হয়ে গেল। বরফ রাজ্য পেরিয়ে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত সবুজ এই উপত্যকা সাধুদের তপস্যাভূমি। ক’জন সাধারণ মানুষ এখানে পৌঁছতে পারে? পাশে প্রবহমান আকাশগঙ্গা নদী, কেউ কেউ বলেন এটিই গঙ্গার মূল উৎস। সামনে শিবলিঙ্গ, মেরুপর্বত,ডানদিকে ভাগিরথী - ১, ২, ৩ স্বমহিমায় বিরাজিত। আকাশে কালো মেঘ জমছে। তেমনি ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। রাতে তুষারপাতের সম্ভাবনা আছে। ঠাণ্ডায় বাইরে থাকা যাচ্ছে না। তাঁবুতে ঢুকে গরম স্যুপ খেতে বেশ লাগল। রাতে তাপমাত্রা কমতে কমতে হিমাঙ্কের দশ ডিগ্রি নীচে নামল। এদিকে টুপুর কিছুই খাচ্ছে না, খাওয়ালেই বমি করছে। আমরা ঠিক করলাম সকালেই নীচে চলে যাব, আরেকটা দিন এখানে থাকার ইচ্ছা থাকলেও সে ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। রাতে ঘুম সেভাবে হল না ।
ভোরের আলো ফুটতেই বাইরে এলাম। নির্মেঘ নীল আকাশে শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গে লাল রঙের ছটা,নদী জমে বরফ হয়ে গেছে,সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। অসাধারণ লাগছে। এদিকে ঠাণ্ডায় হাত কেটে যাচ্ছে। আকাশ পুরোপুরি মেঘমুক্ত, রোদও উঠেছে। ঘাসের ওপর, তাঁবুর ওপর জমে থাকা বরফ গলছে, স্বর্গের আঙিনায় প্রকৃতি সূর্যস্নানে ব্যস্ত।
এখন টুপুর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক – ভীষণ খুশি। ওর হাত ধরে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। শিবলিঙ্গের পাদদেশে করজোড়ে দাঁড়ালাম ,এখানে কোন মন্দির বিগ্রহ নেই তবুও নিজের অজান্তেই মনে ভক্তি আসে। দূর থেকে বাঙালি মাতার আশ্রম চোখে পড়ে, দেখা করে আসি মাতাজির সঙ্গে। এখানে যাঁরা আসেন মাতাজির কাছে আশ্রয় পেয়ে যান। ওনার কাছেই শুনলাম বর্ষার পর তপোবন সবুজ কার্পেটে মুড়ে যায় আর প্রচুর ফুল ফুটে থাকে। ব্রহ্মকমল,ফেনকমলের মত বিরল প্রজাতির ফুলও দেখা যায়। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে তুষারপাতে সব নষ্ট হয়ে গেছে। উনি নিজের জীবনের কথা শোনালেন আমাদের। দূরে কোন এক্সপেডিশন টিম ক্যাম্পিং করছে - এটাই শিবলিঙ্গ ও মেরুর বেসক্যাম্প। আকাশগঙ্গা নদী,পবিত্র শিবলিঙ্গ শৃঙ্গ আর মাতাজিকে ছেড়ে যেতে আমাদের মন চাইছিল না। টুপুরও ফিরতে চাইছে না এত সুন্দর জায়গায় এসে মাতাজির কাছে এতরকম গল্প শুনে। বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মেয়ে গতকাল সারারাত ভয়ে ঘুমোতে পারেনি,আমাকে জড়িয়ে শুয়ে কেঁদেছে।তবু যেতেতো হবেই। আবার আসতেই হবে এই তপোভূমিতে, এই প্রতিশ্রুতি মেয়েকে দিতে তবে সে ফিরতে রাজি হল। মাতাজির আশীর্বাদ নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
ভুজবাসা পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। কাল হেঁটে গঙ্গোত্রী যাব তারপর গাড়িতে উত্তরকাশী। জানি কয়েকঘণ্টা শিবলিঙ্গের পাদদেশে কাটানোর স্মৄতি অমলিন থাকবে চিরদিন, মুছে যাবে দুর্গম পথ চলার কষ্টের অভিজ্ঞতা।
সবাই মিলে আবারও বেরিয়ে পড়ব হিমালয়ের ডাকে সাড়া দিতে। সত্যি টুপুরতো বড় হয়েই গেছে তাইনা?
গোমুখ-তপোবন ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি
নিজের সংসারকে সুন্দর করে রাখার ছাড়াও ঝুমা ভালোবাসেন অনেককিছুই। তাঁর ভালোলাগা-ভালোবাসার তালিকায় বই পড়া, গান শোনা, নতুন নতুন রান্না করার পাশাপাশি রয়েছে ইন্টারনেট সার্ফ করে পাহাড়ের ছবি দেখা আর নানা ট্রেককাহিনি পড়া। আসলে তাঁর কাছে সবকিছুর চেয়ে প্রিয় এই ট্রেকিং-ই। পাহাড়ের ডাকে বছরে অন্তত দুবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনই। আর এই বেড়ানোয় তাঁর সঙ্গী প্রিয়জনদের তালিকায় রয়েছে ডায়েরি আর কলমও।