-->
[ বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে আবার অম্বল থেকে ডায়াবেটিস সবই তার নিত্য সঙ্গী। সেকালে অসুস্থতা আর বার্ধক্য নিয়েই সে ঘুরে বেড়িয়েছে তীর্থে তীর্থে, হেঁটেছে কেদার-বদরীর পথে। আর আজ শারীরিক অক্ষমতার বেড়া টপকে পৌঁছে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে, পাহাড় চূড়ায়। বেড়াতে যাওয়ার সময় ব্যাগপত্র গোছাতে বসলে জরুরি তালিকায় যেটা থাকেই তা হল টুকটাক শরীর খারাপের জন্য চটজলদি কিছু ওষুধ। কিন্তু সেই তালিকায় কী নেব আর কী নেব না বা নিজের কোন শারীরিক অসুস্থতা থাকলে অন্য জায়গায় গিয়ে কতটা সাবধানে থাকব বা তেমন কোন পরিস্থিতি তৈরি হলে সামাল দেব কীভাবে এমন নানান প্রশ্ন নিয়ে 'আমাদের ছুটি' এবার মুখোমুখি হয়েছে এমন কয়েকজন ডাক্তারদের সঙ্গে পেশার সফলতার পাশাপাশি যাঁদের সঙ্গী ভ্রমণের নেশা। আবার এই প্রতিবেদন তৈরি হওয়ার সময়েই উত্তরাখণ্ডে নেমে এসেছে প্রবল দুর্যোগ। স্থানীয় মানুষের পাশাপাশি ভুক্তভোগী অসংখ্য পর্যটক। অনেক দুর্ভোগের শেষে যাঁরা বাড়ি ফিরতে পারলেন এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আতঙ্ক মন থেকে মুছে ফেলতে পারবেন কি? বড় প্রাসঙ্গিক এই প্রশ্নের জবাব খুঁজলাম ডাক্তারদের পাশাপাশি মনোবিদের কাছেও।]
এবার কথোপকথনের আড্ডায় আমাদের সঙ্গে রয়েছেন জেনেরাল মেডিসিন ও এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জি, অর্থোপেডিক ও স্পোর্টস মেডিসিনের ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জি, চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডঃ প্রিয়ঙ্কর পাল এবং মনোবিদ মোহিত রণদীপ।
♦ বেড়াতে ভালোবাসেন সকলেই, কিন্তু আজকের লাইফস্টাইলে নানারকম অসুখ-বিসুখও মানুষের নিত্যসঙ্গী। বেড়াতে বেরিয়ে আকস্মিক দুর্ঘটনা কী প্রাকৃতিক দুর্যোগ এতো হাতের বাইরের ব্যাপার, কিন্তু নিজের সচেতনতা বা সাবধানতার অভাবও অনেকসময় ডেকে আনতে পারে বিপদ। কী করে বুঝব, কেমন করে এড়াব বা সামাল দেব এসব পরিস্থিতি?
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ কাদেরকে তুমি বেড়াতে যাওয়ার আগে নিজের অসুস্থতা সম্পর্কে সচেতন হতে বলবে, ইট ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট - যার ডায়াবেটিস আছে, মেডিসিন খায় বা ইনসুলিন নেয়, পার্টিকুলারলি যারা ইনসুলিন নেয়। আবার যার হাইপারটেনসন আছে যেটা কনট্রোল্ড নয়, মাল্টিপিল মেডিসিনস খায়। কিংবা যার রিসেন্টলি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়েছে - রিসেন্টলি মানে উইদিন সিক্স মান্থস। যার অ্যাকটিভ কোন ইনফেকসন আছে বা যাদের মাস্কিউলোস্কেলিটাল প্রবলেম আছে অর্থাৎ ডিস্ক প্রোল্যাপ্স আছে, সিভিয়ার সারভাইকাল স্পনডোলাইসিস আছে, ভার্টাইগোর প্রবলেম আছে। এদের কখনও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করাই উচিত নয়। সে পাহাড়েই যাক আর সমুদ্রেই যাক। তার কারণ হচ্ছে বেড়াতে গেলে মানুষেরতো লাইফস্টাইল চেঞ্জ হয়। নিজের রুটিনে চলা সম্ভব নয়। রুটিন ভাঙ্গলে কী এফেক্ট হতে পারে সেই সম্পর্কে তার জেনে রাখাটা খুব দরকার। সে কতটা নিয়ম ভাঙ্গতে পারে বা পারে না, তাকে কীভাবে চলতে হবে বা চলতে হবেনা এগুলো প্রত্যেকটা ব্যক্তি অনুযায়ী আলাদা করে বলে দেওয়া হয়। তবে এটাতো ঠিকই যে অত হিসেব করে কেউ বেড়ানো যায়না বা বেড়াতে যাওয়ার মানে হয়না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বেড়াতে গিয়ে লোকে সাধারণতঃ খুব একটা অসুস্থ হয়না, সে যত গন্ডগোলই করুক। নেহাত কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে অন্য ব্যাপার। যেসব অসুস্থতা হয় তা ওই পেট খারাপ, ঠান্ডা লাগা বা পড়ে গিয়ে পা মচকানো - এগুলো আনপ্রেডিক্টেবল। মেজর প্রবলেম যাদের হয়, সেসব ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের কিন্তু আগে থেকেই অসুস্থতা ছিল।
♦ যাঁরা নিয়মিত বেড়াতে যান তাঁদের ওষুধপত্রের কিটে কী কী ওষুধ আর ফার্স্ট এইড রাখাটা জরুরি? দলে ছোট বাচ্চা বা বয়স্ক মানুষ থাকলে এই তালিকায় আর কী যোগ হবে?
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ ওভারঅল একটা লোকের বেড়াতে যাওয়ার আগে যেটা করা উচিত, ওষুধ নিয়ে যাওয়া যদি বল, তা হল পরিচিত একজন ডাক্তারের থেকে কোন কোন ওষুধগুলো দরকার, তার বিভিন্ন ব্র্যান্ডনেম কী সেইসবের একটা তালিকা করে নেওয়া। সাধারণভাবে একটা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ যেন থাকে - জ্বর বা ব্যথা কমানোর জন্য। আইবুপ্রুফেন বলে একটা ব্যথার ওষুধ আছে, রিলেটিভিলি সেফ ওষুধ। বমির ওষুধ ডোমপেরিডন। একটা ডায়েরিয়ার ওষুধ রাখা উচিত। সাধারণত আমরা মেট্রোজিল বা টিনিডাজোল ব্যবহার করি। প্যারাসিটামল দিনে চারবার পর্যন্ত খাওয়া যায়। আইবুপ্রুফেন দুবার খেতে পার। টিনিডাজোল দিনে দুবার করে খাওয়া উচিত। লোমোটিল বলে একটা ওষুধ পাওয়া যায়। এটা চট করে লুজ মোশন কনট্রোল করে। রাস্তায়-ঘাটে চলতে অনেক সময় দরকার হয়। ওষুধের তালিকায় একটা অ্যান্টি অ্যালার্জিক থাকা উচিত। অ্যাভিল জাতীয় ট্যাবলেট বা সেট্রিজিন, লিভোসেট্রিজিন। কারোর কারোর পাহাড়ের বাঁকে উঠতে গেলে মাথা ঘোরে, গাড়িতে উঠলে মাথা ঘোরে – এরজন্য সবচেয়ে ভাল ওষুধ স্টুজিল। অনেকক্ষণের ট্যুর হলে বেড়ানোর আধঘন্টা আগে ও আধঘন্টা পরে একটা করে মোট দুটো ট্যাবলেট খেতে পার তাহলে মাথাঘোরাটা থাকবেনা। প্রয়োজনে কোন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দিনে তিনবারও এই ওষুধটি খেতে পারবেন। কিছু লোকের ট্রেনে-বাসে উঠলেও মাথা ঘোরে, তারাও কিন্তু খেতে পারে। সম্ভব হলে ব্রডস্পেকট্রাম একটা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স কোন ডাক্তারের থেকে জেনে নিয়ে সঙ্গে রাখা ভাল।
আমি যেগুলো বললাম সবকটাই বড়-ছোট সবাইকেই দেওয়া যায়। ছোটদের জন্য বয়স অনুসারে, বডিওয়েট অনুসারে ডোজ কম।
এছাড়া কিছু ব্যান্ড এইড, কিছু লোকাল অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম এগুলো রাখা উচিত। বাচ্চাদের জন্য স্পেসিফিকালি কিছু বলে রাখি - ওদের অনেকসময় পাহাড়ে গেলে ঠাণ্ডা লাগে। ওদের ন্যাজাল ড্রপ, কাফ সিরাপ, অ্যান্টিবায়োটিক সঙ্গে নেবেন। এছাড়া ছোট বাচ্চা উল্টোপাল্টা খেয়ে নেয়, পেটে ব্যথা হয়, তার ওষুধ। বাচ্চাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই ওষুধ থাকে, সেই প্যাকটা যেন বাড়ির লোক বেড়ানোর সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায়।
যেসব পেশেন্টের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনসন, হার্টের অসুখ আছে তারা নিয়মিত যে ওষুধ খান সেসবতো নিয়ে যাবেনই। এদের জন্য আবার কিছু সাবধানতা, নিয়মকানুন মানাও প্রয়োজন। এরা সমতলে যেকোন জায়গায় বেড়াতেই পারেন, যদিনা ডাক্তার তাকে স্পেসিফিকালি বারণ করে থাকে। যেমন ধরো, সুগার যদি আড়াইশো-তিনশোর ওপরে থাকে তাহলে আমরা তাকে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে বারণই করি। ১৪০-৯০ বা তার বেশি প্রেশার থাকলে, তা খানিক না কমা অবধি হাঁটাচলা বেশি না করাই ভাল, নাহলে হার্টের ওপর চাপ পড়তে পারে। কারোর যদি হাঁটলে বুকে ব্যথা করে তাহলে কারণটা খুঁজে বার করে চিকিৎসা করে তবেই বেরোনো উচিত। হার্টের পেশেন্টদের নিজেদের ওষুধ ছাড়াও হাতের কাছে সবসময় সরবিট্রেট রাখতে হবে। চেস্টপেইন হলে ইমিডিয়েটলি জিভের তলায় একটা, পাঁচমিনিট পরে একটা, আবার পাঁচমিনিট পরে একটা এভাবে দু'তিনটে দিতে পারে। যদি ব্যথা কমে যায় তাহলে বুঝতে হবে যে এটা হার্টের ব্যথা। আর যদি তিনটে খাওয়ার পরও ব্যথা না কমে আরও বাড়ছে, আরও কষ্ট হচ্ছে তাহলে ইমিডিয়েটলি ডাক্তারের হেল্প দরকার।
ডঃ প্রিয়ঙ্কর পালঃ বাচ্চাদের জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথা, মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, বমি, পেটখারাপের জন্য ওন্ডানসেট্রন, ডায়েরিয়া হলে ও আর এস, পেট ব্যথা হলে ড্রোটিন, কেটে ছড়ে গেলে অ্যান্টিসেপ্টিক মলম বা ব্যান্ড এইড সঙ্গে রাখবেন। বাচ্চার অ্যাজমার সমস্যা থাকলে ইনহেলার নিতে ভুলবেন না। হাই অলটিচ্যুডে কারো কারো মাথাব্যথা হয়, সেক্ষেত্রে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধের প্রয়োজন নেই। এমনিতে বাচ্চারা ভালোই মানিয়ে নিতে পারে। বাচ্চা নিয়মিত কোন ওষুধ খেলে সেগুলোও নিতে ভুলবেন না।
ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জিঃ যে কোন বেড়ানোর ক্ষেত্রেই মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, গা-বমি ভাবের জন্য ডোমপেরিডন ছাড়া হাঁটু-কোমর ব্যথার জন্য ব্রুফেন, অ্যাসিডিটির জন্য ওমেপ্রাজল ইত্যাদি সাধারণ ওষুধগুলি সঙ্গে রাখা ভালো। তাছাড়া নিজের প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং সেই বাবদ ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন।
♦ কোথায় যাচ্ছি – পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, চেনা শহর বা অচেনা পথে ট্রেকিং-এ তার ওপরেওতো ওষুধের তালিকার হেরফের হবে। লাদাখ বেড়াতে গেলে যা নেব নিশ্চয় আন্দামান বেড়াতে গেলে অন্য হবে। হাই অল্টিচ্যুডে অনেকসময়েই নিশ্বাসের কষ্ট হয়। তেমন পরিস্থিতি হলে কী করব? ভিতরকণিকার মতো ওড়িশার কিছু কিছু অরণ্য অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আছে শুনেছি। সেসব জায়গায় যেতে হলেই বা কী সাবধানতা নেব?
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ সমতলে বেড়ানোর ক্ষেত্রে সবজায়গার জন্যই ওষুধপত্র বা সাবধানতার ব্যাপারটা মোটামুটি একইরকম। ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত জায়গায় যেতে হলে ক্লোরোকুইন জাতীয় ওষুধের একটা কোর্স করতে হয়। স্টার্ট করতে হয় দু'সপ্তাহ আগে এবং ফিরে আসার দু'সপ্তাহ পরে বন্ধ করে দেওয়া যায়। বেড়াতে যাওয়ার আগে কোন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেই কোর্স করে নেওয়া উচিত। কারণ কারো কারো এই ওষুধে অ্যালার্জি হয়।
হাই অল্টিচ্যুডে সমস্যা হয় অক্সিজেনের জন্য। প্লেন ল্যান্ডে অক্সিজেনের যে প্রেশার আর কনসেনট্রেশন সেটা খুব জরুরি আমাদের লাংসে অক্সিজেন ট্রান্সফারের জন্য। অক্সিজেনের চাপ খুব কমে গেলে ফুসফুস থেকে অক্সিজেন রক্তে ঢুকবেনা। যত হাই অল্টিচ্যুডে উঠবে তত অক্সিজেনের চাপ কমে যাবে। ফলে শরীরে অক্সিজেনের আদানপ্রদান কম হবে। আর অক্সিজেন কম হলেই শরীরে সমস্যা দেখা দেবে।
হাই অল্টিচ্যুডকে মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম হাই অল্টিচ্যুড হচ্ছে ৫০০০-১০০০০ ফিট। এই উচ্চতায় খুব একটা সমস্যা হয়না যদিনা তোমার নিজস্ব কোন শারীরিক জটিলতা থাকে। তারপরে ১০০০০-১৮০০০ ফিট – ভেরি হাই অল্টিচ্যুড। আর ১৮০০০-এর ওপরে হচ্ছে এক্সট্রিমলি হাই অল্টিচ্যুড। ১৮০০০ হাজারের ওপর গেলে তাকে প্রিপারেশন, পারমিশন, মেডিকাল চেক আপ নিয়ে যেতে হয়। লাদাখে প্যাংগং লেক আর খারদুং লা দুটোই ওয়ার্ল্ডের দুটো হায়েস্ট মোটরেবল রোডে। দুটোতেই খুব শ্বাসকষ্ট হয়। লে ১০-১২০০০ ফিট আর খারদুং লা ১৮০০০-এর কিছু বেশি। যেখান থেকে পেরিয়ে তুমি নুব্রা ভ্যালিতে ঢুকছ। লে থেকে জিপে খারদুং লা উঠতে লাগে ৪৫-৫০ মিনিট। ১০০০০-১৮০০০ হাজারের মধ্যে তোমাকে অ্যাডাপ্ট করতে হয়। কী করতে হয় – স্লো রাইজ। ধীরে ধীরে ওঠ। প্লেনে করে সরাসরি না যাওয়াই ভাল। শ্রীনগর দিয়ে বাসে এসো কী মানালি দিয়ে বাসে যাও, দেখবে ওতেই অ্যাডাপ্টেশন হয়ে গেছে। আর সোজা দিল্লি থেকে লে-তে নাম তাহলে দুদিন চুপ করে বসে থাক। অ্যাডাপ্ট কর। কারণ তোমার শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি কমানোর জন্য কিছু পরিবর্তন হবে। পরিবর্তনটা করতে দিলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ১৮০০০-এর অনেক ওপরতো সাধারণ লোক যায়না, তাকে ক্লাইম্বার হতে হবে, ট্রেনিং নিতে হবে।
হাই অল্টিচ্যুডে সেরিব্রাল ইডিমা, পালমোনারি ইডিমা হতে পারে। ব্রেনে বা লাংসে জল জমে যায়। এরকম বিপদ হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে নীচে নামিয়ে আনতে হবে। বা হাইপারবেটিক অক্সিজেন থেরাপি করতে হবে। লে-তে আর্মি হেল্প করে ভীষণ। আর্মি হসপিটাল আছে, ডাক্তার আছে, অক্সিজেন টেন্ট সব আছে। হোটেলের লোকজনও সাহায্য করবে। তবে লে গেলে আগে থেকে প্ল্যান করে যাওয়া ভাল। সুগার, প্রেসার, হার্টের প্রবলেম, স্পাইনাল কর্ডের প্রবলেম, যাদের চলাফেরা করতে অসুবিধা হয় বা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিসের মত লাংসের অসুখ আছে তাদের ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে যাওয়া উচিত।
ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জিঃ হাই অল্টিচ্যুডে দশ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় সাধারণতঃ বিশেষ অসুবিধা হয়না। তার ওপরে উঠলে মাথা ব্যথা, শ্বাস কষ্ট, বমি বমি ভাব, অনিদ্রা, ক্ষুধাহীনতা, খিটখিটে ভাব ইত্যাদি হতে পারে। এসবই উচ্চতা জনিত রোগ বা হাই অল্টিচ্যুড সিকনেস।
এরকম হলে চলাফেরা কম করুন। বারে বারে চা, স্যুপ ইত্যাদি গরম কিছু খান। মাথা ব্যথায় প্যারাসিটামল ৬৫০ মিলিগ্রাম দিনে তিন বা চার বার খান। গা বমি করলে ডোমপেরিডন জাতীয় ওষুধ (খালিপেটে এক বা দু'বার) খান। মদিরা সেবন অত্যন্ত অনুচিত।
♦ নানাসময়েই, বিশেষতঃ পাহাড়ে বেড়ানোর ক্ষেত্রে অনেকসময়েই পানীয় জল পেটের পক্ষে ভালো হয় না। এসবক্ষেত্রে জিওলিন ব্যবহার করাই ভাল নাকি মিনারেল ওয়াটার কিনে খাব? বাজার চলতি মিনারেল ওয়াটারগুলোও নিরাপদ তো?
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ নিজের জল নিজে ক্যারি করা ভাল। জিওলিন ব্যবহার করতে পার। দেখবে জিওলিনের মাত্রা দেওয়া থাকে। এক লিটার জলে আট-দশ ফোঁটা দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হয়, নইলে ব্যাকটেরিয়াগুলো মরে না। আর মিনারেল ওয়াটার কিনেতো খেতেই পারো। ব্র্যান্ডেডগুলোর ওপর নির্ভর করা যায়। ভারতের সর্বত্রই খাবারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, তারপর ডায়েরিয়া করে এমন প্রোটোজোয়া পাওয়া যায়, ইট হ্যাজ বিন প্রুভেন বাই টেস্টস। তবে খাবারের থেকেও বেশি রোগ ছড়ায় জল দিয়ে। তাই জল কিনে খাওয়াটাই সবচেয়ে ভাল। আবার অনেকসময় আমরা ভুল করে ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে নিই। খাওয়া উচিত গরম ফুটন্ত খাবার। তুমি একটা চাওমিন খাবে,কী অন্যকিছু খাবে, সামনে বানাতে বলবে, ভেজে দিতে বলবে। ওই টেম্পারেচারে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া মরে যায়। আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলতে পার, বেড়িয়ে বা পেশেন্টদের দেখে যে রাইস-বেসড খাবারগুলো – ফ্রায়েডরাইস, বিরিয়ানি, পোলাও - সবচেয়ে বেশি ডায়েরিয়া করে। কারণ অনেকসময় রাইসগুলো রেখে দেয় ওরা, পরে মিক্স করে। সো ট্রাই টু অ্যাভয়েড দিজ থিংস। বাইরে বেড়াতে গিয়ে ফ্রায়েডরাইস খাওয়া, বিরিয়ানি খাওয়া এসব অ্যাভয়েড করাই ভাল। আনলেস সেটা একটা ওয়েল নোন বা ডকুমেন্টেড জায়গা।
আর সবসময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ক্যারি করবে। পার্টিকুলারলি ফর চিলড্রেন। কারণ বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, প্লেনে কোথায় হাত দিচ্ছে। রেসপিরেটারি ইনফেকশন, জি আই ট্র্যাক্ট ইনফেকশন সবকিছুই হাত দিয়েই হয়। যখনই খাবে তার আগে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
♦ কোমরে, পিঠে স্পন্ডাইলোসিস, এওতো এখন কর্পোরেট চাকুরেদের নিত্য সঙ্গী। তাই বলে কি পাহাড়ে ছোটখাটো ট্রেকিং-ও করা যাবে না? যাঁরা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন না, তাঁরা যদি ট্রেকিং-এ যেতে চান তাহলে কী ধরণের ব্যায়াম বা শারীরিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার?
ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জিঃ স্পন্ডাইলোসিস থাকলে ছোটখাটো ট্রেকিং করতে কোন বাধা নেই – তবে ভারি কিছু বহন না করাই ভাল। ট্রেকিং করার অর্থ পাহাড়ে হাঁটা। সুতরাং ট্রেক করতে গেলে হাঁটা অভ্যাস করতে হবে। প্রাতঃভ্রমণ দিয়ে শুরু করতে পারেন। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটার পরিমাণ বাড়ান। স্নিকার জাতীয় ভাল, আরামদায়ক জুতো অত্যন্ত প্রয়োজন।
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ স্পন্ডাইলোসিস থাকলে ট্রেকিং করতে এমনিতে কোন অসুবিধা নেই। খুব সাংঘাতিক ট্রেকিং নয় অবশ্য – সেসবতো প্রফেসনাল ট্রেকারদের জন্য। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে যে অ্যাকটিভলি কোন পেন না থাকে, বা ভার্টাইগো না থাকে। তাহলে কিন্তু যেতে পারবেনা। উচিত হল আগে একটু এক্সসারসাইজ করে নিজেকে অ্যাডাপ্ট করে নেওয়া। আমরা সবসময় বলি কোন লোক ট্রেকিং করতে গেলে তার কিন্তু কোন রোগ থাকা উচিত না। ট্রেকিং ইজ সামথিং ফর এ ফিট পারসন। কারো যদি স্কেলিটাল প্রবলেম থাকে – সিভিয়ার স্পনডাইলোসিস লাম্বার বা সারভাইকাল তাহলে সে কিন্তু যেতে পারবেনা।
প্রত্যেকটা লোকের বেরোনোর আগে অন্তত সিক্স উইকস ট্রেন করা দরকার। মডারেট স্পিডে ওয়াকিং, একটুখানি জগিং, রানিং, সুইমিং – করে দেখে নেওয়া যে আমি পারছি কীনা। ট্রেকিং তো ভীষণ স্ট্রেনাস জব।
♦ অনেকেরই হার্টের নানান সমস্যা থাকে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হলে বা পেসমেকার বসানো থাকলে কী কী সাবধানতা নেওয়াটা জরুরি? হাই অল্টিচ্যুডে যাওয়া যাবে কি?
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ স্টেন্ট বা পেসমেকার থাকলে প্লেন ল্যান্ডে আলাদা বিশেষ সাবধানতার দরকার লাগেনা। তবে হাই অল্টিচ্যুডে যেতে হলে বা পাহাড়ে হাঁটতে হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে যে সে আদৌ সেটা পারবে কীনা। বিকজ দেয়ার হার্ট ইজ নট ওয়ার্কিং প্রপারলি। ওইজন্যইতো বাইরে থেকে স্টেন্ট বসান হয়েছে বা পেসমেকার। সে এখন যদি লে-তে পৌঁছায়, সেখানে অক্সিজেন কম। আরও প্রেশার পড়বে হার্টের ওপর। তাই অবশ্য এদেরকে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে, ইকোতে কী ফাইন্ডিংস আছে, কটা ব্লক আছে। তুমি যদি বাঁধা গতে বল এরা লাদাখ যেতে পারবে কীনা, আমি বলব - না। যদি বল পুরী যাবে – নো প্রবলেম।
♦ এখন আমাদের মধ্যে একটা খুব চেনা অসুখ ডায়াবেটিস যাতে খাওয়াদাওয়ার নানান বাধানিষেধ থাকে। বেড়াতে গিয়ে এত নিয়ম মেনে চলব কী করে? তেমন অফবিট জায়গা হলেতো ইচ্ছেমতো খাবারও মিলবে না।
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ যাদের ক্ষেত্রে ডায়েটটা একটা বড় ব্যাপার যেমন ডায়াবেটিস, তারা যেন সেটা নিয়ে কম্প্রোমাইজ না করে। যদি মনে কর খাওয়াদাওয়া কনট্রোল করতে পারবেনা, তাহলে তেমন জায়গায় তুমি যাবেনা। আর ডায়াবেটিক পেশেন্টের ক্ষেত্রে বড় চিন্তার হল হাইপোগ্লাইসেমিয়া – হঠাৎ সুগার লেভেল কমে যাওয়া। বেরোনোর আগে তার খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত যেন সে নিজে করে রাখে। সঙ্গে নিজের পানীয় জল থাকবে। অ্যাটলিস্ট কিছু স্ন্যাকস থাকবে, আমরা বিস্কিট নিয়ে যেতে বলি। ধরো তুমি ব্রেকফাস্ট পেলেনা। কিন্তু তোমাকে সুগারের ওষুধ খেতে হবে। তুমি যদি চারটে কী পাঁচটা ক্রিমকেকার বিস্কিট খাও সেটা গুড এনাফ ক্যালরি ফর এ ব্রেকফাস্ট। তুমি লাঞ্চ পেলেনা। তখন একজন ডায়াবেটিক পেশেন্ট তো বসে থাকবেনা বা যা পাবে তাই খাবে না, তোমার কাছে যদি একটা বিস্কুটের প্যাকেট থাকে, তুমি যদি আটটা ক্রিমকেকার বিস্কুট খাও, ইট ইজ কোয়াইট এ গুড ক্যালরি ফর লাঞ্চ। বা তোমার কাছে যদি ব্রেড থাকে বা স্যান্ডুইচ বানিয়ে নিয়ে গেলে তাই খাও অর্থাৎ ডায়াবেটিক পেশেন্টকে নিজের মত করে একটা চেঞ্জ করে নিতে হবে। এছাড়া মুড়ি, চিঁড়েভাজা, ছোলাভাজা নিয়ে যেতে পারে। বেড়াতে গিয়ে সেখানে কী পাওয়া যাচ্ছে তার ওপরে কোনদিন ডিপেন্ড করবেনা। তুমি যদি হোটেলে খেতে যাও, ভাত-রুটি পেতে পার, ডাল পেতে পার। সমস্যা নেই, তুমি জান কতটা খেতে হবে। বেশিরভাগ জায়গায় যে মসলাদার সবজি হয় সেটা ডায়াবেটিক পেশেন্টদের খাওয়ার জন্য নয়। সবজির মধ্যে থেকে গ্রেভিটা বাদ দিয়ে দাও। মাছ, চিকেনতো পাওয়াই যায়, প্রবলেম করে গ্রেভিটা, বাদ দিয়ে দাও। তোমার মত ৫০-৬০ গ্রাম চিকেন বা মাছ তুলে খেয়ে নাও। সাউথ ইন্ডিয়ায় গেলে তুমি টক দই পাবে। ৭৫ গ্রাম কী ১০০ গ্রাম টক দই খেয়ে নাও। এইভাবে মডিফিকেশন করতে হবে। তুমি দেখলে রুটিও পাওয়া যাচ্ছে, পরোটাও পাওয়া যাচ্ছে, আজকেতো পরোটা খেয়ে নিই, এই ধরণের মানসিকতা থাকলে হবেনা। ওর মধ্যে থেকেই তোমাকে বেছে নিতে হবে যে আমার কোনটা। সারা ভারতবর্ষ ঘুরে আমার যেটা মনে হয়েছে সব জায়গায় সব কিছু পাওয়া যায়। আমাদের যদি অ্যাটিটিউডটা ঠিক থাকে তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অ্যাক্সিডেন্টালি তুমি কোথাও গিয়ে পৌঁছালে যেখানে তখন খাবার পাওয়া যাচ্ছেনা, সেটা অন্য সিচুয়েশন, সেটাতো তোমার-আমার হাতে নেই। কিন্তু রুটিন ট্যুরের ক্ষেত্রে তোমার যদি খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন রেস্ট্রিকসন থাকে সেটা মেনে না চলার কোন ব্যাপার আমি দেখিনা।
আর কিছু পরিমাণ গ্লুকোজ ক্যারি করা ম্যান্ডেটারি। পারটিকুলারলি ফর দোজ হু আর অন মেডিসিনস। যারা ওষুধ খায় না তাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার চান্স খুব কম। বেড়াতে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার একটা চান্স থাকে এই কারণে যে তখন ফিজিকাল অ্যাক্টিভিটি অনেকটা বেড়ে যায়, কেউ যদি খাবারটাকে উইদিন কনট্রোলে রাখে, অ্যাক্টিভিটি বাড়ার জন্য সুগার লেভেল ড্রপ করে। যে কোনদিন পাড়াতেও হাঁটে না, সে গেল বৈষ্ণোদেবী। সে যদি সকালে তিনশ সুগার নিয়েও স্টার্ট করে, অতটা এক্সসারসাইজ করার পর অবভিয়াসলি সুগার ড্রপ করবে। ডায়াবেটিক পেশেন্ট, হার্টের ডিজিজ কী হাইপারটেনসন – এদের ক্ষেত্রে হিরোইজমের কোন জায়গা নেই। খুব বেশি এক্সসারসাইজ হলে প্রেশার বেড়ে যাবে, সুগার কমে যাবে, যার অ্যানজাইনা আছে, করোনারি আর্টারি ডিজিজ আছে, তার বুকে ব্যথা হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলে ডায়াবেটিক পেশেন্টদের আবার অন্য প্রবলেম হয়। তুমি ইস্টে গেলে বা ওয়েস্টে গেলে তোমার টাইম জোন পালটাবে, তুমি ওষুধ কখন খাবে? কখন ইনসুলিন নেবে? তুমিতো এখানে ব্রেকফাস্টের আগে সকাল ন'টার সময় নাও ওখানে কটা বাজে তখন? ওখানে পৌঁছে পরেরটা কটার সময় নেবে? তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড টাইমের সঙ্গে ম্যাচ করিয়ে দেখতে হবে। ইস্টে গেলে অ্যাড করবে আর ওয়েস্টে গেলে মাইনাস করবে।
♦বিদেশে বেড়ানোও এখন খুব সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু বিপদের দিনে সবসময় হাতের কাছে ডাক্তার পাওয়া নাও যেতে পারে। হঠাৎ করে কোন এমার্জেন্সি সিচুয়েসন তৈরি হলে কী করব? শহর বা তার কাছাকাছি থাকলেতো একরকম। রিমোট কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার আগে কি এব্যাপারে কিছু সাবধানতা নেওয়ার দরকার আছে? এমন পরিস্থিতি দেশে-বিদেশে যেখানেই ঘটুক না কেন কী করা উচিত?
ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জিঃ বিদেশে বেড়াতে গেলে মেডিকাল ইনসিওরেন্স অবশ্যকর্ত্তব্য। এছাড়া ট্রাভেল এজেন্টদের কাছ থেকে আপৎকালীন ফোন নাম্বার সঙ্গে রাখুন।
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ অসুস্থতার ব্যাপারতো একই। বাইরের দেশে যেটা মুশকিল হয় অন্য ভাষা, তাদের বোঝানো। ওদের হেলথ সিস্টেমও আমাদের থেকে আলাদা হয়। এটাও আমি এক্সপিরিয়েন্স করেছি। চায়নায় গিয়ে লোককে বোঝানো ডিফিকাল্ট যে তোমার কী প্রবলেম হয়েছে। ইস্তানবুলে গিয়ে একজন অসুস্থ হয়েছে, তার প্রবলেম বোঝাতে গিয়ে আমার ঘাম ছুটে গেছে। দে ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইংলিশ। তাদেরকে বোঝানোই যাচ্ছেনা যে এর কী প্রবলেম হয়েছে। আমি বললাম যে আমি নিজেই ডাক্তার, আমি বলেই দিচ্ছি যে কী হবে, কমিউনিকেটই করতে পারলামনা। উড়িয়ে নিয়ে আসতে হল বোম্বেতে, তারপরে তার প্রাণ বাঁচল। যেখানে যাচ্ছ, সঙ্গে বা সেখানে যেন এমন লোক থাকে যে স্থানীয় ভাষা বোঝে। যে সিটিতে যাবে সেখানে নিজেদের এম্ব্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ করে রাখবে, নাম্বার নিয়ে রাখবে। বাইরে গেলে এম্ব্যাসির লোক ভীষণ হেল্প করে। ওদের হেল্প ছাড়া বিদেশে মেজর কোন অসুস্থতায় পড়লে অসুবিধায় পড়বে। আর ইনসিওরেন্স ছাড়া এখনতো অধিকাংশ দেশে ঢুকতেই দেয়না, তা তুমি কোন ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গেই যাও বা নিজে। সবসময় ইনসিওরেন্স করে যাবে। বিদেশে বেড়াতে গেলে এই তিনটে জিনিষ অবশ্যই মাথায় রাখবে।
বিদেশে তুমি কোথাও পৌঁছেই জেনে যাবে কাছাকাছি হাসপাতাল কোথায় আছে, বা কোথায় কী আছে। আর যে গাইড সঙ্গে থাকবে, সে এগুলো সবসময় জানবে। এমনকী কে কোন স্পেশালিস্ট, কোন হসপিটালের সেটাও। আমি যখন জর্ডনে গেছি, ইস্তানবুলে গেছি ওরাই কিন্তু হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে এটা হয়না। আরেকটা জিনিষ বাইরে গেলে হয় ওরা তোমাকে এমন জায়গায় ঢুকতে দেবেনা, যেখানে তুমি অসুস্থ হয়ে পরলে হেল্প পাবেনা। আমাদের দেশে এসব দেখবেনা। লাচেনে ৬৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোন ওষুধের দোকান নেই। লোকে যাচ্ছে বেড়াতে। অনেক দেশে যেতেই দিতনা। এইগুলোতো পার্টিকুলার জায়গার স্পেসিফিক প্রবলেম, ইউ কান্ট ডু এনিথিং। তোমাকে অ্যাসেস করতে হবে যে কে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, তাকে নিয়ে যাবনা। গুরুদোংমার লেকে গিয়ে যেমন আমার ছেলেকে ঢুকতে দিলনা। আট বছরের নীচে আর ষাট বছরের ওপরে গুরুদোংমারে ঢুকতে দেয়না। আমার ছেলের তখন সাত বছর বয়স। আমি ছেলেকে নিয়ে থাকলাম, আমার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে ঘুরে এল। আগেরদিনই ওখানে একটি লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, পাঁচটা বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। অ্যারাউন্ড সেভেনটিন থাউজেন্ড ফিট, অক্সিজেন এত কম, আমারই অস্বস্তি করছিল। অথচ লোকে কী করছে, বয়স লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এতে লাভ কী অসুস্থ হয়ে পড়ে? কারোর বয়স সত্তর বছর, সে বলল পঞ্চান্ন, মিলিটারিতো তোমার বয়স মাপতে যাবেনা। তোমাকে নিজেকেই বুঝতে হবে আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাবনা।
♦ উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে বেঁচে ফিরলেন যেসব পর্যটকেরা, বিশেষ করে শিশু বা অল্পবয়সী তাদের নানারকম শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি একটা মানসিক ট্রমা দেখা দিতে পারে। কীভাবে এইসব শারীরিক-মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে?
মোহিত রণদীপঃ এই ধরণের কোন বিপর্যয়ের একটা প্রতিক্রিয়া মনের ওপর পড়ে। একেকজনের ক্ষেত্রে তার রেসপন্সটা একেকরকম হয়। কারোর ক্ষেত্রে একটা নিরাপত্তাবোধের অভাব কাজ করে - হতবাক হয়ে যায়, কথা বলতে চায়না, একদম চুপ করে যায়। এদের মধ্যে ডিপ্রেশনের মাত্রা বেড়ে যায়। এরা একটুতেই আতঙ্কিতবোধ করে, কোন শব্দ শুনলেই চমকে ওঠে, আকাশে মেঘ দেখলেই ভয় পেয়ে যায়। অর্থাৎ যে অনুসঙ্গগুলোর সঙ্গে ওই স্মৃতির যোগ দেখা যায় কোথাও তাতেই মনের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়। কারোর মধ্যে আবার উদ্বেগ, উৎকন্ঠা এসবের মাত্রা অনেক বেশি থাকে।
এই পোস্ট-ট্রমাটিক স্টেজ অনেকে ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে পারেন। কারোর কারোর মধ্যে এটা বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। ছোট-বড় সকলেই এই ধরণের ঘটনায় অ্যাফেক্টেড হয়। মনের মধ্যে এই যে অনুভূতিগুলো জমা হয় সেটা চেপে না রেখে এক্সপ্রেস করতে পারলে এই ট্রমাগুলো ক্রমশ কমে আসতে থাকে। যেকোন নেগেটিভ ফিলিং যখন আমরা মনের মধ্যে জমিয়ে রাখি, অবদমন করি, পরবর্তীকালে সেটা নানান অসুবিধার আকারে প্রকাশ পায় - কখনও তা মানসিক অসুস্থতার চেহারা নিয়ে, কখনওবা নানান শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ নিয়ে। যে অনুভূতিগুলো বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেটা যত সে প্রকাশ করতে পারবে তত সেই অনুভূতির জন্য মনের মধ্যে জমে থাকা চাপ হালকা হবে। ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো কমতে শুরু করবে। প্রকাশের মাধ্যম নানাকিছুই হতে পারে – কখনও কথা বলে হতে পারে, কখনও লিখে হতে পারে, বা কোন সৃজনশীল মাধ্যম সে ছবি হোক বা কবিতা হোক, হতে পারে। ছোটদের ক্ষেত্রে সৃজনশীল মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করা হয় – খেলা, ছবি আঁকা, ক্লে মডেলিং। ওই অনুসঙ্গগুলোকে এসবের মাধ্যমে প্রকাশ করা। হয়তো বিপর্যয়ের কোন ঘটনা নিয়ে সে ছবি আঁকল, তারপর তাকে ছবির বিষয়টা বলতে দেওয়া।
আরেকটা কথা, আমরা পাশে আছি আর যে ঘটনা ঘটে গেছে এখানে তার আবার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই -কাছের লোকজনকে এই অ্যাসিওরেন্সটা দিতে হবে। কারো কারো ক্ষেত্রে নিরাপত্তাবোধের অভাব যদি খুব বেশি থাকে, অ্যাংজাইটি বেশি থাকে তখন ঘুম আসতে চায়না, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে অ্যাংজাইটিতো থাকেই, তার সঙ্গে ডিপ্রেশনেরও অনেক লক্ষণ দেখা যায়। ডিপ্রেশনের মাত্রা বেশি থাকলে ঘুম মাঝরাতে বা ভোররাতে ভেঙ্গে যায়, মনে অদ্ভুত একটা শূন্যতার বোধ তৈরি হয়। যদি মনে হয় যে মনখারাপ, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা বা বিষন্নতার মাত্রা খুব বেশি যা প্রতিদিনের জীবনকে, ঘুম খিদে এসবকে প্রভাবিত করছে তাহলে অবশ্যই কোন চিকিৎসক অর্থাৎ সাইক্রিয়াটিস্টের পরামর্শ নিতে হবে।
ডঃ প্রিয়ঙ্কর পালঃ সাম্প্রতিককালে উত্তরাখন্ডের বিপর্যয়ে যেসব শিশু বা ছোট ছেলেমেয়েরা বিপদগ্রস্ত, অসুস্থ হয়েছে তাদের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি এখন মানসিক সহায়তা দেওয়াটা খুব জরুরি। সে বাবা-মা, নিকট আত্মীয়-স্বজন হোক বা যাদের পরিবারের কারোর সন্ধান পাওয়া যায়নি তাদের ক্ষেত্রে যাঁরা দেখভাল করছেন তাঁদেরকেই এই কাজ আন্তরিকভাবে করতে হবে। তাহলেই সময় লাগলেও বাচ্চারা এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
♦ আপনিতো নিজেও বেড়াতে খুব ভালোবাসেন। কোথায় কোথায় বেড়াতে গেছেন? বেড়াতে বেরোলে কি নিজেই ডাক্তার এটা বাড়তি একটা সুবিধা বলে মনে হয়? তেমন কোন পরিস্থিতিতে কখনও পড়েছেন কি?
ডঃ দেবাশীষ চ্যাটার্জিঃ নিজে ডাক্তার হলে অবশ্যই নিজের এবং পরিবারের জন্য অনেকটাই নিশ্চিন্তে থাকা যায়। কিছু ক্ষেত্রে নিজের ছোট বাচ্চাকে নিয়েও ঝুঁকি নিতে পেরেছি – দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে কেদারে হেঁটেছি।
বেড়াতে গিয়ে অনেকরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে – তবে সব থেকে মনে পড়ে ১৯৮৪ সালে নেতারহাটের পথে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের কথা। আমি তখন ডাক্তারির ছাত্র। আহতদের তত্ত্বাবধান করে যে আনন্দ আর সম্মান পেয়েছি তা কোন দিনই ভুলব না।
ডঃ পুরুষোত্তম চ্যাটার্জিঃ প্রায় পনের বছর আগের কথা। ডাক্তার-স্টুডেন্টদের একটা বড় গ্রুপে আমরা হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গেছিলাম। যাওয়ার সময় হিমগিরিতে ডাকাতি হয়েছিল। ট্যুরিস্টদের একটা গ্রুপ যাচ্ছিল কলকাতা থেকে ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে। সেই গ্রুপের কয়েকজন লোক ডাকাতদের সঙ্গে লড়াইতে আহত হয়েছিল। একজনেরতো পায়ে বিরাট ইনজুরি হয়েছিল। আমরা চারপাঁচজন মিলে তার চিকিৎসা করেছিলাম। আর একবার ট্রেনে একজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । চেস্ট পেইন হচ্ছিল। আমার কাছে সরবিট্রেট ছিল, খাইয়ে পরের স্টেশনে নামিয়েছিলাম। প্লেনে একবার একজনের খুব ভার্টাইগোর প্রবলেম হয়েছিল, তাকে অ্যাটেন্ড করেছিলাম।
নিজের ফ্যামিলি বা বন্ধুবান্ধবের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধাতো হয়ই। অন্যে ভরসা পায় আমি সঙ্গে গেলে (হাসি)। আর কাউকে কিছু চিন্তা করতে হয়নাতো। আমি হিসেব করে সব ওষুধপত্র নিয়ে যাই। সঙ্গে বাচ্চা গেলে বাচ্চার যে ওষুধের বক্সটা আছে সেটাও নিয়ে নিই। আর কোথাও গেলে সবসময় খোঁজখবর করে যাই ওখানে হসপিটাল কোথায় আছে, পুলিস কোথায় আছে। বাইরে গেলে এমব্যাসির খোঁজ করে রাখি, ইনসিওরেন্স করে রাখি।
বাচ্চাদের অসুস্থতা সবথেকে কম হয়। বয়স্ক বা অসুস্থদের সমস্যা বেশি হয়। যারা পরিবার নিয়ে যান তাদের উচিত পড়াশোনা করে, প্ল্যান করে যাওয়া । আমি প্রায় সারা ভারতবর্ষ একাধিকবার ঘুরেছি। তেমন কোন প্রবলেম হয়নি। লাচুং-লাচেনে যেতে খাবারই পাবেননা ঘন্টার পর ঘন্টা। ওখানে জলও তেমন পাওয়া যায়না। আমরা খাবার, জল সব শিলিগুড়ি থেকেই নিয়ে গেছি। আর অসুখবিসুখতো থাকবেই তবু সবারই উচিত যতটা সম্ভব বেড়ানো, সুস্থ থাকার জন্যই এটা খুব দরকার।
সাক্ষাৎকার – দময়ন্তী দাশগুপ্ত