গডউইনের সমাধির খোঁজে

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

"আমরা তিনজন ঘাস-গজিয়ে যাওয়া বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। দু'দিকে সমাধির সারি – তার এক-একটা বারো-চোদ্দ হাত উঁচু। ডাইনে কিছু দূরে একটা সমাধি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, 'ওটা খুব সম্ভবত পন্ডিত উইলিয়াম জোনস-এর সমাধি, ওর চেয়ে উঁচু সমাধি নাকি কলকাতায় আর নেই।'
প্রত্যেকটা সমাধির গায়ে সাদা কিম্বা কালো মার্বেল ফলকে মৃতব্যক্তির নাম, জন্মের তারিখ, আর মৃত্যুর তারিখ, আর সেই সঙ্গে আরও কিছু লেখা। কয়েকটা বড় ফলকে দেখলাম অল্প কথায় জীবনী পর্যন্ত লেখা রয়েছে। বেশির ভাগ সমাধিই চারকোনা থামের মতো, নীচে চওড়া থেকে উপরে সরু হয়ে উঠেছে। ... 'এই স্তম্ভগুলোর ইংরিজি নামটা জেনে রাখ তোপসে। একে বলে ওবেলিক্স।' ডান-দিক চোখ ঘোরাচ্ছি আর ফলকের নামগুলো বিড়বিড় করছি – জ্যাকসন, ওয়টস্, ওয়েলস্, লারকিনস, গিবনস, ওল্ডহ্যাম...। মাঝে মাঝে দেখছি পাশাপাশি একই নামের বেশ কয়েকটি সমাধি রয়েছে – বোঝা যাচ্ছে সবাই একই পরিবারের লোক। সবচেয়ে আগের তারিখ যা এখনপর্যন্ত চোখে পড়েছে তা হল ২৮ জুলাই ১৭৭৯। তার মানে ফরাসি বিপ্লবেরও বারো বছর আগে।
রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম গোরস্থানটা কত বড়। পার্ক স্ট্রিটের ট্র্যাফিকের শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে।"
- সত্যি, মেঘলা ভিজে ভিজে দুপুরে পার্কস্ট্রিটের এই সমাধিচত্ত্বরের অনেকটা ভেতরে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে বুকলেটের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ঠিক আর বর্তমান কলকাতায় আছি বলেই মনে হচ্ছিল না। কবরখানা এখন অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো – তবু যেন মেঘলা দুপুরে ইতিহাস ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাদের।
'গোরস্থানে সাবধান' বুইয়ের হাতে – ওর জন্যই আরও বেশি করে এখানে আসা। টমাস গডউইনের সমাধিটা খুঁজে বের করবেই। এত বড় হয়ে গেল তাও কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে গল্পটা আসলে গল্পই। একেকটা পরিবেশে অবশ্য সত্যি নিজেদেরও যেন অন্যরকম বিশ্বাস করতে ইচ্ছাও করে।
বেলা একটা নাগাদ পৌঁছেছি। ঢুকেই ও বলল, সোজা একেবারে শেষে পৌঁছে বাঁয়ে – মানে এগুলো বেশ মুখস্থই থাকে পাতার পর পাতা! আমরাও তিনজন – সেই একই পথে এগোই। তবে এখন আর ঘাসে ঢাকা পথ নয় – পরিষ্কার। বর্ষায় শ্যাওলা গজিয়ে উঠছে দেখে নিয়মিত ব্লিচিং দেওয়া হয়, বালিও ছড়ানো রয়েছে।
এরমধ্যে বারদুয়েক পুরো চত্ত্বরটা ঘোরা হয়ে গেছে। প্রাচীন রোমান এবং গ্রীক স্থাপত্যের আদলে অসংখ্য কুপোলা, ওবেলিক্স, পিরামিড ও মুসোলিয়া। আমি কিন্তু প্রাচীন হিন্দু মন্দির আর মুসলমান স্থাপত্যের আদলও খুঁজে পাচ্ছিলাম। প্রাচ্যবিদ এবং পার্ক স্ট্রিটে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জোনসের সাদা রঙের সবথেকে উঁচু কবরটি বারবারই চোখে পড়ছিল। ঘুরতে ঘুরতে রাউডন স্ট্রিটের দিকে পশ্চিম চত্ত্বরে খুঁজে পাওয়া গেল পাতাবাহার গাছে ঘেরা হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র সমাধি – 'টিচার, পোয়েট, প্যাট্রিয়ট অ্যান্ড মেন্টর অব ইয়ংবেঙ্গল'। ছোটবেলায় ইতিহাসের পাতায় পড়া ডিরোজিওর জীবন ও ভাবনা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আমার মেয়ে এখন সেই বয়সে পৌঁছেছে। এতবছর পর ওকে সঙ্গে নিয়ে সেই মানুষটির সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে মেঘলা মনকেমন করা দুপুরে সত্যি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল।
এই চত্ত্বরেই কিছুটা আগে রাস্তার ধারে বাঁয়ে মেজর জেনারেল চার্লস স্টুয়ার্টের হিন্দু মন্দির আকৃতির সমাধিটি চোখে পড়ে। এও আরেক অন্যরকম চরিত্র। 'হিন্দু' স্টুয়ার্ট শুধু যে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তাই নয়, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। প্রতিদিন সকালে উঠে গঙ্গাস্নানে যেতেন এবং বিভিন্ন ঠাকুর-দেবতার পুজো করতেন। মহিলাদের শাড়ি পরাও তাঁর খুব পছন্দ ছিল। স্টুয়ার্ট তাঁর বইতে ভারতীয় সভ্যতার কথা খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করতেন ব্রিটিশদের উচিত এই সভ্যতাকে সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করা। স্টুয়ার্টের সমাধিটিও অন্যান্য সমাধিগুলির থেকে স্থাপত্যে ভিন্ন। খানিক নষ্ট হয়ে গেলেও সমাধিতে খোদিত দেবদেবীর মূর্তি, পদ্ম ও অন্যান্য কারুকাজ হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। অথচ এর মাত্র কয়েকবছর পর আর এক ভারতপ্রেমিক ডেভিড হেয়ারের কবর এখানে দেওয়া যায়নি ইউরোপীয় কমিউনিটির আপত্তিতেই। - এমনই কত কাহিনি, কত অশ্রু জড়িয়ে আছে একেকটা সমাধির সঙ্গে। শুধু টমাস গডউইনের সমাধিটাই কোথাও নেই – আমরা তিনজনেই এখন খুঁজছি কীনা...
কখনও বাঁধানো রাস্তা দিয়ে কখনওবা ভিজে ঘাস মাড়িয়ে চলি। কোথাও কোথাও বেশ খানিকটা খোলা ঘাসজমির মধ্যে এখানেওখানে ছড়িয়ে আছে কবরগুলো, কোথাওবা বড় বড় গাছের সারির মাঝে মাঝে। মেঘলা দুপুরে গাছের ছায়ায় নিস্তব্ধতা যেন আরও ঘন হয়ে আসে। কোথাওবা গাছপালায় ঘেঁষাঘেঁষি-ঠেসাঠেসি করে কেমন একটা আধো অন্ধকার থমথমে, গা ছমছমে ভাব – বুইয়ের ভাষায় ডেথলি না না, ডেডলি...। লালমোহনবাবু থাকলেও কি তাই বলতেন? কে জানে! আমরা ছাড়াও দর্শক আর অল্প কয়েকজন, তারমধ্যে একদল বিদেশি – স্পেন থেকে এসেছে। এখানে সারাবছরে প্রায় আটশো-হাজার দর্শনার্থী হয়। কেউবা আসেন পূর্বপুরুষের স্মৃতি খুঁজতে, কেউবা নিছক ইতিহাসের পাতা ওল্টাতেই।

১৭৬৭ সালে দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারি বা 'দ্য গ্রেট সিমেটারি' চালু হয়। ১৮৩০ সালে শেষ সমাধিটি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। সবচেয়ে পুরনো সমাধিটি সারা পিয়ারসনের, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৭৬৮ তারিখের। ১৯৭৮ সালে কবরখানাটির সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। দেড়শো বছরের অবহেলায় তখন পুরো জায়গাটা জঙ্গলাকীর্ণ – সাপখোপ, কুকুর আর চোর-ডাকাতের আড্ডা। 'গোরস্থানে সাবধান' পড়তে গিয়ে কিন্তু সেই পুরনো কবরখানার জঙ্গলে ঢাকা ভগ্ন চেহারাটাই চোখে ভেসে ওঠে। খুব সম্ভব কাহিনির সময় আটাত্তরের এদিক-ওদিক।
ডাকসাইটে সুন্দরী শ্রীমতি এলিজাবেথ জেন বারওয়েলের সমাধিটি চওড়ায় বেশ বড় – পশ্চিমদিক ঘেঁষে। বিয়ের আগে মিস স্যান্ডারসন বহু ইংরেজ পুরুষের হার্ট থ্রব ছিলেন। একবার এক বলনাচের আসরের আগে তাঁর প্রণয়প্রার্থী যুবকদের সকলকেই গোপনে তিনি কী রঙের পোষাক পরে আসবেন তা জানিয়েছিলেন। সেদিনের আসরে দশ-বারোটি যুবক এলিজাবেথের পোশাকের সঙ্গে মানানসই সবুজ রঙের পোষাকে হাজির হন। শোনা যায় মুগ্ধ অনুগামীদের কাউকেই ফিরিয়ে দেননি এলিজাবেথ, নেচেছিলেন সকলের সঙ্গেই। নাচের আসর ভাঙ্গলে সেইসব যুবকেরা এলিজাবেথের পালকির দু'পাশে দুটি সারিতে গান গাইতে গাইতে তাঁকে এগিয়ে দেন।
সেইসময়ের বহু ইংরেজ মহিলার মতো অল্পবয়সেই মারা যান এলিজাবেথ। সমাধিগুলির তারিখ পড়লেও একটা কথা বেশ বোঝা যায় যে কলোনী স্থাপনের শুরুতে শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহ নয়, প্রতিকূল অচেনা পরিবেশ, দুর্ঘটনা এবং সর্বোপরি নানান রোগ-ব্যাধি কেড়ে নিয়েছিল অনেক জীবনই। দশ-বারো-চোদ্দ, এমনকী তার চেয়েও ছোট অনেক শিশুরই নীচু নীচু সমাধিগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় সমাধির ফাঁকে ফাঁকে।

This lovely bud so young and fair
Called hence by early doom,
Just came to show, how sweet a flower,
In paradise will bloom.

- তারপর কত শীত, কত বসন্ত কেটে গেছে, কিন্তু পিতৃ-মাতৃ হৃদয়ের সেই ব্যাকুলতা আজও মুছে দিতে পারেনি কালের আঁচড়।
নানান পেশার, নানান জগতের কত মানুষ এখানে চিরশয্যায় শুয়ে রয়েছেন – বিচারক জন হাইড (১৭৯৬), স্যার জন রয়েড (১৮১৭) [এঁর নামেই রয়েড স্ট্রিট], মেরি বাওয়ার [নবাব সিরাজদৌল্লার ফোর্ট উইলিয়াম ধ্বংসের সময় ইনি দুর্গ থেকে পালাতে পেরেছিলেন], ব্রিটিশ নৌবাহিনির ক্যাপ্টেন এডোয়ার্ড কুক, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রপৌত্রী লেডি আনে মসন (১৭৭৫) ও তাঁর স্বামী লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জর্জ মসন, বর্তমান সেন্ট থমাস স্কুলের একদা প্রধানশিক্ষক রেভারেন্ড ডঃ জন ক্রিশ্চিয়ান ডিমার। এমন আরও কত বিচিত্র মানুষ, কত বিচিত্র তাঁদের কাহিনি। ব্রিটিশদের পাশাপাশি রয়েছে অনেক আর্মেনিয়ান কবরও।

সতেরো বছরের উচ্ছ্বল তরুণী রোজ আয়েলমার ভালোবেসেছিল কবি লান্ডোরকে। কবির সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছে ওয়েলসের পাহাড় আর সমুদ্রতীর। ভারতবর্ষে পৌঁছানোর মাত্র একবছরের মধ্যেই কলেরায় প্রাণ হারান রোজ। প্রিয়তমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে লেখা বিরহী লান্ডোরের কবিতাটি রয়েছে রোজের সমাধিফলকে। মুল প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে একটু এগোলেই বাঁহাতে ক্যাপ্টেন কুক আর রোজ আয়েলমারের সমাধিদুটি চোখে পড়ে।

ইতিহাসের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই মিশে যায় মানুষের কল্পনা। কারখানার পুবে লোয়ার সার্কুলার রোডের দিকে এম ডেনিসনের কবরটির পরিচিতি ‘ব্লিডিং গ্রেভ’ বলে। সময়ে সময়ে এই কবর থেকে নাকি রক্তের মতো লাল রঙের কোন তরল বেরিয়ে আসে। ভাগ্যিস্, লালমোহনবাবু শোনেননি, নইলে শুধুই ‘গেরোস্থান’ না বলে আঁতকে উঠে আরও কত কী যে বলতেন, কে জানে!
কত অজানা গল্পইতো জানা গেল এই ঘুমন্তপুরীতে হাঁটতে হাঁটতে। কিন্তু গডউইনের সমাধিতো কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না – বুইয়ের মনটা আকাশের মতই মেঘলা। ঘুরতে ঘুরতে শেষে পশ্চিমদিকের একটা কোণ কিছুটা চেনা চেনা লাগে। নাইবা লেখা থাকুক টমাস গডউইনের নাম – আসলে চ্যাপ্টা সমাধিটার ওপরটা কালো হয়ে গেছে, কোন নামই আর পড়া যাচ্ছেনা। কাছে বেশ বড় বড় কয়েকটা গাছও রয়েছে। দিব্যি ভেবে নেওয়া যায় এটাই টমাস গডউইনের সমাধি, আর এখানেই সমাধির গভীরে মাটির অনেকটা নীচে রয়েছে সেই বিখ্যাত 'পেরিগাল রিপিটার' – গল্পটা তাহলে এখান থেকেই শুরু হোক... ।

‘আমাদের ছুটি’-র সম্পাদক দময়ন্তী কর্মসূত্রে যুক্ত ছিলেন দৈনিক ‘কালান্তর’, ‘স্বর্ণাক্ষর’ ও ‘আজকাল’ প্রকাশনার সঙ্গে। পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে মুক্ত সাংবাদিকতা করছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher