-->
[ ১৯৮৯ সালে উত্তরকাশীর এন.আই.এম. থেকে ‘এ’ গ্রেড সহকারে প্রাথমিক এবং অ্যাডভান্সড কোর্স করার পর থেকে দীর্ঘ চোদ্দ-পনের বছর বসন্ত সিংহরায়-এর কেটেছে পাহাড়ে পাহাড়েই। মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন অফ কৃষ্ণনগরের একেবারে প্রথম দিককার সদস্য বসন্ত-র প্রথম অভিযান এবং সামিট ১৯৯০ সালে গ্যাংস্ট্যাং শৃঙ্গ। ১৯৯১ সালে কুমায়ুনের বালজুরি শৃঙ্গ অভিযান থেকে দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। ২০১০ সালে সহ অভিযাত্রী দেবাশিস বিশ্বাসের সঙ্গে প্রথম অসামরিক বাঙালি হিসেবে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয়। এর পরের বছর কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং ২০১২-য় অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ জয়। সব কটি অভিযানেই সঙ্গী ছিলেন দেবাশিস। এর আগে উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ জয়ের মধ্যে রয়েছে কামেট (১৯৯৭), চৌখাম্বা (১৯৯৮), শিব (২০০২),দেওটিব্বা (২০০৩), ইন্দ্রাসন (২০০৪), শিবলিঙ্গ (২০০৫), থলয় সাগর (২০০৮)। ২০১১ সাল থেকে ২০১৩-র এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মাউন্টেনিয়ারিং ও অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ফাউন্ডেশনের যুবা বিভাগের সম্মানীয় উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে গাড়োয়ালের বিপর্যয়ে এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সিকিমের মঙ্গনের ভূমিকম্পে আটকে পড়া পর্যটক এবং অভিযাত্রীদের উদ্ধারকার্যে নিয়োজিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্ধারদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সম্প্রতি ভারত সরকারের তরফে তাঁকে ‘তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার পুরস্কার’-এ সম্মানিত করা হল। এর ঠিক পরপরই পেলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ‘রাধানাথ শিকদার ও তেনজিং নোরগে পুরস্কার’।]
বসন্ত সিংহরায় এবং দেবাশিস বিশ্বাসের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১০ সালে, প্রথম অসামরিক বাঙালি হিসেবে এভারেস্ট জয়ের সংবাদ থেকে। তখনও 'আমাদের ছুটি'-র জন্ম হয়নি, প্রস্তুতি পর্ব চলছে। ২০১১ সালের মে মাসে পত্রিকা প্রকাশের ঠিক আগে আগেই দীপঙ্কর, রাজীব আর মুহিত এভারেস্ট অভিযান সেরে ফিরে এসেছেন। ভেবেছিলাম এই দু'বছরের দুই বাংলা মিলিয়ে ছ'জন অভিযাত্রীর একটা জমাটি আড্ডা নিয়ে লেখা যাবে। কিন্তু বসন্ত সিংহরায়, দেবাশিস বিশ্বাস বা মুসা ইব্রাহিমের সঙ্গে তখন যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। তাই সেবছরের তিন অভিযাত্রীকে নিয়েই আমাদের কথোপকথনের আড্ডা জমিয়েছিলাম। পরবর্তীতে 'আমাদের ছুটি'তে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান নিয়ে লেখাটির সূত্রেই প্রথম দেবাশিসদার সঙ্গে আলাপ হয়। তারপরে এই সদাহাস্যময় সদালাপী বন্ধুবৎসল মানুষটিকে পাই পত্রিকার একবছরের অনুষ্ঠানের জমাটি আড্ডায়। বসন্ত সিংহরায়ের 'তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার পুরস্কার' পাওয়ার পর দেবাশিসদার আমন্ত্রণেই গত ৭ সেপ্টেম্বর কলকাতা প্রেস ক্লাবে কৃষ্ণনগর মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত হয়েছিলাম। সেদিন বসন্ত সিংহরায়ের কন্ঠে তাঁদের অভিযানের বর্ণনা শুনে রীতিমত মুগ্ধ হলাম। তারপর তাঁকে পেলাম আমাদের কথোপকথনের আড্ডায়। মিতভাষী, স্নেহময় মানুষটি ততক্ষণে হয়ে উঠেছেন বসন্তদা। আড্ডার ফাঁকেই দেবাশিসদার কাছে শুনলাম প্রথম আলাপ থেকে ধৌলাগিরি অভিযান – বসন্তদার সঙ্গে কাটান নানান অভিজ্ঞতার কথাও।
~ পর্বতারোহণের আরো ছবি - বসন্ত সিংহরায় || দেবাশিস বিশ্বাস ~
♦ বসন্তদা, ভারত সরকারের 'তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার পুরস্কার' পাওয়ার জন্য প্রথমেই 'আমাদের ছুটি'-র পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
কৃষ্ণনগর মাউন্টেনিয়ার্স ক্লাব আয়োজিত সম্বর্দ্ধনা সভায় ধৌলাগিরি অভিযানের কথা শুনতে শুনতে অদ্ভুত একটা ইন্সপিরেশন পেলাম। ওই যে আপনি বলছিলেন ৭০০০ মিটারেরও অনেক ওপরে খোলা আকাশের নীচে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে একা একা একটা রাত কাটানোর কথা – অক্সিজেন নেই, জল নেই, শরীরে কোন শক্তিও নেই নীচে নেমে আসার মত, অথচ তখনও আশা ছাড়েননি, বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছাটাই সবকিছু ছাপিয়ে সত্যি হয়ে উঠেছিল। এটা কিন্তু যেকোন মানুষকেই উদ্বুদ্ধ করবে। সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা দিয়েই শুরু করি আমাদের আড্ডা।
বসন্ত - ধৌলাগিরিতে আমরা ২১ তারিখ তিন নম্বর অর্থাৎ লাস্ট ক্যাম্পে পৌঁছেছিলাম। সেখান থেকে আমরা ২২ তারিখ সামিট করতে বেরোই। আবহাওয়া খারাপ থাকায় স্প্যানিশ একটা দল ছাড়া অন্য সবাই নীচে নেমে গিয়েছিল। দু'জন মেম্বার আর শেরপা, তিনজনের সেই দলটা রাত দশটার সময় বেরিয়ে পড়ল। হাওয়া তখন অল্প চলছিল। খানিক আলাপ-আলোচনার পর আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম যাব। সাড়ে দশটা-পনে এগারটা নাগাদ ক্লাইম্ব করতে শুরু করলাম। প্রথমেই খাড়া দেওয়াল ধরে উঠছিলাম, বরফে দড়ি লাগানো ছিল। বেশ কিছুটা উঠে এসেছি ২০০-২৫০ মিটার মত। এখানে ছিল চার নম্বর ক্যাম্প। এক জাপানি মহিলা সিজোকো কোকো, ষাটষট্টি বছর বয়স, সে একটু ওপরে এই ক্যাম্প করেছিল। তিন নম্বর ক্যাম্প থেকে ধৌলাগিরির সামিটটা অনেক বেশি সময় লাগবে। তাসত্ত্বেও ভালো জায়গা নেই দেখে আমরা ভেবেছিলাম সেখান থেকেই বেরোব। জাপানি মহিলার তাঁবু পর্যন্ত উঠে দেখলাম ওরাও বেরোচ্ছে ক্লাইম্ব করতে। আমার আর দেবাশিসের সঙ্গে মলয় মুখার্জি বলে আরেকটি ছেলে ছিল। শরীর পুরো সুস্থ না থাকায় মলয় খুব আস্তে আসছিল। আমাদের শেরপা পেম্বা বলল এই রাস্তা আসতেই ওর আরও একঘন্টা সময় লাগবে। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ওকে এখান থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। রাতটা ও একজন শেরপার সঙ্গে জাপানি মহিলার তাঁবুতে থেকে সকালে আমাদের তিন নম্বর ক্যাম্পে ফিরে যাবে। আমি, দেবাশিস আর দু'জন শেরপা পেম্বা আর পাশাং ক্লাইম্ব করছি। আমাদের ওপরে স্প্যানিশ দলের শেরপা সহ তিনজন এবং ওই জাপানি মহিলা ও তার সঙ্গে দুজন শেরপা – এই মোট দশজন আমরা ক্লাইম্ব করছি।
রাত শেষ হল, সকাল হল, আমরা ক্রমশ ওপরে উঠছি। মাঝে মাঝেই বেশ হাওয়া চলছে, ধুলোর ঝড়ের মতো বরফগুঁড়ো গায়ের মধ্যে লাগছে। এর জন্য আমাদের ওঠার গতিটা কমে যাচ্ছিল। আমরা এই পথে দড়ি লাগিয়ে যাইনি, ফলে কঠিন জায়গাগুলোতেও সময় লেগে যাচ্ছিল। যে আগে যাচ্ছে, তাকে খুব সাবধানে যেতে হচ্ছে। কখনও আমরা আগে যাচ্ছি, কখনও সেই জাপানি মহিলা কখনওবা স্পানিশ দলটি। আমরা সবাই একেকটা দলে রোপ আপ করে চলেছি। আমরা চারজন একটা দড়িতে, জাপানি মহিলারা একটা দড়িতে তিনজন, স্প্যানিশ দলটির একজন আর শেরপাটি একটা দড়িতে বাঁধা আছে, ওদের লিডার ভদ্রলোকটি একা একা পেছনে আসছে।
যেতে যেতে বেলা গড়িয়ে গেল – প্রায় তিনটে, তখনও আমাদের কিছুটা বাকী আছে, মোটামুটি ঘন্টাদুয়েক লাগবে, আনুমানিক একশো মিটার নীচে আছি। হঠাৎ স্প্যানিশ ভদ্রলোকের শেরপাটি স্লিপ কেটে গেল। স্লিপ খেয়ে একেবারে ফুটবলের মতো রাউন্ড খেতে খেতে পড়ছে। আর ও যেই পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে ওর সঙ্গে বাঁধা স্প্যানিশ ভদ্রলোকও পড়ে গেলেন। দুজনেই রোল করছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমরা ভাবছিলাম ওরা বেরিয়েই যাবে, কিন্তু যাইহোক হঠাৎ শেরপাটা আটকে গেল। স্প্যানিশ ভদ্রলোকও শেরপাটির গায়ে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেল। তখন আমরা পুরো হতভম্ব হয়ে গেছি, বেলাও হয়ে গেছে, ঠিক করলাম এখান থেকেই ফিরে যাব। দেখি জাপানি মহিলা ইউ টার্ন নিয়ে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে স্প্যানিশ দলের শেরপাটি উঠে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোকটি উঠতে পারছে না। ওদের লিডারও ততক্ষণে চলে এসেছে। দুজনে স্প্যানিশ ভাষায় কী কথা বলছে আমরা বুঝতে পারছি না। দেখলাম যে ওরা সেফ – মারা যায়নি, রেসকিউ করতে হবে। শেরপাটা ঠিক আছে, নিশ্চয় নিয়ে আসতে পারবে। আমরা ফিরতে শুরু করলাম।
ফিরতে ফিরতেই চোখে একটু ঝাপসা দেখতে শুরু করেছিলাম। গগলসের ওপর তুষার জমে শক্ত বরফ হয়ে যাচ্ছে। সেগুলো পরিস্কার করা যাচ্ছিল না। তখন চশমাটা পালটে শেরপার কাছে বাড়তি চশমা ছিল সেটা পড়লাম। দেবাশিসেরও চোখে অসুবিধা হচ্ছিল। যাইহোক সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমরা নামছি আস্তে আস্তে। হেডটর্চ জ্বালিয়ে আসছি। দেবাশিসের হেড টর্চের আলোটা কমে গেল। ও বলল বসন্তদা তোমারটা দাও। আমি সিনিয়র, দলনেতা, স্বাভাবিকভাবে আমি আমার টর্চটা ওকে দিয়ে দিলাম। এবারে আমি আর কিছু দেখতে পারছি না। একেই চোখটা খারাপ হয়েছিল, তারপরে অন্ধকারে কিচ্ছু দেখতে পারছি না, আন্দাজে নামছি। এবারে রাত তখন আটটা-ন'টা হবে, দেবাশিস একটা জায়গায় এসে 'বসন্তদা...' বলে বসে পড়ল। দেখলাম যে ও আর পারছে না। এর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাতেও একবার এরকম অবস্থা হয়েছে, অন্নপূর্ণাতেও একজায়গায় একটুখানি হয়েছিল। আসলে ওর অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। এদিকে আমারও অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। সেইজন্যই যখন নামছিলাম, টলে টলে যাচ্ছিলাম। আমাদের এতটা সময় লাগবেতো ভাবিনি। রাত দশটা-এগারটায় বেরিয়েছি, পরেরদিন দুটো-তিনটে-চারটের মধ্যে ফিরে আসার কথা আমাদের তাঁবুতে।
এবারে দেখি আমারও আর শরীর চলছেনা। বসে পড়লাম পথের ওপরেই। আর উঠতে পারছি না। মনে হল আমি যদি না উঠতে পারি তাহলে আর কী হবে – হয় মরতে হবে নয়তো পিঠে করে নামাতে হবে। পাশাংকে বললাম আমাকে পিঠে করে নামাও। এটা প্র্যাকটিকালি সম্ভব নয় – কোনো শেরপা কাউকে পিঠে করে উপরেও নিয়ে যেতে পারে না, নীচেও নামিয়ে আনতে পারে না, একটু-আধটু হতে পারে। বিশেষ করে ওই উচ্চতায়তো সম্ভবই নয়, তখন আমরা ৭৮০০-৯০০ ফিট ওপরে। তখন কিছুটা সময় গিয়েছে, পেম্বা দেবাশিসকে বুঝিয়েছে যে যদি না নামে তাহলে এখানেই মরতে হবে, আর কিছু উপায় নেই। আমি শুনতে পাই নি অবশ্য। দড়িটা কেটে নিয়ে একটা দড়িতে পেম্বা নিজেকে আর দেবাশিসকে বেঁধে নামতে লেগে গেল। নামার আগে আমাকে কিছু না বলে একবার করুণ চোখে তাকিয়ে পেম্বা চলে গেল। পাশাং তখনো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। এরপর পাশাং-ও নেমে যাচ্ছে দেখে ওকে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে থাক। বলল, না, আমি সকালবেলায় আসব। ও নেমে যাওয়ার পর সেই খোলা আকাশের নীচে শুয়ে আমার মনে হল আর ফিরতে পারব না। ওই অবস্থায় যদি আমি সারারাত পড়ে থাকি তার পরিণতিটা আমি ভালোভাবেই জানি। বেসক্যাম্পেই যদি ওরকম ঠান্ডার মধ্যে বাইরে পড়ে থাকতে হয় তাহলে মরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। একটা হতাশার ভাব আসল – কিছুতো করার নেই, আমি উঠতে পারছি না, ওরা চলে গেছে...। কিন্তু সেটা খুব বেশিক্ষণ থাকল না। তারপরেই মনে হল, আমার কিছু হবে না, আমি বাঁচব। আমি এত ভাল পোষাক পড়ে আছি, পায়ে জুতো, হাতে গ্লাভস আছে, আমার কিচ্ছু হবেনা। হার্টবিটটা মাঝে মাঝে অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে যেন হার্ট ফেল করবে। মনের যতই জোর থাকুক, হার্ট কাজ না করলেতো আমার কিছু করারও নেই। তাহলে কি হার্টফেল করেই মারা যাব? তাও মনে হচ্ছে, না, কিছু হবে না। এটা আমার জীবনের একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা, এটাকেই আমি এনজয় করি। আরেকটা কথাও মনে হল যে কোনরকমে আমায় রাতটুকুনি কাটাতে হবে। সকাল হলেই যে শেরপাটাকে আমরা তিন নম্বর ক্যাম্পে নামিয়ে দিয়েছিলাম ও এসে আমাকে অক্সিজেন দিয়ে নামিয়ে নিয়ে যাবে। এদিকে খুব জল পিপাসাও পেয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল দূরে একটা পাশে আলো জ্বলছে। বুঝলাম সেই জাপানি মহিলা ও তার শেরপারা। ওরা ঠিক রাস্তায় না নেমে একটু অন্যদিকে চলে গেছে। আমার লাইটটা তখন ওদের দিকে অনেকবার করে ঘোরালাম যাতে এদিকে আসে। কিন্তু ওরা কোথায় গেল বুঝতে পারলাম না, আমিও তারপরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে প্রচণ্ড জল পিপাসায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। হাতের গ্লাভস খুলে বরফ একটু খুঁটে খুঁটে মুখে দিলাম। জিভে হয়তো সামান্য একটু লেগেছে, কিন্তু তেষ্টা মেটেনি। তারপরে কোনমতে ওপরের মোটা গ্লাভসটা পরলাম কিন্তু তলার পাতলা গ্লাভসটা আর পরতে পারলাম না।
যাইহোক সারারাত পড়ে থাকার পর একটা সময় দেখলাম সূর্য উঠছে। লাল একটা আভা – সরলরেখায় একটা লাইন হয়, এটা গত কয়েকবছর ধরেই দেখছি – এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণায়। ভোরবেলায় এই লাল সরলরেখাটা আস্তে আস্তে গোলাপি হয়ে যায়, তারপরে সূর্য ওঠে। তখন মনে হল অনেকটা সময় কেটে গেছে, তারমানে এবার ভোর হবে, সকাল হবে, সূর্য উঠবে, আমি বাঁচব। সূর্য উঠলে ঠান্ডাটাও কিছুটা কমবে। ভগবানের আশীর্বাদ কীনা জানি না, রাতে একটুও হাওয়া দেয়নি, একটা ফোঁটাও বরফ পড়েনি, যেটা ওই উচ্চতায় স্বাভাবিক। আবার একটু ঘুমিয়ে গেছি। তারপর ঘুম ভাঙতে দেখছি একজন উঠে আসছে। আমি তাকে দেখে বাঁহাতটা নাড়াতে লাগলাম – একতো খুশিতে, আর আরেক হল তাকে বোঝানো যে আমি বেঁচে আছি, তুমি এস। ভয় পেতে পারেতো আমি মরে গেছি ভেবে। দেখি পাশাং। পরে জানতে পারি ও সে রাতে ক্যাম্পে নেমে যায়নি। কিছুটা নেমে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। ও আসার পর ওকে বললাম তোমার কাছে আমার ক্যামেরা আছে, ছবি তোল। আমি নিজেও শুয়ে শুয়ে অনেকগুলো ছবি তুললাম। ওকে বললাম ওখানে অক্সিজেনের বটল কয়েকটা পড়ে আছে, তার কোনটায় অক্সিজেন আছে কীনা দেখতে। ও সবগুলোতেই রেগুলেটর লাগিয়ে দেখল যে কোনটাতেই নেই। জলও নেই ওর কাছে। তারপরে আর আমার তেমন কিছু মনে নেই, ও কিছু বলেওনি আমাকে। নেমেও গেল কিছুক্ষণ পর। আমি তখনও অপেক্ষা করে আছি সেই শেরপাটা আমাকে নিতে আসবে। তারপর দেখি ওপর থেকে সেই স্প্যানিশ দলনেতা নেমে আসছে। ওর নাম জুয়ান জু। ওর দলের অন্যজনকে শেরপাটা কিছুটা নামিয়ে আর পারেনি, অ্যাঙ্কেলে চোট লেগেছে। জিজ্ঞাসা করলাম জল আছে? ও বোতলটা উলটে দেখাল একফোঁটাও নেই। স্বাভাবিক, ও-ওতো বেরিয়েছে দুদিন আগে রাত দশটায়। ও আমার পাশ দিয়েই নেমে গেল। আমিতো শুয়েই আছি, শরীরে কোন শক্তি নেই। তারপরে হঠাৎ দেখি আরেকজন উঠে আসছে – সেই শেরপাটা, ওর নাম দাওয়া। দাওয়া এসে অক্সিজেন দিল। ওয়াকিটকিতে দেবাশিসদের সঙ্গে কথা বললাম। ওরাতো আশাই করেনি, ভেবেছিল আমি এক্সপায়ার করে গেছি। ওরা বলছে তুমি নেমে এস। বললাম, আমাকে পিঠে করে নামাতে হবে, হাঁটার অবস্থা নেই। ওরা বলছে সেতো সম্ভব নয়, তুমি যে করে হোক নেমে এস। বাড়ির কথা বলছে, ছেলের কথা বলছে...। কিন্তু আমার পক্ষে নামা সম্ভব নয়। ফোনটা কেটে দিলাম। আমি দাওয়াকে বললাম তুমি আমাকে পিঠে তোল। ও পিঠে তুলে সাত-আটটা স্টেপ নেমেই আবার আমাকে নামিয়ে দিয়েছে। ওর কষ্ট হচ্ছে। তারপর আবার তুলেছে। যেই তুলেছে তখন আমার বুকে পেইন হচ্ছে। আমি ওকে বললাম নামিয়ে দাও। তারপরে আর ওর পিঠে উঠিনি। কখনও বসে বসে, কখনও কুঁজো হয়ে কয়েকটা স্টেপ...সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না, কখনও আমি গা ছেড়ে দিচ্ছি ও স্লিপ কাটিয়ে কাটিয়ে নিয়ে এসেছে। এভাবে সারাদিন চলে বিকালবেলায় সেই জাপানি মহিলার তাঁবুতে যেখানে দেবাশিস আছে সেখানে দাওয়া আমাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর চা বা ওই জাতীয় গরম কোন তরল খেতে দিল। সারারাত জাপানি মহিলার ছোট স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে খুব শীত করছিল, কষ্ট হচ্ছিল, খুব কথাও বলছিলাম, অবুঝের মত রাগারাগি করছিলাম। পরেরদিন সকালে আবার নেমেছি – অনেকটাই স্লিপ কেটে, ওরা ধরেছিল, আমার তেমন জোর ছিল না, তবে অক্সিজেন থাকায় কষ্টটা কিছুটা কম হচ্ছিল। কোনমতে তিন নম্বর ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর দেখছি ওরা আমায় ম্যাট্রেস দিয়ে বাঁধছে, কেন বাঁধছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। দেবাশিসকে বলছি আমাকে তাঁবুতে ঢোকাচ্ছে না কেন? মলয় ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল, ওকে বললাম ছবি তোলো। তারপর হঠাৎই শুনি একটা আওয়াজ – হেলিকপ্টারের শব্দ আর তারপরেই দেখি আমি ঝুলছি। ঝুলছি, হাওয়া লাগছে, অস্বস্তি করছে, তবে দু'তিন মিনিটও হবেনা, দেখি বেসক্যাম্প। আমার আলসার হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই আবার ওই হেলিকপ্টারে আমাকে কাঠমান্ডু পাঠান হয়। সেখানে নেমে সোজা আই সি ইউ-তে। এর মাঝে অনেক কথা আমার মনে নেই, গ্যাপ রয়ে গেছে স্মৃতিতে, কোনদিনও আদৌ মনে পড়বে কীনা কে জানে! পরে জানতে পারি ওই জাপানি মহিলাকে আমি দূরে যেখানে আলো দেখেছিলাম ওখানেই তার অক্সিজেন ফুরিয়ে যায় আর এক্সপায়ার করে। স্প্যানিশ ভদ্রলোকটি তিনরাত লড়াই করেছিল। তারপর চতুর্থদিন যখন নীচের থেকে অক্সিজেন ওষুধ নিয়ে রেসকিউ টিম পৌঁছেছে, তখন মারা গেছে। সেই শেরপাটাকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে।
♦ দেবাশিসদা, আপনিতো দীর্ঘ সময় ধরে বসন্তদার পাহাড়পথের সঙ্গী, কিন্তু এবারের মত অভিজ্ঞতা হয়তো আগে কখনও হয়নি। যখন নীচে পৌঁছে দেখলেন বসন্তদা আসেনি তখন খুব খারাপ লাগছিল নিশ্চয়। সেইসময়ের পরিস্থিতি ঠিক কেমন ছিল?
দেবাশিস –ঠান্ডা লেগে চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতে একসময় আর কিছুই দেখতে পারছিলামনা। ফলে বুঝতেই পারিনি যে যেখানটায় আমরা আলাদা হলাম সেখানে বসন্তদা বসে গেছে। আমার মাথায় তখন একটাই ভাবনা যে ওই জাপানি মহিলার তাঁবুটা যেখানে ছিল, আমাদের তাঁবুর দুশো মিটার ওপরে, সেখানে পৌঁছাতে হবে। সারারাত ধরে হাঁটছিতো হাঁটছি। তারপর কোন একসময় সেখানে পৌঁছালাম। পেম্বা বলল, দেবাশিসদা পৌঁছ গিয়া। আমরা যখন আলাদা হয়ে নামতে শুরু করেছিলাম তখন পেম্বাকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম সাড়ে সাতটা বাজে। আমি ভেবেছিলাম সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা, আসলে সেটা পরেরদিন সকাল সাড়ে সাতটা। তাঁবুতে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। মনে হল যেন মারাই যাচ্ছি, চোখের সামনে নানান রঙ দেখছি। তাঁবুর ভেতরে কেউ আমাকে টেনে নিল, আমার মনে হল বোধহয় বসন্তদা। আসলে জাপানি মহিলার একজন শেরপা ছিল - দাওয়া, সেই আমাকে টেনে নিয়েছিল। কেউ একটা গরম কোন তরল আমাকে খাইয়ে দিল। প্রায় ঘন্টাদুয়েক ওভাবে আচ্ছন্ন অবস্থায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। আবছা আবছা আলো দেখতে পাচ্ছি। তখন খেয়াল করলাম বসন্তদা নেই। পেম্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম বসন্তদা কোথায়। বলল, বসন্তদাতো উপর রহ গিয়া, উসকো জিন্দা আনা মুসকিল হ্যায়। পেম্বা এরমধ্যে ওয়াকিটকিতে আমাদের তাঁবুতে যোগাযোগ করেছিল। ওখানে মলয় আর ওর শেরপা দাওয়া ছিল। দাওয়াকে মলয়ের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আর একটু জল বানিয়ে ওপরে বসন্তদার কাছে যত সকালে সম্ভব পৌঁছাতে বলেছিল। আমি যখন খেয়াল করতে পারলাম ততক্ষণে পাসাং নেমে এসেছে, দাওয়া বসন্তদার কাছে পৌঁছে গেছে। ওখান থেকে ওয়াকিটকিতে জানিয়েছে, বসন্তদা মিল গয়া, ও ঠিক হ্যায়, লেকিন চল নেহি সকতা। আমি তখন বসন্তদার সঙ্গে কথা বললাম – তোমার বাড়িতে বৌদি আছে, ছেলে আছে, ওদের কথা ভাব, মনে জোর আনো, উঠে দাঁড়াও। বসন্তদা কেবল একটাই কথা বলছে, আমাকে পিঠে করে নামাতে হবে। কিন্তু ষাট-পঁয়ষট্টি কেজি একজনকে পিঠে করে নামানো সম্ভব নয়। সেকথা বলতে বসন্তদা বলল, তুই তো নেমে গেছিস। বুঝতে পারছি আমি নেমে এসেছি, বসন্তদা পারছে না, এরকম মনে হতেই পারে। আমি অনেক করে বোঝালাম। দাওয়ার সঙ্গেও কথা বললাম যে আমরা যেভাবে নেমে এসেছি, সেভাবে নেমে এস।
তারপর প্রায় এক দেড়ঘন্টা কেটে গেছে। আমরা অপেক্ষা করে আছি। তখনও কেউ ফিরছে না দেখে বার বার ওয়াকিটকিতে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করছি কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না। আমি আর পেম্বা দুজনেই তখন মোটামুটি নিশ্চিত যে নিশ্চয় বসন্তদাকে পিঠে করে আনতে গিয়ে দাওয়ার পা স্লিপ করেছে, দুজনেই পড়ে গেছে। আমার মন পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে – একসঙ্গে এলাম, বসন্তদাকে নিয়ে ফিরে যেতে পারব না! চোখে জল চলে এসেছে। তখন পর্যন্ত অন্য অভিযাত্রীরাও কেউ ফেরেনি, সেটাও খুব খারাপ লাগছে। বসে থাকতে থাকতে খানিক ঝিমুনির মত হয়েছিল, বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ পেম্বা ডেকে বলল, দেবাশিসদা, বসন্তদা আ গয়া। তাকিয়ে দেখি দাওয়া ঠেলে বসন্তদাকে টেন্টে ঢোকাচ্ছে। তখন আমি দাওয়াকে এই মারিতো সেই মারি – তুমি ওয়াকিটকি ধরছনা। দাওয়া বলল বসন্তদাকে প্রায় পিঠে করে এনেছে তাই ফোন ধরার অবস্থাই ছিল না।
বসন্তদা এরপর সেরিব্রাল ইডিমার মত একটা অবস্থায় চলে গেল – ভুল বকছে, ঠিকমত চিনতে পারছে না, রাগ করছে, যা খুশি বলে যাচ্ছে। পরদিন শেরপাদের বললাম, তোমরা যেভাবে হোক বেঁধে বসন্তদাকে নামাও, আমি নীচে চলে যাচ্ছি। আমি থাকলে বসন্তদা কথা শুনবে না। মিনিট পনেরোয় আমি দুশো মিটার নীচে তাঁবুতে নেমে গেলাম। বসন্তদাকে ওই দুশো মিটার নামাতে প্রায় দেড়-দুঘন্টা লাগল। ধাক্কা খেতে খেতে নামায় খুব আহতও হল, হাঁটুর মাংস ছিঁড়ে গেল। আমার মনে হল যে এভাবে নামাতে গেলেতো পথেই মারা যাবে। শেরপাদের বললাম যে যত ম্যাট্রেস আছে, সব দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধ। যখন প্রায় বাঁধা শেষ তখন দেখি একটা হেলিকপ্টার আসছে। নীচে একটা হুক ঝুলছে। ওরা এসেছিল ওই স্প্যানিশ লোকটির খোঁজে। কিন্তু হুক ঝুলছে দেখে আমরা বসন্তদাকে আটকে দিলাম। ওরা প্রথমে বেসক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বসন্তদার হিল ডায়ারিয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই আর রিস্ক না নিয়ে বসন্তদাকে কাঠমান্ডুতে নামিয়ে নিয়ে আসে। ফলে বসন্তদা বেঁচে গেল।
♦ বসন্তদা, এরকম একটা অভিজ্ঞতার পর কি এভারেস্ট বা কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকেও ধৌলাগিরিকে কঠিন বলে মনে হয়েছে, নাকি সেইসময়ে ওই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
বসন্ত -ধৌলাগিরি হোক বা এভারেস্ট হোক, এমনকী ছোটখাটো কোন শৃঙ্গই হোকনা কেন সবগুলোই কিন্তু যেকোন ক্লাইম্বারের ক্ষেত্রেই কঠিন। যদি আমি এগুলোকে পাশাপাশি রেখে তুলনামূলক আলোচনা করি তবেই এই প্রশ্নটা আসে। সেভাবে দেখলে ধৌলাগিরি কিন্তু এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা বা অন্নপূর্ণার মত কঠিন নয়। ওগুলো যেভাবে ক্লাইম্ব করতে হয়, এটায় সেই টেকনিকাল ক্লাইম্ব কোথাও নেই। যেটুকু আছে সেটা যেকোন শৃঙ্গ করতে গেলেই হয়। এখানে একটাই অসুবিধা ওপরে প্রচণ্ড হাওয়া। তার জন্য ধৌলাগিরি বেসক্যাম্পে আমাদের অনেকদিন বসে থাকতে হয়েছে। দুনম্বর ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে ফাইনাল ক্লাইম্বিং-এর আগে বারবার ডেট চেঞ্জ করতে হয়েছে। যেদিন বেরোব বলে ঠিকঠাক, জানি ওয়েদার ভালো থাকবে, হাওয়া কম থাকবে, হঠাৎ জানতে পারলাম ওয়েদার চেঞ্জ হয়ে গেছে, ওপরে হাওয়া বেড়ে গেছে, আমাদের আবার অপেক্ষা করতে হল। এরকম অনেকবার হয়েছে। শেষপর্যন্ত ২১ তারিখ যখন লাস্ট ক্যাম্পে পৌঁছালাম, তখনও কিন্তু হাওয়া বইছে, আমরা বেরোতে পারলাম না। আর আরেকটা ব্যাপারও হয়েছিল – এর আগে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা এই সবগুলোতেই লাস্ট ক্যাম্প থেকে ক্লাইম্ব করতে আমাদের মোটামুটি বারো ঘন্টা লেগেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘায় একটু বেশি। কিন্তু এখানে লাস্ট ক্যাম্প থেকে এতটাই দূরত্ব যে ষোলো -সতের ঘন্টা লাগার কথা। কিন্তু আমরা অতটা সময় দিয়েও পৌঁছাতে পারিনি। এটা একটা বড় সমস্যা হয়েছিল। আমরা যদি আরও ওপরে একটা ক্যাম্প করতে পারতাম তাহলে হয়ত সুবিধা হত।
♦ ফিরে এসে 'তেনজিং নোরগে অ্যাডভেঞ্চার পুরস্কার' পেলেন। সেই অনুভূতিটা ঠিক কেমন? মনে হয়নি কি আরও আগেই এটা আপনার প্রাপ্য ছিল? পশ্চিমবঙ্গ থেকে আপনিই কি প্রথম এই পুরস্কার পেলেন?
বসন্ত - অবশ্যই খুব ভালো লেগেছে। এটাতো একটা স্বীকৃতি। ঊননব্বই সালে আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখনতো ভাবিনি ক্লাইম্ব করে পুরস্কার পেতে পারি। এসব পুরস্কারের কথা জানতামও না, ভালোবাসা থেকেই করেছি। তারপর যখন লোকজনের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে শুরু করলাম যে ভালো একটা ক্লাইম্ব করলাম, তখন খুব ভালো লেগেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত যারা পাহাড়ে যায় তাদের কাছ থেকেই শুধু এই স্বীকৃতিটা পেয়েছি। ২০১০ সালে মাউন্ট এভারেস্ট অভিযানের পর থেকে সাধারণ মানুষ এবং সরকারের কাছ থেকে আমরা সেই সম্মানটা পেলাম। মাউন্টেনিয়ারিং-ও যে একটা ভালো স্পোর্টস সেটাও সকলে উপলব্ধি করল। এভারেস্ট করার পরেই কিন্তু মনে হয়নি, কারণ ভারত থেকে অনেকেই এভারেস্ট ক্লাইম্ব করছে। এরপর আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্লাইম্ব করলাম – সেটাও স্বপ্নেও ভাবিনি। তারপরে অন্নপূর্ণা। কারণ কে২ বা নাঙ্গা পর্বত আমরা যেতে পারব না, অনুমতি মিলবে না। এই তিনটে যখন ক্লাইম্ব করলাম তখন আমার মনে হল যে এই যে ধারাবাহিকতা, এত ক্লাইম্ব করেছি, কোন বছর বাদ যায়নি, এই পুরস্কারটা আমি এবার পেতে পারি। কারণ ইন্ডিয়ান কোন সিভিলিয়ান পরপর এই রেঞ্জের তিনটে পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করেছে বলে আমার জানা নেই। তাছাড়া আমার আগে এমন অনেকেই পেয়েছেন যাঁদের কিন্তু এত ক্লাইম্বের অভিজ্ঞতাই নেই। এভারেস্টের আগে একুশটা অভিযানে অংশ নিয়েছি, যারমধ্যে উনিশটায় নেতৃত্ব দিয়েছি, আঠেরটা শৃঙ্গ জয় করেছি। আমিই বা পাব না কেন?
শুধু পর্বতারোহণই নয়, আমি গাড়োয়াল হিমালয়ে ২০১০ সালে একটা উদ্ধারকাজে সরকারি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। অনেক ট্যুরিস্ট আটকে গিয়েছিল, মাউন্টেনিয়ারকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর সিকিমে এরকম একটা রেসকিউ মিশনে গিয়েছিলাম। সেবার দেবাশিসও আমার সঙ্গে ছিল। পশ্চিমবঙ্গের যুবকল্যাণ দপ্তরের মাউন্টেনিয়ারিং বিভাগের অ্যাডভাইসার ছিলাম দু'বছর। এই ব্যাপারগুলোও কাজ করেছে।
না, আমি প্রথম নই। তেনজিং নোরগে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অনেকগুলো আছে। একটা ল্যাণ্ডে দেয় – মাউন্টেনিয়ারিং-এ, আরেকটা আছে ওয়াটার অ্যাডভেঞ্চার যারা করে, আর এয়ার অ্যাডভেঞ্চারে। এর আগে এই পুরস্কারের নাম ছিল 'ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড'। ১৯৯৮ সালে মাউন্টেনিয়ারিং-এ পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছিলেন অমূল্য সেন। আমি দ্বিতীয়। এছাড়া এখান থেকে বুলা চৌধুরি ও তাপস চৌধুরি অন্য ক্যাটেগরিতে এই পুরস্কারটি পেয়েছেন। এটা কিন্তু 'অর্জুন পুরস্কার'-এর সমতুল্য।
♦ বসন্তদার এই পুরস্কার পাওয়াটা বাঙালি অভিযাত্রীদের কাছে একটা গর্বের বিষয়। দেবাশিসদা আপনার কী মনে হয়েছিল খবরটা পেয়ে? ভবিষ্যতে আপনার প্রাপ্তির ঝুলিতেও এই পুরস্কার আসবে আমরা আশা করছি।
দেবাশিস -বসন্তদাতো ফিরে আসার মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়েছিল, খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। বসন্তদা যেরকম, ঠিক সেরকম লাগছিল না। আসলে ফ্রস্ট বাইট হয়ে গেছিল। পায়ের তিনটে আঙুল কাটা গেছে। বাকী আঙুলগুলো চাঁচতে হয়েছে। হাঁটুর কাছে অনেকটা মাংস উঠে গেছে, বুকে ঠান্ডা লেগে আলসার মত হয়ে গেছে। মানসিক ওই পরিবর্তনটা খুব স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছিল। এই পুরস্কারটা যেন বসন্তদাকে সেই আগের জায়গায় নিয়ে গেল। আমার কাছে সেটাই সব থেকে বড় পাওনা। আগামীতে আমরা আবার একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ব সেই আশাটা এখন আবার করতে পারছি।
পুরস্কার পেলে নিশ্চয় ভালো লাগবে। কিন্তু সেটার আশায় আমি বসে কখনই বসে থাকবনা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই এমন অনেক পর্বতারোহী আছে যাদের যোগ্যতা অন্যান্য রাজ্যে যারা পুরস্কার পেয়েছে তাদের থেকে অনেক বেশী। কিন্তু তারা পুরস্কার পায়নি। তাই আমিও আশা করিনা। আমার সবচেয়ে যেটা খারাপ লেগেছে যে বসন্তদার পুরস্কারটা নিয়ে আমাদের মিডিয়ার কোন হেলদোল নেই। কাগজে ছবি বেরোল বিরাট কোহলি অর্জুন পুরস্কার নিচ্ছে। অথচ তেনজিং নোরগে পুরস্কারও অর্জুন পুরস্কারের সমমানের। বসন্তদাকেই যখন করেনি, আমি যদি ভবিষ্যতে পাই তাহলে ব্যাপারটা একই হবে। তবে সাধারণ মানুষ খুশি হয়েছেন, আমার এইটাই ভালো লেগেছে। নিজের ক্ষেত্রেও সেই কথাটাই মনে হয়।
♦ বসন্তদা, সেদিন সম্বর্দ্ধনা সভায় সৌরেন ব্যানার্জি আপনার মাউন্টেনিয়ারিং জীবনের প্রথম দিককার কথা বলছিলেন। আপনার এই ভালোবাসার শুরু কীভাবে হল, প্রথমদিককার সেইসব অভিজ্ঞতার কথা একটু শুনব।
বসন্ত - সৌরেন ব্যানার্জির কাছ থেকেই আমি শিখেছি। পুরো ব্যাপারটাই হঠাৎ করেই, আগের থেকে জেনে, পরিকল্পনা করে কিছুই করিনি। অনেকদিন পর্যন্ত মাউন্টেনিয়ারিং বলে যে কোন অ্যাডভেঞ্চার হয়, সেটাই জানতাম না, ট্রেকিং-ও জানতাম না। আমার বাড়ি কৃষ্ণনগর। ছোটবেলায় আধা মফঃস্বল গ্রাম্য পরিবেশে প্রকৃতির মধ্যেই বড় হয়েছি। পুকুর ছিল, নদী ছিল, বদমাইশি ছিল, খেলাধুলোও ছিল। একটু বড় হয়ে বুঝলাম যে এবার চাকরি পেতে হবে তখন চাকরির জন্য চেষ্টা করলাম। তারপর চাকরিও পেয়ে গেলাম। প্রথমে সেন্ট্রাল গভর্মেন্টে, তারপরে ব্যাঙ্কে। ব্যাঙ্কে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে চাকরি পাবার পর মনে হল এদিকে এর বেশি কিছু আমি করতে পারব না, ব্যস, এটাই যথেষ্ট। বেড়াতে খুব ভালোবাসতাম। তখন বেড়াতে শুরু করলাম। হয়তো অফিসের লোকজনের সঙ্গে গেছি বা বন্ধুদের নিয়ে গেছি। সেইসময় ভালো ক্যামেরা পাওয়া একটা অসুবিধা ছিল – এখানে পাওয়া যেত না, দামও ছিল। যাইহোক, একটা ক্যামেরা কিনলাম – পেনট্যাক্স টু থাউজেন্ড। তখন কৃষ্ণনগরে সবে 'ম্যাক' হয়েছে। যার সঙ্গে গিয়ে ক্যামেরা কিনলাম সেই আমাকে বলল যে তুমি ওদের সঙ্গে যোগ দাও, বিভিন্ন অভিযানে যেতে পারবে, ছবি তোলার অনেক সুযোগও পাবে। ভাবলাম ভালোইতো, কৃষ্ণনগরের একটা ক্লাব, একটা কোর্স করব, অর্গানাইজারদের দু-এক জনকে চিনিও। আমি আসব শুনে তারা খুব খুশিও হল। সেটা ছিল ওদের দ্বিতীয় কোর্স – শুশুনিয়াতে পাঁচ দিনের রক ক্লাইম্বিং। তখন আমার বয়স সাতাশ বছর। সেই বয়সে পাঁচ দিন একটা ডিসিপ্লিন্ড লাইফ, তাঁবুতে থাকা, তার ওপরে পাহাড়ে চড়া – সবমিলিয়ে দারুণ রোমাঞ্চকর একটা অভিজ্ঞতা। ভালোবেসে ফেললাম রক ক্লাইম্বিং। অর্গানাইজেশনের সাথেও যুক্ত হয়ে গেলাম। ওরাও বুঝতে পারল যে এ একজন ভালো ক্লাইম্বার হতে পারে। সৌরেনদাও দেখল। তারপর নিয়মিত ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং শুরু হল। ট্রেনিং-ও নিলাম উত্তরকাশী থেকে। বেসিক আর অ্যাডভান্স দুটো কোর্সেই খুব ভালো গ্রেড পেলাম। সেখানে থেরু নামের একটা পিক ক্লাইম্ব করলাম। সেটা নব্বই সাল। ওই বছরই সৌরেন ব্যানার্জির নেতৃত্বে আমরা প্রথম অভিযানে গেলাম। গ্যাংস্ট্যাং পিক। আমি একাই ক্লাইম্ব করলাম। একানব্বই থেকে আমিই দলের লিডার হলাম। প্রথমে যেগুলো টেকনিকালি একটু কম কঠিন সেই শৃঙ্গগুলো যেতাম। ছিয়ানব্বই-এ কামেট গেলাম। ভারতের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ। সেবারে হয়নি। পরেরবছর আবার গেলাম। সেবারে দেবাশিসকেও সঙ্গে পেলাম। আমি আর দেবাশিস ক্লাইম্ব করলাম। তারপরে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। যে পিকটাই কঠিন মনে হয়েছে, অন্য ক্লাবগুলো ক্লাইম্ব করতে পারছে না, আমরা গেছি, ক্লাইম্ব করেছি।
♦ দেবাশিসদা, বসন্তদার সঙ্গে আপনার কবে প্রথম আলাপ হয়?
দেবাশিস –১৯৯৪ সালে যখন ম্যাক-এ প্রথম মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করতে আসি তখনই বসন্তদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। বসন্তদা ট্রেনার আর আমি ট্রেনি। এরপর অনেক অভিযানেই বসন্তদা আর আমি সামিট টিম হিসেবে ছিলাম। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণাতো আছেই, তার বহু আগে থেকেই আমরা একসঙ্গে অভিযানে যাচ্ছি। আমরা প্রথম একসঙ্গে যাই ভারতের তৃতীয় উচ্চতম পিক কামেট-এ। এরচেয়ে যে দুটো উঁচু – কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নন্দাদেবী, সেগুলোয় কিন্তু ভারতের দিক থেকে সামিটের অনুমতি দেওয়া হয়না। সেদিক থেকে এটাই সর্ব্বোচ্চ পিক যেটা ভারত থেকে ওঠা যায়। সেই সামিটের পর থেকে আমরা একটা জুটিই হয়ে গেলাম।
♦ বসন্তদা, মাউন্ট শিবা, ইন্দ্রাসন আর থলয়সাগর – ভারতীয় পর্বতারোহী হিসেবে তিনটি পিকই আপনি প্রথম ক্লাইম্ব করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির কথা আমরা শুনব।
বসন্ত - প্রথম করেছিলাম মাউন্ট শিবা – ২০০২-এ। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আটটা অভিযান হয়েছে, কিন্তু কেউ পারেনি। একেকটা টিম দুবার-তিনবার করেও গেছে। পিকটা খুব বেশি উঁচু কিন্তু নয়। তার আগে জুনকো তাওয়াই ক্লাইম্ব করেছিল ১৯৮৮ সালে – প্রথম যে মহিলা এভারেস্ট ক্লাইম্ব করেছিলেন। তারপরে আমি আর দেবাশিস ক্লাইম্ব করলাম। এর পরে আবার অনেকেই করেছে। গিয়ে দেখলাম তেমন কিছু কঠিন নয়, শুধু সাহস করে ঠিক রাস্তাটা খুঁজে বার করতে হবে। এরপরে ইন্দ্রাসন বলে একটা পিক, সেটাও ভারতে আমরাই প্রথম করি। ২০০৩-এ গিয়েছিলাম। সেবারে ৬০০ মিটার নীচ থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপরে ২০০৪-এ আমি একাই ক্লাইম্ব করি। আরেকটা হল থলয়সাগর। নিরানব্বই সালে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম। ওর ঠিক পাশেই ভৃগুবন বলে আরেকটা পিক ক্লাইম্ব করছিলাম। তখন ওটা নিয়ে আমাদের এত ভীতি ছিল যে ক্লাইম্ব করার কথা ভাবিইনি। সে বছর একটি বিদেশী দল ওটা ক্লাইম্ব করেছিল। ২০০৫ সালে যখন শিবলিঙ্গ ক্লাইম্ব করলাম, তখন একটা সম্বর্ধনা সভায় আমার সিনিয়র একজন বললেন, বসন্ত থলয় সাগর কর। সেই মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। ২০০৬-৭-এ হয়নি। ইতিমধ্যে মাওয়ালি বলে একটা পিক ক্লাইম্ব করলাম। সেবারে দেবাশিস নেতৃত্বে ছিল। তারপরে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে রুবলকাং বলে একটা পিক করলাম। ২০০৮-এ থলয়সাগর। আমার নিজের কাছে বেস্ট স্যাটিসফ্যাকটারি ক্লাইম্ব সেটাই। এই পিকটায় প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমাদের আগে পঁচাত্তরবার অভিযান হয়েছে। যারমধ্যে মাত্র পনেরবার ক্লাইম্ব হয়েছে। বিদেশিদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় একটা পিক। এমনকী ভারতের কঠিন পিকগুলোয় আর্মি, আই টি ভি পি, বি এস এফ থেকে ক্লাইম্ব করে, তারাও সাহস করেনি এটা করতে। এন আই এম টি করেনি, এইচ এম আই করেনি। আমি ২০০৮-এ করলাম। এটা নিয়ে একটা মজার কথা বলি, নিম্পট ওই শেরপাদের নিয়েই ২০১০-এ ক্লাইম্ব করে বলল যে ওরাই প্রথম ক্লাইম্ব করেছে (হাসি)। এদিকে ওদের পত্রিকাতেই কিন্তু আমার থলয় সাগর নিয়ে লেখা বেরিয়েছে। এখন কেউ যদি দাবি করে যে তারাই এভারেস্ট প্রথম ক্লাইম্ব করেছে তাতেতো কিছু করার নেই, কেউতো আর আইন-আদালত করতে যাবেনা। তবে আই ভি পি-র কাছে কিছু বলেনি, সেখানেতো রেকর্ডই রয়েছে।
♦ দীর্ঘ চব্বিশ-পঁচিশ বছর ধরে একের পর এক পাহাড়চূড়ায় উঠেছেন। বিশেষ কোন মুহূর্তের কথা কি এখন মনে পড়ছে?
বসন্ত -বিশেষ মুহূর্ত বলতে এভারেস্টের মাথায় যখন উঠেছি। সেটা যেন একটা চরম প্রাপ্তি। আমি আজকে তেনজিং নোরগে পুরস্কার পেয়েছি, সেটা খুব ভালো লেগেছে, প্রচণ্ডই খুশি হয়েছি। কিন্তু এভারেস্টের মাথায় উঠে যে স্যাটিসফেকশন হয়েছে, তার সঙ্গে আর কিছুরই তুলনা হয় না, সেটা একেবারেই আলাদা। এত চেয়েছি যে এভারেস্ট ক্লাইম্ব করব, এদিকে বয়সও বাড়ছিল। আমি ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে এভারেস্ট ক্লাইম্ব করেছি। ক'দিন আগে আমার স্ত্রী বললেন, আমরা যখন ২০০১ সালে বেনারস গিয়েছিলাম, তখন আমি গঙ্গায় প্রদীপ ভাসিয়েছিলাম তুমি যাতে এভারেস্ট ক্লাইম্ব করতে পার এই প্রার্থনা করে। আমি হয়ত মুখে কিছু বলিনি, কিন্তু সেও বুঝতে পেরেছিল যে আমি এত চাইছি । নিরানব্বই সালে একটা টিম তৈরি হয়েছিল এভারেস্ট অভিযানের। সেখানে সিলেকশনের জন্য আমায় রেখেছিল বলে খুব খুশি হয়েছিলাম। শেষপর্যন্ত ওরা দুজন সদস্যের একটা টিম নিয়ে ২০০১ সালে বেরোয়। সেই দুজনের থেকে আমি বেশি যোগ্য ছিলাম, কিন্তু আমাকে ওরা নেয়নি। সেবারে প্রচণ্ড দুঃখ পেয়েছিলাম, সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ওরা খুব বেশিদূর উঠতেও পারেনি, সেটা অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম। ২০১০-এ এভারেস্ট ক্লাইম্ব করে ফিরে আসার পর ওদের দলটির যে লিডার ছিল সে এসে আমায় কনগ্রাচুলেশন জানিয়ে বলেছিল, বসন্ত আমি আজকে স্বীকার করছি সেদিন ভুল করেছিলাম।
♦ বসন্তদা, দেবাশিসদা আপনারা দুজনে একসঙ্গে অনেকদিন ধরে অভিযানে যাচ্ছেন, একটার পর একটা সামিট করছেন। একটা দারুণ জুটিই বলা যায়। দুজনে মিলে একসাথে জীবনের পথে চলাই হোক আর পাহাড়ের পথে, বোঝাপড়াটাই একটা বড় ব্যাপার। অনেক সময়তো মতের অমিলও হয়। নিজেদের মধ্যে এই বোঝাপড়াটা কেমন ভাবে ধরে রেখেছেন?
বসন্ত - দেবাশিস আর আমিতো অনেকদিন একসঙ্গে অভিযান করছি। সেদিক দিয়ে দলের অন্যান্যদের চেয়ে ওর ক্ষমতা অনেকটাই বেশি। খুব ভালো ক্লাইম্বার, অল্টিচুডে খুব ভালো ফিট। ওর অন্য নানান গুণ আছে – ভালো ছবি তোলে, গান গায়। আর সব মিলিয়ে খুব ভালো ছেলে। ওর যেটা অসুবিধা যে দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকার জন্য অনেকসময় ছুটি পায় না বলে যেতে পারেনা, বা নেতৃত্ব দেওয়ার ততটা সুযোগ পায়নি।
একসঙ্গে যখন গেছি কখনও মনোমালিন্যতো হয়েইছে, সেতো স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকলেও ঝামেলা হয়। আমি হয়তো বকেছি, কিন্তু ও কখনও মুখের ওপর কোন কথা বলেনি। আমি একটু বকাবকি করি। আজকে ম্যাক এই জায়গায় দাঁড়িয়েছে, সেটা অনেকটাই আমার এই কড়া মনোভাবের জন্যই।
দেবাশিস - আমি আসলে খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। সমস্ত দিকেই খুব কম্প্রোমাইজ করতে পারি। তুমি বললে না জীবনের ক্ষেত্রে – আমার বউয়ের সঙ্গেও বোধহয় গত বারো-তেরো বছরে কোন ঝগড়া হয়নি। মন কষাকষি হলে অন্যজনের নিশ্চয় খারাপতো লাগেই, কিন্তু আমার নিজেরওতো মানসিক অশান্তি হয়। কেন শুধু শুধু নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করব? আমার সঙ্গে সকলের খুব ভালো সম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে বসন্তদার এমন কিছু কখনও হয়নি যাতে এই সুন্দর সম্পর্কটায় ছেদ পড়তে পারে। আসলে বসন্তদা কেন, যেই হোতনা কেন আমার সঙ্গে কোন অসুবিধা হোত না। আমি সবার সঙ্গে খুব মিলে চলতে পারি। আমার কোনদিনই কারোর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক হয়নি, তাই বসন্তদার সঙ্গেও হবেনা এটাইতো স্বাভাবিক। তাছাড়া বসন্তদাও মানুষ হিসেবে খুব খারাপ না আর আমি মানুষ হিসেবে খুব ভালো (হাসি)।
♦ বসন্তদা, পর্বতারোহীদের মধ্যে অনেক সময় নাম, খ্যাতি, আগে ওঠার চেষ্টা এসব নিয়ে রেষারেষি হয়। তেমন কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে কখনও?
বসন্ত - একটা স্বাভাবিক কম্পিটিশনতো যেকোন ক্ষেত্রেই থাকে। আমার আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অতনু চ্যাটার্জি বলে একজন চারবার এভারেস্ট অভিযানে গেছে। ভদ্রলোক মোটামুটি আমারই বয়সী। ২০০৩ সালে এইচ.এম.আই.-এর সঙ্গে চতুর্থবার অভিযানে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। তখন জানতে পারি যে আবার এভারেস্ট অভিযানে যাচ্ছে। শুনে ভীষণ একটা কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু ঈর্ষা হয়নি। এভারেস্ট অভিযানের আগে তার বাড়িতে গিয়ে আমি অভিযানের খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছি। এই শ্রদ্ধাটা কিন্তু সবসময় কাজ করেছে যে ও একজন ভালো ক্লাইম্বার।
তবে মানুষের কাছে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেতে গেলে শুধু ভালো ক্লাইম্বার হলেই হয়না, ভালো মানুষ হতে হবে। আমি নিজে এটা মেনে চলি। কিন্তু আমার সমসাময়িক বা সিনিয়র অনেকেই আমাকে লেগপুল করেছে, বিভিন্নসময় বদনাম করেছে। আমি শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। আমি পিক ক্লাইম্ব করে এসেছি, মন্তব্য করল, ওর ছবি ভালো হয়নি। ছবিতো সবসময় ভালো হয়না। আমিতো সবাইকে ছবি দেখাতে যাচ্ছিনা। আমার যে অথরিটি ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশন আমি সেখানে জমা দিই। তারা আমাকে স্বীকৃতি দেয় যে ক্লাইম্ব হয়েছে। সেখান থেকে কখনও জিজ্ঞাসাবাচক একটা চিঠিও পাইনি। অথচ এখানে অনেকেই খুব বিশ্রীভাবে সমালোচনা করেছে – ও তো গেলেই ক্লাইম্ব হয়ে যায়। থলয় সাগর গিয়েছি, তখন আবার মন্তব্য করেছে, গিয়েছেতো ভালো, কতজন ফিরবে! কারোর এমন সাহস হয় নি যে ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনকে একটা চিঠি দিয়ে বলে যে ওর এই ক্লাইম্বটা হয় নি, অথচ পিছনে প্রচুর বলে যাচ্ছে। তবে এদের সংখ্যাটা অবশ্যই অনেক কম। আমার প্রচুর শুভানুধ্যায়ী, তারা আমাকে ভালোবাসে, আমার কাজটাকে সম্মান আর স্বীকৃতি দেয়।
♦ সামিট করেছেন এমন কোন শৃঙ্গ দ্বিতীয়বার আরোহণের সুযোগ পেলে কোথায় যাবেন, এভারেস্ট?
বসন্ত - দ্বিতীয়বার কোন পিকেই যেতে আমার ঠিক ইচ্ছা করে না। জানা জিনিস তো। তবে যেমন এভারেস্টে সাউথ দিয়ে গিয়েছি, যদি নর্থ দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাই অবশ্যই যাব। অর্থাৎ অন্য রুটে যাওয়ার সুযোগ পেলে নিশ্চয় যাব।
♦ পর্বতারোহণের বাইরে অন্য কোথাও বেড়াতে গেছেন? সেসব অভিজ্ঞতা কেমন লেগেছে?
বসন্ত - পর্বতারোহণের বাইরেও আমি প্রচুর বেড়িয়েছি। অজন্তা-ইলোরা-পুণে হয়ে বম্বে, এছাড়াও বম্বেতে আরও বেশ কয়েকবার গেছি। বেনারস, সারনাথ। আরাকু ভ্যালি, পুরী, উত্তরবঙ্গ, কাজিরাঙ্গা, শিলং, আসাম। এগুলো বেশিরভাগই গেছি ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে। সবাই মিলে খুব আনন্দ করেছি।
♦ ২০১০ সালে আপনার ও দেবাশিসদার এভারেস্ট জয়ের পর থেকে দুই বাংলার পর্বতারোহীরাই এভারেস্ট এবং অন্যান্য ৮০০০ মিটারের ওপরের শৃঙ্গগুলি একের পর এক জয় করছে। বাঙালি অভিযাত্রীর এই বদলে যাওয়াটা কি আপনাদের জন্যই সম্ভব হল? কি মনে হয়?
বসন্ত - আসলে আমরা যাওয়ার পর একটা ধারণা হয়েছে যে টাকাটা যোগাড় করা যেতে পারে। তারপরে আমরা যেমন বলে দিয়েছি কীভাবে কী করতে হবে। কিছুই না জানার জন্য অ্যারেঞ্জমেন্টের অনেককিছুই আমাদের খুব কঠিন বলে মনে হয়েছিল, আসলে কিন্তু তা নয়। এখন যারা যাচ্ছে তারা জানে আমাকে ঐসব নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। শুধু টাকাটা যোগাড় করতে হবে, আর ক্লাইম্ব করতে হবে। আমরা তখন কে পারমিশন দেবে, এত টাকার ব্যাপার বিশ্বাস করে কোন এজেন্সির মাধ্যমে যাব, কোথায় ইকুইপমেন্ট, অক্সিজেন এসব পাওয়া যাবে এসব কিছু জানতামনা বলেই ভয় পেতাম। আমার শেরপা পেম্বা লোবেন এজেন্সির কথা বলেছিল। অনেক যাচাই করে তারপরে ওদের সঙ্গে চুক্তি করি। তারপর থেকে সবাইতো ওদের মাধ্যমেই যাচ্ছে। আমার পরেই দীপঙ্কররা গেছে। ওদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। তারপরে সেইসূত্রেই আবার অন্যান্যরাও যাচ্ছে। আসলে আমরা কিছু লুকাইনিতো। আমাদের আগে যেমন অনেকেই কিছু তথ্য ঠিক পরিষ্কার করে বলেনি। সেইজন্যেই আমাদের পরেই পরপর ক্লাইম্ব হচ্ছে।
♦ দীর্ঘদিন ধরে ওতপ্রোতভাবে পাহাড়ে চড়ার এই নেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে আগামীদিনের পর্বতারোহীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
বসন্ত - দেখ, আমরাতো কোন প্রচারের জন্য আসিনি, ভালোবেসে এটা করেছি। রোজকার জীবনের বাইরে কিছুদিন অন্য পরিবেশে অন্যভাবে কাটানো। ট্রেকিং যে কেউ করতেই পারে। তবে আজকের যা ফাস্ট লাইফ তাতে আমাদের মতো অনেকদিন ধরে পর্বতারোহণ করা একটু শক্ত, অত সময় দিতে পারবে না। ছোটখাটো পর্বতারোহণ দিয়ে শুরু করতে পারে। ভারতেই অনেক ছোট ছোট পিক আছে, যেগুলো এখনও কেউ ক্লাইম্ব করেনি। সেগুলো করতে পারলেতো ভালো লাগবে। আমি নিজেও ছোট ছোট দিয়ে শুরু করে এই জায়গায় পৌঁছেছি। এর একটা অন্য স্যাটিসফেকশন আছে। আজ যে বিপদের মধ্যে পড়েও বেঁচে ফিরে আসলাম তার কারণ কিন্তু এতদিনের এই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা। আর প্রথমেই যদি এভারেস্টে চলে যায় তাহলেতো জীবনে আর কোন স্বপ্নই থাকবে না। কিন্তু এখনতো প্রচারের যুগ। আমার, দেবাশিসের বা দীপঙ্করের মতো কয়েকজনের যে অভিজ্ঞতা আছে, সেই অভিজ্ঞতা বা অধ্যবসায় কিন্তু তুমি এখন দেখতে পাবে না। দু-একটা ক্লাইম্ব করার পরই এভারেস্টে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে একটা সময় এসে হতাশা এসে যাবে। আসলে আমাদের সাফল্যের পর এই যে একটা প্রচারের আলোয় আমরা এসেছি সেটা অনেককে আকর্ষণ করছে। কিন্তু তার পিছনে যে একটা দীর্ঘ লড়াই রয়েছে সেটা চোখে পড়ছে না।
♦ এর পরে কোথায় যাওয়ার কথা ভাবছেন?
বসন্ত - নেক্সট প্ল্যান হচ্ছে ধৌলাগিরিতে অনেক টাকা ধার হয়েছে সেটা শোধ করা, তারপরে অন্যকিছু ভাবতে পারব।
সাক্ষাৎকার – দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ পর্বতারোহণের আরো ছবি - বসন্ত সিংহরায় || দেবাশিস বিশ্বাস ~