আকাশ আমায় ভরল আলোয়

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

~ কুম্ভমেলার আরো ছবি ~

'আপনিতো অনেকদিন ধরেই কুম্ভে যাচ্ছেন, কখনও বড় কোন মহাত্মার দর্শন পেয়েছেন কি? অলৌকিক কোন ঘটনা ঘটতে দেখেছেন?' - প্রশ্নটা করেছিলাম ভাস্কর মহারাজকে।
এলাহাবাদে মহাকুম্ভে যাওয়ার পরিকল্পনা মাথায় আসতেই থাকবার ব্যবস্থার জন্য বর্ধমানের ছোটনীলপুরের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে হাজির হয়েছি। ভাস্কর মহারাজই কুম্ভমেলার সময় প্রয়াগে আশ্রমের দায়িত্বে থাকেন। পড়ে গিয়ে চোট পাওয়ায় মহারাজ তখন ছোটনীলপুরের আশ্রমেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেখা করার উদ্দেশ্য জেনে মহারাজ আশ্বস্ত করলেন যে আমাদের জন্য জায়গা রাখা থাকবে, তবে কত জন যাচ্ছি বা কত তারিখে পৌঁছাব এইসব সংবাদ যেন লিখিতভাবে ওনাকে দু'এক দিনের মধ্যে জানিয়ে দিই। প্রয়াগের কুম্ভমেলা সম্পর্কে নানা প্রয়োজনীয় তথ্য ওনার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছিলাম। শুনছিলাম নানান গল্পও। মহারাজ বলছিলেন এই সময়ে অনেক সাধক চলে আসেন স্নান করতে, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভীড়ে তাঁদের আর কেউ আলাদা করে চিনে নিতে পারেন না। সেই প্রসঙ্গেই প্রশ্নটা হঠাৎ করে মাথায় এল।
উত্তরটা শুনে কিন্তু একটু নড়েচড়েই বসলাম। মহারাজ বললেন, একবার কুম্ভের সময় হরিদ্বারের হর কি পউরি ঘাটে সন্ধ্যার সময় বসে আছেন। আশে পাশে লোকজন কেউ নেই। অন্ধকার হয়ে আসছে। এমন সময় একজন সাধু এসে বসলেন। তারপর হঠাৎই মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুই অ্যাতোদিন যা করেছিস হঠাৎ সেটা ছেড়ে দিলি কেন? ভাল কাজই তো করছিলি।' মহারাজ সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলেন এই সাধু ওনাকে কী ইঙ্গিত করছেন।সাধুটি তাঁকে দু'এক দিন পর একটি বিশেষ দিনে একইসময়ে একই জায়গায় আসতে বললেন। মহারাজ নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে ঘাটে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই দেখলেন সেই সাধুটি এসে হাজির হয়েছেন, হাতে করে এনেছেন একটি সেতার। মহারাজকে উনি বললেন, 'নে, এটা বাজা।' মহারাজ দীর্ঘদিন সেতার বাজাননি। তবে সেতার হাতে নিয়ে কেমন যেন মনে হল, আত্মস্থ হয়ে গেলেন। উনি বাজাতে শুরু করলেন। তবে কী যে বাজালেন বা কতক্ষণই বাজালেন সেটা ওনার আর কিছুই মনে নেই। সময়টা কেটেছিল একটা ঘোরের মধ্যে। বাজানো শেষ হলে সাধুটি সেতার নিয়ে যেমন এসেছিলেন তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মহারাজের কাছ থেকে ফেরার পথে বারেবারে মনে হচ্ছিল যদি কুম্ভে গিয়ে এমন কোন মহাত্মার দেখা পাই, আবার এও মনে হল কোন মহাত্মা আমাকেই বা দেখা দেবেন কেন, আমার কীইবা যোগ্যতা আছে? কুম্ভের দিকে মনটাতো টানছিলই, এই কাহিনি মনে একটা অন্য আকর্ষণ রচনা করল যেন। কুম্ভ যাওয়ার সবরকম প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। ইন্টারনেট, বই আর পরিচিত মানুষজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ যার একটা বড় ধাপ। ভদ্রেশ্বরের 'ভ্রমণ আড্ডা'-র আসরেও অনেক প্রয়োজনীয় কথা জানতে পারলাম। হরিদ্বার, প্রয়াগ, নাসিক এবং উজ্জ্বয়িনী এই চারজায়গায় কুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বারো বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ অনুষ্ঠিত হয়। আর তার মাঝে প্রতি তিন বছরে অর্দ্ধকুম্ভ। সেই অর্থে হরিদ্বার এবং এলাহাবাদে (প্রয়াগে) কুম্ভ স্নান যোগ ঘটে ছ'বছর অন্তর।

৭ ফেব্রুয়ারি শিপ্রা এক্সপ্রেসের টিকিট কাটলাম। বিধি বাম, আর.এ.সি.-ও জুটলনা, ওয়েটিং লিস্টে আমাদের নাম জ্বলজ্বল করছে। ১০ তারিখ শাহী স্নান। মহারাজ আমাদের আগেই বলে দিয়েছিলেন যে ঐ দিন থাকতে গেলে আমরা যেন দুদিন আগেই পৌঁছাই। আমাকে নিয়ে দলে মোট ন'জন। এরমধ্যে চারজন আমার অপরিচিত। পরিচিত বাকী চারজন হল – অমিয়দা, প্রভাসদা, অমিত আর বাপী। অমিয়দা অর্থাৎ শ্রী অমিয় নিমাই চৌধুরী বর্ধমান রাজকলেজের অধ্যাপক ছিলেন। বছর কয়েক হল চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে উনিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ। যেমন চেহারায় তেমনই কাজকর্মে। ওনার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সহপাঠী প্রভাসদা (প্রভাসকৃষ্ণ সিনহা), কলেজ ছাড়ার পরই ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি করতে শুরু করেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফসল ওষুধ সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য। যে কোন ওষুধের ঠিকুজি কোষ্ঠী গড়গড় করে বলে দেন। তার সঙ্গে রয়েছে অসাধারণ হিউমার বোধ। শ্রীমান অমিত (অমিত ঘোষ), কয়েকটা বছর ওষুধ কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে চট করে মানুষকে বুঝে নিতে পারে আর তিনটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, তাই সে আমাদের অফিসিয়াল মুখপত্র। চাকরি একঘেয়ে লাগছিল বলে শ্রীমান বাপীর (রণজিৎ ঘোষ) সঙ্গে ব্যবসা করতে শুরু করেছে। তবে এই চারজনের একটি ক্ষেত্রে সাদৃশ্য বা কমন ইন্টারেস্ট আছে, তা হল প্রত্যেকেই ক্যামেরা হাতে পাগল অর্থাৎ ফটোগ্রাফার। ক্যামেরা, তার বিভিন্ন মডেল, টেলি বা জুম লেন্স, স্টিল বা মুভি – সব বিষয়েই এরা সকলেই পণ্ডিত। ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াতে এদের কারোর কখনও বিরাগ নেই। আর আমার কাজ হল এদের পিছন পিছন ছোটা।
অমিত আর বাপী শাহী স্নানের সময়টা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছে না। মহারাজের কাছ থেকে জেনেছে ঐ দিন নাগা সন্ন্যাসীরা স্নান করবেন। কুম্ভের পরিবেশে এরকম ফটো তোলবার সুযোগ কি আর কেউ হাতছাড়া করতে চায়? নাগা সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমারও যে কৌতুহল নেই তা অবশ্য নয়। অতএব শুভস্য শীঘ্রম...
যাত্রা শুরুর দুদিন আগে অমিয়দা জানতে পারলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের শিবির শাস্ত্রী ব্রিজের কাছে হয়েছে। তাই আমাদের ট্রেন যদি প্রয়াগ ঘাট রেল স্টেশনে থামে তাহলে খুবই সুবিধা হবে। কিন্তু ট্রেনের টাইমটেবিল ঘেঁটে দেখলাম ওরকম কোন স্টেশনে শিপ্রা এক্সপ্রেস থামে না। এই কথা অমিয়দাকে বলতেই উনি স্তোক বাক্য দিলেন, 'কুম্ভ মেলার সময় নিশ্চয় ট্রেন ওই স্টেশনে থামবে।' মনে মনে ভাবলাম, সেটা হলে তো ভালই হয়, আর ট্রেন যদি সোজা এলাহাবাদ চলে যায়...। আসলে এলাহাবাদ স্টেশন থেকে ৭-৮ কিমি পূর্বে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল। ফলে স্টেশন থেকে আমরা কীভাবে সঙ্গমস্থলে পৌঁছাব সেই সম্বন্ধে কোন ধারণাই কারোর ছিল না। আশা করা হচ্ছিল অটো রিক্সা বা বাস, কিছু না কিছু একটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে। আবার আশঙ্কা হচ্ছিল, যেখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক হাজির হবেন সেক্ষেত্রে যানবাহনের অপ্রতুলতাই স্বাভাবিক। টিভির চ্যানেলগুলিতো বলছে সেদিন আট কোটি লোক হবে!
মুঘলসরাই আসার আগে পর্যন্ত ট্রেন নিজের ছন্দেই ছুটে চলল। মুঘলসরাই আসতেই কুম্ভের প্রকৃত রূপটা খানিক আঁচ পেতে শুরু করলাম – শয়ে শয়ে লোক আমাদের কামরায় উঠে পড়ল। কার্যত আমরা প্রায় বন্দী হয়েই গেলাম। অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাত্যহিক কর্ম্ম করার জন্য বাথরুমে যাবারও উপায় রইল না। এখানে অমিতের জ্বালাময়ী ভাষণও কোন কাজে লাগল না। চারদিকে শুধু মানুষ মাথায় বা কাঁধে মালপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থানীয় দেহাতী মানুষ। তাদের কথাবার্তায় কামরা অল্পক্ষণেই সরগরম হয়ে উঠল। দু’এক জন বৃদ্ধা নীচের বাঙ্কে বা মাটিতে বসে পড়লেও বাকীরা কিন্তু আমাদের জায়গা দখলের কোন চেষ্টাই করেনি। বরং কয়েক ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়েই রইল। বেশ আশ্বর্য হলাম। এলাহাবাদ পৌঁছাতে আরও কয়েক ঘন্টা লাগবে। মুঘলসরাইয়ের পর থেকেই ট্রেনটা লেট করতে শুরু করে দিয়েছে। আপাতত ওপরের বাঙ্কে উঠে ধ্যানস্থ হবার ভান করা ছাড়া সময় কাটাবার আমার অন্য কোন রাস্তা থাকল না। শেষপর্যন্ত প্রয়াগ ঘাট স্টেশনে না থেমে বেশ অনেকটা লেট করে ট্রেন এলাহাবাদে ঢুকল।
এলাহাবাদ স্টেশনে নেমে দেখি শুধুই মানুষ, স্রোতের মত বয়ে চলেছে। আমিও সেই স্রোতে ভেসে চললাম। দলের লোকজনেরা কে কোথায় সেটা বোঝার কোন সুযোগই পেলাম না। জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে এক নম্বর প্লাটফর্মে পৌঁছে একধারে দাঁড়িয়ে চারপাশে চেয়ে আপনজনদের খোঁজ করতে লাগলাম। অবশেষে কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে একটু স্বস্তি হল। ট্রেন দেরী করে পৌঁছনোয় স্টেশনচত্ত্বর থেকেই একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরোব ঠিক হল। একনম্বর প্লাটফর্মেই একটি রেস্তোঁরায় খাওয়া সেরে বেরিয়ে দুটো অটোরিক্সা যোগাড় করতে বাপী আর অমিতের কালঘাম ছুটে গেল। শেষপর্যন্ত যাওবা পাওয়া গেল সাত কিলোমিটার রাস্তার জন্য ভাড়া চাইছে ৭০০ টাকা! অনেক বাদানুবাদের পর ৪০০ টাকায় রফা হল। কিন্তু অটোরিক্সা আমাদের নামিয়ে দিল যেখানটায় সেখান থেকে সেবাশ্রম সংঘের শিবির আরও অন্তত দেড় কিলোমিটার দূরে। ব্যাগপত্র পিঠে নিয়ে হাঁটা শুরু হল। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললাম গন্তব্যের দিকে। মাঝে আধ কিলোমিটার মত একটা ভ্যানরিক্সায় মালপত্র তুলে দিয়ে একটু আরাম পেয়েছিলাম। পুলিশ এসে রিক্সার রাস্তা আটকানোয় আবার মালপত্র পিঠে নিয়ে এগিয়ে চললাম। এই চলার যেন শেষ নেই। সব বয়সী সব ধরণের মানুষই রাস্তায় নেমেছেন। তবে মাঝে মাঝে মোটরগাড়ি যে যাচ্ছে না তা নয়, এদের নিশ্চয় মেলাপ্রাঙ্গণে ঢোকার বিশেষ অনুমতি রয়েছে। শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছে অন্য দলটির সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল, ওরা আমাদের একটু আগেই পৌঁছেছে।
সংঘের শিবিরটি বেশ সুবিধাজনক জায়গায়, শাস্ত্রী ব্রিজের কাছেই। শিবিরে ঢোকার মুখেই বড় গেট। গেটের বাঁ পাশে মাটির মূর্তি – কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুতে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করাচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ। গেট দিয়ে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেই সামনে মন্দির। বাঁ পাশে অস্থায়ী অফিস আর পিছনের দিকে থাকবার জন্য সারি সারি তাঁবু। অফিসটাকে দুটি অংশে ভাগ করে একাংশে দাতব্য চিকিৎসালয় খোলা হয়েছে। অন্যদিকে নাম নথিভূক্তকরণসহ অন্যান্য সেবামূলক কাজ চলছে। চত্ত্বরে প্রবেশ করে মালপত্র রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। অমিত অফিসে গিয়ে কথা বলে থাকবার কী ব্যবস্থা হয়েছে সেটা জেনে এল। অফিসে ভাস্কর মহারাজ একটা চেয়ারে বসেছিলেন, পাশে একটি লাঠি। বুঝলাম উনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি।
প্রাঙ্গণের মাঝখানে অনেকগুলি তাঁবু খাটানো রয়েছে। এগুলিতে অন্যদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক ধারে রান্না এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। পিছনের দিকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত বরাবর ত্রিপল আচ্ছাদিত। আর চট দিয়ে পাশগুলি ঢেকে অনেকগুলি ঘর করা হয়েছে। এই ঘরগুলোর পাশাপাশি দুটিতে আমাদের আশ্রয় জুটেছে। চারপাশ ঢেকে ফেলার জন্য দিনের বেলাতেও যথেষ্ট আলোর অভাব বোধ হচ্ছে। ঘরগুলির এক কোণলে তার থেকে একটা পি.এল. বালব ঝুলছে – সন্ধ্যেবেলায় আলো জ্বলবে, তবে মেয়াদ রাত এগারোটা পর্যন্ত – স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশ্ন করে এই তথ্য জানা গেল। তাঁবুর পাশে দুদিকেই সারি সারি কল, পলিথিন ঘেরা পায়খানা-বাথরুম। সুন্দর ব্যবস্থা, মাথার ওপর উন্মুক্ত আকাশ, এগজস্ট ফ্যানের দরকার নেই।
তাঁবুর মধ্যে নিজেদের খুপরিতে ঢুকে মালপত্র একপাশে রেখে মাঝখানে বসা হল। মাটিতে পাতলা করে খড় বিছানো, তার ওপর তোষক পাতা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেলা পড়ে এলে সকলে মিলে বেরোলাম। রাস্তার ধারে স্থানীয় মানুষেরা মাটির উনুন আর ঘুঁটে বিক্রি করছে। গ্রাম থেকে আসা লোকজন সেই উনুন আর ঘুঁটে কিনে রাস্তার ধারেই সুবিধামত জায়গায় রাতের খাবার বানাতে বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে কোন খাবারের দোকান নেই, তবে রাস্তার ধারে মালা, চুড়ি, টিপ, সিঁদুর, সঙ্গমের জল নিয়ে যাওয়ার জন্য পলিথিনের পাত্র এসব বিক্রি হচ্ছে। শাহী স্নানের এখনও দুদিন বাকী, তাই রাস্তায় হাঁটা যাচ্ছে। গ্রাম থেকে দলবেঁধে যে সব মানুষেরা এসেছেন তাঁরা একে অপরের কাপড় বা লম্বা একটি দড়ি কয়েকজনে মিলে ধরে আছেন। এরা একসঙ্গে থাকতে চাইছে বলে এই জাতীয় দলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ধাক্কা লেগে যাচ্ছে। আসলে কোনকারণে দলছুট হলে জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এরা দলবদ্ধ অবস্থায় থাকতে চায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এইসব মানুষদের পোষাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার সবই আলাদা, অথচ উদ্দেশ্য একটাই। ভারতবর্ষের এই রূপটা যত দেখছি ততই যেন আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।
সঙ্গমস্থলের নদীর চড়ায় সমান্তরালভাবে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি বেশ কয়েকটা রাস্তা সমস্ত অঞ্চলটিকে কয়েকটা জোনে ভাগ করে দিয়েছে। রাস্তার যে অংশ একটু নীচু সেখানে লোহার চওড়া পাত রাখা হয়েছে, নীচ থেকে জল ওঠা বন্ধ করার জন্য এই ব্যবস্থা। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধুসন্ন্যাসী এবং সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই সঙ্গমে স্নান করতে যেতে পারে তারজন্য রাস্তার পাশে বেড়া দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের জন্য অস্থায়ী প্রস্রাবখানা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছেটানো হলেও তার ধারেকাছে যায় কার সাধ্য। দোষ আমাদেরই, আমরাই সঠিকভাবে ব্যবহার করিনা, অপরের কথা একেবারেই ভাবিনা।
চওড়া রাস্তার দুপাশে সাধুদের আখড়া, সর্বক্ষণ মাইক চলছে। যে আখড়ার নাম বেশি তার তাঁবুর আকার-আকৃতিও বড়। মাঝে মাঝে মোটর গাড়ি চেপে দর্শনার্থী/ভক্ত সোজা আখড়ার মধ্যে প্রবেশ করছে। আখড়ার মধ্যে কোথাও নামগান হচ্ছে, কোথাও কোন গুরু ভাষণ দিচ্ছেন। বিস্কুটের কোম্পানি কম দামে ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট বাজারে ছেড়েছে, কোন ভক্ত পেটি পেটি বিস্কুটের প্যাকেট পথচলতি মানুষের মধ্যে বিলি করছেন। এইসব দেখতে দেখতে একটি আখড়ার গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। রাস্তার ধারে ধারে নাগা সন্ন্যাসীদের তাঁবু – বড়, ছোট, মাঝারি। সেইমত চেলাদের সংখ্যাও বেশি-কম। সব জায়গাতেই ধুনি জ্বলছে, ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছে। সাধুবাবাদের অনেকেই বড় গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়েছেন। সেটি একটু একটু করে জ্বলছে। বাবা আদুড় গায়ে ছাই মেখে বসে রয়েছেন। মুখে মৃদু হাসি, অভয় মুদ্রা প্রদর্শন করে রয়েছেন, কেউ কেউ ভক্তকে আশীর্বাদ করছেন। তবে দেশি ভক্তদের চেয়ে বিদেশিনী ভক্তদের কদর বেশি। বাবার পায়ে একশ বা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে প্রণাম করতেই তারা অভ্যস্ত। এক চেলা গুরুর পা টিপে দিচ্ছে। একজন সাধুতো একটি হাত সারাক্ষণ ওপরে তুলে রেখেছেন। এটিই তাঁর সাধন পদ্ধতি। একজন নাগা বাবা কোলের ওপর ল্যাপটপ রেখে মনোযোগ সহকারে কিছু দেখছেন। আমাদের দলে সকলেই ছোট-বড় নানাধরণের ক্যামেরা নিয়ে এসেছে – সবাই ক্যামেরা নিয়ে এইসব নানা কাণ্ডকারখানার ছবি তুলতে ব্যস্ত। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ অনেক আখড়ায় সন্ধ্যারতি শুরু হল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরতি দেখলাম। একজায়গায় সন্ন্যাসীরা আরতি করছিলেন নেচে নেচে। সেখানে লোকের ভিড়ও খুব। একটি আখড়ায় রাস্তার পাশে অস্থায়ী মন্দির তৈরি করা হয়েছে। আরতি দেখতে ভুল করে জুতো পায়েই এগিয়ে গেছি খানিকটা, এক সাধুবাবা আমার পিঠে চাপড় মেরে মনে করিয়ে দিলেন, তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা তিনজন অর্থাৎ অমিয়দা, প্রভাসদা আর আমি ঠিক করলাম শাস্ত্রী ব্রিজে উঠে গঙ্গার ওপাড়ে ঝুসিতে চলে যাব। ব্রিজের ওপর থেকে তাহলে গোটা অঞ্চলটা দেখে নেওয়া যাবে। যদিও আমরা শাস্ত্রী ব্রিজের ঠিক নীচেই আছি, কিন্তু ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশ অনেক রাস্তায় যানবাহন বন্ধ করে রেখেছে। গতকাল বিকেলে যত লোক দেখেছিলাম আজ সকালে তার থেকেও বেশি মানুষের ভিড়। পুলিশেরও বেশ একটা সাজো সাজো রব। ব্রিজের ওপর উঠে কিছুটা এগিয়েছি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথায় কথায় খবর পেলাম নতুন রাষ্ট্রপতি ফাঁসি রদের আবেদন নাকচ করায় গতকাল রাতেই আফজল গুরুর ফাঁসি হয়ে গেছে, তাই চারিদিকে নিরাপত্তার এত কড়াকড়ি।
কুম্ভ মেলার প্রাঙ্গণের হাজার হাজার তাঁবু, তার বিচিত্র গঠন, নানা বর্ণ, ততোধিক বিচিত্র মানুষ দেখতে দেখতে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলেছি আমরা। কোথাও গেরুয়া বস্ত্র পরিহিত সন্ন্যাসীদের জমায়েত, কোথাও লাইন দিয়ে বসিয়ে সকালের জলখাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, বয়স্ক মহিলারা সকালের রোদে পিঠ দিয়ে গল্পে মেতেছেন, কোন মহিলা উনুন ধরিয়েছেন। এইসব টুকরো টুকরো দৃশ্য আজও যেন চোখের সামনে ভাসে। যমুনার ওপর ন'টি অস্থায়ী সেতু তৈরি করা হয়েছে ভাসমান বয়ার সাহায্যে। এগুলির ওপর দিয়ে মানুষ নদী পারাপার করছে। নদী পার হয়ে শাস্ত্রী ব্রিজ থেকে আমরা নেমে পড়লাম, উদ্দেশ্য ফেরার পথে অস্থায়ী সেতু দিয়েই পার হওয়া। যে পথটা ধরলাম সেটা ভারত সেবাশ্রম সংঘের পাশে এসে রাস্তায় মিশেছে। বেশ ক্লান্ত লাগছিল, তাঁবুতে ফিরে আরাম লাগল।
আমাদের দলের নবীন সদস্যেরা স্নানের সময় সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তারা জানিয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে একাধিকবার স্নান করলে কোন দোষ নেই, তাই স্নান যোগের শুরু আর শেষ এই দুই লগ্নেই জলে নামা হবে ঠিক হল। এই বিশেষ যোগে সারা দেশের সাধু-সন্ন্যাসীরা যদি সঙ্গমের জলে ডুব দিতে পারেন, তাহলে আমরাই বা সে পুণ্যের ছিটেফোঁটা থাকে বঞ্চিত হই কেন? তরুণ সঙ্গীরা আমাদের ভরসাও দিয়েছে যে হাত ধরে ধরে স্নানে নিয়ে যাবে। তাহলে আর চিন্তা কী? আমরা তিনজন বয়স্ক আর দুজন অল্পবয়সী জোট বাঁধলাম শাহী স্নানের জন্য।
ভারত সেবাশ্রম সংঘের তাঁবু থেকে সঙ্গম ক্ষেত্র অনেকটা দূরে, তাই সময়টা আন্দাজ করে বেরিয়ে পড়লাম। লজ্জা নিবারণের বস্ত্র ছাড়া পরিধেয় আর সবই বর্জন করা হল। শুকনো জামাকাপড়, গামছা আর কুম্ভের জল নেওয়ার বোতল সঙ্গে নেওয়া হল। যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে একসময় সঙ্গমস্থলে পৌঁছালাম। লোকে লোকারণ্য। তারমধ্যে সামান্য একটু জায়গা করে পলিথিন শিট বিছিয়ে জামাকাপড় রাখা হল আর শিটের তলায় পাদুকা। ঠিক হল প্রথমে তিনজন স্নান করে আসবে, তারপর দুজন। আমি দ্বিতীয় দলে স্থান পেলাম। আপাতত তাই কাজ পাহারা দেওয়া। প্রথম দলটি ফিরলে আমরা দুজন এগোলাম। অগুনতি মানুষের মাঝে ফাঁকফোকর দিয়ে স্নানের জায়গায় পৌঁছতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। বিশাল সঙ্গমক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্রে স্নান করছেন। নদীর পাড় থেকে সামান্য দূরে অগভীর জলে বাঁশের বেড়া দেওয়া আছে, যাতে স্নানার্থীরা জলে না ভেসে যায়। তাছাড়া বেড়ার ওধারে নৌকাতে অনেক পুলিশ রয়েছে স্নানার্থীদের সাহায্যের জন্য।
অগণিত মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে একসঙ্গে স্নান করছে, এটাই অবাক হয়ে দেখার। কালকূটের মত আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়নি সঙ্গমে এসে। কোন বৃদ্ধ আমাকে অবলম্বন করে স্নান করেনি বা পাঞ্জাবী মহিলাদের অনাবৃত অবস্থায় স্নান আমাকে দেখতে হয়নি। শোনা হয়নি কোন যুবতী বিধবা শিবপিয়ানীর দুঃখের কাহিনি। দেখা হয়নি মুন্ডিতমস্তক খনপিসিকে, কিম্বা চিনতে পারিনি কোন সর্বনাশীকে। দোষটা সম্পূর্ণ আমার। আমার চারপাশে অগুনতি মানুষের ভীড়ে অর্ধশতাব্দী আগে কালকূটের দেখা সব চরিত্র আজও রয়েছে। তাদের চিনতে পারার দায় আমার। সে চোখ থাকলে তবেই চোখে পড়বে। তাই অভিজ্ঞতার ঝুলি আমার হয়তো শূণ্যই রয়ে গেল।
স্নান সেরে বোতলে সঙ্গমের জল নিয়ে উঠে আসার পর দেখি চারদিক একইরকম লাগছে। যেখানে জামাকাপড় রাখা আছে আর অমিয়দা-প্রভাসদা দাঁড়িয়ে আছে সেসব কিচ্ছু চোখে পড়ছেনা। চারপাশে অচেনা মানুষের ভিড়ে স্থান-কাল-পাত্র সব একাকার হয়ে গেছে। সদ্য স্নাত দুজনে একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে লাগলাম। মনে মনে ভাবলাম এভাবে আদুড় গায়ে হাফপ্যান্ট পড়েই বোধহয় ফিরতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার সঙ্গী বাকিদের খুঁজে পেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
শেষবিকেলে আবার রাস্তায় বেরোলাম। ভারত সেবাশ্রম সংঘের শিবিরের সামনে, রাস্তার পাশে যেখানে যেটুকু জায়গা ছিল সবটাই দেহাতী গ্রাম্য মানুষদের ভিড়ে ভরে উঠেছে। পরিবারের মহিলারা রাতের খাবার তৈরি করছেন, বাকিরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে ব্যস্ত। আশ্রয় বলতে মাটিতে একটি পলিথিন শিট বা খালি বস্তা পাতা হয়েছে। আর গায়ে দেবার জন্য একটি চাদর। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিকটায় এলাহাবাদে রাতের দিকে যথেষ্টই ঠান্ডা পড়ে। আমাদের মত শহুরে মানুষদের সঙ্গে রয়েছে কয়েকপ্রস্থ শীতবস্ত্র। তফাত এতোটাই। সঙ্গমে স্নানের জন্যে আসা সারা ভারতবর্ষের অগুনতি মানুষ রাস্তার ওপর কুঁকড়ে শুয়ে রাত কাটায় শুধুমাত্র একটি চাদর গায়ে দিয়ে। আর খাবার বলতে – আগুনে পোড়ানো ময়দার ডেলা। এই সব দেখতে দেখতে পথ চলছিলাম। ভাবছিলাম, ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ কত অল্পেই সন্তুষ্ট। কোথাও চোখে পড়েনি কোন মানুষকে বাকবিতন্ডা করতে বা উষ্মা প্রকাশ করতে। অথচ ভারত সেবাশ্রম সংঘের তাঁবুতে আশ্রয় পাওয়া বাঙালি ভদ্রলোকেরা কেউ কেউ রীতিমতো ক্ষুব্ধ আশ্রয় বা খাবারের জন্য। তাঁরা বোধহয় একবারও ভেবে দেখছেননা সর্বত্যাগী এই সন্ন্যাসীরা কী সেবামূলক কাজই না করে চলেছেন সর্ব্বক্ষণ।
রাস্তায় চলতে চলতে কত কিছুই না চোখে পড়ছে। যুবক পুত্র মাকে সঙ্গমে স্নান করাতে নিয়ে এসেছে। ভিড় রাস্তায় আগলে চলেছে মাকে। গ্রাম থেকে দল বেঁধে বয়স্করা এসেছে কুম্ভস্নানে, সঙ্গে দু'একজন কমবয়সী পুরুষ। একে অপরের কাপড়ের খুঁট ধরে রয়েছে যাতে হারিয়ে না যায়। কালকূটের দেখা বিকলাঙ্গ বলরামও রয়েছে, তবে আজ তার আশ্রয় হুইলচেয়ার। রাস্তার পাশে ছোটবড় পুঁতির মালা, হার নিয়ে দেহাতীরা বসে আছে খরিদ্দারের আশায়। এদের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ল অল্পবয়সী সুন্দর মুখ - সিঁথিতে হালকা সিঁদুর আর সলজ্জ হাসিতে চোখে পড়ে দাঁতে কালো ছোপ - ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করি।
দিনের আলো নিভে গিয়ে চারদিকে বিজলি বাতি জ্বলে উঠে মেলাপ্রাঙ্গণকে মোহময় করে তুলেছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে অনেকটা পিছনে চলে এসেছি – উদ্দেশ্য রাতের প্রয়াগ দেখা। উঁচু পাড়, এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাওয়াও গেল একটা বেশ জুতসই জায়গা – ছোট একটি মন্দির সংলগ্ন বাড়ির ছাদে উঠে দুচোখ ভরে দেখলাম আলোকিত প্রয়াগ। আলোর মালা দিয়ে যেন সারাটা প্রাঙ্গণ সাজানো। তবে লক্ষ-কোটি লোকের পায়ের ধুলোয় সাদা হয়ে গেছে। ঢেকে দিয়েছে আলোর মালাকেও।
দশই ফেব্রুয়ারি। সকালে তাড়াতাড়িই তৈরি হয়ে বেরোলাম নাগা সন্ন্যাসীদের দর্শন করার জন্য। কাছেই জিলিপি ভাজে, গতকালই সন্ধান পেয়েছি। মনের আনন্দে জিলিপি দিয়ে পেট ভরিয়ে পথে নামলাম। কিছুটা এসে বাধা পড়ল, পুলিশ রাস্তা আটকেছে। সামনের রাস্তা ধরে বিভিন্ন মঠের সন্ন্যাসীরা ফিরছেন শাহী স্নান সেরে। মোটর গাড়ি, লরি সব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। ওপরে সিংহাসনে উজ্জ্বল পোষাকে আর ফুলের মালা গলায় আশ্রমের মহান্ত-মহারাজেরা বসে রাস্তার দুপাশের দর্শনার্থী-ভক্তদের আশীর্বাদ বিতরণ করছেন। হঠাৎ মাইকের আওয়াজে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড় হল – তাকিয়ে দেখি সেই উচ্চস্বরের গানের সঙ্গে এক সন্ন্যাসিনী সিংহাসনের ওপর বসে বসেই যেন নাচছেন – হাঁ করে তাকিয়ে দেখার মতই ঘটনা বটে।
মুহূর্তে আবার সচকিত হয়ে উঠি 'হঠ্ হঠ্' শব্দে। জনগণ রাস্তা থেকে পাশে সরে যাচ্ছে। দেখি নাঙ্গা সন্ন্যাসীদের মিছিল আসছে, সামনে কয়েকজন সন্ন্যাসীর হাতে খোলা তরোয়াল – রাস্তা খালি করার জন্য একটু ভয় দেখানোই যার উদ্দেশ্য। স্নান সেরে ফিরছেন – সারা গায়ে ভস্ম মাখা। ভিড় আর ধাক্কাধাক্কিতে ইতিমধ্যেই দলছুট হয়ে পড়েছি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও অমিত-বাপীর দেখা না পেয়ে তাঁবুতে ফিরে এলাম স্নানের তোড়জোড় করতে।
গতকাল থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ স্নান করে চলেছেন। সংবাদ মাধ্যম আগেই সতর্ক করেছিল যে আজ মৌনী অমাবস্যার শাহী স্নানে আট কোটি মানুষ সামিল হবেন। আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না ঠিক কত মানুষ রয়েছেন, তবে কোটি কোটি মানুষ একত্র হলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায় তা নিজের অভিজ্ঞতায় পরখ করতে পারলাম। আজ আর অমিয়দা-প্রভাসদা স্নানে গেলেন না, শুধুই বাপী আর আমি দুজনে। ভিড় এড়াবার জন্য এদিক-ওদিক দিয়ে হাজির হলাম সঙ্গমে। কালকের কথা মাথায় রেখে একটা নম্বর দিয়ে চিহ্নিত লাইট পোষ্টের নীচে সাময়িক আস্তানা করলাম। একজন স্নানে গেলে অন্যজন পাহারায় থাকলাম জুতো-জামাকাপড়ের। আজ আর গতকালের মত নাকানি চোবানি না খেলেও এক-দু মিনিট ঘোরাঘুরি করে পোষ্টের নীচে ফেরত আসতে পারলাম।
ফেরার পথে রাস্তায় অজস্র চটি জুতো পড়ে থাকতে দেখে একটু খটকা লেগেছিল। তখন বুঝতে পারিনি ঘটনাটা কী ঘটেছে। তাঁবুতে ফিরে আসার পর অমিতের সঙ্গে দেখা হলে ও জানালো পদপিষ্ট হয়ে কয়েকজন মানুষ মারা গেছেন। সেদিন আমাদের পক্ষে এরচেয়ে বেশি জানা সম্ভব ছিল না। পরে বাড়ি ফিরে পুরোনো খবরের কাগজের পাতা উলটে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারলাম – সকালে স্নান সেরে পুণ্যার্থীরা ফিরছিলেন। কুম্ভের ১২ নং সেক্টরে হঠাৎ ভিড় বেড়ে যাওয়ায় দুজন পদপিষ্ট হয়ে মারা যান। একজন আবার পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। মনে পড়ে গেল প্রায় ছয় দশক আগে কালকুট প্রয়াগ কুম্ভে এসেছিলেন। সেদিনও তাঁকে চাক্ষুষ করতে হয়েছিল এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা। হারিয়ে ছিলেন বলরামকে। এই সঙ্গমে এসেই পরিচিত হয়েছিলেন এক কুলীন ভুঁইহার পরিবারের অশীতিপর বৃদ্ধের যুবতী স্ত্রী শ্যামার সঙ্গে। সেদিন শ্যামাও হারিয়েছিল তার স্বামীকে।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়, মৌনী অমাবস্যার পুণ্যস্নান সেরে ফেরার পথে এলাহাবাদ রেলস্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে অন্তত কুড়ি জন মারা যান। ঘটনাটি ঘটে সন্ধ্যে সাতটার সময়। পরে খবরের কাগজ থেকে জেনেছিলাম ওইসময় মাইকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ৬ নং প্ল্যাটফর্মে একটি ট্রেন আসছে। এরপরেই ওভারব্রিজে থাকা যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়ায় তাদের পায়ের চাপে ওভারব্রিজটিই প্লাটফর্মের ওপরে ভেঙ্গে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
সন্ধ্যায় অন্যদিনের মতই এদিনও সকলে মিলে হাঁটতে বেরোলাম। চোখে পড়েছিল অস্থায়ী সেতুর পাশে আশ্রয় নেওয়া বৈষ্ণব পরিবারটি। সন্তানকে সামলাচ্ছেন পিতা। তিনি নিজেই আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন। একেবারে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে এই ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে হাসিমুখ বৈষ্ণব পরিবারটিকে দেখে একটু আশ্চর্য হলাম বৈকি। খানিক এগোতেই চোখটা আটকে গেল গেরুয়া রঙে – কয়েকজন সাধু গঞ্জিকা সেবন করছেন। ধূমায়িত কলকের হাত বদল হচ্ছে মাঝে মাঝেই – ধোঁয়ার কুন্ডলী উর্দ্ধে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। একজন সাধুতো কলকেতে এমন টান মারছেন যে দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হল দম আটকে না যায়। নদীর ধারে নানান আকার-প্রকারের ক্যামেরা হাতে বিদেশিদের ভিড়। সূর্য্য ডোবার পরই ঠান্ডা পরতে শুরু করে দেয়, আমরা এবার ফেরার পথে ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম। মেলাপ্রাঙ্গণের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল ভিড় অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে, অনেকেই ফিরে গেছেন। আমাদের ফেরার টিকিট অবশ্য বেনারস থেকে কাটা হয়েছে। কিন্তু কালকে এখান থেকে বেনারস যাওয়ার কোন যানবাহন আদৌ পাব কীনা সেই চিন্তা করতে করতেই ফিরছিলাম। এই ভিড়ে সবই অপ্রতুল।
পরদিন সকালে একটু তাড়াতাড়িই তৈরি হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু দলের নবীন সদস্যেরা ক্যামেরা হাতে শেষবারের মত মেলাপ্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়েছিল। অতএব রওনা হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। অনেক নাকানি চোবানি খেয়ে শেষপর্যন্ত মধ্যরাতে বেনারস পৌঁছেছিলাম আমরা। কিন্তু সে আর এক কাহিনি।
সেদিন সকালে ভারত সেবাশ্রম সংঘের তাঁবুর কাছে রাস্তায় ঘোরাফেরা করছি হঠাৎ মধ্যবয়সী এক মহিলা এসে সঙ্গম যাওয়ার পথের হদিস জানতে চাইলেন। আরও দুজন ছিলেন ওনার সঙ্গে। বললেন ভিড়ের চাপে দলছুট হয়ে পড়েছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তাঁদের দুর্দশার কথা। ধাক্কাধাক্কিতে শাড়ি-জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে, কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলেন। সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সঙ্গে টাকাপয়সা আছে কীনা। আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। ভাবছিলাম এত কষ্টের মধ্যেও সহায়সম্বলহীন অবস্থায় প্রয়াগে স্নানের জন্য ছুটে চলেছেন। প্রয়াগ থেকে বেনারস ফেরার পথেও চোখে পড়ল অজস্র মানুষ নিজের মোট মাথায় বা পিঠে করে হেঁটে চলেছেন। এ যেন এক অনন্ত যাত্রা। আমাদের মত শহুরে মানুষের চিন্তা এদের গ্রাস করে না। প্রয়োজন হয় না মিনারেল ওয়াটার কিম্বা যানবাহনের। চোখের সামনে যেন ভেসে এলো হাজার বছরের পুরোনো ভারতবর্ষ। সেদিন থেকে আজও এই আদি ও অকৃত্রিম ভারতবাসীরা সব কিছু ত্যাগ করে পুণ্য অর্জনের জন্য বেরিয়ে পড়েন কুম্ভ বা কেদারনাথের সন্দর্শনে, অক্লেশে, নির্দ্বিধায়।
এটাই ভারতবর্ষের আসল রূপ।

~ কুম্ভমেলার আরো ছবি ~

প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক অপূর্ব-র নেশা বেড়ানো আর ছবি তোলা। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা চোখের আড়ালে চলে যাওয়া টেরাকোটার মন্দিরশিল্পকে ক্যামেরার দৃষ্টিতে পুনরুদ্ধার করাই তাঁর ভালোলাগা। পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভ্রমণ ও অন্যান্য লেখা।

 

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher