পুজোয় প্রবাসে

মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

সপ্তমীর সকালে হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখি প্লেন দেরি করায় গন্তব্যে পৌঁছানোর শেষ বাসটাও ছেড়ে গেছে, এরপর আবার বারো ঘন্টা পরে আসবে। আলোয় ঝলমল কলকাতাকে ফেলে আসার সময়েই মনে হচ্ছিল বিদেশের মাটিতে পুজো কেমন কাটবে কে জানে! যাচ্ছি নিউ কাসেলে দিদির বাড়িতে, লন্ডনে পুজো দেখার একটা নতুন অভিজ্ঞতার আশায়। কিন্তু ভিক্টোরিয়া স্টেশনে অলসভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা পায়চারি করতে করতে আর বার্গার, সসেজ ইত্যাদি খেতে খেতে শুরুটা বিশেষ ভালো হল বলে তো বোধ হচ্ছে না। লন্ডনের নিত্য ব্যস্ততার মাঝে আমি যেন একাই শুধু ভেবে যাচ্ছি আজ সপ্তমী আজ সপ্তমী, কিন্তু টের পাচ্ছি কই?

মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বিমানে বসে জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য দেখে মন ভরে গেল, বলা ভাল একটু মন কেমন করে উঠল বৈকি। এই প্রথম পুজোর সময় কলকাতা ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছি। ফিরে ফিরে তাকাই নীচের দিকে যতক্ষণ নজরে আসে - আলোর বন্যায় ধুয়ে যাচ্ছে শহর কলকাতা। শুনেছিলাম প্যারিস সারাবছর আলোর রোশনাইতে মাতোয়ারা থাকে বলে সেই শহরের আরেক নাম 'সিটি অফ লাইটস'। সেদিন উড়ান থেকে আলোর সাজে মোড়া কলকাতাকে দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন আমাদের 'আলোক নগরী'।
হিথরো এয়ারপোর্ট সংলগ্ন এলাকাগুলিতে কিম্বা ভিক্টোরিয়া স্টেশনের চারপাশে দুর্গাপুজোর কোন জাঁকজমকই চোখে পড়ল না। মনটা বেশ দমেই গেল। এবারে তাওতো পুজোর দিনেই পুজোর আয়োজন, অনেকসময়তো ছুটির অভাবে হপ্তাহান্তেও দুর্গাপুজো হয়। দীর্ঘ বাস জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে দিদির বাড়ি পৌঁছে ফ্রেস হয়ে একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপরে সবাই মিলে ভারতীয় পোষাকে দিদিদের সঙ্গে গাড়ি করে বেরিয়ে পড়লাম কমিউনিটি হলের উদ্দেশ্যে। সেখানেই দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়েছে। কমিউনিটি হলটি বেশ বড়। কিন্তু আমার মন যে খালি কলকাতার পুজোর সঙ্গে তুলনা করে চলেছে তাই আলোটালো সব মিলিয়ে প্রথমটায় একটু নিষ্প্রভই ঠেকল। সিলিং থেকে ঝোলানো কয়েকটা ঝাড়বাতির মৃদু আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে হলটি। মনে হচ্ছিল এ যেন কলকাতার কোন বনেদী বাড়ির পুজো। ঝলমলে আলো, বড় প্যান্ডেল কিম্বা মাইকের আওয়াজ নেই, তবে রয়েছে গভীর আন্তরিকতা,ভক্তি ও নিষ্ঠা।
সবাই পুজোর কাজে বেশ ব্যস্ত। কলকাতার কুমোরটুলি থেকে মা তাঁর ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উড়ানের কারগোতে বাক্সবন্দী হয়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে পৌঁছেচেন প্রবাসী সন্তানদের কাছে মাত্র দুদিনের জন্য। প্রতিমার সাজসজ্জা, পুজোর আয়োজন সবেতেই নিখাদ বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। চারপাশের পরিবেশ বেশ গম্ভীর। ধুতিপরা অল্পবয়সী একটি ছেলে ইংরেজি উচ্চারনে ঠাকুরের মন্ত্র পড়ছে। কাছে গিয়ে দেখি মন্ত্রগুলি ইংরেজি হরফে লেখা। বুঝলাম সে বাংলা পড়তে পারে না। আসলে পুরোহিত বলে কিছু নেই এখানে, ব্রাহ্মণের ছেলে বলে তাকে পুরোহিতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে দেখলাম পুজোর কাজে সে রীতিমতো পটু। একা হাতেই পুজোর যাবতীয় আচার নিখুঁতভাবে করছে। মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম। গঙ্গাজল বড়ই বাড়ন্ত, তাই কয়েকফোঁটা গঙ্গার জল সবার ওপর ছিটিয়ে শান্তি জলের পর্ব চুকল। অঞ্জলির প্রসাদ খেতে গিয়ে দেখি বিচিত্র সব ফলমূল। ব্ল্যাক আর রেড কিউর‍্যান্ট, প্লাম, গ্রিন অ্যাপেল, স্ট্রবেরি। বেশ মজা লাগল আমাদের শশা, কলা, শাঁকালুর পরিবর্তে বিদেশি ফলের প্রসাদ খেতে। শুভ্রাংশুতো তার মধ্যেই খুঁজে পেতে নারকেল নাড়ু ( যা কলকাতা থেকে প্যাকেটে করে প্লেনে চড়ে এসেছে) দু'চারটে নিয়ে মুখে পুরে ফেলল। দুপুরে লুচি, মশলাবিহীন আলুর দম আর ছোলার ডাল – চমৎকার লাগল। সন্ধ্যেবেলায় বেশ ধুমধামের সঙ্গেই আরতি হল।
নবমীর দিন সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, মাঝে মধ্যে নির্মল নীল আকাশ। ইংলন্ডের এই আবহাওয়াতেও ঢাকের আওয়াজ লন্ডনের মাটিতে কলকাতার পুজোর আমেজ এনে দিচ্ছিল। ঢাকি নেই, ঢাকের সিডি সাউন্ড সিস্টেমে বেজে চলেছে অবিরত। দিদির মুখে শুনলাম কোন কোন বছরে ঢাক আর কাঁসর এনেও রাখা হয়। যা ঢাকির বদলে এখানকার বাঙালি পুরুষেরাই বাজান। দুর্গা প্রতিমার চোখ জুড়ানো সাজসজ্জা, শাঁখের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ, ধূপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, প্রবাসী বাঙালি পুরুষদের ধুতি-পাঞ্জাবী পরে ইতস্ততঃ ঘোরাঘুরি, শাড়ি পরা মহিলাদের চুড়ির রিনিঠিনি – এতো কলকাতারই পুজোর ছায়া। শুধু দু-একজন সোয়েটার পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কয়েকজনতো উইন্ডচিটার গায়েই অঞ্জলি দিলেন। আবার এসব চোখে পড়লেই মনে হচ্ছে কলকাতা থেকে কতদূরে ভিন দেশের পুজোর আস্বাদ নিচ্ছি।
নবমীর রাতেই দশমীর শেষ পুজো। ছুটি শেষ, পরের দিন থেকেই সবার রোজকারের কাজকর্মের দিন শুরু হবে। পাঁচদিনের আনন্দোৎসব তাই দুদিনেই সমাপ্ত। বিসর্জনের রেশ লেগেছে সবার মনেই। সাদা গরদের শাড়ি পরে অনাবাসী ভারতীয় মহিলারা একে অপরকে সিঁদুরের লাল রঙে রাঙিয়ে তুললেন, বাদ গেলামনা আমি আর দিদিও। বিসর্জনের নাচেও বেশ নতুনত্বের ছোঁয়া। সেইসময় গুজরাটিদের 'নবরাত্রি' অনুষ্ঠান থাকায় একইসঙ্গে তাঁরাও ডান্ডিয়া নেচে নিলেন। মনে হল এ যেন 'মিনি ইন্ডিয়া'।
ভাবলাম যাইহোক টেমস নদীর জলে ঠাকুর বিসর্জন দেখার সুযোগ হবে। কিন্তু এতো আর কলকাতা নয় যে গঙ্গার জলে ভাঙ্গা কাঠামো আর পচা ফুল-বেলপাতা জমতেই থাকবে। জলদূষণ এড়াতে এখানে মায়ের বিসর্জনই হয় না। বিসর্জনের নাচের পর দৃশ্যটা একটু খারাপই লাগল – মা দুর্গা ছেলে-মেয়ে সমেত একে একে পর্যায়ক্রমে হাত-পা খুলে খুলে পার্ট বাই পার্ট আশ্রয় নিলেন প্যাকিং বাক্সে। আগামী বছর জুড়ে নিয়ে আবার পুজো করা হবে।
রাতে বিজয়া দশমীর জম্পেশ খাওয়া-দাওয়া – ফ্রায়েড রাইস, ল্যাম্ব, চাটনি আর কলকাতা থেকে ক্যানে বন্দী হয়ে আসা কে সি দাসের রসগোল্লা। তারপর প্রবল ঠান্ডার মধ্যে একে অপরকে শুভ বিজয়া জানিয়ে দিদির বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কাল আবার অন্যত্র পাড়ি দেব।

মহুয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর করে বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন। ভালবাসেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ও জীবনানন্দের কবিতা পড়তে। সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন দেশে-বিদেশে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher