--> :: Amader Chhuti :: অপার্থিব

অপার্থিব

প্রোজ্জ্বল দাস

রূপকুণ্ড ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি - -

দুপুরবেলা যখন হামাগুড়ি দিয়ে কালু-বিণায়ক পৌঁছলাম, তখন শরীরে আর শক্তি বলে কিছু বাকি নেই। প্রবল ঠাণ্ডা, তুমুল বৃষ্টি, প্রচন্ড হাওয়া দিচ্ছে, দুর্ধর্ষ খিদে পেয়েছে, তার ওপর আবার ওই সাংঘাতিক চড়াই। কালু-বিণায়কে খানিক বিশ্রাম নিয়ে ভাগুবাসাতে পৌঁছে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। পাথুরে একটা জায়গা, চারদিকে বরফ পড়ে আছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে খালি কালচে বাদামী আর খয়েরী রঙ। কোথাও কোথাও ধূসর অথবা সাদা রঙের বরফ। কেমন একটা বিষণ্ণ জায়গা। গিয়েই মনে হল জায়গাটা থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
একটা পাথুরে চাতালের ওপর আমাদের তাঁবু খাটানো হল। চাতালটা এতটাই পাথুরে যে তাঁবুতে যেভাবেই শোওয়ার চেষ্টা করি না কেন, মনে হয় শরীরটা একটা আঁকাবাঁকা লাইন হয়ে গেছে। সন্ধে হতে না হতেই উষ্ণতা হিমাঙ্কের নিচে। তাঁবুর চেন খুললে তাঁবুর মধ্যে মেঘ ঢুকে পড়ে, এরকম অবস্থা। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কোত্থাও কিচ্ছু দেখা যায়না। তার ওপর উচ্চতার জন্য শুরু হল মাথা যন্ত্রণা। খেতে ইচ্ছে করছেনা, সব মিলিয়ে এক বিশ্রী অবস্থা। কোনমতে অর্ধেক জেগে, অর্ধেক ঘুমিয়ে রাতটা কাটল।
ভোরবেলা উঠে রূপকুণ্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তখনও সূর্য ওঠেনি। পুব আকাশটা সবে ফরসা হতে শুরু করেছে। পশ্চিম দিকে রাজকীয় ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ – ভোরের আলোতে আস্তে আস্তে গোলাপী হয়ে উঠছে। চিড়িয়ানাগে পৌঁছে শুরু হল সত্যিকারের ট্রেকিং। সারারাত ধরে বৃষ্টি হয়েছে। পাথুরে রাস্তা ভিজে পিছল হয়ে আছে। পা ফেললেই হড়কে যাচ্ছি, তার ওপর আবার বরফ। গাইডরা বরফের মধ্যে গর্ত করতে করতে চলেছে। সেই গর্তের মধ্যে পা ফেলে চলতে হবে। তার বাইরে পা রাখলে হড়কানোর সম্ভাবনা একদম সেন্ট পারসেন্ট, আর হড়কালে কোথায় গিয়ে যে পড়ব কোন ঠিক নেই। একটু করে যাই, জিভ বের করে হাঁপাই আর ওপরদিকে তাকিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিই, ওই তো, ওই বড় পাথরটার পেছনেই রূপকুণ্ড!
একটা সময় এল যখন রাস্তা বলে আর কিছুই নেই। এমনিতেই পায়ে চলা রাস্তা, বরফ পড়ে তা কোথাও ভেঙ্গে গেছে, কোথাও ঢেকে গেছে। সামনে খাড়াই পাহাড়, কোথাও বরফ, কোথাও আলগা নুড়ি-পাথর। প্রত্যেকবার পা রাখবার সাথে সাথেই একটু একটু করে নুড়ি-পাথর নীচের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, এত আলগা। আমরা খানিক হামাগুড়ি দিয়ে হরিনাম জপতে জপতে ওপরে উঠছি। ততক্ষণে আমি বেঁচে ফেরার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। এমন সময় দেখতে পেলাম সামনে বেশ খানিকটা বরফে ঢাকা জায়গা, তারপর জমিটা ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে। সেখানটা দেখা যাচ্ছেনা, ঢালু জায়গাটার ওপারে একটা পাহাড় খাড়া দেওয়ালের মত সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। অনেক উঁচুতে যেখানে পাহাড়টা শেষ হয়েছে, সেখানে ঘন নীল রঙের আকাশে ঝকঝক করছে সূর্য। কি তার তেজ! বরফ ঢাকা জায়গাটার পরে যেখানে জমিটা ঢালু হয়ে গেছে ওইখানেই রূপকুণ্ড।
ওপরে উঠে কেমন একটা হয়ে গেলাম। মনে হল পৃথিবী থেকে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছি। সামনে বরফে ঢাকা একটা হ্রদ। হ্রদটার ওপারে সেই খাড়া পাথরের দেওয়াল। উল্টোদিকে, যেদিকে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে গেছে, যেদিক থেকে আমরা উঠলাম, সেদিকে আমাদের থেকে অনেক নীচে মেঘের একটা স্তর। আমরা দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়টার একটা খাঁজে। মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশ। আকাশের এরকম গাঢ় নীল রঙ আমি আগে কখন দেখিনি, খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে যেন চোখ ব্যথা করে! সেই অদ্ভুত নীল রঙের সামনে আশে পাশের পাহাড় গুলোর গাঢ় বাদামী অথবা খয়রি রঙের পাথর আর সাদা রঙের বরফ যে কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে তা বলে বোঝানো যায়না। আমরা বাঙালিরা, যারা গাঙ্গেয় সমভূমিতে বড় হয়েছি, আমাদের আশেপাশে যেরকম সৌন্দর্য দেখতে পাই, তা যেন কেমন কোমল, স্নেহ মাখানো। কিন্তু এ একেবারে দুর্ধর্ষ সুন্দর।
রূপকুণ্ড উত্তরাখন্ড রাজ্যে হিমালয়ের ত্রিশুল পাহাড়ের প্রায় কোলে ১৬,৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটা গ্লেসিয়াল লেক। ট্রেকিং শুরু হয় লোহাজং নামে একটা চটি জাতীয় জায়গা থেকে। তিনদিনের একটু বেশি লাগে পৌঁছাতে। প্রথম দিন লোহাজং থেকে দিদনা নামে একটা গ্রাম, তারপরের দিন দিদনা থেকে বেদনি বুগিয়াল, তার পরের দিন বেদনি থেকে ভাগুবাসা। বেদনি থেকে ভাগুবাসার পথে প্রথমে আসে ঘোড়ালোটানি, তারপর পাথরনাচুনি, তারপর একটা সাংঘাতিক খাড়াইয়ের পর কালু-বিণায়ক, এবং অবশেষে ভাগুবাসা। পরের দিন আলো ফোটার আগে ভাগুবাসা থেকে বেরিয়ে রূপকুণ্ড দেখে একদম বেদনিতে ফেরত। তার পরের এবং শেষ দিন বেদনি থেকে ওয়ান গ্রাম। সেখানেই শেষ হয় এই ট্রেক। আমরা তিন বন্ধু মিলে এই রূপকুণ্ড ট্রেকে গিয়েছিলাম। আমাদের গাইড ছিল মোহন সিং। মোহন সিং-এর বাড়ি ওয়ান গ্রামে। মোহন সিং পুণের একটা দলকে আমাদের সাথে গাইড করছিল। হিমালয়ের বুকে এটাই তাদের প্রথম ট্রেক।
অনেকক্ষণ পরে যখন বরফ গলতে শুরু করল সূর্যের তাপে, আমরাও নীচে নামা শুরু করলাম। বরফ আর নুড়ি-পাথরের মধ্যে দিয়ে কোনমতে নেমে যখন নীচে ভাগুবাসাতে ফিরে এলাম, তখন একটা অদ্ভুত আনন্দ হল – মনে হল তাহলে বাড়ি ফিরতে পারব! এদিকে সকাল থেকে প্রায় কিছুই পেটে পড়েনি, বেলা এগারোটা বাজে, কিন্তু তখনও কিছু খাবারের নামগন্ধ পাওয়া যাচ্ছেনা। কী ব্যাপার? খোঁজ করে জানা গেল দ্বিতীয় দলটির একটা ছেলের রূপকুণ্ড ওঠার সময় শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। মোহন সিং তাকে রাস্তায় বসিয়ে খাবার, জল দিয়ে ওপরে গেছিল, আর বলে গেছিল সে যেন সেখানেই বসে অপেক্ষা করে। মোহন সিং ফেরার সময় তাকে নিয়ে নিচে নামবে। ফেরার রাস্তায় মোহন সিং তাকে দেখতে পায়নি। তাঁবুতে ফিরে এসেও দেখা গেছে সে নেই। গেল কই? নির্ঘাত রাস্তায় কোথাও বসেছিল। ফেরার তাড়াহুড়োতে কেউ খেয়াল করেনি। মোহন সিং তাই কিচেন টেন্ট-এর ছেলেটাকে নিয়ে আবার গেছে তাকে খুঁজতে। অগত্যা থাকো বসে, যতক্ষণ না তারা ফেরে। এদিকে ভাগুবাসা থেকে বাকি দলগুলো এক এক করে ফিরে যেতে লাগল। প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে গেল। তাও কেউ ফেরেনা। শেষপর্যন্ত বাকি সবাই ফিরে গেল, জায়গাটাতে শুধু আমরাই পড়ে রইলাম। কী অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেল ভাগুবাসা। সময় যায়, বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই, কখন কেউ আসবে। মাঝে মাঝেই তাঁবুর পরদা সরিয়ে দেখি কেউ আসছে কীনা। যত সময় যায়, মাথায় তত উল্টোপাল্টা চিন্তা এসে জাঁকিয়ে বসে। এরকম করেই কেটে যায় আরো ঘন্টাখানেক। হঠাৎ দেখা যায় কিচেন টেন্ট-এর ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে আসছে। এসে বলে, "বাবুজি, উ ফিসল গয়া। উসকা বডি মিলা হ্যায়। বহুত নীচে। ম্যায় আয়া গোড়া লে জানে কে লিয়ে।"
হাত-পা কেমন যেন অসাড় হয়ে আসে। কেমন অদ্ভুত একটা ভয় এসে চেপে বসল মনের ওপর। ওদের দলটায় একটা মেয়ে ছিল। হঠাৎ পাশের তাঁবু থেকে মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ভাগুবাসা মনের মধ্যে একটা গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে আসে। জনশূন্য ভাগুবাসাতে বসে একটা মেয়ের চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ – মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। আবার শুরু হয় অপেক্ষা। কখন মোহন সিং ফিরবে। কোথাও কোন আওয়াজ হয়, আর আমাদের মনে হয় ওই বুঝি আসছে। এইবার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখতে হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায়, ঠায় বসে থাকি, মোহন সিং আর ফেরেনা।
বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ তাঁবুর পর্দা সরিয়ে কিচেন টেন্ট-এর ছেলেটা উঁকি মারে। জানায় ওরা মৃতদেহটা নিয়ে ফিরে এসেছে। আজকের মধ্যেই আমাদের বেদনি ফিরতে হবে। আমাদের কিছু খেয়ে নেবার জন্য ডাকল। ঘড়িতে দেখি বিকেল সাড়ে চারটে বাজে। এখন বেদনি!! ভাগুবাসা থেকে বেদনি পৌছাতে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। চট করে স্যাক গুছিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। মোহন সিং প্রত্যেককে খাবারের থালা ধরিয়ে দেয়। পাশেই ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে মৃতদেহটা। তাকাতে সাহস হয়না, তবু চোখ চলেই যায়। চারটে হাত-পা কী ভয়ঙ্করভাবে ঝুলছে। মাথার কাছটা একটা চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা, বস্তাটা চুইয়ে রক্ত পড়ছে পাথরের ওপর। ঘোড়াটা নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। কিছুই খেতে পারিনা। ইতিমধ্যে ওদের দলটা বেরিয়ে পড়েছে। তাদের পেছন পেছন মোহন সিং মৃতদেহ সমেত ঘোড়াটা নিয়ে চলল। তার খানিক পরে আমরা তিনজন। কিচেন টেন্ট-এর লোকেরা রয়ে গেছে, গোছগাছ করে তারপর আসবে।
তিনজনে যখন ভাগুবাসা থেকে হাঁটা শুরু করলাম তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। সাতটায় সূর্যাস্ত হবে। ততক্ষণে আমরা ঠিক কতদূর যেতে পারব এটা হিসেব করতে গিয়ে গলাটা যেন শুকনো শুকনো ঠেকল। হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কোথাও একটা আওয়াজ নেই, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা তিনজনে চুপচাপ কোন কথা না বলে যত জোরে যাওয়া যায়, চলেছি। মাঝে মধ্যেই রাস্তায় পাথরের ওপর পড়ে রয়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত!
দুদ্দাড়িয়ে যখন পাথরনাচুনি এসে পৌঁছলাম, তখন বাকি দুটো দলকে পেরিয়ে গেছি, সবার আগে হাঁটছি। আরো জোরে পা চালালাম – দিনের আলো থাকতে থাকতে যতখানি যাওয়া যায়। ঘোড়ালোটানি যখন পৌঁছলাম, ঠিক তক্ষুনি সূর্য ডুবল। ঘড়িতে তখন সন্ধে সাতটা। আমাদের ধারণা হয়েছিল ঘোড়ালোটানি থেকে বেদনি খুব বেশি দূর না। কাজেই দিনের আলো থাকতে থাকতে ঘোড়ালোটানি পৌঁছতে পেরে আমরা ভারি খুশি হলাম। এটা যে কতবড় ভুল ধারণা ছিল, সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম!
কোথাও একটা জনপ্রাণী দেখা যায়না। আমরা তিনজনে মিলে হাঁটছি। দিনের আলো দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টিটাও ক্রমশ বাড়ছে। ঠিক সোয়া সাতটা নাগাদ দিনের সব আলো শেষ হয়ে গেল – ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। আমাদের তিনজনের কাছে একটাই টর্চ। সেটা নিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছি তিনজনে। বৃষ্টিটা বাড়তে বাড়তে মুষলধারে এল। বৃষ্টিতে পথের পাথরগুলো পিছল হয়ে গেছে, পা রাখামাত্র হড়কে যাচ্ছে। পায়ে চলা পথ, খুব বেশি হলে তিন ফুট চওড়া, বাঁদিকে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, আর ডানদিকে খাদ। সেই সময় কোথা থেকে এল কুয়াশা। সে এমন কুয়াশা যে টর্চ-এর আলো রাস্তা পর্যন্ত ভালো করে পৌঁছায় না। ঠিক করে বুঝতে পারিনা কোথায় পা রাখছি, পাথরে না মাটিতে। ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছি। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে চলেছি। বেদনি যাবার জন্য এই রাস্তা থেকে একটা বাঁক নিতে হয়, কিন্তু এই কুয়াশার মধ্যে সে বাঁক চেনা যে আমাদের কম্ম নয় তা আগেই বুঝেছি। কিন্তু তখন পেছনে ফিরে যাবারও সাহস নেই। একবার ঠিক করলাম দাঁড়িয়ে পড়ি, মোহন সিং এলে তারপর যাওয়া যাবে। কিন্তু বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়াবার পরও কেউ আসেনা। এদিকে ঠান্ডায়, বৃষ্টিতে, ভিজে জামাকাপড় পরে আমাদের জমে যাওয়ার অবস্থা। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। তখন আমরা আবার চলাই ঠিক করলাম। ততক্ষণে আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের পরিণামও ওই ছেলেটার মতই হতে চলেছে। এমন সময় পেছন থেকে যেন একটা আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল। তিনজনেই থমকে দাঁড়ালাম। আবার! কুয়াশার মধ্যে দিয়ে মনে হয় যেন বহু দূরে কেউ কোথাও একটা আলো নাড়াচ্ছে!
আমরা প্রবল জোরে চিৎকার শুরু করি। টর্চের আলোটা নাড়তে থাকি। উত্তরে ওদিকেও আওয়াজটা খানিক বাড়ে। খানিক পরে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটা অবয়ব আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে – ছাতা মাথায় একটা লোক। এসে বললে, "মোহন সিং নে মুঝে ভেজা।" তারপর সমস্ত কিছু কেমন অস্পষ্ট হয়ে আসে। খালি মনে পড়ে আমার আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে একটা লম্বামতন লোক, গায়ে একটা জোব্বা, একহাতে মাথায় ছাতা ধরে আছে। কুয়াশায় তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না। বৃষ্টির মধ্যে টর্চের আলোয় তাকে কেমন নীলচে একটা মূর্তির মত দেখায়। সে তার দেশের নানান গল্প করতে করতে আমার আগে আগে চলেছে আর আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকে অনুসরণ করছি। কখন যেন বাকি দলদুটোও পেছনে এসে হাজির হয়। এখনও মনে আছে, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। যেই একটু আস্তে হচ্ছি, ঘোড়াটা কাঁধের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। অমনি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করছি। খানিক পরে আবার যে কে সেই। এভাবে কতক্ষণ হেঁটেছিলাম মনে নেই। যখন বেদনি পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা।
ঠিক হয়েছিল আমরা বেদনিতে থেকে যাব। আর অন্য দলটা সেই রাতেই ওয়ান গ্রামে ফিরে যাবে। তাঁবু তখনও এসে পৌঁছায়নি, তাই আমাদের জন্য একটা ট্রেকার্স হাট খুলে দিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা। একটা কাঠের ঘর, ভেতরে ফায়ার প্লেসের মতন একটা জায়গায় আগুন জ্বালা হল। আমরা তিনজনে ভেতরে ঢুকে বেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম – এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম! স্যাক ঘেঁটে সব থেকে শুকনো যে জামা-কাপড় গুলো পাওয়া গেল, সেগুলোও আদ্দেক ভেজা। আমাদের টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ কিছুই এসে পৌঁছায়নি। তাই সেই আধ-ভিজে জামাকাপড় পরে বসে বসে কাঁপছি। ঘরে আগুন জ্বলছে, কিন্তু তাও যেন ঠান্ডা যায়না। এমন সময় অন্য দলটাও এসে ঢুকল ওই ট্রেকার্স হাটে। কী ব্যাপার! জানা গেল, আমরা সবাই এলেও মোহন সিং তখনো এসে পৌঁছায়নি। ফরেস্ট অফিসার জানিয়েছে মোহন সিং না আসা পর্যন্ত সে বাকিদের যেতে দিতে পারবেনা। সবাই মিলে ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন মোহন সিং আসবে, কখন স্লিপিং ব্যাগগুলো এসে পৌঁছাবে, এই ঠান্ডায় আর পারা যাচ্ছেনা। অন্ধকার কাঠের ঘরটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে আর চুপচাপ। শুধু মাঝে মাঝে মেয়েটার ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। থেকে থেকে আগুনটা নিবু-নিবু হয়ে আসছে। তখন কেউ একটা উঠে গিয়ে খানিকটা কেরোসিন ঢেলে দিচ্ছে, আগুনটা আবার দপ করে জ্বলে উঠছে। সারা ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে উঠছে, চোখ জ্বালা করছে। দরজার বাইরেটায় শোয়ানো হয়েছে ছেলেটাকে। সবাই ঠান্ডায় জড়সড় হয়ে বসে বসে ঢুলছে। ফরেস্ট অফিসার আমাদের এক এক করে জেরা করছে কী হয়েছিল, আর তারপর গম্ভীর মুখ করে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করতে করতে তার খাতাতে কীসব জানি লিখে রাখছে। এদিকে মোহন সিং আর ফেরেনা!
বেগতিক দেখে ফরেস্ট অফিসার একদল লোককে পাঠাল মোহন সিংকে খোঁজার জন্য। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সেই দলটি ওপরে পাথরনাচুনিতে পৌঁছে ফোন করে জানাল যে পথে কোথাও তারা মোহন সিংকে দেখতে পায়নি। এদিকে পাথরনাচুনিতে একজন জানিয়েছে যে সে মোহন সিংকে নীচে যেতে দেখেছে ঘন্টা তিনেক আগে। তাহলে সে গেল কোথায়? ফরেস্ট অফিসার গম্ভীর মুখ করে মাথা নেড়ে স্বগতোক্তি করে, "লাগতা হ্যায়, মোহন সিং ভি গয়া। ইয়ে বারিষ নে সব গরবর কর দিয়া..."। আমাদের বোধশক্তিটাও যেন লোপ পায়। এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে কাঠের মত শক্ত হয়ে বসে থাকি। আগুনটা আবার আস্তে হয়ে আসে...।
বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। হঠাৎ দড়াম করে ট্রেকার্স হাট-এর দরজাটা খুলে গেল। একঝলক বরফ ঠান্ডা হাওয়া ঘরটায় ঢুকে পড়ল। হাওয়া পেয়ে আগুনটাও আবার দপ করে জ্বলে উঠলো। ধড়মড় করে উঠে বসি আমরা সবাই। আধো আলো আধো অন্ধকারে স্বপ্নের মত দেখা যায় একটা লোক, আগাগোড়া বর্ষাতিতে মোড়া, ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে, মাথার টুপিটা খুলে ফেলে – মোহন সিং। ঘুমভাঙ্গা চোখে ওই আলো আঁধারিতে যেন মসীহার মত দেখতে লেগেছিল সেদিন মোহন সিংকে।
অন্য দলটা তাড়াতাড়ি আসার জন্য ওদের স্যাকগুলো ওপরে ভাগুবাসাতে ফেলে এসেছিল। কথা হয়েছিল ঘোড়াগুলো ওগুলো বয়ে আনবে। কিন্তু একটা ঘোড়া কমে যাওয়ায় এতগুলো স্যাক ঘোড়ার পিঠে চাপানো সম্ভব হয়নি। ঘোড়াওয়ালা তাই নীচে নেমে এসে মাঝরাস্তায় মোহন সিংকে ধরে একথা জানায়। মোহন সিং তখন আবার ফিরে যায় ভাগুবাসাতে। তারপর স্যাকগুলোকে কাঁধে চাপিয়ে বাকি ঘোড়া, টেন্ট, স্লিপিং ব্যাগ সমস্ত নিয়ে এই মাঝরাতে বেদনি পৌঁছেছে। সব কিছু শোনার পর সন্দেহ হয় এ কি সত্যি মানুষ?
বাকি রাতটা সেদিন ওরকমভাবে বসে বসেই কেটেছিল কারণ আমাদের স্লিপিং ব্যাগগুলো আনার সময় বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। সকাল ছ'টার সময় উঠে মোহন সিং আমাদের ম্যাগি আর চা বানিয়ে খাওয়াল। আগের দিন খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হবার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইল। আমরা আশ্চর্য হয়ে বুঝতে পারলাম না ঠিক কী বলা উচিৎ। আবার শুরু হল হাঁটা, এবার দিনের আলোয়, নিশ্চিন্ত মনে। ঘন্টা দুয়েক উৎরাই ভাঙ্গার পর যখন আমরা নীলগঙ্গা নদীর পুলটাতে পৌঁছলাম তখন সকালের উজ্জ্বল রোদ ঝাঁপিয়ে পড়েছে নদীপারের একচিলতে ঘাসে ছাওয়া জমিতে। ঘন সবুজ ঘাসের ওপর সাদা, হলুদ নানা রঙের ফুলগুলো দুলছে। চারদিকে পাখি ডাকছে, কতকগুলো মেয়ে শুকনো পাতা কুড়িয়ে গ্রামে ফিরছে।
জীবন কী আশ্চর্য রকম সুন্দর!

রূপকুণ্ড ট্রেক রুট ম্যাপ || ট্রেকের আরো ছবি - -

প্রোজ্জ্বলের জবানিতে - গড়পড়তা ল্যাদখোর ভেতো বাঙালি। আড্ডাবাজ। রবিবারের সকালের জলখাবারে লুচি আর বিরিয়ানিতে পাঁঠা ছাড়া জীবনটা কেমন খাঁ খাঁ করে। কলকাতা প্রেমিক। শরতের সকালে আর শীতের দুপুরে আপিসে বসে কাজ করতে করতে মনে হয় পর্যটক হলে বেশ হত!

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher