প্রস্তরযুগেও মানুষ বাস করত এখানে, রামায়ণ-মহাভারত গল্পে প্রাচীন অন্ধ্রপ্রদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর ইতিহাসের পাতা ওল্টালে ফিরে যেতে হবে সেই সম্রাট অশোকের সময়ে। অশোকের বিশাল সাম্রাজ্যেরই একটা অংশ ও অন্যতম একটি বৌদ্ধকেন্দ্র ছিল এই অঞ্চল। অশোকের মৃত্যুর পর সাতবাহন বংশের রাজাদের হাত ধরে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলে অন্ধ্র। দীর্ঘ ৪৫০ বছরের সাতবাহন রাজত্বে বৌদ্ধধর্ম প্রসারলাভ করে। সাতবাহনের পর ইক্ষবাকু, পল্লব, চালুক্য, কাকতীয়, বিজয়নগরের রাজাদের, কুতুবশাহি, মুঘল ও নিজামের হাত ঘুরে ব্রিটিশদের করায়ত্ত হয় অন্ধ্রপ্রদেশ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত অবশ্য কাগজে-কলমে নিজামের অধিকারেই ছিল এই অঞ্চল। রাজধানী হায়দ্রাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আজকের অন্ধ্রপ্রদেশ পুরোপুরি রূপ পায় ১৯৫৬ সালে তেলেঙ্গানা রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির পর।
একের পর এক রাজকীয় পালাবদল অন্ধ্রপ্রদেশের ইতিহাসকে শুধু সমৃদ্ধ করেছে তা নয়, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকেও ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। অন্ধ্রপ্রদেশের সংস্কৃতির এই উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায় অপূর্ব গঠনশৈলীর মন্দির, মসজিদ, প্রাসাদ প্রভৃতি স্থাপত্যকীর্তিতে আবার নৃত্য, গীত, বাদ্য এমন নানান শিল্পচর্চায়। কর্ণাটকী সংগীত আর কুচিপুরি নৃত্য যার অন্যতম দুই নিদর্শন। পর্যটকদের কাছে অন্ধ্রপ্রদেশের সেরা আকর্ষণ হায়দ্রাবাদ শহর। এছাড়া গোলকুন্ডা দুর্গ, আরাকু রিসর্ট বা তিরুপতির মতো অন্যান্য বেড়ানোর জায়গাগুলো রয়েছে।
তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ ভারতের দক্ষিণ অংশে ২,৭৫,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। অন্ধ্রের দক্ষিণে তামিলনাড়ু, পশ্চিমে কর্ণাটক, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে মহারাষ্ট্র, উত্তর-পূর্বে মধ্যপ্রদেশ ও ওড়িশা এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর। অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাংশ পর্বতসংকুল। সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মহেন্দ্রগিরির উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৫০০ মিটার। জলবায়ু সাধারণত উষ্ণ ও আর্দ্র। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২৫ সেন্টিমিটার। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রধান দুটি নদী কৃষ্ণা ও গোদাবরী। বৃহত্তম লেক নাগার্জুনসাগর। কৃষি ও বনজসম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল।
উৎসব -অন্ধ্রপ্রদেশের জাতীয় উৎসব পোঙ্গল (Pongal)। পৌষমাসে তিনদিন ধরে এই উৎসব চলে। আশ্বিন-কার্তিকে নবরাত্রি উৎসব ও জুন-জুলাই মাসে মুসলিম পরব মহরমও ধুমধামে পালন করা হয়।
মরসুম- বছরের যে কোনও সময়েই অন্ধ্রপ্রদেশ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়া যায়। তবে খুব গরমের সময়টা না যাওয়াই ভালো।
হায়দ্রাবাদ(Hyderabad)- আধুনিকতা আর ইতিহাসের মেলবন্ধনের নিজস্ব স্বকীয়তায় অনন্য ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম শহর হায়দ্রাবাদ। পুরোনো প্রাসাদ আর বাড়িঘরে মুসলিম আর পারসিক স্থাপত্যের ছোঁয়া। তবে নতুন হায়দ্রাবাদ শহর এখন হাইটেক সিটি-আধুনিক শিল্পনগরী। আরেক পরিচয় -মুক্তোর শহর।
হায়দ্রাবাদ শহরের পত্তন হয়েছিল ১৫৯১ সালে। সেও এক রোমান্টিক গল্পকথা-কুতুবশাহি বংশের নবাব মহম্মদ কোয়ালি কুতুব শাহ প্রেমে পড়েন আদিবাসী তরুণী ভাগ্যমতীর, বিয়েও করেন তাঁকে। প্রিয়তমার নামে শহরের নামকরণ করেন ভাগ্যনগর। ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ভাগ্যমতীর নাম হয় হায়দারমহল, শহরের নাম বদলে হয় হায়দরাবাদ বা হায়দ্রাবাদ। কুতুবশাহি বংশের শাসনের পর ঔরঙ্গজেবের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এই শহর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর আসদ জাহি নিজামের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন এই নিজামেরা। বিশাল প্রাসাদ আজও সেই ইতিহাসের সাক্ষী দেয়।
মুসিনদীর দক্ষিণ তীরে পুরোনো হায়দ্রাবাদ পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র। এখানেই রয়েছে সালারজং মিউজিয়াম, চারমিনার, হাইকোর্ট, কুতুব শাহ গার্ডেন, আমিনবাগ, জু প্রভৃতি দ্রষ্টব্যগুলি।
শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক গোলকুন্ডা দুর্গ (Golkunda Fort)। বারো শতকে ওয়ারাঙ্গালের কাকতীয় বংশের রাজা গণপতির আমলে তৈরি। পরবর্তী সময়ে বাহমনি রাজাদের হাত ঘুরে কুতুবশাহি বংশের রাজধানী হয় গোলকুন্ডা। শেষ কুতুবশাহি সুলতান আবুল হাসানকে পরাজিত করে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব দুর্গ দখল করেন ১৬৮৭-তে। জয়ের চিহ্নস্বরূপ মূল প্রবেশদ্বারের নামকরণ হয় ফতে দরওয়াজা।
গ্র্যানাইট পাথরে গড়া দুর্গটিতে প্রবেশদ্বার আটটি। দুর্গের চারপাশে পরিখার চিহ্ন বর্তমান। দুর্গের একেবারে উপরে দরবারহল। দুর্গের ভিতর ভেঙে পড়া মন্দির, মসজিদ, নানান প্রাসাদ, হারেমমহল, তোপখানা, মাটির নীচের কারাগার, ফোয়ারা আজও পর্যটকের মনে বিস্ময় জাগায়। নাগিনাবাগের বাতাস শুনিয়ে যায় অতীতের কথা। মূল প্রবেশদ্বারের তোরণ পেরিয়ে ফতে দরওয়াজার কাছে করতালি দিলে আজও যেন সচকিত হয়ে ওঠে দুর্গের শীর্ষে দরবারমহলের দেওয়ালগুলো। দুর্গের উপর থেকে আশপাশের দৃশ্যও ভারি চমৎকার। সন্ধেবেলায় সন-এ-লুমিয়ের প্রদর্শনীতে শুনে নেওয়া যায় অতীত ইতিহাসের কাহিনি। একসময় গোলকুন্ডার হীরের খুব খ্যাতি ছিল। যার নিদর্শন বিখ্যাত কোহিনুর হিরে। দুর্গের থেকে এক কিলোমিটার দূরে ইব্রাহিমবাগে কুতুবশাহি বংশের সমাধিস্থল কুতুবশাহি সমাধি।
দুর্গ লাগোয়া কৃত্রিম জলাশয় ওসমানসাগর। হায়দ্রাবাদ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আরেক কৃত্রিম লেক হিমায়েতসাগর। শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে মাধপুরে শিল্পীদের নিজস্ব জায়গা শিল্পগ্রাম। শিল্পগ্রামের গায়ে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা হ্রদ চেরুভু। হায়দ্রাবাদ থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে বনস্থালিপুরম ডিয়ার পার্ক। হায়দ্রাবাদ রেলস্টেশনের উত্তরে নামপালিতে ১২০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে পাবলিক গার্ডেন। সারা বিশ্বের নানা প্রজাতির গাছপালা নিয়ে গড়ে ওঠা বোটানিক্যাল গার্ডেনটি ছাড়াও এই উদ্যানের মধ্যেই রয়েছে হায়দ্রাবাদ মিউজিয়াম। পাবলিক গার্ডেনের কাছেই নওবত পাহাড় ও শ্রীভেঙ্কটেশ্বর মন্দির। এখানেই রয়েছে বি এম বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম ও বিড়লা সায়েন্স মিউজিয়াম। নওবত পাহাড়ের গা ঘেঁষে হুসেনসাগর (Hussain Sagar)। হ্রদের জলে ভেসে পড়া যায় রঙিন বোটে। লেকের গায়েই মনোরম এন টি আর গার্ডেন। হায়দ্রাবাদের বেশ কয়েকটি সাজানো-গোছানো পার্কই ট্যুরিস্ট আকর্ষণ করে। এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণীয় কে বি আর পার্কের ছোট্ট চিড়িয়াখানাটি। লুম্বিনিপার্কে ভগবান বুদ্ধের বিশালাকার মূর্তিটিও দর্শনীয়।
মুসিনদীর তীরে সালারজং মিউজিয়াম (Salarjung Museum) -ইতিহাস এখানে আজও জীবন্ত। এই মিউজিয়াম গড়ে ওঠার পিছনে একটি মানুষের অনেক আবেগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে রয়েছে। নানান দুষ্প্রাপ্য আর অমূল্য জিনিস সংগ্রহই ছিল তৃতীয় সালারজং তথা মির ইউসুফ আলি খানের শখ। আর সেই শখের খাতিরে নিজামের প্রধানমন্ত্রীত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ চাকরিও তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। সালারজং-এর মৃত্যুর পর সরকারের তরফে তাঁর প্যালেসটিতে মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়। দেশবিদেশের পেন্টিংস, আর্ট, স্কাল্পচার, টিপু সুলতানের ব্যবহৃত হাতির দাঁতের চেয়ার, ঔরঙ্গজেবের তরোয়াল, প্রাচীন পান্ডুলিপি এমন নানা অমূল্য সম্ভারের ভান্ডার এই মিউজিয়াম। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকে। শুক্রবার বন্ধ।
সালারজং-এর কাছেই হায়দ্রাবাদের আরেক আকর্ষণ চারমিনার (Char Minar)। ৫৬ মিটার উঁচু চারটি মিনারসহ হলুদরঙের তাজিয়াধরনের এই কাঠামোটি দূর থেকেই দেখা যায়। শোনা যায়, শহর থেকে প্লেগ দূরীকরণের স্মারকস্বরূপ ১৫৯৩ সালে মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ এই মিনারটি তৈরি করান। চারমিনারের উত্তরে চারকামান বা খিলান। কাছেই লাডবাজার। নানান ধরণের পোশাক-আশাক, সাজগোজের জিনিসপত্র, অ্যান্টিক-এইসব নিয়ে জমজমাট বাজারচত্বর। লাডবাজারের গায়ে অতীত ইতিহাসের সাক্ষী রাজপ্রাসাদগুলির ধ্বংসস্তূপ।
চারমিনারের কাছেই জামি ও মক্কা মসজিদ। চারমিনার থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে মির আলম ট্যাঙ্ক ও নেহরু জুলজিক্যাল পার্ক বা চিড়িয়াখানা। এখানে খোলা আকাশের নীচে স্বাভাবিক পরিবেশে জীবজন্তু দর্শন, বিশেষত লায়ন সাফারি পার্কে সিংহ দেখা এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। চিড়িয়াখানা সোমবার বন্ধ থাকে। হায়দ্রাবাদের আর এক আকর্ষণ রামোজি ফিল্ম সিটি (Ramoji Film City)। শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে দুহাজার একর বিস্তৃত জায়গায় এই স্বপ্নপুরীর অবস্থান। পাহাড়-পর্বত থেকে বন-জঙ্গল, বস্তি থেকে প্রাসাদপুরী-সিনেমার কল্পজগতে হারিয়ে যাওয়া কিছুক্ষণের জন্য। এরই ফাঁকে শুটিং দেখে নেওয়া। এনাডু পত্রিকার মালিক রামোজি রাও-এর পরিকল্পনার ফসল এই অভিনব চলচ্চিত্র শহর।
প্রাচীন ইতিহাসের পদচিহ্ন খুঁজতে হায়দ্রাবাদ থেকে আমলাসুর ও মেডক বেড়িয়ে নেওয়া যায়। হায়দ্রাবাদ থেকে মেডক ৯০ কিলোমিটার দূরে। মেডক থেকে আরও ১৫ কিলোমিটার গেলে পোকারাম ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি (Pokaram Wildlife Sanctuary)।
সেকেন্দ্রাবাদ(Secunderabad)- হায়দ্রাবাদ শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে যমজ শহর সেকেন্দ্রাবাদ। নিজাম সিকান্দার ঝা-এর নামে নামকরণ হলেও সেকেন্দ্রাবাদ গড়ে ওঠে ইংরেজদের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবেই। ইংরেজ আমলের হাসপাতাল, ক্লাব, সৈনিকবাস, রাষ্ট্রপতিভবন তার সাক্ষ্যবহন করছে। ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধকের আবিষ্কর্তা স্যর রোনাল্ড রস-এর বাড়িও রয়েছে এখানে। মহাকালী মন্দির ও কুতুবশাহি বংশের তৈরি লেকটি দর্শনীয়।
সেকেন্দ্রাবাদ থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১৭ সালে নিজাম মির ওসমান আলি খানের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে ওঠে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন হায়দ্রাবাদ ও সেকেন্দ্রাবাদ। বিমানবন্দর ১৬ কিলোমিটার দূরে বেগমপেট। বাসে, ভাড়াগাড়িতে বা ট্যুরিজমের প্যাকেজ ট্যুরে টুইন সিটি বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- হায়দ্রাবাদে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল তারামাটি বারাদরি। এছাড়াও হায়দ্রাবাদে ও সেকেন্দ্রাবাদে থাকার জন্য অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। হায়দ্রাবাদের এস টি ডি কোডঃ- ০৪০।
কেনাকাটা-হায়দ্রাবাদি মুক্তো বিখ্যাত। প্রসিদ্ধি আছে কলমকারি নক্সার। এই কাজের শাড়ি বা বেডকভার কেনা যায়। আর রয়েছে সুগন্ধি আতর।
খাওয়াদাওয়া- হায়দ্রাবাদে এসে বিরিয়ানির আস্বাদতো নিতেই হবে। স্থানীয় নিরামিষ পদও চেখে দেখা যায়।
ওয়ারাঙ্গাল(Warangal)- মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্তে কাকতীয় বংশের রাজধানী ওয়ারাঙ্গালের উল্লেখ পাওয়া যায়। তেলেগু সংস্কৃতির পীঠস্থান ওয়ারাঙ্গাল কাকতীয়দের আমলেই উন্নতির শিখরে ওঠে। হ্রদ, প্রাচীন মন্দির আর অরণ্যের টানে পর্যটকরা এখানে আসেন।
হানামকোন্ডার পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত তারকাকৃতি হাজার পিলার মন্দিরটির ভাস্কর্য অতুলনীয়। ১১৬৩ সালে কাকতীয় রাজা রুদ্রদেবের আমলে মন্দিরটি নির্মিত হয়। শিব, বিষ্ণু ও সূর্য-তিন দেবতার তিন মন্দির। চালুক্যশৈলীতে প্রস্তুত মন্দিরটির স্তম্ভের ও পাথরের জালির অসাধারণ কারুকার্য শিল্পরসিক দর্শককে মুগ্ধ করবে। একটিমাত্র পাথর কেটে তৈরি কালো ব্যাসল্টের নন্দীমূর্তিটিও অপরূপ।
হানামকোন্ডা ও ওয়ারাঙ্গালের মাঝে পাহাড়ের শিরে অষ্টভুজা ভদ্রকালী মন্দির। হানামকোন্ডা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ওয়ারাঙ্গাল দুর্গ। ১৩ শতকে কাকতীয়রাজ গণপতিদেব ও তাঁর কন্যা রুদ্রাম্মা দুর্গটি নির্মাণ করান। দুর্গের অনেকাংশই এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। দুর্গের চারপাশে পরিখার চিহ্ন বর্তমান।
ওয়ারাঙ্গাল থেকে হায়দ্রাবাদ যাওয়ার পথে ৮৮ কিলোমিটার দূরে ইয়াডিগিগুট্টায় জনার্দন, লক্ষ্মী ও নৃসিংহস্বামীর মন্দির। এর কাছেই কোলানুসাকায় একসময় চালুক্য রাজাদের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। শৈবপীঠস্থান কোলানুসাকা ‘বীর শৈব’ ধর্মের প্রবক্তা রেণুকাচার্যের জন্মস্থান। একসময় জৈনধর্মেরও প্রসার ঘটে এই অঞ্চলে। দুহাজার বছরের প্রাচীন জৈনমন্দিরটি তার সাক্ষ্যবহন করে চলেছে। মন্দিরে রাখা পাঁচ ফুট উচ্চ লেডপাথরের মহাবীরমূর্তিটি অসাধারণ। চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের নির্মিত সোমেশ্বরমন্দির ও শ্রীবীরনারায়ণ বিষ্ণুমন্দিরটিও বিশেষ দ্রষ্টব্য। কাকতীয় ও চালুক্য আমলের অপরূপ সব ভাস্কর্যের নির্দশন দেখা যাবে কোলানুসাকার সরকারি মিউজিয়ামটিতে।
ওয়ারাঙ্গালের আরেক আকর্ষণ পাখাল হ্রদ ও হ্রদকে ঘিরে পাখাল অভয়ারণ্য। বাঘ, চিতাবাঘ, ভালুক, হরিণ, হায়না প্রভৃতি নানা জীবজন্তুর দেখা মিলবে এই অরণ্যে। অক্টোবর থেকে মার্চ অভয়ারণ্য খোলা থাকে, শীতের সময়ে পরিযায়ী পাখিদের দেখা মিলবে পাখাল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে লাখবাজরম হ্রদে। ওয়ারাঙ্গাল থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এটুরুনাগরম স্যাংচুয়ারি। বেড়ানোর সময় অক্টোবর থেকে মে মাস।
ওয়ারাঙ্গাল থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে পালামপেটে কাকতীয় রাজা গণপতিদেব নির্মিত রামাপ্পা বা রামলিঙ্গেশ্বর মন্দিরের ভাস্কর্য অতুলনীয়। প্রতিষ্ঠাকালে কাটেশ্বর, কামেশ্বর এবং রুদ্রেশ্বর এই তিনটি শিবমন্দির ছিল এখানে। এখন শুধুমাত্র রুদ্রেশ্বর মন্দিরটি দন্ডায়মান। মন্দিরের কাছেই রামাপ্পা হ্রদ।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ওয়ারাঙ্গাল। বিমানবন্দর হায়দ্রাবাদের বেগমপেট। ওয়ারাঙ্গাল থেকে বাসে নরসামপেট পৌঁছে, সেখান থেকে ট্যাক্সি বা বাসে পাখাল যাওয়া যায়। ওয়ারাঙ্গাল থেকে বাসে রামাপ্পায় পৌঁছোনো যায়।
থাকাঃ- অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল ওয়ারাঙ্গাল ও অন্যান্য বেসরকারি হোটেল রয়েছে।ওয়ারাঙ্গালের এস টি ডি কোডঃ- ০৮৭০।
বিশাখাপত্তনম(Vizag / Vishakhapatnam)- সমুদ্র-পাহাড়ের মেলবন্ধনে ভারি সুন্দর শহর বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগ। অন্ধ্রপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। নীলসাগর, সোনালি বালুকাবেলা, সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়-ঠিক যেন পিকচার পোস্টকার্ড।
দেবসেনাপতি কার্তিকের আরেক নাম বিশাখস্বামী। একাদশ শতকে অন্ধ্রের রাজা যুদ্ধে জয়লাভের জন্য এইখানে মন্দির গড়ে বিশাখস্বামীর পূজো করেন। সেই থেকেই বিশাখাপত্তনম নামের উদ্ভব। ১৭৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয় এই শহর, নাম বদলে হয় ভাইজ্যাগ। ব্রিটিশের হাতেই জন্ম হয় যমজ শহর ওয়ালটেয়ারের (Waltair)।
বিশাখাপত্তনমের প্রধান আকর্ষণ শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে রামকৃষ্ণ বিচ (Ramkrishna Beach)। পাহাড়ের গা ঘেঁষে উথালপাথাল সমুদ্র। সৈকতে রয়েছে একটি কালীমন্দির। মন্দিরের পিছনে রামকৃষ্ণ মিশন।
শহর থেকে ৮কিলোমিটার দূরে ঋষিকোন্ডা বিচ (Rishikonda Beach)। ঝাউবন, পাহাড় আর সোনালি বালুকাবেলায় রমণীয়। এখানে বোটে সমুদ্রবিহারের ব্যবস্থা আছে।
বিশাখাপত্তনমের অন্যান্য আকর্ষণীয়ের মধ্যে রয়েছে সাবমেরিন মিউজিয়ামটি। ভারতের প্রথম সাবমেরিনটির কলাকৌশল দেখতে ঢুঁ মারতে হবে এখানে। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশাখা মিউজিয়ামে ঢুকলে অন্ধ্রের অতীত ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করা যাবে।
হাতে একটু বেশি সময় রেখেই বিশাখাপত্তনম ঘোরা ভালো। একে একে দেখে নেওয়া যায় রোজ হিলে রোমান ক্যাথলিক গির্জা, দুর্গকোন্ডায় মসজিদ, ভেঙ্কটেশকোন্ডায় ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দির। পাশাপাশি এই মিশ্র ধর্মসংস্কৃতির সহাবস্থান যেন ভারতবর্ষেরই প্রকৃত চিত্র। ডলফিন নোজ পয়েন্ট লাইট হাউসের চুড়ো থেকে নীলসাগরের অপরূপ রূপ অনুভব করা এক দারুন অভিজ্ঞতা। ঠিক তেমনি আরেক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা কৈলাসগিরি বা মাউন্ট কৈলাসের শিখর থেকে সাগরের রূপমালা দর্শন।
বিশাখাপত্তনম আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি নির্মিত পার্কটি ছোট-বড়ো সবার কাছেই দারুন আকর্ষণীয়। হাতে বাড়তি একটা দুপুর-বিকেল থাকলে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় এখানে। বিশাখাপত্তনমের আরেক বেলাভূমি ভীমানিপতনম বা ভিমিলি ঋষিকোন্ডা ছাড়িয়ে। শহর থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। লাইটহাউস, ডাচদুর্গের ভগ্নাবশেষ, নৃসিংহ মন্দির, সীতাকুণ্ড পায়ে পায়ে বেড়িয়ে নিন। ভিমিলি যাওয়ার পথে বভিকোন্ডা ও থোতলাকোন্ডায় বৌদ্ধবিহার, চৈত্য ও স্তূপের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। পাখি দেখতে যেতে হবে শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে কোন্ডাকারলায়।
বিশাখাপত্তনম থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে নৃসিংহদেবের মন্দিরের জন্য খ্যাত সীমাচলম (Simhachalam Temple)। চতুষ্কোণ আকারের কারুকার্যময় এই মন্দিরটি চোলস্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন বিশাখাপত্তনম। শহর থেকে ১২ কিলোমিটার বিমানবন্দর। কন্ডাক্টেড ট্যুরে বিশাখাপত্তনম, আরাকু ভ্যালি ও আশেপাশের দ্রষ্টব্য বেড়িয়ে নেওয়া যায়। আশেপাশের শহর ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মধ্যে সড়কপথেও যোগাযোগ রয়েছে বিশাখাপত্তনমের।
থাকাঃ- বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগে অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল হরিতা। এছাড়া অনেক বেসরকারি হোটেল রয়েছে। বিশাখাপত্তনম বা ভাইজ্যাগের এস টি ডি কোডঃ- ০৮৯১।
আরাকু ভ্যালি(Araku Valley)- ওক, পাইন, ইউক্যালিপ্টাসে ছাওয়া সবুজ পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আদিবাসী গ্রাম, আর রাঙামাটির পথ নিয়ে সুন্দরী উপত্যকা আরাকু। বিশাখাপত্তনম থেকে দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। ১,১৬৬ মিটার উচ্চতায় স্নিগ্ধ এই ভ্যালির গা ঘেঁষে মেঘেরা গাভির মতো চরে। নির্জন প্রকৃতির মনোহর রূপের মায়াতেই এখানে কয়েকটা দিন কাটিয়া দেওয়া যায়। ৭ কিলোমিটার দূরে ডুম্বুরিগুডা জলপ্রপাত। বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকু আসার পথে অনন্তগিরি পাহাড় ও চুনাপাথরের গুহা। কফির জন্যও খ্যাতি অনন্তগিরির।
বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকুর পথে আরাকুর ৩৪ কিলোমিটার আগে স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইটের প্রাকৃতিক শিল্পকার্যে ভরা রহস্যময় বোরা গুহা (Bora Caves)। এই যাত্রাপথটি ভারি সুন্দর, পথে প্রায় ৫০টি টানেল পড়বে। একশো আঠেরোটি সিঁড়ি ভেঙে চল্লিশ মিটার গভীর গুহার ভিতরে অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করতে হবে। বিদ্যুতের স্বল্প আলোয় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সৃষ্ট শিবলিঙ্গ আর দেবদেবীর আকৃতি দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। সঙ্গে টর্চ থাকলে ভালো। বর্ষায় কিন্তু গুহার অন্দরে নদীর জল ঢোকে।
আরাকু থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে টায়ডা নেচার ক্যাম্প বনপ্রেমীদের জন্য আদরণীয়।
যাওয়াঃ- বিশাখাপত্তনম থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে, বাসে বা ভাড়াগাড়িতে আরাকু ও বোরা গুহা বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- আরাকুতে সরকারি হোটেল ময়ূরী ও বেশকিছু বেসরকারি হোটেল রয়েছে । আরাকুর এস টি ডি কোডঃ ০৮৯৩৬।
তিরুপতি(Tirupati)- হায়দ্রাবাদ থেকে ৫২৫ কিলোমিটার দূরে হিন্দুতীর্থ তিরুপতির অবস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের দক্ষিণপ্রান্তে। পূর্বঘাট পর্বতমালার সাতপাহাড়ের পাদদেশে তিরুপতি শহর। প্রচলিত লোককথা, এই সাতপাহাড় বিষ্ণুর শয্যা শেষনাগের সাতটি ফণা। মন্দিরশহর তিরুমালার অবস্থান একটি পাহাড়ের চূড়োয়। সোনার পাতে মোড়া এই মন্দিরটিই বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী মন্দির।
তিরু শব্দের অর্থ লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর পতি অর্থাৎ ভেঙ্কটেশ্বর স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু। একশো কিলোগ্রাম সোনায় মোড়া গর্ভগৃহে পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে চতুর্ভুজ দেবতা, নানা আবরণ ও রত্নখচিত মুকুট পরা। দেবতার চোখদুটি ঢাকা। মন্দিরে আছে দেবতার দুই স্ত্রী-শ্রীদেবী ও ভূদেবী। প্রচলিত লোককথা, দেবতা ভেঙ্কটেশ্বর বিয়ের সময় কুবেরের কাছে অর্থ ধার করেছিলেন। ভক্তেরা আজও সেই ধার শোধ করছেন। পুজো দেওয়ার নানা পদ্ধতি আছে। অন্নপ্রসাদও মেলে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। প্রসাদ কিনতেও পাওয়া যায়।
মন্দির থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পাপবিনাশম তীর্থ। ৩ কিলোমিটার দূরে আকাশগঙ্গা ঝরনা। তিরুপতি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে হিলস্টেশন হর্সলে হিল। শাল, সেগুন, দেবদারু, ইউক্যালিপ্টাসে ছাওয়া মনোরম পরিবেশ। উৎসাহীরা নেমে পড়তে পারেন নানান অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে, নইলে নিভৃতে নির্জনে কাটিয়ে দিন কয়েকটা দিন। ১৩৮ কিলোমিটার দূরে ভেঙ্কটেশ্বর ন্যাশনাল পার্ক। পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে আসতে পারেন মামানদুরু থেকে। পেনুকোন্ডায় বিজয়নগর রাজাদের চন্দ্রগিরি দুর্গ ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ ফেলে আসা ইতিহাসের গল্প শোনাবে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর তিরুপতি। চেন্নাই থেকে দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার।
থাকাঃ- অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল তিরুপতি ও অন্যান্য বেসরকারি হোটেল । তিরুপতির এস টি ডি কোডঃ ০৮৭৭।
বিজয়ওয়াড়া(Vijayawada)- অন্ধ্রপ্রদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর বিজয়ওয়াড়া অন্যতম একটি পর্যটনকেন্দ্র। পশ্চিমে ইন্দ্রকিলাদ্রি পাহাড় ও উত্তরে বুদামেরু নদী শহরকে বেষ্টন করে রয়ছে। হায়দ্রাবাদ থেকে দূরত্ব ২৭৫ কিলোমিটার।
বিজয়ওয়াড়া শব্দের অর্থ বিজয়ের স্থান। কিংবদন্তি আছে, এখানেই তপস্যায় শিবকে সন্তুষ্ট করে পাশুপতি অস্ত্র লাভ করেছিলন অর্জুন। আরেক গল্প বলে, মহিষাসুরবধের পর ক্লান্ত দেবীদুর্গা এখানেই বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ইন্দ্রকিলাদ্রি পাহাড়ের চুড়োয় কনকদুর্গার মন্দির।
কৃষ্ণানদীর উপরে ১,২২৩.৫ মিটার দীর্ঘ প্রকাশম বাঁধটিও দ্রষ্টব্য। বাঁধসৃষ্ট লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে। প্রকাশম ব্যারেজ লাগোয়া পাহাড়ের ঢালে উন্ডাভাল্লি গুহায় অনন্তনাগের উপর উপবিষ্ট ৫ মিটার উঁচু বিষ্ণুমূর্তিটি পল্লবশৈলীর অপরূপ কীর্তির পরিচায়ক। শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে রাজীব গান্ধী পার্ক, গান্ধী হিল প্রভৃতি। শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মঙ্গলাগিরিতে নৃসিংহদেবের ও ৩ কিলোমিটার দূরে সীতানগরে সোমেশ্বরস্বামীর মন্দিরদুটিও প্রসিদ্ধ। অন্ধ্রের বিখ্যাত কোন্দাপাল্লি পুতুলের কারিগরদের ঠিকানা বিজয়ওয়াড়া থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কোন্দাপল্লিতে (Kondapally)। কাঠের রংচঙে পুতুল অন্ধ্রভ্রমনের স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করতে পারেন।
বিজয়ওয়াড়াকে কেন্দ্র করে কাছেদূরের বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে নেওয়া যায়। বিজয়ওয়াড়া থেকে ৬৪ কিমি দূরে মন্দিরময় দ্বারকা তিরুমালা। শ্রীভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরটি প্রধান। অন্ধ্রের সংস্কৃতির অন্যতম পরিচয় কুচিপুরি নৃত্য। কুচিপুরি নৃত্যের স্রষ্টা সিদ্ধেন্দ্রযোগীর জন্মভূমি কুচিপুরি গ্রাম বিজয়ওয়াড়া থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে। যোগীর বাসভবন এখন কুচিপুরি নৃত্যের স্কুল। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে এখানে কুচিপুরি ডান্স অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সিদ্ধেন্দ্রজয়ন্তী উৎসব হয়। ৬৫ কিলোমিটার দূরে কোল্লেরু পাখিরালয় শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের ঠিকানা। প্রায় ৪০কিমি দূরে মছলিপত্তম হয়ে ১১কিমি উত্তরে মানগিডাপুডি সৈকত।
বিজয়ওয়াড়া থেকে ৮২ কিমি দূরে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির অতীত পিঠস্থান ইতিহাসের অমরাবতী। সাতবাহন রাজাদের রাজধানী এই শহরটি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে গড়ে ওঠে। ১০০ কিমি দূরে নির্জন সূর্যলঙ্কা সৈকত।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর বিজয়ওয়াড়া। বিমানে গেলে হায়দ্রাবাদ হয়ে যেতে হবে। হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই প্রভৃতি দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে সড়কপথে বিজয়ওয়াড়ার যোগাযোগ রয়েছে। বিজয়ওয়াড়া থেকে কাছেদূরের জায়গাগুলিতে ট্যাক্সি, বাস বা লোকাল ট্রেনে পৌঁছানো যাবে।
থাকাঃ- বিজয়ওয়াড়ায় অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল বিজয়ওয়াড়া ও অন্যান্য বেসরকারি হোটেল । দ্বারকা তিরুমালা, অমরাবতী ও সূর্যলঙ্কায় সরকারী ব্যাবস্থাপনায় থাকা যায়। বিজয়ওয়াড়ার এস টি ডি কোডঃ ০৮৬৬।
রাজামাহেন্দ্রী(Rajamahendri)- গোদাবরীর পশ্চিম তীরে সবুজ ধানখেত, নারকেল গাছে ছাওয়া ছবির মতো সুন্দর শান্ত জনপদ রাজামাহেন্দ্রী। পূর্ব গোদাবরী জেলার এই শহরটি প্রকৃতিপ্রেমিক, ইতিহাসপ্রেমী বা পুণ্যার্থী সবার কাছেই আকর্ষণীয়। নানান রাজনৈতিক পালাবদলের ভিতর দিয়ে ১০২২ খ্রীষ্টাব্দে চালুক্যরাজ রাজা নরেন্দ্রর অধীনে আসে রাজামাহেন্দ্রী। রাজা নরেন্দ্রর প্রাসাদ আর দুর্গের ভগ্নাবশেষ আজও রয়েছে। রাজামাহেন্দ্রীর আরেক আকর্ষণ কোটিলিঙ্গেশ্বর শিবের মন্দির। বারো বছর অন্তর গোদাবরীর তীরে বারোদিন ধরে চলে গোদাবরী পুক্করালু উৎসব। জনশ্রুতি, এইসময় গোদাবরীতে পুণ্যস্নানে পাপক্ষয় হয়। এই সময় লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাবেশে সেজে ওঠে শহর।
অন্ধ্র পর্যটনের উদ্যোগে গোদাবরী নদীতে বোটিং-এর ব্যবস্থা হয়ছে। গোদাবরীর বুক থেকে পাপি পাহাড় আর পাউসীমার সৌন্দর্য অসাধারণ।
রাজামাহেন্দ্রীর আরেক আকর্ষণ গোদাবরী নদীর উপর এশিয়ার বৃহত্তম রেলসড়ক সেতু। গোদাবরী ব্যারেজের কাছে ছোটো দ্বীপ শ্রীলঙ্কা।
রাজামাহেন্দ্রীতে অনেকগুলি নার্সারি রয়েছে। নানা দুর্লভ প্রজাতির ফুলের গাছের দেখা মিলবে এখানে। শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে পাপিকোন্ডা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ও ৭০ কিলোমিটার দূরে কোরিঙ্গা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। রাজামাহেন্দ্রী থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে ট্যুরিস্ট স্পট ডিনডি থেকে আরেকটু এগিয়ে গোদাবরী নদীর বদ্বীপে অবস্থিত অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনাসীমা বেড়িয়ে নেওয়া যায় হাঊসবোটে ।
যাওয়াঃ-নিকটতম রেলস্টেশন হাওড়া-চেন্নাই রেলপথে বিশাখাপত্তনম ও বিজয়ওয়াড়ার মাঝে রাজামাহেন্দ্রী। বিশাখাপত্তনম ও বিজয়ওয়াড়া থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ২০৯ ও ১৫০ কিলোমিটার।
থাকাঃ- রাজামাহেন্দ্রীতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
রাজামাহেন্দ্রীর এস টি ডি কোডঃ ০৮৮৩।
নাগার্জুনকোন্ডা (Nagarjunkonda) - ইতিহাসের শহর নাগার্জুনকোন্ডা। একসময় দাক্ষিণাত্যের অন্যতম একটি বৌদ্ধধর্মকেন্দ্র ছিল এই শহর। আজও স্তুপ, বিহার, চৈত্যের ভগ্নাবশেষ প্রাচীন বিজয়পুরীর গল্প শোনায়। বৌদ্ধ আচার্য নাগার্জুনের নাম থেকেই শহরের নামকরণ। ‘কোন্ডা’ শব্দের অর্থ পাহাড়। সাতবাহনরাজ বিজয় সাতকর্ণীর হাতে নগরের পত্তন হলেও ইক্ষবাকু বংশের আমলে তা উন্নতির শিখরে পৌঁছোয়। এইসময়েই বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে। প্রশস্ত বৌদ্ধবিহার, সম্রাট অশোক নির্মিত মহাচৈত্য, বিশ্ববিদ্যালয়, বুদ্ধের নানা মূর্তি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। নাগার্জুন পাহাড়ের মিউজিয়ামটিও দর্শনীয়।
শহরের আরেক আকর্ষণ কৃষ্ণানদীর উপর বিশ্বের উচ্চতম বহুমুখী বাঁধ। বাঁধসৃষ্ট নাগার্জুনসাগর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম লেক। শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে ইথিপোথালা জলপ্রপাত। অক্টোবর থেকে জুন মাসের মধ্যে গেলে নাগার্জুনসাগরে শ্রীশৈলম টাইগার রিজার্ভ-ও বেড়িয়ে আসা যায়।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন বিজয়ওয়াড়া। হায়দ্রাবাদ বা বিজয়ওয়াড়া থেকে বাসে ঘন্টাপাঁচেকের দূরত্বে নাগার্জুনকোন্ডা।
থাকাঃ- নাগার্জুন সাগরে এ পি ট্যুরিজমের হোটেল বিজয়বিহার। নাগার্জুনকোন্ডার এস টি ডি কোডঃ- ০৮৬৮০।
নেল্লোর(Nellore)- প্রাচীন মন্দিররাজি আর নেল্লাপট্টি বার্ড স্যাংচুয়ারি নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের অফবিট ট্র্যাভেলস্পট নেল্লোর। শহরের মধ্যেই রয়েছে ৫০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন ভল্লাগিরি রঙ্গনাথস্বামী মন্দির। মন্দিরের প্রথম প্রবেশদ্বারে ২ মিটার উঁচু গোলিগোপুরম। মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ আয়নাঘর। দেবতার অজস্র প্রতিবিম্ব মুগ্ধ করে দর্শককে। আর রয়েছে ভেনুগোপালস্বামী মন্দির, আয়াপ্পামন্দির, কুমারস্বামী মন্দির, সাঁইবাবা মন্দির। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ভেঙ্কাইয়াস্বামীর মন্দির, ২৫ কিলোমিটার দূরে জোন্নাওয়াড়াতে কামাখ্যাদেবীর মন্দির, ৩১ কিলোমিটার দূরে রামলিঙ্গেশ্বর স্বামীর মন্দির, ১০ কিলোমিটার দূরে পাল্লিপাড়ুতে মহাত্মা গান্ধির আশ্রম।
ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম লবণাক্ত জলের হ্রদ পুলিকাট। শীতের দিনে ফ্লেমিঙ্গো, গ্রে পেলিক্যান, হেরন, টার্নের মতো পরিযায়ী পাখির দল ভিড় জমায় এখানে। হ্রদের বুকে জলবিহার করে আর আতাকানিথিপ্পা ওয়াচটাওয়ার থেকে নেওয়া যায় পাখির খাতার পাঠ।
পুলিকাট নদীর পাড়ে ৪৮৬ বর্গকিলোমিটার জুড়ে নেল্লাপাট্টি বার্ড স্যাংচুয়ারি। আমেরিকা, চিন, আন্টার্কটিকা থেকে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখি এখানে আসে। সংলগ্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চলে রয়েছে শেয়াল, স্লেন্ডার লরিস আর স্পটেড ডিয়ার। ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে ফ্লেমিঙ্গো উৎসব হয়। মোহময়ী মাইপাডু সৈকত আর ভেঙ্কটগিরি শাড়ির জন্য খ্যাত ভেঙ্কটগিরি শহর। নেল্লোর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মাইপাডু গ্রাম।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন নেল্লোর। নিকটতম বিমানবন্দর চেন্নাই।
থাকাঃ- নেল্লোরে থাকার জন্যে বেসরকারি হোটেল আছে। অন্ধ্রপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল রয়েছে মাইপাডুতে । নেল্লোরের এস টি ডি কোডঃ- ০৮৬১।
লেপাক্ষী (Lepakshi) -কর্ণাটকের লাগোয়া অন্ধ্রপ্রদেশের সীমান্তবর্তী জেলা অনন্তপুর। হিন্দুপুর তারই একটি তহশিল শহর। দক্ষিণের অজন্তা নামে খ্যাত লেপাক্ষী এই হিন্দুপুর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার। লেপাক্ষী গ্রামটি বিখ্যাত তার বীরভদ্রমন্দিরের জন্য। পুরাণ, ইতিহাস, লোকগাথা মিলেমিশে এখানে একাকার। দক্ষিণ ভারতের অনেক মন্দিরের মতো এই মন্দিরটিরও প্রতিষ্ঠাতা আদিকালের সেই অগস্ত্যমুনি। একখন্ড কূর্মাকৃতি শিলার উপর পাপনাশক শিবের সাবেকি মন্দিরটি ছিল অতি সাধারণ, কিন্তু জাগ্রত।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বিজয়নগর রাজাদের আমলে হিন্দুপুর ও তার সন্নিহিত অঞ্চল ছিল ব্যাবসা-বাণিজ্যের বড়ো কেন্দ্র। ১৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দে তালিকোটার যুদ্ধে হাম্পি শহরের পতন ঘটলেও আরবিডু রাজবংশের অন্য আরেক শরিক পেনুকোন্ডায় বসে তার পরেও দীর্ঘদিন রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। রাজা তিরুমলের একজন প্রভাবশালী অমাত্য ছিলেন, নাম নন্দীলক্ষ্মী সেট্টি। তাঁর দুই সুযোগ্য পুত্র বিরুপন্ন নায়েক ও বিরন্ন ছিলেন এ অঞ্চলের পদস্থ শাসন আধিকারিক। তাঁদের আদর্শ ছিলেন দশম শতকের আরেক পরাক্রমশালী নৃপতি, চোলসম্রাট রাজারাজা। রাজারাজা ছিলেন ধ্বংসের দেবতা ত্রিপুরান্তকের উপাসক। তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই দুই ভ্রাতাও আরেক বিনাশকারী শক্তি বীরভদ্রের একনিষ্ঠ সেবক হন। তাঁরা পাপনাশক শিবমন্দিরের উপর নতুন মন্দির নির্মান করে উৎসর্গ করেন বীরভদ্রের নামে। মন্দিরের গায়ে উৎকর্ণ লিপি থেকে জানা যায় বিজয়নগরের রাজা অচ্যুতরায়ের রাজত্বকালের শেষভাগে, ১৫৩৮ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়।
মন্দিরটি কিন্তু বিরুপন্ন করে যেতে পারেননি। কেন পারেননি, সেবিষয়ে ইতিহাস নীরব। জনশ্রুতি ও লোকগাথায় অবশ্য একটা হেতু মেলে। এতবড়ো একটা মন্দির নির্মাণ করতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রচুর অর্থের। সম্ভবত পদাধিকারবলে রাজকোশ থেকে সে অর্থের জোগান মঞ্জুর করে থাকবেন বিরুপন্ন। এর পরিণাম যা হয় আর কী, রাজকোশ তছরূপ করে মন্দিরের নির্মাণকাজ চলছে, খবরটা রাজার কানে পৌঁছে দিল ক্ষমতালোভী আরেক অমাত্য। সেসময়ে বিজয়নগর রাজ্যে কোনও অপরাধের শাস্তিবিধান ছিল খুবই নির্দয়। কৃতকর্মের আশুপরিণাম ভবে ভয় পেয়ে গেলেন বিরুপন্ন। নিজেই প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করলেন। নিজের হাতে চোখদুটি উপড়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন কল্যাণমন্ডপের পশ্চিমদিকের প্রাকারের গায়ে। শ্যাওলাধরা দেয়ালের গায়ে অস্পষ্ট হয়ে আসা পাটকেল রঙের দাগদুটি ছলছলে হয়ে ওঠে। লোকে বলে, বিরুপন্ন তাকিয়ে আছেন তাঁর অপূর্ণ সাধের পানে। সেই থেকে লেপা-অক্ষি>লেপাক্ষী-অন্ধজনের গ্রাম।
মন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে ধরবার উপায় নেই যে ভিতরে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা-শিল্পের এ ত্রিধারার কী অপূর্ব সমন্বয় অপেক্ষা করে আছে! পাথুরে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সাদামাঠা প্রবেশপথের উপর গোপুরমের আর যৎসামান্যই অবশিষ্ট। বেশর শিল্পরীতিতে তৈরি মূল মন্দিরের তিনটি ভাগ। সামনে ৩৮টি কারুকার্যমন্ডিত পিলারশোভিত নাটমন্ডপ। তারপর সংক্ষিপ্ত অপেক্ষাকৃত অর্ধ্মন্ডপ ও সবশেষে অন্তরাল। বিজয়নগরীয় ঘরানার নিদর্শন হিসেবে মন্দিরের ডানদিকে অসমাপ্ত কল্যাণমন্ডপ। পিছনের দিকে নাগলিঙ্গ।
দর্শনার্থী নাটমন্ডপে এসে দাঁড়ালে স্বভাবতই নজর চলে যাবে ঊর্ধ্বপানে, সিলিংয়ের দিকে। এ হল সেই বিচিত্র চিত্রে রঞ্জিত পটমন্ডপ, যার জন্য কলারসিকরা ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। প্রায় শতবর্ষ আগে, ১৯১২ সালে এ এইচ লংগহার্স্ট বিস্মৃতপ্রায় লেপাক্ষীর কথা জনসমকক্ষে নতুন করে তুলে ধরেন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থা আর নেওয়া হল কোথায়, বরং উদাসীনতায় ঐতিহ্যশালী সম্পদ আজ ধ্বংসের মুখে। ছাদে ফাটল ধরেছে। আলসের ঢেউ খেলানো কিনারা উপচে বর্ষার জল ছবির মধ্যে চলে আসে।
পটমন্ডপের সিলিংকে ক্যানভাসের মতো করে আয়তক্ষেত্রিক বিভাজন ঘটিয়েছেন শিল্পীরা। ছবির ধূসর খসড়ালিপি থেকে উজ্জ্বল চিত্রলিপির বর্ণানুক্রমিক ফিরিস্তি দেওয়া অল্পপরিসরে সম্ভব নয়। বরং মুখ্য ছবিগুলির কথাই বলি। মাঝখানে খুব বড়ো করে আঁকা বীরভদ্র। প্রজাপতিদক্ষের যজ্ঞস্থলে সতী পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করলেন। ভোলামহেশ্বর মহাক্রোধে নিজের জটাজুট ছিন্ন করে সৃষ্টি করেন বীরভদ্র। দক্ষের বিনাশকারী। বীরভদ্রের পদপ্রান্তে করজোড়ে দণ্ডায়মান সেই সেবক দুই ভ্রাতা, বিরুপন্ন আর বিরন্ন। পরনে ডোরাকাটা পিরান, মাথায় মোচাকৃতি শিরোপা। মহাভারতে অনেকগুলি খণ্ডচিত্র পরপর চিত্রিত। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, অর্জুনের তপস্যা, কিরাতরূপী মহাদেব আর অর্জুনের দ্বন্দ্ব, অর্জুনকে পাশুপত অস্ত্রপ্রদান উল্লেখযোগ্য। রামায়ণ থেকে নেওয়া রামচন্দ্রের বিবাহ, অভিষেক, বনবাসযাত্রার আখ্যানভাগ। যেহেতু শিবের মন্দির, শৈবচিত্রের আধিক্যই লক্ষ্য করা যায়। কল্যাণসুন্দর, ভিখারিবেশী শিব, হরপার্বতীর দ্যুতক্রীড়া, কল্পতরু শিব, শিবের দক্ষিণারূপ, বিবাহ, হরিহর প্রভৃতি এ চিত্রশালার খাজানা। কিছু বৈষ্ণবচিত্রও আছে।
সুরলোকের নিরবচ্ছিন্ন সুখের বারমাস্যা নেমে এসেছে নাটমণ্ডপের স্তম্ভে স্তম্ভে। নৃত্যগীতবাদনে সেইসব সুনিপুণ অমাত্যগণের উপস্থিতি ঘটেছে যাঁদের নাম কলাবিদ্যা রচনাপ্রাতে শাস্ত্রকাররা স্মরণ নিয়ে থাকেন। মৃদঙ্গবাদনে বিরিঞ্চিদেব, গগনচারীগন্ধর্বের হাতে বীণা, শিবের অনুচর নন্দিকেশ্বর বাজাচ্ছেন হুড়ক্ক, মন্দিরা স্বয়ং সেই নটশ্রেষ্ঠর হাতে যাঁর নির্দেশে উর্বশী-রম্ভারা চপলচরণে চৌতালে তাল মেলাচ্ছেন।
সালংকারা রমণীদের চিত্রগুলি সমসাময়িক বেশভূষার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। কারও চুল বিনুনি করা, কারওবা কবরী বাঁধা। মাথায় টিকলি, গলায় হার, হাতে চুরি, পায়ে পাঁয়জর। চওড়া পাড়ের ডুরেশাড়ি মদ্রদেশীয়দের মতো করে কোঁচা দিয়ে পরা। আজও অন্ধ্রপ্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তন্তুবায়রা লেপাক্ষীর মন্দিরে ছুটে আসেন, ছশো বছর আগে আঁকা লতাপাতার বুনোট নকশা সংগ্রহ করতে, যা শাড়ির জমিতে ফুটিয়ে তোলেন। তখনকার দিনে মেয়েদের বক্ষদেশ উন্মুক্ত থাকলেও, ছেলেরা কিন্তু আস্তিন দেওয়া জামা পরত। আরেকটি ছবি-ও উল্লেখ্য - অন্ধকাসুর বধ। অর্ধমণ্ডপের তমসাচ্ছন্ন স্থানে থাকা সত্ত্বেও চিত্রটির রসগ্রাহিতা অন্য মাত্রা দাবি করে।
লেপাক্ষীর ফ্রেস্কোচিত্র রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রিত হলেও বারবার ছুঁয়ে গেছে লোকায়ত শিল্পের সারল্য। আলোছায়া বা পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োগ সেভাবে লক্ষ করা না গেলেও পটচিত্রের আদলে বলিষ্ঠ রেখায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবির নির্মিত। অজন্তাচিত্রের নমনীয়তা এখানে অনুপস্থিত, বরং বলা যায় গুজরাটি শৈলীর জৈনচিত্রের প্রভাব সুস্পষ্ট। এটি আরও পরিষ্কার প্রোফাইল ফিগারগুলিতে। প্রকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি রং ব্যবহার করা হয়েছে।
গর্ভগৃহে শিব আর বিষ্ণুর বেদি মুখোমুখি, মাঝখানে বীরভদ্র।
অনাচ্ছাদিত কল্যাণমন্ডপটির ২৮ খানা স্তম্ভ যেন স্তম্ভ নয়, হরপার্বতীর বিবাহে উপস্থিত দেবতাগণ কোনও অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনে এখন প্রস্তরীভূত। কোন্ডালাইটের কঠিন গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে লতা-পাতা-ফুলের নানান মোটিফ। সমবায়বিন্যাসের ভিত্তিতে শিল্পীরা পরীক্ষা করেছেন বিভিন্ন ফর্ম নিয়ে। যেমন হাতি আর বৃষের একটি মাথা, তিনটি হরিণের মাথা একটি, মানুষের ক্ষেত্রেও তাই-তিনটি লোকের একটি মাথা। এ ধরনের ইলউসিভ ফিগার বহু। গর্ভগৃহের পিছনের দিকে দেখতে পাওয়া যাবে সুবৃহৎ ফণাযুক্ত নাগলিঙ্গ। সপ্তমুখী ফণা ছাতার মতো বিস্তৃত। উরগভূষণের বিরাটত্বের নীচে নিরাভরণ শিবের রূপটি মনোগ্রাহী।
মন্দির থেকে বেরিয়ে কাদরিমুখী রাস্তা ধরে ২০০ মিটারের মতো এগোলে, উত্তর-পূর্ব কোণে দর্শন মিলবে লেপাক্ষীর বিখ্যাত বিগবুল বা নন্দীর। বিক্ষিপ্ত উপলখণ্ডার মাঝে নন্দীর সদম্ভ উপস্থিতি চোখ চেয়ে দেখবার মতো। খোলা জায়গায়, রোদ-জলে এতবড়ো মনোলিথিক শিল্পকর্মটির পেলবতা বেড়েছে বই কমেনি। ঋজুদৃপ্ত ভঙ্গিতে পদচতুষ্টয় মুড়ে বসা। বৃষস্কন্ধ ঘিরে সারিবদ্ধ ঘন্টার মালা। ব্যজনীর মতো পিঠের পরে লুটানো পুচ্ছ রোম। সম্ভবত এটিই দক্ষিণের সবচেয়ে বড়ো বলীবর্দ (৩০ ফুট লম্বা, আর উচ্চতা ২০ ফুট)।
যাওয়াঃ- লেপাক্ষী যেতে হলে ট্রেনে বেঙ্গালুরুতে আসতে হবে। বেঙ্গালুরু থেকে হিন্দুপুরে যাওয়ার ঘনঘন বাস। সড়কপথে দূরত্ব ১৩৬ কিলোমিটার। অবশ্য বেঙ্গালুরুর-গুন্টাকল শাখার রেলেও হিন্দুপুর যাওয়া যেতে পারে। হিন্দুপুর থেকে লেপাক্ষী, এই ১৫ কিলোমিটার পথ বাসে বা অটোয় চেপে যেতে হবে।
থাকাঃ- হিন্দুপুরে সাধারণ মানের বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। লেপাক্ষীতেও পান্থশালা আছে।