এ জীবন পুণ্য করো

অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

~ তথ্য- বেনারস (উত্তরপ্রদেশ) ~ || ~ বেনারসের ছবি ~


শ্বেত পাথরের থালার মতো চাঁদটা কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। অথচ রাস্তায় এখনও স্ট্রিটলাইটই ভরসা। হোটেলের তিনতলার বন্ধ ঘরটা থেকেই মানুষের যাতায়াত বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে আবার সমবেত জোরালো কন্ঠে ভোলা মহেশ্বরের জয়ধ্বনি। গত তিনদিন ধরেই চলছে এমন উৎসবের রেশ। আজ সেই পরমলগ্ন। কার্তিক পূর্ণিমায় গঙ্গামহোৎসব। বারাণসীর পিচ ঢালা রাস্তা রাত তিনটে–সাড়ে তিনটে থেকেই ঢাকা পড়েছে ভক্তমানুষের ভিড়ে। কাতারে কাতারে লোক চলেছে দলবেঁধে। হাতের মুঠোয় পুঁটলি–প্যাকেটে শুদ্ধবসন। স্নান সেরে পরতে হবে যে। কাঁখে শিশু, পাশে প্রিয়জন, মুখে চাপা স্বরে অনবরত ‘ওঁ নমঃ শিবায়’। আজ রহিস–ধনীর সাথে অনাথ-আতুর মিলে গেছে বারাণসীর রাজপথে। এক ফাঁকে আমি আর ছোট ভাই বুকানও মিশে গেলাম জনস্রোতে। ভিড়টা একই দিকে যাচ্ছিল বলে অত লোকের মাঝেও হাঁটতে কোনও অসুবিধা হল না। ওদের লক্ষ্য গঙ্গার পুণ্যবারিতে ধর্মস্নান, আর আমার ইচ্ছে মানুষের এই মহামিলন মেলার মূহুর্তগুলোকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করে রাখা। গোধূলিয়া মোড় থেকে বাঁহাতে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে বেঁকতেই ভিড়টা যেন আরও তিনগুণ বেড়ে গেল। জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে ঘাটের কিনারায়।
ততক্ষণে আকাশটা বেশ ফর্সা হয়েছে। তবে দিনের সোনা তখনও দিগন্তের আড়ালে। এই শীতল ঊষাকালই পুণ্যস্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ। ইতিমধ্যে বহু মানুষই ডুব দিয়েছেন পতিতপাবনীর তরঙ্গে। সিঁড়ির ধাপে ধাপে সারি বাঁধা আতুর চোখের মিছিল। সামনে সাজানো শূন্য ভিক্ষাপাত্র। কোনও কোনও পাত্রে কিছুটা চাল আর পাঁচ-ছটা খুচরো পয়সা। কেউ আবার ভষ্ম মেখে ত্রিশূল হাতে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির চাতালটায়। অপেক্ষা কোনও জলজ্যান্ত অন্নপূর্ণার।
হাওড়া স্টেশনে যেমন কুলি বা ট্যাক্সির খোঁজ করতে হয় না, উল্টে তারাই খোঁজ করে নেয় যাত্রীর। তেমনি আমাদেরও কোনও মাঝির খোঁজ করতে হল না। তবে দাম যা হাঁকল তাতে দমটা বন্ধ হয়ে যায় আর কি। এক ঘন্টা নৌকোভ্রমণ সাড়ে চারশো। বিকেলে এই রেটই নাকি আড়াই হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে, সাংঘাতিক! খানিক দরাদরি করার পর বউনির খাতিরে সাড়ে চারশো কমে সাড়ে তিনশোয় দাঁড়ায়। অবিশ্যি আর পাঁচজন যাত্রীর সঙ্গে গেলে মাথাপিছু অনেক কমই পড়ত। কিন্তু আমি আর ভাই গোটা একটা নৌকো ভাড়া করলাম একঘন্টার জন্য। এর মধ্যে মানমন্দির ঘাটে জড়ো হয়েছে আরও অনেক পুণ্যার্থী। ঘাটে রাখা বড় বড় ছাতাগুলোর তলায় সাধুবাবাজির সাধনভজন। পাশেই গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে আছে হিন্দুস্তানী মেয়ে-বৌ। হয়তো আরও আগে ওদের স্নান সারা হয়ে গেছে।
ঘাট ছেড়ে নৌকোটা একসময় দুলে উঠল নদীর বুকে। মাঝির হালে ছলাৎ ছলাৎ জল কেটে যায়। এগিয়ে চলি সূর্যোদয়ের পথে। হ্যাঁ, অনেকটা তাই-ই। আমরা যত মাঝগঙ্গার দিকে এগোচ্ছি সূর্যও তত যেন মেঘঘোমটার আড়াল সরিয়ে নীল আকাশে সোনার হাসি বিলোচ্ছে। এও যেন এক উৎসব। পৃথিবীর ঘাটে ঘাটে এমন উৎসব তো রোজই ঘটে। তবে দেখার ফুরসত মেলে কই? বিশেষ কোনও সময় এলে নিত্যপ্রবহমান রোজনামচাই নিজে থেকে যেন নতুন করে ধরা দিয়ে যায়। তখন মনে হয়, এমন ভালো বুঝি আজকের দিনের জন্যই। অনেকটা এই গঙ্গার মতোই। রোজই সে পাপ ধুয়ে চলে। তবু আজকের বিশেষ দিনে পাপস্খালনের কী বিচিত্র হিড়িক। সূর্যের গায়ে এখনও টুকরো মেঘ জাপটে আছে। ডিজি ক্যামে কটা যে ছবি বন্দি করলাম খেয়ালই করিনি। একটু দূরে আরেকটি নৌকোয় বিদেশি-বিদেশিনীর দল। বাপ্‌রে, সেই কোন সাত সাগরের পার থেকে তেনারা ছুটে এসেছেন ঘিঞ্জি বারাণসীর উৎসবকে স্বচক্ষে দেখবেন বলে আর এদেশের লোক হয়ে আমিই কয়েকদিন আগে অব্দি গঙ্গামহোৎসবের কথা জানতামই না। কথা ছিল ভাইকে সাথে করে বারাণসী ঘুরব। উৎসব-টুৎসব তখন কোথায়! এমন সময় সুপ্রতিমদা বলল এই মহোৎসবের কথা। এমনকি কালকে রাতে ওর ফোনটা যদি না আসত তাহলে এই সাতসকালে ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে মেখে মাহেন্দ্রক্ষণে গঙ্গার বুকে ভেসে শত পুণ্যার্থীর আনন্দস্নান দেখা হত না।
কিন্তু এতক্ষণে সূয্যিমামার পুরোপুরি ঘুম ভেঙেছে। গঙ্গাবুকে আলতো আলতো ঢেউ তুলেছে দিনের আলো। আমরাও মীরঘাট, ললিতা ঘাট ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছি। সামনের ঘাট বরাবর চোখটা আটকে গেল। আবারও গঙ্গাস্নানের ছবি। তবে এ স্নান গঙ্গার বুকে শেষবার স্নান করে সূর্যের ডুবে যাওয়ার মতো। চারজন মানুষের হাতে এক নিথরপ্রাণের শুয়ে থাকা। ভিড় ঠেলে তাকে জলে নামতে হয়নি। বরং পরম শান্তিতে নিরিবিলিতে গঙ্গার জলে সর্বাঙ্গ ধুয়ে নিচ্ছেন। ওই চারটি মানুষ ধুয়ে দিচ্ছে ঘুমন্ত শরীরটাকে। ঘাটেই সাজানো আছে কাঠের শয্যা। একটুবাদেই প্রচণ্ড উত্তাপে জীবনের সব জ্বালা জুড়োবে ওই মানুষটার। পাঁচ-ছয় হাত দূরেই পুণ্যকামী আরএকজন প্রাণহীন মানুষটাকে ছুঁয়ে আসা গঙ্গাকেই মাথায়-মুখে-বুকে ছিটিয়ে নিচ্ছেন। পুজোয় বসবেন বোধহয়। তাই তার আগে একটু শুদ্ধিকরণ। গঙ্গাকে পতিতপাবনী বলে জানতাম। তবে তাঁর সেই রূপ আমার সামনে যে এইভাবে এসে ধরা দেবে ভাবতে পারিনি। যে ঘাটে এত সব কান্ড, তার নাম মণিকর্ণিকা। আজ এটা শ্মশান। ঘাটের উঁচু অংশে এক চিলতে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলতেই থাকে। কোনও দিন নাকি নেভে না। তবে এর পেছনেও গল্প আছে। এই ঘাটটার আসল নাম রাজবল্লভ শ্মশানঘাট। তেমন একটা পরিচিতি ছিল না। এরই পাশে মণিকর্ণিকার ঘাট। এই শ্মশানের পরিচিতির জন্য মণিকর্ণিকার নামেই নাম হয় মণিকর্ণিকা মহাশ্মশান। রাজবল্লভ নামটা কীভাবে যেন মুছে যায়। নাকি ভেসে যায় কালগঙ্গায়।
ভেসে আসি সিন্ধিয়ার কাছে। কারুকার্যময় একচুড়ো মন্দিরটি বুক ডুবিয়ে হেলে আছে গঙ্গার কোলে। গোয়ালিয়রের রানি বৈজাবাঈ মায়ের স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যেই এই ঘাট বাঁধাতে শুরু করেন। এমন শুভ কাজের আড়ালে তাঁর মনে ক্রমে বাসা বাঁধে চোরা অহংকার। মাতৃঋণ বলে তাঁর জীবনে আর কিছুই নেই। অমনি ডুবে যায় মাতৃস্মৃতিমন্দির। আজও সেই একইভাবে হেলে আছে জলের বুকে। ভোরের আলো হয়তো তাকে সান্ত্বনা দিতে চায়।
বুকান হঠাৎ আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নেয়। কী আবার চোখে পড়েছে কে জানে…। ওমা, এ কী কাণ্ড! ঘাটে বাঁধা নৌকার মাথায় একটা শালিকের নিঃসঙ্গ বসে ইতিউতি চাওয়া। গুণধর ভাই আমার তারই ছবি ক্যামেরা বন্দী করছে। বলি অনাসৃষ্টিরও তো একটা শেষ আছে নাকি! সাত সকালে এক শালিক দেখলে লোকে চোখ বোজে। আর উনি তাকে ছবিতে ধরে রাখছেন। যত্তসব অলক্ষুণে কাণ্ডকারখানা। ‘এই ক্যামেরাটা দে’।
দেখতে দেখতে সঙ্কটা, ভোঁসালা, গণেশ, গঙ্গামহল -এসব ঘাটও একে একে পেরিয়ে গেলাম। হঠাৎই চোখে পড়ল মসজিদের চূড়া। মাঝি বলল, ওটা আলমগীর মসজিদ। পাশেই রামঘাট। দিব্যি আছে। একসময় তাও চোখের ডানদিক থেকে বাঁদিকে সরে গেল। সেই মানমন্দির ঘাটের পর যেকটা ঘাট পেরোলাম একটাতেও উৎসবের ভিড় চোখে পড়ল না। দূরের ঘাটে আবার সেই ভিড়ের ছবি। ওটাই পঞ্চগঙ্গা ঘাট। আসল উৎসব নাকি এই ঘাটকে কেন্দ্র করেই হয়। কাছে আসতে লক্ষ্য করলাম এখানে মহিলাদের ভিড়ই বেশি। আবারও সহায় হল মাঝিভাই। বলল, এনারা একমাস ধরে এই ঘাটে এসে স্নান করেন। আজ তার শেষ দিন। ইসলাম ধর্মেও রোজাকে ঘিরে এমনই একমাসের কৃচ্ছ্রসাধনের প্রথা আছে। কত মিল। তবু অন্তরের টানে এত যে কেন খামতি!? অবশ্য ব্যাতিক্রম আছেই। মানবজীবনের বেঁচে থাকার জন্য আজ ওই ব্যাতিক্রমটুকুই সম্বল। যাইহোক, এই ঘাটের নাম পঞ্চগঙ্গা হবার একটা কারণ আছে। এখানে ধূতপাপা, যমুনা, কিরণা ও সরস্বতী-এই চারটি উপনদী গঙ্গায় এসে মিলিত হয়ে চার আর একে পাঁচ হয়েছে। তাই এটা পঞ্চগঙ্গা। শুধু তাই নয়, পঞ্চগঙ্গা ঘাট পঞ্চতীর্থের চতুর্থ তীর্থ ও কাশীর একটি জাঁকজমকপূর্ণ ঘাট।   
ঘাটের কাছাকাছি আসতেই নৌকোটা ধীর হয়ে গেল। সদ্য শীতের কনকনে জলে শয়ে শয়ে নারীদের মাহেন্দ্রস্নান। যদিও সূর্য এখন মাঝ আকাশের পথে। তবুও দূরের রাজঘাট ব্রিজটা এখনও আবছা কুয়াশার আধারে। দুয়েকটা ডুব দিয়ে হাত জোড় করে সূর্যস্তবে জবাকুসুমের ফুটে ওঠা। পাশেই হাতে রাখা পিতলের ছোট্ট ঘট থেকে দুধ আর গঙ্গার একসাথে উপচে পড়া গঙ্গারই বুকে। কেউ বা সপসপে ভেজা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘাটের পাশের ধাপটায় আপন মনে ঘুরে চলেছেন দশদিক প্রদক্ষিণ করে। মুখে অস্ফুট মন্ত্রোচ্চারণ। চার-পাঁচ বছরের শিশুও বাদ পড়েনি এই পুণ্যের ভাগ থেকে। মায়ের কোলে কেঁদেই চলেছে। ওর মা হয়তো মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে চলেছেন, ‘নমো কর, ঠাকুর তো। এই জলে চানু করলে যা চাইবে তাই পাবে’। ললিপপ কিম্বা কম্পিউটার গেম দেবার ক্ষমতা মা গঙ্গার আছে কিনা জানি না, তবু মা গঙ্গার কাছে একটাই মিনতি, ওইটুকু দুধের শিশুকে নিমুনিয়া অথবা ব্রঙ্কাইটিস উপহার দিও না মা গো।
নৌকো এবার উল্টোপথে। পঞ্চগঙ্গা থেকে দশাশ্বমেধের দিকে। মা গঙ্গা এখন নীলাম্বরী ছেড়ে গলানো কাঁচা সোনার রঙে সেজেছে। আলোয় আলোয় ওপারের চরও ভেসে যাচ্ছে। দূরের নৌকোগুলো কী বিচিত্র শোভায় সূর্যকে অতিক্রম করে ভেসে চলেছে এধার থেকে ওধারে। ছবিটা না তুলে আর থাকতে পারলাম না। এদিকে জলের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গোল গোল চবুতরাগুলোতে এক এক করে সাধুরা এসে ভিড় জমাচ্ছেন। কেউ দর্পণে চোখ রেখে কপাল জুড়ে তিলক এঁকে নিচ্ছেন। ধীরে ধীরে আবার মানমন্দির ঘাট, পাশেই দশাশ্বমেধ এবং তারপর প্রয়াগ ঘাট। উষাকালের শত শত মানুষ কখন যেন হাজারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কত হাজার বলা মুশকিল। গঙ্গা থেকে ঘাটটাকে দেখতে চাইলে কেবল মানুষের মাথার মিছিলই চোখে পড়ে। পৃথিবীর যত রং সব যেন পূর্ণিমা তিথিতে গঙ্গার কোলে উপচে উঠেছে। কেউ হাঁটুজল, কেউবা বুকজলে পুণ্যার্জনে ব্যস্ত। আচারে-বিচারে, পূজার্চ্চনায় কেবল ধর্মেরই প্রতিফলন। কিন্তু উৎসব! সে তো লক্ষ মানুষের মনে-মননে-ভাবনায়-চেতনায়।
মানমন্দির ঘাটের বাজারের মধ্যেকার রাস্তাটা তুলনামুলক তবুও একটু খালি। সেখানেই সারে সারে সাপ-সাপুড়ের মেলা। আজব খেলা। সেদিন সোমবার বলে ওদের হাঁকডাকের জোরটা যেন আরও একটু বেশি। বাবার অঙ্গভূষণ এড়িয়ে গোধূলিয়া মোড়। তারপর সেখান থেকে আবার চেতগঞ্জের দিকে। রাস্তা থেকে জলখাবারের ব্যবস্থাটা করেই ফিরলাম। বাতাসার মতো চারটে কচুরি সঙ্গে কালো রঙের ঘ্যাঁট -দাম দশটাকা। নিলে নিন, নইলে পথ দেখুন। আজ খাবার বিক্রেতাদের রেলাই আলাদা। অগত্যা যা পাওয়া যায়। খেয়েও মুশকিল, ওই খাবারের যেটুকু পেটে গিয়েছিল সেটুকুও প্রায় উগরে দেওয়ার মত অবস্থা। তবে অন্যসময় অবশ্য বেনারসের কচুরি যদি ঠিকঠাক জায়গা থেকে কিনে খাওয়া যায় তাহলে তার স্বাদই আলাদা।
প্রায় তিনদিন কেটে গেল বেনারসে। আমাদের আসার আগের দিন থেকে গঙ্গামহোৎসব শুরু হয়েছে। বড় বড় রাস্তা থেকে গলি-তস্যগলির চেহারাই গেছে বদলে। গত দুদিন আমাদের ট্যুর প্ল্যান যাই থাকুক না কেন বিকেল হলে নিয়ম করে গঙ্গার ঘাটে ঠিক হাজির হতাম। দশাশ্বমেধের বুক ছোঁয়া চবুতরায় দাঁড়িয়েই কেটে যেত সময়ের পল-অণুপল গুলো। দেখতাম কেমন বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যায় সন্ধ্যাবরণের প্রস্তুতি। পর্যটকদের নৌকোগুলো যখন একে একে ঘাট ভ্রমণ সেরে ঘাটে এসে লাগে তখন থেকেই গঙ্গাবুকে প্রদীপ-ভাসান খেলা। একটি-দুটি থেকে দশ-বারোটা, তারপর আরও…আরও, শিখায় শিখায় সেজে ওঠেন মা গঙ্গা। পুণ্যকামী মানুষগুলোর পেছনে, আশেপাশে ফটোগ্রাফারের পারফেক্ট ফ্রেম খোঁজার ব্যস্ততা। যার ছবি যত ভালো, তার দাম তত বেশি। যার যেখানে পুণ্য আর কি! বলাই বাহুল্য, আমিও ওই ছবি সন্ধানীদেরই দলে তবে স্রেফ মনের আনন্দেই।
ঘাটের নীচে তখনও অনেক প্রদীপ জ্বলবার অপেক্ষায়। ওপরটাতে দাঁড়িয়ে থাকা উড়ন্ত জীবনের ছেলেগুলোর হাতে ঘুড়ির সুতোয় তখনও বেশ টান। আঁধার-আলোর সন্ধিবিকেলে চাঁদটা প্রায় থালার মতো। দুয়েকটি নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে মাঝগঙ্গায়। এদিকে দশাশ্বমেধ ঘাটে আরতির আয়োজন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎই ঘাড়ের ওপর সুড়সুড়ি। কাটা ঘুড়ির সুতো। মাইকে সেই কখন থেকে বাংলা আর হিন্দিতে সতর্কবাণী। সঙ্গে দশাশ্বমেধের মাহাত্ম্য। কাশীখণ্ডে বলা হয়েছে, রাজা দিব্যদাস এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করেন। তাই শিব এখানে ব্রহ্মেশ্বর। এ তো গেল পুরাণের কথা। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জয়সওয়ালজি বলেছেন, ভারশিব নামে জনৈক নাগনৃপতি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে এখানে পর পর দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। আর তারপর থেকেই এই পবিত্র যজ্ঞস্থলের নাম হয় দশাশ্বমেধ।
পুরাণ-তর্ক শিকেয় তুলে আজ আপাতত দুই আনকোরা উড়ো পথিকের আবার পথে নামা। গন্তব্য? কোথায় আর, দশাশ্বমেধ। আজই তো মহোৎসবের মহালগ্ন। এই উৎসবের আরও একটা নাম আছে। খেয়াল ছিল না। খেয়াল হল চেতগঞ্জের হোটেল থেকে গোধূলিয়া মোড়ের দিকে আসার সময়। রাস্তার আশেপাশে ছোট ছোট মন্দির, বাড়ির উঠোন, দোকানপাট সবই আজ দীপালোকে প্রজ্জ্বল্যমান। সারে সারে প্রদীপের ভিড়ে অন্ধকার নামার আগেই সে যেন আজকের মতো হারিয়ে গেছে কোন গহনে। তখনও সন্ধে নামেনি। আকাশখানা দখল করে নিয়েছে আলোর বাজি। আজ যে দেবতার দীপাবলি। তাই এর আরেক নাম দেবদীপাবলি। মানুষ তার দীপাবলি জ্বালায় অমাবস্যার রাতে। ঠিক তারই পনেরো দিনের মাথায় ভুবন যখন পূর্ণ চাঁদের মায়ায় ভাসে, তখন ঈশ্বর তাঁর অঙ্গনে জ্বালান দীপ্তদীপের শিখা। দূ-রে, ওই পারে, যেখানে আরতির আলো পৌঁছয় না সেখানে চাঁদের আলোয় চর ভেসে যায়। এপারের চরাচরে তখন বৈদিক মন্ত্রে মঙ্গলগান, শঙ্খনিনাদ, ঘন্টাধ্বনি, ডমরুবোল, ধুনোর ধোঁয়া। দশাশ্বমেধে পরপর সাজানো পূজাবেদির ওপর দাঁড়িয়ে সাতযুবাকন্ঠের শিবস্তুতি, গণেশবন্দনা, গঙ্গাভজন এমনকি শিবতান্ডব স্তোত্রও ফিরে আসে সৃষ্টির সূচনা নিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের চাওয়া মিশে যায় একসাথে -ওই এক আরতির শিখায়। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম পুণ্যারতির আলো বৃত্ত আঁকে। লক্ষ্য আত্মার সুপ্তবাণী যেন ছুটে যায় ভূমণ্ডলের গানে। পাশেই মঞ্চ বেঁধে চলছে ধ্রুপদী সংগীত, নৃত্য আর ঈশ্বর ভজনার স্তব। সেখানেও লোক জড়ো হয়েছে প্রচুর। আজ তিলধারণের জায়গাটুকুও নেই। ঘাটের পাশে উঁচু মতন অংশটাতে, হতে পারে কারো বাড়ির ছাদে বড় বড় ক্যামেরায় দক্ষ রিপোর্টার, লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। ঘাটের সামনের গঙ্গাও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। যত দূর চোখ যায় ততদূরই মানুষ আর মানুষ। অন্যান্য দিন দশ টাকার বিনিময়ে নৌকোয় বসে আরতি দেখার সুযোগ মেলে। আজও তার ব্যাতিক্রম নয়। তবে ভাড়াটা নির্ঘাৎ দশটাকায় আটকে নেই। আজ আরতির প্রদীপ্ত শিখারাশির সঙ্গে মিশে গেছে আনন্দবাজির রং-উল্লাস। ধনী-নির্ধনে একাকার এই ভিড়। পাশের মঞ্চে কত্থকের বোলে ঝড় তুলেছে কোনও এক ক্ষুদে নর্তকীর পা। ঘাটে ঘাটে আলোর প্লাবণে ভেসে যাচ্ছে প্রাচীন বারাণসী। ঘন্টাখানেকের আরতি এখন শেষ। তবু মানমন্দির, দশাশ্বমেধ আর প্রয়াগ ঘাট জুড়ে ঐশ্বরীয় আমেজের মহোল্লাস। বহু দূরে পঞ্চগঙ্গা-ও বোধহয় এমনই আনন্দে মেতেছে।
আজ ভোরে যে লক্ষ পায়ের মিছিল বিভিন্ন গলি -তস্যগলির গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজপথে মিশে গঙ্গার জল স্পর্শ করেছিল, সেইসব চেনা-অচেনা ধুলো-কাদামাখা পাগুলোই আলোর রাজপথ ডিঙিয়ে ফিরে চলেছে অন্ধগলির অন্ধকারে। গঙ্গার তরঙ্গে হাজার হাজার প্রদীপ শিখা ভেসে চলেছে। কোথায়? কাকে আলো দেখাতে? যে নিজেই কোটি সূর্যের কিরণে উদ্ভাসিত! নাকি যারা একটুখানি আলোর জন্য মা গঙ্গার কাছে দুহাত পেতেছিল !?
দুদিন আগে ভরদুপুরে গঙ্গার বুকে ভাসতে ভাসতে দেখা একটা ছবি ভেসে উঠল চোখে-ঘাটে বাঁধা নৌকোর মাঝিটা তার হাল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জলের মধ্যে খোঁচাচ্ছে। আমাদের নৌকো খানিকটা এগোতে কৌতুহল আরও বাড়ল। সাদা মতন কী একটা যেন উঁচু হয়ে জলে ডুবে আছে। ওই মাঝি সেটাকেই তোলার চেষ্টা করছে।
-উও ক্যায়া হ্যায় সুরেশ ভাই? উধর?
সুরেশ মানে আমার মাঝির নির্লিপ্ত উত্তর, ‘উও? উও তো বডি পড়া হ্যায়। কিসিনে মারকে ফেক দিয়া’ -যেন কোনও ব্যাপারই না। ঘাটে দুয়েকজন লোক আর কয়েকটা কুকুরের ভীষণ ব্যস্ততায় ছুটোছুটি। উল্লাসে! ভাই প্রশ্ন করল-‘ইধর পুলিশ-টুলিস নেহি হ্যায়?’ থাক, সুরেশ মাঝির উত্তরটা বরং আমার কলমের আঁচড়েই সেন্সর হোক। নইলে গোল বাঁধতে পারে।
আমার ভাইয়ের হাতের প্রদীপটাও আস্তে আস্তে ভেসে গেল কালো গঙ্গার জলে। ঘাটছোঁয়া সেই জল সবেমাত্র মাথায় ছেটাতে যাবে, ধমকে উঠলাম-‘আঃ, অনেক হয়েছে। ওঠ তো। নোংরা জল আর মাথায় ঠেকাতে হবে না’।
আমি চাই না, শুধুমাত্র নিজের পুণ্যের জন্য আমার ভাই কারও চোখের জলে নিজেকে ধুয়ে নিক…।  

~ তথ্য- বেনারস (উত্তরপ্রদেশ) ~ || ~ বেনারসের ছবি ~

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher