তার সাথে মনে মনে কথা বলা চলে...
কৌশিকব্রত দে
~ তথ্য- বিহারীনাথ (পশ্চিমবঙ্গ) ~ || ~ বিহারীনাথের ছবি ~
দেখলে মনে হয় পাহাড় যেন ঘরের উঠোনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পাহাড় তো, তাই স্বভাবে কিছুটা হয়ত রহস্যময়। বর্ষার মেঘ কখনও তার চুড়োকে ঢেকে দিচ্ছে, কখনও রোদ-ছায়ার মোহময়তা তাকে ঘিরে রাখছে। আসলে তো পাহাড় নয় টিলা। ১৪৮০ ফিটের আস্ত একটা টিলা - বাঁকুড়া জেলার অন্যান্য টিলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু। ছোটনাগপুর মালভূমিটাইতো এরকম ছোট ছোট কত টিলায় ভর্তি। কিন্তু বিহারীনাথ যেন সবার চেয়ে অপরূপ। আদিম নৈঃশব্দ। মহুয়া, শাল, পিয়ালের একাকী মৌন এই পাহাড়টা বড় আপন, বড় নিজের করে পাওয়া। সে একটা জীবন্ত পাহাড়। তার সাথে মনে মনে কথা বলা চলে…।
বর্ষায় পাহাড়ের রঙ থাকে সবুজ আর তার ওপর রোদ আর মেঘের ছায়ার নানা মায়াবী খেলা চলে। তা দেখতে দেখতেই কখন বেলা বয়ে যায়। পাহাড় বেয়ে ওঠাও খুব একটা শক্ত নয়। বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়েই পায়ে চলা পথ উঠে গেছে। তবে বর্ষায় বেশ বিপজ্জনক। পাহাড়ের ওপরে কোনও বসতি নেই। বিহারীনাথ থেকেই চোখে পড়ে শরপাহাড়ি আর দূরের দিগন্তরেখায় আঁকা আবছা পাঞ্চেত পাহাড়। সব মিলিয়ে খুব রোমান্টিক বিহারীনাথ।
পাহাড়ের নীচেই আছে শিব মন্দির, লাগোয়া জলাশয়। মন্দিরের পাশ দিয়ে কালো যে পিচ রাস্তাটা সাপের মতন এঁকে বেঁকে চলে গেছে সেটা গিয়ে পড়েছে শালতোড়ায়। এই রাস্তাটাই বিহারীনাথের একমাত্র রাস্তা। শালতোড়ার দিকে যেতে জনহীন এই পথের দু’ধারে আছে আরও কিছু নাম না জানা ছোট ছোট টিলা। রাস্তাটার অন্যপ্রান্ত একটু গিয়েই পড়েছে একটা তেমাথায়। তেমাথার একটা পথ গেছে ৫ কিমি দূরে দামোদরের পাড়ে- যার উল্টোদিকে বর্ধমান জেলার শিল্পনগরী বার্নপুর। এইদিকের পথটা অবশ্য কিছুটা মাত্র পাকা। বাকিটা কাঁচা। দামোদরের পাড়টা বেশ মনোরম। নদীর চর ধরে অনেকটা যাওয়া যায়। তেমাথার অন্য পথটা গেছে ইতুড়ির দিকে। এই ইতুড়ি থেকে একেবারে লালমাটির একটা ভাঙাচোরা রাস্তা গেছে ৩ কিমি দূরে বিনোদপুর গ্রামে। বিনোদপুর অবধি গাড়ি যায়। বিনোদপুর থেকে এক কিমি বনপথ ধরে হাঁটলেই বিনোদপুরের ছোট্ট একটা ড্যাম। ড্যামের জলাশয়ের ঠিক অপর পাড়েই মাথা তুলেছে ছোট ছোট টিলা। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে একটা টিলার নাম জানা গেল ‘লেদুরি’। বনের মধ্যে জনমানবহীন এই জলাশয় প্রান্তরে প্রকৃতি আর মন যেন মিলেমিশে একটাই সত্তা হয়ে যায় কখন।
কয়েকটা দিন নির্জন প্রকৃতির কোলে বেশ কেটে গেল। উঠেছিলাম শালতোড়া পঞ্চায়েত সমিতির লজে। এখানে ওটাই একমাত্র থাকার জায়গা। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও লজেই। ঘরোয়া খাওয়া - পোস্তর প্রিপারেশনটা মনে রাখার মতো। ফেরার পথে শুনলাম এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজ পাওয়া গেছে। স্পেশাল ইকনমিক জোন হিসেবে সরকার এই অঞ্চলকে ভাবছেন। নামকরা একটি সংস্থা রিসর্টের জন্য জমিও কিনে ফেলেছে পাহাড়ের সামনে। এখানকার আদিবাসী মানুষগুলোর মূল জীবিকা বছরে একবার মরশুমি চাষ, ছোট ছোট স্টোন ক্রাশিং কারখানা আছে অনেক - সেখানে দিন মজুরি খাটা আর বেআইনি কয়লা পাচার। এসব হলে নাকি বদলে যাবে এই জীবন, উন্নতি হবে মানুষগুলোর। হয়তোবা সত্যি তাই অথবা আসলে হয়তো এদের সরে যেতে হবে। বাইরে থেকে আসবে দক্ষ শ্রমিকের দল। কে জানে!
সে যাই হোক না কেন, বিহারীনাথ তখন বোধহয় আর আমার পাহাড় থাকবে না- আমার সাথে এভাবে আর কথা বলবে না...।
~ তথ্য- বিহারীনাথ (পশ্চিমবঙ্গ) ~ || ~ বিহারীনাথের ছবি ~