পবিত্র হ্রদের তীরে
শীলা চক্রবর্তী
~ তথ্য- গুরদোংমার হ্রদ (সিকিম) ~ || ~ গুরদোংমার হ্রদের ছবি ~
দূরের পাহাড়ে হাতছানি আধো-নীলিমার। চোখের সীমানায় পাহাড়ের গাঢ় সবুজ গালিচা। আকাশ আড়াল করা উচ্চতা। কোথাও স্ট্রবেরির ঝোপ। পার্সিমামের ঝাড় কোথাও। হঠাৎ কোথাও পাহাড় থেকে নেমে আসা চঞ্চল ঝরনা ভিজিয়ে দিচ্ছে পথ। সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, নামটিও ভারি মিষ্টি – রংপো -সিকিমের প্রবেশপথ। আমাদের গন্তব্য পূর্ব সিকিমের ১৭,৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত টলটলে জলের হ্রদ গুরদোংমার। রংপোর রাস্তাঘাট চওড়া, মসৃণ। রংবেরং এর রাফট বোট নিয়ে দলে দলে লোক চলেছে বর্ষার ভরা উত্তাল তিস্তায় রাফটিং করবে বলে। হেঁটে - গাড়িতে। তিস্তার বুকে রঙিন রঙিন বোটগুলো চলছে হেলতে দুলতে। পথে গাড়ি থামিয়ে চা বিরতি। পাহাড়ি ছাগল চরছে ইতিউতি। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক পৌঁছতে রাত।
পরদিন সকালে একটি স্থানীয় গাড়ি ভাড়া করে চললাম লা-চেন। আগাম অনুমতি ছাড়া গ্যাংটক ওপাশে ভিন রাজ্যের গাড়ির প্রবেশ মানা। পথের কত সুন্দর সুন্দর পাহাড়ি ঝরনা বাহারি তাদের নাম! নাগা বচ্চন ফলস্ - ঝরনার সু-উচ্চতার কারণে এই নাম। সুন্দর রোদ ঝকমকে দিন, হঠাৎ ঘনিয়ে এল মেঘ নিয়ে এল বৃষ্টি কুচি ভরা হাড়হিম ঠান্ডা হাওয়া। সামনের দৃশ্য ঢেকে গেল। গাড়ির হেডলাইট। কিছুক্ষন পরই আচমকা মেঘ সরে হেসে উঠেছে বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি। এমনই সরল আলো ছায়ার খেলা পাহাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চটকা ভাঙলো ড্রাইভারের ডাকে -
ম্যাডাম, ম্যাডাম, দেখিয়ে, ইয়াক...। তাকিয়ে দেখি রাস্তায়, নীচের উপত্যকায় চরছে অসংখ্য চমরি গাই। পোষা, নিরীহ। ছবি তুললাম ঝটপট। স্থানীয় বাজারে এই ইয়াকের দুধে তৈরি জমাট একধরনের কিউব পাওয়া যায়। রবারের মতো শক্ত, স্বাদহীন। চিবিয়ে নরম করা প্রায় অসাধ্য। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ছুরপি। লা-চেন পৌঁছতে সন্ধে। হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে দু-দুটো কম্বলের নীচে ঢুকে পড়লাম দ্রুত। অসম্ভব ঠান্ডা। তুমুল গ্রীষ্মেও জলের স্পর্শে হাত -আঙুল অসাড়।
পরদিন সকাল সকাল ইয়াকের দুধের বিস্বাদ গলানো মাখনে ভেজা গোবদা পাঁউরুটি খেয়ে যাত্রা করলাম গুরদোংমার। পাহাড়ি পথ আর ঝরনার ক্লান্তিহারা সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম তিব্বত সীমান্তের কাছে ভারতের শেষ সেনা ছাউনিতে। হাত তুলে সামনে এক জওয়ান। গাড়ির কাচ নামলো। জওয়ান বললেন উতরিয়ে - কুছ্ নাশ্তা পানি দেনা হ্যায়। হঠাৎ মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত…নাশ্তা পানি মানে? নির্ঘাৎ এই জনবিরল প্রান্তরে নামিয়ে ধোলাই দেবে এবার। আমার বিবর্ণ মুখ দেখে ভাবনাটা পড়ে ফেললেন জওয়ান। হেসে বললেন- ডরিয়ে মত্, আজ বাবা কা ডে হ্যায়......। ধড়ে প্রাণ এলো। নামলাম। গরমাগরম চা, গ্লুকোজ বিস্কুট, সসে ডোবানো চমৎকার মুচমুচে ফুলকপির পকোড়া, লাল রঙের গরম শরবত দিয়ে আন্তরিক আপ্যায়ন করলেন ওঁরা। আফশোস হচ্ছিল কেন সকালে গোবদা পাঁউরুটি খেলাম - নাহলে এই চমৎকার পকোড়া বেশ জমিয়ে খাওয়া যেত....।
জওয়ানদের সাথে ছবি তুললাম আমরা। ওঁদের মুখেই শুনলাম - সিকিমের জওয়ানদের জীবনযাত্রার পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা কিংবদন্তী সেনা অফিসার বাবা হরভজন সিংহের রহস্যময় সব কাহিনি। বহুকাল আগে রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হওয়া এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেনা অফিসারটি এখনো জীবিত বলেই প্রচলিত বিশ্বাস জওয়ানদের। প্রতি শীতে, ঐ অঞ্চল যখন জনশূণ্য, বাবা তখন ছুটিতে যান বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁর থাকবার ঘর, ব্যবহারের পোশাক ও জিনিস-পত্র সেনাব্যারাকে সাজিয়ে রাখা আছে। মনে করা হয় তিনি আজও সেসব ব্যবহার করেন। তিব্বত সীমান্তের এই অতন্দ্র প্রহরী নিজের কর্তব্য বিষয়ে খুব কড়া। অন ডিউটি কোন সেনা যদি সামান্য ঝিমিয়েও পড়েন- সশব্দে চপেটাঘাতে তাঁকে জাগিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে থাকেন বাবা। যাহোক, আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো। পথটি এবার বেশ সরু। সীমান্তবর্তী পথের দুধারে ল্যান্ডমাইন পোঁতা আছে বলে সতর্ক ড্রাইভার দাওয়া শেরপা। উচ্চতার কারনে অঞ্চলটি বৃক্ষহীন, ধূসর। হঠাৎ হঠাৎ বাঁক নিয়েছে সরু পথ। গাছ গাছালি নেই, তাই পাহাড়গুলোও ন্যাড়া। কী অপার, অপার্থিব তাদের সেই অনাবৃত, উদ্ভাসিত সৌন্দর্য্য! কোনটা ইঁটের মত লালচে, কোনটা আকাশের মত নীল, কোনটা ছাইরঙা, কোনটা ধূসর, কোনটা সোনালি- মাথায় সব বরফের পুরু মুকুট। ঝকঝকে মেঘহীন প্রান্তর- সেই ঐশ্বর্য্যময় তুষারকিরীট ঝকমক করছে সূর্য্যকিরণের ঠিকরে পড়া আশ্চর্য বর্ণচ্ছটায়। আকাশ ঘন নীল, টুকরো পাতলা সাদা মেঘ লেগে আছে কোথাও। এই অনাবিল সৌন্দর্য্যের মধ্যিখানে বাক্যহারা আমার স্মরণে হঠাৎ - পারস্যের বিখ্যাত শায়র শেখ সাদীর একটি রুবাইয়াত -
অগর্ ফিরদৌস্ বার্ রু এ জমিন্ অস্ত্ -
ও হমিন অস্ত্, ও হমিন অস্ত্, ও হমিন অস্ত্।
স্বর্গ যদি থেকে থাকে পৃথিবীর কোনোখানে -
তবে তা এইখানে, তা এইখানে, তা এইখানে...।
অপার বিষ্ময়ে স্তব্ধ। পলকহীন চোখের আবেশ নিয়ে পৌঁছে গেলাম গুরদোংমার হ্রদ। এখানে রয়েছে শিখ ধর্মের পথিকৃৎ ওয়াহি গুরু নানকজির মন্দির। মন্দিরে ওয়াহি গুরুজির মূর্তি রয়েছে। মন্দির চত্বরে ঝুলছে অসংখ্য লুংদার (তিব্বতী ভাষায় ভূত বা অপবিত্র আত্মা তাড়াবার মন্ত্র লেখা রংবেরং এর ছোট পতাকা)। পাশেই ছোট হ্রদটি। শান্ত, তিরতিরে, স্বচ্ছ, নাতিগভীর, চোখজুড়ানো নীল। কথিত আছে, এই অঞ্চলে দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন তপস্যার শেষে গুরু নানক স্নানশুদ্ধ হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু পুরু বরফাবৃত এই প্রান্তরে কোথায় জল? তখন তিনি হাতের ছড়ি দিয়ে এই হ্রদের জমাট বরফে আঘাত করে, বরফ ভেঙ্গে, জল পান ও স্নানে তৃপ্ত হন। তিনি এই হ্রদটিকে আদেশ করেন, যেন হ্রদটি চিরকাল এই তুষারাবৃত প্রান্তরে ক্লান্ত পথিককে জলদান করে এবং কখনো নিজের শরীরে বরফ জমতে না দেয়। সুতরাং, চতুর্দিকের পাহাড়গুলো পুরু বরফে আবৃত হওয়া সত্ত্বেও এই হ্রদে কখনো বরফ জমে না, সর্বক্ষণ এটি টলটলে। এটিই এই পুণ্য হ্রদের মহিমা। স্থানীয় ভাষায় দোং অর্থ ছড়ি বা লাঠি। ওয়াহি গুরুজি এই হ্রদের বরফ ভেঙ্গেছিলেন ছড়ি দিয়ে - তাই এই পবিত্র হ্রদের নাম গুরদোংমার।
ভারত-তিব্বত সীমান্তটি এখান থেকে দৃশ্যমান। যেহেতু এখানে অক্সিজেনের বেশ অভাব তাই কয়েক মিনিটের বেশি কারুর এখানে থাকবার অনুমতি নেই। তাই যথাসম্ভব দ্রুত মন্দির দর্শন ও ছবি তোলা শেষ করে হিহি শীতে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির পেটে ঢুকে পড়লাম। রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ইনহেলার নিতে হলো।
ফেরার পথে আমরা গেলাম চোপ্তা ভ্যালি, বাবা হরভজন সিংহের শীতকলীন আবাস। চারদিকে ছড়ানো উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ। সেই রংবেরঙের রডোডেনড্রনের আমেজ আর চমরি গাই এর গন্ধভরা বাতাসে বুঁদ হয়ে লাচেন ফেরার পথ ধরলাম। পরদিন গ্যাংটক হয়ে শিলিগুড়ি। অতঃপর কলকাতা ফেরার পালা।
মন বেশ খারাপ, ইস্, আরো ক’টাদিন থাকা যেত যদি ! আবার আসতে হবে এই মায়াবী সৌন্দর্যের টানে, কথা দিলাম। মনের মনিকোঠায় অক্ষয় হয়ে রইল অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রূপকথার আধার, গুরু নানকের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র হ্রদ গুরদোংমার।
~ তথ্য- গুরদোংমার হ্রদ (সিকিম) ~ || ~ গুরদোংমার হ্রদের ছবি ~