জলসই
দময়ন্তী দাশগুপ্ত
~ তথ্য- রম্ভা (ওড়িশা) ~ তথ্য- গোপালপুর (ওড়িশা)~
~ ছবি - রম্ভা || ছবি- গোপালপুর ~
দূরে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ডের একটা বড় ঝাঁক জলের ওপর ছড়িয়ে বসেছিল। মনে হচ্ছিল কালো জলের ওপর কে যেন হাল্কা রঙের একটা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সাদা-কালোয় মেশানো শরীর আর ডানা, লালচে হলুদ রঙের ঠোঁট আর পা নিয়ে অনেকটা বড়সড় হাঁসের মত চেহারা। মোটরবোটের একটানা বিশ্রি আওয়াজটা কাছে আসতেই চাদরে টান পড়ল। আওয়াজ থেমে গেলেও ওরা টের পাচ্ছিল আমাদের উপস্থিতি। চঞ্চল হয়ে উঠছিল। মাঝে মাঝেই ঝাঁক থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গিয়ে আকাশে চক্কর খেয়ে আবার ঘুরে এসে বসছিল। মোটরবোটের মুখটা ঘুরিয়ে আবার রওনা দিতেই বুড়ো আংলার হাঁসের দলের মত ঠিক যেন রিদয়কে নিয়ে একঝাঁকে উড়ে গেল পাখিগুলো।
শীতের সময় সুদূর সাইবেরিয়া, ইরান, মধ্য এশিয়ার নানান দেশ থেকে ফ্লেমিংগো, পেলিকান, সোনালি টিট্টিভ, সিন্ধু ঈগল প্রভৃতি হাজারো পাখি ভিড় জমায় চিল্কার বুকে। একত্রিশে ডিসেম্বর বিকেলে হাল্কা শীতের আমেজ গায়ে মেখে আমরাও যেন পরিযায়ীর দল, ভেসে পড়েছি চিল্কায়।
উঁচু পাড়ের গায়ে অগভীর জলে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে নৌকো আর মোটরবোটগুলো। ঘাসজমিতে আর জলের মধ্যে জেগে থাকা মাছধরার জালের গায়ে ইতিউতি বসে স্থানীয় আর অতিথি পাখিরা। কোথাও দল বেঁধে, কোথাওবা একলাই। ভোরবেলায় এরা দলে আরও ভারি ছিল। জলাজমির ঘাসে মুখ ঢুকিয়ে শিকার খোঁজে বক আর মাছরাঙার দল। কমন স্যান্ডপাইপারের কাজলটানা চোখদুটো দেখতে ভারি ভালোলাগে।
সমুদ্রের কোলঘেঁষা বলেই হয়তো চিল্কার জলে কোথাও একটা সীমাহীনতার ছোঁয়া রয়েছে, অথচ পাড়, জলের বুকে জেগে থাকা টিলাগুলো সবই সীমানির্দেশ করে। জলের ধারে রম্ভা পান্থনিবাসের বারান্দায় বসেই হ্রদের বুকে ওয়াচটাওয়ারটা নজরে পড়ে। টাওয়ারটা দেখতে মন্দিরের মাথার মত। জলের মধ্যে ছোট্ট একটা ঘর, মোটরবোট থেকে সিঁড়ির প্রথম ধাপে নেমে আরও দুটো সিঁড়ি ভেঙে ঘরের মধ্যে যাওয়া যায়। ওয়াচটাওয়ার থেকে কিছুটা এগিয়ে একটা টিলার গায়ে থামল মোটরবোট। টিলার ওপরে গুহায় শিবমন্দির। এবড়ো খেবড়ো পথে টিলার গা বেয়ে উঠে যায় দলের বাকিরা। জলের বুকে নৌকায় একা বসে থাকি। শেষ বিকেলের আলোয় দিগন্ত আর জলরাশি রাঙা হয়ে ওঠে।
দূরে টিলার মাথায় ধিরে ধিরে ঢলে পড়ে বছর শেষের সূর্য। মায়াবী হয়ে ওঠে চারিদিক। একা একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াচটাওয়ারের চারপাশে জল চিকচিক করে ওঠে। পাখির দল কোথাও জলের মধ্যে জেগে থাকা জালের গায়ে বিশ্রাম নেয়, কেউবা উড়ে চলে দিগন্তে।
রম্ভা থেকে গোপালপুরের রাস্তাটা সবটা খুব ভালো না হলেও এই অটোপথ ভালো-ই লাগছিল। রম্ভা থেকে বরকুল বেড়ানোর সময়ই অটোচালক রত্ন-র সঙ্গে আমাদের বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। তার জোরাজুরিতেই ছোট্ট অটোতে যাবতীয় ব্যাগপত্তর ঠেসে বেরিয়ে পড়েছিলাম গোপালপুরের দিকে। জায়গায় জায়গায় পাহাড়ি এলাকার মতো। উঁচু উঁচু টিলা কেটে চওড়া রাস্তা এগিয়েছে। পথের গা ঘেঁষে ছুটে যায় ট্রেন। আবার নীচু জমি জল-কাদা, ক্ষেতের পাশ দিয়ে নাচতে নাচতে চলে অটো। মনের আনন্দে একের পর এক গান গেয়ে চলে আমাদের দশ বছরের আর বন্ধুর আট বছরের মেয়ে। গান শেষ হতে না হতেই অটো এসে থামে ছোট্ট শহর পেরিয়ে একেবারে সমুদ্রের কাছে।
সমুদ্র বোধহয় ঠিক রূপসী নারীর মতো। তাকে যতই দেখা যায় আশ মেটেনা কিছুতেই। এত উচ্ছ্বল অথচ এত শান্ত। গোপালপুরে এসে বারবার আন্দামানের সমুদ্রের কথা মনে পড়ছিল। সাগরের অত রূপ আর কোথাও দেখিনি। ওখানে সে যেন রাজরানী। নীল-সবুজ বেনারসীতে চিরযৌবনা। আর এখানে যেন পাশের বাড়ির আটপৌরে বধূটি। আধখোলা ঘোমটার ফাঁকে শান্তসুন্দর মুখেই কখনও খেলে বেড়ায় রাগের ভ্রুকূটি।
হোটেলের ঘরের ঠিক সামনে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে গেলেই একেবারে বালিতে। সমুদ্রসৈকতটা বেশ চওড়া। বেলা এগারটা-বারটা বাজে। জানুয়ারির প্রথমদিন। রোদ কিন্তু বেশ চড়া। দুপুরের ঝকঝকে রোদ নীল জলে পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। বেলাভূমিতে তেমন ভিড় নেই। সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত কয়েকজন। বালিতে অলসভঙ্গীতে শুয়ে-বসে আরও জনা কয়েক। দূরে জেলেরা জাল গোটাচ্ছে। জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়াই সৈকতে। বেলাভূমিতে জাল ছড়িয়ে বসেছে জেলেরা। জালের গায়ে ছোটবড় অজস্র কাঁকড়া। কোনো কোনোটার পেটে আবার হলুদ বা কালো রঙের একগুচ্ছ ডিম। জালেরে ফাঁকে ফাঁকে আটকে রয়েছে কয়েকটা স্টারফিশ আর জীবন্ত ঝিনুক।
গোপালপুর শহরটা পুরীর মত জমজমাট নয়, আবার চাঁদিপুরের মত একেবারে নির্জনও না। বেশ মধ্যবিত্ত মেজাজ। বাজার এলাকাটা সমুদ্র থেকে খানিক দূরে। সমুদ্রের ধারে হোটেল আর রেস্টুরেন্ট ইতস্ততঃ ছড়ানো। ওড়িশার সাইক্লোনে গোপালপুরের কয়েকটা হোটেল বেশ ভেঙে গিয়েছিল। ভাঙা হোটেলের কাঠামোর গায়ে জমে উঠেছে বালির স্তুপ। জঙ্গল হয়ে গেছে আপন নিয়মেই। সমুদ্রের পাড়ে বিকেল-সন্ধেয় এই ভাঙা বাড়িগুলো কেমন রহস্যময়তার সৃষ্টি করে। উঁচু পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে একটা চাতালের ওপর বালিতে বানানো জগন্নাথের মূর্তি নজরে পড়ে। কে জানে কোন শিল্পীর সৃষ্টি!
হোটেলের সামনেই রাস্তার এপারে-ওপারে গোটা তিনেক গিফট শপ। আরও খানিকটা এগিয়ে বাঁহাতে লাইটহাউস। সূর্য পশ্চিমে ঢলছে। পায়ে পায়ে পৌঁছে যাই লাইটহাউসে। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসি ওপরে। অসাধারণ প্যানোরামিক ভিউ। দিগন্তবিস্তৃত নীল সমুদ্রে সাদা ঢেউ ভাঙছে। হলুদ বালিতে কমলা-হলুদ গার্ডেন ছাতার নিচে লাল রঙের চেয়ারের সারি আর রঙিন পোষাকে পর্যটকের দল। অস্তরাগের মায়াবি আলোয় অপরূপ হয়ে ওঠে দিগন্ত। অন্ধকার নেমে আসে।
লাইটহাউস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসি সৈকতে। গরম কফির কাপ হাতে বসে পড়ি সৈকতের ধারের বাঁধানো সিঁড়িতে। সমুদ্রের হাওয়ায় এখন একটা ঠাণ্ডা আমেজ। লাইটহাউসের আলো হারিয়ে যায় সাগরের বুকে। রাত বাড়তে থাকে......।
ভোর বেলার সমুদ্র ভারী নরম। সূর্যের মিঠে আলো লাগে চোখেমুখে। পায়ের পাতা ছুঁয়ে যায় জল। সৈকতে সমুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লাল-নীল-সবুজ মাছ ধরার নাও। সাগরের বুকে ভেসে যায় আদরের নৌকো। রাত থাকতেই জেলেদের যে দলগুলো সমুদ্রে বেরিয়েছিল তাদের কেউ কেউ ফিরে এসেছে। তাদের জালে মাছ আর কাঁকড়ার স্তুপ। অদ্ভুত দেখতে একটা সাপও উঠেছে জালে। মুখটা অনেকটা মাছের মতন। সাপটাকে ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে জালে গেঁথেছে। ওটাই এবার টোপ হবে। বালির ওপর হাঁটতে হাঁটতে দেখি দুজনে মিলে কাঁধে কী যেন ঝুলিয়ে হেঁটে আসছে। কাছে আসতে দেখি ওরেবাবা এযে বিশাল এক শঙ্কর মাছ। মাছটাই একমানুষ সমান। লেজটাতো আরও বড়। রোদ উঠে গেছে। সৈকতে ফ্লাইং ডিস্ক ছুঁড়ে খেলছে আমাদের দুই বালিকা। এবার জলে নামার পালা, ডাক দিই ওদের।
বিকেলে সৈকত ধরে সাগরের গা ছুঁয়েছুঁয়ে হাঁটা। জেলেরা জাল বুনছে বেলাভূমির ধারে। মেয়ের সাথে ছুটে ছুটে ঝিনুক কুড়োই। হোটেল থেকে নেমে বাঁদিকে পায়েপায়ে অনেকটা চলে এসেছি। পিছনে তাকালে চোখ আটকায় লাইটহাউসে। আরও এগিয়ে একজায়গায় দেখি তিরতিরে জলধারা মিলিয়ে গেছে সাগরের বুকে। ঠিক যেন মোহনা। জল ভেঙে ওপার থেকে ফিরছে বিদেশিনী। সমুদ্রের বুকে সন্ধ্যা নেমে আসে….।
~ তথ্য- রম্ভা (ওড়িশা) ~ তথ্য- গোপালপুর (ওড়িশা)~
~ ছবি - রম্ভা || ছবি- গোপালপুর ~