-->
ইতিহাসের তীর্থভূমি অমৃতসর
অদিতি ভট্টাচার্য্য
অমৃতসরের তথ্য || অমৃতসরের আরো ছবি
"পঞ্চনদীর তীরে
বেণী পাকাইয়া শিরে
দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে
জাগিয়া উঠেছে শিখ –
নির্মম নির্ভীক।"
অমৃত সরোবরের ধারে দাঁড়িয়ে অপর পাড়ে সূর্যের আলোয় ঝলমল করা সোনালি হরমন্দির সাহিবকে প্রথমবার দেখে সেই ছোটবেলায় পড়া ক'টা লাইনই কেন জানি না মনে পড়েছিল। হরমন্দির সাহিব মানে ভগবানের মন্দির, আমরা সবাই যাকে চিনি স্বর্ণমন্দির নামে। শিখদের পঞ্চম গুরু অর্জুন ১৫৮৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন। পরে ১৬০৪ সালে আদি গ্রন্থকে এখানে স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে দশজন শিখ গুরুর বাণী সম্বলিত হয়ে এই আদি গ্রন্থই গুরু গ্রন্থ সাহিব নামে খ্যাত হয়। অমৃত সরোবর অবশ্য তারও অনেক আগেই খনন করা হয়েছিল, করেছিলেন চতুর্থ গুরু রামদাস। অমৃত সরোবর থেকে এর আশেপাশের অঞ্চলের এবং পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা শহরের নাম হয় অমৃতসর। ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস ব্যধি নিরাময়ের অলৌকিক ক্ষমতা আছে এই সরোবরের জলের।
মহাষ্টমীর রাতে পৌঁছেছিলাম অমৃতসরে। পরেরদিন সকাল থেকেই ছিল ব্যস্ততা ঘুরে বেড়ানোর। আর এই ঘুরে বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরেই ছিল স্বর্ণমন্দির। স্বর্ণমন্দির সম্পর্কে প্রথমেই যেটা বলতে হয়, যা দেখে মুগ্ধ হয়েছি তা হল প্রচুর জনসমাগম সত্ত্বেও এখানকার সুশৃখঙ্খল ব্যবস্থা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। ঢোকার মুখেই রয়েছে একটি অগভীর জলাধার যেখানে পা ধুয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশের আগে নারী পুরুষ নির্বিশেষে মাথা আবৃত করতে হয়। ঢুকেই একটু গিয়ে অমৃত সরোবর, যার চারদিকে মার্বেলে মোড়া রাস্তা। অনেকেই সরোবরের জল মাথায় স্পর্শ করাচ্ছেন, স্নান করছেন। জল পড়ে মার্বেলের মেঝে যাতে পিচ্ছিল না হয় তার জন্যে মোটা দড়ির কার্পেট পাতা রয়েছে। প্রবেশপথ সরোবরের যেদিকে হরমন্দির সাহিব তার বিপরীতে। কাজেই একদিক থেকে যাত্রা শুরু করে হরমন্দির সাহিব দর্শন করে অপর দিক দিয়ে বেরোলে অমৃত সরোবরকে পরিক্রমা করা হয়ে যায়। সরোবরটি যথেষ্ট বড়ো এবং চত্বরটি বিশাল। হরমন্দির সাহিবের আশেপাশে সরোবরের ধার দিয়ে আরো গুরদ্বোয়ারা আছে, সেখানেও সব সময় গুরু গ্রন্থসাহিব পাঠ হচ্ছে। যেতে যেতে এসব দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি হয়।
সেদিন ছিল রবিবার এবং দুর্গাপুজোর মহানবমী। স্থানীয় দর্শনার্থী ছাড়াও আমাদের মতো বাইরে থেকে আসা ভ্রমণার্থীদের সংখ্যাও প্রচুর। স্বাভাবিকভাবেই হরমন্দির সাহিবে ঢোকার লম্বা লাইন। দেখলাম অনুরোধ করলে বয়স্ক ব্যক্তিদের বা যাঁরা শারীরিক কারণে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম তাঁদের দ্রুত দর্শন করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হরমন্দির সাহিবে ঢোকার দরজা চারদিকে চারটি। জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকলের অবারিত দ্বার বোঝাবার জন্যেই নাকি এই চার দুয়ারের নির্মাণ। ভেতরে গুরু গ্রন্থসাহিব অধিষ্ঠিত, সুন্দর কারুকার্যময় চাদরের নীচে। দুপাশে দুজন চামর দোলাচ্ছেন, একজন বসে পড়ছেন। মেঝেতে মোটা কার্পেট পাতা। দেওয়ালের কারুকার্য মনোমুদ্ধকর। দর্শনার্থীরা ঢুকছেন, অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, অনেকে বসেও আছেন। কোনো ঠেলাঠেলি নেই, কোলাহল নেই, সুন্দর শান্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশ। সত্যিই মন ভরে যায় এখানে এলে। দোতলায় অকাল তখত, গুরু গ্রন্থসাহিবের রাত্রিকালীন আবাস। প্রতিরাতে সোনার পালকিতে করে বাদ্য সহকারে তাঁকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার ভোররাতে নামিয়ে আনা হয় একইভাবে। আরও ওপরে আছে মিউজিয়াম। বর্তমানে যে হরমন্দির সাহিব আমরা দেখি তা ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি। পরে আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সংস্কার করা হয়। উনিশ শতকের প্রথমদিকে মহারাজা রণজিৎ সিংহ একে সোনায় আবৃত করার কাজ শুরু করেন।
স্বর্ণমন্দিরের লঙ্গরখানার কথা উল্লেখ না করলে বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রোজ হাজার হাজার মানুষ এখানে আহার গ্রহণ করেন। রীতিমতো বিশাল আয়োজন প্রতিদিনই। রুটি তৈরির মেশিন রয়েছে যা দিয়ে প্রতি ঘন্টায় হাজারের ওপর রুটি বানানো হয়। ধর্মপ্রাণ শিখরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে এখানে শ্রমদান করে পুণ্য অর্জন করেন। সে লঙ্গরখানায় রান্না করে, এঁটো বাসন মেজে, গুরদ্বোয়ারা ঝাঁট দিয়েই হোক কী দর্শনার্থীদের জুতো রাখার ব্যবস্থা করেই হোক।
পরের গন্তব্য জালিয়ানওয়ালা বাগ। হ্যাঁ ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সেই জালিয়ানওয়ালা বাগ যেখানকার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। সেই সরু গলিটা দিয়েই ঢুকলাম, যেখানে দুজন পাশাপাশি ভালোভাবে হাঁটতে পারে না। জালিয়ানওয়ালা বাগে ঢোকা বা বেরোনোর এই একটাই রাস্তা ছিল তখন আর এই রাস্তাটাকেই বন্ধ করে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালান হয়েছিল এখানে সমবেত মানুষের উদ্দেশ্যে। হুড়োহুড়িতে কতজন পড়ে গেছিল, গুলি থেকে বাঁচার জন্যে কতজন কুয়োতে ঝাঁপ দিয়েছিল তার ঠিক ঠিকানা নেই। হাজার হাজার মৃতদেহ স্তুপাকৃতি হয়েছিল সেদিন এখানে - ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল। চিহ্নিত করা আছে সেই জায়গা ঠিক যেখান থেকে গুলি চালান হয়েছিল। দেওয়ালের গায়ে আজও রয়েছে অসংখ্য গুলির চিহ্ন। মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে অমর জ্যোতি। যদিও অত্যন্ত দৃষ্টিকটূভাবে সেই জ্যোতির দুধারে দাঁড়িয়ে ফটো তোলার হিড়িক চোখে পড়েছে। এক শিখ যুবকের আক্ষেপ, ছবি তোলার যত উৎসাহ তার অর্দ্ধেকও ইতিহাস জানার জন্যে নয়। বাগানটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংরক্ষিত। মিউজিয়ামও আছে, তাতে আছে এই সময়কার আলোকচিত্র যা দেখলে মন আরও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
স্বর্ণমন্দির আর জালিয়ানওয়ালা বাগ দেখতে দেখতেই দেখি ঘড়ির কাঁটা দুটোর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। অতএব তাড়াতাড়ি জঠরাগ্নিকে শান্ত করে ওয়াঘার উদ্ধেশ্যে দৌড়। সেখানে আবার প্রচণ্ড ভিড় হয় এবং অনেক আগে থেকে না গেলে নাকি রিট্রিট সেরিমনি দেখার কোনো আশাই থাকে না। আর এবার তো শুনলাম অমৃতসরে রেকর্ড ভিড় হয়েছে।
ওয়াঘা বর্ডার ভারত আর কাশ্মীরের মধ্যে একটি রোড বর্ডার। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের ওপর এই বর্ডার। ওয়াঘা নামে একটি গ্রামের ওপর দিয়ে এই সীমা রেখা যা র্যাডক্লিফ লাইন নামে ইতিহাসে পরিচিত সেটি গেছে। এই গ্রামটির একাংশ বর্তমানে ভারতে এবং অপরাংশ পাকিস্তানে। ওয়াঘা থেকে লাহোরের দূরত্ব বাইশ কিলোমিটার এবং অমৃতসরের আঠাশ কিলোমিটার।
বর্ডারের অনেক আগেই গাড়ি পার্কিং-এ ছেড়ে দিতে হয়। রিকশা করে কিছুদূর যাওয়া যায়। তারপর সিকিউরিটি চেকিং এর পর বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। মাঝখানে জি টি রোড, দুপাশে মানুষের ঢল। জি টি রোডের দুপাশেই গ্যালারি। সেখানে তখন তিল ধারণের স্থান নেই, যদিও আমরা সূর্যাস্তের প্রায় আড়াই ঘন্টা আগে পৌঁছেছি। যাই হোক অনেক ধাক্কাটাক্কা খেয়ে গ্যালারির ওপর দিকে কোনো মতে দাঁড়াবার একটু জায়গা পেলাম। ভালো করে তাকাতেই অবাক! এই তো চওড়া জি টি রোড চলে গেছে, ওই তো একটা গেট আর গেটের ওপারে পাকিস্তান! ওইতো ওদের সাদা সবুজ রঙের গ্যালারি দেখা যাচ্ছে। একেবারে যেন হাতের মধ্যে। রাস্তায় তখন অনেকে ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে দৌড়চ্ছে, একেবারে গেট অবধি যাচ্ছে। দেশাত্মবোধক গান বাজছে, ভিড়ের মধ্যে থেকেও প্রচুর তিরঙ্গা উড়ছে। মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠছে 'বন্দেমাতরম,' 'জয় হিন্দ,' 'হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ।' মজার ব্যাপার আমাদের এদিকে এত ভিড়, ওপাশে পাকিস্তানের গ্যালারিতে গুটিকয়েক লোক।
প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে ওয়াঘা বর্ডারে রিট্রিট সেরিমনি হয়। গেট খুলে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। প্যারেড করে আমাদের বি এস এফের জওয়ানরা গেট অবধি যায়, ওদিক থেকে পাকিস্তানের সেনারা আসে। একসঙ্গে দুদেশের পতাকা নামানো হয় সেদিনের মতো। পতাকা সুন্দর করে ভাঁজ করে নিয়ে আসা হয়। প্যারেডেও বেশ অভিনবত্ব আছে। এটা দেখতেই মানুষের ঢল। একটা সময় যখন গেট খোলা ছিল তখন আর দুটো দেশ যেন মনে হচ্ছিল না, শুধু দেখা যাচ্ছিল একটা চওড়া সোজা রাস্তা আর আর তার দুপাশে শুধু মানুষ। পতাকা নেমে গেল, অনুষ্ঠান শেষ হল, সূর্যও ডুবল ওয়াঘা সীমান্তে। প্রতিদিন ঘড়ির কাঁটা ধরে এই অনুষ্ঠান হয়। ভিড় বেশি হয় অনুষ্ঠানের সময়েই, দিনের অন্য সময় ফাঁকাই থাকে। ইচ্ছে করলে অন্য সময় এসে ফাঁকায় ফাঁকায় সীমান্ত দেখে নেওয়া যায়।
দিনের শেষে অমৃতসর দর্শন সেরে আমাদেরও হোটেলে ফেরার পালা।
স্বর্ণমন্দির, জালিয়ানওয়ালা বাগ, ওয়াঘা - সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ মনে পরের দিন বিদায় জানালাম ছোটবেলার বইয়ের পাতার বড় চেনা ইতিহাসের তীর্থভূমি অমৃতসরকে।
অমৃতসরের তথ্য || অমৃতসরের আরো ছবি
সংখ্যাতত্ত্ববিদ অদিতির কাছে বই আর অক্সিজেন সমতুল্য। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। ভ্রমণ,ছবি তোলা, এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি ইদানীং লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন (আসমানিয়া, জয়ঢাক,পরবাস, মাধুকরী, গল্পকবিতা ডট কম) ও আরো দু একটি পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।