চন্ডীগড় (Chandigarh)-পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের রাজধানী কেন্দ্রশাসিত চন্ডীগড়ের পত্তন হয় ১৯৫০-৫৩ সালে। ১৯৮৬ তে পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত হয় এই শহর। ১১৪ বর্গকিমি ব্যপী এই শহর ৪৭টি সেক্টরে বিভক্ত। এর মধ্যে শহরের কেন্দ্র ১৭ নং সেক্টর তথা সিটি সেন্টার। জেলা সদর, আই এস টি টি বাস টার্মিনাস, প্যারেড গ্রাউন্ড, শপিং সেন্টার, অফিস, ব্যাঙ্ক, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আধুনিক বাড়িঘর-সবমিলিয়ে জমজমাট এই শহর বর্তমানে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিটির তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
চন্ডীগড় ভ্রমণার্থীদের জন্য দর্শণীয় সেক্টর ১-এ নেকচাঁদের অভিনব সৃষ্টি রকগার্ডেন। রকগার্ডেন লাগোয়া শুকনা লেক। শীতে পরিযায়ী পাখিদের আসর বসে এখানে। লেকের পাড় থেকেই দূরে চন্ডীদেবীর মন্দিরের চূড়ো নজরে পরে-দেবীর নামেই শহরের নাম। শহরের কেন্দ্রে রয়েছে সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট এবং বিধানসভা। হাইকোর্টের উত্তরে বিশালাকার ওপেন হ্যান্ড- মৈত্রীর প্রতীক।
সেক্টর ১০-এ পাশাপাশি রয়েছে মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি। সেক্টর ১৭-য় সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভবনে পোর্ট্রেট সংগ্রহ ও সেক্টর ২৩-এ বালভবনে নানান দেশের পুতুল সংগ্রহ দেখার মত।
সেক্টর ১৪-য় মনোরম পাহাড়ি পরিবেশে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। সেক্টর ১৬-য় ২৭ একর এলাকা জুড়ে এশিয়ার বৃহত্তম জাকির গোলাপবাগ। প্রায় ১৫০০-২০০০ প্রজাতির গোলাপ ফোটে এখানে। লাগোয়া স্টেডিয়াম। সেক্টর ১৬-র আরেক আর্কষণ ওষধি বৃক্ষের বাগান শান্তিকুঞ্জ। সেক্টর ৩-এ বোগেনভিলা গার্ডেন।
শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে হাটবীর জ্যুলজিকাল গার্ডেন। চন্ডীগড় থেকে বাসে ১০৩ কিমি দূরে নাঙ্গাল। নাঙ্গাল থেকে ১৩ কিমি দূরে ভাকরা। এখানে রয়েছে শতদ্রু নদীর ওপরে বিখ্যাত ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ (Bhakra-Nangal Dam)। নাঙ্গাল থেকে ২৩ কিমি দূরে রোপার জেলায় আনন্দপুর সাহিব-শিখদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। আনন্দপুর সাহিবকে ঘিরে নানান ইতিহাস আর গল্পকথা ছড়িয়ে রয়েছে। নিচু টিলার ওপর দুধসাদা রঙের কারুকার্যময় গুরুদ্বারটি দূর থেকে নজরে পড়ে। আনন্দপুর-চন্ডীগড় সড়কের মাঝ দূরত্বে ঐতিহাসিক রোপার (Ropar)।
যাওয়াঃ- রেল, বাস, বিমান-ভারতের নানান অঞ্চলের সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে চন্ডীগড়ের। নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর চন্ডীগড়। সিটি সেন্টারে ইন্টার স্টেট বাস টার্মিনাস। বাসে বা ট্রেনে চন্ডীগড় থেকে আনন্দপুর সাহিব বেড়িয়ে নেওয়া যায়।
থাকাঃ- বিভিন্ন সেক্টরে সরকারি ট্যুরিস্ট বাংলো বা গেস্ট হাউস আছে। শহরজুড়ে রয়েছে অনেক বেসরকারি হোটেল ও ধর্মশালা। এছাড়া সরকারি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পঞ্চায়েত ভবন, ইউনিয়ন টেরিটরি গেস্ট হাউস, ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউস, পাঞ্জাব ভবন, হরিয়ানা হাউস।
শহর থেকে ২ কিমি দূরে পঞ্চকুলায় সরকারি যাত্রীনিবাস আছে। আনন্দপুর সাহিবে পাঞ্জাব ট্যুরিজমের কাটাম্বা ট্যুরিস্ট বাংলো এবং হরিয়ানা ট্যুরিজমের চম্পা ট্যুরিস্ট হাট রয়েছে। আনন্দপুর সাহিবের গেস্টহাউসটিও ভালো। চন্ডীগড়ের এস টি ডি কোডঃ- ০১৭২।
কেনাকাটাঃ- সেক্টর ১৭-য় গভর্মেন্ট এম্পোরিয়াম। সুপার বাজারও এখানেই। কেনাকাটার তালিকায় রাখা যায় লুধিয়ানার শাল ও সোয়েটার।
উৎসবঃ- এখানকার বড় উৎসব হোলা-মহল্লা ও দেওয়ালি। হোলির পরদিনই শিখ উৎসব হোলা-মহল্লা জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়।
অমৃতসর (Amritsar)- পাঞ্জাব ভ্রমণের মূল আর্কষণ অমৃতসর। ছেলেবেলার ইতিহাসের পাতা থেকে জীবন্ত হয়ে ওঠে স্বর্ণমন্দির (Golden Temple) আর জালিয়ানওয়ালাবাগ (Jalianwalabag)।
ওয়াঘা সীমান্তঘেঁষা শিখ তীর্থভূমি অমৃতসর। ভারত পাকিস্তানের সংযোগকারী সড়কও গেছে এই শহরের বুক দিয়ে। শিখদের চতুর্থ গুরু রাম দাস ১৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে শহরটি প্রথম গড়ে তোলেন। পঞ্চম গুরু অর্জুন ১৬০১ সালে গড়ে তোলেন আয়তাকার সরোবরের মাঝে হরমন্দির। এই সরোবরের জল অমৃতের মতোই শুদ্ধ-তাই শহরের নাম চক রামদাসপুর থেকে বদলে হয় অমৃতসর। গুরু অর্জুন-ই শিখদের পবিত্রগ্রন্থ আদি গ্রন্থসাহিব সঙ্কলিত করে হরমন্দিরে স্থাপন করেন। ১৬৬১ সালে আহম্মদ শাহ দুরানি শিখদের পবিত্র এই মন্দিরটি ধ্বংস করেন। ১৭৬৪ তে মন্দির আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয়। ঊনবিংশ শতকে রণজিৎ সিংজির উদ্যোগে মন্দিরটি পুনরায় সংস্কার করা হয়। এইসময়েই মন্দিরের উপরিভাগ সোনায় মুড়ে দেন রণজিৎ সিং। নাম বদলে হয় স্বর্ণমন্দির। মন্দিরের রুপোর দরজায় ও অন্দরের কারুকার্যও স্বর্ণখচিত। স্বর্ণমন্দিরে খালি পায়ে ও মাথা ঢাকা দিয়ে ঢোকা বাধ্যতামূলক। মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ।
স্বর্ণমন্দিরের লাগোয়া অকাল তখত শিখদের ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। মন্দিরের কাছেই বাবা অটল সাহিব গুরুদ্বারা।
স্বর্ণমন্দির থেকে অল্প দূরে ঐতিহাসিক জালিয়ানওয়ালাবাগের দেওয়ালগুলি আজও ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলের বুলেটের ক্ষতের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আন্দামানের সেলুলার জেলের মতো জালিয়ানওয়ালাবাগও প্রতিটি ভারতবাসীর তীর্থক্ষেত্র। নিস্তব্ধ দুপুরে বিকেলের নির্জনতায় দাঁড়ালে আজও যেন মনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে নিরস্ত্র জমায়েতের ওপর ব্রিটিশ বাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালানোর সেই নির্মম দৃশ্য। লাল বেলে পাথরের শহীদ স্মারক আর অনির্বাণ দীপশিখা সেইসব হতভাগ্য ভারতবাসীর কথা নীরবে শোনায় তাদের উত্তরসূরীদের।
অমৃতসরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে স্বর্ণমন্দির থেকে মিনিট পনেরোর দূরত্বে দেবী দুর্গার মন্দির বা দুর্গিয়ানা মন্দির। আরও এগিয়ে গোবিন্দগড় দুর্গ। রেলস্টেশনের কাছে রামবাগ উদ্যান।
শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে রামতীর্থ। এখানেই ঋষি বাল্মিকীর আশ্রমে রাম-সীতার যমজ সন্তান লব-কুশের জন্ম হয় বলে কথিত আছে।
শহর থেকে ২৭ কিমি দূরে ওয়াঘা সীমান্তে প্রতিদিন বিকেল ৫-৩০ নাগাদ ভারত ও পাকিস্তানি ফৌজের আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা নামানোর বীটিং রিট্রিট সেরিমনি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। খেয়াল রাখবেন ভিজিটর্স এরিয়ায় ক্যামেরা, স্বচ্ছ প্লাস্টিক ব্যাগে জলের বোতল, টুকিটাকি খাবার নিতে দিলেও কোন রকম ঢাকা ব্যাগ কিন্তু নেওয়া যাবেনা।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর অমৃতসর। তবে একযাত্রায় পাঞ্জাব-হিমাচল বেড়াতে হলে গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন ১১২ কিমি দূরের পাঠানকোট (Pathankot)।
থাকাঃ- শহরজুড়ে নানা মান ও দামের বেসরকারি হোটেল রয়েছে। অমৃতসরের এস টি ডি কোডঃ-০১৮৩।
কেনাকাটাঃ-অমৃতসরের কম্বল, উলের পোশাক ও কার্পেট বিখ্যাত।
মরসুমঃ- বেড়ানোর সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ।
উৎসবঃ- অমৃতসরের বড় উৎসব দেওয়ালি। আলোকমালায় সেজে ওঠে শহর। দীপ সজ্জায় আলোকিত হয় মন্দির। নভেম্বর মাসে কার্তিক পূর্ণিমার তিথিতে রামতীর্থে চারদিনব্যাপী উৎসব চলে।
ভ্রমণ কাহিনি - ইতিহাসের তীর্থভূমি অমৃতসর