যেখানে ঢেউ ওঠে লবণ হ্রদে
সুমিতা সরকার
~ লাদাখের তথ্য ~ লাদাখের ছবি ~ লাদাখের ছবি ~
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান সেবিকার কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতে না আসতেই দেখি সিটের সামনের স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে লে শহরের নাম - আমরা পৌঁছে গেছি। জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরফ ঢাকা পর্বতশ্রেণী। চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সেই ছোট্ট এয়ারপোর্টে নামছে আমাদের বিমান । সত্যি সত্যি নিজের গায়ে ব্যথা দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল এটা আদৌ স্বপ্ন নাকী বাস্তবই - এই সেই অপার সৌন্দর্যে মোড়া চির রহস্যের দেশ লাদাখ! হ্যাঁ সত্যি,স্বপ্ন নয় সত্যি।
বহুদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল লাদাখ যাবার কিন্তু কাশ্মীর হয়ে গাড়িতে লাদাখ পৌঁছতে তিন থেকে চার দিন লাগে। আমার এবং কর্তার কষ্টের কথা ভাবিনা, কিন্তু সঙ্গে যে আছে আমাদের ছোট্ট রোশনি, আমার মেয়ে। সেও বেড়াতে খুব ভালবাসে। কিন্তু অতিরিক্ত উচ্চতার কষ্টের কথা ভেবেই লাদাখ যাবার পরিকল্পনা বারবারই পিছিয়ে দিচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ মনে হল যদি দিল্লি থেকে প্লেনে লে যাই তাহলে হয়তো পথের সৌন্দর্য কিছুটা কম দেখব কিন্তু আমাদের আনন্দ আমার ছোট্ট মেয়ের কষ্টের কারণ তো হবেনা। ব্যস, নবমীর সকালে দিল্লির ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে চড়ে বসলাম বিমানে। পৌঁছে গেলাম লে। চারদিকের নানা রঙের পাহাড় যেন হাত ধরাধরি করে আগলে রেখেছে শহরটাকে। সব পাহাড়ই যেন হাত ছোঁয়া দূরত্বে। আমরা বাক্য হারা। যে আমি এক সেকেন্ড কথা না বলে থাকতে পারি না, সেই আমিও ঘোরের মধ্যে দিয়ে চেকিং পর্ব সেরে কখন যে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি টের পাইনি ।
হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের এবারের সফরসঙ্গী "করমা ভাইয়া''। অসম্ভব ভালো - যেমন বিনয়ী, তেমনি মিশুকে আর তার সঙ্গে পরম সাহায্যকারী। লাদাখে প্রিপেড কানেকশান চলে না। উপায়? ভরসা সেই করমাই। দিয়ে দিল আস্ত একটা মোবাইলই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ। উত্তরে পেলাম এক গাল হাসি। চটপট উঠে পড়লাম গাড়িতে। অক্টোবর মাস হলেও লে শহরে বেশ ভালো ঠাণ্ডা - দিনের বেলাতেই ৮-৯ ডিগ্রি। ধীরে ধীরে গাড়ি ঢুকল শহরে। হোটেল, দোকান- বাজার, বাড়ি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো পাহাড়ি শহর। তবে চরিত্রের দিক থেকে সিমলা কী দার্জিলিং সবার থেকে আলাদা। অনেক হোটেলেরই নিজস্ব ছোট ছোট কিচেন গার্ডেন আছে। আমরা যে হোটেলটায় উঠেছিলাম সেটা বাজারের একদম কাছেই। ঘরে দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানলা। পর্দা সরাতেই দেখা যাচ্ছে বরফ ঢাকা পর্বতশ্রেণী। আর নীচের তাকালেই চোখে পড়ছে বাগান জুড়ে বাঁধাকপি, শাকসবজি তার সঙ্গে আপেল গাছ থেকে গোলাপ গাছ সবই। ভাবা যায় না। সত্যি বলতে কী হোটেলের ওই জানলাটা আমার চোখের ও মনের দুইয়েরই রসনা পরিতৃপ্ত করছিল।
পরেরদিন সকাল সাতটায় আমরা বেড়িয়ে পড়লাম প্যাংগং লেকের উদ্দেশে। প্রথমে খানিকটা পথ শহরের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম দুধারে সুন্দর সুন্দর বাড়ি, হোটেল আর তার সঙ্গে লাগোয়া বাগান। ধীরে ধীরে শহর ছেড়ে গাড়ি বেড়িয়ে পড়ল যে রাস্তায় তার দু'ধারে রুক্ষ প্রান্তর, দূরে কারাকোরাম শৃঙ্গের সারি। এক এক শৃঙ্গ এক এক রঙের, কিন্তু অদ্ভুত তাদের গায়ে কোন গাছপালা নেই। সেই রুক্ষ সৌন্দর্য যেন এক অজানা পৃথিবীতে পৌঁছে দিয়েছিল। সেই অজানা প্রান্তরে কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর হঠাৎ শুরু হল এক নীল নদের পথ চলা। জানতে পারলাম এই হল ইতিহাস প্রসিদ্ধ সিন্ধু নদ। যার নীল জলের হাত ছানিতে সাড়া দিয়ে আমরা তিনজনেই তার কাছে উপস্থিত। হাত দিয়ে ছুঁলাম তাকে, মনে হল যেন পৌঁছে গেছি অতীত কালে, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই এখান দিয়ে একদল শক অথবা হূণ সৈন্য ঘোড়া চালিয়ে ছুটে যাবার পথে ঘোড়াকে জল খাওয়াতে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই সুন্দর অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে করমা ভাইয়ার ডাকে আবার গিয়ে উঠলাম আমাদের বর্তমান যুগের যন্ত্রযানে।
পথে দেখা হল লাদাখের অতি পুরাতন গুম্ফা হেমিস। কিন্তু দরজা বন্ধ থাকার জন্য বাইরে থেকেই চোখের পিপাসা মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই পৌঁছতে হবে সেই রহস্যময়ীর কাছে - যার নাম প্যাংগং লেক। পথে পড়ল ছোট্ট গ্রাম কারু।
যেহেতু রাস্তায় কোন হোটেল নেই তাই গাড়িতে ওঠার সময় কিছু কেক, বিস্কুট, বাদাম, চকলেট কেনা হয়েছিল। সেই বিস্তীর্ণ ধূধূ প্রান্তরে করমা ভাইয়ার গাড়ির লাদাখি সঙ্গীত আর মুখরোচক খাবার লাদাখের প্রাকৃতিক দৃশ্যকে আরও মনোরম করে তুলেছিল। এখানে পাহাড়ের গায়ের রঙে সোনালি আভা। পথের বাঁ দিকে পাহাড়ের মাথায় চোখে পড়ল একটি গুম্ফা। জানা গেল এটি চারশো বছরের পুরাতন চেমড়ে গুম্ফা। এরই মাঝে এল পাহাড় ঘেরা আরেক এক ছোট্ট গ্রাম নাম শাকতি।
এর পর ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের পর পাহাড় টপকাতে লাগলো। প্রথমে দেখলাম পথের ধারে অল্পসল্প বরফ পড়ে আছে, চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেখি চারদিকে শুধুই সাদা বরফ আর দূরে দেখা যাচ্ছে চাংলা পাস। হঠাৎ করমা ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে দিল। দেখলাম গাড়ির পিছন থেকে বেরিয়ে এলো লোহার চেন, লাগানো হল গাড়ির চাকায়। এই সময় দেখি কিছু গাড়ি ফেরত আসছে। করমা ভাইয়া তাদের প্রশ্ন করে জানলো সামনে বরফ পড়ে রাস্তা প্রায় বন্ধ। তবে মিলিটারি ভাইরা রাস্তা পরিস্কার করছে, সময় লাগবে। আমার কর্তা মহাশয় খুবই চিন্তিত, আগে এগোবে না আজ ফিরে যাবে।
অদ্ভুত আমাদের চালক, তার কপালে সামান্য চিন্তার স্বেদবিন্দুও জমেনি, তার কথায় যদি আমরা এগোতে রাজি থাকি সে ঠিকই পৌঁছে দেবে। খানিকটা এগিয়ে দেখি সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বাঁকের কাছে ক্রেন দিয়ে বরফ পরিস্কার করার কাজ চলছে। যাইহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তা পরিস্কার হোল, চলতে শুরু করল গাড়ি। বললে ভুল হবে না, যখন এই বরফ ঢাকা সরু পথ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল আমাদের নিজেদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন নিজেরাই শুনতে পাচ্ছি। ধীরে ধীরে গাড়ি পৌঁছল তুষার ঢাকা চাংলা পাস - উচ্চতা ১৭০০০ ফিট ।
চাংলা বাবার মন্দিরে নানা রঙের প্রার্থনা পতাকা উড়ছে। এখানে একটি মিলিটারি ক্যাম্পও আছে। আমাদের চালক লে শহর থেকে করে আনা পারমিট চাংলা পৌঁছনোর আগেই কারু চেকপোস্টে জমা দিয়ে ছিল। মিলিটারি ভাইরা এতটাই ভালো, আমাদের সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে দেখে নিজেরাই ও ঠিক আছে কিনা খোঁজ নিল। তারপর নিজেদের থেকে ওষুধও দিল, যাতে কষ্ট না হয়। তবে আমি তখন চাংলার সাদা পেঁজা তুলোর মতো বরফ ঢাকা রূপে আত্মবিস্মৃত, গাড়ি থেকে নেমে পায়ে পায়ে দাঁড়ালাম বরফের ওপর। কিন্তু ওই যে আমার আবার ছটফটে স্বভাব, না দেখে পা দিয়েছি শক্ত বরফের ওপর। ব্যাস পপাত ধরণীতলে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েছি, চারদিক দেখছি কেউ দেখেনি তো, ও মা দেখি মেয়ে আর কর্তা দুজনেই সাক্ষী এবং ফিকফিক করে হাসছে! আর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা গাড়িতে। আমরা ছাড়াও ছিল কিছু বিদেশি টুরিস্ট, লাদাখি গ্রামবাসী আর মিলিটারি সৈন্য। যেদিকেই চোখ রাখি মনে হয় সব দৃশ্যই ক্যামেরায় বন্দি করি। কিন্তু আমার কর্তার ভাষায় কিছু দৃশ্য মন-ক্যামেরায় তুলে রাখতে হয়।
যাইহোক করমা ভাইয়া আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলো। পাস থেকে নামার মুখে হঠাৎ দেখি করমা ভাইয়া গাড়ি থামিয়ে এক দৌড়ে সামনের গাড়ির একপাশ ধরে উঠে পড়ল সঙ্গে আরও কয়েকজন লাদাখি। ভালো করে দেখে বুঝলাম জিপটা আরেকটু হলেই গড়িয়ে খাদে নেমে যাচ্ছিল। আমাদের চোখে না পড়লেও করমা ভাইয়ার অভিজ্ঞ চোখ সেই বিপদকে দেখতে পেয়েছিল তাই তার এই চেষ্টা এবং সত্যি জিপটি ধীরে ধীরে রাস্তায় উঠে এল। দুহাতের ধুলো বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে সে যখন আবার চালকের আসনে বসল তখন তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কিছুই হয় নি। ধীরে ধীরে রাস্তার দুধারের বরফ কমতে লাগল এবং আমরা পাহাড় ছেড়ে নেমে এলাম উপত্যকায় যেখানে লম্বা রাস্তার দুধারে ধু ধু প্রান্তর। ধীরে ধীরে সামনে এল ছোট্ট একটা গ্রাম নাম তাংসে ( উচ্চতা ১৩০০০ ফিট )। করমা ভাইয়া বলল এখানে কিছু খাবার খেয়ে নিতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি অনেকেই প্যাংগং দেখে ফিরে এখানেও রাত কাটান। সামনের একটা ছোট্ট সুন্দর বাড়িতে ভাইয়া আমাদের নিয়ে গেল। তাদের খাবার ঘরে এল গরম গরম মোমো, ধোঁয়া ওঠা লাল চা আর চাউমিন। আমি তো খুব খুশি, মেয়েও। দেখি আবার ভাত ডাল সবজিও এল। আমরা তখন পরস্পরের দিকে অবাক নয়নে দেখছি। যাঃ বাবা, এত খাওয়া যায় নাকি? প্রশ্ন করতে জানা গেল, যেহেতু আমরা বাঙালি তাই ভাতেরও ব্যবস্থা। উফ, এই ঠাণ্ডায় গরম ভাত, চাউমিন সব তখন অমৃতের মতো। চটপট খাওয়া সেরে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। তাংসে থেকে প্যাংগং প্রায় ৩৫ কিমি। হঠাৎ নিজের পুঁথিগত বিদ্যা যাচাই করার ইচ্ছা হোল। করমা ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম পথে তো লুকুং নালা পড়বে, সেখানে কি জলে ভরে যাবে? তবে আমরা যাব কী করে? কী বুঝল জানি না, তবে জানালো এখন কোন অসুবিধা নেই। চোখ পড়ল দুপাশের পাহাড়ে, দেখি কোনোটা লাল তো কোনোটা খয়েরি আবার কোনোটাবা কালো। যেন এই মাত্র হোলি খেলা হয়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে। হঠাৎ দূরে দেখি ফাগে রাঙা পাহাড় গুলির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কোন এক অপরূপার সবুজ মসলিনের আঁচলের অংশ। বুঝলাম এই সেই অপার্থিব সুন্দরী প্যাংগং সো-র এক ঝলক ।
সেই এক ঝলক সৌন্দর্যকেও ক্যামেরা বন্দী করে ফেলল আমার কর্তাটি। আমি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায়, আর কতক্ষণ লাগবে ওই রূপসীর কাছে পৌঁছতে? জানা গেল মিনিট কুড়ি। এবার গাড়ি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলো এবং আরও একটা দুটো পাহাড়কে ভেদ করে তৈরি করা রাস্তা দিয়ে নামতেই সামনেই বিস্তৃত প্যাংগং সো।
গাড়ি নেমে এল লেকের ধারে। লেকের জলে সবুজ ও নীল রঙের মেলামেশা। জোরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্রাহ্মণী হাঁস। চ্যাং চেনমো পর্বতশ্রেণী ঘিরে আছে এই হ্রদকে। এই হল ১৪০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত স্বর্গীয় লেক, যা প্রস্থে ৬ থেকে ৭ কিমি, দৈর্ঘ্যে ১৩০ কিমি। এর তিন ভাগ চিনে এক ভাগ ভারতে। তবে সৌন্দর্য মনকে ভরিয়ে তুললেও শরীর তখন ক্লান্তিতে ভরে উঠেছে। হ্রদের ধার দিয়ে দিয়ে ডানদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে সাত কিলোমিটার দূরে হ্রদের তীরেই রয়েছে স্পাংমিক গ্রাম। তারই কিছুটা আগে রয়েছে মারতসেমিক ক্যাম্প। সেখানেই আমাদের বুকিং ছিল। গাড়ি পৌঁছে দিল সেই ক্যাম্পে। তবে শুনতেই ক্যাম্প, কোন পাঁচ তারা হোটেলের থেকে কম নয় সুযোগ সুবিধা। বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটরই ভরসা। ক্যাম্পে ঢুকে আমরা প্রথমে রিফ্রেশ হতে হতেই চলে এল কফি। কফির কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে দেখি পাশের ক্যাম্পে উঠেছে দুজন ছটফটে বিবাহিত তরুণতরুণী। আলাপ করতে জানতে পারলাম ওদের গাড়িটাই খাদে নেমে যাচ্ছিল। ওরাও বাঙালি। জমে উঠল আড্ডা। সন্ধ্যে নেমে এল প্যাংগং এর বুকে। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে লেকের জল। সেই সৌন্দর্যকে অনুভব করতে করতেই টুপ টাপ করে বরফ পড়া শুরু হল। কর্তার আদেশে কন্যাসহ তাঁবুতে ফিরলাম। তিনি কিন্তু ক্যামেরা হাতে ঝিলের ধারে ঘুরে এলেন এবং দেখালেন চাঁদের আলোয় তোলা ঝিলের আধো আলো আধো আঁধারের ছবি। অপূর্ব সেই দৃশ্য।
লেপের তলায় ঢুকে কন্যা তখন তার বাবার সঙ্গে সারাদিনের অভিজ্ঞতার গল্প করতে ব্যস্ত, এমন সময় ক্যাম্পের ম্যানেজার এসে জানালো খেতে যেতে হবে ওদের ডাইনিং হলে। একটুও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। কিন্তু কী আর করব জ্যাকেট চড়িয়ে পৌঁছালাম খাবার জায়গায় । চিনা লণ্ঠন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো বেশ বড় একটা তাঁবু । আর খাবার? স্যুপ থেকে চিকেন কারি সবই প্রস্তুত। কিন্তু খাবার লোক বলতে আমরা পাঁচজন। যাইহোক সুস্বাদু খাদ্য আর বাঙালির আড্ডায় জমে গিয়েছিল ওদের ডাইনিং হল। ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা গেল সবকিছুই আসে লে শহর থেকে। গ্রীষ্মকালে এখানে বার্লি আর কড়াই শুঁটির চাষ হয়। পশমিনা ভেড়ারও চাষ হয় এখানে। এই গ্রামের অধিবাসীদের চাংপা বলে। আড্ডা শেষে সোজা তাঁবুতে ঢুকে লেপের তলায়।
সকালে ঘুম ভাঙল কর্তার হাঁকডাকে। তাঁবুর বাইরে পা দিতে গিয়েই দেখি চারদিক নরম সাদা বরফে ঢেকে গেছে। আকাশ পরিষ্কার। নীল সাদা মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। চটপট তিনজনে নেমে গেলাম লেকের ধারে। লেকের বিপরীত দিকের পর্বত শ্রেণী বরফে ঢেকে গেছে। যেদিকেই তাকাই শুধু সাদা বরফ। কিন্তু ঝিলের জলে এক ফোঁটাও বরফ নেই। আর আশ্চর্য এই ঝিল। এর জলে সমুদ্রের মতো ঢেউ ওঠে। ক্ষণে ক্ষণে রংও বদলায়, কখনো নীল কখনও সবুজ। আবার কখনও দুটি রঙই হাত ধরাধরি করে থাকে। খানিকক্ষণ শুধু ক্যামেরার সাটার টেপার শব্দটুকু ছাড়া সব শব্দই নিজের কানে অদ্ভুত ঠেকছিল। বুঝতে পারছিলাম না কী বিশেষণ দেব এই সৌন্দর্যকে। অপূর্ব, অপার্থিব, অসাধারণ, স্বর্গীয়! - ব্যাস আমার দৌড় শেষ। কিন্তু প্যাংগং সো- র সৌন্দর্য সব বিশেষণের উর্দ্ধে। যা শুধু চুপচাপ ঝিলের ধারে দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়। ভাষায় প্রকাশ করা বোধ হয় যায় না।
তারপর আর কী আবার ধীরে ধীরে ক্যাম্পে ফেরা। খাবার জায়গায় গিয়ে দেখি এলাহি ব্যাপার। আলুর পরোটা, বাঁধাকপির পরোটা, ডিমের ঝুরি ভাজা, কর্নফ্লেক্স দুধ, পরিজ, আরও কত কী। কিন্তু এবার ফেরার পালা তাই দুধ কর্নফ্লেক্স দিয়েই প্রাতঃরাশ সারা হোল। এর মধ্যেই করমা ভাইয়া গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত। বিদায় নেওয়ার আগে লেকের ধারে চেয়ার পেতে বসে সবাই মিলে কফি খাওয়া হোল। এবার বিদায় নেওয়ার পালা পরস্পরের থেকে আর অবশ্যই তাদের থেকে যারা এই জনশূন্য জায়গায় অপেক্ষা করে থাকে আমাদের জন্য সেই ম্যানেজার দাদা আর তার সঙ্গীরা। আর একবার লেকের ধারে গাড়ি নিয়ে ঘুরে লেকের জলে হাত ছুঁয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিদার জানালাম প্যাংগংকে।
গাড়ি রওনা দিল লে শহরের দিকে।
~ লাদাখের তথ্য ~ লাদাখের ছবি ~ লাদাখের ছবি ~
নৃত্য বিশারদ সুমিতা ভালবাসেন বই পড়তে ও গান শুনতে। ঘর সামলানোর ফাঁকে অবসর আর সুযোগ পেলেই সপরিবারে বেড়িয়ে পড়েন অচেনা অদেখা প্রকৃতির অমোঘ টানে।