সুন্দরী নায়াগ্রা
সুচেতনা মুখোপাধ্যায় চক্রবর্তী
~ নায়াগ্রার তথ্য ~ নায়াগ্রার আরো ছবি ~
সকাল আটটা বাজার আগেই ট্যুরিস্ট বাসে উঠে সাত তাড়াতাড়ি নিজের সিটে গিয়ে বসলাম – টানটান উত্তেজনা আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখা অন্যদের আসার অপেক্ষায়। একে একে সকলে চলে এল, কিন্তু গন্তব্যস্থলটি এতটাই আকর্ষণীয় যে আমার আর তর সইছিল না – ওয়ার্ল্ড ডেস্টিনেশন – নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
ওয়াশিংটন ডি. সি. থেকে নায়াগ্রা যেতে সময় লাগবে আটঘন্টা। মাঝে দু'একটা ব্রেক। বাস চলতে শুরু করতেই ট্যুরিস্ট গাইড গ্যাবি-র মাইক হাতে ঘোষণা – ভিক্টোরিয়া যদি বিশ্বের দীর্ঘতম হয়, তবে নায়াগ্রা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয়তনযুক্ত জলপ্রপাত। গ্যাবির কথা শুনতে শুনতেই বাইরে তাকিয়ে দেখি মসৃণ পিচের রাস্তা দিয়ে হু হু করে চলেছে আমাদের বাস। দুপাশে কখনও বাগানঘেরা সুন্দর কাঠের বাড়ির সারি, কখনওবা চাষের ক্ষেত। পথচলতি দু'একটা গাড়ি প্রায় ঝোড়ো হাওয়ার মত আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল। দুপুরে রাস্তার ধারে একটা রেস্টুরেন্টে স্যান্ডুইচ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কফি সহযোগে লাঞ্চ সেরে আবার পথ চলা।
পথের দু'ধারে গাছের সারি – মনে হল কোন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। সাইনবোর্ডে চোখ পড়তে দেখি – ক্যাটোকিন ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। ছোট ছোট চেকপোস্ট, ফরেস্ট বাংলো পেরিয়ে তায়োগা নদীকে পাশে রেখে পেনসিলভেনিয়ার মেনরোডে পড়লাম। এবারে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি চলেছে। বাঁপাশে রেলপথ আমাদের সঙ্গী। পাহাড়ের গায়ে সুন্দর ছোট ছোট বাংলো বাড়ি। ডানদিকে বয়ে চলেছে কোহকটন্ নদী। নদীর স্বচ্ছ্ব জলে পাহাড়ের ছায়া পড়ে জায়গাটা অপূর্ব সুন্দর করে তুলেছে, ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের ছবি। রাস্তায় ছোট ছোট কেনু রিভার র্যাফটিং-এর জন্য রাখা আছে। আমাদের পাশ দিয়ে আরও কয়েকটা বাস আর গাড়িও চলেছে পাল্লা দিয়ে – সবার গন্তব্যই নায়াগ্রা।
নায়াগ্রা শহর পৌঁছাতে পৌঁছাতে পৌনে চারটে বাজল। কংক্রিটের ইমারত আর গাড়ির ভিড় সত্ত্বেও বেশ ছিমছাম শহর, নিউইয়র্ক স্টেটেরই অন্তর্ভুক্ত। বাস একটা ব্রিজে উঠল, ব্রিজের নীচে শান্তনীল জল সূর্যের আলোয় চকচক করছে। মাইকে গ্যারির কন্ঠও কানে এল – এটাই নায়াগ্রা নদী। নায়াগ্রা নদীকে পাশে রেখে কিছুক্ষণ নায়াগ্রা শহরের মধ্য দিয়ে চললাম। হঠাৎ দূরে কী যেন দেখে সবাই চেঁচিয়ে উঠল। দেখি সবার অবাক দৃষ্টি সেইদিকেই। চোখ পড়তে আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। রাশি রাশি সাদা জলকণা আকাশ সমান উচ্চতায় উঠে আবার নীচে পড়ছে। কেউ কেউ ক্যামেরাবন্দী করছে সেই অসাধারণ দৃশ্য। বিস্মিত হয়ে প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা দেখছি, কানে এল গ্যাবির গলা, ওইটা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের একটা ছোট্ট অংশ!
নরম সিল্কের মত ঝাঁ চকচকে রাস্তাটা গিয়ে পড়েছে গন্তব্যস্থলের একেবারে সামনে। জুলাই মাস – আমেরিকায় সামার। ছুটি কাটানোর মনের মত জায়গা এই নায়াগ্রায় তাই অজস্র মানুষের ভিড় । গ্যাবি আমাদের অনুসরণ করতে বলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। গ্যাবির পিছন পিছন আমরাও দাঁড়ালাম বিশাল এক লাইনে। ভারতীয়-বিদেশি নানান মানুষের সঙ্গে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম লাইন ধরে। থামলাম একটা লিফটের সামনে। দশতলার সমান উচ্চতা থেকে লিফটে নামতে নামতেই এক পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে এল – আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনারা পৌঁছে যাবেন বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড ডেস্টিনেশন নায়াগ্রাতে। লিফট থেকে নেমে এগিয়ে চললাম – রাশি রাশি মানুষ – চরম একটা উত্তেজনা সকলের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে – কখন বোট আসবে, পৌঁছে যাব 'মেড অফ দ্য মিস্ট'-এর জগতে।
অবশেষে বোট এল। আঠেরশো লোক ধরে এই বোটে। নায়াগ্রা নদীর নীল জলের ওপর দিয়ে ভেসে চলল বোট। দূরে নায়াগ্রা জলপ্রপাত। যেদিকেই তাকাই সাদা রাশি রাশি জল, বাঁদিক থেকে ডানদিকে গোল করে বিস্তৃত। ইরি লেকের জল প্রবলবেগে আছড়ে পড়ছে অন্টারিও লেকের মধ্যে। অপূর্ব তার সৌন্দর্য, অপরিসীম তার শক্তি। চারদিকে ছিটকে পড়ছে জলকণা।
তিনটি জলপ্রপাত নিয়ে নায়াগ্রার বিস্তার। বাঁদিকে আমেরিকান ফলস্, মাঝখানে ব্রাইডাল ভেইল ফলস্ আর ডানদিকে হর্স শু ফলস্। বোট প্রত্যেকটি ফলসের কাছেই যাবে। উত্তেজনা তখন শিরায় শিরায়। বাঁদিক ঘেঁষে বোট এগোলো। আমেরিকান ফলস্-এর ছিটকে পড়া জলকণা ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। উত্তেজনায় কেউ চিৎকার করছে, কেউবা ফেটে পড়ছে উল্লাসে। সূর্যের সোনারঙা আলো জলপ্রপাতের গায়ে পড়ে ঝলসে দিচ্ছে চোখ। রামধনু তার সাত রঙ দিয়ে ঘিরে রেখেছে প্রকৃতির এই সুন্দরী রূপকে।
আমেরিকান ফলস্-এর সৌন্দর্য মনকে ছুঁয়ে যেতে না যেতেই বোট পৌঁছে গেল ব্রাইডাল ফলস্-এর কাছে। এবারে একেবারেই ভিজে গেলাম আমরা। শুধু শরীরই নয়, যেন বিন্দু বিন্দু জলের ছোঁয়ায় ভিজে যাচ্ছিল মনও। এই অভাবনীয় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে পেরে সত্যিই নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল।
সবশেষে হর্স শু ফলস্ – বিশাল এই জলপ্রপাতের জল বড় বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে আকাশের দিকে ছিটকে যাচ্ছে ঠিক যেন সাদা ধোঁয়ার মত। ভয়ে অনেকেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে। জল যেখানে আছড়ে পড়ছে তার কাছাকাছি প্রচণ্ড স্রোত। সেখানে পৌঁছে দুলতে দুলতে হেলে পড়ছে বোট। প্রাণপনে আঁকড়ে ধরে থাকি রেলিংটা। দুলতে দুলতেই বোট ফেরার পথ ধরে।
'মেড অফ দ্য মিস্ট' ছাড়া আরও একটা রাইড আছে নায়াগ্রাতে 'কেভ অফ দ্য উইন্ড'। গুহার ভেতর দিয়ে ব্রাইডাল ভেইল জলপ্রপাতের পিছনে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখানে আর গেলাম না। এতক্ষণ ধরে ঘোরাঘুরি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, সুন্দর একটা ঘাস বিছানো জায়গা দেখে বসে পড়লাম। অনেকে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আশপাশে বেশ কয়েকটা স্যুভেনিরের দোকানও রয়েছে। কেউ কেউ নায়াগ্রার চারপাশে ঘুরে দেখার জন্য ট্যুরিস্ট বাসে করে চলেছেন।
একটু পরে উঠে হাঁটতে হাঁটতে রেলিং-এর পাশে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। চারপাশ থেকে আলোর ফোকাস এখন সাদা ঝরনাকে রঙিন করে তুলেছে। লাল, নীল, হলুদ আলোর বন্যায় যেন সে সেজে উঠেছে রানির মতই। ঠিক যেন সুন্দরী মেয়েকে সিঙ্গার দিয়ে সাজিয়ে করে তোলা হচ্ছে অপরূপা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। ওরই মধ্যে আবার আর এক চমক। সাড়ে দশটা বাজতে না বাজতেই আকাশের গায়ে রঙিন বাজির বৃষ্টি – চারদিক রঙে রঙে ভরে উঠেছে যেন। কোনো বাজি আকাশে গিয়ে সোনালি ফুলের মত ছড়িয়ে পড়ছে, কোনোটা লাল ফুল, কোনোটা সবুজ। রাত এগারোটা পর্যন্ত আলোর বন্যায় ভেসে এবার ফেরার পালা। বাসস্ট্যাণ্ডে ফিরে দেখি গিটার নিয়ে গান করছেন একজন। তাঁর সুরের মূর্চ্ছনায় চারদিক আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। গানের রেশ মেলাতে না মেলাতেই গ্যাবি হাজির - আমাদের নায়াগ্রা অভিযান শেষ।
~ নায়াগ্রার তথ্য ~ নায়াগ্রার আরো ছবি ~
ভ্রমণ সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী সুচেতনার প্রিয় বিষয় জঙ্গল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখায় পাহাড়, নদী, পশুপাখি আর অরণ্যের আদিবাসী জীবনের পাশাপাশি উঠে এসেছে শহুরে জীবনের বিচিত্রতাও। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'অরণ্য হে'।