শুশুনিয়াকথা

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

শুশুনিয়ার তথ্য

(১)

যেখানে ছিলাম তার ঠিক পেছনের দিকটায় একটা পাহাড় উঠে গিয়েছে ঢেউ খেলানো মালভূমির জমি ফুঁড়ে। সারা গায়ে তার গাছের পোশাক, সবুজ আর সবুজ। তার মাথার উপর দিয়ে সীমানাহীন একটা আকাশ ঝুলে আছে, খুব লঘু হয়ে যেন। দেখতে চেয়েছে আমাদের খেলাধূলো। যখন যেমন আমরা বদলাচ্ছি সেও বদলাচ্ছে তার মেজাজ। ভোরের ঘুম জড়ানো ভার কাটিয়ে দিনের মধ্যে প্রখর হয়ে উঠছে। তার ঘুমের আলস্যর পাশ দিয়ে ছেলেমেয়েরা হেঁটে গিয়েছে পাহাড়ের চূড়োয়। বেশ কিছুটা নিয়মিত পায়ে চলার পথের হালকা খাড়াই একটা সময় তীব্র হয়েছে। বেড়েছে দিনের রোদও। নামার পথে অনেকের বুক কেঁপেছে। একটু এদিক ওদিক হলেই ঠিকরে একেবারে নীচে। বন্ধু কেমন যেন শত্রু হয়ে উঠছে! চেনা কেমন অচেনা হয়ে উঠছে! তবু তাকে পেরিয়েই নেমে আসা। সকালের জলখাবারের শেষে নাট্য মহড়ার শুরু। একদল মহড়ায়। অন্যদল অন্যান্য আয়োজনে ব্যস্ত। রোদ তীব্র হতে হতে হঠাৎ ভারী মুখ নিয়ে বসে পড়লো থেবড়ে আকাশজুড়ে, মেঘ হয়ে। আমরা কেন তাকে দেখছি না এমন এক শিশুর অভিমানে! আমরা শুধুই ব্যস্ত আমাদের কাজ নিয়ে। তখন মুখ ফেরাতেই হয়। মহড়ার পালা শেষ করে নেমে পড়তে হয় জলে। জলের মধ্যে এসে পড়েছে পাহাড়ের ছায়া। মাথার উপরে টাঙানো আকাশ তার সঙ্গে কে বড় কে বড় খেলছে! আমরা জলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সাঁতারে, ডুবে, খেলায়। সময় ঘুড়ির মত ভোঁ-কাট্টা হয়ে যাচ্ছিল আর কী! তখন, ঠিক তখন খিদে, আদিম খিদে জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব আমাদের।
জল ছেড়ে জলপিপিপনা ছেড়ে আমরা খাবার ঘরে। ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ মাখা, পোস্তর বড়া। পাশে স্যালাড, লঙ্কা আর বিটনুন। শেষ করার জন্য হাপিত্যেস করে আছে ডিমের ঝোল। পোস্তর স্বাদ জিভ ছাড়াতে না ছাড়াতেই তার ঝাঁপ। একটু আটকে যেতে হয়। কেমন একটা বালি উঠে আসে প্রত্যেক গরসে। বালি কেন খাবারে? ভাতে নেই, ডালে ছিল না তত, তাহলে ডিমের ঝোলে কেন? রহস্যটা পরিস্কার হল ফেরার দিন রাতে। হলুদ ক্ষেত থেকে তুলে তার তৈয়ারি হয়। বালিমাটির বালি মিশে যায় সেই হলুদে। তার কিছু উঠে আসে আমাদের মুখে। আপনমনেই মুচকি হাসি। তিনদিনে আমার খেতে কী অস্বস্তি, আর এই খেয়েই চলছে এখানে বছরগুলো। বিকেল গড়িয়ে আসে। খোলা মাঠের মধ্যে আমরা নেমে পড়ি। সকাল থেকে চিতি সাপের আনাগোণা চলছে সেখান দিয়ে। বিষ আছে। কামড়ালে সাত থেকে বারো ঘন্টার মধ্যে হাড়ের গাঁটগুলো ও পাকস্থলীতে দারুণ ব্যথা শুরু হবে। সঙ্গে পেট কামড়ানোও। তো, তার মধ্যে যদি অ্যান্টি ভেনাম না জোটে তাহলে...!
বাগানের আশেপাশে খানিক দাপিয়ে নিয়ে শুরু হয়ে যায় বৈদিক একটি নাট্যের অংশপাঠ ও প্রশিক্ষণ। ঋগ্‌বেদের নাট্যাংশ এটি। যাঁরা তখন কাজটা করতেন তাঁদের তো অরণ্যের মধ্যেকার আশ্রমেই করতে হত। সাপ কী সিংহ তা নিয়ে খুব বিলাসিতার সুযোগ ছিল না। ধীরে ধীরে বেদের ছান্দস আর তার বাংলা অর্থ বোঝার পালার মধ্যেই সূর্য লাল হয়ে ওঠে। তার এবারে যাবার সময়। সন্ধে নেমে আসে বনবাংলোর আশেপাশে। মন্ত্রীর গাড়ি, এস এল আর-ধারী দেহরক্ষী, উর্দি পরা বনবিভাগের কর্মচারী, অনতিদূরের স্পঞ্জ আয়রন কারখানার অবিশ্বাস্য দূষণ, আশেপাশের একটি বর্ধিষ্ণু আর অন্য সব হত দরিদ্র অথচ সুন্দর পরিচ্ছন্ন গ্রামগুলোর মাথার উপরে কালো রং এঁকে দেয় কেউ যেন। সব সমান, সবাই সমান!
সব সমান? সবাই সমান? আমরা বলি। আধুনিক ও প্রগতিশীল আমরা বলি। সঙ্গোপনে সকলে মানি না। প্রকাশ্যে কেউ কেউ মানেন না। সে সব থাক! যা মানা না মানার বাইরে তা হল মানুষ অন্যান্য জন্তুদের মতনই একটি জন্তু। তার মানুষ বলে যে স্বপরিচয় তা অর্জন করতে হয়। সে অর্জন তো একদিনে সম্ভব না। অনিচ্ছেতেও সম্ভব না। ইচ্ছেতেই আমরা এমন কর্মশিবির সাজিয়েছি। সেখানেও মাপকাঠি থাকে। থাকবেই। কে কতদূর 'আমিত্ব' আর 'মনুষত্ব'-র ফারাক রেখাটি টানবে। তাই কিছু ঠিক হবে, কিছু ভুল। হবেই। ভুলগুলোকে বুঝে তাকে পেরোলে, ঠিকের সংখ্যা কিছু বাড়ে। এবং আজ যা ঠিক তা কালকের ভুলে পরিণত হবে সে কথাটাও কিছুটা বোঝা যায়। বোঝার জন্য আমরা একটা নাট্যানুষ্ঠান করবো। রাত্রে। গভীর, গহীন রাত্রে। পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে প্রাথমিক অর্জনগুলোকে সম্বল করে করবো। তার আগে সন্ধের মহড়া চলবে অন্য একটি প্রসেনিয়াম প্রযোজনার। রাত ঘনাক, আমরা ফিরে আসবো আমাদের শুশুনিয়া কথায়। বাকী অর্জন আর বাকী শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসবো।

(২)

থিয়েট্রিক্স-সেপার এবারের ওয়ার্কশপ শুশুনিয়া পাহাড়ে। বাঁকুড়া স্টেশনে যখন নামলাম তখন ভোর হবে হবে করছিল। গাড়ি নিয়ে একপ্রস্থ দরাদরি করে রওনা হওয়ার পর থেকেই আমাদের চিন্তা-চেতনায় ছিল শুশুনিয়া আর সামনের দিনকালগুলো। রাস্তাজুড়ে ছিল কাশের সারি। শরত সাজতে বসেছিল আমাদের জন্য। যে সম্পদ সে পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছিল সেই সম্পদ কুড়িয়ে নিতে নিতে কেউ কেউ যাচ্ছিল। কেউ তখনো মগ্ন মাথার ভেতরের ফেলে আসা শহরের অভ্যাসে। এই করতে করতেই এক সময়ে পৌঁছে গেছিলাম বন বাংলোয়। পাহাড়ে গেলো কেউ কেউ, কেউ চলে গেল মহুয়া আর হাঁড়িয়ার খোঁজে। সামনের শুশুনিয়া গ্রামের থেকে এসেছিলেন আমাদের এক বন্ধু। পর্বতারোহী তিনি। পার্থ কর্মকার। সেই বন্ধুটি আমাদের আঞ্চলিক গাইড ও সহযোগী হয়ে উঠলেন। তাঁর নিবাস যে গ্রামে সেই গ্রামটি পাথরের কাজের জন্য ভারতবর্ষে বিখ্যাত। সে গ্রামের ৯০% মানুষ পাথরের মূর্তি তৈরী করেই জীবিকানির্বাহ করেন। মূলত সে সমস্ত মূর্তি হিন্দু দেবদেবীর। বেশ কিছু শিল্পী আছেন যাঁরা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত। ঘুরে এসেছি তাঁদের কর্মশালাও। উপার্জন বেশ ভালই হয়েছে তাঁদের। অন্যান্য গ্রামগুলির তুলনায় ওখানকার গ্রামে পাকা বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। কম করেও ৮০% বাড়িই পাকা এবং দোতলা-তিনতলা বাড়ি বেশ সংখ্যায় রয়েছে। আগে শুশুনিয়ার থেকে আনা পাথরে তাঁরা মূর্তি বানাতেন। কিন্তু এখন সেখান থেকে পাথর আনা আইনত দণ্ডণীয়। তবু কি পাথর আসে না? আইনী পথে রাজস্থান থেকেও আসে মার্বেল পাথর। কিন্তু শুশুনিয়ার থেকেও আসে। বনবাংলোর গা ঘেঁষে যে পাহাড় উঠে গিয়েছে তার নীচের ঝিলটির কথা বলেছিলাম। সেই ঝিলের ঠিক পেছন দিয়েই চলে গিয়েছে সরু একচিলতে জঙ্গুলে পথ। দু পাশের জঙ্গলে ঢাকা থাকে বলে প্রায় দেখা যায় না। সেই পথ দিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে যান স্থানীয় শ্রমিকরা। তাঁরা হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে পাথর কাটেন। যখন যেমন লাগে। কখনো ছোট পাথর, যা দু জনে বয়ে আনা যায়। কখনো এক পাথরে গড়া বড় মূর্তির জন্য বিরাট পাথর, বয়ে নিয়ে আসেন আট-দশজনে। নিঃশব্দে কাজটা হয়ে যায়।
এর আরেকটা দিকও আছে। দিকটা হল ধর্মের। শুশুনিয়া গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলে ধর্মীয় বিধিনিষেধ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড়ের ঠিক নীচেই পাহাড়ের মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে একটি প্রস্রবণ। ভূস্তরের নীচ থেকে আসা সেই প্রস্রবণের জল নানা খনিজে সমৃদ্ধ। সে জল পান করলে হজম সংক্রান্ত সমস্ত সমস্যা মিটে যায়। যাই খাওয়া যাক না কেন তা হজম করিয়ে দেবার মতন ক্ষমতা এই জল রাখে। সে কারণে অঞ্চলের লোকেরা এই জলকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করে থাকে। সেখানে ধীরে ধীরে মন্দিরও গড়ে উঠেছে। তার সেবায়েতও রয়েছেন। প্রতি শনি বা রবিবার সেখানে বেশ একটা বড় ভীড় হয়। কখনো কখনো পনেরো-বিশ হাজার লোকেরও সমাগম হয়। জেলা উন্নয়ন সমিতি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি বোতল জল পিছু দুটাকা করে নিলেও অঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সাধারণের ব্যবহার্য্য শৌচালয় বা অরণ্য অঞ্চলকে ঠিকভাবে পরিস্কার রাখার কাজে চিরকালই গাফিলতি দেখাচ্ছে। আবার ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে মাংস সংক্রান্ত নানা নিষেধাজ্ঞা। শূয়োরের বা গরুর মাংস নিয়ে বেশ একটা ট্যাবু দারুণভাবে প্রচলিত সেখানে। রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুপ্রবেশও বেশ দেখার মতন। হিন্দুত্বের অ্যাজেণ্ডাটা ওখানে হোটেল মালিক, পাথরের মূর্তি গড়ার কারিগরদের যোগসাজশে বেশ বিস্তৃত হয়েছে। যাঁরা দেবদেবীর মূর্তি বানান তাঁদের দেবভক্তি বজায় রাখার দায় আছে। যাঁরা হোটেল চালান তাঁদের দায় আছে প্রতি শনি-রবিবারের যে জল নিয়ে মেলা হয় সেই মেলাকে চালিয়ে রাখার। দুপক্ষই এখানে উপকৃত। সুতরাং বিধান বেশ কড়া। আর সেই বিধানের চাপে পিষ্ট হচ্ছেন দলিত মানুষজন। নাচ-কাঠির এক শিল্পী অত্যন্ত কুন্ঠার সঙ্গে জানালেন তাঁরা এখনো প্রায় জল-অচল। সরকারের একশো দিনের কাজের প্রকল্পের সুবাদে কোনো রকমে কাজ পেয়ে টিঁকে আছেন সেখানে। কিন্তু স্থায়ী হবার সম্ভাবনা বেশ কম। আর তাঁদের অনুষ্ঠানও কমে গিয়েছে। যেমন নাকি মূলবাসীদের শিকার উৎসব ঘিরে শুরু হয়েছে অসংখ্য কড়াকড়ি। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন যাতে তারা না ভাঙে তার জন্য পুলিশি পাহারায় পাহাড় ঘিরে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে শিকার উৎসবের দিনে। বুনো শূয়োর, কখনো কখনো দাঁতাল হাতি, কালেভদ্রে চিতা, বনরুই, নানা পাখির প্রজাতি এখনো রয়েছে পাহাড় ও তার পাদদেশে। মূলবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাঁদের গ্রাম সভার দখল নেই। সুতরাং অরণ্যের অধিকার আইনের ব্যবহার তাঁরা করতে পারছেন না। শিকার যেমন তাঁরা করতেন তেমনই অরণ্য ও পশু সংরক্ষণও তাঁদের মাধ্যমেই বহু অরণ্যে বেশ ভালই ঘটেছে। গোটা পৃথিবীজুড়েই এই পরীক্ষা অনেক বেশী সাফল্য পেয়েছে পুলিশ পাহারার চেয়েও। তবু ওখানে এখনো তার প্রয়োগ তেমন করে শুরু হয়নি বলেই দেখে এলাম। এই ধর্ম, অরণ্য সম্পদের দখল এবং মানুষের অধিকারকে মাথায় রেখেই যাবার পথেই আমরা প্রযোজনার বিষয় নির্বাচন করেছিলাম। বেদ মানেই শুধু ধর্মাচরণ না, বেদ মানে এক সামাজিক ইতিহাসও বটে, দলিলও। ঋগ্‌বেদের যম-যমী সূক্তটি দেব-দেবীর আখ্যান বিহীন এক সাধারণ মানুষের কথা, যা তার কামনা-বাসনা-সম্পদের চলন ও সমাজ গঠনের পরম্পরার দলিল।

(৩)

এখানে আসার পথে ভাবছিলাম ধর্ম নিয়ে। মানুষের, মানে হোমো স্যাপিয়েন্স আর নিয়েনডারথালের ডি এন এ তো আলাদা হয়ে গিয়েছে ৫ লক্ষ বছর আগে। হোমো স্যাপিয়েন্স কথাটা ল্যাটিনে 'বিবেচক মানুষ' অর্থ। তো সেই বিবেচক মানুষ ধর্মের বিবেচনা কেন করলো? মুখ্যত কারণটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের শৃঙ্খলা। তার আগে নানান শক্তি সম্বন্ধে তার ভয়ের উদ্ভব হয়েছে। রীতি-নীতি-প্রথা একটু একটু করে তৈরী হয়েছে। এটা অনেকটা আজকের দিনের প্রথার মতন। ধরুন আমি আজকে একটা নীল জামা পরে বেরিয়েছিলাম, কিছু কাজ ছিল। সেগুলো বেশ ভাল হল। এর আগে অব্দি আমার তেমন ভাল হচ্ছিল না। কাল খয়েরী জামায় হল না। পরশু আবার নীল জামায় হল। তখন মনে হবে যেন নীল জামাটাই আসলে একটা বড় ফ্যাক্টর। ভেতরে একটা বিশ্বাস তৈরী হয় অনেকের। এই করে ঘড়ি পরা থেকে কলম বা মোবাইল নেওয়া, পায়ের জুতো সবেতেই চলে আসে। সে সময়েও তাই হয়েছে। এমন কিছু সমাপতনকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে তৈরি হয়েছে রীতি-নীতি-প্রথা। কিন্তু তাকে ধর্ম বলার মতন সংগঠন অর্জন সে করেনি তখনো। করলো যখন সম্পদের অবস্থান সুনিশ্চিত হল সমাজ জীবনে। ধর্ম তো শুধু ঈশ্বর ভাবনা না, সে আসলে এক ধরণের সমাজ সংগঠন। সে অনেক ক্ষেত্রেই একটা পিরামিডাকার ব্যবস্থা যার শীর্ষে শক্তির উৎস হিসেবে ঈশ্বর আছে। সেই কারণেই ধর্মীয় টেক্সটগুলোতে সমাজবিধির নানা বিধান রয়েছে।
ঋগ্‌বেদেও রয়েছে। আমাদের এই উপমহাদেশের গ্রন্থিত নাট্যঐতিহ্যের আদি কয়েকটি নাট্য, অসম্পূর্ণ হলেও, নাট্য সংগঠনের ভাবনা হিসেবে পরিস্কার, রয়েছে ঋগ্‌বেদের দশম মণ্ডলে। এক একটি শ্লোককে বলে ঋক্‌ বা স্তুতিমন্ত্র। একগুচ্ছ ঋক্‌ মিলে এক একটি কবিতা বা সূক্ত। এগুলো দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত ঋগ্‌বেদে। অধ্যায়গুলোকে বলে মণ্ডল। তার মধ্যে দশম মণ্ডলের পনেরোটি সূক্ত নাট্যগুণসম্পন্ন। প্রাচীনরা একে অনেক সময় কখনো ইতিহাস কখনো আখ্যান বলেছেন। যাস্ক তাঁর নিরুক্তে এবং শৌনক তাঁর সংহিতায় একে বলেছেন সংবাদ-সূক্ত। পণ্ডিতেরা অনেক কথা বলেন। বলেন সোমযজ্ঞের সময় এগুলো গীত হত। প্রাকৃতিক পরিবেশে বৈদিকরা নাচতেন এর সঙ্গে। কেউ কেউ বলেন এর মধ্যেই ছিল গদ্য সংলাপ, যা বেদে গ্রথিত হয়নি। কালের প্রকোপে গিয়েছে হারিয়ে। তা সে যাই হোক, আমরা আমাদের কাজের জন্য বেছে নিয়েছিলাম যম-যমী সংবাদ।
প্রস্তুতির কথা এর আগে অল্প-বিস্তর বলেছি। এবারে বলি কেন বাছলাম তার কথা! যম-যমী সংবাদ ঋগ্‌বেদের অনুবাদে বারেবারে অশ্লীলতার জন্য খুব কষ্ট করে প্রকাশিত হয়েছে। নানান রকমের আড়াল-আবডাল রেখে প্রকাশ করা হয়েছে। রমেশচন্দ্র দত্ত অনুবাদ করার সময়ে একে দিবা ও রাত্রির কথা বলে-টলে শাক দিয়ে অনেক মাছ ঢেকেছেন। কিন্তু কেন? কেন না ভাই-বোনের সঙ্গম আজকের সামাজিক চোখে অবৈধ। কেন না এখন আমাদের কাছে বেশ কিছু স্টাডি রিপোর্ট আছে যা বলছে ইনব্রীডিং ক্ষতিকারক শিশুর পক্ষে। কিন্তু এ যে সময়ের কথা সে সময় তো এই তথ্য ছিল না। সে সময় গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ অত্যন্ত প্রচলিত বিষয় কোথাও কোথাও। নর্স মিথোলজি, ব্যাবিলনিয়ান কাহিনীগুলো এই সম্পর্কের অজস্র প্রমাণ বহন করছে। কিম্বা ইন্দো-ইরাণীয় পুরালোকগাথায় য়িম ও য়িমেহ যমজ ভাইবোন, যাদের গর্ভে প্রথম মানুষের জন্ম। আদতে যম-যমী সংবাদে যম যদি নতুন সমাজের প্রতীক হয় তাহলে যমী পুরাতন সমাজের প্রতিনিধি। নতুন সমাজ সমস্ত কিছুর মতন যৌনতাকেও এক বিধিতে বাঁধতে চাইছে। পুরাতন চাইছে অবাধ যৌন সম্পর্ক। এমন কনফ্লিক্ট বাকী কোনো নাট্যগুণভূষিত কাহিনীতে ছিল না।
রাত গভীর হল শুশুনিয়াতে। দিনের বেলায় যে কাঠকুটো জড় করা হয়েছে তা কেটেছেঁটে তৈরী হল মশাল ও যজ্ঞের কাঠকুটো। অভিনেতাদের কস্টিউম তৈরী হচ্ছিল। সাধারণ এবং হাতের কাছে থাকা জিনিসপত্র দিয়েই সব হচ্ছিল। এক অভিনেত্রীর সঙ্কোচ ছিল কাঁধ উন্মুক্ত করে গামছাকে কাঁচুলির মতন বাঁধতে। সে বাধা পেরোনো গেল। গামছা পরার পরে কিছুক্ষণ চলাফেরার পরে যখন দেখলেন যে এর জন্যে তাঁকে যৌন অবজেক্ট বলে মনে হচ্ছে না, বা কোনো অশ্লীল ভাবনার উদ্রেক হচ্ছে না তখন তিনি বললেন যে এবারে এমন অবস্থায় তিনি যে কোনো কাজ করতে পারেন। ইনি জীবনে কখনো এ ভাবে অভিনয় করেননি। আসলে বাধা পেরোনোটাই থিয়েটারের কাজ। জীবনকে স্বচ্ছ ও স্বচ্ছন্দ করাটাই একটা বড় কাজ।
আগুণ জ্বলে উঠলো। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কাটা সিঁড়িতে সারি দিয়ে দাঁড়ালেন অভিনেতারা। উঁচু থেকে তাঁরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসবেন সমতল ক্ষেত্রে। কিছুটা মিছিল করে চলার পরে একটি ঢালু জমিতে হবে নাট্যাভিনয়। মিছিল শুরু হল। বেজে উঠলো মাদল। ঝিঁ ঝিঁ-র আওয়াজ ছাড়া যেখানে আর কোনো প্রাকৃতিক শব্দ ছিল না সেখানে পাহাড় ভরে উঠলো এক রহস্যময় মাদলের দ্রিম দ্রিম শব্দে। প্রকৃতির বুকে, স্বল্প অবলম্বনে অভিনেতারা চললেন, সঙ্গে দর্শকরাও। মাদলের সঙ্গে মিশে গেল বৈদিক ছান্দসের বহুকন্ঠে উচ্চারিত এক গম্ভীর সুর। পাহাড়টা জেগে উঠলো। অজস্র বছর পরে তার নীচে এমন এক কাণ্ড ঘটছে। এর আগে কয়েক শত বছর বা হাজার বছর আগে কিছু মানুষ হয়তো এমনভাবেই ঘোর রাত্রে নাচতো-গাইতো। আজ আবার হচ্ছে এমন কাণ্ড!
যেখানে গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে একটি ঝিল থেকে জল বেরিয়ে পড়ছে একটি নালাতে। জলের কুলকুলধ্বনি মিশে গেল মাদলের শব্দে। বেজে উঠলো আরেকটি লোক সাঙ্গীতিক যন্ত্র। একতারা। রহস্য গাঢ় হয়ে এল। জ্বলে উঠলো যজ্ঞের আগুণ। মন্ত্রোচ্চারণে বিরতি নেই। সকল অভিনেতা এখন যাজ্ঞিক। সোমযজ্ঞ হচ্ছে। তার হবন হচ্ছে। সেই যজ্ঞের মধ্যেই একসময় উঠে দাঁড়ালেন দুই অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাঁরা প্রকৃত প্রস্তাবে স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু গত দুই রাত্রি তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে এক শয্যায় শুতে যাননি। দিন কাটিয়েছেন নিতান্ত ভাই বোনের মতন। এখন তাঁরা অভিনয় করছেন আদিম দুই ভাই বোনের চরিত্রে। এক বোন যে ভাইকে আকাঙ্খা করছে, সঙ্গমের অনুরোধ করছে। আরেক ভাই যে সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছে সমাজনীতি ও দেবতাদের রোষের কথা বলে। নাটক ঘন হতে থাকলো। ঘন হতে থাকলো রাত। আগুণ পলে পলে বেড়ে উঠছে। যাজ্ঞিকরা ত্রুটিহীন। মাদল বেজে চলেছে। সঙ্গতে একতারা। বহু বহু দূরের গ্রামের মানুষ পরের দিন ফিরে আসার সময়ে আমাকে বলেছিলেন গভীর রাত্রেও তাঁরা সেই মাদল আর মন্ত্রোচ্চারণের সুর শুনেছেন। ঘোর লেগেছিল তাঁদের। ঘোর লেগেছিল আমাদের অভিনেতাদেরও। ঘোর লেগেছিল আমাদের দর্শকদেরও। পাহাড়, বনভূমি, ঝিল, মাথার উপরে তারা ঝলমলে আকাশ অনেক অনেকদিন আগের এক স্মৃতি ফিরে পেয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চই থম মেরে বসেছিল। আমাদের ত্রুটিতে ঠোঁট টিপে হেসেওছিল হয়তো। ভেবেছিল মানুষের এমন দিনও তো ছিল, তারা যার সব কিছু জানে, মানুষ ভুলে গিয়েছে শুধু। আর তারাও বলবে না। শুশুনিয়া পাহাড়ের উল্টো পিঠে চন্দ্র রাজার পাথর খোদাই ভাবছিলো যে কেন এখানে এ সব হচ্ছে! তারপরে হেসেছিল। সে তো সেই চতুর্থ খ্রীষ্টাব্দ থেকে আছে। প্রাকৃত আর সংস্কৃততে খোদাই করা অক্ষর নিয়ে। সে জানে বাগদী, বাউড়ি, জেলে, হাড়ি, ডোম, কূড়মালি, মাল পাহাড়ির দেশকে ঐতরেয় উপনিষদ বলেছে অসুরদের দেশ। এখনো কত গ্রামের নাম অসুরদের নামে। সেখানে এক গন্ধর্ব আর অপ্সরার পুত্র-কন্যার কাহিনীই তো হতে পারে। যাদের মধ্যে পুত্রটি পুরাণ মতে পৃথিবীর প্রথম মানব যে মরণশীল ছিল। ফলত সেই প্রথম মৃত পৃথিবীতে। তার সমাজায়ন, আর্যায়নের কাহিনীই তো আসলে বিবর্তনের এক উপাখ্যান, যা নাচকাঠির দলিত শিল্পীর মাথায় ব্রাহ্মণের পা তুলে দিয়েছে। সেই পাথরে খোদাই হেসেছিল বিষণ্ণতায়। এই তো সে দেখে এসেছে এতকাল!
মাদল বেজে চলে রাত্রি চিরে...।

শুশুনিয়ার তথ্য

আপাদমস্তক সৃজনশীল মানুষ শুদ্ধসত্ব-র লেখনীর অবাধ বিচরণ গদ্য, কবিতা, নাটক, সঙ্গীত, সাংবাদিকতা – সৃষ্টির নানান আঙিনাতেই। কাগজের পাতায়, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের পর্দায় বা পর্দার আড়ালে, আন্তর্জালের অলিগলিতে সর্বত্রই রেখেছেন তাঁর সৃষ্টিশীলতার সাক্ষর। তাঁর অন্যরকম ভাবনায় উঠে এসেছে মহাভারতের নতুন রূপ। প্রকৃতির বুকে নিয়ে গিয়েছেন মগ্ন এক নাট্য আয়োজনকে, নাট্যশিক্ষা প্রসারের জন্য আয়োজন করেছেন লোকনাট্যশিক্ষার থিয়েটার ট্যুরিজম। ভ্রমণ আর জীবনের রঙ্গমঞ্চকে মিলিয়ে দিয়েছেন এভাবেই । আসলে বেঁচে থাকা আর সৃষ্টিশীলতা তাঁর অভিধানে সম অর্থ বহন করে।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher