বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com
বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতনে
শুভ্রনীল দে
শীত পেরিয়ে বসন্তের উন্মনা হাওয়া আর পথের ধারে আলো হয়ে ফুটে থাকা শিমুল-পলাশ মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল গতবছরের দোলের দিনটাকে ...
"ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্।।"
এই গানের তালে তালে ছাত্র-ছাত্রীদের নাচের ছন্দে ছন্দে প্রতিবারের মত শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব, ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক সকাল সাতটা। শুধু দূষণের ভয়ে আশ্রম মাঠের পরিবর্তে পৌষ মেলার মাঠে হয়েছে এই উৎসবের আয়োজন।
১৯০১ সালে পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে শুরু করা শান্তিনিকেতন আজ মহীরূহ হয়ে উঠেছে। বসন্তকে রঙে-রসে, সুরে-নৃত্যে স্বাগত জানানোর এই উৎসবও রবীন্দ্রনাথেরই কল্পনার এক রূপ। আজকে সেই উৎসব বিশাল আকার ধারণ করেছে। বিশ্বভারতীর গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে সর্বভারতীয় এক উৎসব। দেশ-বিদেশের নানা মানুষের ভিড়ে বর্ণময় হয়ে ওঠে উৎসব প্রাঙ্গণ।
গতবছর মার্চের ২৬ তারিখ রাত ১০.৪৫ নাগাদ হাওড়া-বোলপুর কবিগুরু এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে রাত ২.০৫-এ বোলপুরে এসে পৌঁছেছিলাম। হোটেলে ঘন্টা তিনেকের মতন বিশ্রাম নিয়ে ভোর তিনটে নাগাদ হোটেলের সামনে থেকে একটা অটো ধরে চলে এসেছিলাম সোজা উৎসবের মাঠে।
মাঠে পৌঁছে দেখি উৎসব প্রাঙ্গণে নিরাপত্তার কড়াকড়ি অন্যবারের চেয়ে অনেক বেশি। এতে অনুষ্ঠান পরিচালনার সুবিধা হলেও সাধারণ দর্শকদের খুব অসুবিধা হয়। এর আগেও দেখেছি যেমন অনেক জ্ঞানীগুনী মানুষ রঙের উৎসবে শান্তিনিকেতনে আসেন তেমনি প্রচুর সাধারণ মানুষ এখানে সারা রাত জেগে রাস্তার ধারে, ফাঁকা মাঠে পড়ে থাকেন পরদিন ভোরবেলায় অনুষ্ঠান দেখার জন্য।
কবিতো বলেই গেছেন –
"আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে।
ওগো আমার প্রিয়, তোমার রঙিন উত্তরীয়
পরো পরো পরো তবে।।"
এখানে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই, সবাই সবাইকে আবিরের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার আনন্দে মশগুল।
শান্তিনিকেতনে এসে যেটা চোখে পড়েছিল, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও অনেক মহিলার মাথায় বা গলাতে পলাশ ফুলের কুঁড়ির মালা। এমনকী বেশ কিছু ভদ্রলোকের গলাতেও মালা রয়েছে! কবিগুরু যখন বসন্তকে আহ্বান করে লিখেছেন –
"নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল।
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল।।"
অথবা,
"ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে -
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।।"
তখন হয়তো এই পলাশ ফুলের আগুন রঙের কথা স্মরণ করেই লিখেছিলেন। আসলে শুধু বিধি-নিষেধ দিয়েই হবে না, আমাদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে গাছেদের ভালোবেসে।
একের পর এক গান আর নাচের ছন্দে ঘড়ির কাঁটা ন'টায় পৌঁছালো। "রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাওগো এবার যাবার আগে..." – অনুষ্ঠান শেষের গানের সুরে সুরে শুরু হয়ে গেল মাঠজুড়ে আবির খেলা। আকাশে-বাতাসে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনীর নানা রঙ উড়ে বেড়াচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে সকলেরই দেহে-মনে।
"রঙে রঙে রঙিল আকাশ, গানে গানে নিখিল উদাস -
যেন চলচঞ্চল নব পল্লবদল মর্মরে মোর মনে মনে।।
ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে"
আবির খেলার ছবি তুলতে শুরু করলাম। ক্রমে ক্রমে বেলা যত গড়াতে লাগল সূর্যের তাপে ফাঁকা মাঠে গরম অসহ্য হয়ে উঠছিল। উৎসব মাঠ থেকে বেরিয়ে অটো করে একটা হোটেলে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরে এসেছিলাম বোলপুর প্ল্যাটফর্মে। দেখি ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা আবির খেলছে। প্ল্যাটফর্মে বেশ কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায় ১৫-১৬ বছর ধরে নিয়মিতই এখানে আসছেন বসন্ত উৎসবে। আমিতো মাত্র কয়েকবছরই আসছি। আসলে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের একটা আলাদা মেজাজ আছে যেটা এখানে না এলে ঠিক অনুভব যায় না।
সন্ধ্যেবেলায় ফেরার ট্রেনে বসে দেহে আর মনে আবিরের রঙ মেখে শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে ক্লান্ত অথচ আনন্দিত আমি আপনমনেই গুনগুন করে উঠেছিলাম,
"এবার বিদায়বেলার সুর ধরো ধরো ও চাঁপা, ও করবী!
তোমার শেষ ফুলে আজ সাজি ভরো।।
যাবার পথে আকাশতলে মেঘ রাঙা হল চোখের জলে,
ঝরে পাতা ঝরোঝরো।।"
সে সুর যেন এই বসন্তে আজও বাজে, মনোমাঝে ...
অন্তরের 'যাযাবর' মানুষটিই শুভ্রনীলের প্রকৃত আত্মপরিচয়। ভালবাসেন ক্যামেরার ফ্রেমে ধরে রাখতে ভাল লাগার মুহূর্তগুলো।