দিনান্তভ্রমণে দিঘা
তপন পাল
~ দিঘার তথ্য ~ দিঘার আরো ছবি ~
তারিখ – ১৭ নভেম্বর ২০১৩
গন্তব্য – ব্রাইটেন অফ দি ইষ্ট – দিঘা
যাত্রাপথ – ১২৮৫৭ হাওড়া দিঘা ফ্ল্যাগ তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস, কোচ-ডি-২, সিট- ৬০, জানালা। প্রত্যাবর্তন ১২৮৪৮ দিঘা ফ্ল্যাগ হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেস। কোচ-সি-৩, সিট-৪৫, জানালা।
উদ্দেশ্য – চিকিৎসা, মাসে অন্তত একবার সমুদ্র না দেখলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
সঙ্গী – একা।
বাড়ি থেকে পিঠে ব্যাগ বেঁধে রওনা সাড়ে পাঁচটায়। বাবুঘাটে রাসপূর্ণিমার পুন্যস্নানার্থীদের ভিড় ঠেলে হাওড়া নব রেল আড়ত; ঘড়িতে তখন ছ'টা দশ।
আমার গাড়ি তখন ১৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ডিজেল চালিত এক ইঞ্জিন ফাঁকা কামরাগুলিকে টেনে নিয়ে এলো। তার আগায় একটি লালরঙা বিদ্যুৎ ইঞ্জিন। হাওড়া-দিঘা পুরো রেলপথই এখন বিদ্যুতায়িত।
রেল গাড়িটি খুব একটা লম্বা নয়। ইঞ্জিনের পর সাতটি সাধারণ অসংরক্ষিত কামরা, তারপর ডি ই কোচ একটি, ডি-১ থেকে ডি-২ সংরক্ষিত কামরা, সাত নম্বর আহার্য কামরা, এরপর বাতানুকূল আসনের কামরা ও আবার দুই অসংরক্ষিত কামরা – মোট আঠেরোটা। দিনের যাত্রায় বাতানুকূল কামরায় ওঠা মানে জানালার ধারে বসার আনন্দটাই মাটি। ডি-২ কামরায় নিজের আসনে বসতে গিয়ে দেখলাম তিন আসনের বেঞ্চিতে অপর দুই সওয়ারি যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান। খুব ব্যাজার মুখে আমাকে জানলার আসন ছাড়লেও দেখলাম বেশ কোণঠাসা অবস্থা।
নেমে সংরক্ষণ তালিকায় চোখ রেখে দেখলাম ডি-৫ ও ডি-৬ কামরায় কোন যাত্রী নেই। ডি-৬ কামরায় উঠে পড়লাম। কামরার বাকী সাত সহযাত্রীর টিকিট অসংরক্ষিত যাত্রার। যাইহোক সাঁত্রাগাছি, উলুবেড়িয়া, মেচেদা, তমলুক, কাঁথি, রামনগর হয়ে সকাল দশটায় দিঘা পৌঁছলাম। ধীরেসুস্থে বেরিয়ে দেখি ততক্ষণে ভিড় কেটে গেছে, রিক্সা, অটো, গাড়ির আহ্বান স্তিমিত। দরাদরি করে একটা অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ি আটশো টাকায় রফা হল।
পুরোনো দিঘার ভিড় ঠেলে মোহনা, পথের দুধারে সারাই-এর জন্য উলটে রাখা অজস্র নৌকা। আমার প্রথম দিঘা দর্শন ১৯৭০-এ, তদানীন্তন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে, বাড়িতে না বলে; প্রবল পিতৃপিটুনির প্রগাঢ় আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে। তখন সৈকত বরাবর হেঁটে ধীবর গ্রাম মোহনা আক্ষরিক অর্থেই ছিল এক আবিষ্কার। এখন মোহনা দিঘা যাত্রীদের অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকায়।
হট্টপূর্ণ মাছের বাজার ছাড়িয়ে নির্জন সৈকত বিস্তৃত। ভিজে বালি কোথাও কোথাও নরম। পা ডুবে যায়। ঢেউখেলা জল ছুঁয়ে উড়ে চলে সামুদ্রিক পক্ষীকুল, জলে ভেসে যায় অগণন ট্রলার, রঙিন পালতোলা নৌকা। সৈকতে মৃত কাঠা (Turtle)-এর খোলা। আর সদ্যমৃত স্কুইড, জেলিফিশ। নাকের গোড়ায় অগণন ফড়িং।
চোখ টানে এক ভ্রাম্যমাণ স্টুডিও। তিন চাকার সাইকেল ভ্যানের ওপর মাছ সংরক্ষণের থার্মোকলের বাক্সে ছবি প্রিন্টিং-এর বন্দোবস্ত। পর্যটকদের সবার হাতে ডি.এস.এল.আর, স্মার্ট ফোন। তবু ছাপানো দৃশ্যযোগ্য ছবির আবেদন কী অমোঘ! দেখা গেল নব প্রজন্মের বালক বালিকারা হাতে গরম ছবি পেতে উৎসুক ও তৎপর।
মোহনা ছেড়ে সরু রাস্তা ধরে দিঘা কাঁথি রোড। পুরোনো দিঘা পেরিয়ে নতুন দিঘা। এক সরাইখানায় মধ্যাহ্নভোজন। ভাত ডাল তরকারি আশি টাকা। সঙ্গে স্বর্গীয় এক থালা কাঁকড়া – দক্ষিণা তিনশো টাকা। আহারান্তে যাত্রা শুরু, সীমান্ত পেরিয়ে ওড়িশা-দিঘা জলেশ্বর রোড ধরে কিয়াগেড়িয়া-চন্দনেশ্বর পেরিয়ে বিচিত্রপুর ম্যানগ্রোভ প্ল্যানটেশন – ওড়িশা ফরেষ্ট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (OFSDP)-এর উদ্যোগে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল সংরক্ষণ, পুনর্নবীকরণ ও সুরক্ষা যা আজ সারা দেশের কাছে একটা দৃষ্টান্ত। বন সংরক্ষণ ও জীবিকা নির্বাহ যে পরস্পর বিরোধী দুই কার্যক্রম নয়, বরং পরিপূরক, তা মনে করিয়ে দেয় এই প্রকল্প। স্থানীয় জনগণকে যুক্ত করে জঙ্গল থেকে তাদের আয় বাড়াবার পথ করে দেওয়ায় স্থানীয় জনগণই জঙ্গল সংরক্ষণ করেন। সৈকত বরাবর সুবর্ণ দ্বীপের গা ঘেঁষা এই জঙ্গলে পক্ষীকূলের সমাহার। গোবেচারা গো বকের পাশাপাশি লিটল গ্রিন হেরন, চেষ্টনাট বিটটার্ন, গোলিয়াথ হেরন, নানা প্রজাতির পানকৌড়ি-ডার্টার, শ্যাগ, করমোনান্ট-এর অলস আনাগোনা। কিন্তু দুপুরতো আর পাখি দেখার সময় নয়। দূরবীনের মধ্যে দিয়েও রোদ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তদুপরি দর্শনার্থী আমি একা। সময় বিশেষে সেটাও খুব স্বস্তিকর অভিজ্ঞতা নয়। পক্ষীকুলের পাশাপাশি জীবজগতের যে শাখায় আমার কৌতুহল এসচুয়ারিন ম্যানগ্রোভের সেই সজীব সদস্যরা তখন শীতঘুমে মগ্ন। আসন্ন বর্ষায় আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্জন জঙ্গল ছাড়ি। রাস্তার দুপাশ দেখে বেশ বোঝা যায় আগে এগুলি বালিয়াড়ি ছিলো। হয়তো একটু দূরে এখনও আছে কোথাও। রাস্তার দুপাশে প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু জমি, তাতে বনস্পতি সদৃশ ক্যাসুরিনাকুল, মধ্যে মধ্যে ডাঙ্গা জমি, পরিণামে ক্যাসুরিনার উন্মুক্ত শিকড়রাজি দৃশ্যমান।
পথে ভোগরাই নামে এক গ্রাম। দিগন্তবিস্তৃত ফাঁকা জমি, মধ্যে মধ্যে জলরেখা। মহিষকুল পুচ্ছটি উর্দ্ধে তুলে জলরেখা অতিক্রমণে সদাব্যস্ত। পুরোটাই সুবর্ণরেখা নদীর খাত – সাগরে মেশার আগে তার বিস্তৃতি বুকে কাঁপন ধরায়। যেদিকে তাকাই অগণন নৌকা। নেমে দূরবীন আর ক্যামেরা বাগাতেই ভিড় জমে গেল। জায়গাটি রাস্তার মোড়ের মত – চায়ের দোকান, সাইকেল সারাইয়ের দোকান, মোবাইল রিচার্জ...। বাসিন্দারা পর্যটক দেখতে অভ্যস্ত নন এবং তাদের যে খুব একটা পছন্দ করেন না, বোঝা গেল। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, 'এই যে ছবি তুলছো কত করে বেচবে?' বিস্মিত হয়ে বললাম, 'বেচবো! বেচবো না তো, এমনিই।' – শুনে তিনি বিশ্বাস করেন না, তাঁরও ক্যামেরা আছে, ছবি তোলেন। কিন্তু সে ছবি বিক্রি হয় না। এদিকে বাবুরা তাদের গ্রামের ছবি তুলে 'অনেক' টাকায় বিক্রি করে এমনটিই তাঁর ও অন্যান্যদের ধারণা। বেশিক্ষণ থাকার ভরসা হয়নি, নাহলে ইচ্ছা ছিলো সুবর্ণরেখার খাতে প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটাহাঁটির।
ভূষণ্ডেশ্বর রোড ধরে বালি পাহাড় পেরিয়ে কুম্ভিরগাড়ি। যেখানে ভূষণ্ডেশ্বর, বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিবলিঙ্গ। মন্দির চত্ত্বরটি সুবিস্তৃত; পুন্যার্থীদের জন্য পূজা-উপকরণ বিক্রির দোকান, গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত। জানা গেল বর্ষায় সুবর্ণরেখা ভাসায় গোটা চত্বরটি। সম্ভবত সেই কারণেই মন্দিরটি ছোট। একটি বড় পাতকুয়ার মত জায়গায় মাটির অনেক নীচে থেকে উঠে এসেছে সাড়ে বারো ফুট উঁচু ও চোদ্দ ফুট পরিধির কালো গ্রানাইটের স্বয়ম্ভু শিব। নীচে নামার জন্য ঘোরানো সিঁড়ি – শিবঠাকুরের মাথায় দুধ, ঘি, দই বেলপাতা ঢালার জন্য মই। দেওয়াল নেই। শুধু টিন দিয়ে মাথায় আচ্ছাদন। খুঁটিয়ে দেখে মনে হল মন্দিরের ছাদের কাঠামো প্রতি বছর বর্ষার পর বদলানো হয়।
দুপুরবেলায় মন্দির জনহীন। শুধু স্থানীয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে কিছু পুণ্যার্থীর ভিড়। যতদূর মনে হলো পথের দুর্গমতার জন্য বাইরে থেকে খুব একটা লোকজন এখানে আসেন না। মন্দির সন্নিহিত অঞ্চলে গ্রানাইট পাওয়া যায় না। দূর থেকে নিয়ে আসা হলেও এত বড় ও ভারি শিবলিঙ্গ কী করে নদীবহুল দুর্গম এমন জায়গায় আনা হলো তাও এক বিস্ময়। সুবর্ণরেখার বানভাসি জলে বছরে ছ'মাস ওই এলাকা জলে ডুবে থাকে। সেই থেকেই জনশ্রুতির উদ্ভব – লিঙ্গ স্বয়ম্ভু – ব্রহ্মাণ্ডের আদি লিঙ্গ সুবর্ণরেখার চর জমি থেকে উথ্থিত হয়েছিল। মতান্তরে হিমালয়ের কৈলাস পর্বত থেকে জলে ভেসে দেবাদিদেব মহাদেবের মর্ত্যে আগমন - যদিও এটাই ভৌগোলিক অসম্ভাব্যতা। মন্দির চত্বরে পূজা উপকরণের দোকানে দেবমাহাত্ম্য বর্ণনাকারী বাংলা পুস্তিকা উপলব্ধ। তাই পড়ে জানা গেল দেবতা অতি জাগ্রত ও ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণে উদার হস্ত। আমার তখন একটাই প্রার্থনা – ঠাকুর, দিঘা-হাওড়া দূরন্ত এক্সপ্রেস ট্রেন আমাকে না নিয়ে ছেড়ে না যায়।
এবার ফেরার পালা। গাড়িতে সটান নতুন দিঘা। ঘড়িতে তখন তিনটে দশ। দশ মিনিট সৈকতে। আইসক্রিম। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ১২৮৪৮ দিঘা-হাওড়া দূরন্ত। তিনটে পঁয়ত্রিশে যাত্রা শুরু। তারপরি আহার্য। ভক্ষণান্তে এক ঘুমে হাওড়া। ঘড়িতে তখন ছটা আটান্ন – তেইশ মিনিট লেট।
~ দিঘার তথ্য ~ দিঘার আরো ছবি ~
অ্যাকাউন্টস ও ফিনান্সের দক্ষ আমলা তপন পাল বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি এবং ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ফ্যান ক্লাবের সদস্য। ভালোবাসেন বেড়াতে আর ছবি তুলতে।