তিন সাগরের মিলনস্থল - কন্যাকুমারী

অদিতি ভট্টাচার্য্য

কন্যাকুমারীর তথ্য || কন্যাকুমারীর আরো ছবি

কন্যাকুমারী। ভারতের মূল ভূখণ্ডের একেবারে দক্ষিণতম প্রান্ত। ছোটোবেলায় কতদিন ভারতের মানচিত্রর সামনে দাঁড়িয়ে ভেবেছি কবে যাব ওইখানে, ওই প্রান্তে যেখানে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরব সাগর মিলে মিশে একাকার। অবশেষে সুযোগ হল, কেরালা ভ্রমণের সঙ্গে জোড়া হল কন্যাকুমারীকেও।
কোভালম থেকে এক সকালে রওনা দিলাম কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পথে দেখলাম পদ্মনাভপুরম প্যালেস। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত কাঠের এই প্রাসাদটি কেরালার প্রাচীন স্থাপত্য রীতির এক অনবদ্য নিদর্শন। এই প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ আছে - মন্ত্রশালা অর্থাৎ রাজার মন্ত্রণালয়, থাই কোট্টারাম অর্থাৎ রাজার মার বাসস্থান, নাটকশালা ইত্যাদি। প্রাসাদের অভ্যন্তরে বহু পুরোনো কাঠের নানা রকম আসবাবপত্র রয়েছে। সিলিং এবং থামের কাঠের নকশা এক কথায় অসাধারণ। এক জায়গায় সিলিং-এ নব্বইটি বিভিন্ন ডিজাইনের ফুল রয়েছে, সবই কাঠের। প্রাসাদটি ঘুরে দেখতে যথেষ্ট সময় লাগে। প্রাসাদের লাগোয়া মিউজিয়াম। প্রাসাদের মাথায় একটি তিনশ বছরের পুরোনো ঘড়ি আছে যা এখনও সঠিক সময় দিয়ে চলেছে।
ওখান থেকে সোজা কন্যাকুমারী। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে, খাওয়া দাওয়া করেই সমুদ্রের ধারে চলে এলাম। তীর থেকে আধ কিলোমিটার মতো দূরে সমুদ্রের জলের মধ্যে মাথা তুলে আছে একটি প্রস্তরখণ্ড। প্রাচীন কাল থেকেই এটি প্রসিদ্ধ শ্রীপদ পারাই নামে। পুরাণ অনুসারে দেবী কুমারী এখানে তপস্যা করেছিলেন। তাঁর পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল এই প্রস্তর। পাথরের একটি অংশ লম্বাটে, বাইরে বেরোন, অনেকটা মানুষের পায়ের মতো দেখতে। এটিকেই দেবীর পা বলে মনে করা হয়। তামিল ভাষায় পারাই মানে পাথর।
তিন বছর ধরে সারা ভারতের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোর পর ১৮৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে এক বাঙালি যুবক এখানে এসেছিলেন। মনে তখন তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তাল সমুদ্র, নিজের দেশবাসীর দুর্দশা দূর করার তীব্র আকুতি। সেই জিজ্ঞাসাকে শান্ত করতে, নিজের ভবিষ্যত পথ নির্ধারণ করতে তিনি সাঁতরে সমুদ্রের ভেতর জেগে থাকা এই পাথরে আসেন এবং তিন দিন তিন রাত এখানেই ধ্যানমগ্ন থাকেন। এরপরের ঘটনা ইতিহাস। তাঁর স্মরণেই এখানে গড়ে উঠেছে বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল।
লঞ্চে করে পৌঁছতে হয় বিবেকানন্দ রকে। এ যাত্রাটাও বেশ লাগে। এর দুটি অংশ, বিবেকানন্দ মণ্ডপম এবং শ্রীপদ মণ্ডপম। বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে বিবেকানন্দ মণ্ডপমে উঠতে হয়। সেখানে একটি বড়ো হলে রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বিশাল মূর্তি। ছবি তোলা এখানে নিষিদ্ধ। রয়েছে ধ্যানকক্ষ। মণ্ডপদুটি এমনভাবে নির্মিত যাতে স্বামী বিবেকানন্দের মুখ দেবীর পদচিহ্নের দিকেই থাকে। সুন্দর এখানকার পরিবেশ। পেছনে তাকালে ভারতের মূল ভূখণ্ড, তাছাড়া শুধুই জলরাশি। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরব সাগর এখানে এক। কত যে রঙের খেলা তাতে! দেখতে দেখতে বেশ সময় কেটে যায়।
বিবেকানন্দ মেমোরিয়াল রকের অনতিদূরে অপেক্ষাকৃত ছোটো এরকমই আরেকটি পাথরের ওপর আছে বিখ্যাত তামিল কবি তিরুভাল্লুভারের মূর্তি। মূর্তিটি আটত্রিশ ফিট উঁচু একটি পেডেস্টালের ওপর বসানো। সব মিলিয়ে পুরো স্থাপত্যটি একশ তেত্রিশ ফিট উঁচু। এখানেও লঞ্চে করেই যেতে হয়। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটে অবধি লঞ্চ চলাচল করে।
কন্যাকুমারী – যাঁর নামে দক্ষিণ ভারতের এই শহর এবং জেলার নাম, তিনি দেবী কুমারী, দেবী দুর্গার কুমারী রূপ। দুপুরে মন্দিরে যাওয়া যায় নি, তাই সন্ধের আরতির সময় গেলাম দেবী দর্শন করতে। পুরাণকথা অনুযায়ী দৈত্যরাজ বাণাসুরের অত্যাচারের হাত থেকে সবাইকে মুক্তি দিতে দেবী কুমারীর আবির্ভাব। সমুদ্রের একদম কাছেই মন্দির। জনশ্রুতি এই মন্দির তিন হাজার বছরের পুরোনো। মন্দিরের ভেতরে দেবীর বালিকা রূপের মনোরম মূর্তি। খুব সম্ভবত দেবীর কুমারী রূপের মূর্তি ভারতের এই একটি জায়গাতেই আছে। দেবীর সর্বাঙ্গে নানা মূল্যবান অলঙ্কার। তবে সবচেয়ে দৃষ্টি কাড়ে দেবীর হীরের নথ। প্রদীপের স্বল্প আলোকেও যার উজ্জ্বল দ্যুতি। শোনা যায় প্রাচীন কালে যখন মন্দিরের পূর্ব দিকের দরজা খোলা থাকত তখন সূর্যের আলোয় এই হীরের নথের ঝলকানি দূরে সমুদ্রে নাবিকরাও নাকি দেখতে পেত। বর্তমানে এই দরজা বন্ধই রাখা হয়, কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের সময় কখনো সখনো খোলা হয়। দেখে ভালো লাগল যে একেবারে সামনে থেকে দর্শনের সুযোগ পাওয়া যায়।
মন্দির থেকে ফিরে সমুদ্রের ধারে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। দূরে বিবেকানন্দ মেমোরিয়াল রক তখন সেজে উঠেছে আলোকমালায়। অন্ধকারে সমুদ্রের বুকে যেন জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃতি সদয় থাকলে এখানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্যও অতি মনোরম।

(তথ্যসূত্রঃ কেরালা পর্যটনের ওয়েবসাইট এবং উইকিপিডিয়া)

কন্যাকুমারীর তথ্য || কন্যাকুমারীর আরো ছবি

সংখ্যাতত্ত্ববিদ অদিতির কাছে বই আর অক্সিজেন সমতুল্য। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। ভ্রমণ,ছবি তোলা, এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি ইদানীং লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন (আসমানিয়া, জয়ঢাক,পরবাস, মাধুকরী, গল্পকবিতা ডট কম) ও আরো দু একটি পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher