যেখানে আকাশ নাম ধরে ডাকে

মার্জিয়া লিপি

কেদারনাথের তথ্য

স্নেহের ভোর,

বন্যাবিধ্বস্ত কেদারনাথের ছবি দেখছিলাম টেলিভিশনে। মনে পড়ছিল বছর কয়েক আগের কথা। সেবারে ভারত ভ্রমণে আমাদের গন্তব্য দেরাদুন, সিমলা, নৈনিতাল, দিল্লি। সেটা ছিল ২০০৪ সাল। সেবারে হিমালয় তীর্থযাত্রা শেষে আমি তোমাকে ধারণ করি, তোমার অস্তিত্ব অনুভব করি। আজ বারবার সেই ভ্রমণকথা মনে পড়ছিল। সেই যাত্রায় আমার সঙ্গী ছিলেন তোমার বাবা আর কলকাতার দু'জন।

তুমিতো জানো বরাবরই প্রকৃতি আমাকে খুব টানে। নদী, ঝরনা, পাহাড়, সন্ধ্যার আকাশ, আকাশ ভরা তারা, পূর্ণিমা, শরতের ভোর, শিউলি ফুল ঝরা, কাশবন - নিস্বর্গ প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার ভিতরের শূন্যতাকে আরো শূন্য করে। আমার তখন শূন্যতায়, নিমগ্নতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে।

সব মানুষই অন্যরকম। তারপরও আমি সব সময়ই খুব বেশি অন্যরকম...

তোমাকে লিখতে লিখতে শুনতে পাচ্ছি, দূর থেকে গান ভেসে আসছে - "পাহাড়ের কান্না দেখে, তোমরা তাকে ঝরনা বলো" ...

হাওড়া থেকে যাত্রা করে দুন এক্সপ্রেসে দু'দিন দু'রাত কাটানোর পর তৃতীয় দিনে সূর্য হঠাৎই বললো - 'হিমালয়ে ট্রেকিং করবে? পাহাড়ে ২৮ কিলোমিটার হাঁটতে পারবে তো?'
ট্রেকিং-এর কোন পূর্বপ্রশিক্ষণ নেই, আমার তিরিশ বছরের জীবনে তখনও পাহাড়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা কেবল মাধবকুণ্ড আর সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির।
ভাটি এলাকায় হওয়ার কারণে শুকনো মৌসুমে সদর জেলার বাড়ি থেকে গ্রামের বাড়ি আসা যাওয়ার জন্য কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। কিন্তু সেটা পাহাড়ে নয় সমতলে। সেই হাঁটার অভিজ্ঞতা আর আত্মবিশ্বাসকে সম্বল করে সূর্যকে প্রশ্ন করেছিলাম - ২৮ কিলোমিটার হাঁটলে কী পাবো?
উত্তরে শুনলাম 'হিমালয়'।
কল্পনার চোখে দেখতে লাগলাম - সাদা বরফের শৃঙ্গ হিমালয় আর শেরপাদের ছবি।
এর আগে দিব্য চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছিলাম দার্জিলিং-এ। সেখানে প্রতিষ্ঠিত তেনজিং নোরগের মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-এ গত ট্যুরে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। তখন ইচ্ছে হয়েছিল, ভেবেছিলাম, একটু আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবো কিনা? চেষ্টা করে দেখবো নাকি, আমিও শেরপাদের মত পাহাড়ে যেতে পারি কিনা?
সূযের্র প্রস্তাবে কিছু না ভেবেই তাই ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে গেলাম।
একটু দুশ্চিন্তা আর পিছুটান ছিল - কলকাতা থেকে করে নিয়ে আসা সিমলা, নৈনিতাল আর দিল্লির রিটার্ন টিকিটগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে।

সামনের ষ্টেশন হরিদ্বার। ঘন্টা খানেক পর অবশেষে শিবালিক পাহাড়ের পাদদেশে হরিদ্বারে পৌঁছালাম। পুরনো পরিচয় মায়াপুরী নামে। এখান থেকেই গঙ্গার সমতলে যাত্রা শুরু হয়েছে। আমাদের গন্তব্য উত্তর প্রদেশের হিমালয় শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ।
দুপুরে হিমালয়ের ট্রেকিং-এর প্রস্তুতি হিসেবে মনসামঙ্গল পাহাড়ে চার ঘন্টার ট্রেকিং শেষ করলাম।
সন্ধ্যায় 'হরি কি পউরি' ঘাটে ৯৯৯টি ফুল, প্রদীপ দিয়ে সাজানো পাতার ভেলায় মঙ্গলারতির কথা এখনও চোখের সামনে ভাসছে। হরিদ্বারে স্টেশনে রিটার্ন টিকিট ফেরত দেওয়ার সময় কলকাতার দাদাদের কাছে ধরা পড়লাম। পাসপোর্টে নাম দেখে বুঝে গেলেন – তাঁদের দুই তীর্থ সহযাত্রী, হিন্দু নয় মুসলিম!

ভোর পাঁচটায় রওনা হলাম শৈবতীর্থ হিমালয় শৃঙ্গের উদ্দেশে। কাঁধে হ্যাভারস্যাক, হাতে স্পাইক লাগানো লাঠি আর হঠাৎ ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে উইন্ডসর ।
কেদারশৃঙ্গের পাদদেশে মন্দাকিনী নদীর কূলে, গাড়োয়াল হিমালয়ে ১২৮৬৬ ফুট উঁচুতে কেদারনাথের মন্দির।
সেদিন ছিল অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখ। দেওয়ালির পর ২৫ তারিখে মন্দিরের মূর্তিকে সমতল ভূমি উখিমঠে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখন বরফের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে গৌরীকুণ্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কেদারনাথের পথে সবুজ মন্দাকিনী আর শ্বেত অলকানন্দা নদী রুদ্রপ্রয়াগে মিলিত হয়েছে। সেখানে সঙ্গমে একখণ্ড শিলা - নাম 'নারদশিলা'। কথিত আছে, এই শিলায় বসে নারদ তাঁর বীণা বাজাতেন।

কেদারনাথ যাওয়ার জন্যে হরিদ্বার থেকে তেরো ঘণ্টা বাস জার্নি করে প্রথমে পৌঁছেছি গৌরীকুণ্ডে। পার্বতী এখানকার উষ্ণ কুণ্ডে স্নান করতেন, তাই এ জায়গার নামকরণ গৌরীকুণ্ড। শৈবতীর্থ কেদারনাথ শৃঙ্গ সেখান থেকে ২৮ কি. মি. আসা যাওয়া, ট্রেক বা পায়ে হাঁটার পথ। যদিও হেলিকপ্টার, ঘোড়া, ডান্ডি - অনেক কিছুর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের এই চারজনের পদযুগল ভরসা।

কলকাতার শিবুদার প্রেরণা আমি। তাঁর ভাষায়, "একটা মেয়ে মানুষ, তার চোখের সামনে দিয়ে হিমালয়ের শৃঙ্গে যাচ্ছে,আর তিনি পারছেন না; তা কি হয়?"
আমিও পারছিলাম না, তারপরও অনেক কষ্টে একরকম কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছিলাম। পা সাথে আছে কীনা বুঝতে পারছিলাম না মাঝেমাঝেই। গৌরীকুণ্ড থেকে ৭ কিলোমিটার যাওয়ার পর রামওয়াড়াতে যাত্রা বিরতি করলাম। সেখানে অসংখ্য ভেড়ার দেখা মেললো। ভেড়ার আধিক্যের কারণে নাকি এ জায়গার এরূপ নামকরণ। ছোট্ট পাহাড়ি টঙ-এ চা খেলাম শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ানোর আশায়। দলনেতা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি জানতেন পাহাড়ে একই গতিতে হাঁটতে হয়। থেমে গেলে স্থিতি জড়তার কারণে চলার গতি স্লথ হয়ে যায়। এত উচ্চতায় অক্সিজেন কম তাই নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বুকের ভিতরে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছিলাম।

রাস্তার দু'পাশে গভীর খাদ। হিমালয়ের সাদা বরফে সোনা রং-এর রোদের তীব্র ছটায় মনে হয়, যেন পাহাড়ে আগুন ধরে গেছে। খালি চোখে তাকানো যায় না। রোদ চশমায় তাকিয়ে দেখছিলাম বরফে সূর্যের তীব্র আলোর প্রতিফলন। অসাধারণ অপার্থিব। প্রতিমুহূর্তে বিমোহিত হয়েছি। পথের নৈসর্গিক দৃশ্য, মন্দাকিনীর সবুজ সুন্দর প্রবাহ, অসংখ্য ঝরনা - পাহাড়ের গা বেয়ে পাথর চিরে ছুটে যাচ্ছে প্রচণ্ড বেগে কোথাওবা ঝিরঝির হয়ে। কেদারশৃঙ্গের বরফের রুপালি ঝলক, পথের সমস্ত কষ্ট দূর করে দেয়।

অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম, সাদা বরফের শৃঙ্গ হিমালয় - শৈবতীর্থ কেদারনাথ।

কেদার থেকে ফিরে গেলাম হৃষীকেশ। হরিদ্বার থেকে ২৪ কি.মি. দূরে বিখ্যাত আর এক পৌরাণিক শহর। ত্রিবেণী সঙ্গম আর প্রকৃতির শান্ত,নির্জন বনচ্ছায়া, ঋষি, মুনি, পর্যটক কুলকে মুগ্ধ করেছে চিরকাল ধরে। ত্রিবেণী সঙ্গমের কাছে শৈলশহর মুসৌরী আর উত্তরাঞ্চলের রাজধানী দেরাদুন। সন্ধ্যায় গেলাম শহর থেকে ৮ কি.মি. দূরে দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত ফরেষ্ট রিসার্চ ইনষ্টিটিউটে। ইন্দিরা গান্ধী আর রাজীব গান্ধীর বিখ্যাত দুন স্কুল কাছেই। শিখদের সাঁইবাবার দরবারে সুরের ঝংকার, চোখ বন্ধ করলে আজও কানে বাজে।

সারা রাতের বাস যাত্রা শেষে হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায়। ব্রিটিশ যুগে গড়ে ওঠা শহর। সিমলা থেকে কালকা, পাহাড়ের ১৪০ টি সুড়ঙ্গ কেটে রেলপথ। গ্রীনভ্যালি, কুফরি, ফাগু, হেলিপ্যাড আর বিখ্যাত এ্যাসেম্বলি ভবন যেখানে ১৯৭২-এ পাকিস্তান ও ভারতের সিমলা চুক্তি হয়েছিল। কালকার খুব কাছেই হরিয়ানা আর পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডিগড়। পৌরাণিক কুরুক্ষেত্র খ্যাত হরিয়ানায় মোঘলদের শিল্প সৌকর্যের পিঞ্জর গার্ডেন।

ঘোড়ায় চড়ে কুফরির পাহাড়ের শৃঙ্গে পৌঁছে আপেল গাছের নীচে বসে রেস্টুরেন্টে টমেটোর স্যুপ খেতে খেতে হঠাৎই চোখে পড়লো অর্ধবৃত্তাকার হিমালয়ের তুষারের রূপালি শৃঙ্গমালা - অপার্থিব সৌন্দর্য, চারপাশে যেন মালার মতো ঘিরে রেখেছে - সিমলাকে।

জীবন কী আশ্চর্য সুন্দর! চারপাশের শ্বেত শুভ্র তুষার, নীচে সবুজ পাইনের উপত্যকা, উপরে গাঢ় নীল আকাশ - চারপাশে আশ্চর্য আলো, হাত ধরে সূর্যের পাশে দাঁড়িয়ে আছি তারপরেও মনে হয়, কোথাও কেউ নেই। এত অসহ্য সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে খুব রিক্ত মনে হয়।

সেদিন ছিল আমার জন্মদিন।
হঠাৎ মনে হলো, এতগুলো বছরে নিজের অর্জন কী ? "কিছুই না"!

ফিরে এসে তোমাকে পেলাম - আমার জীবনের ভোর।
মাতৃত্বের অনুভূতি তো সকলেরই শাশ্বত।

ইতি,
তোমার মা


কেদারনাথের তথ্য

লেখিকা ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া বাংলাদেশের জাতীয় স্তরে পরিবেশ পরামর্শক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কর্মরত। কাজের সূত্রে এবং ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের আনাচেকানাচে এবং ভারতের নানান জায়গায়। প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ নিয়ে সেই অনুভূতির ছোঁয়াই ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। প্রকাশিত বই 'আমার মেয়েঃ আত্মজার সাথে কথোপকথন'।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher