নিরালা গ্রাম পানতুমাই

এ.এস.এম. জিয়াউল হক

~ পানতুমাই-এর তথ্য ~ পানতুমাই-এর আরো ছবি ~

সিলেট জেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন-এর পানতুমাইকে বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম। ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তের নিভৃত কোলে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই গ্রামটি। আটচল্লিশটি গ্রাম নিয়ে এই পশ্চিম জাফলং ইউনিয়ন গঠিত এবং প্রায় ৬৯,০০০ মানুষ এই ইউনিয়ন-এ বাস করেন। অনেকে এই গ্রামের নাম "পাংথুমাই" বলেন, কিন্তু মতভেদে এর সঠিক উচ্চারণ "পানতুমাই"।
"ভবঘুরে বাঙালি"-র পক্ষ থেকে ছ'জনের একটি দলে আমরা তিরিশে এপ্রিল রাতের ট্রেনে রওনা দিয়েছিলাম সিলেট এর উদ্দেশে। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নামলাম সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে। একটা হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে পায়ে পায়ে রওনা হলাম বিখ্যাত কিন ব্রিজ-এর দিকে। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে সোজা আম্বরখানা। আম্বরখানা থেকে আবার সিএনজি করে গোয়াইনঘাট। গোয়াইনঘাট পৌঁছে সেখান থেকে আমরা কিছু শুকনো খাবার কিনলাম। দোকানে পরিচয় হল হেলাল ভাইয়ের সাথে। উনি আমাদের বললেন সিএনজি নিয়ে সরাসরি পানতুমাই চেয়ারম্যানের বাড়ি চলে যেতে। আমরাও রওনা হলাম পানতুমাই এর উদ্দেশে।

পানতুমাই গ্রামে ঢোকার মুখেই আশ্চর্যসুন্দর দৃশ্য দেখে চমকে যেতে হয়। দূরের মেঘালয় পাহাড়গুলো যেন হঠাৎ চোখের সামনে চলে এল, মনে হয় হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। পানতুমাই পৌঁছে আমরা সোজা চেয়ারম্যানের বাড়ি গেলাম। যেতে না যেতেই বৃষ্টি শুরু হোল। ব্যাকপ্যাকগুলো বারান্দায় রেখে আমরা চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ততক্ষণে প্রায় দুপুর বারোটার কাছাকাছি বাজে। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান মোঃ ফয়জুল ইসলাম এলেন। ইনি পুরো পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ওনার মতো অমায়িক মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। এই সামান্য পরিচয়েই আমরা কেন তাঁকে আগে খবর দিয়ে আসিনি, এখন তিনি আমাদের কী দিয়ে আপ্যায়ন করবেন এই নিয়ে ভারী বিব্রত হয়ে পড়লেন। আমরা সঙ্গে করে তাঁবু আর শুকনো খাবার নিয়ে এসেছি। কিন্তু তাঁকে কিছুতেই এটা বোঝাতে পারলাম না যে শুধু তাঁর সাথে দেখা করতেই এসেছি, আশ্রয়ের জন্য নয়। তিনি সঙ্গে স্থানীয় সেলিম ভাইকে দিয়ে দিলেন যাতে আমরা "ইন্ডিয়ান ঝরনা" দেখতে পারি। ব্যাকপ্যাকগুলো চেয়ারম্যানের বাড়িতে রেখে রওনা দিলাম ঝরনার দিকে। এই ঝরনাটিকে স্থানীয় ভাষায় ফাটাছড়ির ঝরনা বা বড়হিল ঝরনাও বলা হয়। যদিও ঝরনাটি ভারতের ভিতরে পড়েছে, কিন্তু পিয়াইন নদীর পাড়ে দাঁড়ালে একে খুব কাছ থেকে দেখা যায়। ঝরনার পাশেই রয়েছে বিএসএফ এর ক্যাম্প। বড় গাছের সারি দিয়ে এখানে দুই দেশের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।
যাই হোক, ঝরনার ঠাণ্ডা পানিতে আর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পিয়াইন নদীতে আমরা গোসল করলাম। এরপর বের হলাম দুপুরের খাবারের খোঁজে। বেড়ানোর জায়গা নয় বলে পানতুমাই গ্রামে কোন খাবার হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় বাজার প্রায় এক দেড় কিমি দূরে। উপায় না দেখে নদী পার হয়ে আমরা চলে গেলাম হাজিপুর বাজারে। আরেকটি বাজার আছে - মাতুরতল বাজার। কিন্তু সেটা বিপরীত দিকে এবং অপেক্ষাকৃত দূরে। যাওয়ার পথে আমরা পাহাড়ের কোলে আরেকটি ঝরনার শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু ঘন জঙ্গল আর খিদের তাগিদে ওদিকে আর গেলাম না। হাজিপুর বাজারে আমরা খেলাম সেখানকার এক মাত্র খাবার এক ধরনের ভাত, ভাজি আর সাথে পিঁয়াজি এবং ছোলা। খাওয়ার শেষে আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম গ্রামের উদ্দেশে। এক জায়গায় দেখলাম মাঠে কয়েকজন ক্রিকেট খেলছে। পাহাড়ের কোলে এত সুন্দর একটা মাঠে খেলার লোভ আর সামলাতে পারলাম না। ছেলেগুলোও আমাদেরকে আপন করে নিল এবং খেলা শেষে বারবার বলতে লাগলো, আমরা যেন আবার পানতুমাই আসি।

সন্ধ্যার সময় আমরা আবার চেয়ারম্যানের বাড়িতে ফিরে এলাম। ইচ্ছা ছিল এখান থেকে ব্যাকপ্যাকগুলো নিয়ে ঝরনার আশপাশে কোথাও তাঁবু ফেলব। কিন্তু আকাশের পরিস্থিতি এবং রাতে আমাদের নিরাপত্তার জন্য চেয়ারম্যান সাহেব সেটা করতে দিলেন না। রাতে তাঁর বাসাতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। আমরাও বৃষ্টির অবস্থা দেখে আর না করিনি। রাতে সেখানেই খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ন'টার ভিতরে আমরা চা খেয়ে ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ফেললাম। আমাদের প্ল্যান বিছনাকান্দি হয়ে সিলেট ফেরার। চেয়ারম্যান সাহেব এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হতেই সেলিম ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা পাটুয়া বর্ডার যেতে চাই কিনা? আমরাতো এক কথায় রাজি। যাওয়ার পথে আগেরদিন যে ঝরনার শব্দ শুনেছিলাম, ওটার উৎসের সন্ধানে জঙ্গলের দিকে এগোলাম। এর মাঝে আবার বৃষ্টি শুরু হোল। বাঁশঝাড় আর জঙ্গল পেরিয়ে এমন একটা জায়গায় পৌঁছলাম যেখান থেকে ঝরনার মোটামুটি একটা ভিউ পাওয়া যায়। স্থানীয়রা একে "ফেরেডের ঝরনা" বলে। যে খাসিয়া সরদারের মালিকানাধীন মেঘালয়ের এই স্থানটি, তাঁর নাম ফেরেড। বড় বড় পাহাড়ি জোঁক উপেক্ষা করে আমরা ঝরনার ছবি তুলে ফিরতি পথ ধরলাম।
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা পাটুয়া সীমান্ত ঘুরে নিলাম। এরপর পাটুয়া থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু হোল বিছনাকান্দির দিকে। মেঘালয়ের এই রেঞ্জে ভারতের কিছু ঝরনা আছে যেগুলো বর্ষার সময় বেশ ফুলে ফেঁপে উঠে। পাটুয়া থেকেই সেলিম ভাইও বিদায় নিলেন। আমরাও পানতুমাইকে বিদায় জানিয়ে মেঘালয়ের সারি সারি পাহাড়কে ডান পাশে রেখে নদীর পাড় ধরে গ্রামের মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সোনার হাট। বিজিবি ক্যাম্প-এর ডান পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ - একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে নদী। তীর ধরে হাঁটতে ভালই লাগছিল। কখনও বৃষ্টি আবার কখনওবা রোদ। আনুমানিক ঘণ্টা তিনেক হাঁটার পর পৌঁছলাম ইসলামাবাদ বলে একটা জায়গায়। এখানে নৌকা করে নদী পার হতে হবে। হঠাৎ ডান দিকে তাকাতেই একেবারে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। বিস্তীর্ণ মাঠের শেষে পাহাড়ের সারি এবং মেঘের মিশ্রণ দেখে ভুলে গেলাম এটা আদৌ বাংলাদেশের কোন জায়গা। এই অসাধারণ ক্যাম্প স্পটে তাঁবু টাঙানোর লোভ অনেক কষ্টে সংবরণ করতে হোল। একেতো বৃষ্টি নামলে আশপাশে কোন আশ্রয় নেই আর অরণ্যের পরদিন জরুরি কাজও ছিল।

আবার ফিরে আসব, মনে মনে এই সান্ত্বনা নিয়ে নদী পার হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ডান দিকে পাহাড়ের সারিতে চোখ রেখে হাঁটছিলাম। হঠাৎ পাতার ফাঁক দিয়ে দেখি পাহাড়ের কোলে বিশাল এক ঝরনা । মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আমরা সবাই। "জিরো লাইনের ঝরনা"-র সেই বিশাল জলধারা পাহাড়ের কোলে রীতিমতো গর্জন করে নীচে নেমে আসছে। ছবি তুলে ফের হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি বিস্তীর্ণ মাঠের শেষে পাহাড়ের শুরু। মাঝে একটা ট্রেইল। আমি আর শাহিন ভাই মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বাকি চারজন মাঠের ভিতর দিয়ে আসতে লাগলো। ট্রেইল-এর এক জায়গায় আবার নদী পার হতে হবে। নদীর কিছু কিছু জায়গায় পাথর আবার কিছু কিছু জায়গা খুব গভীর। খুব সাবধানে পা ফেলে আর লাফ দিয়ে আমরা নদী পার হলাম। এখানেই পরিচয় হল শামসুদ্দিন-এর সাথে। সে সাইকেল চালিয়ে বিছনাকান্দিতে তার বাড়িতে ফিরছিল। সাইকেল থেকে নেমে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সে স্থানীয় একটা মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে পরে। বেড়াতে তার ভারী ভালোলাগে। পথে যেতে যেতে আরেকটা ঝরনা দেখাল শামসুদ্দিন - "দমদমার ঝরনা"। এখানে নদীর পাড়ে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। সামনে তাকাতেই পাহাড়ের কোলে ভারতের একটা ব্রিজ দেখা গেল। ব্রিজ থেকে আরেকটু দূরে ঝাপসা ভাবে আরেকটা খুব বড় ঝরনা চোখে পড়ল। শামসুদ্দিন বলল সেই ঝরনার পাদদেশে নাকি একটি গ্রাম আছে, সেখানে সে গিয়েছে। নদীর ওপারে সীমান্তে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ উদ্যোগে তৈরি একটি বাজার আছে - "নওয়া বাজার"। সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু দিনে শুধুমাত্র হাটবারে মাত্র দু'ঘণ্টার জন্য এই বাজার খোলা থাকে। আমরা এখানে আসার আধ ঘণ্টা আগেই বাজার উঠে গেছে। ব্রিজ এর নীচেই নদীর ওপারে একটা পাথর বেষ্টিত জায়গা দেখা গেল, যেখানে পানি বেশ স্বচ্ছ। ওখানে গোসল করার লোভ সামলাতে না পেরে আমরা নৌকার জন্য আশপাশে তাকাতে লাগলাম, কিন্তু কোন নৌকা আমাদেরকে ওপারে নিয়ে যাবেনা। পরে একজন স্থানীয় লোক জানালেন, একটু ঘুরপথে হেঁটে ওখানে যাওয়া যায়। আমরা সেইপথে এগিয়ে একটা জায়গায় এসে হেঁটে নদী পার হলাম। কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ল বিজিবি ক্যাম্প। আরো এগোতে আরেকটি ছোট বাজার। বাজারের পরেই বিস্তীর্ণ মাঠ আর মাঠের শেষে পাহাড়। আমি আর শামসুদ্দিন আগে আগে মাঠে নেমে এলাম। সামনে তাকাতেই দেখি মাঠের মাঝখানে ভারত এবং বাংলাদেশের সীমান্তসূচক তিনকোণা লোহার পিলার। এমন সময় ফাহিম এসে বলল যে সবাই বাজারে অপেক্ষা করছে, আমি ফিরলেই সিলেটের উদ্দেশে রওনা হবে। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো, যে উদ্দেশ্যে এখানে আসা, সেই নদীতেই আর নামা হল না।
বিছনাকান্দি বাজার থেকে আমরা হাদারপাড়-এর উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলাম। হাদারপাড় থেকে সিএনজি যায় সিলেটে। পথে শামসুদ্দিনের বাড়ি। এইটুকু আলাপেই বড় আপন হয়ে গিয়েছিল সে। নাস্তা খাওয়ার জন্য তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে কিছুতেই নিল না। আবার আসলে দেখা করবো এই প্রতিজ্ঞা করে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
হাদারপাড় যাওয়ার পথে একটি নদী পড়ে। নৌকায় পার হয়ে আমরা নদীর তীরে পাহাড়ের ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে মেঘ জমেছে। একটু পর পরই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। হেডলাইট জ্বালিয়ে পাহাড়ের সারি পিছনে ফেলে আমরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম। হাদারপাড় বাজারে পৌঁছতেই শুরু হোল তুমুল বৃষ্টি। এর ভিতরে একটি লেগুনা দেখে তাতে উঠে পড়লাম। কিন্তু ঝড় না থামলে সেটা যাবে না, রাস্তা খুব খারাপ। বৃষ্টি একটু কমলে লেগুনা ছাড়ল। বৃষ্টির ভিতর ভিজতে ভিজতে পাহাড়ের সারি পিছনে ফেলে ভাঙ্গা রাস্তায় আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। কিছুদূর যেতে না যেতেই গাড়ি খারাপ হয়ে গেলো। যাইহোক ড্রাইভার একটা সিএনজি ঠিক করে দিলো, যেটা সালুটিকর পর্যন্ত যাবে। যাওয়ার পথে ড্রাইভার এবং ফাহিমের পাল্লা দিয়ে গাওয়া গান, আমাদের সময় কিছুটা হলেও কমিয়ে দিলো।
সালুটিকর নেমেই দেখি একটা খালি ট্রাক সিলেটের দিকে যাচ্ছে। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে উঠে পড়লাম। গান আর হইহুল্লোড়ের মাঝখানে ট্রাক থেকে নামলাম জিন্দাবাজার। ইতিমধ্যে, পাথরবাহী ট্রাকের ধুলোয় সবার বেশ মাখামাখি অবস্থা।
সিলেটের বিখ্যাত পানসী রেস্তোরায় রাতের খাবার খেয়েই আমরা ছুটলাম ঢাকার বাস ধরার জন্য। অবশেষে রাত সাড়ে বারোটার হানিফ পরিবহণে আমরা ঢাকায় ফিরলাম।

~ পানতুমাই-এর তথ্য ~ পানতুমাই-এর আরো ছবি ~

ভ্রমণপ্রেমী জিয়াউলের স্বপ্ন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে প্রকৃতি আর বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher