বাংলাদেশ - নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আপামর বাঙালির নস্টালজিয়া। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি এই দেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব একটা ফ্লেভার আছে। নদী আর ইলিশের দেশ। সবুজ পাহাড়, ট্রপিকাল রেন ফরেস্ট, চা বাগিচা, ধানের ক্ষেত, সমুদ্রসৈকত, আবার আধুনিক বড় বড় শহর এইসব মিলিয়েই আমার সোনার বাংলা।
ঢাকা (Dhaka)- - মসজিদ, মসলিন আর রিকশার শহর ঢাকা। নামের উৎপত্তি ঢাকেশ্বরী কালীর থেকে। শহরের গা বেয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা। প্রাচীন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধনে বাংলাদেশের কর্মসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু এই রাজধানী শহর।
আহসান মঞ্জিল(Ahsan Manzil)- বুড়িগঙ্গার তীরে হাল্কা গোলাপী রঙের নয়নমনোহর আহসান মঞ্জিলটি নবাবি স্থাপত্যের এক অসাধারণ নির্দশন। পিঙ্ক প্যালেস নামে পরিচিত এই প্রাসাদটিতে এখন মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। প্রাসাদের ৩১টি কক্ষে ২৩টি গ্যালারিতে সাজানো রয়েছে নবাবদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। বৃহস্পতিবার বাদে সপ্তাহের সবদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
লালবাগ দুর্গ(Lalbag Fort)- পুরনো ঢাকার লালবাগে রয়েছে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র আজমের নির্মিত লালবাগ ফোর্ট। ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এটি তৈরি হয়েছিল। তিনতলা দুর্গটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য পরিবিবির সৌধ, শায়েস্তা খানের স্নানঘর -এটি এখন মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই দুর্গের নাম। শনিবার বাদে সপ্তাহের সবদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দুর্গ খোলা থাকে।
শহিদমিনার (Shahid Minar)- বাংলাভাষার জন্য আত্মত্যাগের প্রতীক শহিদমিনার। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে হাজার হাজার মানুষ ফুল দিয়ে ঢেকে দেন মিনারের পাদদেশ। নিরবে স্মরণ করেন সেই শহিদদের যাঁরা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন।
জাতীয় মিউজিয়াম (National Museum)- অতীত ইতিহাসের খোঁজে যেতে হবে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম আমলের স্থাপত্য ও শিল্পের অসাধারণ সংগ্রহ রয়েছে। আর আছে প্রাচীন মুদ্রা, বই, রুপো ও অন্যান্য ধাতুর তৈরি প্রাচীন জিনিসপত্র প্রভৃতি নানান কিছু। বৃহস্পতিবার বাদে রোজ সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে।
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (Bangabandhu Memorial Museum)- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন। বঙ্গবন্ধু ভবন এখন তাঁরই স্মৃতিতে মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে। তিনতলা এই মিউজিয়ামে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও ছবির সংগ্রহ রয়েছে। বুধবার বাদে সপ্তাহের অন্যান্যদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম(Muktijoddha Museum)- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহিদদের স্মৃতিতে এই মিউজিয়ামটি গড়ে উঠেছে। রবিবার বাদে সপ্তাহের অন্যান্যদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মিউজিয়াম খোলা থাকে।
স্বাধীনতা স্তম্ভ (Swadhinata Stambha) - ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। এই ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে তাঁর দেশের মানুষকে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে বক্তৃতাস্থলে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ।
নজরুলের সমাধি(Cemetery of Kazi Najrul)- ঢাকা ইউনিভার্সিটি মসজিদের গায়েই সমাধিস্থলে রয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি।
সুরাবর্দি উদ্যান(Surawardi Garden)- সবুজ এই প্রাঙ্গণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম শপথ গ্রহণ করা হয়। এটি রেস কোর্স পার্ক(Racecourse Park) নামেই অধিক জনপ্রিয়।
বঙ্গভবন (Bangabhaban)- প্রেসিডেন্টের বাসভবন। বাইরে থেকেই এই অনুপম প্রাসাদটি দেখতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট(Institute of Art and Craft)- শাহবাগে ছবির মত পরিবেশে আদিবাসী শিল্পকলার সংগ্রহালয়টি রয়েছে।
কার্জন হল(Curzon Hall)- লর্ড কার্জনের নামে নামাঙ্কিত অপরূপ স্থাপত্যের এই বাড়িটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান দপ্তর।
১৮৫৭ মেমোরিয়াল(1857 Memorial)- ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের স্মরণে তৈরি। এই স্থানেই সর্বসমক্ষে বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনকর্তারা।
চিড়িয়াখানা ও বটানিকাল গার্ডেন(Zoo and Botanical Garden)- ঢাকা থেকে ২০কিমি দূরে মীরপুরে তুরাগ নদীর তীরে পাশাপাশি চিড়িয়াখানা ও বোটানিকাল গার্ডেন। দেশ-বিদেশের নানান জীবজন্তুর মধ্যে চিড়িয়াখানার সেরা আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ২০৫ একর এলাকা জুড়ে ১,২০০ প্রজাতির প্রায় ৫০,০০০ গাছপালার ঠিকানা বোটানিকাল গার্ডেন। তবে সেরা আকর্ষণ গোলাপবাগটি। প্রায় ৩০০ প্রজাতির গোলাপের গাছ রয়েছে এখানে। সপ্তাহের সাত দিনই চিড়িয়াখানা ও বোটানিকাল গার্ডেন খোলা থাকে।
সিতারা মসজিদ(Sitara Mosque)- ১৮ শতকে ঢাকায় এক অভিজাত জমিদার মিরজা গুলাম পির অপূর্ব এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সাদা সিমেন্টের মধ্যে চায়নাওয়ারের কারুকার্যে মসজিদের গায়ে ঝলমল করছে অজস্র তারা। অন্দরের কারুকাজও ভারি সুন্দর।
বাইতুল মুকররম মসজিদ(Baitul Mukarram Mosque)- মসজিদের শহর ঢাকার আরেক অনুপম নিদর্শন। সবুজ বাগান আর ফোয়ারায় সাজানো মসজিদটির চেহারাও বেশ জমকালো। ঢাকার পুরনো পল্টন এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটি কাবা শরিফের আদলে তৈরি।
ঢাকেশ্বরী মন্দির (Dhakeswari Temple)- পুরনো ঢাকা আর নতুন ঢাকার সংযোগস্থলে প্রাচীন এই হিন্দু মন্দিরটির অবস্থান। বেশ বড় চত্বর নিয়ে মন্দির এলাকা। মূল মন্দিরে দেবী দুদিকে শিব নিয়ে অধিষ্ঠান করছেন। এছাড়াও চত্বরে আরও চারটি শিবমন্দির আছে।
বাবা আদমের মসজিদ(Mosque of Baba Adam)- ঢাকার কাছেই রামপালে ইলিয়াসশাহী সুলতান জালালুদ্দিন ফতে শাহের আমলে ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ছয় ডোমের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন জনৈক মালিক কাফুর। মসজিদের ভাস্কর্যে সেই সময়কার স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়।
সোনারগাঁও (Sonargaon)- ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে ঢাকা থেকে ২৯কিলোমিটার দূরে বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও। ১৩ শতক পর্যন্ত সোনারগাঁও ছিল দেব রাজবংশের রাজধানী। পরবর্তী সময়ে বাংলার দ্বিতীয় রাজধানীরূপে এই স্থান চিহ্নিত হয়। গোয়ালডিয়া মসজিদ, ফোকলোর মিউজিয়াম, সুলতান গিয়াসুদ্দিনের সৌধ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য।
জাতীয় শহিদ স্মৃতিসৌধ (National Martyr Memorial)- ঢাকার থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে নবীনগরে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্মরণে ১০৮ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে শহিদ স্মৃতিসৌধ। সবুজে ছোয়া বাগানের মাঝে ১৫০ ফুট উঁচু সাদা রঙের স্মৃতিসৌধটির স্থাপত্য সুন্দর।
বিরিশিরি [Birishiri] - নেত্রকোণার কাছে সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি। এখানে নদী এবং পাহাড়ের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। দ্রষ্টব্যগুলি হলঃ বিজয়পুর চীনামাটির খনি, রানীখং গীর্জা, কালচারাল একাডেমী, সোমেশ্বরী নদী, সাগর দিঘি প্রভৃতি।
বিজয়পুর [Bijoypur]-বিরিশিরির মূল আকর্ষণ বিজয়পুর চীনামাটির খনি। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
চীনামাটির পাহাড়গুলো সাদা রঙের। কিছু কিছু জায়গায় মেরুন বা হালকা লাল রঙ বিদ্যমান। পাহাড় থেকে মাটি তোলায় সেখানে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ হ্রদের জলের রঙ নীল। আবার কিছু কিছু জায়গায় সবুজাভ নীল, সাদা বা লাল। তবে হ্রদ থেকে পানি তুলে খনন করার জন্য লাল পানি এখন আর নেই। হ্রদের উপর পাহাড় চূড়ায় কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে দারুণ লাগবে। বিজয়পুরের ট্যুরিষ্ট সিজন শীতকাল। তখন পানি গাঢ় নীল থাকে।
ভ্রমণ কাহিনি - মায়াবী দীপচর আর সাদা পাহাড়ের কথা || অপরূপা সোমেশ্বরী
রানীখং গীর্জা [Queen's Church]- দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৬ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্তে সোমেশ্বরী নদীর কোল ঘেঁষেই রানীখং মিশনটি একটি উচু পাহাড়ে অবস্থিত। ১৯১০ সালে রাণীখং মিশনটি স্থাপিত হয়। এখান থেকে প্রকৃতিকে আরও নিবিড়ভাবে উপভোগ করা যায়।
কালচারাল একাডেমি [Cultural Academy]-বিরিশিরি কালচারাল একাডেমিতে উপজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করা হয়। এখানে প্রতি বছর উপজাতীয়দের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।
কমলা রাণী দিঘি [Kamaa Rani's Lake] -বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই কমলা রাণী দিঘি। এই কমলা রাণী দিঘি, সাগর দিঘি নামেও পরিচিত। দিঘিটি পুরোপুরি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখনও কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
সোমেশ্বরী নদী [Someswari River] - এই নদীটি একটি কয়লা খনিও বলা যায় । সারা দিন স্থানীয় দিন-মজুররা এই নদীতে কয়লা তোলেন। মেঘালয়ের গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই সোমেশ্বরী নদী যার আদি নাম ছিলো 'সমসাঙ্গ'। বিজয়পুর, রানী খং এসব জায়গায় যেতে হলে এই নদী নৌকায় পার হতে হয়।
কুল্লাগড়া মন্দির [Kullagara Temple] -বিজয়পুর যাওয়ার সময় পথেই পড়বে কুল্লাগড়া মন্দির।
যাওয়াঃ-ঢাকার মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বিরিশিরির বাস পাবেন। বিরিশিরির বাস বলা হলেও সোমেশ্বরী ব্রীজের কাজ শেষ না হওয়ার কারণে বাস থেকে নামতে হবে সুখনগরীতে। সেখানে নৌকায় ছোট নদী পার হয়ে ওপাড় থেকে মোটর সাইকেল, রিক্সা, টেম্পো বা বাসে দুর্গাপুর যেতে হবে। বিরিশিরি থেকে বিজয়পুর, রানীখং, বিডিআর ক্যাম্প এসব ঘুরতে রিক্সা অথবা মোটর সাইকেল ভাড়া করতে হবে। সোমেশ্বরী নদী পাড় হয়ে ওপাশে যেতে হবে। মোটরসাইকেলে গেলে রাস্তা খুবই খারাপ হওয়ায় মোটরসাইকেলে গেলে সুবিধা হবে - সব ঘুরে আসতে সময় লাগবে ঘন্টা ছয়েক ।
থাকাঃ-সব চেয়ে ভালো থাকার জায়গা YWCA রেষ্ট হাউজ। বেশ সুন্দর, ছিমছাম, গোছানো। কাছাকাছি প্রায় একই মানের YMCA এর রেষ্ট হাউজ, কালচারাল একাডেমির নিজস্ব রেস্টহাউস ও জেলা পরিষদ ডাক বাংলো। এছাড়াও কম খরচের হোটেল স্বর্ণা আছে। এছাড়াও বেশ কিছু কম দামি হোটেল রয়েছে।YWCA/YMCA তে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার জন্য একটু হেঁটে বাজারে যেতে হবে।
তথ্যঃ ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম’ ফেসবুক গ্রুপের বন্ধুদের সৌজন্যে
চট্টগ্রাম (Chattagram / Chittagong) - সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর বর্ণনায় চট্টগ্রামকে-‘কুয়াশা আর জল থেকে উঠে আসা এক ঘুমন্ত রাজকুমারী’ রূপে উল্লেখ করেছিলেন। ১৬ শতাব্দীতে পর্তুগীজ নাবিকরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘পোর্তো গ্রান্ড’। নীল সমুদ্র আর সবুজ পাহাড়ে মাখা চট্টগ্রামকে দেখলে আজও ওই দুই উপমাই সত্যি বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্দর চট্টগ্রাম। রাঙামাটি, খাগরাচারি আর বান্দরবন-এই তিন জেলা নিয়ে চট্টগ্রাম। সবুজে ছাওয়া উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে ফেনি, কর্ণফুলি, সাঙ্গ আর মাতামুহুরি নদী আর তাদের শাখানদীগুলি। উত্তরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে থাংনাং, লাংলিয়াং আর খাটিয়াং শৃঙ্গ, আর দক্ষিণে রামু, তাউং, কিকরাডাং, তাহজিনডং (বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, ৪৬৩২ ফুট), মোদক মোউল প্রভৃতি একের পর এক শৃঙ্গগুলি। বনপাহাড়ের চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ আদিবাসী মানুষ।
রাঙামাটি (Rangamati) -পাহাড়ে ঘেরা সবুজ অরণ্যের মাঝে কাপ্তাই লেক ছোট্ট শহর রাঙামাটির প্রধান আকর্ষণ। লেকে বোটিং,ওয়াটার স্ক্রুজ ও ওয়াটার স্কিয়িং-এর ব্যবস্থা আছে।
বাইজিদ বোষ্টমীর সমাধিক্ষেত্র - চট্টগ্রাম থেকে ৬কিমি দূরে টিলার উপরে পবিত্র এই সমাধিভূমি। এখানে একটি বড় ট্যাঙ্কে বেশ কয়েকশো কচ্ছপ রয়েছে। প্রচলিত গল্পকথা এই যে ১,১০০ বছর আগে এক সাধু এখানে এসেছিলেন। তাঁর অভিশাপে দুষ্ট আত্মা কচ্ছপে রূপান্তরিত। মনে করা হয় সংশ্লিষ্ট জলাধারটিতে আজও বেঁচে আছে তার উত্তরসূরীরা।
ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু সিমেটারি(World War II Cemetery)- শহরের মাঝেই শান্ত সুন্দর জায়গায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র ও স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে পাশাপাশি শায়িত রয়েছেন সাতশোরও অধিক ইংরেজ, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডীয়, নিউজিল্যান্ডবাসী, ভারতীয়, বার্মিজ, আফ্রিকান, ওলন্দাজ ও জাপানি সেনানী।
ফয়েজ লেক (Foy’s Lake)-শহর থেকে ৮কিমি দূরে পাহাড়তলীতে সবুজের বুকে ছবির মত লেক।
এথনোলজিকাল মিউজিয়াম (Ethnological Museum)- বাংলাদেশের আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে যেতে হবে আগ্রাবাদের এই মিউজিয়ামে।
সীতাকুণ্ড (Sitakund)- চট্টগ্রাম থেকে ৩৭কিমি দূরে সীতাকুণ্ড হিন্দু ও বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থ। এখানে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মাথায় চন্দ্রনাথ মন্দির ও বুদ্ধের চরণচিহ্ন সম্বলিত বৌদ্ধমন্দিরটি দর্শনীয়। প্রতিবছর শিবচতুর্দশী মহা ধুমধামে পালিত হয়। একান্ন পীঠের এক পীঠ এই সীতাকুণ্ড। এখানে সতীর ডান হস্ত পড়েছিল। কুণ্ডের ধারেই মন্দির। মন্দিরের মধ্যে পাথরের ভৈরব ও কালীমূর্তি।
চট্টেশ্বরীর মন্দির (Chatteswari Temple)- চট্টেশ্বরী থেকে নাম চট্টগ্রাম। স্টেশন থেকে মিনিট কুড়ি রিক্সা করে গেলে চট্টেশ্বরীর মন্দির। রাস্তা থেকে একটু উঁচুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকে মায়ের মন্দির, ডানদিকে শিবমন্দির। মাঝখানে বাঁধানো চত্বর। শিবমন্দিরের পাশে কুন্ড।
পাটেঙ্গা সৈকত (Patenga Beach)- চট্টগ্রামের সেরা আকর্ষণ ২২কিমি দূরে কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমে মোহময়ী পাটেঙ্গা সৈকত।
বান্দরবান [Bandarban] - চট্টগ্রাম থেকে ৯২ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ি শহর বান্দরবান। বান্দরবান জেলা চট্টগ্রাম বিভাগে। এর আয়তন ৪৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার।
নীলগিরি [Nilgiri] - নীলগিরি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যটন কেন্দ্র। এই পর্যটন কেন্দ্রের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ফুট। এটি বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলায় অবস্থিত। বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণ- পূর্ব দিকে এই পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। এই পর্বতের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত উপজাতী সম্প্রদায় ম্রো পল্লী। যাদের বিচিত্র সংস্কৃতি দেখার মত। বর্ষা মৌসুমে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র থেকে মেঘ ছোঁয়ার দুর্লভ সুযোগ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নীলগিরি থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর ও আধুনিক এই পর্যটন কেন্দ্রটি সেনা তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এর পাশেই রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প।
যাওয়াঃ-পর্যটকদের নীলগিরি যেতে হলে বান্দরবান জেলা সদরের রুমা জীপস্টেশন থেকে থানছিগামী জীপ অথবা বাসে করে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া যায়। বান্দরবনা জীপ ষ্টেশন থেকে জীপ, ল্যান্ড রোভার, ল্যান্ড ক্রুজারসহ অন্যান্য হালকা গাড়ি ভাড়ায় পাওয়া যায়। নীলগিরি যাওয়ার পথে সেনা চেকপোস্টে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে। বান্দরবান জেলা সদর থেকে সাধারণত বিকেল ৫ টার পর নীলগিরির উদ্দেশে কোন গাড়ি যেতে দেওয়া হয় না।
থাকাঃ-নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান জেলা সদর থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায়। এছাড়া নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে রাত্রিযাপনের জন্য বান্দরবান সদর সেনা রিজিয়নে বুকিং দেয়া হয়। তাছাড়া নীলগিরি পর্যটনে গিয়ে সরাসরি বুকিং করা যায়। বান্দরবান জেলা সদর থেকে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় অধিকাংশ পর্যটক দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসেন।
স্বর্ণমন্দির [Golden Temple] - বান্দরবানের উপশহর বালাঘাটার পুল পাড়ায় সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে সুদৃশ্য এই প্যাগোডা।বান্দরবান জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। এটি বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের একটি পবিত্র তীর্থস্থান।এখানে দেশ বিদেশ থেকে অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আসেন। এর অপর নাম মহাসুখ প্রার্থনা পূরক বুদ্ধধাতু চেতী। গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক কালে নির্মিত বিশ্বের সেরা কয়েকটি বুদ্ধ মুর্তির মধ্যে একটি এখানে রয়েছে। এই প্যাগোডাটি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার সেরাগুলির একটি।এই সুউচ্চপাহাড়ের উপর দেবতা পুকুর নামে একটি পানি সম্বলিত ছোট পুকুর আছে।
এই প্যাগোডা থেকে বান্দরবানের বালাঘাটা উপশহর ও এর আশপাশের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া বান্দরবান রেডিও স্টেশন, বান্দরবান চন্দ্রঘোনা যাওয়ার আকাঁবাকাঁ পথও দর্শনীয়। প্রতিবছর নির্দ্দিষ্ট সময়ে এখানে মেলা বসে।এই প্যাগোডা বা জাদীটি স্বর্ণ মন্দির হিসেবেও পরিচিত। বিকেলবেলায় প্যাগোডাটি দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
যাওয়াঃ- বান্দরবান থেকে রিক্সা অথবা ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়।
মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র [Meghla Tourist Spot] - বান্দরবান শহরের প্রবেশদ্বার বান্দরবান কেরাণীহাট সড়কের পাশেই পার্বত্য জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স অবস্থিত। পাহাড়ের খাদে বাঁধ নির্মাণ করে কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি করা হয়েছে।বান্দরবান শহর থেকে এর দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। বেড়াতে আসা পর্যটকদের চিত্ত বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে শিশুপার্ক, নৌকা ভ্রমণের সুবিধা, ঝুলন্ত সেতুর মাধ্যমে চলাচলের ব্যবস্থা এবং সাময়িক অবস্থানের জন্য একটি রেস্টহাউস। এছাড়া আকর্ষণীয় একটি চিড়িয়াখানা এই কমপ্লেক্সের সৌন্দর্য বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। মেঘলায় দুটি ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে।
যাওয়া ও থাকাঃ- মেঘলায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের খাওয়ার ও রাত্রিযাপনের জন্য বান্দরবান শহরে কিছু মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে। এছাড়া মেঘলার পাশেই রয়েছে দুটি আধুনিক মানের পর্যটন কমপ্লেক্স।
শৈল প্রপাত - বান্দরবান রুমা সড়কের ৮ কিলোমিটার দূরে শৈলপ্রপাত অবস্থিত। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সৃষ্টি। ঝরনার হিমশীতল পানি এখানে সর্বদা বহমান। এই ঝরনার পানি খুবই স্বচ্ছ। বর্ষাকালে এ ঝরনার দৃশ্য দেখা গেলেও ঝরনাতে নামা দুস্কর। রাস্তার পাশে শৈলপ্রপাতের অবস্থান হওয়ায় এখানে পর্যটকদের ভিড় বেশি দেখা যায়। এখানে দুর্গম পাহাড়ের কোল ঘেঁষা আদিবাসী বম সম্প্রদায়ের সংগ্রামী জীবন প্রত্যক্ষ করা যায়।
যাওয়াঃ- বান্দরবান শহর থেকে ট্যাক্সি, চাঁদের গাড়ি কিংবা প্রাইভেট কার ও জীপ ভাড়া করে শৈলপ্রপাতে যাওয়া যায়।
নীলাচল ও শুভ্রনীলা - বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে জেলা সদরের প্রবেশ মুখ টাইগার পাড়ার কাছে পাশাপাশি রয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্র দুটি। নীলাচল জেলা প্রশাসন ও শুভ্রনীলা বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।প্রায় ১৭০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের উপর নির্মিত এ দুটি পর্যটন কেন্দ্র থেকে পার্শ্ববর্তী এলাকার দৃশ্য দেখতে খুবই মনোরম।
যাওয়াঃ- বান্দরবান শহরের বাস ষ্টেশন থেকে জীপ, ল্যান্ড ক্রুজার, ল্যান্ড রোভার ভাড়া নিয়ে যেতে হবে অথবা বান্দরবান শহরের সাঙ্গু ব্রীজের কাছ থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে নীলাচল ও শুভ্রনীলায় যেতে পারেন ।
মিলনছড়ি (Milanchari) - মিলনছড়ি বান্দরবান শহর হতে ৩ কি:মি: দক্ষিণ পূর্বে শৈল প্রপাত বা চিম্বুক যাওয়ার পথে পড়ে। পাহাড়ের ওপর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পূর্ব প্রান্তে অবারিত সবুজের খেলা এবং সবুজ প্রকৃতির বুক চিরে সর্পিল গতিতে বয়ে চলা সাঙ্গু নদীটি দেখতে অপূর্ব লাগে।
চিম্বুক (Chimbuk Hill) - বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। চিম্বুক সারা দেশের কাছে পরিচিত নাম। বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট।চিম্বুক যাওয়ার রাস্তার দুই পাশের পাহাড়ি দৃশ্য খুবই মনোরম। পথে সাঙ্গু নদীও চোখে পড়ে। ২৫০০ ফুট উঁচুতে চিম্বুক পাহাড় থেকে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের নীচ দিয়ে মেঘ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা যায়।এখান থেকে পার্শ্ববর্তী জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম-এর বিভিন্ন উপজেলাগুলোকে দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে চিম্বুক পাহাড়ের পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য চিম্বুক। চিম্বুককে বাংলার দার্জিলিং বলা হয়।
যাওয়াঃ- চিম্বুক যেতে হলে বান্দরবান শহরের রুমা বাস স্টেশন থেকে চাঁদের গাড়ি হিসেবে পরিচিত জীপ, ল্যান্ড ক্রুজার, ল্যান্ড রোভার, পাজেরো এবং বান্দরবান-থানছি পথে যাতায়াতকারী বাস ভাড়া নিতে হবে - নিজস্ব গাড়ি হলে ভাল হয়। রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম হওয়ায় বাসে যাতায়াত করা ঝুঁকিপূর্ণ।
থাকাঃ- জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে একটি রেস্টহাউস আছে। অনু্মতিসাপেক্ষে রাত্রি যাপনের সুযোগ রয়েছে। চিম্বুকের পাশে সেনাবাহিনীর ক্যান্টিন রয়েছে। এখানে সকালের নাস্তা ও দুপুরে খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া খাবারের জন্য বান্দরবান থেকে চিম্বুক যাওয়ার পথে দুটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। চিম্বুক যাওয়ার পথে বান্দরবান থেকে হালকা খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ায় ভালো।
সাঙ্গু নদী ও ব্ল্যাক ফরেস্ট (Sangu River & Black Forest) – বাংলাদেশে উৎপত্তি হয়েছে এমন একমাত্র নদী সাঙ্গু চিম্বুক পর্বত শীর্ষ থেকে নেমে এসে বান্দরবন শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। বান্দরবান শহরের পূর্বে পাশে পাহাড়ি ঢালে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী দৃষ্টি নন্দন করে।
বান্দরবানের গহিন অঞ্চলে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারের সীমান্তে সাঙ্গু নদীর উৎসের কাছে "দ্য ব্ল্যাক ফরেস্ট" বা আন্ধারমানিক-এর অবস্থান।
যাওয়াঃ ঢাকা থেকে রাতের বাসে বান্দরবান। সেখান থেকে চাঁদের গাড়ি বা লোকাল বাসে থানচি। থানচি থেকেই গাইড এবং নৌকা ঠিক করে ফেলুন। প্রথম রাত্রি তিন্দু অথবা রেমাক্রিতে থেকে পরদিন ভোরেই চলে যান আন্ধারমানিক। এখানে বলে রাখা দরকার, রেমাক্রির পরে সাধারণত টুরিস্টরা খুব কম যায়, বি.জি.বি. সাধারণত বড় মদক ক্যাম্পের পরে আর যেতে দিতে চায় না। তাই অনুমতির ব্যাপারটা আগেই ঠিক করে রাখুন। মনে রাখবেন এই অঞ্চল এখনো টুরিস্ট স্পট না, অনেক বেশি দুর্গম তাই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং সম্ভব হলে প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করে আন্ধারমানিকে প্রবেশ করুন।
ভ্রমণ কাহিনি - রহস্যময় আন্ধারমানিক
বগা লেক (Boga Lake)- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বগালেক। কেওকারাডাং এর কোল ঘেঁষে বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলা সদরের কাছে পাহাড়ের উপরে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে এই হ্রদের অবস্থান। এখানে বাস করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বম ও খুমী সম্প্রদায়। অদ্ভুত সুন্দর এই নীল রঙের হ্রদের সঠিক গভীরতা বের করা যায়নি। স্থানীয়ভাবে দুইশ' থেকে আড়াইশ' ফুট বলা হলেও সোনার মেশিনে ১৫১ ফুট পর্যন্ত গভীরতা পাওয়া গেছে। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটি লেক। এর আশেপাশে পানির কোন উৎসও নেই। তবে বগালেক যে উচ্চতায় অবস্থিত তা থেকে ১৫৩ মিটার নিচে একটি ছোট ঝর্ণার উৎস আছে যা বগাছড়া (জ্বালা-মুখ) নামে পরিচিত। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে লেকের পানি প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাসে ঘোলাটে হয়ে যায়।
যাওয়াঃ- শুখা মৌসুমে বান্দরবান জেলা সদরের রুমা জীপ ষ্টেশন থেকে রুমাগামী জীপে করে রুমা সেনা গ্যারিসন (রুমা ব্রীজ) পর্যন্ত যাওয়া যায়। সেখান থেকে নৌকায় করে ২০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে রুমা উপজেলা সদর। বর্ষাকালে রুমাগামী জীপ কইক্ষ্যংঝিড়ি পর্যন্ত যায়।সেখান থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ঘন্টাখানেকের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে রুমা সদরে যেতে হয়।রুমা থেকে পায়ে হেঁটে অথবা জীপে বগালেক যেতে হয়। বর্ষায় বগা লেক যাওয়া নিতান্তই কষ্টসাধ্য। তাই বগালেক ভ্রমণে শীতকালকে বেছে নেওয়া শ্রেয়।
থাকাঃ- রাত্রি যাপনের জন্য বগালেকে জেলা পরিষদের অর্থায়নে একটি রেস্টহাউস নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বম উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন কিছু ঘর ভাড়ায় দিয়ে থাকেন।এঁরাই পর্যটকদের জন্য রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করে থাকেন।রুমা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার কিনে নেওয়াই শ্রেয়। উল্লেখ্য যে, নিরাপত্তার জন্য রুমা ও বগালেক সেনা ক্যাম্পে পর্যটকদের রিপোর্ট করতে হয়। স্থানীয় গাইড ছাড়া পায়ে হেঁটে রুমা থেকে অন্য কোন পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া উচিত নয়।
কেওক্রাডং এবং তাজিংডং (Keokradong & Tajingdong) – বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ তাজিংডং। উচ্চতা ৪৬৩২ ফুট।কেওক্রাডং বাংলাদেশের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গ।উচ্চতা ৪০৩৫ ফুট [সূত্রঃ বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন]।স্থানীয় উপজাতীয়দের ভাষায় ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড় আর ‘ডং’শব্দের অর্থ পাহাড়। এটি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে অবস্থিত। বর্ষাকালে তাজিংডং যাতায়াত অত্যন্ত কষ্টকর। গরমের সময় অনেকে অ্যাডভেঞ্চার করে পায়ে হেঁটে তাজিংডং যান।বর্তমানে রুমা উপজেলা সদর থেকে চাঁদের গাড়িতে কেওক্রাডং এর কাছাকাছি যাওয়া যায়।
ট্রেক করে যেতে হলে বগালেক থেকে খুব ভোরে বেরিয়ে পড়তে হবে। আসা যাওয়াসহ ৮-১০ ঘন্টা হাঁটার অভ্যাস থাকতে হবে।তাজিংডং ভ্রমণের সময় শুকনো খাবার,পানীয় জল,জরুরি ওষুধপত্র সঙ্গে নিতে হবে।রুমা উপজেলা সদরে রাত্রিযাপনের জন্য কয়েকটি হোটেল আছে। তাজিংডং যেতে হলে বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রথম যেতে হবে রুমা উপজেলা সদরে।রুমা সেনা গ্যারিসনে পর্যটকদের নাম ও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করতে হবে।পরবর্তীতে রুমা উপজেলা সদর সেনা ক্যাম্পে আবারও রির্পোট করতে হবে।রুমা উপজেলা সদর থেকে সাধারণত বিকাল ৪টার পরে বগালেক,কেওক্রাডং বা তাজিংডং এর উদ্দেশে যেতে দেওয়া হয় না। বর্ষায় গেলে বান্দরবান শহরের রুমা জীপ ষ্টেশন থেকে রুমাগামী চাঁদের গাড়িতে করে কৈক্ষ্যং ঝিড়ি যেতে হবে। তারপর নৌকায় ১ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে রুমা সদর। শীতকালে জীপে রুমা উপজেলা সদরের কাছে বোটঘাটায় পৌঁছে সেখান থেকে নৌকায় রুমা পৌঁছানো যাবে।রুমা থেকে পায়ে হেঁটে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং এর পাশ দিয়ে তাজিংডং যেতে হয়।
জাদিপাই জলপ্রপাত (Jadipai Falls) - কেওক্রাডাং থেকে পায়ে হেঁটে ১ঘন্টায় জাদিপাই জলপ্রপাতে পৌছানো যায়।কেওক্রাডং থেকে নীচে নামতে হয় যাওয়ার সময়।ফেরার সময় ওপরে উঠতে ঘন্টাদুয়েক সময় লাগে। তবে নীচে নামাটাই বেশি বিপজ্জনক। শেষের কিছু অংশ বেশ পিচ্ছিল। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। যাওয়ার সময় জোঁকের কামড়ের ভয় আছে।আগে থেকে সাবধানতা নেবেন।সঙ্গে অবশ্যই গাইড নিতে হবে।
থাকাঃ- কেওক্রাডাং এর পাশে কিছু ঘর তুলে হোটেলের মত থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে।
তথ্যঃ ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম’ ফেসবুক গ্রুপের বন্ধুদের সৌজন্যে
ভ্রমণকাহিনি - কুয়াশাঘেরা হ্রদ-পাহাড়ের উপকথা
কক্সবাজার(Cox’s bazar Beach)- বর্মার রাজা হদোফয়োরের অত্যাচার আর দুর্ভিক্ষের তাড়নায় প্রায় তিরিশ হাজার আরাকানবাসী ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অংশে আশ্রয় নেন। ব্রিটিশ অধিকৃত এই অঞ্চলের দেখাশোনার ভার পড়ে কক্স নামে এক ইংরেজ যুবকের উপর। তার থেকেই নাম কক্সবাজার। চট্টগ্রাম থেকে ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে দীর্ঘ সোনালি সৈকত, ক্লিফ, রঙবেরঙের প্যাগোডা, বৌদ্ধ মন্দির নিয়ে বাংলাদেশে ট্যুরিস্ট আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কক্সবাজার। শহর থেকে প্রায় ১কিমি দূরে সমুদ্র। সমুদ্রের ধার পর্যন্ত গাড়ি চলে যায়। শহরের মধ্যেই একটি বৌদ্ধমন্দির ও একটি কালীমন্দির আছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এই কক্সবাজার ১২০কিমি দীর্ঘ। ৩২কিমি দক্ষিণে সমুদ্রের কোলঘেঁষা মনোরম পিকনিক স্পট হিমচরি(Himchari)তে রয়েছে বিখ্যাত ব্রোকেন হিল আর জলপ্রপাত। ১৬কিমি দূরে বৌদ্ধ গ্রাম রামু(Ramu)। এখানকার মনাস্ট্রিটি ভারি সুন্দর। কক্সবাজার থেকে আধঘন্টার দূরত্বে অপরূপ নির্জন সৈকত ইনানি(Inani)। কক্সবাজারের আরেক আকর্ষণ শঙ্খের বাজার, আদিবাসীদের হস্তশিল্প আর চিংড়ির চাষ। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা দেখতে যেতে পারেন কক্সবাজার। সাধারণত অক্টোবর মাসেই প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপিত হয়।
ভ্রমণ কাহিনি - প্রবারণা পূর্ণিমার রাতে
মহেশখালি(Maheshkhali) - কক্সবাজার থেকে মাত্র ১২কিমি দূরে কাছেই জঙ্গল-পাহাড়, আদিনাথের মন্দির আর বৌদ্ধ প্যাগোডা নিয়ে মনোরম দ্বীপ মহেশখালি। ৬৯টি সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের মাথায় শিবমন্দির। পাশেই অষ্টভুজার মন্দির। ফাল্গুনমাসে বিরাট করে শিবরাত্রির মেলা বসে।
সোনাদিয়া দ্বীপ (Sonadia Island)-কক্সবাজার থেকে ৭কিমি দূরে বালুকাময় দ্বীপ সোনাদিয়া। বেলাভূমিতে ছড়িয়ে থাকে শাঁখ-ঝিনুক। শীতকালে মাছের আশায় এখানে ডেরা বাঁধেন মৎসজীবীরা। পর্তুগিজ দস্যুদের হাত থেকে সোনাবোঝাই জাহাজ বাঁচাতে প্রবল লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত ডুবে যায় জাহাজটাই। জাহাজের ওপর পলি আর প্রবাল জমে দ্বীপের সৃষ্টি এমনই বিশ্বাস স্থানীয় মানুষের। তাই নাম সোনাদিয়া।
টেকনাফ (Teknaf)- কক্সবাজার থেকে ৮৫কিলোমিটার দূরে বর্মা সীমান্তে টেকনাফ। একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে নাফনদী। নাফ বর্মা ও বাংলাদেশকে আলাদা করেছে। এখানকার দৃশ্য ভারি সুন্দর। বালুকাবেলার গা ঘেঁষে উঠে গেছে সবুজ পাহাড়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ(St. Martin Island) - টেকনাফ থেকে রোজই ফেরি যাচ্ছে নারকেলে ছাওয়া ছোট্ট কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। স্থানীয় নাম নারিকেল জিনজিরা। শান্ত -মনোরম দ্বীপ। অক্টোবর-এপ্রিল মাসে এখানের হোলসেল বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসেন আশেপাশের অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা। ঢাকা থেকেই হোটেল বুকিং করে নেওয়া ভালো হবে। এখানে একটা রাত কাটানো এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে তা যদি হয় পূর্ণিমা। সেন্ট মার্টিনে থেকে ঘুরে নেওয়া যায় লাগোয়া চিড়া-দ্বীপ। ভাঁটার সময় হেঁটেই এক দ্বীপ থেকে অন্যদ্বীপে যাওয়া যায়। জোয়ারে আলাদা হয়ে যায় দ্বীপদুটি।
কুয়াকাটা (Kuakata) -বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তের জনপ্রিয় সৈকত কুয়াকাটা বা সাগরকন্যা পটুয়াখালি জেলায়। স্থানীয় রাখাইন আদিবাসীরা যখন এখানে বসতি স্থাপন করেন সেই সময় জলের খোঁজে সমুদ্র সৈকতে কুয়ো কাটেন। সেই থেকে কুয়াকাটা নামের উৎপত্তি। দীর্ঘ শান্ত সৈকতে অপরূপ সূর্যোদয় – সূর্যাস্ত। নারকেলে ছাওয়া সৈকতে শীতের দিনে ভিড় জমায় পরিযায়ী পাখির দল। সৈকতের কাছে প্রায় একশো বছরের প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির আছে। রাসপূর্ণিমা ও মাঘি পূর্ণিমায় এখানে বিরাট মেলা বসে।
সিলেট [Sylhet]- উত্তরে খাসিয়া আর জয়ন্তিয়া পাহাড় আর দক্ষিণে ত্রিপুরা পাহাড়ের মাঝে সুর্মা ও খুশিয়ারা নদীপুষ্ট সবুজ উপত্যকা সিলেট। মাইলের পর মাইল চা বাগিচা আর ট্রপিকাল অরণ্যে ঢাকা সিলেটের বাসিন্দা মণিপুরি আদিবাসীরা। সিলেটের ইতিহাসও তার প্রকৃতির মতই সমৃদ্ধ। মুসলিম শাসনের আগে স্থানীয় চিফটেনদের অধিকারে ছিল এই ভূমি। ১৩০৩ সালে, দিল্লি থেকে পির হজরত শাহ জালাল ও তাঁর অনুগামীরা এসে রাজা গৌরগোবিন্দকে পরাজিত করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮ শতকে ব্রিটিশরা দখল করে গড়ে তোলে চা বাগান। আজও বাংলাদেশের চায়ের ঠিকানা সিলেট। শ্রীমঙ্গল-কে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে রয়েছে চা বাগিচাগুলি।
ঢাকা থেকে ঘন্টাসাতেকের বাসজার্নিতে সিলেট চলে আসা যায়। পথে অনেকগুলো নদী পেরোতে হবে। সিলেটের প্রবেশদ্বার তেলিয়াপাড়া (Teliapara)-তে চোখ জুড়াবে চাবাগানের সবুজ। এখানে বিখ্যাত পির জালালের মাজার (Cemetery of Pir Jalal)। বিশাল এলাকা নিয়ে মাজার। মূল মাজারে মহিলাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। প্রচলিত ধারণা, পীর জালাল রাজা গৌরগোবিন্দ ও তাঁর ডাকিনী বিদ্যা পারদর্শী সঙ্গীদের বোয়ালমাছে রূপান্তরিত করেন। যারা এখনো লাগোয়া পুকুরটিতে বেঁচে রয়েছে।
সিলেট শহর থেকে আড়াই ঘন্টার বাসপথে ছবির মত সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি জনপদ জাফলং(Jaflong)। ছোট ছোট টিলা পেরিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে পথ গিয়েছে। জাফলংয়ের গায়েই বল্লানদী। ওপারে ভারতের মেঘালয়।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থান: হযরত শাহজালাল(রাঃ) ও হযরত শাহ পরাণ(রাঃ) এর মাজার শরীফ [Majar/ Tomb of Hazrat Shahjalal (R) & Hazrat Shahporan (R)], জৈন্তাপুর রাজবাড়ি [Palace of Jaintapur], মাধব কুণ্ড ও পরীকুণ্ড জলপ্রপাত [Madhabkund and Porikund Waterfalls], শ্রীমঙ্গল (চা বাগান, লাওয়াছড়া বন,মাধব পুর লেক)[Srimangal Tea estate & Lawachara National Park], তামাবিল [Tamabil], হাকালুকি হাওড় [Hakaluki Haor/Wetlands], মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেবের বাড়ি [Sri Chaitanya Dev's House], হাছন রাজা যাদুঘর [Museum of Hason Raja], মণিপুরি রাজবাড়ি ও মিউজিয়াম [Manipuri Palace & Museum ], হামহাম জলপ্রপাত [Hamham waterfalls], সাতছড়ি অভয়ারণ্য [Satchari Sanctuary], রেমা উদ্যান [Rema Garden], এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং [Baniachang, largest village of Asia], বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর বাড়ি [Shah Abdul Karim's house], বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র [Bangladesh Tea Research Institute]।
যাওয়াঃ ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন তিনটা ট্রেন আছে সিলেটের উদ্দেশ্যে। ট্রেনে গেলে উপবন এক্সপ্রেসে যাওয়াটাই সব থেকে ভালো।বাসে যেতে চাইলে শ্যামলি,হানিফ,সোহাগ,ইউনিক,গ্রীন লাইন উল্লেখ যোগ্য। ভোর থেকে শুরু করে রাত ১২.৩০ টা পর্যন্ত এসব বাস পাওয়া যায়।
থাকাঃ সিলেটে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল, মোটেল, কটেজ। ফাইভস্টার হোটেল রোজভিউ ছাড়াও রয়েছে হোটেল ডালাস, ফরচুন গার্ডেন, পর্যটন মোটেল সিলেট, হোটেল অনুরাগ, হোটেল সুপ্রিম, হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া সিলেটে প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী নানা মানের হোটেল পাবেন। কয়েকটি পরিচিত হোটেল হল হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেইট, সুরমা, কায়কোবাদ।
হাকালুকি হাওর [Hakaluki Haor/Wetlands] - হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর।এর আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর। এটি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্হিত। মৌলভীবাজারের বড়লেখা,জুরী,কুলাউড়া এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ,গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় এর বিস্তৃতি। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায় হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতি বছরই আকষ্মিক বন্যা হয়।শীতকালে এই হাওড়কে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে উঠে গোটা এলাকা।
বর্ষাকালে আদিগন্তু বিস্তৃত জলরাশি নিয়ে হাওরের রূপ ঠিক যেন এক সাগর। জলের মাঝে মাঝে দুই-একটি বর্ষীয়ান হিজল,তমাল বৃক্ষ। অথচ শীতকালে বিস্তৃত এই হাওর ধু-ধু সবুজপ্রান্তর, কোথাওবা ধান ক্ষেত এবং খানাখন্দ। নীচু ভূমিতে প্রায় ২৩৮টি বিলের সমষ্টি। বাংলাদেশের সংরক্ষিত জলাভূমি হাকালুকি হাওর মাছের জন্য প্রসিদ্ধ। শীত মৌসুমে এশিয়ার উত্তরাংশের সাইবেরিয়া থেকে প্রায় ২৫ প্রজাতির হাঁস এবং জলচর নানা পাখি পরিযায়ী হয়ে আসে। এছাড়া সারাবছর এখানে স্থানীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে।
হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। বিলগুলিতে প্রায় সারাবছর পানি থাকে। হাওরের জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী ও পানাই নদী। এই বিলগুলি মৎস্য সম্পদের আধার। বছরে প্রায় ২৫০০টন মাছ উৎপাদন হয়। তবে যথেচ্ছভাবে মাছ ধরার কারণে দেশী জাতের রানী, তুরাল, রাঁচি, বাতাসি, গলদাচিংড়ি, বাঘমাছ, চিতল ইত্যাদি মাছ আর এখন হাওরে পাওয়া যায় না।
হাওরে শীতকালে আসা অতিথি পাখির মধ্যে ভূতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, বালি হাঁস, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, রাজ সরালি, পান ভুলানি, কাস্তেচড়া, পানকৌড়ি. বেগুনী কালিম, মেটেমাথা টিটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে বিদেশী আর্থিক সহায়তায় সরকারের CWBMP প্রজেক্ট হাওর এলাকায় চলমান রয়েছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করে জীবকূলকে রক্ষার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।
যাওয়াঃ কুলাউড়ায় অবস্হিত CWBMP এর অফিসে যোগাযোগ করে হাওরে যেতে পারেন।ঢাকা থেকে ট্রেনে অথবা বাসে কুলাউড়া শহর। সেখান থেকে রিকশা যোগে পছন্দমতো বিলের নিকটমতো গ্রাম। অতঃপর ট্রেকিং। এছাড়া বড়লেখা থেকে কানুনগো বাজার হয়েও ঘুরে আসতে পারেন এই হাওর।
থাকাঃ হাওর এলাকায় বিল ইজারাদারদের দোচালা কুটিরগুলোয় দু‘চারজন পর্যটক থাকার জন্য চমৎকার। তবে অবশ্যই বিল মালিকের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। সবচেয়ে ভালো হয় বিল এলাকায় তাঁবু ফেলে রাত্রি যাপন। জোৎস্না রাতে তাঁবুতে যাপন, পাখি পর্যবেক্ষণ যে কোনও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটককে বিমোহিত করবে।
টাঙ্গুয়া হাওর, সুনামগঞ্জ [Tanguar Haor/Wetlands, Sunamganj] - নীল আকাশ যেখানে পানির সঙ্গে খেলা করে, সাদা মেঘ যেখানে পাহাড়ের কোলে ঘুমায়, গাছের সারি যেখানে প্রতিনিয়ত সবুজ পানির আরসিতে মুখ দেখে, আর পানির নীচে যেন রঙিন বনের বসতি। কল্পনা নয় - সেই জায়গাটার নামই টাঙ্গুয়া হাওর।
টাঙ্গুয়া হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। স্থানীয় লোকজনের কাছে হাওরটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝোরা এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। একসময় গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিলো এই হাওর। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তখনই অবসান হয় দীর্ঘ ৬০ বছরের ইজারাদারির। ২০০০ সালে ২০ জানুয়ারি এই হাওরকে 'রামসার স্থান' (Ramsar site) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান, প্রথমটি সুন্দরবন।
ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক আসে এই হাওড়ে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ।
হিজল করচের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়। এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলেঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী হিজল, করচ, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলশী, নলখাগরা, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদি সহ দু’শ প্রজাতিরও বেশী গাছগাছালী রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। এছাড়াও ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির সাপ, বিরল প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটিসহ নানাবিধ প্রাণীর বাস, এই হাওরের জীববৈচিত্র্যকে করেছে ভরপুর। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এই হাওরের বিখ্যাত মাছের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করা যায় মহাশোলের কথা। মাছটির দুটো প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Tortor এবং Torputitora, টাঙ্গুয়ার হাওরে দুই প্রজাতিই পাওয়া যেতো।
জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বর্তমানে এ হাওরে রয়েছে ছোট বড় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। নলখাগড়া বন বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।
সুনামগঞ্জের সাহেববাজার ঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকা চারপাশের চৌহদ্দি ছাড়ানো সবুজ দেখে আপনি ভুল করে ভেবে বসতে পারেন যে নিউজিল্যান্ডের কোথাও আছেন। সুরমা নদীর ওপারেই মেঘালয়ের পাহাড় মেঘ কোলে নিয়ে অতিথির জন্য বসে আছে। চোখের সামনে ঠিক যেন নিউজিল্যান্ডের ডেইরি ফার্মের গরুগুলো ঘাস খাচ্ছে। তাদের পেছনে বাঁক খেয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের দেয়াল। যত দূর চোখ যায়, সবুজের মখমল। নিচে নীলচে পানি, পানির নিচে শেওলার অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। নলখাগড়ার ডগা ভেসে ভেসে ঢেউয়ের দোলায় নাচছে হাওর জুড়ে। যাওয়ার পথে আনোয়ারপুর গ্রামে পাথরের স্তূপ। এখানে পাথর ভাঙা হয়, হলদে বালির বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাথরগুলো রোদ পোহাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে, ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছে পানির। নীল থেকে কালো, কালো থেকে সবুজ, আবার গাঢ় নীল। এভাবে প্রায় ছয় ঘন্টা পর টাঙ্গুয়া হাওরে পৌঁছান যায়।
বর্ষা মৌসুমে গোটা টাঙ্গুয়াই পরিণত হয় ২০-২৫ ফুট জলের এক স্বচ্ছ অ্যাকুরিয়ামে। পানি এতই পরিষ্কার যে ২০ ফুট নিচের ঘাস, গাছ, লতাগুলো মনে হয় অ্যাকুরিয়ামে সাজানো। অচেনা এক পৃথিবী মনে হয় যখন দেখি কোনো রকম ভেলা বা জাহাজ ছাড়াই থইথই পানিতে ভাসছে ছোট ছোট গ্রাম। পুরো হাওর গাছের সীমানা দিয়ে ঘেরা। সেই গাছও মাথাটুকু বাদে ডুবে আছে নীলের সমুদ্রে। এখানে বাতাস কখনো ক্লান্ত হয় না, এখানে আকাশের নিচে সাদা মেঘের বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে কচি পাহাড়, আর সেই পাহাড়ের কোলে নাচে উদ্দাম, উত্তাল, দুরন্ত সবুজ জ্যাকেট পরা নীল পানি, হাওরের পানি।
যাওয়াঃ ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ শ্যামলী/ইউনিক পরিবহনে ৪০০-৪৫০ টাকা মত ভাড়া নেবে। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায়। সেখান থেকে টাঙ্গুয়া হাওরের উদ্দেশ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করবেন, প্রতিদিনের জন্য ভাড়া নেবে তিন হাজার টাকা। হাওরে যেতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। দু-তিন দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করলে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে নেবেন। হাওর ঘুরে রাতটা তাহিরপুর থানার ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন। ৩ কিঃমিঃ উত্তর-পূর্বে টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্পের রেস্ট হাউজে অবস্থান করা যায়।
তাহিরপুরে রাতে থেকে পরদিন ট্যাকেরহাট, বারিক্কাটিলাসহ জাদুকাটা নদী ঘুরে সুনামগঞ্জ চলে আসতে পারেন। সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে বেলা আড়াইটায় একটা, এরপর রাত ১০ টায় আরেকটা গাড়ি ছাড়ে। এটা বর্ষাকালে যাওয়ার রাস্তা। শীতকালে নৌকা চলবে না, সে ক্ষেত্রে আপনাকে সুরমা নদী পার হয়ে মণিপুরীঘাট থেকে ২ ঘন্টায় শ্রীপুর বাজার/ডাম্পের বাজার যেতে হয়। ভাড়া ২৫০ টাকা মত। সেখান থেকে ভাড়াটে নৌকায় টাঙ্গুয়া ঘুরে আসা যায়। সেক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ ব্যয় হতে পারে ৪০০-৫০০ টাকা।
রামসার কনভেনশন (Ramsar Convention) হলো বিশ্বব্যাপী জৈবপরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ইরানের রামসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশসমূহ কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস নামক একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পরবর্তিতে এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ মোট ১৫৮টি দেশ স্বাক্ষর করে এবং পৃথিবীর ১৬৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ১,৮২৮টি স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
মাধবপুর লেক (Madhabpur Lake) - সুনীল আকাশ, ঘাঢ় সবুজ পাহাড়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত মনোরম চা বাগানের দৃশ্যে হারিয়ে যান আপন মনে। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত লেকটি সত্যি অপূর্ব। লেকের ঝলমল পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলে। আস্তে আস্তে যতই সামনের দিকে এগুতে থাকবেন ততই ভাল লাগবে। মাঝে মাঝে বানর ও হনুমানের লাফালাফির দৃশ্যও চোখে পড়ে। মাধবপুর লেকে গিয়ে পৌঁছতেই সবুজ পাতার গন্ধ যে কারো মনকে চাঙ্গা করে তুলবে। চারদিকে সবুজ পাহাড়। পাশাপাশি উঁচু উঁচু টিলা। সমতল চা বাগানে গাছের সারি। হয়তো এরই মাঝে একঝাঁক পাখি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাবে তাদের সুরের মুর্চ্ছনা দিয়ে। পাহাড়ী পাখির গান আর নৃত্য ছাড়াও দেখা যায় নানান প্রজাতির বন্যপ্রাণী। মাধবপুর লেক যেন প্রকৃতির নিজ হাতে অঙ্কিত মায়াবী নৈসর্গিক দৃশ্য। সুনীল আকাশ আর গাঢ় সবুজ পাহাড়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মত চা বাগানের এই মনোরম দৃশ্য আকর্ষন করে নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে।
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে পাত্রখোলা চা বাগানে লেকটির অবস্থান। এটি মৌলভীবাজার শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে ও শ্রীমঙ্গল থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। খানাখন্দে ভরা চা বাগানের রাস্তা দিয়ে এই লেকে যেতে হয়। মাধবপুর লেকের ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ। টিলার পাঁজর ঘেঁষে টলটলে পানিতে ভেসে থাকা নীলপদ্ম আর শাপলা-শালুকের মাঝে নানা জাতের হাঁস, সরালি, পানকৌড়ি, জলপিপির খেলা মনকে মুগ্ধ করে। শীতকালে অতিথি পাখির দল আসে এই হ্রদে। দশটি বাঁক নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ের ভেতর তার চলা। চারদিকে সবুজ পাহাড়। হ্রদের দুই পাশে টিলায় টিলায় ছড়ানো চায়ের গাছ। ছায়াবৃক্ষ। আরও আছে অচেনা ঝোপঝাড়। সেই ঝোপঝাড়ে ফুটে আছে নানা জাতের সাদা, কালচে, গোলাপি রঙের মায়া লাগা বুনো ফুল। ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে ভাঁট ফুলের।পাহাড়ি গাছের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসে সূর্যকিরণ।
চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা-বাগানের টিলার নিচে লেকের পাড় ঘেঁষে হাঁটার জন্য সরু পথ করে দিয়েছে। টিলার ওপর আছে খড়ের তৈরি তাঁবু। আর টিলার ওপর থেকে যেদিকেই চোখ যায় বনের নীল রেখা। মাধবপুর লেকে একসঙ্গে জল, পাহাড়, চা-বাগান—একটা বুনো নির্জনতা আছে। তবে সন্ধ্যা ছয়টার আগেই সেই জায়গাটি থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সেটাই মাধবপুর চা-বাগান কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধের দূরত্ব মাধবপুর হ্রদ থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটারের মতো। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং দেখতেও চমৎকার জায়গাটি এক ফাঁকে ঘুরে আসা যায়।
যাওয়াঃ মাধবপুর হ্রদে যেতে হলে ট্রেন বা বাসে করে শ্রীমঙ্গল অথবা কমলগঞ্জে আসতে হবে। প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের পথে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রা করে। পারাবত এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৬ টায়, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস দুপুর ২টায় এবং উপবন রাত সাড়ে ১০টায়। বাসে যেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। রয়েছে শ্যামলী পরিবহন (এসি, নন-এসি), সিটিলিংক, হানিফ, মৌলভীবাজার সিটি (এসি, নন-এসি), তাজ, মিতালী (এসি নন এসি) বাস। তারপর কমলগঞ্জের ভানুগাছ চৌমোহনা থেকে মাধবপুর হ্রদ। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা বাসে করে সেখানে যাওয়া যায়।
থাকাঃ কোলাহল মুক্ত পরিবেশে থাকতে চাইলে উঠতে পারেন চা বাগানের ভিতর বি টি আর আই রেস্ট হাউস অথবা টি রিসর্ট-এ। এছাড়া মনোরম পরিবেশে একটু আয়েসে থাকার জন্য রয়েছে “ভ্যাকেশন রিসর্ট, হবিগঞ্জ মেইন রোডেই রয়েছে এই সুন্দর রিসর্টটি। রিসর্টে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে আপনার কাঙ্খিত ট্যুরের সকল ধরনের সহযোগীতা পাবেন। (মোবাইলঃ ০১৭৫৯৫৯৯৭১৭) এ ছাড়া শ্রীমঙ্গল শহর ও শহরতলীতে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো রেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল। শ্রীমঙ্গলের সব দর্শনীয় স্থান দেখতে হলে আপনাকে কমপক্ষে ৩/৪ দিন সময় নিয়ে আসতে হবে। শহরে খাওয়া দাওয়ার জন্য প্রচুর হোটেল রয়েছে।
মাধবকুণ্ড [Madhabkund Waterfalls]- মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের অন্তর্গত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলিতে অবস্থিত। পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে অন্যতম বিখ্যাত এই স্থানটিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউস ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকাটিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে "মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক"। মাধবকুন্ড ইকোপার্ক, নয়নাভিরাম দৃশ্য ও নান্দনিক পিকনিক স্পট হিসাবে দেশী বিদেশী পর্যটকদের সুপরিচিত। সুবিশাল পর্বত, শ্যামল সবুজ বনরাজি বেষ্টিত ইকোপার্কে প্রবীণ, নবীন, নারী-পুরুষদের উচ্ছাস অট্টহাসি আর পাহাড়ী ঝরনার প্রবাহিত জলরাশির কল কল শব্দ স্বর্গীয় আমেজের সৃষ্টি করে।
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী থানা বড়লেখার ৮ নম্বর দক্ষিণভাগ ইউনিয়নের অধীন গৌরনগর মৌজার অন্তর্গত পাথারিয়া পাহাড়ের গায়ে এই জলপ্রপাতের স্রোতধারা বহমান।সিলেট সদর থেকে ৭২ কিলোমিটার, মৌলভীবাজার জেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে ৩২ কিলোমিটার এবং কাঁঠালতলী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে পাথারিয়া পাহাড় অবস্থিত।
পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত। এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত হয়ে প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নীচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে। মাধবকুণ্ডটি প্রায় ২৫ ফুট গভীর। পানিতে নামা নিষেধ।
কুণ্ডের ডানপাশে পাথরের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে একটি গুহার। মাধবকুণ্ডে এলে গুহার ভেতর প্রবেশ করে নতুন আমেজ পাওয়া যায়। বৃষ্টির মৌসুমেও শতাধিক দর্শনার্থী গুহায় আশ্রয় নিতে পারেন। স্থানীয় ভাষায় গুহাকে ‘কাব’ বলা হয়ে থাকে। পাহাড়ের গভীরে তৈরী গুহাকে মনে হবে আধুনিক কারুখোচিত পাথরের একচালা ঘর। গুহাটির সৃষ্টি প্রাকৃতিক ভাবে হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করলেও মুলত এটি ছিল সন্ন্যাসী মাধবেশ্বরের ধ্যানের জায়গা। এটি কিভাবে, কারা তৈরী করেছিল তার সঠিক তথ্য আজও রহস্যাবৃত।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত এলাকায় এককালে কমলা বাগান ছিলো; ছিলো আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, সুপারি ও পানের বাগান। এখানে ফলতো লেবুসহ অন্যান্য ফলমূল। এছাড়া ছিলো বিভিন্ন প্রকার বনজ গাছপালা। কিন্তু বর্তমানে এর অধিকাংশই অতীত। "সামাজিক বনায়ন"-প্রকল্পে প্রাকৃতিক গাছপালা কেটে ফেলে রোপন করা হয়েছে বিভিন্ন হাইব্রিডজাতীয় গাছপালা, যেমন: একাশিয়া (স্থানীয় নাম আকাশি)। ঔষধি ও অর্থকরি গাছ আগরও আছে রোপন তালিকায়। মাধবকুণ্ড এলাকায় বাস করে আদিবাসী খাসিয়ারা। খাসিয়ারা গাছে গাছে পান চাষ করে থাকে। মাধবছড়াকে ঘিরে খাসিয়াদের জীবনযাত্রা আবর্তিত হয়। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে এলে চোখে পড়বে উচু নীচু পাহাড়ী টিলায় দিগন্ত জোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পান পুঞ্জি ও জুম চাষ।আর তাদের সনাতনী বাড়ি ঘর।
মাধবকুণ্ড অতীত থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থ স্থান হিসাবে পরিচিত। ভগবান মাধবেশ্বরের আশির্বাদ নিতে হাজার হাজার মানুষ আসেন প্রতি বছরের চৈত্র মাসে। এ সময় মধুকৃষনা ত্রয়োদশীতে পুণ্যার্জন ও বারুনী স্নান করে পাপ মুক্তির কামনা করেন। মাধবের মন্দির ছাড়াও রয়েছে শিব মন্দির। বিশালাকার শিবলিঙ্গ পুজা করাও হয়ে থাকে। চৈত্রমাসের ওই সময়ে বিশাল মেলা বসে।
যাওয়াঃ দেশের যে কোন জায়গা থেকে সড়ক পথে সরাসরি বাসে আসা যায়। তাছাড়া রেলপথেও সুবিধা আছে। ট্রেনে গেলে থেকে প্রথমে কুলাউড়া হয়ে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার কাঠালতলীতে যেতে হবে। সেখান থেকে রিক্সা, অটো রিক্সায় বা স্কুটারে মাধবকুণ্ড যেতে হবে। বড়লেখা থেকে রিক্সা ভাড়া ৭০-৮০ টাকা, স্কুটার ভাড়া জনপ্রতি ৬০-৭০ টাকা। অথবা আপনি মাইক্রোবাস বা সিএনজি তে সরাসরি যেতে পারেন।
থাকাঃ পর্যটন কর্পোরেশনের ডাক বাংলো আছে ।
ভ্রমণ কাহিনি - প্রকৃতির কাছাকাছি
পরীকুণ্ড জলপ্রপাত [Porikundo waterfalls] - মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের খুব কাছেই লুকিয়ে আছে আর এক বিস্ময় -একটি বুনো ঝরনা - পরীকুণ্ড জলপ্রপাত।
সবুজে আবৃত আর পাহাড়ে ঘেরা এই জলপ্রপাতটি সিলেট বিভাগের মৌলবিবাজার জেলায় অবস্থিত। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে মাত্র ১০-১৫ মিনিট হাঁটা পথ। পেয়ে যাবেন নীরবে নিভৃতে ঝরে পরা এই দৃষ্টিনন্দন ঝরনাটি। তেমন কোন পর্যটক এখানে যায় না বলে ঝরনা এলাকাটি শান্ত থাকে সারা বছর। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে ঝরনার চারিপাশ, যেন সবুজের মেলা বসেছে এখানে। আর ঝরনার শব্দ আর পাখির কলতানই এখানে কেবল এখানে নিস্তব্ধতার ঘুম ভাঙ্গায়। প্রায় ১৫০ ফুট উচু হতে পাথরের খাড়া পাহাড় বেয়ে শোঁ শোঁ শব্দ করে জলধারা নীচে আছড়ে পড়ছে। তলায় বিছানো পাথরের আঘাতে পানির জলকনা বাতাসে উড়ে উড়ে তৈরি করছে কুয়াশা।
মাধবকুণ্ড ঝর্নার ঠিক আগে বাঁ হাতে একটি শিব মন্দির রেয়েছে। এর বিপরীত দিকে একটি রাস্তার পাশে নতুন একটি সিড়ি হয়েছে। ঐ সিড়ি ধরে নেমে গেলে মাধবকুণ্ড ঝরনা থেকে বয়ে আসা পানির ছড়া। আর ওই ছড়াটির সোজাসুজি পাথর বিছানো ছড়া দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই পরীকুণ্ড জলপ্রপাত। পথ চিনতে কষ্ট হলে স্থানীয় লোকজন কিংবা পর্যটন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে আপনাকে যাবার পথ বলে দিবে।
মাধবকুণ্ড থেকে পরীকুণ্ড আসার পথটা একটু পাথুরে ও জলময়। তবে ভয়ের কিছু নেই, কেবল পায়ের পাতাই ভিজবে। আপনাকে হাঁটতে হবে ছড়া বরাবর। পুরোটা ছড়া পাথর বিছানো। পাথরগুলো সবসময় ভিজে থাকে বলে বেশ পিচ্ছিল। তাই সাবধানে হাটতে হবে। যাঁরা মাধবকুণ্ড বেড়াতে যেতে চান তাদের জন্য এটি একটি বাড়তি পাওনা।
বিঃ দ্রঃ শীতকালে জলপ্রপাতে পানি কম থাকে। এজন্য বর্ষায় মাধবকুণ্ড ও পরীকুণ্ডে যাওয়াই ভাল।
হামহাম জলপ্রপাত [Hamham waterfalls] -সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ী এলাকার রযেছে অপূর্ব এই জলপ্রপাত। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটক যারা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন কেবল তাদের জন্যই এই ঝরনা দর্শন।
কেবলমাত্র দৃষ্টিনন্দন ঝরনাই নয় পথের দুপাশের বুনো গাছের সজ্জা দৃষ্টি কেড়ে নেবে অনায়াসে। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন একরূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব আপনার মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে আপনার দু’চোখের সামনে ভেসে উঠবে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে উঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হবে যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্খিত হামহাম জলপ্রপাতের খুব কাছাকাছি।
কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। কাছে গিয়ে দেখতে পাবেন প্রায় ১৬০ ফিট ওপর হতে আসা জলপ্রপাতের সেই অপূর্ব দৃশ্য । প্রবল ধারায় উপর হতে গড়িয়ে পরছে ঝরনার পানি নিচে থাকা পাথরের উপর। পাথরের আঘাতে জলকনা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশা। চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেঁয়ে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে, গুঁড়ি গুঁড়ি জলকনা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের দেড়শ ফুট উপর হতে গড়িয়ে পড়া স্রোতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতীর লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ী শরীর। স্রোতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভুমিতে। তৈরি করছে স্রোতস্বিনী জলধারা। সে যে কি এক বুনোপরিবেশ না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়।
যাওয়াঃ প্রথমেই আপনাকে যেকোন স্থান হতে গিয়ে পৌছতে হবে শ্রীমঙ্গল কিংবা সরাসরি মৌলভীবাজার। সেখান হতে কমলগঞ্জ। ট্রেনে করে আপনি যেতে পারেন শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে জিপ রিজার্ভ করে কলাবনপাড়া। ভাড়া পড়বে ২০০০-২৫০০ টাকা। মৌলভীবাজার হয়ে যেতে চাইলে প্রথমেই যেতে হবে কমলগঞ্জ। এটি মৌলভীবাজারের একটি উপজেলা। কমলগঞ্জ হতে আদমপুর বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া পড়বে ১০-১৫ টাকা। সেখান থেকে ২০০-২৫০ টাকা ভাড়ায় সিএনজি যোগে আপনি অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারেন আদিবাসী বস্তি তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন বস্তি পর্যন্ত । সেখান থেকে আরও প্রায় ৮ কিঃমিঃ পথ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে কাংখিত সেই হামহাম জলপ্রপাতের। যেভাবেই যান না কেন গহীন অরন্যে প্রবেশের পূর্বে তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন বস্তির আদিবাসীদের সাহায্য নিয়ে আপনাকে ট্রেকিং করতে নামতে হবে। প্রায় ৮ কিমি. দুর্গম পাহাড়ের গায়ে হামহাম জলপ্রপাতে আপনি যেতে পারেন ঝিরি পথে অথবা টিলা পথে। ঝিরি পথ মুগ্ধ করবে আপনাকে। তবে ঝিরি পথে সময় কিছু বেশি লাগতে পারে। টিলা পথে হামহাম যেতে সময় লাগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টা। ঝিরি পথে ফিরে আসতে সময় লাগবে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘন্টা।
উচু নিচু পাহাড় আর টিলা, বুনো জঙ্গল, পাথুরে আর কদর্মাক্ত পথ, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান ঝিরিপানি। শুধু তাই নয় এই দুর্গম পথে রয়েছে বন্য মশা মাছি এবং রক্তচোষা জোঁকের ভয়ানক উৎপাতও। হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন গাইড নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ প্রথমবার যাঁরা যাবেন তাঁরা রাস্তা ভুল করতে পারেন। কলাবন গিয়ে একজন গাইড সাথে নিয়ে নিবেন। তাকে ৩০০-৪০০ টাকা দিতে হবে। ট্রেকিং করার সময় হাতে একটি বাঁশ বা লাঠি নিয়ে নিবেন। এটি আপনার ভারসাম্য রক্ষা করতে, হাটত এবং সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতে নিরাপদ রাখবে। সাথে সরিষার তেল আর লবণ নিয়ে নিবেন। জোঁকে ধরলে লবণ দিয়ে ফেলে দিবেন। দুপুরে খাবার জন্য হালকা শুকনা খাবার নিয়ে যাবেন। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ডেটল,তুলা এগুলো নিয়ে নিতে পারেন। থ্রি কোয়াটার্র টাইপের প্যান্ট আর টিশার্ট পরে যাবেন জুতা হিসেবে কেডসের তুলনায় প্লাস্টিকের স্যান্ডেল বেশ কাজে দেয়। বর্ষাকালে ঝরনার প্রকৃতরূপটা দেখা যায়। তবে সেক্ষেত্রে যাবার রাস্তায় কষ্টও বেশী হবে। শীতকালে রাস্তায় তেমন পানি থাকেনা বলে যাওয়াটা একটু সহজ। কিন্তু শীতে অধিকাংশ ঝরনাতেই একদম পানি থাকে না। সেটা দেখাও খুব একটা সুখকর নয়। সুতরাং কষ্ট হলেও বর্ষাকালেই যাওয়া উচিত।
হামহাম ঝরনাস্থলে পৌছে খুব বেশীক্ষণ উপভোগ করার উপায় নেই। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে পাহাড়ে ঘনকালো অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা শতভাগ। বন্যপ্রাণীদের আক্রমণেরও শিকার হতে পারেন। ঢালু ও পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে ওঠা কষ্ট হলেও সহজ, কিন্তু নিচে নেমে আসা খুবই বিপজ্জনক ও কঠিন। তাই ঝিরি পথে এসে সবাইকে কাছাকাছি থেকে খুবই সন্তর্পনে ট্রেকিং শুরু করতে হবে। প্রায় চারঘন্টা পর আপনি ফিরে আসবেন সেই কলাবনে। অতঃপর সেখানে আদিবাসী বস্তিতে রাত্রিযাপন নতুবা ঘরে ফেরার পালা।
থাকাঃ প্রথমে শ্রীমঙ্গলের কোন একটি হোটেল বা গেষ্ট হাউসে ওঠাটাই ভালো। এখানে রাত্রি যাপন করে সকালে চলে যেতে পারেন কলাবন পাড়ায়। সেখানে আপনি চাইলে তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন আদিবাসী বস্তিতে আস্তানা গাড়তে পারেন। অথবা আদিবাসীদের ঘরেও থাকতে পারেন। তারা এ ব্যপারে আপনাকে সহায়তা করবে। পর্যটকদের প্রতি তারা খুবই বন্ধুবৎসল। এখানে থাকার জন্য খুব একটা উন্নত ব্যবস্থা নেই। তবে থাকার জন্য একটা জায়গা পেয়ে যাবেন। ঝরনা দেখে ফেরার পর আপনি এতই ক্লান্ত থাকবেন যে ঐ মুহুর্তে আর শ্রীমঙ্গল ফিরতে ইচ্ছে করবে না কিংবা ফেরার হয়তো উপায়ও থাকবে না। সুতরাং কলাবন আদিবাসী বস্তিতে থাকাটাই সবচাইতে উত্তম হবে।
রেমা–কালেঙ্গা অভয়ারণ্য (Rema-Kalenga Wild Life Sanctuary) - বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খুব কাছে এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে এর দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। ১৯৮২ সালেএই অঞ্চল অভয়ারণ্যের স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে এই অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। হবিগঞ্জে জেলায় বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের তিনটি বিট: কালেঙ্গা, রেমা আর ছনবাড়ী নিয়ে এই অভয়ারণ্য গঠিত।
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বর্তমানে এই বনে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির জন্য এই বন সুপরিচিত এবং এদের মধ্যে রয়েছে — ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল প্রভৃতি।
এই বনে তিন প্রজাতির বানরের বাস, এগুলো হল: কুলু, রেসাস ও লজ্জাবতী বানর। তাছাড়া এখানে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখা যায়। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালয়ান বড় কাঠবিড়ালি একমাত্র এ বনেই পাওয়া যায়। আরও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বুনো শুয়োর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগা প্রভৃতি সহ এ বনে আঠারো প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়া যায়।
তবে নির্বিচারে গাছ চুরি ও বন ধ্বংসের কারণে এ বনভূমির অস্তিত্ব বর্তমানে প্রশ্নের মুখে।
ভ্রমণ কাহিনি - বনে বনে পথ চলা
জাফলং [Jaflong] - প্রকৃতি কন্যা হিসাবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি,উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও শুনশান নীরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করে। প্রকৃতি কন্যা ছাড়াও জাফলং বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের রাণী - এসব নামেও পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। ভ্রমণ পিয়াসীদের কাছে জাফলং এর আকর্ষণই যেন আলাদা। সিলেট ভ্রমণে এসে জাফলং না গেলে ভ্রমণই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।
সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মওসুমের সৌন্দর্যের রূপ ভিন্ন। বর্ষায় জাফলং এর রূপলাবণ্য যেন ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠে। ধূলিধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে শ্বাস-নি:শ্বাসে থাকে ফুরফুরে ভাব। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি পাহাড়ি পথ হয়ে উঠে বিপদ সংকুল -সে যেন এক ভিন্ন শিহরণ। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝরনাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়।
খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় (Khasi & Jaintia Hills) - ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। তারপরও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পতিত পড়ে রয়েছিল। ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌ পথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকায় গড়ে উঠে নতুন জনবসতিও। আশির দশকে সিলেটের সাথে জাফলং এর ৫৫ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পাশাপাশি প্রকৃতি প্রেমীরাও ভিড় করতে থাকেন জাফলংয়ে। জাফলং এখন দেশের সেরা পর্যটন স্পট। এছাড়া দেখার স্থানঃ জিরো পয়েন্ট, মারি নদী, চা বাগান, খাসীয়া পল্লী।
যাওয়াঃ সিলেট থেকে আপনি বাস/ মাইক্রোবাস/ সিএনজি চালিত অটোরিক্স্রায় যেতে পারেন জাফলং এ। সময় লাগবে ১ ঘন্টা হতে ১.৩০ ঘন্টা।
থাকাঃ থাকার তেমন বেশি সুব্যবস্থা জাফলং-এ নাই। তবে যে কয়টি ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে জেলা পরিষদের নলজুরী রেস্ট হাউস (থাকতে হলে পূর্বে অনুমতি নিতে হবে), শ্রীপুর পিকনিক স্পট উল্লেখযোগ্য। কিছু বোডিং এর ব্যবস্থা আছে। এছাড়া শ্রীপুর ফরেস্টে এর একটি বাংলো আছে পর্যটকদের থাকার জন্য। সিলেটে ফিরে গিয়েও থাকতে পারেন।
পানতুমাই – ছবির মত সুন্দর গ্রাম পানতুমাই – বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে। ঢাকা থেকে সিলেট গিয়ে আম্বরখানাপয়েন্ট থেকে সি এন জি ট্যাক্সি করে গোয়াইনঘাট-এ থানা সংলগ্ন বাজারে যাবেন । সেখান থেকে আবার ট্যাক্সিতে পানথুমাই গ্রাম। পানথুমাই-এ যেখানে পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেছে সেখানে নেমে এবার পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে হবে।
থাকা-খাওয়া - পানতুমাই কোন তথাকথিত পর্যটন স্থান নয়। তাই থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে। বাংলাদেশের অন্য সব জায়গার মতো এখানকার গ্রামবাসীরাও খুব অতিথিপরায়ণ।
মনে রাখবেন - বর্ডার সংলগ্ন এলাকায় কোন ঝুঁকি নেবেন না।
পর্যটন স্থান না হওয়াতে, পানতুমাইতে এখনও আপনি প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারবেন। একে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
ভ্রমণ কাহিনি – নিরালা গ্রাম পানতুমাই
শ্রীচৈতন্যমন্দির (Shri Chaitanya Temple)- সিলেটের দক্ষিণ -পূর্বে ৪৫কিলোমিটার দূরে প্রায় পাঁচশো বছরের প্রাচীন শ্রীচৈতন্যমন্দিরটিতে আজও ভিড় জমান ভক্তরা। প্রতিবছর ফাল্গুন পূর্ণিমায় এখানে বিরাট মেলা বসে।
গৌরগোবিন্দ দুর্গ(Gourgabinda Fort)- মুরারিচাঁদ গভর্নমেন্ট কলেজের কাছেই ছবির মতো পরিবেশে টিলার ওপর রাজা গৌরগোবিন্দের দুর্গের ভগ্নাবশেষ।
জৈন্তাপুর(Jaintapur)- সিলেটের ৪৩ কিলোমিটার উত্তরে সিলেট -শিলং রোডে প্রাচীন রাজাদের রাজধানী জৈন্তাপুর আজও ভুলে যাওয়া ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ বুকে নিয়ে জেগে রয়েছে। একসময় এটি ছিল প্রমীলা রাজ্য। শাসন করতেন রানি ঊর্মি।
লাওয়াছড়া রেন ফরেস্ট (Lawacherra Rain Forest)- বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত অরণ্য। হরিণ, লেপার্ড, বুনো মুরগি, কাঠবিড়ালি, গিবন, পাইথনের বিচরণভূমি। পক্ষিপ্রেমিকদেরও স্বর্গ এই অরণ্য। তবে এই বনভূমির অন্যতম আকর্ষণ এশিয়ার বিরল প্রজাতির ক্লোরোফর্ম গাছের একটি আজও এখানে বেঁচে রয়েছে।
গ্যাসফিল্ড হরিপুর (Haripur Gas field)- দেশের প্রথম গ্যাসফিল্ড হরিপুর শহর থেকে ২২কিলোমিটার দূরে সিলেট -জাফলং সড়কের পাশে। জ্বালানি গ্যাস মিথেন ও পেট্রোল উত্তোলিত হয়।
তথ্যঃ ‘বাংলাদেশ ট্যুরিজম’ ফেসবুক গ্রুপের বন্ধুদের সৌজন্যে
ভ্রমণ কাহিনি – জঙ্গলে জঙ্গলে সাইকেলে
রাজশাহি - পাহাড়পুর (Rajsahi - Paharpur) - বৃহত্তর রাজশাহি জেলার জামালগঞ্জের পশ্চিমে ৫কিলোমিটার দূরে ছোট্ট গ্রাম পাহাড়পুরে রয়েছে হিমালয়ের দক্ষিণভাগের বৃহত্তম বৌদ্ধ মনাস্ট্রির ধ্বংসাবশেষ। সপ্তম শতাব্দীর এই মনাস্ট্রিটি মোটামুটি ২৭ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে। মনাস্ট্রিকে ঘিরে ১২ -১৫ ফুট উঁচু দেওয়াল। সবমিলিয়ে ১৭৭টি ঘর রয়েছে মনাস্ট্রিতে। মনাস্ট্রির স্থাপত্যে দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বিশেষ করে মায়ানমার ও জাভার স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব সুস্পষ্ট। মনাস্ট্রি লাগোয়া ছোট্ট মিউজিয়ামটিতে ও রাজশাহির বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে এখান থেকে পাওয়া টেরাকোটার কাজ, বিভিন্ন মূর্তি, মুদ্রা, শিলালিপি প্রভৃতি রাখা হয়েছে।
ছোট সোনা মসজিদ(Chhoto Sona Mosque)- সুলতান আমলের অন্যতম সেরা মসজিদটি রাজশাহি গৌড়ে অবস্থিত। সোনালি রঙের ছোট্ট এই মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে (১৪৯৩ -১৫১৯) গড়ে তোলেন ওয়ালি মহম্মদ।
পুথিয়া(Puthiya Photos)- অনেকগুলি প্রাচীন হিন্দুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে এখানে। এরমধ্যে গোবিন্দ মন্দিরটি ১৮২৩-১৮৯৫ সালের মধ্যে পুথিয়ার মহারানিরা গড়ে তোলেন। টেরাকোটার অপূর্ব কাজ রয়েছে এই মন্দিরে। অন্যান্য মন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর ভারতের মন্দিরের আদলে তৈরি শিব মন্দিরটি এবং ১৬ শতকের জগন্নাথ মন্দির প্রমূখ। রাজশাহির ২৩কিলোমিটার পূর্বে মন্দিরময় পুথিয়ার অবস্থান।
সুন্দরবন (Sundarbans National Park)-সুন্দরবন (Sundarban) - সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের ম্যানগ্রোভ বনভূমি হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বে সর্ববৃহৎ। বাংলাদেশের খুলনা বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত।১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর তরফে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবন স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিরূপের অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সূচিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় পার্ক নামে। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ছোট ছোট দ্বীপ। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলের এলাকা। এই বনভূমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক এখন সুন্দরবন এলাকায় ৫০০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে।
মুঘল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। ১৮২৮ সালে বৃটিশ সরকার সুন্দরবন অঞ্চলকে নিজেদের শাসনাধীনে আনেন। এল. টি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরীপ কার্য পরিচালনা করেন। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৭৯ সালে সমগ্র সুন্দরবনের দায় দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে। যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.২% এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪%। ১৮৭৫-৭৭-র সালের মধ্যে সুন্দরব্নকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উদ্ভিদবৈচিত্র্যঃ সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী (Heritiera fomes), গেওয়া (Excoecaria agallocha), গরান (Ceriops decandra) এবং কেওড়া (Sonneratia apetala)। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে। সুন্দরী ও গেওয়া অরণ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ধুন্দল (Xylocarpus granatum)। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে Poresia coaractata, Myriostachya wightiana, শন (Imperata cylindrical), নল খাগড়া (Phragmites karka), গোলপাতা (Nypa fruticans) রয়েছে সুবিন্যস্তভাবে। কেওড়া নতুন তৈরি হওয়া পলিভূমিকে নির্দেশ করে এবং এই প্রজাতিটি বন্যপ্রাণীর জন্য জরুরী, বিশেষ করে চিত্রা হরিণের (Axis axis) জন্য । বনভূমির পাশাপাশি সুন্দরবনের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নোনতা ও মিঠা পানির জলাধার, আন্তঃস্রোতীয় পলিভূমি, বালুচর, বালিয়াড়ি, বেলেমাটিতে উন্মুক্ত তৃণভূমি এবং গাছ ও গুল্মের এলাকা।
প্রাণীবৈচিত্র্যঃ সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণীবৈচিত্র্য বিদ্যমান। এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি সংরক্ষিত - বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ (Hog deer - Axis procinus ও Swamp deer - Cervus duvauceli), মহিষ (Bubalis bubalis), গন্ডার (Javan rhinoceros - Rhiniceros sondaicus ও Single horned rhinoceros - Rhinoceros unicornis) এবং কুমিরের (Mugger crocodile - Crocodylus palustris) এর মত কিছু কিছু প্রজাতি সুন্দরবনে বিরল হয়ে উঠেছে ২১ শতকের শুরু থেকে। ২০০৪ সালের হিসেব মত সুন্দরবন ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল যা পৃথিবীতে বাঘের একক বৃহত্তম অংশ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে বিচিত্র জীববৈচিত্র্যের আধার বাংলাদেশের সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮টি উভচর প্রজাতির আবাসস্থল।
মৎস্য সম্পদঃ ধারণা করা হয়, সুন্দরবনে শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। এছাড়া ১২ প্রজাতির কাঁকড়া-চিংড়ি ও ৯ প্রজাতির শামুক রয়েছে।
ভ্রমণ - সুন্দরবনের সত্যিকারের আরণ্যক চেহারাটা বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে না গেলে বোঝা যাবে না। সুন্দরীগাছ, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে প্রায় দেখাই যায় না। এখানে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধুই সুন্দরীর জঙ্গল। কেওড়া, গরাণ, সুন্দরীগাছের দল আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে প্রায় পঞ্চাশ -ষাট ফুট। নারকেল গাছের মত দেখতে গোলপাতা গাছও ছড়িয়ে রয়েছে এখানে - সেখানে। অরণ্য এখানে অনেক গভীর। গ্রাম এসে দখল করেনি অরণ্যভূমি। জলের কিনারায় হেঁটে বেড়ায় লালচে রঙের ফিডলার ক্র্যাবের দল। এই জঙ্গলে মাছরাঙাই আছে ন’রকম। আর রয়েছে বক, সারস, শঙ্খচিল, অ্যাডজটেন্ট স্টর্ক, সাইবেরিয়ান ডাক এমন অজস্র পাখি। হরিণ, বুনোমোরগ, বুনো শুয়োরের দেখা মিলবে এই অরণ্যে। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে চড়ায় বিশ্রামরত কুমির কিম্বা খোদ রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরও দেখা মিলতে পারে।
করমজল - করমজলে একটি ফরেস্ট অফিস এবং হরিণ ব্রিডিং সেন্টার আছে।
হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল) (Hiran Point) - এটা একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল। হাঁটতে হাঁটতে বন্য প্রকৃতি, পাখি ও চিত্রল হরিনের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এখানে। মাঝে মাঝে বাঘ দেখা যায়, তাই দল বেঁধে ও গাইডের সাথে ভ্রম্ণ করতে হবে। এখানে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের একটা রেস্ট হাউস ও ওয়াচ টাওয়ার আছে।
দুবলার চর - এটা জেলেদের দ্বীপ।
কচিখালি (টাইগার পয়েন্ট)- প্রায়ই বাঘ দেখা যায় এখানে। বন বিভাগের একটা রেস্ট হাউস আছে।
কটকা (Katka) - খুলনা জেলার দক্ষিণতম বিন্দু কটকা। গায়েই বঙ্গোপসাগর। পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন লোকালয় নেই। নিশ্ছিদ্র আদিম বনভূমি। বুনো কেওড়ার রাশি রাশি ফল ভেসে যায় জলে। ফল খেতে নদীর তীরে হাজির হয় হরিণের দল। কটকার সমুদ্র সৈকতটিও অসাধারণ। ৪০ ফুট উঁচু কাঠের ওয়াচ টাওয়ারটিতে বসে শুধুই অরণ্যচারীদের জন্য নিঃশব্দ প্রতীক্ষা। [ সতর্কতাঃ কটকা সমুদ্র সৈকতে ও বনের ভিতরে একা একা ঘোরাঘুরি না করে সব সময় গাইডের সাথে থাকবেন ]
যাওয়া ও থাকা - খুলনা থেকে মংলা বন্দর হয়ে সুন্দরবনের প্রবেশপথ। মংলা থেকে মোটরবোটে সুন্দরবনের প্রধান দুই ট্যুরিস্ট স্পট -হিরণ পয়েন্ট ও কটকায় যাওয়া যায়। কারামজোল, কোচিখালি ও মান্দারবেরিয়া অরণ্য তিনটি স্পট। হিরণপয়েন্ট ও কটকায় থাকার ব্যবস্থা আছে। বুকিং করে যেতে হবে।
ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালীনি হয়ে ট্যুরের জন্য শ্যামলী থেকে সাতক্ষীরার বাস ধরে সাতক্ষীরা/শ্যামনগর পৌঁছতে হবে। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার দূরত্ব ৩৪৩ কিলোমিটার। সাতক্ষীরা সদর থেকে বুড়িগোয়ালীনি ৭০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে সাত থেকে আট ঘন্টা। এখান থেকে সুন্দরবনের দর্শনীয় স্থানগুলো কাছে হয়, সময় লাগে কম, তাই খরচও কম। কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম চারটি স্পটের মধ্যে হিরণ পয়েন্ট, নীলকমল, দুবলাচর ও মান্দারবাড়ি সমুদ্র সৈকত ঘুরে আসা যায়।
যোগাযোগঃ বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন, ম্যানেজার (ট্যুরস), ২৩৩ এয়ারপোর্ট রোড, তেজগাঁও, ঢাকা – ১২১৫। ফোনঃ ৩২৫১৫৫-৫৯।
প্রয়োজনীয় - সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায়, এখানে ভ্রমণের জন্য আগে খুলনা বন অফিস থেকে অনুমতি নিতে হবে। এই অনুমতি নেওয়ার দৌড়াদৌড়ি এবং সুন্দরবনে থাকা-খাওয়ার জায়গার স্বল্পতার জন্য কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ভ্রমণের আয়োজন করা সুবিধাজনক। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এবং অন্যান্য বেশ কিছু ট্যুর এজেন্সি এই ট্যুরগুলি কন্ডাক্ট করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সুন্দরবন বেড়াতে নিয়ে যায়, যোগাযোগ থাকলে তাদের সঙ্গী হওয়া যায়।
(তথ্য সহায়তা – শ্রীমতি মার্জিয়া লিপি ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফেসবুক গ্রুপ)
ভ্রমণকাহিনি - বাঘের বাড়ি
যাওয়া - বাংলাদেশের মূল প্রবেশদ্বার ঢাকা। নিকটতম বিমানবন্দর ও রেলস্টেশন ঢাকা। বিভিন্ন দেশ থেকে বিমান নিয়মিত ঢাকা যাচ্ছে। এখন ট্রেনও যাচ্ছে ভারত থেকে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগ রয়েছে। বেড়িয়ে নেওয়া যায় বাসে বাসেও। ঢাকা -চট্টগ্রামের মত শহর বেড়াতে ভালো বাহন রিক্সা কিম্বা বেবি ট্যাক্সি।
থাকা – বাংলাদেশে বেড়ানো ও থাকার জন্য সরকারি পর্যটন বা বেসরকারি ট্যুর অপারেটরের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারি ট্যুরিজমের ওয়েবসাইট-http://www.parjatan.gov.bd
ঢাকা শহর জুড়ে নানান মান ও দামের অজস্র হোটেল আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরেই রেস্ত ও পছন্দ অনুযায়ী হোটেল মিলবে।
খাওয়াদাওয়া – স্থানীয় মাছ আর মিস্টি এখানকার বিশেষত্ব।
কেনাকাটা – ঢাকার তাঁত আর সিল্কের শাড়ি ও গোলাপি মুক্তো-র খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
এছাড়াও কেনাকাটার তালিকায় রাখা যায় নানান হ্যান্ডিক্র্যাফট আইটেম থেকে শুরু করে শীতলপাটি, সোনা, রূপা, তামার নানা সামগ্রী, লেদার গুডস, স্থানীয় পুতুল ইত্যাদি।
মরসুম – সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ বেড়ানোর সেরা সময়।
জরুরি- বাংলাদেশের বেশ কিছু জরুরি ফোন নম্বরের পাওয়া যাবে http://www.bizbangladesh.com এই ওয়েব ঠিকানায়।