রেশম পথের যাত্রী
মঞ্জুশ্রী সিকদার
~ উজবেকিস্তানের তত্থ্য ~ উজবেকিস্তানের আরও ছবি ~
দীর্ঘ ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবনসঙ্গী চলে যাওয়ার পর মনটা ভীষণ একটা শূণ্যতায় আছ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই আমার ভ্রমণসঙ্গী জুরান সাহার ফোনটা এল। ওরা উজবেকিস্তান যাচ্ছে, আমাকেও দলে পেতে চায়। আমিও যেন দূরে কোথাও যেতে চাইছিলাম...
মধ্য এশিয়ার একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র উজবেকিস্তান। ১৯২৪ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে ছিল। ১৯৯২ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে উজবেকিস্তান দেশের জন্ম হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সভ্যতা সংযুক্তকারী বিখ্যাত রেশম পথের ওপরে এর অবস্থান একে ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য দিয়েছে।
একত্রিশে অক্টোবর ষোলো জনের একটা দলে পাড়ি দিলাম দিল্লি হয়ে তাসখন্দের পথে। উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে পৌঁছে সেখান থেকে অন্তর্দেশীয় বিমানে এলাম উরগেন-এ। উরগেন থেকে গাড়ি চলল খিভার পথে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ইচান কালা কমপ্লেক্স, কালটা মিনার, মহম্মদ আমিন খান মাদ্রাসা, জুম্মা মসজিদ, বোরগাজী খান মাদ্রাসা, ইসলাম খোজা মাদ্রাসা ও মিনার,তাস খাউনি এবং হারেম - এ পথের দ্রষ্টব্যস্থানগুলি দেখতে দেখতে কখন পেরিয়ে গেলাম ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা। প্রাচীন কালে খিভার শাসকদের বাসস্থান কুন্যা আর্ক (Kunya Ark) দেখেও বেশ ভালো লাগলো। মুসলিম স্থাপত্যগুলির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সবই দেখতে অনেকটা একরকম লাগে। খিভাতে প্রথম অ্যাকাডেমিক অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখানে ইসলাম ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে। বর্তমানে এই দেশে ইসলামই প্রধান ধর্ম। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আলবেরুণী উজবেকিস্তানের মানুষ ছিলেন। মঙ্গোলিয়া থেকে এসে চেঙ্গিস খানও এখানে কিছুকাল রাজত্ব করেছিলেন। পথে যেতে যেতে বেশ কিছু সিমেটারি দেখলাম। এখানকার সিমেটারিগুলো একেকজায়গায় একেকরকম। মাটির নীচে জল থাকায় পাহাড়ের ঢালে সিমেটারিগুলো তৈরি করা হয়েছে।
দোসরা নভেম্বর সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করে আটটা নাগাদ খিভা ছাড়লাম। এবারে কিজিলকুম মরুভূমির ওপর দিয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে – ১২ থেকে ১৪ ঘন্টার সফর। উজবেকিস্তানের উত্তরের নিম্নভূমি আসলে এক বিশাল মরুভূমি যা দক্ষিণ কাজাকিস্তানেও প্রসারিত হয়েছে। বিখ্যাত সিল্ক রুট ধরে পার হচ্ছি এই মরুভূমি। সমতল নয়, বেশ উঁচুনীচু। ধূ ধূ বালিও নয়, মাঝে মাঝে কাঁটাগাছ। প্রাচীনকালে এই পথ দিয়ে চলত উটের ক্যারাভান। এই ক্যারাভানেই চলতো রেশম পরিবহন। এসব কথা মনে হতেই দিনের বেলায় এই মরুপথ পেরোনোর রোমাঞ্চ অনুভব করছি। পথে পড়লো আমুদরিয়া নদী। ২৫৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ উজবেকিস্তানের বিখ্যাত নদী এই আমুদরিয়া। নদীর ধারে গাড়ি দাঁড়ালে সঙ্গীরা অনেকেই নীচে নদীর খাতে নেমে গেল। পায়ের ব্যথার জন্য আমি গাড়িতেই রয়ে গেলাম। আমার জন্য একজন বোতলে করে নদীর জল নিয়ে এসেছিলেন। সেই জল স্পর্শ করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। নদীর ধারে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার চলা শুরু হল। যেতে যেতে চোখে পড়ল দূরে মরুভূমির ওপর দিয়ে ট্রেন চলেছে।
উজবেকিস্তানের প্রধান ভাষা উজবেক। চোদ্দ শতাংশ মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলেন। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশগুলির ভাষাও, যেমন – তুর্কমেন, কাজাক, কিরগিজ প্রভৃতি এখানে প্রচলিত। এখানকার মুদ্রার নাম সোম (Som)। উজবেকিস্তান প্রজাতান্ত্রিক দেশ। এখানে ধর্মেরও কোন গোঁড়ামি নেই। আঠেরো বছরের ছেলেদের জন্য আর্মি সার্ভিসিং বাধ্যতামূলক। সরকার থেকে বিনা খরচে শিশুদের সমস্ত রকম টিকা দেওয়া হয়। পতাকার চারটে রঙ – নীল – পবিত্রতা, সাদা – শক্তি, সবুজ – মা, লাল – রক্ত-এর প্রতীক । বারোটা প্রভিন্স বোঝাতে পতাকায় বারোটি তারা ব্যবহার করা হয়। অর্দ্ধেক চাঁদের অর্থ গ্রোয়িং কান্ট্রি। এদেশের মাটির তলায় নাকি প্রতিবছর ৮০ টন সোনা মেলে। তামা মজুতে বিশ্বের নবম দেশ, ইউরেনিয়ামে একাদশ – গাইডের মুখে এসব বিচিত্র কথা শুনতে শুনতে সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছলাম বুখারা শহরে। যে হোটেলে উঠলাম সেটা শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে। খুব সুন্দর সাজানো শহর। মরক্কো যেমন মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন অথচ জীবন্ত শহর, বুখারাও মধ্যএশিয়ার সেরকমই একটি পুরোনো অথচ প্রাণবন্ত শহর। শোনা যায় সংস্কৃত 'বিহারা' শব্দটি থেকে 'বুখারা' শব্দের উৎপত্তি।
তেসরা সকাল ন'টার সময় বেরোলাম ওল্ড বুখারা দেখতে। এখানে এগারোটা গেট আছে। ওল্ড বুখারা ঢোকার মুখে রাস্তার দুদিকের প্রাকার মুসলিম স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই প্রাকার তৈরি হয়েছিল। প্রাকারটির উচ্চতা ১০ মিটার, চওড়া ৮ মিটার এবং ব্যাপ্তি ৩০০ কিলোমিটার। অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আক্রমণে এই প্রাকারের কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ১৯২০ সালে রেড আর্মিও খানিকটা ধ্বংস করেছিল। প্রথমেই আমরা নামলাম ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে তৈরি সিটাডেল আর্ক (Citadel Ark) দেখতে। এটা বুখারার শাসকদের রাজপ্রাসাদ। ২০ মিটার উঁচু একটা পাহাড় বানিয়ে তার ওপর তৈরি হয়েছে এই প্রাসাদ। রেড আর্মির আক্রমণে এই প্রাসাদেরও কিছু অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিছুটা এগিয়ে চশমা আয়ুব মৌসলিয়াম (Chashma Ayub Mausoleum)। এই মৌসলিয়ামকে ঘিরে গল্পকথা রয়েছে। শোনা যায় বুখারাতে জলের অভাব চিরদিনের মত মেটাতে প্রফেট জোভ (আয়ুব) এই মৌসলিয়ামের একটা জায়গা চিহ্নিত করে তাঁর শিষ্যদের বলেন শলাকা গরম করে মাটি খুঁড়তে। মাটির ভেতর থেকে পরিষ্কার সুস্বাদু জল বেরিয়ে আসে। এই জল আজও পবিত্র বলে মনে করা হয়। এরপর দেখলাম বোলো খাউজ মসজিদ (Bolo Khauz Mosque) – এটা বুখারীয় শিল্পশৈলীকে তুলে ধরেছে। ১৭১৪ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। কাঠের কাজ করা কুড়িটি স্তম্ভ আছে। বড় গাছ না থাকায় স্তম্ভের কাঠ রাশিয়ার থেকে আনা হয়েছিল। তাকিয়ে দেখি পাশের পুষ্করিণীতে স্তম্ভের প্রতিফলিত ছায়া অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যপট রচনা করেছে। প্রত্যেক শুক্রবার ইমাম এখানে আসেন। সামানিড ডাইন্যাস্টির সাক্ষ্য বহন করছে সামানিড মৌসলিয়াম (Samanid Mausoleum)। এর মিনারগুলি খুবই কারুকার্যমণ্ডিত। মিনারটি চেঙ্গিস খাঁ-এর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। শুনলাম, এটি তৈরি করার সময় নাকি ডিমের সাদা অংশ আর উটের দুধ দিয়ে মাটি মাখা হয়েছিল।
পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সমরখন্দের উদ্দেশে। প্রথমেই চলেছি শখরিসবজ (Shakhrisabz) – তৈমুর লঙের জন্মস্থানে। তৈমুরই এখানকার প্রথম জাতীয় নেতা। তাঁর বাবা ছিলেন মঙ্গোলিয়ান মুসলিম, মা স্থানীয় নারী। তৈমুর নিজেকে চেঙ্গিস খাঁ-এর বংশধর হিসেবে দাবী করতেন। তৈমুরের সবচেয়ে বড় আকাঙ্খা ছিল চিন জয় করা। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে পথে অসুস্থ হয়ে ছিয়ানব্বই বছর বয়সে মারা যান। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ছিলেন তৈমুরের বংশধর। বিখ্যাত সিল্ক রুটটিও তৈমুরের সহায়তায় তৈরি হয়। এখানে পৌঁছে আমরা প্রথমেই দেখলাম একসারায় (Aksaray) শ্বেত প্রাসাদ – তৈমুরের বৈভবের নিদর্শন হিসেবে আজও যা দাঁড়িয়ে রয়েছে। উলুক বেগের তৈরি কোক গুম্বাজ (Kok Gumbaz) বা ব্লু ডোম মসজিদ (Blue Dome)। দেখা শেষে বিকেলে সমরখন্দের হোটেলে পৌঁছলাম।
পাঁচ তারিখ সকালে সমরখন্দ ঘুরতে বেরোলাম। পথে যেতে যেতে গাইডের মুখে শুনলাম, মহান আলেকজান্ডার বিভিন্ন উপজাতির সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য সমরখন্দের রাজার মেয়ে রুকসানাকে বিয়ে করেছিলেন। এখান থেকেই আলেকজান্ডার ভারতে আসেন। সিল্করুটের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সমরখন্দই ছিল প্রাচীনকালে উজবেকিস্তানের রাজধানী। সমস্ত শহর প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। জমি খুবই উর্বর। এখানে প্রচুর সোনাও পাওয়া যায়। সমরখন্দের মূল আকর্ষণ 'রেগিস্তান' নামের এলাকা। যার চারপাশে আছে অনেকগুলি প্রাচীন মাদ্রাসা। এগুলি অবশ্য দোকানেরই নামান্তর। রেগিস্তান স্কোয়ার বাজারে মধ্যযুগীয় শৈল্পিক বিন্যাসের প্রকাশ লক্ষ্য করার মত। প্রচুর গালিচা, সিল্কজাত সুন্দর হাতে কাজ করা জিনিস – যেদিকেই চোখ যায় মন ভরে ওঠে, সেই অনুভূতি লিখে ঠিক বোঝানো যাবে না। ভারত জয় উপলক্ষে তৈমুর যে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন সেটাও দেখলাম। গুর এমির মৌসলিয়াম (Gur Emir Mausoleum) – তৈমুরের পরিবারের সমাধিক্ষেত্রটির ভিতরটা খুব কাজ করা। উলুক বেগ ছিলেন একাধারে বিজ্ঞানী এবং জ্যোতির্বিদ। মাত্র পনের বছর বয়সে এখানকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তাঁর অবজারভেটরি এখন মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে।
ছ'তারিখ সমরখন্দ থেকে বেরিয়ে তাসখন্দের পথে চলেছি। আজকের পুরো পথটাই 'বাম-ই-দুনিয়া' অর্থাৎ পৃথিবীর ছাদ পামীর মালভূমির ওপর দিয়ে যাব। ঘন্টাখানেক চলার পর দুদিকেই চোখে পড়ছে ধু ধু কঠিন প্রান্তর। আবার কখনও পাশে সবুজ ক্ষেত। রাস্তার দু'ধারে মাঝে মাঝে আবার লম্বা লম্বা গাছ। এইসব জায়গায় আবার দূরে দূরে দু'একটা বাড়ি। রাস্তার দু'পাশে আপেল গাছ। মধ্যএশিয়ার উজবেকিস্তানে অবস্থিত পামীর রেঞ্জ পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালাগুলির মধ্যে অন্যতম। এটা প্রধানত সমরখন্দকেই ঘিরে আছে। পামীর পাসের ভিতর দিয়ে পাঁচ ঘন্টার সফর শেষে তাসখন্দে এসে পৌঁছলাম। আজ এখানেই বিশ্রাম।
সাত তারিখ সকালবেলা ন'টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ফারঘানা ভ্যালির উদ্দেশ্যে। ফারঘানা যাওয়ার পথে পামীরের সৌন্দর্য একেবারে অন্যরকম। বাঁদিকে প্রায় খাড়া সবুজ পাহাড়। ডানদিকে অনেক দূরে নিরবিচ্ছিন্ন আরেক সারি পাহাড়। দূরের পর্বতমালা বরফের চাদরে ঢাকা। আর মাঝখানে বিস্তীর্ণ সমতলভূমি। হিমালয়, তিয়ানশান, কারাকোরাম, কুনলুন ও হিন্দুকুশ – নামী গিরিমালার সংযোগস্থলে প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার অংশ নিয়ে পামীর ছড়িয়ে আছে উজবেকিস্তান, চিন, কিরঘিস্তান, তাজিকিস্তান-এ। টলেমির লেখায় আছে পামীরের ওপরে বাণিজ্যপথের কথা। চিন থেকে অনেক বৌদ্ধও এসেছেন এই পথে।
পামীর হাইওয়ের পোশাকি নাম এম-৪১। পাহাড়ি রাস্তা কিন্তু খুব চওড়া। যেতে যেতে মনে হচ্ছে দূরে প্রকাণ্ড আকাশ যেন নেমে পড়েছে শৃঙ্গের আড়ালে। জনঘনত্ব সামান্য, তাই বসতও ভীষণ কম। পরপর দুটো সুড়ঙ্গ পার হলাম। একটার দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার। অন্যটা এক কিলোমিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। পাহাড়ি ধ্বস আটকানোর জন্য কোথাও কোথাও রাস্তার ধারে মোটাসোটা একগুচ্ছ লোহার গোলাকৃতি স্তম্ভ। এগুলোর উচ্চতা প্রায় পনেরো ফুট। খনিজ সম্পদে পূর্ণ এই পামীর মালভূমি। বিকেলবেলায় কোকন্দ (Kokand) নামে একটা জায়গায় পৌঁছলাম। এটি আগে এই অঞ্চলের রাজধানী ছিল। এখানে খান প্যালেস মিউজিয়াম, ফ্রাইডে মস্ক এবং নরবুট্যাবি (Norbutabiy) মাদ্রাসা দেখলাম। এরপর রিশান নামের এক জায়গায় সেরামিক ফ্যাক্ট্রি দেখলাম। এই ফারঘানা ভ্যালিই বাবরের জন্মস্থান। আগে এখানে পার্সিদের প্রাধান্য ছিল। এখান থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর প্রথমে আফগানিস্তানে আসেন এবং পরবর্তীকালে ভারত জয় করেন। অষ্টাদশ শতকে স্বাধীনতা আন্দোলন করে ফারঘানা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীস্কৃতি পেলেও পরে আবার রাশিয়ার দখলে চলে যায়। রাত্রিটা ফারঘানার হোটেলেই কাটানো হল।
আট তারিখ সকালে আবার যাত্রা শুরু রাজধানী শহর তাসখন্দের উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে গাড়ি থামলো মার্গিলান (Margilan) শহরে। মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম রেশম উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে আমরা রেশম কীট থেকে কীভাবে সিল্ক সুতো তৈরি হয় তা প্রত্যক্ষ করলাম। পথ শেষ হল আজকের গন্তব্য তাসখন্দ প্যালেস হোটেলে।
ন' তারিখ সকালে হোটেলে ব্রেকফাষ্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ার। উজবেগ প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে ১৯৯৮-৯৯ সালে তৈরি পার্কটিতে রয়েছে বিশাল বড় ধাতুর তৈরি একটি মাতৃমূর্তি। গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মুখের এই মূর্তিটির সামনে সর্বক্ষণ জ্বলছে অগ্নিশিখা। যুদ্ধে যাওয়া উজবেকদের জন্য দেশমাতৃকার চিন্তার প্রতিমূর্তিস্বরূপ। কাছেই একটি সুদৃশ্য ভবনের বারান্দায় সার দিয়ে রয়েছে ধাতব বই, যার পাতায় পাতায় লেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত উজবেক সেনাদের নাম। ষোলটি সুন্দর স্তম্ভের ওপর অসাধারণ ফটক। উচ্চতা তিরিশ ফুটের মতো। উপরে দুটো উড়ন্ত সারস। পার্কের কোথাও রয়েছে ছোটদের জন্যে খেলার আয়োজন, কোথাওবা জলাশয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের পাল। মালবেরি, প্লাটান, পাতাবাহারের ঝাড় – নানারকম গাছ আর ফুলের শোভায় সজ্জিত পার্কটিতে রয়েছে নানা মাপের প্রায় পঞ্চাশটি ফোয়ারা।
তাসখন্দ (Tashkent) মানে পাথুরে শহর। এই শহরের সঙ্গে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি এখানেই লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উপস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি হয়। আমরা যে হোটেলে ছিলাম, শাস্ত্রীজীও সেই হোটেলেই থাকতেন। এটি এখানকার একটি পুরোনো ঐতিহ্যময় হোটেল। শহরে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর একটি আবক্ষ মূর্তি এবং ওনার নামে একটি রাস্তা আছে। চেঙ্গিস খাঁ-এর হাতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটিকে পরবর্তীকালে তৈমুর পুনর্নির্মাণ করলেও আবারও কাঝাক, ইরান এবং মঙ্গোলীয় হানায় বিধ্বস্ত হয়। তবে আজকের সাজানোগোছানো ঝকঝকে শহর, চওড়া রাস্তাঘাট, হকারমুক্ত ফুটপাথ, বহুতল বাড়ি, চোখধাঁধানো শপিং মল এইসব আধুনিক উপকরণ দেখলে ইতিহাসের গল্প অবিশ্বাস্য ঠেকে। কেনাকাটার সবচেয়ে বড় জায়গা চোরসু বাজার। দলের সবাই সেখানে পৌঁছে ভারী উৎসাহিত। বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে তারপর গ্রাণ্ড অপেরা হাউস প্রদক্ষিণ করে ঢুকে পড়লাম হোটেলে।
উজবেকিস্তান সফর এখানেই শেষ। আবার সেই চেনা দুঃখ-সুখে ফিরে আসা...।
~ উজবেকিস্তানের তত্থ্য ~ উজবেকিস্তানের আরও ছবি ~
ভারত সরকারের মহাগাণনিক দপ্তর থেকে অবসর নেওয়া মঞ্জুশ্রীর পায়ের তলায় সর্ষে। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসেন এদেশ-ওদেশ। ছয় মহাদেশের মাটিতে পা রাখার পর এখন তাঁর স্বপ্ন আন্টার্টিকা ভ্রমণ।