জারোয়াদের দেশে কয়েকদিন
স্তুতি বিশ্বাস
~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরো ছবি ~
আন্দামান - কালাপানির দেশ, জারোয়াদের দেশ...
ইতিহাস আর ছেলেবেলা থেকে শোনা নানান গল্পকথা মনের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল এক রোমাঞ্চকর আবহ...
শত শত স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী, আইনের চোখে অপরাধী মানুষের অন্তিম গন্তব্যস্থল। অতীতের অত্যাচার আর উৎপীড়নের এক জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় বিরাজ করবে এই নাম। নিপীড়িত মানুষের হাহাকার যেন আজও গুমরে গুমরে বেড়ায় আন্দামানের আকাশে বাতাসে। গহন অরণ্যে স্তব্ধ নিশ্ছিদ্র ঝোপঝাড়ের মাথা ছাড়িয়ে প্রাচীন গম্ভীর বনস্পতিরা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। অরণ্য যেন এক ধ্যানমগ্ন বিশাল যোগী। আর কালাপানি - সে তার ঢেউয়ের অর্ঘ্য সাজিয়ে সেই যোগীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলতে চাইছে আমার কালিমা ঘুচিয়ে দাও। নয়ন মেলে দেখ আমার রঙ, আমার রূপ - কখনো শান্ত স্নিগ্ধ, কখনো বা উত্তাল।
অনন্ত সমুদ্র, সোনালি বেলাভূমি আর জারোয়া দর্শনের টানে আমরাও গত শীতে আন্দামানে পৌঁছেছিলাম। চেন্নাই থেকে ভোরবেলা আন্দামানের ফ্লাইট। তাই আগের দিন রাতেই চেন্নাই এয়ারপোর্টে ডেরা গেড়েছিলাম। কাকভোরে সূর্য আর প্লেন দুটোই একসঙ্গে আকাশে উঠল। ঘন্টাদুয়েক বাদে পোর্টব্লেয়ারে নামলাম। সাদামাটা ছোট্ট এয়ারপোর্টে। মালপত্র নিয়ে বাইরে আসতেই মখমলের মত মিষ্টি রোদ দুহাত বাড়িয়ে বলল, সু-স্বাগতম। সবুজ, সবুজ আর সবুজ - চারিদিক শুধুই সবুজ। তারই মাঝে নারকেল, সুপারির সারি। ধোঁয়া-ধুলো বিহীন পরিবেশ। বেশ কিছু লোক নাম লেখা কাগজ উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের হাতে আমাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড দেখে এগিয়ে গেলাম। ছেলেটি একগাল হেসে বললো - ওয়েলকাম টু আন্দামান। বুঝলাম এই আমাদের আগামী দিনগুলির কান্ডারী। নাম সনু। চড়ে বসলাম তার গাড়িতে - গন্তব্য হোটেল। রাস্তা চড়াই উতরাই। ফাঁকে রাস্তায় গাড়ি চলল নিজের মত - পিছন থেকে হর্ন দেওয়া বা ওভার টেক করার বিশেষ কেউ নেই। যেতে যেতে রাস্তার ধারে নজরে পড়ল টিনের ছোট ছোট দোচালা বাড়ি। সামনে সুন্দর পরিপাটি বাগান। লোকজন বেশ ধীরেসুস্থে চলেছে রাস্তা দিয়ে। বুঝলাম কারোর সেরকম তাড়া নেই। ড্রাইভার ছেলেটি বেশ মিশুকে। পূর্বপুরুষ কেরালাবাসী হলেও ওর জন্মকর্ম সব এই দ্বীপেই। গল্প করতে করতে বললো ছোট জায়গা, লোকজনও কম। কারোর সঙ্গে সকালে দেখা হলে আবার বিকেলেও দেখা হয়ে যায়। সবাই সবাইকে চেনে। তবে কর্মসংস্থান খুব কম। আগে লোকে ক্ষেতিবাড়ি করেই জীবনযাপন করত। এখন ট্যুরিজম হওয়ায় বেশ কিছু লোক কাজ পেয়েছে। গল্পে গল্পে কখন হোটেলের গেটে পৌঁছে গেছি খেয়াল করিনি। নামটি বেশ সুন্দর - 'মেগাপড নেস্ট'। মেগাপড আন্দামান দ্বীপমালার প্রতীকি পাখি। অনেকটা মুরগীর মত দেখতে। কয়েক ফুট লম্বা। লম্বা লম্বা পা। ধারালো নখ। গায়ের রং বাদামী বা কালো, তাতে সাদা ছিট ছিট। মাথাটা লাল। এরা বিখ্যাত স্বভাবের জন্য। সমুদ্রের ধারে বালি,পচা জৈবপদার্থ, ছত্রাক এসব দিয়ে উঁচু বাসা তৈরি করে একটা বাসা বহু বছর ব্যবহার করে। মা পাখি বাসায় ডিম পেড়ে চাপাচুপি দিয়ে চলে যায়। গরম বালি আর জৈবপদার্থের পচনক্রিয়ার স্বাভাবিক উত্তাপে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। দেখতে দেখতে পূর্ণাঙ্গতা পায়। তারপর একদিন শিশু মেগাপড বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। তখন সে জানে না কে তার বাবা-মা। অনেকটা আন্দামানের লোকজনের মত যাদের কোন অতীত নেই। কার হাত ধরে এসেছে বলতে পারবে না। নিজে কী করতে পেরেছে সেটাই শুধু জানে।
রিসেপসনের জাবদা খাতায় সইসাবুদ মিটিয়ে আমরা এগোলাম কটেজের দিকে। সমুদ্রের দিকে সুন্দর সাজানো বাগান পেরিয়ে বেশ খানিকটা নীচে কটেজ। কটেজের বারান্দায় দাঁড়াতেই সমুদ্রের লবনাক্ত শীতল হাওয়া গায়ে লাগলো। সামনে শুধু জল জল আর জল। ডানদিকে নির্জন রস আইল্যান্ড। বাঁদিকে লাইট হাউস। মাঝে মাঝে ঢেউ এসে টিলার নীচে আছড়ে পড়ছে। দুপুরে সামান্য লাঞ্চ করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সেলুলার জেল দেখতে। জেলের সাতটা উইংর মধ্যে তিনটে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা। বাকীগুলো ভেঙে যাওয়ার পর সেখানে হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। ছোট ছোট কুঠরীতে মানুষ কী ভাবে দিন কাটাত ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। তার ওপর ছিল অমানুষিক অত্যাচার, সাহেবদের চাবুক। মানুষ এত নৃশংস হতে পারে!! সন্ধ্যেবেলা লাইট এণ্ড সাউণ্ড শো দেখে হোটেলে ফিরলাম। পরদিন গন্তব্য বারাটাং আইল্যাণ্ড, পথে জারোয়া দর্শন।
আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড র্পোটব্লেয়ার থেকে জারোয়া অধ্যুষিত জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে বারাটাং। প্রতিদিন সীমিত সংখ্যক গাড়ি চলে এই পথে। সরকারি পারমিট ছাড়া যাওয়া যায় না। সনু বললো, সকাল ৬ টার মধ্যে জঙ্গলের গেটে পৌঁছাতে হবে, লম্বা লাইন পরে। জারোয়ার কথা প্রথম শুনি 'সবুজ দ্বীপের রাজা' সিনেমায়। সে তো পর্দায়। আর এ হল চাক্ষুশ দেখা। বেশ উত্তেজনা সকলের মনেই। ভোর সাড়ে চারটেয় বেরিয়ে পড়লাম হোটেল থেকে। শেষরাতে চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আমার কল্পনায় জারোয়াদের ডেরার নিভে যাওয়া আগুনের গোলাপী ধোঁয়া দিগন্তে মিলিয়ে যাবার আগেই গেটে পৌঁছে গেলাম। সনু গেল পারমিটের সন্ধানে। দেখি এক পুলিশকর্তা মাইকে কিছু একটা ঘোষণা করছেন। অনেকগুলো গাড়ির একটা কনভয় পুলিশ পাহারায় যাবে। জঙ্গলে গাড়ি থামানো, জারোয়াদের ফটো তোলা বা খাবার দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। খানিক পরে সনু পারমিট নিয়ে ফিরে এলে আমাদের যাত্রা শুরু হল জঙ্গলের পথে। হাজার হাজার বছর ধরে বেড়ে ওঠা গর্জন, বাদাম ও সিমোয়া গাছের জঙ্গল। যেমন তার গঠন তেমনি তার উচ্চতা আর শক্তি। আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাছেদের কথোপকথন শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছি। হঠাৎ ড্রাইভার বলে উঠল - 'জারোয়া' 'জারোয়া'। তাকিয়ে দেখি বেশ কিছু কুলীকামিন ছোট ট্রাকে করে চলেছে কোথাও রাস্তা বানাতে। তাদের সঙ্গে দুজন জারোয়াও চড়ে গেছে ট্রাকের ওপরে। একটু এগোতেই রাস্তার বাঁকে দেখি এক বিবস্ত্র জারোয়া রমনী পিঠে বাচ্চা বেঁধে চলেছে। সনু জানলার কাঁচ বন্ধ করে দিতে বললো। জারোয়ারা নাকি জানালা খোলা পেলেই হাত বাড়িয়ে জিনিষপত্র তুলে নেয়। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে নাইটি পরা একটি জারোয়া মেয়ে সঙ্গে প্যান্ট পরা একটি ছেলে আমাদের গাড়ি দেখে হাত নাড়তে লাগলো। সনু গাড়ি আস্তে করতেই ওরা জানলার কাছে এসে কী বললো। সনু বললো, বিস্কুট চাইছে। দুটো বিস্কুট এগিয়ে দিতেই ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে পুরো প্যাকেটটা নিয়েই চলে গেল। ঘন অরণ্যের পথে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। হঠাৎ দেখি এক বিরাট ছায়া আমাদের সঙ্গে চলেছে। পিছন ফিরতেই দেখি এক জারোয়া যুবক আমাদের গাড়ির পেছনে উঠে পড়েছে। ঠিক কলকাতার ভিড় বাসে কণ্ডাক্টার জায়গা না পেলে যেভাবে পেছনের পাদানীতে দাঁড়ায় সেই ভাবে। সনু গাড়ি থামিয়ে কিছু বলায় ছেলেটি ভীষণ ভাবে দুদিকে মাথা নাড়ল। বুঝলাম ও নামতে নারাজ। অবশেষে সনু বললো পুলিশ আ রহা। ব্যাস এতে কাজ হল। ছেলেটি নেমে দুড়দাড় করে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল। পুলিশকে নাকি খুব ভয় পায়। কৌতুহলী হয়ে সনুকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'তুমি জারোয়া ভাষা জান?' ও স্মার্টলি উত্তর দিল, 'ওরা তো হিন্দি বলে, হিন্দি বোঝে'। হতাশ হলাম জারোয়ারাও নিজের ভাষা ছেড়ে হিন্দি বলছে!!
ঘন্টাদুয়েক চলার পর বারাটাং জেটি। সেখান থেকে বড় নৌকায় বিরাট জলরাশি পেরিয়ে বারাটাং দ্বীপ। নৌকাতে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হল। এবার স্পীডবোট। খাড়ির মধ্য দিয়ে যাব লাইমস্টোন কেভ। সরু খাড়ি একবারে একটা বোটই যেতে পারে। দুদিকের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। দ্বীপের রক্ষিবাহিনী। শিকড়ের জাল দিয়ে ভূমিক্ষয় আটকে রেখেছে। তলা দিয়ে জল চলে গেছে। জলের ওপর ঝুকে পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে। মাথা বেশি উঁচু করলেই ধাক্কা লাগবে। নিরবিচ্ছিন্ন নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে দুএকটা পাখির আওয়াজ প্রাণের স্পন্দন জানান দিচ্ছে। আধঘন্টা চলার পর গাছ কেটে বানানো ছোট্ট জেটিতে পৌঁছালাম। মাটির কয়েকটা ধাপ নেমে পায়ে চলা জঙ্গলের রাস্তা। চলেছি অজানা পথে চুনাপাথরের গুহার সন্ধানে। সঙ্গে গাইড। এই জনমানবহীন ঘন জঙ্গলে কে আবিস্কার করেছিল এই গুহা, কে জানে! গাইড বললো, মাইল খানেক হাঁটতে হবে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। হঠাৎ দেখি জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে। সামনে ক্ষেত, গরু চড়ছে। প্লাস্টিকের সিট লাগিয়ে অস্থায়ী দোকানে ঠাণ্ডা শরবৎ, শশা বিক্রি হচ্ছে। এই গহন অরণ্যেও মানুষ বসতি করেছে। ক্লান্ত হয়ে ওখানেই বসে পড়লাম। নিম্বুপানি খেতে খেতে শুনলাম গুহার কাছে ১০/১২টি পরিবারের একটি গ্রাম আছে। তারা কোন একসময়ে ঝাড়খণ্ডের অধিবাসী ছিল। চাকরি করতে এসে এখানেই থেকে যায়। বর্হিবিশ্বের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ খুবই কম। খুব দরকার পড়লে পোর্টব্লেয়ার যায়। সত্যি মানুষগুলো কত অল্পে খুশি। ওদিকে গাইড টর্চ নিয়ে প্রস্তুত গুহার ভেতরে যাবার জন্য। গুহার মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাইডের লাইটই একমাত্র ভরসা। পাথরের ফাটল দিয়ে জল চুঁইয়ে লাইমস্টোনে তৈরি হয়েছে নানান কারুকার্য। কল্পনায় কোথাও ঝাড়লন্ঠন, কোথাও পাখি, কোথাও গনেশের অবয়ব। এইসব কর্মকাণ্ডের স্রষ্টা প্রকৃতি। হাজার হাজার বছর ধরে সুনিপুণ হাতে গড়ে তুলেছে তার শিল্পকলা। গুহা দেখা শেষ করে খাড়ি পেরিয়ে আবার ফিরলাম জেটিতে। জেটির কাছে ছোট্ট একটি জনপদ। কয়েকটি খাবার দোকান। সেখানেই লাঞ্চ সেরে চললাম মাড ভলকানো দেখতে। এ এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। দেখে কাদার ঢিবি ছাড়া বেশি কিছু লাগলো না। এবার ফেরার পালা। অসীম জলরাশি পেরিয়ে গহন অরণ্যের পথ। ফেরার পথে বেশ কিছু সাদা ঘাসের পোষাক পরা জারোয়া নজরে এল। পায়ে চলা পথে ঘরে ফিরছে।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতে দেখি মিষ্টি রোদে ঘর ভরে গেছে। আজ বিশ্রাম। দুপুরে মিউজিয়াম দেখে শহরের মধ্যেই ঘোরা হল। বিকেলে ভাইপার আইল্যাণ্ড দেখে ফেরার পথেই সূর্য পশ্চিমে হেলে গেল। একটু পরে রক্তাভ লাল সূর্য দিগন্তের অসীম জলরাশিতে ডুব দিল। রাতেই মালপত্র সব গুছিয়ে নিলাম। পরের দিন সাতসকালে যাব হ্যাভলক আইল্যাণ্ড।
ফিনিক্স বে জেটি থেকে সকাল ৬ টায় জাহাজ ছাড়ল। ঝকঝকে আকাশ, ঝলমলে রোদ। নীল জলরাশি কেটে এগিয়ে চলেছে জলপরী। গন্তব্য সবুজ দারুচিনি দ্বীপ হ্যাভলক। আমরা ডেকে গিয়ে বসলাম। দেখতে দেখতে ডাঙ্গা অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিকে রাশি রাশি জল। অজস্র জলকণা ভেসে ভেসে মাঝে মাঝে রামধনু তৈরি করছে। একটু পরেই রোদের রিমঝিম তাপে আর বসে থাকা গেল না। জাহাজের পেটের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। এরপর চললো রোলিং - এধার থেকে গড়িয়ে ওদিক, আবার ওদিক থেকে এদিক। বেগতিক দেখে কেউ কেউ মেঝেতে শুয়ে পড়ল। তিন ঘন্টা ধরে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে হ্যাভলক দ্বীপে পা দিলাম। জেটিতে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। সে নিয়ে গেল বিজয়নগর বিচের ডলফিন রিসর্টে। এখানে আমরা থাকব নিকোবরি কটেজে। মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে গোল টিনের ছাদ দেওয়া ছোট ছোট কটেজ। সামনে অনন্ত জলরাশি। সমুদ্র এখানে বহুরূপী - সকালে সাদা, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হালকা সবুজ ওড়না জড়িয়ে নেয়, পড়ন্ত বিকেলে নীলবর্ণা। রুমে মালপত্র রেখে বেড়িয়ে পড়লাম সমুদ্রের আহবানে। উত্তাল সমুদ্র, রূপালি বেলাভূমি, মৌন পাহাড়, গম্ভীর জঙ্গলের সমন্বয় রাধানগর বিচ। দুধের মত সাদা ঢেউ ফেনিল হয়ে উপচে পড়ছে আবার পরক্ষণেই গুটিয়ে নিচ্ছে আঁচল। দুধারে নারকেল গাছের সারি। বেলাভূমির সাদা বালি পায়ে মেখে এগিয়ে চললাম। চারিদিকে ছড়ানো ঝিনুক, শামুক, সামুদ্রিক কোরাল। প্রকৃতির এই অনাবিল রূপ দেখে যেন আশ মেটে না - দুহাতে উজাড় করে সাজিয়েছে এই দ্বীপমালা। ফেরার পথে দেখি তটভূমি হারিয়ে গেছে জলের টানে। বিচের ধারে ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু দোকান। এক জায়গায় দেখি নিকোবরি ডাব বিক্রী হচ্ছে। এ ডাবের জল খুব মিষ্টি। তবে দামটাও বেশ সরেস।
পরের দিন সকালে পায়ে হেঁটে বেরোলাম দ্বীপ দেখতে। ছোট জায়গা। মাঝখানে বাজার। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজনের বাসস্থান। বেশিরভাগই বাঙালি - পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু। ভিটামাটি ছেড়ে এসে এখানে জঙ্গল কেটে নতুন বসতি করেছে। লোকজন সাদাসিধা মিশুক প্রকৃতির। আলাপ হল সূত্রধর পরিবারের সঙ্গে। নিজের সুপারি বাগানে ছোট ছোট কটেজ বানিয়ে ব্যবসা করছেন। অতিথি আপ্যায়নের ভার গৃহিনীর ওপর। ওদের ছোট্ট রেস্তোঁরায় ভাত,ডাল ও কুকারী মাছের ঝোল দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম। ফাউ হিসেবে প্রচুর গল্প হল। ফেরার সময় আমাদের ব্যাগে বেশকিছু বাগানের কলা ভরে দিলেন।
ফিরে আসতে আসতে মনে হচ্ছিল, সভ্যতার পাগলা ঘোড়া এই দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সে ভাবে তছনছ করতে পারেনি এখনও। জানি না প্রকৃতি আর কত দিন এই শান্তির নীড়কে ধরে রাখতে পারবে!
~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরো ছবি ~
বর্তমানে দিল্লীর উপনগরী নয়ডার বাসিন্দা স্তুতি বিশ্বাস স্বামী ও পুত্রের কর্মসূত্রে ঘুরেছেন দেশবিদেশ। বেড়ানো, বাগান করা, রান্না, গল্পের বই পড়তে নিজেও যেমন ভালোবাসেন তেমনি এই সব বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে খুবই আনন্দ পান।