আন্দামান (Andaman Islands)
নীল সমুদ্রের বুকে ঘন সবুজ পান্নার মালা। নর্থ, মিডল, সাউথ ও লিটল - এই নিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। রুপোলি বালুকাবেলা, ঘন সবুজ অরণ্য, অনুচ্চ পাহাড়, নানান রঙের কোরাল, রঙিন মাছ, আদিম জনজাতির মানুষজন আর স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত সেলুলার জেল, ভাইপার দ্বীপ - এইসব কিছু নিয়ে আন্দামানের আকর্ষণ চিরকালীন। ভারতের একমাত্র জীবন্ত আগ্নেয়গিরিও আন্দামানেই - ব্যারেন আইল্যান্ডে।
পোর্টব্লেয়ার (Portblair) - জাহাজে বা বিমানে পোর্টব্লেয়ার পৌঁছে সিটি ট্যুরে দেখে নেওয়া যায় আশপাশের দ্রষ্টব্যগুলি। তবে শুধুমাত্র রাজধানী পোর্টব্লেয়ারেই এত অজস্র দ্রষ্টব্য আছে যে একদিনে ঘুরে ফেলা অসম্ভব। শহরের প্রাণকেন্দ্র জমজমাট আবেরদিন বাজার। আবেরদিন বাজার ছাড়িয়ে একটু এগোলেই নেতাজি স্টেডিয়ামের পাশেই শান্ত নীল সমুদ্র। আবেরদিন জেটিতে ঢোকার মুখে গেটের সামনেই রয়েছে একটি সুউচ্চ স্মৃতিফলক, ‘ব্যাটল অফ আবেরদিন’ - ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত উপজাতি মানুষদের স্মৃতিতে নির্মিত। আরও আধ কিমি এগিয়ে ভারতবাসীর পীঠস্থান সেলুলার জেল। সিটি ট্যুরে দেখে নেওয়া যায় ভারতীয় নৌবাহিনীর মিউজিয়াম ‘সামুদ্রিকা’, চাথাম শ-মিল, মাউন্ট হ্যারিয়েট, অ্যানথ্রোপলজিকাল মিউজিয়াম, জুলজিকাল মিউজিয়াম, ফরেস্ট মিউজিয়াম, ফিশারিজ মিউজিয়ামের মতো দ্রষ্টব্যগুলি আর চিড়িয়াটাপুর অসাধারণ সূর্যাস্ত। একটা অপরূপ বিকেল কাটানো যায় করভিন্স কোভ সৈকতেও।
আবেরদিন জেটি থেকে বোটে চড়ে ঘুরে আসা যায় ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ আর ভাঙ্গাচোরা জাপানী বাঙ্কার বুকে নিয়ে বেঁচে থাকা নির্জন রসদ্বীপ (Ross Island) থেকে। নারকেল গাছে ছাওয়া নির্জন দ্বীপে ঘুরে বেড়ায় হরিণের দল। রসদ্বীপের সমুদ্রসৈকতটিও অসাধারণ।
আবেরদিন জেটি থেকেই বোটে করে ঘুরে আসা যায় নর্থ বে (North Bay) ও ভাইপার দ্বীপ (Viper Island)। নর্থ বে- তে সমুদ্রের জলে স্নর্কলিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। আর আছে চোদ্দোতলা উঁচু লাইটহাউসটি। ১৪৫টি লোহার সিঁড়ি ভেঙ্গে লাইটহাউসের ওপরে পৌঁছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হয়। আন্দামানের প্রথম জেল গড়ে ওঠে ভাইপার দ্বীপেই। আজও শের আলির মতো শহীদদের স্মৃতি বুকে নিয়ে নির্জন ভাইপার দ্বীপে টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে লালরঙের বাড়িটি।
পোর্টব্লেয়ার থেকে বাসে বা ভাড়াগাড়িতে ওয়ান্ডুরে (Wandoor) পৌঁছানো যায়। পথে পড়বে সিপ্পিঘাট ফার্ম নার্সারি। ওয়ান্ডুর জেটি থেকে কোরাল দেখতে বোটে করে যাওয়া যায় জলি বয় (Jolly Buoy), রেডস্কিন (Red Skin) দ্বীপ বা মহুয়াডেরা (Mohuadera) বীচে।
হ্যাভলক আইল্যান্ড(Havelock Island) - পোর্টব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটি থেকে ছোট জাহাজে চড়ে পাড়ি দেওয়া যায় হ্যাভলক আইল্যান্ডের দিকে। হ্যাভলকের জেটি থেকে বাজারের মোড় পর্যন্ত একটাই রাস্তা। মোড় থেকে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা সোজা পৌঁছেছে ডলফিন রিসর্টে। অন্যটা চলে গেছে ১২কিমি দূরে রাধানগর সৈকতে (Radhanagar Beach)। হ্যাভলকের অধিকাংশ বাসিন্দাই বাঙালি। দেশভাগের পর ওপার বাংলার উদ্বাস্তুদের একটা বড় অংশকে জোর করেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দামানে। কলকাতা থেকে ১,৫০০ কিমি দূরে হ্যাভলকের বাজারে হঠাৎই নজরে পড়বে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড। পথের পাশে চোখে পড়বে বাঙালি সংসারের চেনা ছবি।
জেটি থেকে মিনিট দশেকের দূরত্বে সমুদ্রের ধারে নারকেল বীথিকায় ছাওয়া সাজানো গোছানো ডলফিন রিসর্ট। নানান মাছের নামে নামাঙ্কিত ডলফিনের বাহারি কটেজগুলোর সামনে নারকেল গাছে ছাওয়া খোলা বাগান। বাগানের বাঁয়ে দু’তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছনো যায় নির্জন সৈকতে। জল এখানে কাঁচের মত স্বচ্ছ। সাদা বালির সৈকতে হেঁটে বেড়ায় জীবন্ত ঝিনুক।
রাধানগর সৈকতের বাঁদিকে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় কিছুটা ঝুঁকে এসেছে। ডানদিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সৈকত। সৈকতের বালি হলুদে-ধূসরে মেশা। ডানদিকে সৈকতের পরে দ্বীপের জঙ্গল শুরু হয়েছে। বিশাল বিশাল গাছ উঠে গেছে আকাশের দিকে। রাধানগর সমুদ্রের জলে চোরা টান রয়েছে। তাই জলে নামার সময় সাবধান হওয়া উচিত। এই সৈকতে সূর্যাস্ত দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বোটে চেপে হ্যাভলক জেটি থেকে মিনিট কুড়ি দূরত্বে সমুদ্রের বুকে এলিফ্যান্টায় পৌঁছে স্নর্কলিং করা যায়।
নীল দ্বীপ(Niel Island)- হ্যাভলকের মতই আরেক সুন্দর দ্বীপ নীল। সীতাপুর সৈকতে হাত বাড়ালেই জলের কাছে প্রবালের মেলা। সোনালি বালুকাবেলা, নীল সমুদ্র আর সবুজ দ্বীপ নিয়ে অপরূপ নীল। পোর্টব্লেয়ার থেকে দূরত্ব ঘন্টা তিনেকের। সপ্তাহে ৪ দিন মোটরবোট যাচ্ছে ফিনিক্স বে জেটি থেকে নীলদ্বীপে। হ্যাভলক থেকে সপ্তাহে একদিন লঞ্চ যাচ্ছে।
মায়াবন্দর (Mayabundar)- পোর্টব্লেয়ার থেকে জাহাজে রঙ্গত (Rangat) পৌঁছে সেখান থেকে সড়ক পথে যাওয়া যায় মায়াবন্দর। পোর্টব্লেয়ার থেকে সরাসরিও মায়াবন্দর চলে যাওয়া যায়। রঙ্গত থেকে মায়াবন্দর যাওয়ার পথে পড়বে সমুদ্র সৈকত কাথবার্ট বে (Cuthbert Bay)। ডিসেম্বর-মার্চ মাসে, রাত্রিবেলা এই সমুদ্রসৈকতে অসংখ্য সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। মায়াবন্দর থেকে ছোট বোটে বেড়িয়ে আসা যায় নারকেল গাছে ছাওয়া নির্জন দ্বীপ এভিস (Avis Island)। দ্বীপের বাসিন্দা শুধু দুই পাহারাদার। রুপোলী সৈকতে পড়ে থাকে ঝিনুক, কড়ির মালা। মায়াবন্দরে মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নির্জন সৈকত কারমাটাং।
রঙ্গত থেকে মায়াবন্দরের পথেই পড়ে মাড ভলকানো (Mud Volcano) ও লাইমস্টোন কেভ (Limestone Cave)। আর পোর্টব্লেয়ার থেকে রঙ্গতের পথে আদিম অরণ্যে ঘেরা জারোয়া রিজার্ভ (Jarawa Reserve)।
মায়াবন্দর থেকে আরও এগিয়ে আন্দামানের উত্তরতম পয়েন্ট দিগলিপুর (Diglipur)। পোর্টব্লেয়ার থেকে ফেরিজাহাজে বেড়িয়ে আসা যায় আন্দামানের দক্ষিণতম বিন্দু লিটল আন্দামান (Little Andaman) থেকে।
যাওয়াঃ- নিকটতম বিমানবন্দর পোর্টব্লেয়ার। কলকাতা ও চেন্নাই থেকে নিয়মিত উড়ান আসছে। জাহাজঘাঁটিও পোর্টব্লেয়ার। কলকাতা ও চেন্নাই থেকে মাসে বারতিনেক জাহাজ আসে পোর্টব্লেয়ারে। পর্যটন দপ্তরের কন্ডাক্টেড ট্যুরে অথবা বাস বা ভাড়াগাড়িতে পোর্টব্লেয়ারের আশপাশে ঘুরে নেওয়া যায়। ফিনিক্স বে জেটি থেকে ছোট বোটে বা জাহাজে রস দ্বীপ, ভাইপার, নর্থ বে ঘুরে আসা যায়। ছোট জাহাজে পাড়ি দিয়ে যেতে হবে হ্যাভলক ও নীলদ্বীপে। জলপথে বা স্থলপথে রঙ্গত হয়ে মায়াবন্দর পৌঁছান যায়। ওয়ান্ডুর থেকে ছোট বোটে ভেসে পড়তে হবে জলিবয়, রেড স্কিন ও মহুয়াডেরার উদ্দেশ্যে।
থাকা -
পোর্টব্লেয়ারঃ- আন্দামান ও নিকোবর ট্যুরিজম-এর আন্দামান টিল হাউস। আন্দামান ও নিকোবর ইন্ট্রিগ্রেটেড ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড-এর ট্যুরিস্ট হোম মেগাপড নেস্ট। এছাড়া রয়েছে মিউনিসিপাল ধর্মশালা (আবেরদিন বাজার),ইয়ুথ হোস্টেল (নেতাজি স্টেডিয়ামের কাছে),রামকৃষ্ণ মিশন আর পোর্টব্লেয়ার জুড়ে নানান মান ও দামের বেসরকারি হোটেল।
হ্যাভলকঃ- আন্দামান ও নিকোবর ট্যুরিজম-এর ডলফিন রিসর্ট। এছাড়া বেশ কয়েকটি উচ্চমান ও দামের বেসরকারি হোটেল রয়েছে।
নীল দ্বীপঃ- এ.পি.ডব্লু.ডি-র রেস্ট হাউস হাওয়াবিল নেস্ট
মায়াবন্দরঃ- এ.পি.ডব্লু.ডি-র রেস্ট হাউসটিই থাকার জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা। এছাড়া নানা মানের বেশকিছু বেসরকারি লজ আছে।
রঙ্গতঃ- কাট বার্ট বে তেঃ- আন্দামান পর্যটনের হক্সবিল নেস্ট। এছাড়া, এ.পি.ডব্লু.ডি.-র গেস্ট হাউস ও কয়েকটি প্রাইভেট হোটেল আছে।
আন্দামানের এস টি ডি কোডঃ- ০৩১৯২
কেনাকাটা - পোর্টব্লেয়ারে সরকারি এম্পোরিয়াম সাগরিকা ও খাদি এম্পোরিয়াম। এখানে শাঁখ, ঝিনুক, মুক্তোর গয়না ও ঘর সাজানোর নানান জিনিস মেলে। আন্দামানের বিখ্যাত প্যাডক কাঠের ফার্নিচারও এখানে পাওয়া যায়। এছাড়া হস্তশিল্পের আরও দোকান রয়েছে পোর্টব্লেয়ারে।
বেড়ানোর মরসুম - আন্দামান বেড়ানোর সেরা মরসুম নভেম্বর থেকে মার্চ।
ভ্রমণকাহিনি -
কাকাবাবু হেরে গেলেন? || জারোয়াদের দেশে কয়েকদিন || নীল দ্বীপান্তরে || আন্দামানের দিনলিপি || কালাপানির অন্দরমহলে ||
নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (Nicobar Islands)- আন্দামানের দক্ষিণে ২৮টি দ্বীপ নিয়ে উপজাতি অধ্যুষিত নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। দূর্গমতার জন্য এখনো পর্যটকদের কাছে তেমন জনপ্রিয় নয় নিকোবর। বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভারতীয়রা যেতে পারেন। পোর্টব্লেয়ার থেকেই যেতে হবে। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে উত্তরে কার নিকোবর দ্বীপে নিকোবরের সদর দপ্তর। কার নিকোবরের সামান্য দূরে কোরাল দ্বীপ চাওরা। চাওরা ছাড়িয়ে টেরেসা ও কাছাল দ্বীপ। কাছালের পূর্বদিকে নানকৌড়ি (Nankowrie)। একেবারে দক্ষিণে ভারতের শেষ ভূখন্ড নিকোবরের বৃহত্তম গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। গ্রেট নিকোবরের প্রধান শহর ক্যাম্বেল বে। গ্রেট নিকোবরের দক্ষিণতম বিন্দু ইন্দিরা পয়েন্ট।