অযোধ্যা কাণ্ড
লোকেন্দ্র নাথ রায়চৌধুরী
শীতের এক কাকভোরে, খুবই কষ্ট করেই ঘুম থেকে উঠে, লুমু গাড়ি চালিয়ে গিয়ে আমাদের সংরক্ষিত বাসের চালক ও পথপ্রদর্শককে জাগিয়ে রওনার জন্য তৈরি থাকতে বলে এল। ইংরেজি প্রবাদে বলে, নরকের রাস্তা বাঁধান হয় সদুদ্দেশ্যের শানপাথর দিয়ে। অর্থাৎ, লুমু প্রথমেই নিশ্চয় এমন কিছু অমঙ্গলসূচক অযাত্রা করেছিল, যার ফলে যেতে আর আসতে দুদিকেই আমাদের দুর্দ্দশার শেষ ছিল না। বাসে ওঠার পর প্রথমেই জানা গেল, সড়কপথে ওই বাস কোথাও ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের বেশি যেতে পারে না। বুকিং-এর সময় বাস মালিক সগর্বে শুনিয়েছিল, তার এই বাস নিয়ে, এই চালক ও পথপ্রদর্শক নাকি বহুবার পুরুলিয়া গেছে, এসেছে। ক্রমে গড়িয়ে গড়িয়ে কোলাঘাট এসে গেল, শনিবারের বারবেলাও পড়ে গেল, আবিষ্কার হল, চালক বা পথপ্রদর্শক কস্মিনকালে সল্ট লেকের বাইরে পদার্পণ করেনি, তারা শুধুই সল্ট লেকের মধ্যে বাসে করে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে গেছে, ফেরত এনেছে! কোনমতে গুড় গুড় করে আরও খানিকটা পথ পেরিয়ে অবশেষে দিবা দ্বিপ্রহরে এক জনহীন প্রান্তরের মাঝে বাস ঝিমিয়ে পড়ল। কি ব্যাপার? না, টায়ার ফেটেছে।
স্থবির বাস থেকে নেমে কেউ কেউ গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিল। মেরামতির পর গতিবেগ একটু যেন বাড়ল। পাঁচলা, বাগনান, গড়বেতা, বকদহ, ওন্দা, বিশপুরিয়া, সিরকাবাদ ছাড়িয়ে বাস এগিয়ে চলল। শেষপর্যন্ত রওনা দেওয়ার ১০ ঘণ্টা পরে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছান গেল। প্রথম গীয়ারে দিয়েও বাস পাহাড় বেয়ে উঠতে তো পারলই না, বরঞ্চ কয়েকবার বিফল চেষ্টার পর পিছন দিকে গড়াতে লাগল। হ্যান্ডব্রেক মেরে, চাকার পিছনে কাঠের গুটকা গুঁজে সমবেত প্রচেষ্টায় বাসের পিছন দিকে গড়ানো কোনোমতে রোখা গেল। বাজে রাত ৮টা। কেউ কেউ বাস থেকে নেমে পড়ল। বাসে আলোও নেই। অনেকের স্যুটকেসেই টর্চ আছে, কিন্তু সেগুলো বাসের পিছনে স্তুপ করে রাখা আছে, আলো না জ্বাললে খুঁজে পাওয়ার কোন উপায় নেই। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাতাস হিমশীতল। আকাশে অভূতপূর্ব সুন্দর লক্ষ তারার উজ্জ্বল নামাবলী। চারিদিকের জঙ্গল গায়ে কাঁটা দেয়। এটা 'জনযুদ্ধ' সন্ত্রাসবাদী অধ্যুষিত এলাকা, উপরন্তু নাকি পরিযায়ী হাতিদের যাতায়াতের রাস্তা...
নাহ্, জঙ্গলে রাত কাটাতে হয়নি। একটা ট্রেকার পাহাড় বেয়ে নেমে আসছিল। সেটা ধরে, ন্যাড়া আর বুড়ো নিকটতম লোকালয়ে পৌঁছে অন্য কয়েকটা ট্রেকার ধরে আনল। আমরা সেগুলোতে ভাগাভাগি করে পৌঁছালাম সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের পর্যটক আবাসনে। আমাদের মূল সংগঠক ন্যাড়া ও বুড়ো গেল আমাদের নির্দিষ্ট ঘরগুলোর দখল বুঝে নিতে, দীপ ও লোকেন রইল পর্যবেক্ষণের জন্য বাগানে দাঁড়িয়ে। অচিরাৎ সশব্দে একদল রোগা রোগা স্থানীয় মানুষের উদয় হল, ছেঁড়া ন্যাতা কানিই তাদের একমাত্র শীতবস্ত্র। কারও কারও সঙ্গে সাঁওতালী ধামসা, মাদল, কাঁসর, বাঁশী ইত্যাদী। জানা গেল, এরা স্থানীয় সাংস্কৃতিক দল, যদিও মেয়েদের পরনে রঙিন পাড় সাদা শাড়ি নয়, তাদের পরনে শতছিন্ন ফ্রক মাত্র। দারিদ্রের দুর্দ্দশা অতি প্রকট, কিন্তু দলটিতে হাসি ও আনন্দের কমতি নেই। এই অতিথিশালারই অন্য কোন দল এদের ভাড়া করে এনেছে। অতিথিশালার ছাদে কয়েকটা অত্যুজ্জ্বল বিশাল আলো জ্বলে উঠল। গাছের ছায়ার জন্য বাগানের মাটিতে জেব্রার গায়ের মত আলো আঁধারির এক অদ্ভুত সাদা কালো ছোপছোপ। ভারতীয় জাতীয় অভ্যাসমত কিছু প্রাথমিক বিশৃঙ্খলার পর শুরু হল সাঁওতালী নাচ। গেঁয়ো গন্ধ গায়ে মাখা কাঁসি, বাঁশী, ধামসা, মাদলের তালে তালে সে নাচ অতি মনোহর। খানিকক্ষণ সেই আকর্ষণীয় নাচ চলার পরে, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'আগন্তুক' সিনেমা দেখা অত্যুৎশাহী কিছু শহুরে মহিলা তাতে যোগ দিলেন। আর তখনই ব্যাপারটা গেল কেঁচে। তাঁদের কেউ কেউ সালওয়ার কামিজ পরা, কনুইয়ে ঝুলছে ভ্যানিটি ব্যাগ। এমন অসংলগ্নতার হাস্যকর দৃশ্য কমই দেখা যায়। সাঁওতালী নাচের স্বাভাবিক ছন্দ গেল ভেঙ্গে। তাঁদের কতিপয় পুরুষ সঙ্গী হ্যান্ডিক্যাম বার করে সোৎসাহে সেই বিদঘুটে ভগ্নছন্দ নাচের ছবি তুলতে লাগলেন। গাছের তলার ঘন অন্ধকারে আর ছাদের তীব্র আলোর মাঝখানে তাঁরা কী ছবি তুললেন সেটা তাঁরাই জানেন। সেই ব্যর্থ প্রয়াস খানিকক্ষণ দেখার পরে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করলাম।
রাতের আকাশ স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, শহরের মত আলোকদূষণ এখানে নেই। লক্ষ তারা চেয়ে আছে। তারা আর ত্রয়োদশীর চাঁদ মিলিয়ে যা আলো দিচ্ছে, তাতে অতিথিশালার আলোবিহীন পথগুলোতেও হেঁটে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না। আমাদের বিরাট দলের জন্য একটা ডরমিটরি নিয়েছিলাম। তৎসত্ত্বেও আরও দুটো ঘর নিতে হয়েছিল। সে দুটো আবার অন্য বাড়িতে পড়েছিল। আড্ডার জন্য সবাই ডরমিটরিতেই জমায়েত। ডরমিটরির সামনের ছোট বারান্দায় এক পাল কুকুর আমাদের লেজ নেড়ে স্বাগত জানাল। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেভাবে ঘরে ঢুকেই খাটগুলোর তলায় শুয়ে পড়ল, তাতে বোঝা গেল, এটা ওদেরই মৌরসি পাট্টা। বহু অনুরোধ উপরোধ করে, বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে তাদের পুনরায় বারান্দায় ফেরত পাঠান গেল। ক্রমে তাদের বোঝান গেল, তারা বারান্দায় থাকলে বিস্কুট, মাংসের হাড়, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর সবই পাবে, কিন্তু ঘরে ঢুকলে নয়। ডরমিটরির দেওয়াল আর অ্যাজবেস্টসের ছাদের মধ্যে যথেষ্ট ফাঁক। বাইরেটা হিলহিলে ঠাণ্ডা, পরে আবিষ্কার হল, রাতের তাপমাত্রা ছিল ৫º সেন্টিগ্রেড। বাতাস ছাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে ঘরটাকে অচিরাৎ সুমেরুর তাপমাত্রায় পৌঁছে দিল। তার মধ্যেই অভ্যাসমত চিত্রিতা ঠাণ্ডা জলে স্নান সেরে ফেলল। ছেলেপুলেদের উৎসাহে আর ঠাণ্ডা কাটাবার জন্য, ঘরের মধ্যে উদ্দাম নৃত্য শুরু হল, বাচ্চা থেকে বড় কেউই বাদ গেল না। কাছেপিঠে কেউ নেই, তাই নৃত্যের অনুসঙ্গ হিসাবে রেকর্ডারে তারস্বরে গান, বাজনা বাজালেও কারো কিছু বলার নেই।
পরদিন সকালে কিছু স্থানীয় অনুসন্ধানের পর এক 'Hill Top Hotel' আবিষ্কার হল। তারা বেশ দক্ষতার সঙ্গেই আমাদের বিরাট দলের প্রাতরাশটা পরিচালনা করল। হোটেলের চেহারা যাই হোক, খাবার ভাল আর দাম এত ভাল, যে ন্যাড়ার মুখেও হাসি ফুটল। ঠিক হল, বাকি দিনগুলোয় এই হোটেলেই খাওয়াদাওয়া হবে। ভালো করে চা-টা খেয়ে, আমরা বেরোলাম আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য কী কী আছে দেখবার জন্য। মনোহর সাঁওতালী গ্রাম, ধানের বীজতলা আর ঢেউখেলানো সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ দেখে যাত্রার যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে কুটিরগুলোর দিকে নজর পড়ল। কোনো কোনোটার দরজাই নেই। সামনে গরু, কুকুর ঢোকা আটকাতে আগড় দেওয়া, কোনোটাতে চ্যাঁচারির দরজা, দড়ি দিয়ে রাত্রে বাঁধা থাকে। কুঁড়ের বাইরে চালের নীচে দুটো করে বাঁশ আড়াআড়িভাবে বাঁধা, তার ওপরে কিছু মাটির হাঁড়ি আর বাঁশ থেকে সামান্য দু'একটা কাপড় ঝুলছে। গ্রামের রাস্তা, কুঁড়ের পাশে উঠোন সব একদম পরিষ্কার করে নিকানো, কোথাও কোন আবর্জনা নেই। কুঁড়ের ভিতরে উঁকি দিলে আশ্চর্য্য হতে হয়। ভিতরে কিচ্ছু নেই। এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর অনাড়ম্বর জীবন দেখে অবাক হলাম। লজ্জা হল, আমাদের জীবনে কত কিছুই না লাগে, এদের কিছুই নেই, কিছুই লাগে না। কয়েকটা কুঁড়ের চালের নীচে পোষা পায়রার জন্য সার দিয়ে কাঠের বাক্সের বাসা। যে পায়রাগুলো বসে পালক পরিষ্কার করছে, তাদের চেহারায় কোন অনাহারের চিহ্ন নেই, বরং বেশ কোঁতকা। হতে পারে, এই সব পোষ্য পায়রারা অসময়ে গৃহস্থের প্রোটিন-এর প্রয়োজনও মেটায়।
হাঁটার পক্ষে যে সব জায়গাগুলো একটু বেশি দূর, সেগুলো দেখার জন্য পরদিন সকালে দুটো ট্রেকার ভাড়া করা হল। দ্রষ্টব্যের মধ্যে ছিল বামনী (ব্রাহ্মণী) জলপ্রপাত, তুঙ্গা জলপ্রপাত, তুরগা বাঁধ, বাঘমুণ্ডি ও সাহেব বাঁধ, বাঁধঘাটু ইত্যাদি। এখানে এক বিশাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হতে চলেছে। দানবীয় সব মাটি কাটার যন্ত্র সগর্জনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতিকায় সব লোহার কাঠামো আর মোটা মোটা লোহার নল ঝালাই করে জোড়া দেওয়া হচ্ছে। নলগুলো পরে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হবে। অযোধ্যা পাহাড়ে না ছিল কোন সাধারণ ফোন, না ছিল কোন সচলভাষের মিনার। এখানে দুইই আছে, সবাই তড়িঘড়ি ইতিউতি ফোন সারতে লাগল। দূর থেকে ময়ূর পাহাড়ের উচ্চতা দেখে সেটা বেয়ে ওঠার শখ মিটে গেল। গড়জয়পুরও যাওয়া হল না, যদিও বুড়োর বেড়ানোর ফর্দ্দের মধ্যে তার নাম ছিল। ফেরবার পথে আমরা চড়িদা গ্রামে একটু থামলাম। কেউ কেউ ছৌ নাচের মুখোশ কিনল। ডরমিটরিটা বড্ড ঠাণ্ডা বলে সেটার বদলে শেষের রাতে আমরা বড় বাড়িটায় কয়েকটা ঘর নিয়ে নিলাম। ঘরগুলো অত বেশী ঠাণ্ডা নয়। পরের দিন সকালে একটা ট্রেকার এসে, কয়েক খেপে মালপত্র শুদ্ধ আমাদের অযোধ্যা পাহাড় থেকে সিরকাবাদে নামিয়ে আনল। সিরকাবাদে আমাদের সেই কুখ্যাত বাস অপেক্ষা করছে, সেটা নাকি এর মধ্যে সারানো হয়েছে!
যাত্রা শুরু হতে না হতেই বাস আবার কেতরে পড়ল। সৌভাগ্যবশত সামনেই এক গ্যারাজ, যদিও অতি পাতি। মেরামত শেষ হবার আগেই আবিষ্কার হল, কাছেই এক মেলা চলছে, যেখানে সস্তায় বালুচরী আর স্বর্ণচরী শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। উদ্বিগ্ন ন্যাড়া এক চোখ রাখছিল গাড়ি সারানোর উপর, আরেক চোখ মহিলাদের উপর, যাতে তাঁরা না মেলার দিকে পালান। ব্যাপারটা কেঁচিয়ে দিল বরুণ। কোত্থেকে ঘুরে এসে চাউর করল, কাছেই অনেক ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে আছে, প্রদর্শনীর মাঠ মাত্র ১০ মিনিটের পথ, ভাড়া ৩ টাকা। বুড়ো চেষ্টা করল, যাতে কথাটা ঘুরে যায়। সামনেই নারকোল গাছ থেকে কয়েকটা ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসা দেখিয়ে তাদের বাসা তৈরির অপূর্ব শিল্পশৈলীর প্রশংসা করে এক দীর্ঘ ও বিজ্ঞ ভাষণ শুরু করল। বাস্তবানুগ বর্ণনার খাতিরে, বুড়ো একটা পাখির বাসার খোঁজ শুরু করল। মাটিতে পড়া একটা থ্যাঁৎলানো বাসা পেয়ে লোকেন সন্তর্পণে তার একটা শুঁয়ো ধরে তুলে এনে বুড়োকে উপহার দিল। দু হাতে সেটাকে ভাল করে ধরে, বুড়োর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দ্বিগুণ উৎসাহে চলল। যখন প্রকাশ পেল, ভাঙা বাসাটা মাটিতে কুকুর ও মনুষ্য মূত্রের কাদায় এতক্ষণ পড়ে ছিল, তখন প্রবল গণ আন্দোলনের ফলে বুড়ো সেটা বর্জন করতে বাধ্য হল। এর মধ্যেই কিছু মহিলা মেলায় চলে গিয়েছিলেন। সুবিধামত কিছু না পেয়ে ভগ্নমনোরথ হয়ে তাঁরা ফিরে এলেন। আবার নতুন উদ্যমে বাস রওনা দিলে রাত পৌনে বারটা নাগাদ আমরা কলকাতায় বাড়িতে পৌঁছালাম।
চাকরিজীবনের শেষে আপাতত অবসরই পেশা লোকেন্দ্র নাথ রায়চৌধুরীর। আর নেশা বেড়ানো, বই পড়া, ছবি তোলা, কলেজ সহপাঠীদের সঙ্গে আড্ডা মারা।