অরণ্যের রূপকথারা
কাঞ্চন সেনগুপ্ত
~ ডুয়ার্সের তথ্য~ ডুয়ার্সের আরো ছবি ~
ডেস্টিনেশন ডুয়ার্স! মন আনচান করা মনসুনেই আমরা রওনা হলাম জঙ্গলের টানে। আমরা – আমি নোয়েল, আমার সঙ্গিনী ব্রুনি, ব্রুনির বান্ধবী র্যাচেল আর তার বয়ফ্রেন্ড স্যাম এবং আরেক বন্ধু পল। চোদ্দই অগাস্ট, ২০১৩, রাতের শিয়ালদা স্টেশন ছেড়ে রেলগাড়ি ঝমাঝম। সবাই বাড়ি থেকেই পেটপুরে লুচি-আলুরদম। আলগোছে কিছু কথা। তারপর যে যার বার্থে ঘুমঘুম . . .। ঠিক তখনই বৃষ্টি শুরু - ঝুমঝুম-ঝিমঝিম। খোলা জানলা গ'লে ঘুমের ভেতরেও খানিক টুপটাপ টপটপ. . .। রিনরিনে মিহি ঠাণ্ডা হাওয়ার মায়াতে মাথা না পেতে, রেলকোম্পানির ঝাঁঝরিকাটা লোহাসিরিয়াস জানলা ধরে টান - ধুপধাপ ধুপধাপ। বাইরে তখনও ঝুমঝুম-সন্সন্ . . . লেটগাড়ি ঝমাঝম . . . সারারাত ঘুমঘুম . . . . . .।
নতুন সকালে যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঝোলা নিয়ে নামলাম তখন ভারতীয় সময় মাফিক সাড়ে ন'টা। পরের চারটে দিন যেন বয়ে গেল আমাদের ডুবিয়ে ভাসিয়ে হাসিয়ে . . . একেবারে-এ-এ-এ তলিয়ে গিয়ে স্বপ্ন-স্বপ্ন ঘোরের গভীর থেকে পাড়ে জেগে উঠে দেখি; ঠিক পেয়ে গেছি সেই আশ্চর্য ঝিনুক, যার ভেতরে জমা আছে সেই দুর্লভ – মেমোরিzzzz।
এবারের ট্যুরের সবটা ব্যাখ্যা করতে পারব বলে মনে হয় না। কোথাও বাস্তবের চৌহদ্দিতে হঠাৎ স্বপ্নের বেপরোয়া হানাদারি, আবার অতর্কিতে আলো-আধাঁরি স্বপ্নের পাতলা আস্তরণ ফুঁড়ে রিয়েলিটির চরম টর্চলাইট। এ কি পরাবাস্তব না মারিজুয়ানা! এ কী কাণ্ড বলো দেখি! NJP-তে নামতেই দেখি মিষ্টি মেয়ে ডেইজি দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষায় আমাদের। দেখে ভালো লাগল, ঠিক আগের মতোই স্বতঃস্ফুর্ত ও প্রাণোচ্ছল আছে ও! বছরের এই সময়টা এখনও কোনো না কোনো জঙ্গল-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়! সে কাহিনির বিস্তারে যাব না। প্রজাপতি, পোকা-মাকড় ও ক্ষ্যাপা-বাইসনের মতো পাহাড়ি ঝোরার আসক্তি ডেইজিকে ক্রমশঃ আরো ধাঁধালো করে তুলছে আমাদের কাছে। আপাতত এখান থেকে ডেইজি আমাদের সঙ্গে। গন্তব্যের গাড়ি অপেক্ষায়, মাল তোলা চলছে। এসবই প্রত্যাশিত। এই ট্যুরে আমাদের স্থান, যান, অভিযান, খানা-পিনা এসব যিনি অলক্ষ্যে থেকে পরিচালনা করে চলেছেন, পল বলে দিয়েছিল তাকে যেন আমরা ব্রো নামে ডাকি। ডুয়ার্সের এ-তল্লাটের গাছেরা হাওয়ায় মাথা দোলালে ধ্বনিত হয় চলমান অশরীরির নাম ---- ব্রো ... ব্রো ... ব্রো (অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ)। স্টেশনেও দেখা মিলল না ব্রো-এর। পাঠিয়ে দিয়েছে স্থানীয় একজনকে আন্তরিক আতিথেয়তার সৌজন্যে। প্রথম যখন পরিচয় হল শ্রীযুক্তকলপল্লবিতবিহঙ্গসুখ মহাশয়ের সঙ্গে, আমরা নিঃসংশয় হলাম, এ ট্যুর হতে চলেছে চমকের 'চাঁদের পাহাড়'। আমরা ঠিক করে নিলাম ওনাকে আমরা সুখ নামে ডাকব। গাড়ি চালু হোতেই সুখ হাতে হাতে বিলি করে দিল সকালের নাস্তা। অভাবনীয়! জলপাইগুড়ির মসৃণ-বন্ধুর রাস্তা ধরে গাড়ি চলল আমবাড়ি - গজলডোবা - ক্রান্তি হয়ে মুর্তির পথে। ডেইজি বলল, বাইপাস ধরেছি। স্টিয়ারিং-এ চালক পাহাড়ি। শুকনো রুটিন থেকে নিঃসারে চারপাশ নরম হতে না হতেই শহুরে চিনা-মাটির ছাঁচগুলো ভেঙ্গে-খসে পড়তে লাগলো গা থেকে। ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল টাটকা আদিম 'আমি'গুলো। হাসি-ঠাট্টা-খুনসুটিতে হোটেলে পৌঁছলাম বেলা সাড়ে বারোটা। রিসর্ট মূর্তি রেসিডেন্সি।
মনোমোহিনী মূর্তি নদীকে ডানহাতে রেখে বাঁ-দিকে ছোট্ট বাঁক নিতেই সামনে আদিগন্ত সবুজ গালিচার মাঝে হলুদ ড্যাফোডিলের মতো ফুটে আছে একচালা-দোচালার সুখনিবাসগুলি - আগামী দুদিনের জন্য আমাদের খাসতালুক। এখানেই প্রথম দেখা পেলাম চলমান অশরীরির। নাম-পরিচয় নয়, প্রথমেই জানতে চাইলেন, 'রাস্তায় হাতি পেলেন?' একঝলক হতাশ মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিলেন, 'আছেন তো আমার সঙ্গে, পেয়ে যাবেন'। হোটেল-রুম, ডাইনিং, ম্যানেজারবাবু, আর কলিন, কোয়াককে (ওরা কিন্তু রাজহাঁস) পেয়ে অলরেডি আমরা আটখানা! ঠিক তখনই ডেইজি পেশ করল আরেক চমক, পাহাড়ি স্কোয়াশ, বাতাবি লেবুর খোসা-কুচি, শুকনো গাঁজা পাতা, আর অজানা আরো কী -একটা দিয়ে বানানো ওর নিজস্ব রেসিপি। তার যে কি সোয়াদ সে যে-না খেয়েছে তাকে বোঝানো আমার কম্মো নয়। বলল, লাদাখ গিয়ে এইরকম কিছু চেখে দেখেছিল। ওখানকার লোকেরা অবশ্য ইয়াকের দুধ দেয় সামান্য। তাতে অল্প কষাটে গন্ধ হয়। ফিরে এসে ও নিজের মতো কিছু অদল-বদল করেছে এতে। নিমেষের মধ্যে চেটে-পুটে সাফ এক পেল্লায় টিফিন বক্স। স্ট্রিক্ট ডায়েটে থাকা র্যাচেলও আমাদের টিটকিরি গায়ে-না-মেখে তার বাহারি নেল-পালিশ শোভিত অতি যত্ন-লাঞ্ছিত সূঁচালো নখর-সম্বলিত সুললিত তর্জনীটি চাটিয়া চাটিয়া এমত অবস্থার অবতারনা করিয়াছিল, যে স্যাম আমায় জনান্তিকে ডাকিয়া অতি সন্তর্পণে কানে কানে বলিয়া ফেলিল, 'এনগেজমেন্ট রিংটা ভাগ্যিস ঐ আঙ্গুলে পড়ায় না, তা না হোলে অ্যাতোক্ষণে পেটে . . .'। কোনোমতে হাসি চেপে আমি কথা ঘোরালাম। ডেইজির কাছে জানতে চাইলাম এই উপাদেয় মলম মলম খাদ্যটিকে কি-নামে ডাকব! ডেইজি স্বভাবগত তৎপরতায় জবাব দিল, 'স্থানীয় নাম জানি না, তবে লাদাখ থেকে শিখে এসেছি যখন, একে লে-হালুয়া বলতে পারো'। হাল্কা হাসির খোলামকুচি ছড়াতে ছড়াতে পুরো দলটা গেলাম লাঞ্চ সারতে। সাদা-মাঠা ডাল-ভাত-ভাজা আর মাছের ঝোল, তাই যেন অমৃত। খাওয়া শেষ হতে না-হতেই দেখি গাড়ি রেডি। বুনো মোষের মতো গর্গর্ করতে থাকা জিপটি গর্জন করে রিসর্টের গেট পেরোনোর পর পিছনের দরজাটা টেনে দিলাম। আমরা চলেছি সামসিং হয়ে সান্তালেখোলা।
স্থানীয় ভাষায় 'খোলা' শব্দের অর্থ 'ঝোরা' - সৌজন্যে সেই ডেইজি। আর সান্তারা থেকে অপভ্রংশ সান্তালে বা সুনতালে। কমলালেবুর বাগান রয়েছে। তবে বর্ষায় কমলালেবুর এক টুকরো খোসাও দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। খোসা না হোক আমরা দেখলাম 'খোলা' - বর্ষায় সেই ঝোরা তখন মত্ত হস্তিনী ; পাথরে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে তার মত্ততা যেন বলগা ছাড়া। ঝোরার ওপর যেইখানটায় কাঠ আর লোহার তার দিয়ে ঝুলন্ত পুল টানা আছে, ঠিক তার ওপারটায় পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে এক পেল্লায় পাহাড়। ওপারে যেন আর যাওয়ার উপায় নেই, অথচ পুলটা যেন সমানে হাতছানি দিয়ে ওপারে ফুসলাচ্ছে। হাতে রইল পুল আর আমরা সড়াৎ নেমে গিয়ে ঝোরার গা-ঘেষে দাঁড়ালাম। পাথরে পাথরে পা রেখে এই প্রবল পাগলামির একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াবার সাধ। ঠিক এইসময় হাওয়া বেজে উঠল দামামার তালে (অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ)। মাথা তুলে দেখি পুল পেরিয়ে ওই পাহাড়ের দিক থেকে লোকালয়ের দিকে চলেছে গুরান, সঙ্গে গোটাচরেক জঙ্গলা মানব-শিশু ও একটা গাধা প্রজাতির জন্তু। যেতে যেতে বলে গেল, 'ওহে বুটিক-স্যাভি সিটিজেন, অতো কায়দা ভালো নয় এখানে, ঘোলা জলে ভেসে চলে আসছে গভীর অরণ্যের বুভুক্ষু জোঁকের দল।' পরিষ্কার বাংলায় বলল, সত্যি! বলতে বলতে মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে। আমরা তড়িঘড়ি ব্রিজের ওপর, কিন্তু পল-কে আটকানো গেল না। নাচতে নাচতে নেমে গেল শ্যাওলা ধরা পাথরে। পেছন পেছন গেল ডেইজি ছবি তুলবে বলে।
আমরা গুটি গুটি পুল পেরিয়ে এগোতে লাগলাম অজানাপুরীর দিকে। হাতে নামমাত্র ভাঙা ছাতা। রাস্তা শেষ হোলো যেখানে, দু'মানুষ সমান এক লোহার দরজা। আমরা খুব অবাক হোলাম দেখে, সেই দরজার ওপর ভাঙ্গা-চোরা-চল্টা ওঠা ইংরাজি হরফে লেখা আছে, 'হার্বাল ম্যাসাজ অ্যাভেলেবেল'। এ-ওর দিকে তাকালাম আমি আর স্যাম। স্যামের চোখ জোড়া চকচক করতে দেখলাম। পিছন থেকে পলের গলা শোনা গেল, 'ইংরেজদের সাথে সাথে ওসব বিলিতি কেতাও বিলেত গেছে। ব্রিটিশরা লন্ডন গেল এসব অ্যাবান্ডন করে দিয়ে। চলো দেখি হার্বাল-টি পাওয়া যায় কীনা ভেতরে গিয়ে দেখা যাক।' বৃষ্টি তখনও পড়ছে। আমরা সবাই কমবেশি ভিজেছি। দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে পাহাড়ে। প্রস্তাব মন্দ নয়, তবে এই নিশ্চিহ্নপুরে কে আমাদের জন্য চায়ের পেয়ালা হাতে অপেক্ষায় থাকবে! নজরে এলো মায়াবী আমন্ত্রণের মতো গেটটা অল্প ফাঁক। ঠেলে ভেতরে ঢুকে প্রথমেই মনে হোলো চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা কোনো শয়তান ডাইনির আস্তানায় এসে পড়েছি। উঁচু ইমারত, কারুকাজ করা জানলা-দরজা, কেয়ারি করা বাগান, মাঝখান দিয়ে আলতো পায়ে চলা পথ এমন শুয়ে আছে যে তুমি না-হেঁটে পারবে না। আর ঠিক তখনই দেখলাম বাঁ-পায়ের গুলিতে ধরেছে জোঁক। বলতেই অভ্যস্ত হাতে সটান ছাড়িয়ে নিল ডেইজি। চুঁইয়ে সামান্য লাল দাগ। পল তৎক্ষনাত কাগজের টুকরো দিয়ে আটকে দিল ক্ষতের মুখ। একবার মনে হল ফিরে যাওয়া যাক। অথচ ভাবতে ভাবতেই মোহাবিষ্টের মতো এগিয়ে গেলাম বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণের ঘরটার দিকে। ঘরটার শার্সি গ'লে আলোর আভা ঠিকরে পড়ছিল ভেজা সরু পথটার ওপর। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম এক প্রস্থ ডাইনিং হল্, যার লাগোয়া আরেকটি ঘর আছে, সম্ভবত কিচেন। ভেতর থেকে হাল্কা আওয়াজ ভেসে আসছে - কথা বলার শব্দ। ইতস্ততঃ করতে করতে ঢুকলাম, উঁকি মেরে দেখি চারজন বামন বেশ উঁচু গোল গোল গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো টুলে বসে গল্প করছে। আমাকে এক ঝলক দেখে চোখের নিমেষে গাছের গুঁড়ির টুল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ওরা রান্নাঘরে ছড়ানো কিছু আসবাবের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। একজন পালিয়ে গেল রান্নাঘরের অন্য একটা দরজা দিয়ে। আমাদের বাকীরা সবে ছাতা ঝেড়ে বসেছে ডাইনিং রুমের এক কোণে রাখা একটা বেশ বড় ডাইনিং টেবিলকে ঘিরে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রান্নাঘরের দরজায়। আশা করছি ভয় কাটিয়ে ওরা বেরিয়ে আসবে। এলো, তবে সেই লোকটি, যে পালিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে নিয়ে এলো তার থেকে সাইজে বড় একটা বল্লম। সোজা ধরল আমার কন্ঠনালী বরাবর। আমি একমুহূর্ত চিন্তা করলাম তারপর গা থেকে ভেজা গেঞ্জিটা খুলে ফেললাম তুরন্ত। এতে কাজ হোলো। ওরা জানে শহরের মানুষ কোমরে গুঁজে রাখে অস্ত্র যা দিয়ে আগুন বেরোয়। আমায় ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝল আমি কারোর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আসি নি। বল্লম নামিয়ে নিল। ততক্ষণে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্যাম। ভেজা গেঞ্জি নিংড়ানোর জন্য ও একটু আগেই খুলেছে গা থেকে। সুতরাং কোনো বিপদ ঘটল না। এতক্ষণে গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই। বললাম, 'চা পাওয়া যাবে?' সবাই চুপ। বুঝলাম গুরান ছাড়া এরা কেউ বাংলা জানে না। হাতের ইশারায় বোঝাতে হোলো। স্যাম সাইন ল্যাংগোয়েজ জানে। অনেক চেষ্টায় সফল হয়েছে বলে যখন মনে হচ্ছে তখন একজন হঠাৎ এক খাবলা নুন এনে স্যামের দিকে ছুঁড়ে মারল। রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম আমরা। পলরা ছুটে এলো। তারপর দেখা গেল স্যামের পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আমরা কেউ খেয়াল করিনি কখন জোঁক ধরেছিল! অবস্থা স্বাভাবিক দেখে আমরা টেবিলে গিয়ে বসলাম। একটু পরে বাঁশের গুড়ির খোদল কাটা পেয়ালায় এলো গরম চা, সঙ্গে পেঁয়াজির মতো কী একটা। খেতে বেশ ভালো। ওরা যে এমন ভাজতে জানে এটা ধারনায় ছিল না। অবাকই হলাম। ডেইজি বলল, 'গুরান শিখিয়েছে নিশ্চয়ই'। বাইরে প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। এই পরিবেশ দারুণ লাগছিল তবু অন্ধকার ও জোঁকের ভয়ে তাড়াতাড়ি চা শেষ করে উঠে পড়লাম। বেরোবার আগে স্যাম একজনের হাতে একটা একশ টাকার নোট ধরালো। সে নোট টাকে উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলো। র্যাচেল বলল, 'পড়তে জানে?' ব্রুনি ফোড়ন কাটল, 'আসল কিনা দেখে নিল'। পুল পেরোনোর সময় আবার গুরানের সাথে দেখা। বাচ্চাদের নিয়ে ও ফিরছে। পল বলে উঠল, 'বিদায় বন্ধু'। গুরান আলতো হেসে জানতে চাইল, 'পেঁয়াজি খাও নি তো'! সকলে একসঙ্গে 'কেন' বলে উঠলাম। মিচকি হেসে গুরান বলতে বলতে হাঁটা লাগালো, 'ওটা ডেঁয়ো পিঁপড়ের ডিম ভাজা'। স্যাম চেঁচিয়ে উঠল, 'আমরা যে একশো টাকা দিয়ে এলাম'। গুরান দূর থেকে চেঁচিয়ে উত্তর দিল, 'তাহলে এতক্ষণে ওরা তামাক পুরে বিড়ি বানিয়ে ফুঁকে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি গেলে আমি কাউন্টার পেতে পারি'। আলো তখন ভালোমতো মুখ লুকিয়েছে দানব-পাহাড়ের আড়ালে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাড়ি পর্যন্ত এলাম। চালক পাহাড়ি জানতে চাইল, ঝোরার ওপারে যে সরকারি গেস্ট-হাউস আছে পাহাড়ের কোলে দারুণ সুন্দর, অতদূর আমরা গেছি কিনা! বর্ষা বলে বন্ধ। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে নাকি ভিড় বাড়তে থাকে। আমরা এ-ওর মুখ চাওয়া-চায়ি করলাম। পল তাড়া দিল, 'গাড়ি ঘুমাও'! চালক পাহাড়ি সাঁ-সাঁ গাড়ি ছোটালো। রিসর্টে পৌঁছে আরেক কাপ করে কফি আর খাঁটি পেঁয়াজের পেঁয়াজি সহযোগে সান্ধ্য চা চলছে যখন, গুরানের শেষ রসিকতার রেশ তখনো রয়ে গেছে আমাদের হাসিতে।
পাহাড়, বৃষ্টি, হাতি এসব নিয়ে আড্ডা গড়ালো রাতের খাওয়ায়। বাইরে তখন বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। সারা আকাশ ঘন মেঘে অন্ধকার। গল্পের সাথে মেখে নিয়েছি রূপকথার মতো গরম গরম হাত-রুটি আর দেশি মুরগির মাংস। সেই রাতেই ঠিক করা গেল পরের দিন সকালের নাস্তা সেরেই মূর্তি নদীতে স্নান আর লাঞ্চের পর ধাওয়া করব বন্য জীবন গরুমারা পর্যন্ত। গণ্ডা চারেক রুটি আর কেজি খানেক মাংস সাঁটিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে যখন বুড়ো আঙ্গুলের মাথা থেকে আচারের শেষটুকু চেটে নিচ্ছি, ম্যনেজার বাবু অস্ফুটে বলে গেলেন, 'কপাল ভালো থাকলে হোটেলের হাতায় হাতি এসে দেখা দিয়ে যাবে আপনাদের। রাতে সজাগ থাকবেন'। উৎফুল্ল হব না ভয় পাব এই দোটানায় হাত চাটতে চাটতে শুতে গেলাম। ব্রুনির গলায় স্পষ্ট ভয়, 'উঠোনে হাতি আসে তো জানলাগুলো কাঁচের বানিয়েছে কেন! তার ওপর একটাও লোহার শিক দেয় নি! কী হোটেল রে বাবা! 'আমি যোগ করলাম, আমাদের আবার একেবারে ধারের কটেজ!' ব্রুনি ঘটাং করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ক্রমাগত বৃষ্টিতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল তাই আলগোছে কম্বলটা গায় টেনে নিতে আমারও চোখে ঘুম নেমে এলো।
হাতি তো হাতি, দূর দূর তক্ হাতির নাদেরও কোনো চিহ্ন পায় নি ডেইজি ও পল। ওরা সাত-সকালেই নদীর ধারে হাঁটতে গিয়েছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম স্যাম ও র্যাচেলও এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। কলিন আর কোয়াককে বাগানময় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে পল। আর ডেইজি তার ফটো তুলে চলেছে। সারারাত বৃষ্টির পর দারুণ ঝকঝকে একটা সকাল হয়েছে। হাল্কা সাদা তুলোর মেঘের বুটিদার ঘন নীল জমিনের কাপড় পড়েছে আকাশটা। ঝলমলে রোদ্দুর কলিনের সাদা ডানায় এমন চমকাচ্ছে যে বারবার ডেইজিকে এক্সপোজার অ্যাডজাস্ট করতে হোচ্ছে। এরই মধ্যে চা এসে গেল সঙ্গে নানান রকম বিস্কুট ও ভুজিয়া। এমন সুন্দর সকালে, যতদূর চোখ যায় হাল্কা-ঘন সবুজের ঘেরাটোপে, কটেজের হাতায় বন্ধুদের সান্নিধ্যে বসে চায়ের আমেজ নিচ্ছি, অলস সময় বয়ে যাচ্ছে আলতো বিলি কেটে। স্বর্গচ্যুত শাপভ্রষ্ট দুই দেবকন্যা দুটি অপাপবিদ্ধ রাজহাঁস হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে পায়ের কাছে। একে বাস্তব বলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। অ্যাতো ছিল সৌভাগ্যে! ঘোর ঘোর মেজাজে কাঁধে গামছা ফেলে চললাম নদীর দিকে। নদীর পার ধরে দূরের পাহাড়ি গ্রামে চলে যাওয়া রাস্তায় উঠে এলাম দু'মিনিটেই। রাস্তাটা সোজা দিগন্তের কাছে গিয়ে আবছা পাহাড়ের কোলে মিলিয়ে গেছে। আমি আর পল ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লাম। আমাদের আগে ডেইজি ফিনিশিং লাইনে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়ালো। দৌড় শুরু হলো - ফটো তোলা হলো - দৌড় শেষ হলো - ১০০ মিটার হলো কীনা কেউ মেপে দেখে নি। এরপরই আমরা একে একে হাত ধরাধরি করে নেমে গেলাম মূর্তির জলে। পাড়ের দিকে তুলনামূলক বড় পাথরে পায়ে লাগছিল। নদীর মাঝ বরাবর যেতেই পাথর প্রায় নুড়ির সাইজের হয়ে গেল। বর্ষার নদীতে খুব স্রোত। অথচ কোথাও গোড়ালি কোথাও হাঁটু কোথাও কোমর তো কোথাও ডুব জল। স্যাম আর ডেইজি আমাদের মধ্যে সাঁতার এক্সপার্ট। পলও ভালোই জানে। ওরা বহতা জলে গা ভাসিয়ে ফুর্তি করতে লাগল, আর আমি, ব্রুনি ও র্যাচেল এক জায়গায় কোমর জলে গা ডুবিয়েই খুব মজা পাচ্ছি ভাব দেখালাম। স্যাম আলাদা ভাবে আমাকে, ব্রুনিকে ও র্যাচেলকে সাঁতার শেখাবার চেষ্টা করল, তবে সেটুকু শেখার মতো আয়াস বা আগ্রহ কারোর মধ্যেই দেখা গেল না। ঘন্টাখানেক যে-যার মনের খুশিতে গা-ভাসিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঠিক মাঝনদীতে কোমর ডুবিয়ে গোল হয়ে বসলাম এক অভিনব আড্ডায়। আমি আর স্যাম বসেছি উজানের দিকে মুখ করে। বসেছি বলা ভুল, স্যাম বুদ্ধি দিল - কোলের কাছের কোনো পাথর যেটা জমাট করে পোঁতা আছে, সেটা দু'হাতে ধরে বাকি শরীর স্রোতে ভাসিয়ে দে। সাঁতার না জানলেও এটা করতে অসুবিধা হলো না। আর তারপর আরও ঘন্টা দুয়েক কাটিয়ে দিলাম জলে। সামনে থেকে ধেয়ে এসে আমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদীর শীতল জল। ডানপাশে জঙ্গল, এতোই কাছে যে কোথাও কোথাও জলে ছায়া পড়েছে তার। বাঁ-পাশ দিয়ে সেই সরু রাস্তা আর ছবির মতো কিছু কটেজ। এছাড়া শুধুই ধানি জমি। কচি-গাঢ় সবুজের কার্পেট। আরো দূরে আবছা হয়ে যাওয়া পাহাড়ের ছায়ায় ছোট গ্রাম - এ দৃশ্যকল্প স্বপ্ন ছাড়া আর কী! বেলা বাড়ছে, মাথার ওপর সূর্য, এবার ওঠা যাক। জল থেকে উঠে আসছি হঠাৎই মাথায় এলো ফটোসেশান করার। এমন মার্ভেলাস ব্যাকড্রপ আর ডেইজি, র্যাচেলের মতো মারকাটারি মডেল থাকতে এ-সুযোগ হেলায় যেতে দেওয়া যায় না। নিমেষে মূর্তির জলে বয়ে গেল আরও আধ-ঘন্টা।
দুপুরের খাওয়া সেরে আবার গাড়ির সামনে জড়ো হয়েছি। মাঝের সিটের জানলার ধারে বসা নিয়ে র্যাচেলের সঙ্গে ব্রুনির তুমুল ঝগড়া বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠল। ওরা একে অপরকে 'বেগুনি জেলিফিশ', 'অক্টোপাসের ডান-বগলের ঘা' ইত্যাদি বলে গালাগালি দিতে থাকল। আমি হাল্কা মনে আবার পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম চোখে রোদচশমাটা দিয়ে। গন্তব্য গরুমারা।
এর পরপর বেশ কিছু 'জানি না কেন' ঘটনার অবতারনা হবে। গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের টিকিট কাউন্টারে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর আড়াইটে। সকাল ৬ টা থেকে দফায় দফায় গরুমারা জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার টিকিট পাওয়া যায়। দুটোয় এক রাউন্ড জঙ্গলে ঢুকে গেছে। এখানকার নিয়ম মাফিক আমরা ঢোকার অনুমতি পাব বিকেল সাড়ে চারটে। এব্যপারে সুখ আমাদের কিছুই জানায়নি আগে, 'জানি না কেন'! কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমরা ঘ্যানঘ্যান করতে করতে পাশেরই এক অনামা চা-বাগান দেখতে গাড়ি ছোটালাম, 'জানি না কেন'! চা-বাগানের থেকেও বেশি উৎসাহ ছিল চা কিভাবে প্রোসেস হয় কারখানায় ঢুকে তা দেখার! সৌভাগ্যবশতঃ সেই কারখানায় সেদিন ছুটি ছিল, 'জানি না কেন'! দুর্ভাগ্যবশতঃ একজন সিকিউরিটি গার্ড বসে আরেকজনের সঙ্গে গ্যাঁজাচ্ছিল। পড়ে গেল আমাদের খপ্পরে। বাহাদুর বা সজ্জন সিং সুবেদার নয়। না তার মোটা মোচ, না হাতে গাট্টা-গোট্টা লাঠি। স্থানীয় বাঙালি এক যুবকের সঙ্গে আমরা হিন্দিতে বাক্যালাপ শুরু করলাম, 'জানি না কেন'! যা-হবার তাই হোলো, নিয়মের পাক্কা মুখচোরা গার্ডটি বাধ্য হয়ে তার উর্দ্ধতন এক কর্মচারীকে ডেকে নিয়ে এলো আমাদের দোরে দাঁড় করিয়ে। আর সেই ওপরওয়ালাটি অল্প কথায় আমাদের নিয়ে হাফ বন্ধ মিলটা পুরো ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিলেন 'জানি না কেন'! শেষে তিনি আমাদের আগামীকাল আবার আসার অনুরোধ জানালেন, চালু মিল ভালো করে দেখিয়ে দেবেন। অথচ আমরা নিরুপায়। আমাদের আছে শুধু এই সময়টুকু। 'কবে-কখন-কোথায়-কেউ জানে না' ফিলোজফিতে জারিত আমরা ক'জন হই হই করে ঢুকে পড়লাম ফাঁকা চা-বাগানে। ঘুরে-ফিরে, দু-একটা ছবি তুলতে না তুলতেই আকাশের মেঘ গলে ফোঁটা ফোঁটা শুরু হোলো, আর আমরাও তড়িঘড়ি গাড়িতে ফিরে এলাম। আমরা গাড়িতে রেডি। ওমা! পল নেই। সামনেই রেঞ্জারের আফিস। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গেছে রেঞ্জারের সঙ্গে ভাব জমাতে। 'জানি না কেন'? ও ফিরে এলে চালক গাড়ির মুখ ঘোরালো গরুমারা ন্যাশনাল পার্কের দিকে।
আমাদের ঢোকার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মোষে টানা গরুর-গাড়িতে করে গরুমারা জঙ্গলে ঢুকলাম। প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে একটা পাকা ওয়াচ টাওয়ার। জঙ্গলের গভীর চৌহদ্দি শুরু এর পর থেকেই। এই ওয়াচ টাওয়ারটি আসলে জঙ্গলের হাতায়, জঙ্গলের ভেতরে নয়। তবু গিজগিজ করছে 'পাবলিক'। টেলি লেন্সের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় নিয়ে গিয়ে ক্যামেরায় চোখ রেখে দেখলাম নদীর ওপারে দুটো গন্ডার, গোটাচারেক সাদা বক। মনে হোলো গন্ডার দুটোকে যেন গলায় লম্বা দড়ি পড়িয়ে খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে যেমন গরুকে চরতে দেওয়া হয়। আর সাদা বকগুলো গন্ডারের পিঠে চেপে পয়েন্টারের কাজ করছে। আধ ঘন্টা ওখানে কাটালাম। এর বেশি জঙ্গলে যাওয়া বারণ। এখন বর্ষাকাল। ফিরে আসছি দেখি আমাদের ফেরার পথের পাশেই দাঁড়িয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঘাস-পাতা খাচ্ছে এক দাঁতাল। পায়ে শক্ত বেড়ি। একেবারেই পাত্তা দিতে ইচ্ছা করল না। ভাঙা মনের ওপর প্রলেপ দিতে, রুদ্ধ জঙ্গলের গা ঘেষে শুদ্ধ লোকনৃত্যের আয়োজন কালীপুর আখড়ায়।
দিনের শেষ সাফারির জন্য এই আয়োজন। শুনতে পেলাম, আগের সাফারিগুলোর প্যাকেজে লোকনৃত্যের বদলে পাওয়া যায় নদীতে বোটিং-এর সুযোগ! চা-বিস্কুট-ফটো-নাচ-জোঁক সহযোগে সে-পাঠ চুকিয়ে যখন ফেরতা পথে আমাদের গাড়ি, রিসর্ট থেকে চালক পাহাড়ির ফোনে বার্তা এলো, 'কাম শার্প! রিসর্টের কাছে নদীর ধারে হাতির পাল জল খাচ্ছে!' এরে কয় পোড়া-কপাল। ফিরতে ফিরতে ঝুপ্পুস অন্ধকার। আকাশ জলভরা মেঘে ভারি। রিসর্টের চৌহদ্দি ডুবে আছে লোডশেডিং-এ। খাওয়ার জায়গায় ব্যবস্থা করা গেছে কিছু টিমটিমে LED ল্যাম্পের। ম্যানেজারের ইন্তেজামে সেই সন্ধের জল-খাবারে উৎকৃষ্ট মোমো। তবে আমাদের আকর্ষণের বিষয় ছিল মোমোর সঙ্গের পাহাড়ি এক বুনো লঙ্কার চাটনি। স্যামকে যতদূর জানি, দেশ-বিদেশের বহু প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল ওর চষা কাজের সূত্রে। শেষবার মনিপুরের জিরিবামে কাটিয়ে এসেছে টানা পাঁচ মাস। দারুণ উৎসাহে ও চাটনি চেটে চেটে খাচ্ছিল আর ওর দু-চোখ দিয়ে জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল ঝাল। আমাদের বারবার বারণ, র্যাচেলের হাড়-হিম করা ভ্রুকুটি, কিছুই যেন স্পর্শ করছিল না স্যামকে। এক জান্তব উল্লাস লক্ষ্য করছিলাম ওর চোখ দুটোয়। অল্প আলো আর অনেকটা আঁধারী, বাইরে গুরু গুরু মেঘ আর ঝোড়ো হাওয়ার আভাস - এসবই, নেহাতই এক ঘরোয়া পরিবেশের ওপর অচিরেই বিছিয়ে দিল এক গা-ছমছমে জংলা গন্ধ-মাখা শিরশিরানি। যা, একটু আগে জঙ্গলের ভেতর গিয়েও টের পাইনি। আমাদের আল্গা, অতি মৃদু এতোল-বেতোল কথার আলুনিতে একমাত্র স্থির জ্বলজ্বল করতে থাকল স্যামের চোখ দুটো। এই আবেশেই সন্ধে গড়ালো রাতে। মূর্তিতে শেষ রাত। পল একবার প্রস্তাব দিল ক্যাম্প-ফায়ারের। বৃষ্টি আসতে পারে বলে নিরস্ত করলাম ওকে। যদি বলতাম, ম্যানেজার বলছে কাঠ জোগাড় নেই এবং জোগাড় করতে হলে পাশের জঙ্গলে যেতে হবে, তাহলে ওকে আর আটকানো যেত না। কী জানি, কোয়াক-কলিনের মধ্যে কাল সকালে একজনকে না পাওয়া গেলেও অবাক হতাম না। যাই হোক রাতের খাওয়া শেষ করে ঘোর-লাগা মানুষের মতো শরীরটাকে টেনে বিছানায় নিয়ে গেলাম।
সে রাতে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম এক। স্বপ্ন কখনই এত সাযুজ্যপূর্ণ, এত ঠাস বুনোটের হয় কি! এই রাতটুকুই তো শেষ এই মায়াময় মূর্তিতে। মজার ব্যাপার, স্বপ্নটা শুরুই হোলো আমাদের অপূর্ণ সাধ পূরণ করে। বুজে আসা চোখের ভেতর মায়াবী যবনিকা সরতেই দেখতে পেলাম রিসর্টের হাতায় ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। চড়্ চড়্ করে পাখসাট মারছে আগুন। ফট্ ফট্ শব্দে শুকনো কাঠ ফাটছে। গোটা মোরগাটাকে তরিজুত করে ঝলসাচ্ছে স্যাম, আর জুলজুল করে তাকিয়ে আছে ব্রুনি। দক্ষ হাতে শিঁকে বেঁধা মাংসপিন্ড ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে স্যাম আর ব্রুনিকে বোঝাচ্ছে ঠিক মতো মাংস ঝলসাতে পারা একটা আর্ট, চট্ করে হয় না। এ-কাজে বিস্তর সময় দিতে হয়। তা নাহলে ভেতরে কাঁচা থেকে যাবে। স্বাদ আসবে না। ব্রুনি বলে উঠল, 'তাই তো চিরে চিরে দিতে বলছিলাম। আর লেবুর রস কি মাখিয়ে মাখিয়ে ঝলসায়, না শেষে?' তেমন ঠাণ্ডা নেই তবু আমি আরও একটু কাছে সরে বসলাম আগুনের। যেন তাত এসে লাগল গায়। ভালো লাগল। পল, ডেইজি ও র্যাচেল হাতে হাত লাগিয়ে আরও কাঠ জড়ো করে সাজিয়ে রাখছিল। এরই মধ্যে খুব তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ ভেসে এল। আবার সব চুপচাপ। সবাই ঘুরে তাকিয়েছি। শব্দটা এল কটেজগুলোর পিছনের অন্ধকার থেকে। পল সাবলীল হাঁটা লাগাল সেইদিকে। উঠতে যাচ্ছিলাম, আমায় হাত দেখিয়ে থামতে বলল। তারপরই মুছে গেল অন্ধকারে। বাকীরা শ্বাসরোধ করে তাকিয়ে আছি সেইদিকে। আড় চোখে দেখলাম স্যাম শিক থেকে মোরগাটাকে ছাড়িয়ে পাশে রেখেছে। হাতে ধরে আছে শিকটা। এর-ওর দিকে মুখ চাওয়া-চায়ি করে এগিয়ে দেখব ভাবছি, তখনই দেখি পল ফিরে আসছে, পেছনে এক ছায়ামূর্তি। আগুনের আলোর আওতায় এলে দেখলাম, আর কেউ না, সাক্ষাৎ চলমান অশরীরি, আমাদের ব্রো। সাদরে আমন্ত্রণ জানালাম ব্রো-কে, 'কাম্-অন, জয়েন আস'! ব্রো বসল আমাদের সঙ্গে কিন্তু মাংস ছুঁলো না। ব্রুনি ও র্যাচেল সামান্য পিড়াপিড়ি করতেই সাফ জানিয়ে দিলো, সে শাকাহারী, আমিষ খায় না। ঠিক তখনই আকাশ ফালা করে খেলে গেল নীল আগুন। কাছাকাছিই বাজ পড়ল কালা করে দিয়ে। দ্রুত শেষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম সদ্য রোষ্ট করা তাজা মাংসপিণ্ড। তারই ফাঁকে পল খুব হাল্কা চালে কথাটা পাড়ল। প্রায় শোনা যায় না তার গলা – 'গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে, আজ রাতে জঙ্গলে যাব।' কারোর মুখে কোনো কথা নেই। পল দ্রুত চোখ বোলালো সবার মুখে। তারপর যোগ করল, 'ব্রো থাকবে সাথে'। জমাটটা কিছুটা পাতলা হল। পল তাড়া দিল, 'আর দেরী নয়। লেটস্ মুভ!'
আকাশ তখন স্লেটের মতো। ক্ষনিকে ক্ষনিকে বিদ্যুতের খড়ি দাগ কেটে মিলিয়ে যাচ্ছে। চাপা বুনো গর্জনে স্টার্ট নিল রাতের সওয়ারি। তারপরই গোলার মতো ছুটে চলল টান টান করে পাতা সরু রাস্তা ধরে। স্বপ্নের মাঝে পেরিয়ে এলাম মূর্তি নদীর ব্রিজ। আর সাঁ সাঁ ছুটে চললাম জঙ্গলে। স্টিয়ারিং হুইলে বেপরোয়া টাইগার হঠাৎই নিভিয়ে দিলো গাড়ির হেডলাইট। আর একটা মিশমিশে কালো চাদর যেন আগাপাশতলা মুড়ে ফেলল আমাদের - গাড়ি সমেত। দু'হাত দূরের কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। টাইগারের এই স্বেচ্ছা অন্ধত্বের স্বেচ্ছাচার, ভয়ের উর্দ্ধে রোমাঞ্চের এক চরম সীমায় নিয়ে গেছে আমাদের প্রত্যেককে। গতির মাঝে থমকে আছি সবাই। আমি বসেছি ব্যাক সিটে। আমার মুখোমুখি ব্রো। ভাবলেশহীন মুখ। হাতে প্রায় ছোট-খাটো সার্চলাইটের সাইজের একটা টর্চ। মাঝে মাঝে দপ্ করে জ্বলে উঠছে পাশের জঙ্গলের দিকে মুখ করে। নিভে যাচ্ছে যখন, আরও কালো করে দিচ্ছে রাত। পেছনে তাকালে মনে হোচ্ছে দৈত্যাকার এক অন্ধকার কীট, এই জঙ্গল, আকাশ, এই চরাচর সমস্তটা গিলতে গিলতে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। দূর আসমান, প্রায় মেঘের কাছাকাছি উঠে গিয়ে সেখান থেকে দেখতে পেলাম সমস্তটা। আবছায়া আবছায়া দেখা যায় নিচে যতদূর, শুধু জঙ্গল, গাছগুলো যেন লোমশ দানব সব সার বেঁধে, ঝোলা কাঁধ, ঘাড় গোজা, ঝিমুচ্ছে। আর মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ায় ঠেলা-ঠেলি করে এ-ওর ঘুম ভাঙ্গাতে চাইছে। তার মাঝখান দিয়ে নিকষ কালো চুলের মতো এক চেরা রাস্তা। আমাদের গাড়ি যেন ট্রাঞ্জিস্টারের কাঁটা। কে যেন অদৃশ্য অতিকায় কোনো নব্ ঘুরিয়ে চলেছে পাগলের মতো আর কাঁটা দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে অগুন্তি চ্যানেল পেরিয়ে পেরিয়ে। মনোমতো ফ্রিকোয়েন্সি পাচ্ছে না তাই এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে চলেছে কাঁটা, শুধু বিরক্তিবোধক ঘস্ঘস্ শব্দ করে। হঠাৎ ঝপ্ করে নেমে গেলো বৃষ্টি আর আমার স্বপ্নও হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এল গাড়ির ভেতর। শুধু নামলো না, নামলো মুষলধারে! মাঝরাত্তির, গভীর জঙ্গল, তদুপরি প্রমাণ সাইজের এক জবরদস্ত দুর্যোগ – স্বপ্নকে দুঃসাহসিক প্লটে পাল্টে ফেলার সব উপাদান প্রস্তুত। বৃষ্টির তোড় ফেঁড়ে যতটুকু হেডলাইট ততটুকুই আমাদের থাকা, ঠিক ততটুকুই বর্তমান। বর্তমানকে পলকে অতীতের চৌহদ্দি পেরোতে দেখছি চোখ ফিরিয়ে তো সেইমাত্র ঢুকে পড়ছি ভবিষ্যতের চৌকাঠ পেরিয়ে। অকাতরে কালের হাতে সমস্তটা ছেড়ে দিয়েও স্বপ্নের গড়ান হোঁচট খেয়ে থমকে গেল, যখন চির-রহস্যময় সেই আঁধার থেকে আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলোর বৃত্তে ধরা পড়ল এক ভুপতিত মহীরুহ আমাদের চলার পথের এপার-ওপার দখল করে পড়ে আছে। আমরা সকলে কিংকর্তব্যবিমুঢ়! ব্রুনি, র্যাচেল, ডেইজি ও পাইলট টাইগারকে গাড়িতে রেখে আমদের রাস্তায় নামতে হল সামনে পড়ে থাকা গাছ সরানোর চেষ্টায়। সত্যি, আমার ক্ষমতায় থাকলে স্বপ্নটাকে এতটা দুঃস্বপ্ন হতে দিতাম না। আশপাশের ছোট ডালপালা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতেই বোঝা গেল পুরো গাছ নয়, তবে বেশ বড় একটা গাছের ডাল। আমাদের পক্ষে তুলে সরানো অসম্ভব। চলমান অশরীরি সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও। আপাদমস্তক ঝুপ্পুস ভিজে যখন ভেবে চলেছি অতঃকিম্, চাপা গলায় ব্রো হিস্হিসিয়ে উঠল, 'সবাই গাড়িতে ওঠো, কুইক।' আমরা ঘাবড়ে গাড়িতে উঠে এলাম তড়িঘড়ি। সব কটা দরজা লাগিয়ে ফিসফিস করে বলল, 'পুরো গাছ হলে ধরে নিতাম ঝড়ে পড়েছে, কিন্তু একটা ডাল . . . দেখে মনে হোচ্ছে খুব বেশিক্ষণ হয়নি। টাইগার যেভাবে হোক বেরিয়ে চল্।' টাইগার তৈরি ছিল স্টিয়ারিং-এ। গাড়ির গর্জন খান খান করতে থাকল সেই দুর্যোগ রাতের জঙ্গল। সামনের চাকা দুটো পিষতে থাকল আড়াআড়ি পড়ে থাকা ডালটার ঝাড়ালো অংশ। তারপর একবার রাস্তা থেকে সামান্য ডাইনে একদিককার চাকা নামিয়ে সেই ডালের উপর দিয়েই চালিয়ে দিলো গাড়ি। পরের মূহুর্তেই পেছনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ডালটা। গাড়ি আর ঝঞ্ঝার আওয়াজের লড়াইয়ের মাঝে আমরা মূক। শুধু ব্রো একবার বলল, 'দাঁতাল ছিল'। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল স্বপ্নের এই জায়গায়। বলা যেতে পারে এক অনুভূতি শূণ্য আবস্থা। গতির মধ্যেও নিশ্চলতা অনুভব করছি। শব্দ শুনছি, কিন্তু শুনছি না কিছুই। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সপ্সপে ভেজা তবু অদ্ভুত ফুরেফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে যেন ভেসে আছি। ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলে সেঁধিয়ে চলেছি বিলকুল! ক্রমশঃ ঘাড়ের ওপর চেপে আসছে জঙ্গল। গাড়ির চাকার দাগ ধরে গতি বাড়িয়ে চলেছে টাইগার। কোথায় শেষ জানি না। এরই মধ্যে টালমাটাল পেরিয়ে এসেছি চওড়া চওড়া প্রাকৃতিক নালা, প্রায় চার/পাঁচটা। তুমুল বর্ষায় নালাগুলো সব ফুঁসছে। অথচ কিছুই যেন আমাদের আর ছুঁতে পারছে না! আমরা যেন এসবের বাইরে থেকে দূরে বসে স্বপ্ন দেখছি মাত্র! সচেতন ভাবে সবাই যেন বুঝে গেছে এটা!
সকালে ব্রুনির ধাক্কায় ঘুম ভাঙ্গল যখন, দেখি ঘামে বিছানা পুরো ভেজা। ব্রুনি অল্প শাসন করল, 'সহ্য করতে পারো না যখন খাও কেন অত?' বেরিয়ে দেখি ঝকঝকে সকাল। অ্যাতোটাই ঝকঝকে যে গতকালটা স্বপ্ন না হয়ে উপায় নেই। শুধু সকাল না, কাউকে দেখেই কিছু বোঝার উপায় নেই। পল আর স্যাম যেমন গৃহপালিতের মতো দুধ-চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে, আর ডেইজি তার ক্যামেরায় কলিন ও কোয়াককে নিয়ে আদিখ্যেতা করছে। ব্রুনি ও র্যাচেল নিতান্তই সেই এক বস্তাপচা - না না, এরা কেউই আমার গতকালের স্বপ্নের চরিত্ররা নয়। আমি আস্বস্ত হয়ে আয়েশ করে বেতের চেয়ারটি বাগিয়ে, সামনে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে বসলাম। সকালের জলখাবারের পরই মূর্তি ছাড়লাম। চললাম ঝালং হোয়ে রোঙ্গুর পথে। গেট পেরোবার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লনে তখনও গতরাতের ক্যাম্পফায়ারের ছাই। স্থানীয় সংবাদেও বৃষ্টি নিয়ে কোনো কথা বাড়ায় নি। তবু মনে হোলো, ভেজা মাটিতে থকথকে ছাইয়ের ওপর একঝলক যা চোখে পড়ল তা কি দেখার ভুল না হাতির পায়ের ছাপ!
বাকি সফরটা আমি আর এই মায়াজাল থেকে বেরোতে পারি নি। মূর্তি থেকে সকাল দশটায় বেরিয়ে রোঙ্গু পৌঁছতে হয়ে গেল দুপুর। মূর্তি থেকে খুনিয়া মোড় পেড়িয়ে চাপরামাড়ি রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছোটাল চালক পাহাড়ি। আমায় হতবাক করে দিল, গতরাতের স্বপ্নটার সাথে কী মিল চারিদিকের! রোঙ্গু খুব বেশি উঁচুতে নয়। তিন-সাড়ে তিন হাজার ফিট হবে। বাঁ হাতে ঝালংকে রেখে, ডান দিকে দলগাঁওয়ে থামলাম খানিক! গাড়ি থেকে নেমে কাদায়-পাথরে-ঘাসে মাখামাখি পায় চলা পথে গড়িয়ে গড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম এক খাদের ধার ঘেঁষে! পরিচয় হোল অদ্ভুত এক পাহাড়ির সঙ্গে! খাদের ধারে রেলিং দেওয়া দলগাঁওয়ের এই অনামী ভিউ পয়েন্টকে নানান বাহারী ফুলে ফুলে সাজিয়ে চলেছে এই মানুষটি গত দশ বছর ধরে! খুব অল্পেই ভাব হয়ে গেল। এক খাবলা বুনো গাছের পাতা চটকে ব্রুনির হাতে দিয়ে বলল শুঁকতে! ব্রুনিকে মাইগ্রেন ভোগাচ্ছিল। আশ্চর্য, খানিক আরাম পেল! খাদের পায়ের পাতায় চুলের ফিতের মতো কুল কুল জলঢাকা। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে পাশাপাশি দু'একটা মেমোরি ক্লিক করতে-না-করতেই পেছনটা সাদা চাদরে ঢেকে গেল! পাহাড় বিহ্বল করে প্রতিনিয়ত। কুয়াশার দিকে পিঠ করে ফিরে এলাম গাড়িতে। জানি গন্তব্য অন্যত্র, তবু এমনই হয় বারবার; অকারণে আঘাটায় মন আটকে আটকে যায়!
রোঙ্গুতে যে পাহাড়ের কোলে আমরা আস্তানা গেড়েছিলাম, তারই মাথায় চড়ে পেলাম এক বৌদ্ধ মন্দির। এখান থেকেও নীচে সরু ফিতের মতো জলঢাকা। পল মনে হয় মনে করিয়ে দিল, আমরা রয়েছি ভারতে, আর নদীর ও পাড়ে ওই পাহাড়টা ভুটান, বিদেশ! নদীর গভীরে গোপন তাদের আষ্টেপৃষ্টে ধরে থাকা হাতের কম্পনে আরো কিছুটা ছলকে উঠে বয়ে গেল জলঢাকা। সন্ধের আগেই নেমে এলাম। রাত পোহাতেই গোছগাছের পালা। বেলা গড়াতেই আরো নেমে এলাম। বিন্দুতে জলঢাকাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে সোজা চলে আসার কথা আমাদের জলপাইগুড়ি। তবে ডেইজির আবদারে একবার যেতেই হোলো ঝালং-এর কাছে। ঝালং একটি নিষ্পাপ শিশু, যার এখনও লিঙ্গভেদ হয়নি। সবে পাহাড় থেকে নেমেছে। গায়ে এখনও ঝরনা ঝরনা আতুড়। নির্বোধ ও নির্বাঁধ তরঙ্গকে শাসনে রাখতে জঙ্গলা পাহাড়ের ব্যাকড্রপের সঙ্গে মানানসই ছোট-বড় পাথরের রাস্তা। আমি দাঁড়িয়ে আছি যেখানে, সামনে দেখছি যা, তা যদি সাজানো জলছবি হয়, তাতেও কোনো খেদ নেই, শুধু অনুরোধ আমার ঘোর কাটিয়ে দিও না। তবে ডেইজি শুনলে তো। হিড়হিড় করে নিয়ে গেল ঝালং-এর পাড়ে, আর তারপরই ঝাঁপ। 'সাঁতার জানি না' বলে চেঁচিয়ে কোনো ফল হবে না জানি, উত্তর আসবে 'এখানে সাঁতার জেনেও কোনো লাভ নেই'। সত্যি তাই। শিশুর মতো সরল হলে তার নিষ্ঠুর হতে আটকায় না, ঝালংও তাই। তবে আমার ওই একটাই ভরসা, সবটাই তো স্বপ্ন, আর আমার স্বপ্নে আমি মরে যাব না নিশ্চয়ই। আর গেলেও শুধু ঘুমটা ভাঙ্গবে না, এই তো!
কিন্তু না, ঘুম সেই ভাঙ্গলোই। ঝালং থেকে টেনে তুলে ডেইজি যখন আমদের রাতের ট্রেনে জলপাইগুড়ি থেকে সি-অফ করছে, তখন ভিড়ে, শব্দে, ব্যস্ততায় স্টেশন চত্তর থেকে খুব সংগোপনে স্বপ্নের লক্ষ্মণগুলো লোপাট হোতে থাকল। জাস্ট হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকল সুখ, চালক পাহাড়ি, ব্রো - অনেক রাতে, সবাই যখন যে যার বার্থে ঘুমঘুম, জানলা দিয়ে বাইরের নিকষ অন্ধকারে দেখলাম যেন, একটা সাদা ঘোড়া, পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে সমানে। পিঠে জিন। বেপরোয়া কেশরের সাথে সাথে পড়ানো লাগামটাও ছটফট করছে! অথচ কোনো সওয়ারি নেই! ঘোড়াটা ছুটেই চলেছে, সমান তালে . . . ।
~ ডুয়ার্সের তথ্য~ ডুয়ার্সের আরো ছবি ~
কাঞ্চন সেনগুপ্তের ছেলেবেলা কেটেছে ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরে। কর্মসূত্রে কলকাতায়। ২০০০ সাল থেকে বেসরকারী কনস্ট্রাকশন ফার্ম সিমপ্লেক্সের সঙ্গে যুক্ত। ভালো লাগে লেখালেখি, ছবি তোলা, বেড়ানো। আবার কখনওবা সময় কেটে যায় ছবি আঁকা বা টুকিটাকি হাতের কাজে ।