স্বর্গ দর্শন

তুহিন ডি. খোকন

~ কাশ্মীরের তথ্য~ কাশ্মীরের আরো ছবি ~

স্বর্গ লাভের ইচ্ছে তো সবারই, কিন্তু ইহকালে এমন কোন পুণ্যকাজ করিনি যে স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ভূ-স্বর্গ দর্শনের দুর্বার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করা গেল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। বিদেশ তো বটেই, তার উপর ঝুঁকি-বহুল এলাকা কাশ্মীর। যেখানে প্রতিনিয়তই কোন না কোন দুর্ঘটনা বা সশস্ত্র হামলা ঘটছেই। তবুও ভূ-স্বর্গ বলে কথা, আনাচে কানাচে যার লুকায়িত ঐশ্বর্যে ভরা।
কলকাতা থেকে জম্মু অবধি দুটি ট্রেনই আছে। তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম সময় নেয় হিমগিরি এক্সপ্রেস। সপ্তাহে মাত্র তিনদিন চলা এই ট্রেনের টিকিটও অনেকটা সোনার হরিণের মতো। যাই হোক একটু আগেভাগে প্ল্যান করাতে প্রায় দেড়মাস আগে এসি টু-টায়ারে ছয়টির মধ্যে চারটি কনফার্ম টিকিট পেয়ে গেলাম, বাকি দু'টি আর.এ.সি. থাকলো। আমার ইন্ডিয়ান ট্রাভেল এজেন্ট জানালো এই দু'টি টিকিট কনফার্ম হয়ে যাবে ভ্রমণের চব্বিশ-ঘণ্টা আগেই। আমাদের শুধুমাত্র অনলাইনে অথবা স্টেশনে গিয়ে চার্ট দেখে সিট ও বগি নম্বরটি জেনে নিতে হবে। টিকিট কাটার মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের স্বর্গ দর্শনের প্রতীক্ষা.....প্রতীক্ষার প্রহর সত্যিই খুব যন্ত্রণাদায়ক।
নোমান,আমি এবং আমাদের পরিবার ইতিমধ্যে হিমাচল প্রদেশ সহ ভারতের বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা ভ্রমণ শেষ করেছি। ভ্রমণের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসতে লাগলো, আমরা ততই উত্তেজিত হতে লাগলাম। প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে গুছানো শেষে একদিন সত্যি সত্যি সোহাগ-পরিবহণের তথাকথিত স্ক্যানিয়াতে করে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশে। প্রথমদিন কলকাতায় রাত্রিযাপন শেষে পরদিন সকালে নাস্তা সেরেই ছুটলাম ফেয়ারলি প্লেসে ফরেন কোটায় দিল্লি টু কলকাতা টিকিট কাটাতে। কেননা আমাদের যাওয়ার টিকিট কনফার্ম থাকলেও ফেরার টিকিট পাইনি পূজার ছুটির ভিড়ের কারণে। ভাগ্য ভালো যে ওই দিনের জন্যে মাত্র ছয়টি টিকিটই ছিল এসি –থ্রি টায়ারে ফরেন কোটাতে। ছ'টি টিকিটই কনফার্ম করলাম আমরা।

হিমগিরি এক্সপ্রেস। নামটি যেমন সুন্দর ট্রেনটিও তেমনি। কলকাতা থেকে জম্মুর দূরত্ব প্রায় ২০২০ কিলোমিটার। প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা জার্নি শেষে যখন জম্মু রেল স্টেশনে পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় তিনটা। স্টেশন থেকে বেরিয়েই মাথায় হাত। শ'য়ে শ'য়ে মানুষ দাঁড়িয়ে-বসে-শুয়ে আছে, কিন্তু কোন গাড়ি যাচ্ছে না। প্রি-পেইড ট্যাক্সি কাউন্টারে খবর নিয়ে জানতে পারলাম আজ বনধ্‌। কোন গাড়ি শ্রীনগরে যাবে না। আমার দীর্ঘ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি পৃথিবীতে দু'নম্বর ব্যবস্থা সবখানেই থাকে। তাই একটুও দেরী না করে বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজতে বেরুলাম আমি আর নোমান। খানিক খোঁজাখুঁজির পর স্টেশনের পাশেই এক সরু গলিতে একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথা বলতে তারা মোটামুটি সহনীয় ভাড়াতেই আমাদের শ্রীনগর নিয়ে যেতে রাজি হয়ে গেল। আপেলের ভরা মরসুম, তাই গাড়িতে ওঠার আগে খুব সস্তায় বিশাল আকৃতির আপেল কিনে বেলা সাড়ে তিনটায় রওনা দিলাম ২৯৮ কি. মি. দূরে কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। প্রায় ১৪ ঘণ্টা পাহাড়ি রাস্তায় জার্নি শেষে যখন শ্রীনগরে পৌঁছলাম তখন রাত দু'টো। মেক মাই ট্রিপ ডট কমে হোটেল রিজার্ভেশন আগেই করা ছিল। এই রাত দুপুরে হোটেলওয়ালাকে ফোন করতেই সে জানালো যে লোক পাঠাচ্ছে আমাদেরকে চৌদ্দ নম্বর ঘাটের সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শুরুতেই যা খটকা লাগলো একটু পরেই সত্যি প্রমাণিত হলো তা। ওয়েবসাইটে হোটেলের ছবিতে হোটেলটির অবস্থান ডাঙাতে দেখালেও সত্যিকারে ওটির অস্তিত্ব বিখ্যাত ডাল-লেকের ওপাড়ে। শুনশান শীতল মধ্যরাতে প্রায় আধ-ঘণ্টা অপেক্ষার পর ঘুটঘুটে অন্ধকার ডাল-লেক থেকে ভেসে এলো লম্বা জোব্বা পরিহিত বৃদ্ধ-তরীওয়ালার ডাক। ভয় লাগছিল স্বাভাবিকতই, যাই হোক বউ-বাচ্চা নিয়ে বিপদ-সংকুল কাশ্মীরের পথে পড়ে থাকার চেয়ে সেই ডাকে সাড়া দেওয়াই উত্তম মনে করলাম। লেকের ওপাড়ে গিয়ে দমে গেলাম হোটেল রুম আর টয়লেটের অবস্থা দেখে। রুমের মধ্যেই টয়লেটের ভেন্টিলেশন। এই মাঝ রাতে কিছু করার নাই দেখে কোনক্রমে রাতটি পার করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাত প্রায় তিনটের দিকে ঘুমালেও চিরাচরিত অভ্যাসের কারণে ভোর ৫ টাতেই ঘুম ভাঙলো। ট্র্যাকস্যুট ও কেডস পরে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু মেনল্যান্ডে যাওয়ার জন্যে এই ভোরে কোথাও কোন পারাপারের ডিঙি তথা শিকারা দেখলাম না। পাশাপাশি সারিবদ্ধ হাউসবোটগুলোর হালচাল দেখে আবারও রুমে ফেরত এলাম। আটটার দিকে নোমানকে ডেকে নিয়ে মেনল্যান্ডে চলে এলাম একটা শিকারা ধরে। বউ-বাচ্চাদের নাস্তার ব্যবস্থা হোটেলে করে এলেও তখনও আমরা দু'জনের কেউ নাস্তা করিনি। ছোট একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রেকফাস্ট সারলাম ডিম ও মাখন-পাউরুটি দিয়ে, তারপর বেরুলাম স্থলভাগে হোটেলের সন্ধানে। অনেক খোঁজাখুঁজির শেষে মেন রোড থেকে সামান্য ভেতরে "হোটেল মধুবন" কে একেবারে মনেপ্রাণে পছন্দ হয়ে গেল। বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান, সবুজ ঘাসের লন, সুদৃশ্য হোটেল দালান। নোমান কথা বললো হোটেল ম্যানেজার মেহেদী হাসানের সঙ্গে। প্রথমে ২৫০০ রুপি ভাড়া চাইলেও পরে সেটিকে আমরা প্রতিরাত ১২৫০ রুপিতে ম্যানেজ করলাম পাঁচ দিনের জন্যে। ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড থেকেই ১৬০০ রুপি দিয়ে হাফ-ডে সাইট সিয়িং এর ব্যবস্থা করলাম। আমাদের ড্রাইভারের নাম রিয়াজ।
কাশ্মীর ভ্যালিতে অবস্থিত শ্রীনগর শহরটির আয়তন ১৮১ বর্গ কিলোমিটার, স্থানীয় লোকসংখ্যা প্রায় দশ লাখের কাছাকাছি। সমগ্র কাশ্মীর তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ঘেরা - প্রথম স্তরে পুরোপুরি ভারতীয় সেনাবাহিনী, দ্বিতীয় স্তরে আধা-সামরিক বাহিনী বিএসএফ ও তৃতীয় স্তরে কাশ্মীরি পুলিশ। প্রথম দেখাতেই অনেকেই ভড়কে যাবে মাত্রাতিরিক্ত এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে। অবশ্য আমরা কাশ্মীরে পৌঁছানোর মাত্র দু'দিন আগেই আজাদ কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলারা একজন পূর্ণ কর্ণেলসহ সেনাবাহিনীর ৮ জন সদস্যকে হত্যা করেছে। ফলশ্রুতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন আরো কঠিনতম অবস্থায়। অবশ্য এর বিপরীতে যা দেখলাম তাতে চোখ জুড়িয়ে গেল। পুরো ভারতবর্ষসহ অনেক দেশ ঘুরলেও কাশ্মীরের বাসিন্ধুা তা পুরুষ হোক আর মহিলা, এত রূপবান পুরুষ ও রূপবতী নারী আমি আগে কোথাও দেখিনি। প্রধানত: আবহাওয়াগত কারণে এদের স্বাস্থ্য, রঙ ও মেজাজ এতো ভালো। আমাদের পুরো দলই কাশ্মীরিদের রূপ-মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
প্রথমেই আমরা গেলাম মোগল গার্ডেনে। পথে পথে পাইন সারির শোভাবেষ্টিত পর্বতমালা, তারই মাঝে অসংখ্য নাম না জানা ফুলের স্বর্গ, চারদিকে এতো রঙ যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পরের গন্তব্য শহর প্রান্তে পরিমহল। অনেক ওপরে অবস্থানগত কারণে নাগিন ও ডাল লেকের প্রান্তঘেষা মোটামুটি অর্ধেক শ্রীনগর শহরকে দেখা যায় এখান থেকে। প্রাচীন দুর্গের ফাঁকে ফাঁকে নানাবর্ণের অর্কিডের মেলা। এরপর নিশাত গার্ডেনে ভিড়লো আমাদের গাড়ি। তিনদিক থেকে পর্বতে ঘেরা এই উদ্যানের আয়তন বিস্তীর্ণ। দু'তিনশ বছরের বুড়ো মেপল ট্রি ও কৃত্রিম পানির ফোয়ারা এই গার্ডেনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা হলাম হযরতবাল মসজিদের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে গাড়িতেই খানিকটা ঝিমাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু রসিক ড্রাইভারের উচ্চ-ভলিয়্যুমের অডিও আমার দিবানিদ্রার বারোটা বাজিয়ে দিল। কারণ জিজ্ঞেস করতে জানালো সে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করছে। হাজার হাজার কবুতর আকাশ অন্ধকার করে উড়ছে। তার আড়াল থেকে দর্শন মিলল সুগম্ভীর হজরতবাল দরগা। এখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পবিত্র চুল সংরক্ষিত আছে যা মুগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে সৈয়দ আবদুল্লাহ সুদূর মদিনা শহর থেকে নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। মাজার দর্শন শেষে আমরা ফিরে চললাম আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। মাথার ওপরে তখন ঝুঁকে এসেছে সন্ধে। নাগিন লেকে কৃত্রিম ফোয়ারার আলো আর দূরে দু'একটি দোকানের বিজ্ঞাপনের আলোগুলোও জলের উপরিভাগে সৃষ্টি করছে লাল-নীল আভা, সেসব সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে অস্তরাগে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে ফিরেই পুরো ৪ দিনের কাশ্মীরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্যে ভাড়া করলাম।
পরদিন সকালে যথারীতি ভোর সাড়ে পাঁচটাতেই ঘুম ভাঙলো। ভোরবেলার শ্রীনগর দেখার প্রবল ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে একা একা বেরিয়ে এলাম হোটেল রুম থেকে। ডাল লেকের পাশে পাশে দৌড়তে লাগলাম। শ'য়ে শ'য়ে কাশ্মীরি - বয়সের ভেদাভেদ ছাড়াই সবাই হাঁটছে, দৌড়াচ্ছে ডাল-লেকের পাশ ধরে। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর ঠাণ্ডা মোটামুটি সহনীয় হয়ে এলো। ডাল লেকের ঘাটগুলো নাম্বারিং করা। এই ভোরে সেইসব ঘাট স্বাস্থ্য -উদ্ধাররত কাশ্মীরিদের দখলে। উল্লেখযোগ্য যেটা দেখলাম তাহলো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিন্দুমাত্রও শিথিল নয় অপুষ্ট এই ভোরেও।
স্বচ্ছতোয়া ডাল লেকের অভ্যন্তরে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ, ছোট-ছোট রুপোলি মাছ খেলছে সেই গুল্মলতা ঘিরে ঘিরে। হঠাৎ দেখলাম তুলতুলে ছোট ছোট বালিহাঁসের কয়েকটি ছানা জলকেলিরত। কাছে গিয়ে ছবি তুলবার জন্যে যেই ক্যামেরা তাক করেছি, সঙ্গে সঙ্গে তাদের দীর্ঘ ডুব সাতাঁর শুরু হয়ে গেল, এইখানে ডুব দেয় তো দূরে ওখানে গিয়ে ওঠে। শেষে ব্যর্থ হয়ে হোটেল রুমে ফিরে সবাইকে জাগিয়ে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে দলবেঁধে মোড়ের ছোট্ট নাস্তার দোকানটিতে ছোলাবাটোরা ও গরম গরম পুরি সহকারে ব্রেকফাস্ট সারলাম। ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাই গাড়ি নিয়ে হাজির। শুরু হলো গুলমার্গ যাত্রা।
কাশ্মীরে ভ্রমণার্থীদের জন্যে বড়ই উদ্রেকের বিষয় হচ্ছে পথে পথে টোল পরিশোধের ঝামেলা, যা গাড়ির আরোহীকেই বহন করতে হয়। কোথাও একশ, কোথাও পঞ্চাশ কোথাওবা বিশ রুপি না দিলে রাস্তার উপর পড়ে থাকা বাঁশের ব্যারিকেড উঠবে না। এরকম প্রায় তিনটি ব্যারিকেড পেরিয়ে আমাদের ইনোভা পৌঁছালো গুলমার্গ জিপ স্ট্যান্ডে। গাড়ি পার্কিয়েরও ১০০ রুপি। গাড়ি থেকে নামতেই একঝাঁক ঘোড়াওয়ালা ঘিরে ধরলো, গুলমার্গ ঘুরিয়ে দেখাবে আর যেহেতু গণ্ডোলা (রোপওয়ে-কার) বন্ধ তাই বরফের কাছে নিয়ে যাবে। আসার আগেই এই ঘোড়াওয়ালাদের প্রতারণার ঘটনা পড়েছিলাম তাই ওদের কথায় কান দিলাম না। দু'জন কাশ্মীরি পুলিশ এগিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম সত্যি সত্যি গণ্ডোলা বন্ধ কিনা। ওরাও জানালো রিপেয়ারিং এর জন্যে ফেজ ওয়ান ও ফেজ টু অভিমুখী গণ্ডোলাই বন্ধ। ভগ্নচিত্তে আমরা হাঁটতে লাগলাম, পিছনে পিছনে হাঁটছে ঘোড়াওয়ালারা। পরিস্থিতিটা অনেকটা এই রকম, আমরা ঘোড়া নেবনা আর ওরা আমাদের ঘোড়ায় চড়িয়েই ছাড়বে। আমরা চুপচাপ হাঁটছি আর ওরা পেছন থেকে নানারকম মন্তব্য করছে - 'কতটুকু পায়ে হেঁটে যেতে পারবে দেখা যাবে, কিছুই দেখতে পারবে না' ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর একজন ঘোড়াওয়ালা একজন পুলিশকে নিয়ে এল আমাদেরকে বোঝাতে যে হেঁটে হেঁটে গুলমার্গ দেখা যায় না। পুলিশটিও আমাদের ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে লাগলো গুলমার্গ-দর্শণে ঘোড়ার গুরুত্ব। অবশেষে আমি ও নোমান দরদাম করতে লাগলাম, শুরুতে একটি ঘোড়া ৮০০ রুপি বললে আমরা বললাম ১০০ রুপি। শেষে অনেক বাগ-বিতণ্ডার পর প্রতি ঘোড়া ২০০ রুপিতে রফা হলো শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের জন্যে। আমি ও নোমান পায়ে হেঁটেই রওনা হলাম ওদের পিছুপিছু। প্রথমে গেলাম চিলড্রেন পার্কে। গলফ-কোর্টের মতোই সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ, চারপাশে পাইন ট্রি-এর নন্দিত শোভা, মধ্যখানে কৃত্রিম পাথুরে লেক। মাঠের মাঝে মাঝে বসবার জন্যে কারুকার্য শোভিত মেটাল বেঞ্চ। বন্ধের দিন হওয়াতে মোটামুটি অনেক কাশ্মীরি পিকনিক পার্টি সেখানে ভিড় করেছে পরিবার-পরিজনসহ। বিস্কিট ও ঠান্ডা পানি সহযোগে আমাদের মিনি লাঞ্চ সারলাম,পার্কে বসে। কিছুক্ষণ পর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যে রওনা হলাম গণ্ডোলা স্টেশনের দিকে। চড়তে না পারি অন্তত: স্টেশন আর কারগুলো দেখে আসি। গুলমার্গে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প ঘুরে রোপওয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান-বর্ডার সংলগ্ন পর্বতচুড়ায় অকস্মাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো। জলবতী মেঘ, করাৎ-করাৎ শব্দে বাজ পড়ছে থেকে থেকে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। কারণ এই ঠাণ্ডার মধ্যে যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই তাহলে আমাদের শিশুদের তো বটেই এমনকি আমরা বয়স্করাও নিউমোনিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারবো না, যেহেতু আমাদের সাথে বাড়তি কোন পোশাক নাই। তাই ঘোড়াওয়ালাদের বললাম তাড়াতাড়ি কোন আড়ালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করলো এই বলে যে বৃষ্টি ঠিক ওই পর্বতমালার উপরই ঝরবে, খোলা এই উপত্যকায় পড়বার সম্ভাবনা খুব কম। ঘোড়াওয়ালাদের ভবিষ্যতবাণী সত্যি হলো জোরালো এক পশলা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ধোঁয়াশা পর্বতগুলোকে মিনিট পাঁচেক ভিজিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। শুকনো অবস্থাতেই আমরা গণ্ডোলা স্টেশনে পৌঁছলাম।

স্টেশনে পৌঁছতেই দেখলাম বিশাল লম্বা লাইন। ওরেবাবা! সবাই কি আমাদের মতো দুধের-স্বাদ ঘোলে মেটাতে এসেছে নাকি! স্টেশনের সিকিউরিটি গার্ডদের জিজ্ঞেস করতেই আসল সত্য বেরিয়ে এলো। ফার্স্ট-ফেজে গণ্ডোলা ঠিকই চলছে, শুধুমাত্র মেন্টেনেন্স-এর জন্যে সেকেন্ড-ফেজই বন্ধ। প্রথমেই ধরলাম ঘোড়াওয়ালাদের আমাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করার জন্যে। আমাদের অভিযোগ তাদের কানে গেল কীনা ঠিক বোঝা গেল না , কারণ তখন তারা উদাস ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কী আর করা, নোমানকে পাঠালাম তাড়াতাড়ি টিকিট কিনতে। মাথাপিছু ৪০০ রুপি করে টিকিট। প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর পর আমাদের পালা এলো গণ্ডোলা চড়ে ফাস্ট-ফেজ তথা খিলানমার্গের পর্বত চূড়ায় পৌঁছানোর জন্যে। একেবারে খাড়া পর্বতের ঢালে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোপওয়ের টাওয়ার। ধীরে ধীরে রোপওয়ে উঠছে আমাদেরকে নিয়ে আর আমরা জীবনে প্রথমবার গণ্ডোলা চড়ায় রীতিমত উত্তেজিত। মোটামুটি বিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম খিলানমার্গে। গণ্ডোলা স্টেশন থেকে বেরোতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। এই ভরদুপুরে এখানকার তাপমাত্রা এখন মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে না জানি কী অবস্থা দাঁড়ায় !
খিদেয় সবার পেটে ছুঁচো ডন মারছে। তাই যেমন হোক,কারো জন্যে নুডুলস, কারো জন্যে ফ্রায়েড রাইসের অর্ডার দিলাম অস্থায়ী একটি হোটেলে। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে খিলান মার্গের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে পরিচিত হলাম কিছু কাশ্মীরি যুবকের সাথে। কাশ্মীরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পেলাম তাদের কাছ থেকে। চিরশীতের রাজ্যখ্যাত খোদ কাশ্মীরেই নাকি এমন জায়গা আছে যেখানের গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস !! কত অজানারে . . .
খিলানমার্গ থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ নেমে আসা পাহাড়ি সন্ধ্যা আমাদের পেয়ে বসলো। অন্ধকারের সঙ্গে ঠাণ্ডাও নামছে সমান তালে। রিয়াজ ভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসতে। আপেলের ভরা মরসুম এখন। গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে পার্শ্ববর্তী আপেলবাগান থেকে প্রায় পঁচিশ-কেজি ওজনের একপেটি আপেল কিনলাম মাত্র ২০০ রুপি দিয়ে। রাত প্রায় আটটার দিকে শ্রীনগর শহরে পৌঁছে প্রথমেই রেস্টুরেন্ট করিমস-এ কাশ্মীরি বিরিয়ানি নামে অখাদ্য খেলাম। কেউ যেন ভুলেও এই রেস্টুরেন্টে না ঢোকেন। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। তাই হাল্কা পায়ে হেঁটেই হোটেলে ফিরলাম।
কাশ্মীর মানেই তো বরফরাজ্য, এত বছর শুধুমাত্র তুষার-আবৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন ছবি দেখে দেখে এমন ধারণা জন্মে গিয়েছিল আমাদের সবার। কিন্তু বরফ কই, তুষারপাত কই, আমাদের তো মাথা খারাপ অবস্থা। আজ তাই আমরা সোনমার্গ যাবো। যতটুকু জেনে নিয়েছি তাতে এই ভর-গ্রীষ্মে শুধুমাত্র সোনমার্গের গ্লেসিয়ারগুলোই বরফে আবৃত থাকে। আমাদের ড্রাইভার রিয়াজভাই ঠিক সময়মতোই তুলে নিলো আমাদের হোটেল থেকে। ডাল লেক, নাগিন লেক হয়ে গাড়ি ঘুরে সোজা ঢুকে গেলো বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত সমৃদ্ধ কাশ্মীরের গাঁ এলাকায়। সোনালী পট-ভূমিকায় ধূসর পাথরের গা ও সবুজ এসবেস্টসে ছাওয়া ঘর, পাইনে ঘেরা গ্রাম গুলোকে দেখতে অনেকটা অয়েল পেইন্টিং এর মতো।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব মোটামুটি ৮০ কি: মি: , কিন্তু বিপদসঙ্কুল পাহাড়ি রাস্তা হওয়াতে এই দূরত্ব পেরোতেই প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা লেগে গেল। গাড়ি সোনমার্গ পার্কিং পয়েন্টে পৌঁছতেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। অর্থাৎ যথারীতি ঘোড়াওয়ালাদের অত্যাচার, সাথে যুক্ত হলো আরেক সমস্যা। সোনমার্গ লোকাল ভিউ দেখতে হলে সোনমার্গের বাইরে থেকে আসা কোন গাড়িকে যেতে দেওয়া হয় না। লক্কর-ঝক্কর মার্কা টাটাসুমোই হায়ার করতে হবে তার জন্যে। গ্লেসিয়ারের দূরত্ব কতটুকু জানতাম না তাই এবারও ভুগতে হল। আসা যাওয়া মাত্র ৬ কি. মি. পথের জন্যে দু'হাজার রুপি গুণতে হলো। অচিন দেশ, কী আর করা!
সোনমার্গ ভ্যালিতে পৌঁছলে আবারও ঘোড়াওয়ালা! এ যেন ঘোড়াওয়ালাদেরই রাজ্য। মেজাজটা এমনিতেও খিঁচড়ে ছিল, তাই দু'একজনকে হালকা ধমক লাগাতেই পথ ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু পেছন থেকে ঠিকই টিটকারি দিতে থাকলো এই বলে যে - হেঁটে গেলে জীবনেও বরফের দেখা পাব না। কিছুক্ষণ পরের তাদের ভবিষ্যত বাণীকে বিফল প্রমাণিত করে দেখা মিললো প্রত্যাশিত তুষার-ছাওয়া পর্বত চূড়ার, তবে অনেক উঁচুতে এবং সীমিত আকারের। গলিত বরফের হিমশীতল জল নেমে এসে সোনমার্গ ভ্যালিতে সৃষ্টি করেছে পাথুরে ছড়ার, কুলকুল শব্দে বইছে সে বিশুদ্ধ জলের ধারা। সবাই জুতো খুলে নেমে গেলাম তাতে, তবে কয়েক মুহূর্তের জন্যেই। কেননা জল এতোটাই ঠাণ্ডা যে দশ-পনের সেকেন্ডের বেশি থাকা যাচ্ছে না। খাওয়ার পানির বোতল ভরে নিলাম, সঙ্গে থাকা বিস্কুট ও জেলি সহযোগে সবাই হাল্কা নাস্তা খেলাম, স্বস্তিও পেলাম, কারণ এখানেও অক্সিজেনের ঘাটতি আছে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই ঝরনা জলবাহী পাথুরে নদী সিন্ধু, তার পাশেই নয়নাভিরাম সোনমার্গ রিসর্ট। এখানের ঘাসের লনও গলফ-কোর্টের মতো সবুজাভ, আশেপাশে নানারঙের দুষ্প্রাপ্য অর্কিডের বাগান - এককথায় অনন্য। রিসর্ট সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারলাম কাশ্মীরি মসলা সমৃদ্ধ ঝাল মুরগী ও ফ্রাইড রাইস সহকারে। খেয়ে অনিন্দ্য-সুন্দর সোনমার্গ-ভ্যালির লনের বিছানো বেঞ্চে বসে রোদ-পোহাচ্ছি আর ছবি তুলছি ইচ্ছে মতো।
রওনা হলাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। আমরা চলেছি, আর আমাদের পাশাপাশি চলেছে বরফগলা উত্তাল সিন্ধু-নদী। মাঝপথে দেখা মিললো নদীর ওপারে ম্যাপল-গাছে ছাওয়া আরেকটি উদ্যানের, এটি একটি চিলড্রেন পার্ক। মাথাপিছু দশটাকা দর্শনী দিয়ে ঢুকলাম সবাই। মাথা ব্যথা করছিল সবার, চা খাওয়া তাই জরুরি। অনেকটা চড়া দাম দিয়েই পাইন-ম্যাপলে ঘেরা গাঢ় এই সবুজে বসে চা খেলাম সবাই,আমাদের শিশুরা পার্কে আগত অন্যান্য শিশুদের সাথে খেলতে লাগলো। ঘণ্টাখানেক কাটানোর পর রওনা হলাম শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। শহরে যখন ঢুকলাম তখন আকাশ প্রদীপ পুরোপুরি নিভে গেছে।
যুসমার্গে আমাদের অভিযানটা তেমন সুখের হলো না। যতটুকু বুঝতে পারলাম, একমাত্র তুষারপাতের সময়টাতেই এই অঞ্চল আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। চিরাচরিত কাশ্মীরের গাঢ় সবুজ রূপ, বিস্তীর্ণ ঘাসের লন ও পাইনের সমারোহ। একেতো অফ সিজন, তার উপর সহিংসতার কারণে যুসমার্গ এখন বস্তুতঃ পর্যটক শূন্য। যার ফলে এখানকার ঘোড়াওয়ালাদের অবস্থাও ত্রাহি ত্রাহি। এখানকার দ্রষ্টব্য স্থান দুধ-গঙ্গা দেখার জন্যে হেঁটেই রওনা দিলাম ঘোড়ায় চড়ার হাজারো প্রস্তাব উপেক্ষা করে। একটু তফাতে সবার পেছনে আমি। এক বুড়ো ঘোড়াওয়ালা হাজির হলো তার ঘোড়া নিয়ে, অনুনয় করতে লাগলো তার ঘোড়াটি নেওয়ার জন্যে, গত কয়েকদিন উনি কোন পর্যটকও পাননি। ভাড়া হিসেবে আমার যা খুশি তাই দিলেই চলবে। আশপাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম উনিই সবচেয়ে বৃদ্ধ সহিস। মনটা নরম হয়ে গেল, উঠে পড়লাম উনার ঘোড়াতে। এদিকে আমার দেখাদেখি আমার স্ত্রীকেও উঠিয়ে নিলো বুড়োর নাতি তার ঘোড়াতে। যেহেতু আমাদের যা খুশি তাই ভাড়া দিতে হবে তাই কিছুদূর গিয়ে নোমানদেরও তুলে দিলাম অন্য চারটি ঘোড়াতে। সাতটি ঘোড়া টগবগিয়ে চললো কথিত দুধ গঙ্গার উদ্দেশ্যে. . .।

মাইলটাক যাওয়ার পরই শুরু হলো আসল বিপদ। ওরে সর্বনাশ !!! পাহাড়ের খাড়া গিরিখাত ধরে নামতে শুরু করলো আমাদের ঘোড়াগুলো, আলগা পাথুরে পথ খানাখন্দে পরিপূর্ণ। ঘোড়াওয়ালাদের হাজারো আশ্বাস সত্ত্বেও আতঙ্কে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া। কিছুদূর নেমে ঘোড়াগুলোও অস্বস্তিতে নাক দিয়ে ঘোঁ-ঘোঁ আওয়াজ করতে লাগলো আর সবেগে মাথা ও কান নাড়তে লাগলো। ঘোড়াওয়ালাদের জানালাম আমরা আর যাব না। মাথায় থাক আমাদের দুধ-গঙ্গা দর্শন। কিন্তু ঘোড়াওয়ালারা জানালো কোন সমস্যা নাই তাদের ঘোড়াগুলো অতি-প্রশিক্ষিত ও এ-পথে প্রতিদিন কয়েকবার যাতায়াত করে। ঘোড়াওয়ালাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা মৃদু কিঞ্চিৎ শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো আবারও চলতে শুরু করলো আর আমরা সর্বশক্তিতে ঘোড়ার পিঠ-আঁকড়ে পড়ে থাকলাম।
কিছুদূর গিয়েই দেখা মিললো দুধ-গঙ্গার। এবার বুঝতে পারলাম এর নাম রহস্যটি। চওড়া দৈর্ঘ্যের পাথুরে নদী দুধ-গঙ্গা। পানির রঙ সম্পূর্ণ সাদা। এখন বর্ষা নয়, তাই বিশাল পাথরের চাঁইগুলো ডিঙিয়ে সফেদ জলরাশি কুলকুল করে বয়ে চলেছে, দু'ধারে পাইনের ঘন জঙ্গল, মাথার উপর অফুরন্ত নীল। নৈসর্গিক এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি জানিনা। সম্বিৎ ফিরে পেলাম 'হ্যালো কাউবয়' সম্বোধন শুনে। ফিরে তাকিয়ে দেখি দু'জন ষাটোর্ধ্ব বৃটিশ (পরে জেনেছি) পর্যটক হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণে বুঝতে পারলাম আমাকে রাখাল বালক ডাকার কারণটি। অনেক আগে শখের বশে আমি একটি কাউবয় হ্যাট কিনেছিলাম, চিরাচরিত জিনস্‌ এর ট্রাউজার ও শীতকালীন জ্যাকেটও তার সাথে ভালোই মানিয়ে গেছে। ত্বকের রঙ পুরোপুরি পশ্চিমাদের মতো না হলেও রোদে পোড়া রাখাল-বালক হিসেবে আমাকে বেশ চালিয়ে দেওয়া যাবে। পরিচিত হলাম বৃদ্ধ দুই পর্যটকের সাথে। জানলাম ওঁরা হেঁটে হেঁটেই কাশ্মীর পর্যটন করছেন। থাকছেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা টেন্ট ও স্লিপিং ব্যাগে। রান্নাবান্নাও নিজেরাই করছেন। অনেকটা চমৎকৃতই হলাম তাদের এই অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও ভ্রমণ পদ্ধতি দেখে।
দুপুরে শ্রীনগরে ফিতে খাওয়াদাওয়া দেরে বিশ্রাম করে সন্ধ্যায় নোমান আর আমি বেরোলাম শেষ বারের মতো ডাল লেকের শোভা দর্শনে। দূরে হাউসবোটের রকমারি আলোকসজ্জা রাতের ডাল-লেককে করে তুলেছে নয়নাভিরাম। রাতের ডিনার হিসেবে কাশ্মীরি ভেড়ার টিক্কা ও নান কিনে নিলাম। রুমে ফিরেই অজান্তেই মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল।
আমাদের অন্তিম গন্তব্যস্থল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত স্নিগ্ধ এক টুকরো স্বর্গ পহেলগাঁও। সরাসরি হিমালয় থেকে নেমে আসা লিডার নদী ঘিরে রেখেছে ছোট্ট এই শহরটিকে । জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অনন্তনাগ জেলার অন্তর্গত নয়নাভিরাম এই শহরটি বছরে মাত্র ৬ মাস দর্শনার্থীদের জন্যে উম্মুক্ত থাকে। সাধারণত: অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মার্চের শেষ নাগাদ পর্যন্ত এখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রিতে ওঠানামা করে। তখন এখানে মানুষ বসবাসের অবস্থা থাকে না। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের এই হিল স্টেশনের সমস্ত দোকানপাট, হোটেল ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও তুষার পাতের জন্যে। জুলাই-আগষ্ট প্রান্তিকে মুলত: হিন্দু তীর্থযাত্রীদের অমরনাথ যাত্রার জন্যেই এ শহর খুলে দেওয়া হয়। শহর থেকে ১৬ কি:মি: উত্তরে অবস্থিত চন্দনবাড়ি থেকে শুরু হয় অমরনাথে তীর্থযাত্রা।
শ্রীনগর থেকে বেরিয়ে কোনপ্রকার বিরতি ছাড়াই আমরা ঢুকে গেলাম পহেলগাঁও এর বিস্তীর্ণ আপেল বাগানে। ইতিপূর্বে গুলমার্গ ও যুসমার্গেও আমরা আপেল বাগান দেখেছি। কিন্তু পহেলগাঁও এর মতো এতো সুবিশাল আয়তনের উদ্যান এর আগে আমাদের চোখে পড়েনি। মাইলের পর মাইল বাগান এবং সৌভাগ্য বশতঃ এখনই আপেলের ভরা মরশুম। দুপুর হয়ে এসেছিল। মূল শহর তখনও ঘন্টা খানেকের পথ। তাই আমাদের ড্রাইভার রিয়াজ ভাইকে বললাম অনুরোধ করলাম বড় দেখে একটি আপেল বাগানেই ব্রেক নিতে।
এই বাগানটির মালিক ওসমান শেখ। উনি এক ছেলে, ছেলের বউ, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে এই বাগানের পরিচর্যা করেন তিনি। কিছু বাড়তি আয়ের জন্যে বাগানের মূল ফটক সলগ্ন একটি মুদি দোকানও চালান তিনি। হোটেল থেকে সাথে করে নিয়ে আসা ফ্রাইড রাইজ ও চিলি চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সারলাম সবাই। তারপর ঢুকে পড়লাম একমাথা উচু বাগানের মধ্যে। আপেলের ভারে নুয়ে পরেছে প্রায় প্রতিটি গাছ। এক একটি আপেলের ওজনই প্রায় ছ'শ থেকে সাতশ' গ্রাম। দেখলেই জিভে জল আসে, কিন্তু বিনা অনুমতিতে ছিঁড়লেই দু'হাজার রুপি তৎক্ষনাৎ জরিমানা। ফলে শুষ্ক মুখে শুধুই ছবি তোলা। সহৃদয় বাগানমালিক হয়তো আমাদের মনোভাব বুঝতে পারলেন, সবাইকে বিশাল আকৃতির এক-একটি আপেল উপহার দিলেন খাওয়ার জন্যে। উপহারের বিনিময় মূল্য হয় না তবুও অর্থ-বৃত্তের দিকে পিছিয়ে পড়া এই কাশ্মীরিদের জন্যে ইতিমধ্যে আমাদের সবার মনে মমত্ববোধ জেগেছে । আপত্তি সত্ত্বেও তাই ওনার নাতি-নাতনিদের সবার হাতে কিছু কিছু রুপি গুজে দিলাম। খানিকক্ষণ গল্প গুজব করলাম তাঁদের সঙ্গে। রিয়াজ ভাইকে আমাদের পহেলগাঁও পৌঁছে দিয়ে আবার দিনে দিনে শ্রীনগর ফিরতে হবে। তাই অনিচ্ছা সত্বেও পাততাড়ি গোটালাম লোভনীয় ও মোহনীয় এরকম একটি বাগান থেকে।
পহেলগাঁও শহরে যখন ঢুকলাম তখন বেলা প্রায় দু'টো। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ। অথচ এরই মধ্যে হাড়কাপাঁনো শীতের উপস্থিতি। চটজলদি হোটেল ঠিক করে ফেললাম। আমাদের রুম দু'টিই রাস্তার দিকে, ফলে সামনে দণ্ডায়মান বিশাল পর্বতমালার তুষার আবৃত সুউচ্চ রিজ ও তার সমতলে অনিন্দ্য-সুন্দর পহেলগাঁও টাউন-গার্ডেন। দু'ধারে প্রবাহমান লিডার নদী, তার মাঝে ছোট ছিমছাম এই উদ্যানে পেতে রাখা রঙিন বেঞ্চ ও লাইট পোষ্ট, এবং যথারীতি নাম না জানা দুর্লভ অর্কিডের সমারোহ। হোটেলে লাগেজপত্তর রেখেই ফ্রেশ হতে হতে বেলা সাড়ে তিনটে। সবাই এক কাপ করে কফি খেয়ে নিয়ে প্রথমে গা-গরম করলাম তারপর ভারী জামা-কাপড় চাপিয়ে সোজা উদ্যানে গিয়ে উপস্থিত। শুধুমাত্র স্থানীয় কিছু কাশ্মীরি ও একেবারে নগন্য সংখ্যক পশ্চিমী পর্যটকের দেখা মিললো। সন্ধ্যা অবধি পার্কে কাটিয়ে বাচ্চাদেরকে হোটেলে পাঠিয়ে আমরা বেরোলাম নতুন দেখা এই শহরের বিপনিবিতান দর্শনে। শহর বন্ধের সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে, তাই ক্রেতাশূন্য দোকানগুলোতে সবকিছুই মোটামুটি জলের দরে বিকোচ্ছে। স্থানীয় পন্যের মধ্যে শীতের উন্নতমানের শাল ও সোয়েটারই হচ্ছে এখানে হস্ত-শিল্পের মূল নিদর্শন। আমাদের স্ত্রীরা কিছু কেনাকাটা করলো তারপর নোমান গিয়ে বাচ্চাদের হোটেল থেকে নিয়ে আসতেই মোটামুটি গোছের একটি রেস্টুরেন্টে বসে কাশ্মীরি নান সহকারে নিরামিষ খেলাম সবাই। সারাদিনের ধকলে গিয়েছে, তাই হোটেলে ফিরেই সবাই ঘুমে কাদা।
পরদিন সকালে নাস্তা না সেরেই জিপ স্ট্যান্ডে গেলাম আমি আর নোমান। প্রায় পর্যটক শূন্য এই অঞ্চলেও গাড়ি ভাড়ার সঙ্গে দিতে হবে সমিতির চাঁদা। একটু ঘোরাঘুরি করতেই স্ট্যান্ড্-এর বাইরে থেকে প্রায় অর্ধেক ভাড়ার চুক্তিতে একটি টাটাসুমো ঠিক করে ফেললাম পহেলগাঁও সাইট সিয়িং এর জন্যে। ঘন্টাখানেক সময় চেয়ে নিলাম ড্রাইভারের থেকে ব্রেকফাস্ট সারার জন্যে, তারপর গাড়িতে চড়লাম সবাই পহেলগাঁও দর্শনে।
প্রথমেই গেলাম সম্প্রতি বিধস্ত্ব হয়ে যাওয়া চন্দনবাড়িতে। নিষ্ঠুর প্রকৃতির করাল আঘাতে দুমড়েমুচড়ে গেছে সবই। স্বর্গে এসে ধ্বংসযজ্ঞ দেখাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তাই এখানে আর বেশিক্ষণ না কাটিয়ে রওনা দিলাম আরুভ্যালির উদ্দেশ্যে। চারদিকে হিমালয়ের পাইন-ফারের সবুজের সমারোহ, টুলিয়ান লেক, শীষনাগ লেক নামক অমৃতজল পাথুরে নদীদের পেছনে ফেলে আমরা এসে পৌঁছলাম আরু ভ্যালিতে। এখানকার দৃশ্যাবলী অনেকটা সোনমার্গের মতোই। তিনদিকে তুষার আবৃত পর্বতমালা ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকা, সেইসব গ্লেসিয়ার থেকে নেমে আসা বরফগলা জলের অগভীর স্বচ্ছ ঝিল, আর মাথার ওপরে অফুরন্ত নীল। সময়ের স্বল্পতার কারণে আধঘন্টার বেশি থাকা গেলনা এখানেও। গাড়ি ঘুরলো ভারতীয় চলচ্চিত্র 'বেতাব' খ্যাত বেতাব-ভ্যালির দিকে। আলোচিত এই সিনেমাটির এখানেই দৃশ্যায়িত হয়েছিল। বেতাব ভ্যালিতে লিডার নদী অনেকটা চওড়া। নান্দনিক শৈলীতে নির্মিত সেতুতে নদী পেরিয়ে ভ্যালিতে ঢুকলাম। মোটামুটি সাতটি ফুটবল মাঠের সমান আকৃতির বেতাব ভ্যালির সৌন্দর্য্য সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর। আমাদের বাচ্চারা আনন্দে নেমে পড়লো নদীর কাকচক্ষু স্বচ্ছজলে। কিন্তু মুহুর্ত কয়েকই, বরফগলা জলের ভয়াবহ ঠাণ্ডার কামড়ে পড়িমড়ি উঠে এলো পাড়ে। এই মরসুমে বেতাব ভ্যালিও কার্যত স্থানীয় পিকনিক পার্টির দখলে। আস্ত ভেড়ার রোস্ট সহকারে মসলাদার খাবারের মনমাতনো সৌরভ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে আশেপাশে, আর আমাদের ক্ষুদার্ত বেহায়া নাক তা তৎক্ষনাত ধরে ফেলছে! বেতাব ভ্যালিতে প্রায় ঘন্টা দেড়েক কাটালাম। সাথে আনা আপেল, বিস্কিট ও পানি সহকারে মিনি লাঞ্চ সেরে আবার ফেরার পথে রওনা। বিকেলে আবার আবার পদবজ্রে পহেলগাঁও শহর পরিদর্শন।
পরদিন ভোর পাচঁটাতে পহেলগাঁও থেকে গাড়িতে বেরিয়ে এলাম। এই শহরতলি তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত, নিকষকালো আকাশে শুকতারার সহ অন্য নক্ষত্রের সুস্পষ্ট হইচই। যাযাবরদের ভেড়ার পাল ও আপেলের ভরা মরসুম হওয়াতে ফলবাহী লরির চাপে প্রায় চৌদ্দঘন্টা জার্নি শেষে যখন আমরা জম্মুতে পৌঁছলাম দিল্লিগামী ট্রেন ছাড়তে তখন মাত্র আর বিশ মিনিট বাকি।

~ কাশ্মীরের তথ্য~ কাশ্মীরের আরো ছবি ~

মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানীতে কর্মরত তুহিন ডি. খোকনের বেড়ানোর নেশা ছোটবেলা থেকেই। বড় হয়ে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ফটোগ্রাফিও। বই পড়া ও গান শোনার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করছেন বেশ কয়েকবছর ধরেই।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher