কো-লার্ন দ্বীপে মধুচন্দ্রিমা

মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

থাইল্যাণ্ডের তথ্য

অথৈ সমুদ্রের জল ভেঙে ফেরিটা এগিয়ে চলেছে। রঙ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে জলের গভীরত্ব। দু-ধারে শুধু জল আর জল। হঠাৎ স্পিকারে ঘোষণা, যারা যারা প্যারাসেলিং বা স্নর্কেলিং বা স্কুবা ডাইভিং করেতে আগ্রহী তারা এই ফেরি পরিবর্তন করে অন্য ফেরিতে চলে যান। কো-লার্ন দ্বীপ থেকে ফেরার পথে আবার তাদের এই ফেরিতে তোলা হবে। দেখি বেশ কিছু তরুণ তরুণী (বেশিরভাগই চিন ও জাপান থেকে আসা) অসীম উৎসাহের সঙ্গে অন্য ফেরিতে যাবার জন্য তোড়জোড় করতে লাগল। আমরা চলেছি পাটায়া থেকে কিছু দূরে অবস্থিত কো-লার্ন বা কোরাল দ্বীপে। জলপথে ফেরিতে করে যাওয়া, দ্বীপ ঘুরে দেখা, সমুদ্র স্নান করা, দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে বিকেলে আবার পাটায়া ফেরা - এই হচ্ছে আমাদের সারা দিনের সূচী। এখানে প্যারাসেলিং-এর কায়দা গোয়ার থেকে কিছুটা আলাদা। বে অফ থাইল্যান্ড একটা জেটি - যেটা শুধুমাত্র প্যারাসেলিং এর জন্যই রাখা হয়েছে। স্নর্কেলিং ও স্কুবা ডাইভিং এর জন্যও বেশ উন্নতমানের আলাদা ব্যবস্থা আছে। আর যাঁরা শুধুই দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাদের জন্য রয়েছে আলাদা প্যাকেজ। আমরা শেষের প্যাকেজটাই নিয়েছিলাম।

পাটায়া থেকে কো-লার্ন বা কোরাল আইল্যান্ড যেতে লাগে এক ঘন্টা। ব্রেকফাস্ট খেয়ে সকাল ৯ টার সময়ে আমরা উঠে পড়েছিলাম নির্দিষ্ট বোটে। তখনই রোদের তাপ বেশ চড়া। বোটের সবাই মুখে ও হাতে - পায়ে প্রচুর পরিমাণ সান-স্ক্রীন মাখতে শুরু করলেন। দেখাদেখি আমরাও খানিকটা করে মেখে নিলাম। কিছুদূর এগোতেই জোয়ার এসে গেল। সমুদ্রে জোয়ারের টানে দুলতে থাকা ছোটো বোট থেকে আমাদের তুলে নেওয়া হল গভীর জলে অপেক্ষমাণ একটি ফেরিতে। নৌকোগুলো এমন দুলছিল যে ফেরিতে ওঠার সময় সঙ্গের বাচ্চাগুলোর জন্য একটু ভয়ভয়ই করছিল।
সমুদ্রের বুক চিরে যত গভীরে ফেরি এগোতে লাগলো ততই আমাদের অবাক হওয়ার পালা - জলের রঙ বারবার যেন বদলে বদলে যাচ্ছে। ঘন্টা খানেক চলার পর পৌঁছলাম কো-লার্ন দ্বীপে। ফেরিটি একেবারে সৈকতে না পৌঁছে কিছুটা দূরে দাঁড়াল। ফেরি থেকে নেমে, আবার ছোটো বোটে উঠলাম। তারপর খানিক জল ভেঙে পৌঁছে গেলাম দ্বীপে। এই দ্বীপের বালির রঙ প্রায় ঝকঝকে সাদা। আর জলও খুব স্বচ্ছ। শুনলাম এরকমই কোনো একটি ভার্জিন বিচে জেমস বন্ডের একটি ছবির শুটিং হয়েছিল কিছুদিন আগে।
কো-লার্ন দ্বীপটি আকারে খুব একটা বড় নয়। খুব কম মানুষজন থাকেন এখানে। পাহাড়ের মাথায় একটি চার্চ আছে। বিচে আছে কিছু রেস্টুরেন্ট, কয়েকটা স্যুভেনির শপ - যদিও সংখ্যায় খুবই কম। একটা সরু রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেছে। আমরা বিচটি হেঁটে দেখছিলাম। অন্য ফেরিতে আসা কয়েকজন পর্যটক সময় নষ্ট না করে নেমে পড়লেন ফটো শ্যুটের জন্য। তাঁদের রকম সকম দেখে বুঝতে পারলাম ওই দলের একজন বিচ মডেল। কোনো আর্ন্তজাতিক ম্যাগাজিনে বিচ মডেলিং এর ফটো পাঠাবার জন্য তাঁরা এই দ্বীপে এসেছেন। দুই-তিন জন ক্যামেরাম্যান ফটো তুলতে লাগলেন। আর আমরাও এই সুযোগে লাইভ বিচ মডেলিং দেখে নিলাম।
কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে ৫০ ভাট দিয়ে ঠাণ্ডা ডাবের জল খেয়ে রঙিন ছাতার তলায় আশ্রয় নিলাম। অনেকে বিচে ছাতার তলায় শুয়ে শুয়ে ফুট ম্যাসাজ নিচ্ছিলেন। কিছু পর্যটক সমু্দ্রে স্নান করতে নেমে গেলেন। আমরাও কিছুক্ষণ জলে হাত পা ছুঁড়ে নিলাম, কেউ কেউ বানানা রাইড চড়লেন। সমুদ্র স্নান করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। ঝকঝকে পরিস্কার ওয়াশরুমে মিষ্টি জলে স্নান করে এসে দেখি এক অভিনব লাঞ্চ রেডি। প্রতিটি টেবিলে দুটো ফ্যামিলির বসার আয়োজন। আমরা একজন জাপানি কাপল- এর সঙ্গে টেবিল শেয়ার করলাম। লাঞ্চে প্লেন রাইস, সামুদ্রিক মাছ ভাজা, আলু ভাজা ও স্কুইডের একটা পদ। এছাড়া ছিল বিভিন্ন সামুদ্রিক খাবারের একটা মিশ্র পদ যার মধ্যে অক্টোপাসও ছিল। ডেজার্টে সুন্দর করে কাটা মিষ্টি তরমুজ ও মাস্ক মেলন। আমরা সবই অল্প অল্প করে খেলাম। প্রত্যেকটি পদ বেশ সুস্বাদু। তবে অক্টোপাসটা খেতে মন সায় দিল না।
লাঞ্চের পর দু-একটা স্যুভেনির শপে ঘোরা ঘুরি করে সবে ছাতার তলায় বসেছি দেখি কী অবাক কাণ্ড - এক প্রৌঢ় ভিয়েতনামী কাপল স্যুইম স্যুট ছেড়ে হঠাৎ তাদের ওয়েডিং ড্রেস পরে ফেললেন। ওঁদের সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফার ছিলেন, তিনি একের পর এক ছবি তুলতে শুরু করলেন। প্রথমে তো বুঝেই উঠতে পারছিলাম না যে এবার কী হচ্ছে - সিনেমার শুটিং না আবার মডেলিং! একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ঐ প্রৌঢ় দম্পতি তৃতীয় বার বিবাহ করেছেন দিন সাতেক আগে। বর্তমানে পাটায়ায় এসেছেন মধুচন্দ্রিমা সারতে। নিরালা এই দ্বীপে তাঁদের মধুচন্দ্রিমাকে স্মরণীয় করে তুলতে সঙ্গে একজন ফটোগ্রাফারকে নিয়ে এসেছেন। তিনি ক্যামেরা বন্দী করতে লাগলেন দুজনের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে নির্জন দ্বীপের প্রেক্ষাপটে। ততক্ষণে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে ওঁদের অভিনন্দন জানিয়ে ছবি তুলতে শুরু করেছেন। আমরাও বা বাকী থাকি কেন? তাঁদের শুভেচ্ছা জানিয়ে অভিনব এই মধুচন্দ্রিমার কিছু মিষ্টি মধুর মুহূর্তের ছবি তুলে ফেললাম।
কখন দুপুর তিনটে বেজে গিয়েছিল কারোর খেয়াল ছিল না । হুইসেলের আওয়াজে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। তাই তো - ফেরিতে ওঠার কথা তিনটের সময়। প্রথমে হাঁটু জল পেরিয়ে আবার সেই ছোট বোটে, তারপর গভীর জলে গিয়ে নির্দিষ্ট ফেরিতে ওঠা। ফেরিতে বসে সবারই একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব - দীর্ঘক্ষণ জলে মাতামাতি করার ক্লান্তি আর পেট ভরা খাবার। আস্তে আস্তে কো-লার্ন দ্বীপ চোখের আড়ালে মিলিয়ে গেল। অতল সমুদ্রের জল কেটে কেটে ফেরিটি এগোতে লাগল। হঠাৎ থেমে যাওয়ায় চোখ খুলে দেখি সেই উৎসাহী দলটি যারা প্যারাসেলিং ও অন্যান্য প্যাকেজ নিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। ওরা ওখানেই লাঞ্চ সেরে অন্য একটা দ্বীপ ঘুরে অপেক্ষা করছিল। সূর্যাস্তের একটু আগেই পাটায়ার সৈকতে ফিরে এলাম।


থাইল্যাণ্ডের তথ্য

মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতোকোত্তর করে বর্তমানে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছোট গল্প ও ভ্রমণকাহিনি লেখেন। ভালবাসেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ও জীবনানন্দের কবিতা পড়তে। সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন দেশে-বিদেশে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher