-->
পার্বত্য প্রকৃতি, সাস্কৃতিক ঐতিহ্য, বর্ণময় আচার-অনুষ্ঠান আর অসাধারণ সব সমুদ্র সৈকত থাইল্যান্ডের সেরা আকর্ষণ। একযাত্রায় এদেশের সবটুকু রূপ-রং দেখে নেওয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র রাজধানী শহর ব্যাংককের রাজপ্রাসাদ, অজস্র মন্দির আর কাছেপিঠের দ্রষ্টব্যগুলি দেখতেই বেশ কয়েকদিন লেগে যাবে। এরপর পাটায়া, ফুকেত আর কো সামুইয়ের সমুদ্রবেলার চিরকালীন আকর্ষণ তো রয়েইছে। তবে থাইল্যান্ডে সবচেয়ে যেটা মুগ্ধ করে তা হল সাধারণ মানুষের অসম্ভব ভদ্র ও বিনয়ী ব্যবহার। অফিসে, রেস্তোরাঁয়, বিমানবন্দরে সর্বত্রই তা অনুভব করা যায়।
গত সাতশো বছরের ইতিহাসে তেমনভাবে কখনওই সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনস্থ হয়নি এই দেশ। বর্তমান রাজা ভুমিবল আদুলিয়াদেজ বা চক্রি সাম্রাজ্যের রাজা নবম রামের পূর্বপুরুষ প্রথম রাম ব্যাংককে রাজধানী স্থাপন করেন। এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে লাং না ছিল থাইল্যান্ডের রাজধানী। মন, খেমের ও তাই উপজাতীয়দের বাসভূমি এই দেশ।
ব্যাংকক (Bangkok) : সদা কর্মব্যস্ত শহর। ব্যাংককে পা রাখলেই অতীত আর বর্তমানের পাশাপাশি সহাবস্থানের ছবিটি চোখে পড়ে। ব্যাংককের মতো এত রঙিন শহর বোধহয় গোটা পৃথিবীতেই খুব কম আছে। বাড়িঘর-অফিস-কাছারি থেকে গাড়ি-ঘোড়া সবই নানা রঙে রঙিন। রাস্তার ধারে ধারে নানা রঙের ফুলের শোভাও শহরকে আরও রঙিন করে তুলেছে। দোকান, রেস্তোরাঁ, বার, মাসাজ পার্লার, ম্যল, মার্কেট নিয়ে জমজমাট শহরের রাস্তার সওয়ারি নিয়ে ছুটছে 'টুকটুক' অর্থাৎ অটোরিকশা। পথের ধারেই ফেরিওয়ালারা বেচছে খাবার। ব্যাংককের প্রধান দ্রষ্টব্য চাও প্রায়া নদীর পশ্চিমতীরে না ফ্রা লারন রোডের উপর প্রায় এক বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত প্রাচীন রাজপ্রাসাদ বা 'দুসিত মাহাপ্রাসাত'। ১৭৮২ সালে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন রাজা প্রথম রাম। প্রাসাদচত্বরেই রয়েছে ব্যাংককের আরেক আকর্ষণ ওয়াট ফ্রা কায়ে বা পান্নার বুদ্ধমন্দির। রাজা রামের আমলেই ১৭৮৫ সালে মন্দিরটি তৈরি হয়। মন্দিরের বাইরের ও ভিতরের দেওয়ালে নানা ভাস্কর্য, ফ্রেসকো ও সূক্ষ্ম কারুকাজ রয়েছে। বুদ্ধের মূর্তিটি একটিমাত্র জেড পাথর কেটে তৈরি। প্রাসাদচত্বরে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির এবং কাম্বোডিয়ার আঙ্কোরভাটের একটি মিনিয়েচার মডেল আছে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে বারোটা এবং দুপুর একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত গ্র্যান্ড প্যালেস খোলা থাকে।
ব্যাংককের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির ওয়াট পো বা ওয়াট ফ্রা চেতুপন। শায়িত বুদ্ধের এই মন্দিরটি পঁচানব্বইটি প্যাগোডা, বোধিবৃক্ষ ও কৃত্রিম ঝরনায় সজ্জিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে মোট ৩৯৪টি বুদ্ধমূর্তি আছে। তবে প্রায় দেড়শো ফুট লম্বা ও চল্লিশ ফুট উঁচু বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের শায়িত সোনার পাতে মোড়া মূর্তিটি সত্যিই অসাধারণ। ব্যাংককের আরেক দ্রষ্টব্য সোনার বুদ্ধমন্দির। প্রধান বুদ্ধমূর্তিটি প্রায় পনেরো ফুট উঁচু। দ্য ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রয়েছে প্রায় ১৫০০ বছরের বৌদ্ধ শিল্পকলার নিদর্শন। বুদ্ধদেবের জন্মস্থানের নামাঙ্কিত সবুজ ঘাসে মোড়া লুম্বিনি পার্কটিও ভারি সুন্দর। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে।
মন্দির, রাজপ্রাসাদ, মিউজিয়াম, পার্ক ঘুরে দেখে স্টিমারে ভেসে পড়া যায় চাও প্রায়া নদীর বুকে। চাও প্রায়া নদীর বুকে সূর্যাস্ত এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
'ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই'-চলচ্চিত্রের কল্যাণে বিশ্বখ্যাত এই ব্রিজটিও দেখে নেওয়া যায়। একসঙ্গেই বেড়িয়ে নেওয়া যায় এরওয়ান জলপ্রপাত। ব্যাংকক থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে ওয়াট ফা লুয়াং টা বুয়া বা ব্যাঘ্রমন্দির। বৌদ্ধমন্দিরটিতে লামাদের সঙ্গে থাকে পোষা বাঘেরাও।
পাটায়া (Pattaya): ব্যাংকক থেকে ১৪৭ কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ডের অন্যতম সেরা সৈকত পাটায়া। সৈকতে গার্ডেন হাতার নীচে ডেকচেয়ারে গা এলিয়া দিয়ে সমুদ্রের আমেজ উপভোগ করতে দারণ লাগে। সৈকত জুড়ে রয়েছে আমোদ-আয়েশের এলাহি ব্যবস্থা। অসংখ্য রেস্তোরাঁ-বার, সৈকতের ধারে রেস্টুরেন্টগুলিতে কিং লবস্টার, টাইগার প্রনের সব লোভনীয় ডিশও মিলবে। বিচ রোড থেকে স্পিডবোটে পৌঁছে যাোয়া যায় সমুদ্রের গভীরে এক প্ল্যাটফর্মে। এখান থেকে প্যারাগ্লাইডিংয়ের ব্যবস্থা আছে। ফেরিতে ঘুরে আসা যায় কো-লার্ন দ্বীপ থেকে। কোরাল দ্বীপে রয়েছে স্নর্কেলিং-এর ব্যবস্থাও। রাতের পাটায়া আবার অন্যরকম মাদকতায় ভরপুর। রাস্তায় রাস্তায় রয়েছে বিয়ার বার, পাব, ডিস্কো থেকে, মাসাজ পার্লার, নাইট ক্লাব। পাটায়ার আরেক আকর্ষণ না নুচ বোটানিক্যাল গার্ডেন।
চিয়াং মাই-চিয়াং রাইঃ উত্তর থাইল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত বর্ণময় অঞ্চল চিয়াং মাই ও চিয়াং রাই। ব্যাংকক থেকে দূরত্ব যথাক্রমে ৭৮৫ ও ৮৯০ কিলোমিটার। লানা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা মেংগ্রাই ১২৬২ সালে চিয়াং রাই রাজ্যটি ও পরবর্তীকালে ১২৯৬ সালে চিয়াং মাই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ আর স্থানীয় জনজাতিদের নিয়ে অনন্য চিয়াং রাই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,০২৭ ফুট উচ্চতায় মন্দিরের দেশ চিয়াং মাই। স্থানীয় প্যাকেজট্যুরে শহর ও কাছেপিঠের দ্রষ্টব্যগুলি ঘুরে নেওয়া যায়। সবথেকে প্রাচীন চিয়াংমান বৌদ্ধমন্দিরে বুদ্ধের মূর্তিটি স্ফটিকের তৈরি। অন্যান্য মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেভিলুয়াং মন্দির, সোয়াংডট মন্দির ও বুপ্পারাও মন্দির। মন্দির ছাড়াও বৌদ্ধগুম্ফা, প্রাচীন তোরণ, প্রাচীর, ধ্বংসস্তূপ ঘুরে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। হস্তশিল্পের জন্য খ্যাত বোসাং গ্রাম। স্থানীয় শিল্পীদের হাতে তৈরি রঙিন রঙিন ছাতা সংগ্রহ করে রাখার মত।
দোই সুথেপ পাহাড়ের মাথায় ৩,৫২০ ফুট উচ্চতায় প্রাচীন বুদ্ধমন্দিরটি চিয়াং মাইয়ের প্রতীক। মায়ানমার সীমান্তে মে হংসন ও আখা উপজাতি গ্রামদুটিও দ্রষ্টব্য। এখানকার বাসিন্দা উপজাতি মেয়েদের গ্রীবা দীর্ঘ হয়। মে হংসনে হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলভ্রমণও ভালো লাগে।
যাওয়াঃ কলকাতা থেকে জেট, থাই ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ব্যাংকক যাচ্ছে। সময় লাগে মোটামুটি আড়াই ঘন্টা। ব্যাংকক থেকে চিয়াং মাই থাই এয়ারওয়েজের বিমানে ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছোনো যায়। এছাড়া বাস বা ট্রেনেও ব্যাংকক থেকে চিয়াং মাই যাওয়া যায়।
জরুরি: রাজপ্রাসাদ ও বৌদ্ধমন্দিরে প্রবেশের নিয়মকানুন মেনে চলবেন। থাইল্যান্ডের কোনও ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগের সময় সংস্থাটির বৈধ লাইসেন্স আছে কি না যাচাই করে নেবেন। ব্যাংককের স্থানীয় মুদ্রা বাট। ১বাট=১.৮৬ টাকা, ১ বাট=০.০৩১ ইউ এস ডলার (জুলাই, ২০১৪)।
কয়েকটি থাই শব্দ: হ্যালো - সোয়াৎ ফি, হ্যাঁ - চাই, না - মাই চাই, থ্যাঙ্ক ইউ - খোব খুন।
থাইল্যান্ডের আই এস ডি কোডঃ ৬৬
খাওয়া : চাইনিজ ও থাই খাবারের সমারোহ শহরের সর্বত্র। টম ইয়াং কুং হচ্ছে নারকেলের দুধ, কাঁচালংকা, আদা, লেমন গ্রাস, মাশরুম আর চিংড়ি দিয়ে তৈরি একরকম স্যুপ। স্টিমড রাইস উইথ গ্রিনহোল পিপারকর্ন দিয়ে সবুজ অথবা লাল চিকেন কারি। কাঁচা পেঁপে, আম, লেবুর রস আর লংকা মেশানো স্যালাড এর সঙ্গী। চেখে দেখা যায় শার্ক ফিন স্যুপ আর বার্ড নেস্ট স্যুপ। ছোটো ছোটো ফলের আকারে তৈরি মিষ্টিগুলি দেখতেও ভারি মজা লাগে। ভালো লাগবে রোজ অ্যাপল, ম্যাঙ্গোস্টিন।
কেনাকাটা: শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র বিশাল বিশাল ঝাঁ-চকচকে ম্যল। এর মধ্যে জনপ্রিয় এম বি কে, সিয়াম প্যারাগন, সেন্ট্রালওয়ার্ল্ড, ফ্লোটিং মার্কেট, প্যানথিপ প্লাজা, আই টি ম্যাল, চাতুচক উইকেন্ড মার্কেট, সুয়ান নাইট মার্কেট। স্থানীয় হস্তশিল্প, সিল্ক, গয়না, জামাকাপড়, জুতো, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেট এমন হরেক জিনিস রাখা যায় কেনাকাটার তালিকায়।
থাকা: বিভিন্ন ট্যুরিজম সংস্থা থাইল্যান্ডের নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ব্যবস্থায় থাইল্যান্ড ঘুরতে চাইলে হোটেল ও নানান প্যাকেজের খোঁজ পাওয়া যাবে www.tourismthailand.org, www.agoda.com এই সব ওয়েবসাইটে।
~ ভ্রমণ কাহিনি - কো-লার্ন দ্বীপে মধুচন্দ্রিমা ~