সান্দাকফুর টানে
শাশ্বতী ঘোষ
~ সান্দাকফুর তথ্য~ সান্দাকফু ট্রেক রুট ম্যাপ~সান্দাকফুর আরো ছবি ~
অনেক দিন একসঙ্গে কোথাও যাওয়া হয় নি।
হঠাৎই সব ঠিক করে এবছর সরস্বতী পুজোর দিন বেরিয়ে পড়েছিলাম সদলবলে - সম্পূর্ণ পারিবারিক ট্রেকিং দল - আমি, দিদি (বেদাতী), জামাইবাবু (শঙ্খশুভ্র), বোন(অদিতি) আর ভগ্নিপতি (সুদীপ)। গন্তব্য বহু আকাঙ্খার সান্দাকফু।
৪ ফেব্রুয়ারী রাতে শিয়ালদহ থেকে পদাতিক এক্সপ্রেস-এ যাত্রা করে পরদিন বেলা একটার সময়, প্রায় তিনঘণ্টা দেরিতে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম। নেমে দেখি আমাদের গাইড সান্তা কুমার তামাং সকালেই মানেভঞ্জন থেকে গাড়ি নিয়ে এসে অপেক্ষা করে আছে। পরিচিতি পর্ব শেষ করে মালপত্র গাড়িতে চাপিয়ে রওনা দিলাম মানেভঞ্জনের উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি থেকে কিছুটা এগিয়ে গারিধুরায় কিছুক্ষণ জলখাবারের বিরতি। তারপর গাড়ি চলল পাহাড়ের দিকে।
পথের দুদিকে চা বাগান, সুন্দর চিত্রপট। একে একে ছেড়ে এলাম বিভিন্ন জনপদ। থারবো চা বাগানে আবার খানিকক্ষণের বিরতি। খুব সুন্দর থারবো চা বাগান। মিরিক ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে পথের পাশে সারিবদ্ধ পাইন গাছ। ছবির মত পথ ধরে বিকেল ৪-৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম মানেভঞ্জন। একটা বাঁধানো সরু নালা আলাদা করেছে ভারত আর নেপালকে। আমাদের সেদিনের আস্তানা হিমালয় হোটেল। পায়ে হেঁটে ছোট্ট মানেভঞ্জন ঘুরে, নালা পেরিয়ে নেপাল ছুঁয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ আমাদের পদব্রজে সান্দাকফু যাত্রা শুরু করার কথা। আমরা তৈরি, সকাল ৭টায় গাইড সান্তার আসার কথা। ঠিক ৭টায় গাইড এল কিন্তু সে তো সান্তা না! নতুন গাইড নিজের পরিচয় দিলেন রুদ্র ছেএী। জানালেন সান্তা তামাং-এর স্ত্রী অসুস্থ থাকায় যেতে পারবেন না তাই রুদ্রকে পাঠিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সান্তা নিজেই এসে সব বললেন। তাঁর স্ত্রীর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে আমরা রুদ্রজীর সঙ্গে যাত্রা শুরু করলাম।
মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর দূরত্ব ৩১ কিমি। সিংগালিলা অভয়ারণ্যের মধ্যে দিয়ে পথ। পারমিট করে নিয়ে যাত্রা শুরু। পাইন ঘেরা চড়াই পথ ধরে চলতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে বিশ্রাম, তার সঙ্গে সুন্দর কিছু দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করা। দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছালাম ৪ কিমি দূরে চিত্রে গ্রাম। চিত্রেতে জলখাবারের বিরতি। ম্যাগি, চা আর সঙ্গে আনা কেক সহযোগে জলখাবার ভালই হল। আবার যাত্রা শুরু। এখান থেকে চড়াই কিছু কম। কখনও ছোট গাছ আবার কখনও জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। অনেক ওষধি গাছ বা গুল্ম এই পথে পাওয়া যায়। গাইড অনেক রকম গাছ আর গুল্ম দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললেন। বেলা ১১ টা নাগাদ এলাম মাত্র ৩-৪ ঘর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের বসতি লামেধুরা গ্রামে। আকাশ তখন মেঘে ঢেকে গেছে। একটু বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। দিদি ইতিমধ্যে অনেকটা এগিয়ে গেছে, মাঝে আমি আর বোন আর দুই জামাই একেবারে পিছনে। বেলা ১ টা নাগাদ পৌঁছলাম মেঘমাতে। মেঘে ঢাকা মেঘমা, এক হাত দূরের জিনিসও দেখা দুষ্কর। সেনাবাহিনীর শিবিরে সবার নাম নথিভুক্ত করিয়ে প্রবল শীতের মধ্যে চন্দ্র স্যারের দোকানে গিয়ে বসলাম। দু গ্লাস করে গরম জল খেয়ে মনে হল দেহে যেন সাড় এল। চা খেয়ে বসে রইলাম কিন্তু বাকিদের পাত্তা নেই। বেলা ৩ টে নাগাদ আমি আর দিদি আবার চলা শুরু করলাম। গাইডকে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করতে বলে এলাম। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। সেই মানেভঞ্জন থেকেই আমাদের সাথী একটা করে কুকুর। প্রথমটি চিত্রেতে এসে চলে যায়। চিত্রে থেকে অন্য একটা কুকুর আমাদের সঙ্গী হয়। মেঘমা থেকে সেও আমাদের গাইড। ঘন মেঘে ঢাকা পথ ধরে কুকুরটির পাশে পাশে ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর হঠাৎ মেঘ কেটে গেল, দেখি সামনে সুন্দরী টুমলিং। প্রথমেই পড়ল শিখর লজ, আমাদের দ্বিতীয় দিনের আস্তানা। খুব পরিষ্কার করে সাজানো। লজ থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা! অসাধারণ সেই দৃশ্য।
পরের দিন, ৭ তারিখের গন্তব্য হল কালপোখরি। সকাল ৭টা নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তা মোটামুটি সুন্দর। বেলা ৯টা নাগাদ ৪ কিমি. দূরে জৌবারি পৌঁছলাম। ইন্দিরা হোটেলে মোমো আর চা খেয়ে আবার পথ চলা শুরু। এবার শুধু নেমে চলা উৎরাই পথে। দেখতে দেখতে চলে এল ২ কিমি. দূরের গৈরিবাস। আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেল। এখান থেকে আবার শুরু হল দমফাটা চড়াই। আকাশ মেঘলা, তার সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম কাইয়াকাটা। দেহের উন্মুক্ত সামান্য অংশ মনে হচ্ছে যেন জমে যাবে। কাইয়াকাটার পর থেকে রাস্তা মোটামুটি সমতল কিন্তু প্রচণ্ড হাওয়ার দাপট। যত এগিয়ে চলেছি মেঘের আনাগোনাও বেড়ে চলেছে। অবস্থা এমন হল যে এক ফুট দূরের জিনিসও মেঘে ঢেকে গেল আর ঝড়ের বেগে হাওয়া বইতে লাগল। দিদি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আমরা গাইড এর সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। মাঝে মাঝে পথের ধারে ঝরনার জল জমে রয়েছে। এক সময় পৌঁছে গেলাম কালপোখরি। কালপোখরি একটা ছোট হ্রদ যার জলের রঙ কালচে। ঝড়ো হাওয়ার দাপটে সোজা হয়ে দাঁড়ানো দায়। আমাদের সেই রাতের আস্তানা ছুয়ান লজ। সন্ধ্যা ৭-৩০ টার মধ্যে রাতের খাওয়া শেষ করে লেপের ভিতর ঢুকে পড়লাম। রাত যত বাড়তে লাগল, হাওয়ার দাপটও ততো বাড়তে লাগল। চিন্তা শুরু হল সান্দাকফুতে এভারেস্ট দেখতে পাব তো? ঠাণ্ডায় ভাল করে ঘুমাতেও পারলাম না।
ভোর ৫ টা নাগাদ দেখি আলো ফুটেছে কিন্তু হাওয়াতে জানলা খোলা মুশকিল। অনেক কষ্টে জানলা সামান্য ফাঁক করে মন আনন্দে নেচে উঠল। বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশ! তাড়াতাড়ি সুস্বাদু তিব্বতী রুটি, আলুর তরকারি আর জ্যাম দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সান্দাকফুর উদ্দেশ্য। বিকেভঞ্জন (মানে বিষাক্ত উপত্যকা) পর্যন্ত পথ বেশ সুন্দর। বিকেভঞ্জনে চা খেয়ে আবার চলা শুরু। এবার শুধুই চড়াই। কিছুক্ষণ পর থেকে চোখের সামনে ভেসে উঠল কাঞ্চনজঙ্ঘা, পান্ডিম, সিম্ভো, কাব্রু ও অন্যান্য তুষারাবৃত শৃঙ্গ। সিলভার পাইন ঘেরা পথ, নীল আকাশ আর তুষার ধবল শৃঙ্গরাজি - সব মিলিয়ে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য! বেলা ১২-৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম বহু আকাঙ্ক্ষিত সান্দাকফুতে (মানে বিষাক্ত হাওয়ার দেশ)! পরিষ্কার আকাশ, কিন্তু শৃঙ্গগুলি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। প্রবল বাতাসের দাপটে রোদের মধ্যেও দাঁড়ানো দায়। বাইরের তাপমাত্রা শূন্যের নীচে!
আমাদের আস্তানা হোটেল সানরাইজ। এই পথে একটা মজার ব্যাপার হল পথ মাঝে মাঝে নেপাল দিয়ে আবার কখনও ভারত দিয়ে। আমাদের হোটেল সানরাইজ নেপালে কিন্তু সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট ভারতে! ৯ তারিখ ভোর পাঁচটায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর প্রবল হাওয়া উপেক্ষা করে চলে গেলাম ভিউ পয়েন্ট থেকে সূর্যোদয় দেখতে। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সামনে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি কোণে হিমালয়ের অসংখ্য শৃঙ্গরাজি। বাঁদিকে খুব সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে তিন বোন (Three sisters – Lhotse, Mt. Everest, Makalu) - লোৎসে, এভারেস্ট, মাকালু! একেবারে সামনে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা সোনালি হয়ে উঠল। অসাধারণ সে দৃশ্য যা ক্যামেরায় ধরা যায় না, মনের মণিকোঠাতেই একমাত্র বন্দী করে রাখা যায়। সোনালি শৃঙ্গেরা ধীরে ধীরে রুপোলি হয়ে উঠতে লাগল ...
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথ গুরদুম হয়ে সিরিখোলা। বেলা ৮-৩০ নাগাদ নামা শুরু হল। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে খাড়া উৎরাই পথে নেমে চললাম। প্রচণ্ড হাওয়ায় গাছের পাতা নড়ার আওয়াজ জঙ্গলের স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিচ্ছে বার বার। আর কোন শব্দ নেই। প্রায় ৫ কিমি. পথ পেরিয়ে এসে একটা সমতল জায়গায় একটু বিরতি। দেখা হল ইজরায়েল থেকে আসা এক দম্পতির সঙ্গে। ওঁরা গুরদুম দিয়ে সান্দাকফু যাবেন। আবার চলা শুরু । প্রায় ৭০ ডিগ্রি খাড়াই পথ দিয়ে শুধু নেমে যাওয়া। দেখতে দেখতে ১৪ কিমি. দূরের গুরদুম চলে এলাম বেলা একটা নাগাদ। একটা লজ সামনে পড়ল। সেখানে ডিমের অমলেট, চা আর কেক খেয়ে খানিক বিশ্রামের পর আবার শুরু হল পথ চলা। পাথরে বাঁধানো পথ। যেন আরও বেশি খাড়াই। এই পথে হাঁটা মনে হয় বেশি পরিশ্রমের। দূরে নীচে চোখে পড়ল খুব সুন্দর ছবির মত তিম্বুরে গ্রাম। পথ ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। মাঝে মাঝে কিছু বুনো ফুল ফুটে রয়েছে। দু একটা গাছে লাল রডোডেনড্রন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর জলের শব্দ কানে এলো। সিরিখোলার বয়ে যাওয়ার আওয়াজ। বুঝলাম পথ শেষ হয়ে আসছে। বিকেল ৪টে নাগাদ পৌঁছে গেলাম সিরিখোলার ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে কিছুটা দূরে রাতের আস্তানা হোটেল শোভরাজে। একদিনে নেমে এলাম প্রায় ১৯ কিমি. পথ। শেষ হল আমাদের চার দিনের পথ চলা।
সিরিখোলা থেকে পরদিন, ১০ তারিখ, গাড়িতে নিউ জলপাইগুড়ির পথ ধরলাম। ছবির মত অপরূপ পথ দিয়ে গাড়ি চলল। পথে পড়ল সুন্দর,সাজানো সব গ্রাম। ধোতরে এসে দেখি পরিষ্কার নীল আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা! থমকে দাঁড়ালাম শেষ বারের মতো। আবার এগিয়ে চলা।
ক্রমশ পেরিয়ে গেল চেনা মানেভঞ্জন, মিরিক...
ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল পাইনের বন, চা বাগান।
~ সান্দাকফুর তথ্য~ সান্দাকফু ট্রেক রুট ম্যাপ~সান্দাকফুর আরো ছবি ~
পেশায় সফটওয়্যার প্রফেশনাল শাশ্বতী ঘোষ একটি বেসরকারি সংস্থাতে ম্যানেজার পদে কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসেন ভ্রমণ কাহিনি পড়তে। বড় হয়ে ভ্রমণ আর ট্রেকিং-এর আকর্ষণে ঘুরেছেন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়াও বই পড়া, গান শোনা, ছবি তোলা তাঁর নেশা।