সমুদ্রকন্যা লাক্ষাদ্বীপ
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
~ লাক্ষাদ্বীপের তথ্য ~ লাক্ষাদ্বীপের আরও ছবি ~
প্রস্তুতি
ভারতবর্ষের মানচিত্রের মোটামুটি দক্ষিণ পশ্চিমে লক্ষ হীরার মত লক্ষ দ্বীপ... আমরা বলি লাক্ষাদ্বীপ। আরবসাগরের নোনাজলের বুকে ভেসে থাকা এই দ্বীপের সংখ্যা কিন্তু সাকুল্যে সাঁইত্রিশ! প্রাচীন ও মধ্য যুগের কিছু নাবিকদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই দ্বীপপুঞ্জের। কিন্তু সংখ্যাটি সঠিক না জানার দরুণ লোকমুখে দাঁড়িয়েছিল লক্ষাধিক। কেরালার রাজকুলের সঙ্গে আরব বনিকদের জলবাণিজ্যসূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল কয়েকটির। তারপর নারকেল চাষ ও বসতি গড়ে ওঠা।
ঠিক হয়েছিল পুজোয় লাক্ষাদ্বীপ। শরতের দুপুরে পৌঁছে গেলাম কেরালার কোচি বিমানবন্দরে।
উড়ান
পরদিন কোচি বিমানবন্দর থেকে সকাল দশটায় আমাদের উড়ান। ঝকঝকে ছিমছাম বিমানবন্দর। শোনা গেল লাক্ষাদ্বীপ যাবার বিমানের আসন সংখ্যা মাত্র ষোল! উত্তেজনায় টগবগ করছিলাম... সত্যি যাচ্ছি তা হলে, সত্যিই!
প্লেন ছাড়ার কিছু আগে কফিপান করছিলাম। হঠাত পেছন থেকে শুনলাম 'অমায়িক' কেউ ভাঙা বাঙলায় বলছে, "আজ আর প্লেন উড়বে না ম্যাডাম।" ফিরে দেখলাম জাঁদরেল চেহারা, দরাজ গলার মালিককে। আগে দেখেছি বলে মনে পড়লো না। কফি শেষ করে প্রতীক্ষা করছিলাম। এখানে ভিড় ও ব্যস্ততা দুইই কম। কাচের দরজার মধ্যে দিয়ে অপেক্ষমান বিমানদের দেখা যাচ্ছিল। রানওয়েতে খানিকটা দূরে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের খেলনা যান। একসময়ে নির্দেশ এলো আমাদের জন্যে। হাতব্যাগ বগলদাবা করে লাইন দিলাম ওঠার জন্যে। এবারে "হাই" বললেন এক ফরাসি কন্যে। সঙ্গে পুরুষটি (স্বামী বা বন্ধু) অতি সুদর্শন, দীর্ঘকায়, গৌরাঙ্গ। মাথায় লম্বা হ্যাট, পরিধানে বারমুডা ও সুতির গেঞ্জি। মেয়েটির পোষাকও সমগোত্রীয়।
সাকুল্যে এগারোজন যাত্রী নিয়ে আকাশে উড়লো আমাদের জাহাজ। গন্তব্য আগাট্টি, লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র দ্বীপ, যেখানে আছে বিমানবন্দর। রাজধানী কাভারট্টির সঙ্গে সংযোগের উপায় জাহাজ কিম্বা হেলিকপ্টার। সেখানে এয়ারপোর্ট নেই। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দরাজ গলা এবং দশাশই চেহারার সেই প্রৌঢ় এসে বসলেন কক্পিটে। আলাপী মানুষ, অভিজ্ঞতায় ও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আমরা ক্রমশঃ অনেক উঁচুতে। কন্যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল নীচে। ছোট্ট জানালার মধ্যে দিয়ে বিরাট দর্শন হয়ে গেল। দেখলাম, প্রকৃতির দুনিয়ায় কোনো বিবাদ নেই, বিভেদ নেই, বর্ণ-ধর্ম-জাতিভেদ এসব কিছুই নেই! দিব্যি সুন্দর সহাবস্থানে চঞ্চল উচ্ছল নীলচে-সবুজ আরবসাগর আর শান্ত, গভীর গম্ভীর নীল ভারত মহাসাগর। মাঝে কোনো বিচ্ছিন্নতার রেখা টানা নেই। তাই পৃথিবীর রাজনৈতিক আর ভৌগোলিক মানচিত্র পুরো আলাদা। একটি আমাদের স্বার্থপর ঈর্ষাকাতর ভাগাভাগির শিকার আর অপরটি প্রকৃতির পরম যত্নে, কোমলতায় সস্নেহ রচনা। ক্রমশঃ স্পষ্টতর হচ্ছিল সবুজ-সাদায় মেশা সে দ্বীপ। আগাট্টির ছোট্ট এয়ারপোর্টে নামলাম আমরা। বিচ-রিসর্টের দু'জন কর্মী সসম্মানে গ্রহণ করলেন অতিথিদের।
বেলাভূমে
বেলা প্রায় সাড়ে এগারো। আগাট্টি বিচ রিসর্টের কর্মীরা আতিথেয়তা করলেন প্রত্যেককে কচি ডাব দিয়ে। মিষ্টি জল মুহূর্তে আমাদের তৃষ্ণাহরণ করল। রিসেপশন-কক্ষ কংক্রিটের নয়। নারকেল পাতায় ছাদ ও দেওয়াল, শুধু লাল সিমেন্টের মেঝেটুকু। বড় আরাম লাগল তার আপন করা স্নিগ্ধতা। খাতা খুলে নামধাম মিলিয়ে নিলেন ম্যানেজার। নিয়মরক্ষার কাজ শেষ করে মালপত্র নিয়ে এবার সংরক্ষিত কটেজের দিকে এগোলাম। রিসেপশন পেরিয়েই বিশাল ডাইনিংরুম। সাদা বালিতে পা বসে যাচ্ছে, পদক্ষেপ শ্লথ। ঘরের কাছে এসে দেখি, অস্থায়ী কুটির যেন আলগা করে তটভূমির ওপরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে সাদা নুনের মত বালি আর অদূরেই সমুদ্রের নীলাভ সবুজ রেখা। আরও অনেকগুলি এইরকমের ঘর ইতস্তত ছড়ানো রয়েছে। সেগুলোর মাঝে নানা উচ্চতার নানা বয়সের নারকেলগাছেরা। তাতে দড়িতে বোনা নেটের দোলনা বাতাসে দুলছে।
জিনিসপত্র রেখে সংলগ্ন বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ধবধবে সাদা বালি। মাথার ওপরে অমল আকাশ, স্তরে স্তরে দুঃখহীন সাদা মেঘেরা, ঠিক সামনে দিগন্তরেখায় মিলে যাওয়া শান্ত সমুদ্রের অপার বিস্তার। এটি মূল সমুদ্রের অংশমাত্র (লেগুন)। জলের নীচে বিস্তৃত প্রবালদ্বীপের উপস্থিতি সামুদ্রিক উদ্দামতাকে প্রশমিত করেছে। তাই ঢেউ নেই এখানে। শুধু বাতাসের ধাক্কায় দোলা লাগছে আর তীরভূমি ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে জল - স্থির সংযত। জলের বুকে ছোট জেটিঘাট। জল অগভীর বলে বড় জাহাজ ঢুকতে পারেনা। তবে, কেউ যদি যেতে চায় কোচি বা কাভারট্টি, এখান থেকে ছোট বোট তাদের সেই জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে। ওরকম গোটাচারেক ছোট বোট নোঙর করা... নাচছিল জলের ঢেউয়ে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে এগোতে থাকি, পায়ে হেঁটে যতখানি যাওয়া যায়।
রিসর্টের মূল দরজাটি পার হয়েই সরু ও সর্পিল পিচের রাস্তা লম্বালম্বি সমান্তরালে চলেছে। এক মাথায় আগাট্টি বিমানবন্দর (যেখানে আমরা নেমেছি) আর অন্যপ্রান্ত ধরে হেঁটে গেলে শহরের অন্য একটা অংশ। রাস্তাটার আড়াআড়ি কী? একটু দাঁডিয়ে নজর করে দেখি, অন্যদিকেও সাদা বালি দেখা যাচ্ছে। ঢাল গেছে নেমে আর শোনা যাচ্ছে জলোচ্ছ্বাসের পরিচিত শব্দ। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সামান্য যেতেই আবার সফেন সমুদ্ররেখা - গাঢ় নীল। মেঘের সঙ্গে মিল সাদা ফেনার আর আকাশের সঙ্গে জলের। অনন্তকাল ধরে এদের এই জানাচেনার খেলা! যে নরম উষ্ণ বাতাস গায়ে এসে লাগছিল, কে বলতে পারে কোন শতাব্দীর প্রাচীন গুহাকন্দর পার হয়ে, কোন পুষ্পবরণী আরবসুন্দরীর সুবাস বয়ে এনে আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে! ধাঁধাঁয় পড়লাম। সাধারণত সমুদ্রশহরের একদিকেই সমুদ্র দেখেছি, অন্যদিকে থাকে গড়ে-ওঠা আধুনিক শহর। এখানে এমনটা কেন? কী রহস্য? বিস্ময়ের নিরসন হলো খানিক পরে। জানলাম, আগাট্টি দ্বীপটি দৈর্ঘে সাড়ে আট কিলোমিটার মতো, আর চওড়া? মাত্র তিন কিলোমিটার। মনে পড়ল স্কুলের ভূগোলে মুখস্থ করেছিলাম, "দ্বীপ হলো সমুদ্রের মধ্যবর্তী এক ভূখন্ড, যার চারদিকে জল।" আজ এত বছর পরে সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে তার সত্যিকারের উপলব্ধি হলো আমার। ততক্ষণে ঢেউয়েরা আমাদের পায়ের কাছে এসে ডাকাডাকি করছে। পা বাঁচাতে পিছিয়ে যাই, আলগা বালিতে গেঁথে যায় পা। এখানে বালিতে মাটির ভাগ খুব কম, লবণ বেশি। বালি লাগলে গা চটচট করে, সহজে ছাড়তে চায়না।
বালির পাড় ধরে ধরে চলছিলাম। ইতস্তত চোখে পড়ছিল নানান সামুদ্রিক প্রাণীর খোলসের টুকরো টাকরা। বেশ ধারালো অনেকগুলো। খালি পায়ে চলা মুশকিল। কিছুক্ষণেই আপাদমস্তক বালিমণ্ডিত উঠে এলাম রাস্তার ওপরে। এবার রাস্তা ধরে এগোই। দুপাশে বাউন্ডারির মাঝে ছোটো একতলা ঘরগুলো এখানকার মানুষজনের বসতি। মাঝখান দিয়ে সরু সিঁথির মতো ওই একমাত্র রাস্তা। একজন মধ্যবয়সী ডাব কেটে কেটে স্তূপাকারে রাখছিল। আমাদের দেখে বললেন, "গুড মরনিং। হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?" নাম বললাম আমরা, তিনিও বললেন।
জানতে চাইলাম, ডাব পাওয়া যাবে কী না। মুশকিল হল, রাষ্ট্রভাষাটি এখানে অচল। ওরা নিজেদের মত ইংরেজি, মালয়ালাম ও আঞ্চলিক ভাষা মিলিয়ে কাজ চালায় ট্যুরিস্টদের সঙ্গে। আর আকার-ইঙ্গিত তো আছেই। এই লোকটির সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়েছিল। বিচ রিসর্টের একজন কর্মী সে। আমাদের প্রতিটা নৌকাযাত্রায় একে পেয়েছি। মজলিশি মেজাজ, মিশকালো গায়ের রঙ, অসমান দাঁতের পাটি, আর মাথার নীল টুপি সমেত ছবিটা আঁকা হয়ে গিয়েছিল মনে।
সুনীল সাগরে শ্যামল কিনারে
প্রতিদিন মুহূর্তগুলোকে চেখে দেখেছি, কোথাও এতটুকু ফাঁকি দিইনি। যে বিচ্ছিন্ন নিমেষ সযত্নে সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে সামগ্রিক রূপটি তৈরি হয়েছিল, তার কোনটি বেশি আনন্দদায়ক বলা শক্ত। বিভূতিভূষণের অপুর কথা মনে হল, "নিজের আনন্দের হিসেবে তুমিও একজন দেশ আবিষ্কারক।" গ্লাসবটম বোটে বসে সমুদ্রতল দেখার অভিজ্ঞতা আন্দামানে হয়েছিল একবার। তবু বারেবারে দেখা তো নয়! পায়ের কাছে তাই জলতলের রঙিন প্রবালদ্বীপের বিশালতা, জলচরদের অবাক জীবন স্বপ্নের মত ভেসে গেল চোখের ওপর দিয়ে। প্রবালরাজ্য কী রঙিন... পান্নার মতো, রক্তগোলাপের মতো, মার্বেলের মত। আমাদের আশেপাশে নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করছিল মস্ত দুই কচ্ছপ। এরা ভারী মজার। প্রবালসমাজের দুই বিশিষ্ট বাসিন্দা - খুব বন্ধুভাবাপন্ন!
দুপুরের খাওয়াটা বেশ। সামুদ্রিক মাছভাজা, চিকেন, আর কিছু নিরামিষ পদ। সরষের তেলের ব্যবহার নেই। চিংড়িমাছ খেতে এদের দেখিনি। ডাইনিংরুমে বসে আলাপ হলো সুইডিশ মা মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে ডাক্তার, মা আর্টিস্ট। চাইনিজ ইঙ্ক-এ দ্রুত স্কেচ করছিল নারকেল গাছ, দোলনা, মানুষজন। রৌদ্রস্নান করে ঝলসে গেছে মাখনবর্ণ ত্বক, তবু ভারতীয় শ্যামলিমা পায়নি। হায়রে আমাদের শ্যামল-সুন্দরীরা! কবে যে কাটবে মোহ...।
পরের দিন সকালে যাওয়া হবে বাঙ্গারাম দ্বীপ। আগাট্টির মতন আরেকটি - এবং একেবারে নীল নির্জনে। বিভিন্নসূত্রে জানা গেছে, লাক্ষাদ্বীপের সাঁইত্রিশটির মধ্যে মাত্র দশটিতে মানুষের বসতি (২০০৫)। অন্যগুলো অভেদ্য কুমারী। পদচিহ্ণ পড়েছে, অনুপ্রবেশ ঘটেনি। রাত্রের খাওয়া সেরে বালির ওপরে বিশ্রামচৌকিতে আধশোয়া হয়ে আরাম করছিলাম। সামনেই সমুদ্র। নিশ্চিন্ত নিরুত্তাপ আনন্দের মত শিরশিরানি এই সামুদ্রিক বাতাসে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের। অনেকদূরে বিন্দুর মতো কোনো জাহাজ বুঝি বা। অদূরে জেটিঘাটের স্তম্ভগুলোর নীচে ছলাৎ ছলাৎ করে চলেছে ঠাণ্ডা জল। তাদের ওপরে পড়ে থাকা অল্প আলোয় জেটিঘাটের ছায়া। পারাপারের ব্রিজটিতে আলো জ্বলছে। এখানে ভিড় নেই একেবারে। রাতের আকাশের অভিজাত চাদরে তারা ঝিলমিল। জলের ওপরে লক্ষ লক্ষ কিম্বা অগুনতি হয়ে ভেঙে গেছে তাদের আলোর ছবি। অনাদি অনন্ত যুগ ধরে চলেছে এমনটা। ভাবছিলাম, এক বছরও পূর্ণ হয়নি, এশিয়া ভূখন্ডের একদিকে সুনামি নামের যে প্রবল প্রলয় নাড়িয়ে দিয়ে গেছে মানবসভ্যতা ও তাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি, তার খবর অন্যপ্রান্তে নির্ভয়ে ভেসে থাকা এই সুখী দ্বীপ জানে কি?
শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা
পরদিন বাঙ্গারাম আর পরেলি। যেতে যেতে পথেই পাখিদের দ্বীপ। পাখপাখালিরা নির্ভাবনায় আসছে যাচ্ছে বসছে। কেমন রূপকথা রূপকথা অনুভূতি হচ্ছিল আমার। এই 'সাগরবিহঙ্গ'দের দ্বীপটি এখানকার ক্ষুদ্রতম। অথবা ঠিক দ্বীপও নয়, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা চরের মতো। আমরা বসেছি ছোট মোটরবোটে। তার ছাউনি আছে, কিন্তু রোদের তাপ খুব বেশি। আমাদের সঙ্গী এক দক্ষিণী পরিবার, জাহাজে এসেছেন কোচি থেকে। তাঁদের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছিলেন। চোখের সামনে ক্রমশঃ পিছিয়ে যাচ্ছিল আগাটি – এতক্ষণে পূর্ণ পরিসরে দেখা যাচ্ছিল তাকে। ঘন নারকেল বনের ফাঁকে সাদা বালির আলপনা। রূপসী সমুদ্রকন্যার বুকে লুকিয়ে রাখা সবুজ মন। ক্রমে সমুদ্র গভীরতর হয়ে আসছে। ঢেউয়ের তালে জলের চূড়ায় মোচার খোলা আমাদের নৌকো দুলছে। পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছে নানা সামুদ্রিক জীব। জল এখানে এত স্বচ্ছ যে খালি চোখেই প্রায় তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। আমরা চপল হয়ে উঠেছি। জলে হাত ডোবাচ্ছি, ছেটাচ্ছি।
পাখির দ্বীপ শেষ হয়ে সরু হয়ে গেল। তারপরে বাঙ্গারাম। আরও সবুজ, নির্জন এবং প্রাকৃতিক। একপ্রান্তে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিলাসবহুল পর্ণকুটির। সেখানে বেশির ভাগ সময়ে বিদেশি অতিথিদের দেখা মেলে। আসলে দক্ষিণাটিও তেমনই। ঘর ছেড়ে বেরোলেই সম্পূর্ণ উদার করে মেলে দেওয়া প্রকৃতির কোল... সমুদ্রের অথৈ থৈথৈ। জন্মদিনের পোশাকে সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও সামুদ্রিক প্রাণী ও পাখিরা ছাড়া দেখার কেউ নেই। দেখতে পেলাম সেই ফরাসি-যুগল এখানেই আছেন এবং আপাতত সমুদ্রস্নানে ব্যস্ত। হাঁটতে হাঁটতে - একদিকে ঘন নারকেল বন, অন্যদিকে বিদেশিনীর চোখের মত জলরাশি। কী অনন্য! পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়ো পেতে রাখা দড়ির দোলনায়, পাতাই আছে। কিম্বা শুধু বালির ওপরেই। এখান থেকে আবার ভাসলাম জলে। যেখানে নামলাম, সে দ্বীপের নাম পরেলি। এক নয়, একজোড়া, নাম একটাই। একটা ছোট একটা কিছুটা বড়। এখানে নারকেল বন আর সামুদ্রিক জঙ্গল শুধু, আর কিছু নেই। আয়তনে আগাট্টির চেয়ে ছোট। নৌকো থেকে নেমে আবার পায়ে চলা। চমকে দেখি, পায়ের তলায় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে কিছু... হাড়ের পাহাড়, কড়ির পাহাড়! শেষে ঠাকুমার ঝুলির কোনো অজানা রাজ্যে পৌঁছুলাম নাকি? পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে বেসামাল হয়ে যাই। অজস্র – অজস্র - অজস্র প্রবালের টুকরো অংশ জমে জমে স্তূপ। নানান রঙ, নকশা, বিচিত্র গঠন তাদের। এরাও সমুদ্রের নীচেই ছিলো কখনও।
'সমাজতন্ত্র'
ইতিমধ্যে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে কথা হয়েছে মোবাইলে। অনেকেই জানতে চেয়েছে, 'কী কী দেখলে? কী আছে দেখার মতো?' দেখার মতো? ভেবে ভেবে বলি... এই নীলরঙের জল, সাদারঙের বালি, জলের নীচে রঙচঙে প্রবাল... আর... আর নারকেল বন। এ-ইই, ব্যস। জবাব আসে, 'ওঃ! এ আর কী!'
আমাদের পাশের কটেজে যারা আছেন তাঁরা এসেছেন মধ্যভারত থেকে। মাঝবয়সী হাসিখুশি দম্পতি। ভদ্রলোক বিমানসংস্থার কোনো উঁচুপদে ছিলেন। অবসর নিয়েছেন। আজ ওঁদের সঙ্গী হলাম। আগাট্টির ছোটো গ্রামখানি দ্রষ্টব্য। একটা মারুতি ভ্যান জোগাড় হল বিচ রিসর্ট থেকে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই তিনি ন যযৌ...। একটু আশাহত হলাম। তবে উপলব্ধি হল, আসলে পায়ে হেঁটে না দেখলে দেখা হয়না কোনও জায়গাই। গাড়ির অল্পবয়সী চালকটিও নেমে পড়েছে, তাদের গ্রাম দেখাবে বলে ভারী উৎসাহ। সেই সিঁথির মত এক চিলতে পাকা রাস্তা - যেটা প্রথমদিন এসে দেখে ছিলাম। এই রাস্তাটা গ্রামের শেষ অবধি গেছে। পথে দেখলাম এক মসজিদ, প্রায় চারশো বছরের পুরোনো। তার গঠনপ্রণালী বা স্থাপত্য দেখে না বলে দিলে মসজিদ বলে বোঝা যায়না। একটা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই দ্বীপের শতকরা একশোভাগ মানুষই মুসলমান। এঁরা কিন্তু সে অর্থে আদিবাসী নন (যেমন আন্দামানের জারোয়া, বা নীলগিরির টোডা, ছোটনাগপুরের সাঁওতাল বা মুন্ডা)। জনসংখ্যা প্রায় হাজার সাতেক মতো(২০০৫ সাল)। ভারত সরকার সযত্নে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন ব্যবস্থা রেখেছেন এঁদের জন্যে - হয়তো তাই এঁরা যান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতি বিভিন্ন দূষণ সম্পর্কে ততটা ওয়াকিবহাল নন।
সরু ও সর্পিল পথখানির শেষে আবার সাদা বালি, আরেকটু এগোলেই সমুদ্র। ব্যাপ্তি যেহেতু আট কিলোমিটার মাত্র। আমাদের দেখে কয়েকটি ছোট ছেলে মেয়ে নিজেদের খেলা থামিয়ে এগিয়ে এলো হাসিমুখে। বেশ সুন্দর চেহারা, কালো দীঘল চোখ, উন্নত নাক, সমুদ্রের মতো সজল গায়ের রঙ। এরা এখানকার আদি অধিবাসীদের উত্তরসূরী। চেহারায় কিছুটা হলেও সাদৃশ্য আছে মধ্য এশিয়ার অধিবাসীদের সঙ্গে। ক্যামেরা আর অবাক হওয়া চোখ দেখে বুঝেছে আমরা ট্যুরিস্ট। ওরা অবশ্য এতে বেশ অভ্যস্তই। সঙ্গে কিছু লজেন্স ছিলো। দিয়ে ভাব করলাম। আলাপ করার চেষ্টা করতে, বাধ সাধলো ভাষা। এরা সকলে স্কুলে পড়ে... নম্র, ভদ্র, সুস্থ, প্রাণবন্ত। প্রকৃতই আলোকপ্রাপ্ত, অন্তরের আলোতে ভাস্বর। অনতিদূরে শিশু কোলেকাঁখে দু'একটি মা। আঠারো থেকে বাইশের মধ্যে বয়স। ছবি তুলতে চাইলাম। রাজি হলো না, সলজ্জ হাসিতে আমাদের ফিরিয়ে দিলো।
ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, স্বচ্ছলতাও বেশ বোঝা যায়। ইলেকট্রিসিটি আছে, প্রাইমারি স্কুল, একটি সেকেন্ডারি স্কুলও দেখা গেল। উচ্চতর শিক্ষার জন্যে ভারতের মূল ভূখন্ডে যেতে হয়। পোষ্য আছে - ছাগল, মুরগি। ছোট দোকান বা ব্যবসা করেন কেউ কেউ, কিন্তু মূলত প্রয়োজনীয় জিনিস আসে জাহাজে, কোচি থেকে। চলতে চলতে চমৎকার আর এক অভিজ্ঞতা হলো। এখানে একটি 'কম্যুনিটি গার্ডেন' বা মাঝারি মাপের শাক-সবজির বাগান আছে। গ্রামবাসীদের বেশির ভাগ সেখানে কাজ করেন। প্রতিদিনের প্রয়োজন অনুযায়ী সবজির তালিকা ও মাপ লিখে কুপন কাটতে হয়। তারপর সেদিনের উৎপাদন অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। একই জিনিসের চাহিদা বেশি থাকলে, উৎপাদন দেখে ভাগ করা হয়। কম হলে, যিনি বেশি চাইবেন, তাঁকেও হয়তো সেদিনের মতো অল্পে সন্তুষ্ট হতে হয়। 'সমাজতন্ত্র' একে বলা যায় কি?
আমরা কথা বলতে বলতে চলেছি। সেই আওয়াজে ঘর ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন হাসিমুখ মহিলারা। বাচ্চারাও। আলাপ করতে চাই, ওরাও... কিন্তু উপায় নেই। সুন্দরীদের কানে পরা বিচিত্র সব নক্সাদার বড়সড় স্বর্ণাভরণ। এখানে চুরিডাকাতির ভয় নেই। প্রায় সকলের মাথা ঢাকা কিন্তু বোরখা পরতে দেখিনি কাউকেই। এক মিষ্টি চেহারার রোগাপাতলা তরুণী এসে ইংরেজিতে আলাপ করল আমাদের সঙ্গে। বেশ সপ্রতিভ। সে ওখানে প্রাইমারি ইস্কুলে অঙ্ক ও মালয়ালম পড়ায়। মনে হলো, আহা, এমন একটা জীবন যদি পেতাম, বইয়ে দিতাম সমুদ্রের রঙিন ঢেউয়ে ঢেউয়ে।
ফেরার রাস্তায় দেখলাম ছোট মিউজিয়ামটি। অর্ধসমাপ্ত, কাজ চলছে। এদ্বীপ সেদ্বীপ থেকে সংগ্রহ করা নানান অমূল্য জিনিস ডাঁই করে রাখা একটি ঘরে। সাজানো হয়নি। আঠের বা উনিশ শতকের চিহ্ণসমেত জাহাজের মাস্তুল, কম্পাস, সে সময়ের লণ্ঠন, কিছু তৈজসপত্র, ভাঙা মূর্তি... আপাতত এইসব দর্শনীয়। কোন ভিনদেশী নাবিক দিক দিশা হারিয়ে অজানা দ্বীপে এসে পৌঁছে গিয়েছিলেন, কোথায় এসে কেমন করে জঙ্গল কেটে বাসস্থান বানিয়ে তুলেছিলেন, কেমন করে কোন ভাষায় ধর্মপ্রচার শুরু করেছিলেন... ভাবছিলাম সেখানে দাঁড়িয়ে। গা-ছমছম করা অনুভূতি নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম তিনশ' বছর পিছনে।
মৎস্য শিকার
ফিরে এসে দুপুরবেলার ভোজন ও বিশ্রাম। সমুদ্রের ধারে আরামচৌকিতে শুয়ে চোখ জুড়িয়ে আসছিল। নারকেলপাতার দুলুনি মাথার ওপরে। পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো দুবোর্ধ্য নক্সা কাটছে নীচে। হঠাৎ আমার কত্তামহাশয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে দেখি, অদূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কারও সঙ্গে। কী ব্যাপার! না, মাছ ধরতে যাওয়া হবে। দারুণ খুশি হয়ে চটপট চটি গলিয়ে নিলাম। বোটে চড়ে বসলাম। এটা 'ফিশিং' বোট। যে বোটে দ্বীপান্তরে গিয়েছিলাম এটি তেমন নয়। প্রবল নাচের তুমুল ছন্দে লাফাতে লাফাতে চলছে আমাদের নৌকো। এত দুলছে যে টাল সামলাতে পারছিনা। শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরেছি রেলিং। একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই হয়তো পপাত সমুদ্রতলে। দেখলাম, সবাই বেশ মাছ মারতে উৎসাহী হয়ে পড়েছেন। নৌকার মাঝিরা বড়শিতে গেঁথে দিয়েছে মাছের চাড়। জলে ফাতনা ডুবিয়ে বসে বসে ধৈর্যের পরীক্ষা দিই। এমন অভিজ্ঞতা আগেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয়না। হঠাৎ নীচের বড়শিতে টান। উত্তেজনা তুঙ্গে। ইউরেকা ! ইউরেকা ! এ্যায়সা টান মেরেছি আমিও... কোথায় কী! ভোঁ ভাঁ। আমার শিকার অনেক চালাক। ছুঁয়েই বিপদ বুঝে খাবার মুখে নিয়ে পালিয়ে গেছেন। এরই মধ্যে কী করে কে জানে, আমার কন্যা গেঁথে ফেলেছে একটা সত্যিকারের মাছ... হুমড়ি খেয়ে দেখি তাকে। কালো রঙ, পমফ্রেট ও তেলাপিয়ার মাঝামাঝি একটা চেহারা।
নৌকার গলুই থেকে ঝুঁকে চেয়ে দেখি টলটল করছে জল। খালি চোখে তাকিয়ে থাকি, জলের তলায় অসংখ্য রঙিন মাছেরা নিশ্চিন্তে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। যেন স্বপ্নপুরী, টেলিভিশনে দেখা 'ডিসকভারি' চ্যানেল। মনখারাপ হয়ে যায়, আর একদিন মাত্র। তারপরে বাস্তবের প্রবল দূষণে স্বপ্নের রঙিন বুদবুদ ফেটে যাবে। বেঁচে থাকবে স্মৃতি। অভিজ্ঞতা।
চাঁদের সাম্পান
রাতের খাওয়ার মেনুটি একটু স্পেশাল হলো। অতিথিদের জন্যে আঞ্চলিক কিছু পদ রেঁধেছিলেন গ্রামের মহিলারা। একটু গোল ও মোটা চালের ভাত, নারকেলের দুধে ফোটানো সামুদ্রিক মাছের বিশেষ ডিশ। দু'একটা সবজিও। ডাইনিংরুমের বাইরে ঝুরো বালিতে পাতা হয়েছিল সমস্ত চেয়ার টেবিল। মাথার ওপরে খোলা আকাশে ঝুলছিল চাঁদ। তারারা সাজিয়েছিল ঝাড়লণ্ঠন। নারকেলগাছে বাঁধা দড়ির দোলনা দোল খাচ্ছিল সমুদ্রবাতাসে। গাছেদের গা বেয়ে ওঠানামা করছিল অসংখ্য ঝিনুক। এই রাতটার কথা বহুকাল মনে পড়বে।
আমি মানব একাকী
একটি অল্পবয়সী দম্পতি এসেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে। দুটিতেই ইঞ্জিনিয়ার, আই-টি কোম্পানিতে কাজ করে। একজোড়া ইহুদী দম্পতি... এরা প্যালেস্টাইন থেকে। আমাদের পাশের কটেজের অতিথিরা চলে গিয়েছেন। ওঁদের জায়গায় এই দুটি। সারাদিন সাঁতারের পোশাক পরা। বেশ বিপুল বপু দুজনেরই। গায়ের রঙ সোনালি, চুল কালোর কাছাকাছি। জলচর প্রাণীদের মতো সারাটা দিন জলে বা বালিতে। বিশেষ চশমা পরে জলে ডুবছে, ভাসছে, বালি মাখছে সারা শরীরে। পিঠে বাঁধা অক্সিজেন সিলিন্ডার। আমরা সকলে সঙ্গী হয়ে গেলাম আর এক দ্বীপে। নাম কালপিট্টি।
ছোট্টো গোলাকার দ্বীপ। এখানে 'কিছুই' নেই। সাদা ঝক্ঝকে বালিতে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যের আলো, চোখ ধাঁধাঁচ্ছে। যতদূর চোখ ছড়াই ধূধূ জল আর জল। ঢেউ এসে পাড় ভাঙছে বারেবারে, ভাঙছে তার নিস্তব্ধ ধ্যান। আমরা বালি পেরিয়ে জলে নেমেছি, কোমরজল ভেঙে এগিয়ে চলেছি এমনিই... উদ্দেশ্যহীন। জায়গায় জায়গায় কবে থেকে বালি জমে পাথর হয়ে আছে। ওখানে এসে আছাড় খাচ্ছে জল। ওর ফাঁকফোকরে কাঁকড়াদের বাড়িঘর। লক্ষ লক্ষ ছটফটে কাঁকড়া আসা যাওয়া করছে। বালিতে কাঁকড়া দেখেছি অনেকবার... কিন্তু এ একেবারে অন্যরকম। ক্রমে তীরভূমি সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে। আমরা জল ভাঙছি। বাঁদিকে দিশাহীন অনন্ত সমুদ্র, ডানদিকে জংলা ঝোপঝাড়। কিছু মৌমাছি ওড়াউড়ি করছিল, হাত দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে বাঁচাতে চলছিলাম। আমরা কৃত্রিমতার মানুষ, ভয় হচ্ছিল, বিষাক্ত পোকামাকড় বা মনসাপুত্রদের দেখা পেলে কী করব! আমাদের নৌকো যে কোথায় বোঝা যাচ্ছিলনা। জলচর ইহুদি দুজনকেও দেখতে পাচ্ছিলামনা। প্রায় পুরো দ্বীপটির প্রদক্ষিণ সেরে ঝলসানো বেগুনপোড়া চেহারায় চোখে পড়লো নৌকো। অবাক হয়ে দেখলাম যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, এতোটা ঘুরে আবার সেখানেই! বসলাম উঠে, ধড়ে প্রাণ এলো। আর, দ্বীপের মধ্যে জলের কাছাকাছি এক বিড়াল... বেশ তাগড়া, স্বাস্থ্যবান। কোত্থেকে এসেছে কে জানে? আমাদের দিকে চেয়ে মিঁউমিঁউ করলো।
বিকেলের দিকে প্লাস্টিকের নৌকো চেপে 'কায়াকিং' করতে গেল আমাদের কন্যা। নিজেই দাঁড় বাইল। এই বোটগুলো বালির ওপরে রাখাই থাকে। যখন খুশি নিয়ে নেমে পড়ো জলে। ঘন্টাখানেক জল ছিটিয়ে উঠে এল সে। আপাদমস্তক জল ও বালিতে মাখামাখি, খুশিতে উজ্জ্বল।
উলটোরথ
আমাদের মেয়াদ ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োলো। সকাল এগারোটায় আমাদের উড়োজাহাজ ছাড়বে আগাট্টি এয়ারপোর্ট থেকে। ভোরবেলা উঠে পড়েছি। মেয়ে আরও একবার কায়াকিং করে এলো নৌকো ভাসিয়ে। চটপট গুছিয়ে নিয়েছি প্যাঁটরা, ব্রেকফাস্ট সারা হলো। ঘুমঘুম চোখ নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আছে সমুদ্র। রিসেপশন কাউন্টারে বাকী জমাখরচের হিসেব মেলানো... আবার আসার জন্যে অনুরোধ। কী পেলাম, কী জমা পড়ল, তা হিসেবনিকেশ পরে করা যাবে। কিন্তু একী! এই চারদিনেই কি অপূর্ব মায়ায় বেঁধে ফেলেছে এই স্বপ্নের চেয়ে সুন্দর পৃথিবীর কোন। আপাতদৃষ্টিতে তেমন কিছু নেই, আর যা আছে তাতো বলেইছি। চোখধাঁধাঁনো আড়ম্বর নয়, এর সৌন্দর্য এর স্বচ্ছতা, অকৃত্রিমতা, প্রকৃতির মাধুর্য। না আছে শহর বাজারে ঝকঝকানি, না হ্যান্ডিক্রাফটের সারসার দোকান, না গন্ধে প্রলুব্ধ করা রেস্তোরাঁ।
যাওয়ার সময়ে পেছন ফিরে বারবার দেখছিলাম - শ্বেত বেলাভূমির কোল ঘেঁষে চঞ্চল সমুদ্রসখার অনন্তকালের খেলা। না আছে বিশ্রাম, না পরিবর্তন। আমাদের বিমান ছাড়লো, গন্তব্য কোচি এয়ারপোর্ট। আমরা উড়তে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এলো দ্বীপগুলো তাদের বিস্তৃত বালুকাবেলায় অনন্ত আনন্দের আহ্বান নিয়ে। তারপর ক্রমশ আরো ছোট ... মিলিয়ে গেল। আর দেখা গেলো না। মনে মনে বললাম, আসব আসব আসব।
~ লাক্ষাদ্বীপের তথ্য ~ লাক্ষাদ্বীপের আরও ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শ্রাবণী দাশগুপ্ত বর্তমানে থাকেন স্বামীর কর্মসূত্রে রাঁচিতে। কিছুকাল স্কুলে পড়ানোর পর বাড়িতে থিতু হয়ে এখন লেখালেখি আর বই পড়াই ভাললাগার বিষয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে ছোট গল্প। প্রথম পছন্দ পাহাড় - জঙ্গলও খুব প্রিয়। বেড়াতে ভালোবাসলেও ভ্রমণ কাহিনি লেখায় হাত পাকানো অল্পদিন।