মালয়ালম ভাষায় লাক্ষাদ্বীপ –এর অর্থ 'লক্ষদ্বীপ'। যদিও মাত্র ছত্রিশটি দ্বীপ নিয়ে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগরের বুকে লাক্ষাদ্বীপের অবস্থান। গল্পকথা বলে, সপ্তম শতাব্দীতে মক্কার সাধু উবাইদুল্লা স্বপ্ন দেখেছিলেন মহম্মদ তাঁকে ধর্মপ্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়তে বলছেন। লোকলস্কর সমেত তাঁর ছোট জাহাজটি ঝড়ের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল এই দ্বীপগুলির কাছেই। তিনি ভেসে আসেন আমিনি দ্বীপে। সেখানেই ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ইতিহাস বলছে, হিন্দু, মুসলিম ও পর্তুগিজদের হাত ঘুরে ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের দখলে যায় এই দ্বীপগুলি। যদিও এখনও এখানকার অধিকাংশ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ৩৬ টি দ্বীপের মধ্যে মাত্র ১০টি বসবাসযোগ্য – আগাত্তি, আমিনি, আন্দ্রোত্ত, বিটরা, চেতলাত, কদমাত, কালপেনি, কাভারাত্তি, কিলতান এবং মিনিকয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজের অংশ হিসেবে গণ্য হবার পর ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রের সরাসরি শাসনাধীন হয়। লাক্ষাদ্বীপ নামকরণ আরও পরে, ১৯৭৩-এ।
নারকেল গাছে ছাওয়া প্রবাল দ্বীপ লাক্ষা ক্রমশই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে লাক্ষাদ্বীপে যাওয়ার জন্য অনুমতিপত্রের প্রয়োজন। লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের আকর্ষণ বিচিত্র - সমুদ্রের বুকে ডলফিনদের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে একদ্বীপ থেকে আরেকদ্বীপে জাহাজে পাড়ি, নির্জন দ্বীপে বসবাস অথবা পায়ে হেঁটে দ্বীপের জনজীবনের সঙ্গে পরিচয় করে নেওয়া। সব দ্বীপেই রয়েছে এক বা একাধিক লেগুন যা সেখানের সৌন্দর্যকে আরও মনোরম করেছে। নানান ওয়াটার স্পোর্টস, স্নর্কলিং বা গ্লাসবোটে সমুদ্র ভ্রমণের ব্যবস্থাও রয়েছে বিভিন্ন দ্বীপে।
লাক্ষাদ্বীপের সদর দপ্তর কাভারাত্তি দ্বীপে (Cavaratti)। কাভারতি লেগুন অর্থাৎ উপহ্রদের নীল-সবুজ জলে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত মনোরম। দ্বীপ জুড়ে অনেকগুলি প্রাচীন মসজিদ আছে, এরমধ্যে উজড়া মসজিদের কারুকার্য অপরূপ। মেরিন অ্যাকোরিয়ামটিও দর্শনীয়। কায়াকিং, ইয়াচট সেলিং-এর মত ওয়াটার স্পোর্টসের জন্য লেগুনটি আদর্শ। গ্লাস বটম বোটে চড়ে দেখে নেওয়া যায় সমুদ্রের নীচের জলচরদের দুনিয়া।
লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের মধ্যে কালপেনি (Kalpeni) দ্বীপের লেগুনটিই সবথেকে বড়। সবরকমের ওয়াটার স্পোর্টসই এখানে হয়। কালপেনির সমুদ্রতীরে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কোরাল। কালপেনির গায়ে লেগে থাকা টিলক্কাম, পিত্তি, চেরিয়ামের মত দ্বীপের ছোট্ট ছোট্ট টুকরোগুলি আর এদের মাঝে মাঝে ঝলমলে লেগুনগুলি তাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে খ্যাত। লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের এই দ্বীপটিতেই প্রথম শিক্ষার আলো দেখা গিয়েছিল। অন্যান্য দ্বীপে যখন এই নিয়ে রীতিমতো বাধানিষেধ ছিল তখন মেয়েরাও স্কুলে যেত এই দ্বীপে।
দ্বীপপুঞ্জের সর্বদক্ষিণে মিনিকয় (Minicoy) দ্বীপ। অন্য দ্বীপগুলির থেকে এর ভৌগোলিক দুরত্ব কিছুটা বেশি হওয়ার জন্যই হয়ত এখানে মালদ্বীপ এবং দক্ষিণ ভারতীয় মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। স্থানীয় ভাষা 'মাল'(মালদ্বীপের ভাষা)। প্রজাতান্ত্রিক এই দ্বীপের গ্রামসমাজে মহিলাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। সমুদ্রের ধারে ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন লাইটহাউস। দুশোটারও বেশি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে দিগন্তবিস্তৃত আরবসাগরের রূপ ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ মন্দির, নানান মসজিদ, কৃত্রিমভাবে টুনা মাছ সংরক্ষণের ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। স্থানীয় লোকনৃত্য 'লাভা' বিখ্যাত।
একমাত্র কদমাত (Kadmat) দ্বীপেরই দুপাশেই লেগুন রয়েছে। দারুচিনি দ্বীপ নামেও পরিচিতি রয়েছে এই দ্বীপের। নারকেল গাছে ছাওয়া বেলাভূমি, দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত আর ছবির মত ট্যুরিস্ট হাটগুলি নিয়ে দেশবিদেশের পর্যটক আর প্রকৃতিপ্রেমিকদের কাছে আকর্ষণীয় এই দ্বীপ। দেশের সেরা ডাইভিং স্পট এবং ওয়াটার স্পোর্টসের অঢেল সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে একটি পুরোদস্তুর ওয়াটার স্পোর্টস ইনস্টিটিউট এবং একটি ডাইভ স্কুল গড়ে উঠেছে। বাঙ্গারাম এবং আগাত্তি ছাড়া লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের একমাত্র এই দ্বীপেই বিদেশি ট্যুরিস্টরা আসতে পারেন।
এই দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র এয়ারপোর্টটি রয়েছে আগাত্তি (Agatti) দ্বীপে। কোচি থেকে নিয়মিত যাচ্ছে উড়ান। লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের অন্যতম সুন্দর লেগুনটিও এখানেই। আগাত্তি দ্বীপটি দৈর্ঘে সাড়ে আট কিলোমিটার মতো, আর প্রস্থে তিন কিলোমিটার। সরকারি ট্যুরিস্ট লজের অস্থায়ী কুটিরটি তটভূমির মাঝে বসানো। চারপাশে সাদা নুনের মত বালি আর অদূরেই সমুদ্রের নীলাভ সবুজ রেখা। অনেকগুলি এইরকমের ইতস্তত ছড়ানো ঘরের মাঝে মাঝে নানা উচ্চতার নানা বয়সের নারকেলগাছেরা। তাতে দড়িতে বোনা নেটের দোলনা বাতাসে দুলছে।
নীল সমুদ্রের বুকে একফোঁটা অশ্রুবিন্দুর মতো ছোট্ট সবুজ বাঙ্গারাম (Bangaram) দ্বীপটি হলদেটে সাদা বালি দিয়ে ঘেরা। খুব গরমেও নারকেল গাছের ছায়ায় ঠাণ্ডা থাকে দ্বীপের আবহাওয়া। জনবসতিহীন এই দ্বীপটি রোমান্স আর রোমাঞ্চের জন্য আদর্শ। নির্জন দ্বীপের একপ্রান্তে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল পর্ণকুটির – পর্যটকদের বাসস্থান। সেখানে বেশির ভাগ সময়ে বিদেশি অথিতিদের দেখা মেলে। একদিকে ঘন নারকেল বন, অন্যদিকে বিদেশিনীর চোখের মত জলরাশি। ক্লান্ত হয়ে পড়লে ইতস্তত ছড়ানো দড়ির দোলনায় রয়েছে বিশ্রামের জন্য। কাচের মত স্বচ্ছ্ব সমুদ্রের জলের তলার রাজ্য হাতছানি দেয় স্কুবা ডাইভারদের। রঙবেরঙের বিচিত্র কোরালের দেশে দেখা মেলে কালো রঙের কোরালেরও। অ্যাঞ্জেল, ক্লাউন ফিস, বাটারফ্লাই,সার্জিওন, স্টিং রে, ইল আর বেশ নিরীহ হাঙরের দল ঘুরে বেড়ায় কোরাল পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে। হাত বাড়ালেই তিন্নাকারা, পারালি-১ ও ২ আরও তিনটি জনবসতিহীন ছোট দ্বীপ। পারালির দুটি দ্বীপের মধ্যে একটা ছোট একটা কিছুটা বড়। এখানে নারকেল বন আর সামুদ্রিক জঙ্গল শুধু, আর কিছু নেই। যেন ঠাকুমার ঝুলির কোনো অজানা রাজ্য! পায়ের তলায় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় কড়ির পাহাড়! অজস্র – অজস্র - অজস্র প্রবালের টুকরো অংশ জমে জমে স্তূপ। নানান রঙ, নকশা, বিচিত্র গঠন তাদের।
পাখিদের স্বর্গরাজ্য পিট্টি (Pitti) দ্বীপে রয়েছে বার্ড স্যাংচুয়ারি।
যাওয়াঃ- মূল ভূখণ্ডের কেরলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে লাক্ষার। কোচি থেকে নিয়মিত ছোট জাহাজ যাচ্ছে দ্বীপভূমিতে। রবিবার ছাড়া প্রতিদিন কোচি থেকে আগাত্তি দ্বীপে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের উড়ান। লাক্ষাদ্বীপ ট্যুরিজমের প্যাকেজ ট্যুরেও বেড়িয়ে আসা যায়। সেক্ষেত্রে জাহাজই হবে রাতঠিকানা। অনুমতিপত্র এবং ট্যুর প্যাকেজের বিষয়ে বিশদ জানা যাবে http://lakshadweeptourism.nic.in এই ওয়েবঠিকানায়।
থাকাঃ- কাভারাত্তি, বাঙ্গারাম, আগাত্তি ও কদমাত দ্বীপে সরকারি ট্যুরিস্ট হাট আছে। ট্যুরিজমের গেস্টহাউস হয়েছে কাভারাত্তি ও কদমাত দ্বীপে। পি ডব্লু ডি-র বাংলো রয়েছে মিনিকয় ও কাভারাত্তি দ্বীপে। বেসরকারি থাকার ব্যবস্থা কম।
জরুরিঃ- শুধুমাত্র বাঙ্গারাম দ্বীপ ছাড়া সর্বত্র মদ্যপান নিষিদ্ধ। কোরাল সংগ্রহ করাও নিষেধ।
ভ্রমণ কাহিনি - || সমুদ্রকন্যা লাক্ষাদ্বীপ ||