রঙবাহারি রাজস্থান
দেবাশিস বসু়
~ রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি ~
অনেকদিনের ইচ্ছে এবার বাস্তব হল - একটা লম্বা রাজস্থান ট্যুর। দলে আমরা দু'জন মহিলা সহ ছয় প্রবীণ নাগরিক। এবছরের ফেব্রুয়ারির একেবারে প্রথম দিনে রাতের যোধপুর এক্সপ্রেস ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ট্রেনে আড্ডা দিয়ে, ঘুমিয়ে কেটে গেল বেশ সময়টা। তিন তারিখ সকালে বিকানীর পৌঁছালাম – ঠিকানা হোটেল লালজি।
যেটা প্রথমে নজরে এল তা হল রাস্তার ধারে অধিকাংশ বাড়িই পাথরের আর রাজস্থানী স্থাপত্যে তৈরি। আর চারপাশে যেন রঙের উৎসব। মহিলাদের ঘাগরা-চোলি, উড়নিতে নানান রঙের ছোঁয়া। পুরুষদের লম্বা ঝুলের ধুতি আর শার্ট সাদা রঙের হলেও বাহারি পাগড়ির কনট্রাস্টে যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠেছে। পাগড়িও তেমনি বিশাল – শুধু রঙের বাহারই নয়, পরারই কৌশল নাকি আট রকমের। পুরুষদের চেহারায় আরেক চোখে পড়ার বিষয় হল গোঁফ – কারোর বেশ চওড়া আর মোটা, আবার কারোর দাড়ির সঙ্গে জুড়ে গিয়ে আরও জমকালো হয়ে গেছে। অবশ্য স্থানীয় পোষাক ছাড়াও আধুনিক নানা পোষাকে সজ্জিত নারীপুরুষের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। আরেকটা জিনিস খুব চোখে পড়ছিল যত্রতত্র, সেটা হল উটে টানা গাড়ি।
সোয়া এগারটা নাগাদ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অটোয় গন্তব্য ৩২ কিলোমিটার দূরে কর্ণি মাতার মন্দির। দেবী দুর্গারই এক রূপ এই কর্ণিমাতা। ছ'শো বছরের প্রাচীন বেশ বড় মন্দির। ১৭ শতকে তৈরি মন্দিরটির চুড়ায় সোনার ছাতা। বিশাল গেটে রুপোর পাতে সূক্ষ্ম কারুকাজ। মন্দিরের মার্বেলের কারুকার্যও দেখার মত। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল বিরাট চত্ত্বরে অনেক ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে, এরা দেবীর কাছে উৎসর্গীকৃত, গায়ে চড়লে পুন্যি কিন্তু পায়ের চাপে মরে গেলেই পাপ, তাই খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে। বেশ বড় কানা উঁচু থালায় দুধ রাখা আছে, ইঁদুরগুলো কানা বেয়ে উঠে দুধ খাচ্ছে। ইঁদুরকে খাওয়ানোও এখানে পুণ্যের কাজ। বিকেল সন্ধ্যায় হেঁটে সঙ্কটমোচন হনুমান মন্দির, শ্রীকৃষ্ণ মন্দির এসব দেখা হল।
চার তারিখে সারাদিনের ঘোরার প্ল্যান – ভাড়া গাড়িতে সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সদলবলে। প্রথম গন্তব্য রামপুরিয়া হাভেলি। রাজস্থানের এই হাভেলিগুলি অতীতের বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের তৈরি। সরু গলিতে চার-পাঁচতলা বিশেষ ধরণের বাড়ি। পাথরের জাফরিতে, ঝুলন্ত জানলায়, খিলানে দক্ষ শিল্পীর হাতের কাজ। এই বাড়িগুলো নাকি গরমে ঠাণ্ডা আর শীতে গরম থাকে। শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ১৪ শতকের তৈরি ভাণ্ডেশ্বর জৈন মন্দির কমপ্লেক্স। মন্দির নির্মাতা দুই ভাইয়ের নাম ভাণ্ডেশ্বর আর ষণ্ডেশ্বর। ভাণ্ডেশ্বরের মন্দির সাজানো কাচ আর ফ্রেস্কোর কাজে আর ষণ্ডেশ্বরের বৈশিষ্ট্য এনামেল আর সোনায় মোড়া কারুকার্য। লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরটিও বেশ বড় আর সুন্দর।
বিকানীর শহরের ঠিক মাঝখানে জুনাগড় দুর্গ। ১৫৮৭-১৫৯৩ খ্রীস্টাব্দে আকবরের প্রাক্তন সেনাপতি রায়সিং লাল ও গোলাপি বেলেপাথরে এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। বর্গাকার দুর্গ ৩০ ফুট গভীর পরিখায় ঘেরা। মূল প্রবেশপথ সূরয পোল। দুর্গ চত্ত্বরের ভিতরে অজস্র দ্রষ্টব্য - লাল নিবাস, চন্দ্রমহল, ফুলমহলের রঙিন কাঁচের কারুকার্য, ইতালীয় মোজাইক, জাফরির অপূর্ব কাজ, বাদলমহল, বর্ণাঢ্য সূর্যনিবাস বা দরবার হল, গঙ্গানিবাস, দুর্গানিবাস, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধে হারানোর স্মারক করণমহল, শিসমহল, ছত্তরমহল, বিজলিমহল, রাজপরিবারের গৃহদেবতা শিবঠাকুরের মন্দির, হাজারি দরোয়াজা মিউজিয়াম, মিনিয়েচার পেন্টিং, চিনি বুরুজ বা সবুজ-সাদা রঙের চিনা টাওয়ার ইত্যাদি – একের পর এক দেখছি আর অপার বিস্ময়ে শুধু মুগ্ধ হচ্ছি।
গঙ্গা গোল্ডেন জুবিলি মিউজিয়ামে দেখলাম গুপ্ত রাজাদের সময়কার টেরাকোটার কাজ, প্রাক্ হরপ্পাকালের নানান সংগ্রহ, রাজা রাজসিংহকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দেওয়া নজরানা সিল্কের পোশাক, সাদা মার্বেল পাথরের অপরূপ সুন্দর দেবী সরস্বতীর মূর্তি, রাজকীয় আবরণ-আভরণ, অস্ত্র-শস্ত্র, প্রচুর মূর্তি ও ছবি।
এর পরের গন্তব্য লালগড় প্রাসাদ ও মিউজিয়াম। শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে মহারাজ গঙ্গা সিং তাঁর পিতা মহারাজ লালসিং-এর স্মারকরূপে, স্যার স্যুইনটন জ্যাকবের নক্সায়, গেরুয়া রঙের বেলেপাথরে লালগড় প্রাসাদ তৈরি করেন। প্রাসাদের স্থাপত্যে পাশ্চাত্যের শিল্প জৌলুসের সঙ্গে মিশেছে প্রাচ্যের কল্পনার জগত – বেলজিয়ামের ঝাড়লন্ঠন, কাট-গ্লাসের অলঙ্করণ, অপরূপ জালির কাজ, সুন্দর সুন্দর কার্ভিং, নকশাকাটা কারুকার্য, প্রচুর ছবি, স্টাফড্ জীবজন্তু নিয়ে সাজানো প্রাসাদ। প্রাসাদ চত্ত্বরে রয়েছে ফুলবাগান, বিকানির স্টেট রেলওয়ের বগি আর চিড়িয়াখানা। প্রাসাদের এক অংশ এখন বিলাসবহুল হোটেল। অন্য একটি অংশে বাস করেন রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। দ্বিতলে রয়েছে রাজপরিবারের নানা সংগ্রহ নিয়ে শাদূল মিউজিয়াম ও অমূল্য দুষ্প্রাপ্য সংস্কৃত বইয়ের অনুপ লাইব্রেরি।
এদিনের শেষ দ্রষ্টব্য ছিল ক্যামেল ব্রিডিং ফার্ম। এখানে উট প্রজনন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য নানা রকম ব্যবস্থা আছে। জানা গেল রাজস্থানে উট মুখ্যতঃ চার প্রজাতির – বিকানেরি, জয়সলমেরী, মেয়ারী ও কচ্ছি। ভারতে অবশ্য আরও একরকমের উট পাওয়া যায়, লাদাখের শীতল মরুভুমিতে দুটো কুঁজওয়ালা উট।
পাঁচ তারিখ সকালে বিকানির থেকে রওনা দিয়ে জয়সলমীর পৌঁছালাম দুপুর নাগাদ। আজ প্যাকেজ প্রোগ্রামে ঘোরা। হোটেল থেকে গাড়িতে ৫০ কিমি দূরে সাম ডিউন – মরুভূমির দেশ। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা সুইস টেন্টে। ওই গাড়িতেই ২৫-৩০ কিমি দূরে সানসেট পয়েন্টে গিয়ে মরুভূমির বুকে একটা অসম্ভব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখলাম। সন্ধেবেলায় লোক সঙ্গীত ও নৃত্যের সঙ্গে গরম গরম পকোড়া আর কফি। পরদিন সকালে সাম ডিউনসের শেষ অভিজ্ঞতা আধঘন্টার উট সাফারি। উটের বসা অবস্থায় পিঠে চড়ার পর সে ক্রমশ সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর আমি জটায়ুর মতোই শিহরিত হচ্ছি।
জয়সলমীরের হোটেলে পৌঁছে আবার গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য সোনার কেল্লা। শীতের দুপুরের নরম রোদে হলুদ বেলেপাথরের দূর্গ যেন সোনার মতই ঝলমল করছে। আমাদেরতো মনে হচ্ছিলই, স্থানীয় গাইড আর সিকিউরিটির লোকজনও বারবার সত্যজিৎ রায়ের নাম করছিলেন, সারা পৃথিবীর সামনে সোনার কেল্লাকে তুলে ধরার জন্য। শহরের দক্ষিণ দিকে ৭৬ মি উঁচু ত্রিকূট পাহাড়ের ওপর এই দুর্গ। দৈর্ঘে প্রায় ৪৬০ মি, প্রস্থে ২৩০ মি। প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে চিতোরের পরেই এর স্থান। বৃত্তাকার প্রাচীর ঘেরা এই দুর্গে মোট ৯৯ টি বুরুজ আছে। দুর্গের অনেকগুলি গেট বা পোল রয়েছে। অক্ষয় পোল, গণেশ পোল, সূরজ পোল, হাওয়া পোল পেরিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলেছে। প্রথমেই পাঁচ মহলা, সাত তলা মহরাওয়াল বা সিটি প্রাসাদ। জুনা মহলের জালির কাজ খুব সুন্দর। সাধাসিধে জেনানা মহলের পর চৌহাটা পেরিয়ে মর্দানা মহল। হাওয়া পোলের ওপরে আছে কাচ ও ম্যুরাল চিত্রে ভরা রঙমহল। সর্বোত্তম বিলাসে নীল টালি আর মোজাইকের সুন্দর কাজ। পাশেই গজবিলাসে পাথরের সুন্দর অলঙ্করণে মোতি মহল। সামনে আম দরবার। আর এক আকর্ষণ মহারাজ বারিসালের গড়া বাদলবিলাস বা মেঘ দরবার বা টাওয়ার অফ ক্লাউডস্। এর শীর্ষে মুঘল স্থাপত্যের তাজিয়া মিনার আছে। দেওয়ান-ই-আম-এর পাথরের সিংহাসনও অনবদ্য। কাছেই নারায়ণ ও শক্তি স্তম্ভ আছে।
পরবর্তী গন্তব্য গদীসর বা গদীসাগর – মরুভূমির মাঝে মরুদ্যান। এর অনেকগুলি ঘাট। মাথায় কলসির ওপর কলসি বসিয়ে রাজস্থানী মেয়েরা জল নিতে এসেছে। জলাশয়কে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলি মন্দির। কারুকার্যময় তোরণ। কাছেই রয়েছে পাঁচতলা তাজিয়া।
সেলিম সিং হাভেলি আর নাথমলজী কী হাভেলির পাথরের অপূর্ব জাফরির কাজ দেখে ফেরার পথ ধরলাম।
সাত তারিখ ভোরবেলাতেই ট্রেনে যোধপুর পৌঁছলাম। পৌনে এগারটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম সারাদিনের জন্য। প্রথম গন্তব্য শহর থেকে ৫ কিমি দূরে ১২১ মি উঁচু গোদাগিরি পাহাড় অবস্থিত মেহেরণগড় দুর্গ। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে রাও যোধা দুর্গটি নির্মাণ করেন। কোথাও গোল কোথাওবা চারকোনা গম্বুজ রয়েছে দুর্গ প্রাচীরের গায়ে। প্রাসাদ, সৈন্যাবাস, মন্দির, ঘরবাড়ি নিয়ে একসময় জমজমাট এই দুর্গ মুঘলদের কাছেও অজেয় ছিল। যোধপুরের রাজবংশের সঙ্গে মিত্রতাও গড়ে উঠেছিল মুঘলদের। আকবরের প্রধানা মহিষী যোধাবাঈ ছিলেন উদয়পুরের রাজকন্যা, রাও উদয়সিংহের ভগ্নী। উদয়সিংহ জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দেন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে উদয় সিংহকে রাজা খেতাব দেন সম্রাট আকবর। পর্যটকদের কাছে দুর্গের আকর্ষণ এখন মিউজিয়াম হিসেবে।
দুর্গে ঢোকার সাতটি পোল রয়েছে – ফতে পোল বা গেটওয়ে অফ ভিকট্রি মুঘলদের যুদ্ধে পরাজিত করবার স্মারকরূপে গড়ে তোলা হয়েছিল, গোপাল পোল, দোধকাংড়া পল, জয় পোল, ১৮০৬-এ মহারাজ মানসিংহের তৈরি লোহা পোল, সূরজ পোল ইত্যাদি। মহলের পর মহল রাজকীয় বৈভব আর নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। মোতিমহল বা দেওয়ান-ই-আম-এ শ্বেতপাথরের করোনেশন থ্রোন। মহারাজা অভয় সিংহের তৈরি ৮০ কেজি সোনার সুন্দর কারুকার্যময় ফুলমহল বা দরবার হল। সোনালী রঙের থাম, খিলানে আর ছাদে সোনালী নকসা কাটা ফুল। শিলেখানায় রয়েছে রণসাজ ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শনী, প্রচুর ছবি। আর রয়েছে সাড়ে সতেরো কিলো ওজনের তালা, কিংখাবে মোড়া নানা রকম হাওদা, দোলনা ইত্যাদি। জেনানা মহল বা রাজার হারেমে জাফরির অভিনবত্ব, চন্দনকাঠের সিলিং, আয়নাখচিত দেওয়াল নজর কাড়ে। দুর্গের ভেতরে দুটি তালাও – রানী সাগর ও গুলাব সাগর। র্যামপার্টে রয়েছে কামানের সংগ্রহ। কেল্লার আরাধ্যা দেবী চামুন্ডার মন্দির দেখে বেরিয়ে সাঁইবাবার মন্দির ও কৈলানা লেক ঘুরে ফিরে এলাম।
আট তারিখ সকালে উঠে বেরিয়ে পরলাম ওশিয়াঁর উদ্দেশে। এখানে মাতাজির মন্দির আছে, মা দুর্গারই আরেক রূপ। দুর-দুরান্তর থেকে মহিলারা সন্তান কামনায় এখানে পুজো দিতে আসেন। এছাড়া ষোলটি সুন্দর স্থাপত্য শিল্পের জৈন মন্দির রয়েছে।
লঙ্কার রাজা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর দেশ ছিল নাকি মন্দোর বা মান্ডোর। এখানে সুসজ্জিত উদ্যানে লাল বেলে পাথরের সুন্দর ভাস্কর্যের ছত্তিশ বা মন্দির আছে। মিউজিয়াম ছাড়াও যেটা খুব ভাল লাগল তা হল ১৮ শতকে একটি মাত্র পাথর কুঁদে তৈরি ৩৩ কোটি দেবদেবী শোভিত 'হল অফ হিরোজ'।
যোধপুর শহরের একপ্রান্তে ইতালীয় শৈলীতে গোলাপী মার্বেল পাথর আর লাল বেলে পাথরের প্রাসাদ উমেদ ভবন। এটি অবশ্য তেমন প্রাচীন নয়। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। এখানে আছে সোনায় মোড়া পৌরাণিক আখ্যান চিত্রিত দেওয়ানি খাস, দেওয়ানি আম, থ্রোন রুম, পাঠাগার ভবন, মহারাজ উমেদ সিং-এর বিমান, নানারকম অস্ত্রশস্ত্র আর বিচিত্র সব ঘড়ি – আংটিতে ঘড়ি, টিকলিতে ঘড়ি, ঘড়ির আওয়াজে পাখির গান এমন নানারকম।
ন'তারিখ বেলা পৌনে বারটা নাগাদ রণকপুর পৌঁছলাম। এখানে জনবসতি নেই। আছে শুধু ১২ থেকে ১৫ শতকে তৈরি জৈন মন্দিরগুলি। কোনটা ছেড়ে কোনটাকে ভালো বলব, সবই যেন একেকটি শ্বেতপাথরের কাব্য! মন্দির আছে আদিনাথের, নেমিনাথের ও পার্শ্বনাথের। আদিনাথের মন্দির বিশেষ উল্লেখযোগ্য – শিল্প সুষমায় উজ্জ্বল চারটি প্রবেশপথ প্রথমেই নজরে পড়ে। সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত ১৪৪৪টি স্তম্ভ আর মন্দিরগাত্রের অপরূপ ভাস্কর্যশৈলী। এছাড়া সূর্য্যনারায়ণ ও অম্বামাতার মন্দির রয়েছে। চারপাশে প্রচুর হনুমান আর ময়ূর নজরে পড়ল। দুপুরে আবু রোডে পৌঁছে সন্ধ্যেবেলায় নক্কি লেকের আশপাশে ঘুরে বেড়ালাম।
দশ তারিখ সকালে গন্তব্য শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে রাজস্থানের সর্ব্বোচ্চ শিখর ১৭৭২ মি উচ্চ গুরুশিখর। মনোরম পরিবেশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মন্দির। তিনশ সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌঁছলাম অত্রি ঋষির মন্দিরে। এখানে গুরু দত্তাত্রেয়র পায়ের ছাপ আছে। গুরুশিখর থেকে নেমে ফুলবাগানে সাজানো ব্রহ্মকুমারীদের শান্তিবন বা পিসপার্কে পৌঁছে খানিকক্ষণ ধ্যানের বিষয়ে বক্তৃতা শুনে বেরিয়ে পড়লাম অচলগড়ের দিকে। একসময়ের চৌহান রাজধানী অচলগড় পরে রানা কুম্ভের দখলে আসে। ভেঙ্গে পড়া দুর্গের নীচে ৮১৩ শতকে তৈরি অচলেশ্বর মন্দির। এখানে শিবের প্রতিভূ পাথরের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। দেওয়ালে পার্বতী ও গণেশ মূর্তি আছে। ধাতুর তৈরি নন্দীমূর্তিও রয়েছে। পাশের মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন দশাবতাররূপী বিষ্ণু। চামুন্ডা দেবীর মন্দিরও রয়েছে।
এবারে আমাদের গন্তব্য বিশ্ববিখ্যাত দিলওয়ারা বা দেলওয়াড়া মন্দির। মোট পাঁচটি মন্দির – আদিনাথ, নেমিনাথ, মহাবীর, ঋষভদেব ও পার্শ্বনাথ। শ্বেত পাথরের ওপর অনবদ্য সূক্ষ্ম কারুকাজ। গুজরাতের প্রথম সোলাঙ্কি রাজা ভীম দেবের মন্ত্রী বিমল শাহ ১০৩১ সালে ১৮ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে, পনেরোশো শিল্পী ও বারোশো শ্রমিকের শ্রমে চোদ্দ বছর ধরে গড়ে তোলেন বিমল বাসাহি, সেখানে রয়েছেন, প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথ। মন্দিরের সূক্ষ্ম অলঙ্করণে আছে হাতির যূথ সারি, ফলমূল, জীবজন্তু শোভিত অষ্টভূজাকার গম্বুজ, আটচল্লিশটি থামসহ অলিন্দের স্থাপত্য, দেবদেবীর মূর্তি সম্বলিত ৫২ টি কুঠুরি, শ্বে্তপাথরের কার্ভিং ও সিলিং-এর সুন্দর ও সূক্ষ্ম কারুকার্য। গুজরাতরাজ বীর ধাওয়ানের সময় তাঁর দুই মন্ত্রী বাস্তুপাল ও তেজপাল আদিনাথ মন্দিরের উত্তরে দুটি মন্দির – লুনা বাসাহি ও তেজপাল মন্দির তৈরি করান ১২ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে। লুনা বাসাহিতেও শ্বে্তপাথরের সুন্দর ভাস্কর্য্যমন্ডিত স্তম্ভ, ঝালর, নাচের মুদ্রা, যেন জল থেকে তুলে আনা পদ্ম, তোরণ, চেন, জীন আখ্যান, রাজকীয় মিছিল – দক্ষ শিল্পীদের করা অপূর্ব সুন্দর কাজ। এখানে রয়েছেন বাইশতম জৈন তীর্থঙ্কর নেমিনাথ। মূল মন্দিরের দুপাশে দেওরাণী-জেঠাণী মন্দিরের কারুকার্যেও নূতনত্ব আছে। লুনা বাসাহির বিশেষ আকর্ষণ রঙ্গমন্ডপ। ষোলটি দেবদেবীর মূর্তি, গম্বুজের চারপাশে বাহাত্তর জন তীর্থঙ্কর সহ তিনশ ষাট জন জৈন সন্ন্যাসীর মূর্তি আছে। তুলনামূলকভাবে ১৫ শতকে তৈরি মহাবীর, ঋষভদেব ও পার্শ্বনাথ মন্দিরগুলির অলঙ্করণ অনেকটাই নিষ্প্রভ।
এদিনের শেষ গন্তব্য আরাবল্লী পাহাড়ে সানসেট পয়েন্ট। পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ঘেরা জায়গায় বেশ কিছু বসার আসন আছে। ওপারেই গভীর খাদ। ঠিক সূর্যাস্তের মুহূর্তে মনে হল আকাশ থেকে সূর্য বুঝি টুপ করে খসে পড়ল। এই নৈসর্গিক শোভা অপরূপ।
এগার তারিখ সকাল সাড়ে ন'টা নাগাদ রওনা দিয়ে উদয়পুর পৌঁছলাম প্রায় দুপুর একটায়। মহারানা উদয় সিং, যিনি সূর্যবংশীয় রামচন্দ্রের উত্তরপুরুষ বলে পরিচিত, ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে আরাবল্লী পাহাড়ের ঢালে, পিছোলা লেকের পাড়ে ৫৭৭ মি উচ্চতায় এই শহর গড়ে তোলেন। একে ভেনিস অফ দ্য ইস্ট-ও বলা হয়। মনোহর হ্রদ, মর্মর প্রাসাদ, সুসজ্জিত উদ্যান আর প্রাচীন মন্দির নিয়ে উদয়পুর শহর। এখানে প্রাসাদ আছে মোট পাঁচটি – সিটি প্যালেস, জগনিবাস, জগমন্দির, লক্ষ্মীবিলাস ও মনসুন প্যালেস। প্রতিটি প্রাসাদের নির্মাণশৈলী ও অলঙ্করণ ভিন্ন ভিন্ন।
প্রথমে যাই সিটি প্যালেসে। এটি রাজস্থানের বৃহত্তম রাজপ্রাসাদ ও মহারাণার শীতকালীন আবাস। প্রথম বড়ি পোল হয়ে ত্রিপোলিয়া গেট, যাতে তিনটি খিলান ও আটটি তোরণ আছে। ত্রিপোলিয়ার পরে গণেশ দেউড়ি, শিশমহল, কৃষ্ণা ভিলা, ভীম ভিলা, ছোট চিত্রশালি, দিলখুসমহল, মানকমহল, মোতি মহল, বড়ি মহল আর ১৬৭৬ সালে তৈরি কাঁচ কি বুরুজ। সব মিলিয়ে এগারটি মহল। প্রতিটি মহলই সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত। মোরচকে ১৯ শতকে নির্মিত পাঁচহাজার টুকরো রঙবেরঙের কাঁচ বসিয়ে ময়ূরের প্রতিকৃতি এককথায় অপূর্ব – সূর্যের আলোয় প্রতিফলন হয় নীল, সবুজ, সোনা রঙে। অন্য এক ঘরে সূর্যমূর্তি, মানক বা রুবিমহলে কাচ ও পোর্সিলিনের সুন্দর সুন্দর মূর্তি। কৃষ্ণকুমারীর মহল কৃষ্ণবিলাসে রাজস্থানী মিনিয়েচার চিত্র, করণ সিং-এর তৈরি জানলা বিহীন জেনানা মহলে ফ্রেস্কোচিত্রে আঁকা কৃষ্ণগাথা, চরকুঠুরি, ঝুলবারান্দা, রঙীন দেওয়াল মেঝে, রংবেরং-এর কাচের জানালা – সবই খুব সুন্দর আর দৃষ্টিনন্দন। আর রানিমহলে আছে রানিদের ব্যবহৃত নানাধরণের পালকি, হাওদা ও ঘোড়ার গাড়ি। মোতিমহলে কাচের সুন্দর কারুকার্য, চিনি কি চিত্রমহলে চীনা ও ডাচ শিল্পীদের করা অলঙ্করণও মনোমুগ্ধকর। কারুকার্যময় শিখরে বিষ্ণু-কৃষ্ণ ও অপ্সরাদের নানা আখ্যান খোদাই করা আছে। প্রাসাদের এক অংশে সরকারি মিউজিয়াম। আরেক অংশে হোটেল। অন্য এক অংশে রাজপরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন। প্রাসাদের গায়েই ১৪ শতকে তৈরি ১০ বর্গ কিমি জুড়ে পিছোলা লেক। চারদিকে পাহাড় ঘেরা, জল আসছে ১৬০ কিমি দূর থেকে। জলাশয়ের মাঝে মাঝে দ্বীপ, দ্বীপের মাঝে প্রাসাদ আর মন্দির। একদিকে সুন্দর বাগান আর অন্যদিকে ঘাটের পর ঘাট। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থাও আছে। পূর্ণিমা রাতে এই লেকের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। এই লেককে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানান গল্পকথা। প্রচলিত কথা, পিছোলার জল পান করলে তাকে আবার এখানে ফিরে আসতেই হবে। লেকের মাঝে এক দ্বীপে রয়েছে এক নর্তকীর স্মৃতিস্তম্ভ। জনশ্রুতি, মহারাণার সঙ্গে এক নর্তকীর এই শর্ত হয় যে, সে যদি, দড়ির ওপর নাচতে নাচতে এপার ওপার করতে পারে পুরস্কারস্বরূপ অর্দ্ধেক রাজত্ব পাবে। সে প্রায় অন্য পাড়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেখে প্রধান মন্ত্রী দড়িটি কেটে দিলে নর্তকীর সলিল সমাধি হয়।
পরবর্তী গন্তব্য ফতেহ সাগর ও নেহরু পার্ক। ১৯৩৭ সালে দুর্ভিক্ষের সময় সাধারণ মানুষকে কাজ যোগাতে বৃন্দাবন গার্ডেনের আদলে এটি তৈরি করানো হয়। জলাশয়ের মাঝে ১৫০ ফুট উঁচু সুদৃশ্য ফোয়ারা আছে। উত্তরে প্রতাপ মেমোরিয়াল আর বাকি তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা।
বারো তারিখ সকাল দশটা নাগাদ জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম গুলাব বাগ বা সজ্জননিবাস দেখতে। পিছোলা লেকের ঠিক পাশেই একশ একর জায়গা জুড়ে এই প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি ১৮৫৯-৭৪ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন মহারাণা সজ্জন সিং। এখানে রয়েছে নওলাক্ষা ভবন, ভিক্টোরিয়া হল বা সরস্বতী ভবন, কমল তালাও আর ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য মিনি ট্রেন, অল্পদূরেই চিড়িয়াখানা। গোলাপ বাগে দেশি-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য সব গোলাপ আছে।
ফতেহ সাগরের পাড়ে, চারটি পদ্মপুকুরের মাঝে ফোয়ারা দিয়ে সাজানো অভিনব বাগিচা সহেলিয়াঁদের বাড়ি। বাগিচার মধ্যস্থলে রয়েছে কালো পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত ছত্রি। এই ছত্রিগুলি রাজস্থানী স্থাপত্যের অন্যতম সুন্দর নমুনা। সাধারণতঃ ৫/৬ ফুট চৌকোকার। চারকোণে চারটি থাম, শিখরযুক্ত গম্বুজাকৃতি ছাদ। মধ্যস্থলের ছত্রির ছাদের চারদিক দিয়ে বর্ষার জলের মত ঝরনার জল পড়ছে, আর তাতে বৃষ্টির মত আওয়াজ হচ্ছে। তাই একে 'বিন বাদল বরসাত/বারিশ' বলা হয়। এই বাড়ি নিয়ে দুটি জনশ্রুতি আছে। একমতে এটি রাজপরিবারের মহিলাদের বেড়াবার জায়গা ছিল। অন্যমতে মুঘল দরবার থেকে ভেট পাওয়া মুসলিম নর্তকীদের বাসস্থান।
সোয়া বারটা নাগাদ উদয়পুর ছেড়ে উত্তরে কুম্ভলগড়ের রাস্তা ধরলাম। দুরত্ব ৮৪ কিমি। ১৪৫৮ সালে পাহাড়ের ওপর ১০৮৭ মি উচ্চতায় এই দুর্গটি গড়ে তোলেন রানা কুম্ভ। এই কুম্ভলগড়েই সেই ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটেছিল – ধাত্রী পান্না বাঈ, রানা উদয় সিং-এর শৈশবাবস্থায় ঘাতকের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য নিজের সন্তানকে ঘাতকের হাতে তুলে দেন। এই বিশাল দুর্গকে ঘিরে আছে ৩৬ কিমি লম্বা ও ৪ কিমি চওড়া প্রাচীর। প্রাচীরটি সাতটি বুরুজ ও তোরণে সজ্জিত। রাজস্থানের দুর্গের ইতিহাসে প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে চিতোরের পরেই এর স্থান। দুর্গের ভিতর মহলের পর মহল তালাবন্ধ। যেটুকু দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে অনবদ্য দরবার হল বা মেঘ দরবার। অভিনবত্ব আছে জেনানা মহল ও মর্দানা মহলে। রাম পোলের কাছে মন্দিরগুলিও দর্শনীয়। নীচে দ্বিতীয় শতকের কিছু জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। দুর্গের অভ্যন্তরে রানা কুম্ভের ছত্রী বা সমাধি ছাড়া, কালী, নীলকন্ঠ, কুম্ভস্বামী ও মহাদেব মন্দির আছে। দুর্গের ছাদ থেকে দৃশ্যমান কুম্ভলগড় স্যাংচুয়ারি।
কুম্ভলগড় থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যেবেলায় হলদিঘাটে পৌঁছে রানা প্রতাপের মিউজিয়ামে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখলাম। ১৫৭৬ সালের ২১ জুন এই হলদিঘাটের প্রান্তরেই রানা প্রতাপের সঙ্গে আকবরের যুদ্ধ হয়েছিল, যা হলদিঘাটের যুদ্ধ বলে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। মিউজিয়ামে রানা প্রতাপ ও তার প্রিয় ঘোড়া চেতকের অনেক মূর্তি আছে। আছে চেতকের স্মৃতি সৌধ। রানা প্রতাপের সেনাপ্রধান হাকিম খান সুরীর সমাধি। আর বেশ বড় গোলাপবাগ। এখানে গোলাপফুলজাত নানা টুকিটাকি দ্রব্যাদি কিনতে পাওয়া যায়। হলদিঘাট থেকে সাতটা নাগাদ বেরিয়ে আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছলাম নাথদ্বারা। এদিনের রাতঠিকানা।
তেরো তারিখ সকালে রওনা হলাম চিতোরের উদ্দেশ্যে। পথে শ্রীসাঁওয়াল শেঠজীর মন্দির ও একটি শনি মন্দির দেখে নিলাম। দুপুর দেড়টা নাগাদ চিতোর পৌঁছলাম। এই সেই ঐতিহাসিক দুর্গ – রানি পদ্মিনীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে চিতোর আক্রমণ করে ধ্বংস করেন আলাউদ্দিন খিলজি। আর রানি পদ্মিনী সম্মান বাঁচানোর জন্য দুর্গের সব নারীদের নিয়ে জহর ব্রত পালন করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেন।
এই শহরের হাওয়ায় শোনা যায় –
"গড় তো চিতোরগড়, ঔর সব গড়ৈয়া,
রানি তো রানি পদ্মিনী, ঔর সব গধৈঁয়া।"
সে তর্ক বা আলোচনায় যাব না, বরং আমরা চিতোরগড় দেখি। ১৫০ মি উঁচু এক পাহাড়চূড়ায় ৭০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রাচীন এই দুর্গ ৫ কিমি দীর্ঘ প্রাকারে ঘেরা। দুর্গে মোট সাতটি পোল বা ফটক আছে। প্রথম বাদল পোল। সূক্ষ্ম ভাস্কর্যমন্ডিত এই পোলটি রাজকুমার বাঘ সিং-এর স্মৃতিস্মারক। দ্বিতীয় ভৈঁরো বা টুটা পোল, তৃতীয় হনুমান পোল, চতুর্থ গণেশ পোল, পঞ্চম জোড়লা পোল, ষষ্ঠ লক্ষণ ও সপ্তম রামপোল। দুর্গের অন্দরে রয়েছে ১১ শতকে তৈরি কারুকার্যময় জৈন মন্দির। মন্দিরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও আছে। পূর্বদিকে সুরয পোল-এ নীলকান্ত মহাদেবের মন্দির। এখানে ১২ শতকে জিজা নামে এক জৈন ব্যবসায়ীর গড়া কীর্তিস্তম্ভ আছে। ২২ মি উচ্চ এই স্তম্ভটি নানা ভাস্কর্যে অলঙ্কৃত এবং জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথের নামে উৎসর্গীকৃত। রানা কুম্ভ মালোয়ার সুলতান মামুদকে হারিয়ে চিতোর পুনরুদ্ধারের পর এই জয়ের স্মৃতিস্বরূপ একটি জয়স্তম্ভ গড়ে তোলেন। এই স্তম্ভ ১৪ মি বর্গাকার, ৩ মি উঁচু বেদীতে স্থাপিত ৩৭ মি উচ্চ এবং ন'টি তল বিশিষ্ট। একেকটি তলার বেড় ৯ মি। এর গঠনশৈলী ও কারুকাজ ভারি সুন্দর। এতে পৌরানিক আখ্যান যেমন আছে তেমনই রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, আর আরবী ভাষায় খোদিত আল্লার বাণী। এছাড়াও অলঙ্করণে রয়েছে হিন্দু দেবদেবী, হাতি সিংহ ও অন্যান্য বিভিন্ন পশুর মূর্তি প্রভৃতি। ১৫৭ টি সিঁড়ি বেয়ে স্তম্ভের ওপরে উঠলে পাখির চোখে পুরো চিতোরগড় দেখে নেওয়া যায়। তবে আমরা খোলা পাইনি, এখন বন্ধ আছে। বত্রিশ ধাপ উঠে অষ্টম শতকে তৈরি চিতোরেশ্বরী কালীকামাতার মন্দির। কষ্টি পাথরের জাগ্রত মূর্তি। মন্দির তৈরির সময় পুজো হত সূর্যদেবের। আকবরের চিতোর আক্রমনের পর, ১৫৬৮ সালে মন্দির সংস্কারের সঙ্গে দেবতার পরিবর্তন। বাইরের দেওয়ালে দেবতা ও দানবদের সমুদ্র মন্থন, সূর্যদেবতার মূর্তি খোদিত আছে। বড়ী ও ত্রিপোলিয়া গেট পেরিয়ে রানা কুম্ভের প্রাসাদ। যদিও অষ্টম শতকে এটি নির্মাণ করেন বাপ্পাদিত্য, পরে ১৪৩৩ সালে এর আমূল সংস্কার করেন রানা কুম্ভ। রাজপুত স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন এই প্রাসাদ। হাতি, ঘোড়ার আস্তাবল ছাড়া শিব মন্দিরও আছে। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর, নও লক্ষা ভান্ডার ও মিউজিয়াম রয়েছে। ১৯২০ সালে তৈরি ফতেহ প্রকাশ প্যালেস। কেল্লার উত্তরে ১৫৩০ সালে পাথরে তৈরি, রত্নেশ্বর লেকের পাড়ে, রানা রতন সিং-এর প্রাসাদ। মিউজিয়াম লাগোয়া ১৪৪৮ সালে রানা কুম্ভ-র তৈরি কুম্ভশ্যামজীর মন্দির। দেবতা বরাহ অবতাররূপী বিষ্ণু। মন্দিরটি কারুকার্যময়, ছাদ অনেকটা পিরামিডের মতো। কাছেই ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি মীরাবাঈ-এর কৃষ্ণমন্দির। দেবতার কোন মূর্তি নেই। নাটমন্দির, জগমোহন ও মূলমন্দির নিয়ে পুরো মন্দির চত্ত্বর। মন্দিরটি যেন কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ-এর সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১২ শতকে তৈরি জৈন মন্দির শৃঙ্গার চৌরি-র কারুকার্যও খুব সুন্দর। দেবতা ১৬ তম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথ।
চোদ্দ তারিখ সকালে চিতোর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। লক্ষ্য পুস্কর হয়ে জয়পুর। পথে বেশ কয়েকটা মন্দির দেখলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সোনিজী কী নঁসিয়া। একতলা মন্দিরটির পুরোটাই সোনালী রঙের। কোথাও সোনার জল করা, কোথাওবা সত্যি সোনারই। আমার সেই ছেলেবেলায় পড়া রাজা মিডাসের গল্প মনে পড়ছিল। দেবতার বরে (!) রাজা যাতেই হাত দিতেন তাই সোনা হয়ে যেত। বড় হলঘরে ঝুলনের মত সাজানো গাছপালা, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবই সোনা রঙে উজ্জ্ব্বল ঝকঝকে,আলো যেন ঠিকরে পড়ছে।
হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মেরই তীর্থস্থান পুস্কর। প্রথমে দরগায় ঘুরে এসে তারপরে ব্রহ্মা মন্দির দেখতে ঢুকলাম। প্রাচীন কুণ্ডের ধারে ভারতের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির। বিরাট তোরণদ্বার, যার ওপরে ব্রহ্মার বাহন হাঁসের মূর্তি। তেতাল্লিশ ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দির চত্ত্বর। শ্বেতপাথরের মন্দিরটির চূড়া লাল রঙের, অনেকটা মোচাকৃতি । গর্ভমন্দিরে রুপোর সিংহাসনে শ্বেতপাথরের চতুরানন হংসবাহন ব্রহ্মা, বাম পাশে গায়ত্রী দেবী। শাস্ত্রমতে সকল তীর্থের সেরা হিন্দুতীর্থ পুষ্কর। ব্রহ্মার কিন্তু পুজো হয় না। এই নিয়ে পদ্মপুরাণে একটি কাহিনি আছে। কলির প্রভাব থেকে জগৎ সংসারকে বাঁচাতে, স্বর্গের পবিত্র পুষ্করকে মর্ত্যে পাঠাবার মানসে ব্রহ্মা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে কলিহীন জায়গার সন্ধানে পদ্মফুল নিক্ষেপ করেন। সেই ফুল পৃথিবী ভ্রমণ করে পুষ্করে তিনজায়গা স্পর্শ করে। সেই তিন জায়গায় জল বেরিয়ে সরোবর তৈরি হয় – বুড়া বা ব্রহ্মা পুষ্কর, মধ্যম বা বিষ্ণু পুষ্কর ও কনিষ্ঠ বা রুদ্র পুষ্কর। ব্রহ্মার মনোস্কামনা পূরণ হল বলে তিনি যজ্ঞ করতে বসেন। বিধিমতে স্ত্রী সহ যজ্ঞ করার প্রথা। স্বর্গের দেবীদের আনতে গিয়ে সাবিত্রীদেবীর দেরী হয়ে যায়। লগ্ন প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পুত্র নারদের পরামর্শে গোপবালাকে গরুর দুধে শোধন করে, নামান্তরিত গায়ত্রীদেবীকে গান্ধর্বমতে বিবাহ করে ব্রহ্মা কনিষ্ঠ পুষ্করে যজ্ঞে বসেন। আর ঠিক তখনই সাবিত্রীদেবী যজ্ঞস্থলে এসে পৌঁছান। সব দেখেশুনে, হ্মুব্ধ ও অপমানিত বোধে তিনি শাপ দিলেন যে এরপর থেকে ব্রহ্মাকে কেউ পুজো করবে না। সেই থেকে কোথাও ব্রহ্মার পুজো হয় না। এমনকী আর কোথাও ব্রহ্মার মন্দিরও নেই। অন্যান্য দেবতাদেরও ব্রহ্মাকে মদত দেওয়ার জন্য অভিশাপ দেন সাবিত্রীদেবী। তারপর শোকে-দুঃখে নিজে পাহাড় চূড়ায় ঠাঁই নিলেন। পাহাড়ের নামও সেই থেকে হয় সাবিত্রী পাহাড়।
ব্রহ্মার মন্দির চত্ত্বরে নানা অন্য মন্দিরও আছে – পাতালেশ্বর, মহাদেব, নারদ, গণেশ, কুবের, সূর্যদেব, সপ্তঋষি ইত্যাদি। কুণ্ডের পাড়ে অন্য এক পাহাড়ে রয়েছে গায়ত্রী মন্দির। কুণ্ডের চারধারে বাহান্নটি ঘাট আছে। এখানে স্নান, তর্পণ ও পারলৌকিক ক্রিয়ায় অক্ষয় ফললাভ হয় বলে স্থানীয় বিশ্বাস। একটি ঘাটে চোখে পড়ল অল্পবয়সী এক বিদেশিনী পুরোহিতের সাহায্যে তর্পণ করছেন।
জয়পুর পৌঁছলাম রাত ন'টা নাগাদ। পনেরো তারিখ সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লাম সারাদিনের জন্য জয়পুর ঘুরতে। প্রথম গন্তব্য অম্বর প্যালেস। এই প্রাসাদও রাজপুত স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। সুরয পোল দিয়ে ঢুকে ডানদিকে জালেব চক, কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে সিংহ পোল-এর পরে দোতলায় ডানদিকে পাথরের মন্দিরে শিলা মাতা যশোরেশ্বরী বা বাংলার দেবী কালি। এই দেবী সম্পর্কে প্রচলিত ছড়া –
শিলাদেবী নামে
ছিলা তাঁর ধামে
অভয়া যশোরেশ্বরী।
মথুরাতে রাজা কংস, দৈববাণীতে ভীত, দেবকীর সন্তানদের একটি শিলাখণ্ডে আছড়ে মারতেন। সেই শিলাখণ্ডে যোগমায়াকে বধ করলে, অষ্টভূজারূপে দেবীর আবির্ভাব হয়। বাংলার রাজা প্রতাপাদিত্য সেই শিলা থেকে দেবী মূর্তি গড়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬০৪ সালে মান সিংহ বাংলা জয় করলে, দেবীকে অম্বরে নিয়ে আসেন। পুরোহিতও আসেন বাংলা থেকে। এই দেবী শক্তি সাধনার প্রতীক। সেই সময় দেবীর সামনে মোষ, ছাগল, ভেড়া এমনকী নরবলিও হত। শোনা যায়, রাজা সোয়াই জয় সিংহ নরবলি বন্ধ করায় দেবী রুষ্ট হয়ে বামে মুখ ফিরিয়ে নেন। এখনও সেই রকম আছে। যদিও প্রচলিত কালী মূর্তি থেকে কিছুটা আলাদা – মূর্তির জিভ মুখের বাইরে নেই, পদতলে শিবও নেই, শ্বেতপাথরের এই অষ্টভুজা দেবী মূর্তি কিন্তু খুবই সুন্দর। রুপোর দরজা ও মন্দির কারুকার্যময়। রাজদরবার বা দেওয়ানি আম-এর পুরো হলটাই রাজপুত স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব সমাবেশ। সম্রাট জাহাঙ্গীর নাকি ঈর্ষান্বিত হয়ে এই কারুশিল্পের ওপর আস্তরণ লাগিয়ে দেন। ছাদ দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশটি সূক্ষ্ম কারুকার্যময় শ্বেত পাথরের স্তম্ভের ওপর। গণেশ পোলের গেটটি মোজায়েকের অল্পঙ্করণ ও সুন্দর চিত্রে সাজানো। ওপরে গণেশের মূর্তি। ভেতরে সুন্দর জাফরি দিয়ে তৈরি জেনানা মহল। মাঝে সুন্দর বাগিচার চারপাশ ঘিরে রয়েছে জয় মন্দির, শিশ মহল, যশ মন্দির, সোহাগ মন্দির ও সুখ মন্দির। এরমধ্যে জয় মন্দির হল দেওয়ানি খাস বা রাজার নিজস্ব মন্ত্রণা সভা। এটি মূল্যবান পাথর ও মণি-মানিক্য দিয়ে সাজান, কাঁচের অভিনব মোজাইকও আছে। শিশ মহলের দেওয়াল, ছাদ ও মাঝে বিভিন্ন রঙের কাঁচ ও আয়না দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। এটি রাজা প্রথম জয়সিংহের তৈরি। গণেশ পোলের ওপরে সোহাগ মন্দিরে, জানালায় সূক্ষ্ম ও সুন্দর জালির কাজ আছে। এই জানলা দিয়েই রানিরা উৎসবাদি দেখতেন। সুখনিবাসের দরজায় হাতির দাঁত ও চন্দন কাঠের সূক্ষ্ম কারুকার্য। এখানে জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, তেমনই মেঝেতে খাঁজ করে শীতল জলপ্রবাহের অভিনব বাতানুকুল ব্যবস্থা। এরপরে রয়েছে প্রথম মান সিংহের মহল, এটিও অনবদ্য। এখানে আছে হাতির দাঁতের কাজ, পাথরের কাজ ও পাথরের ওপর পেন্সিলে আঁকা ছবির অভিনব সংগ্রহ। খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে অনেক তীর্থস্থানের ছবি আঁকা আছে। সব শিল্পকর্মই অপূর্ব সুন্দর। এখানে আরও আছে, জগৎ শিরোমণি বা কৃষ্ণ মন্দির ও গরুড় মন্দির। রয়েছে রাজপরিবারের কারুকার্যময় স্মৃতিস্তম্ভ।
পরবর্তী গন্তব্য নাহারগড় বা সুন্দরগড় দুর্গ বা টাইগার ফোর্ট। শহরের ৬.৫ কিমি উ-পূবে ১৮০০ মি উঁচু পাহাড়ের মাথায় ১৭৩৪ সালে রাজা জয়সিং-এর তৈরি দুর্গ। একে শহরের প্রহরীও বলা হয়। এর দুটি তলা মাটির নীচে। দুপুরের খাওয়া সেরে ফেরার পথে চোখে পড়ল জলমহল। ১৭৯৯ সালে মানসাগর হ্রদের মাঝখানে পাঁচতলা এই গ্রীষ্মাবাসটির নির্মাণ করান রাণা প্রতাপ সিং। বর্তমানে এটি একটি বিলাসবহুল হোটেল।
ষোল তারিখ সকালে প্রাতরাশ সেরে আবার সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গোবিন্দজির মন্দির। ঔরঙ্গজেবের হাত থেকে রক্ষা করতে ১৮ শতকে সোয়াই জয় সিংহ গোবিন্দজীকে বৃন্দাবন থেকে এনে, জয় নিবাস বাগে সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের সিলিং সোনায় অলঙ্কৃত করা আছে। কষ্টিপাথরের অপূর্ব শ্রীমণ্ডিত দণ্ডায়মান গোবিন্দজী, পূজা পাচ্ছেন বাঙালি পূজারির হাতে। পরবর্তী গন্তব্য সিটি প্যালেস। এই প্রাসাদ চন্দ্রমহল নামেও খ্যাত। জয়পুরের এই প্রাসাদ রীতিমতো ছোটখাট এক শহর। রাজস্থানী ও মুঘল স্থাপত্যে গড়া এই প্রাসাদ পুরী, চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রাসাদে মূল প্রবেশ পথ দুটি – একটি পূর্বে – শিরে কি দেওড়ি আর দক্ষিণে ত্রিপোলিয়া দরোয়াজা। শিরে কি দেওড়ি দিয়ে ঢুকে বিধান সভা বা টাউন হল, অফিস কাছারির পরে নক্কর দরোয়াজা, তারপর জালের চক।
চকের পর যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস ও হাওয়া মহল। এই প্রাসাদ বা দুর্গ ১৭২৮-৩২, মহারাজা সোয়াই জয় সিংহের হাতে তৈরি হলেও, পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহারাজার হাতে নতুন নতুন মহলের সংযোজন হয়েছে। শ্বেতশুভ্র দোতলা মুবারক মহল বা মহারাজার অতিথি ভবন বা গেস্ট হাউসের শ্বেত মর্মরের কারুকার্য অনবদ্য। দোতলায় রাজপরিবারের পরিধেয় বস্ত্রের মিউজিয়াম। এরপর ক্লক টাওয়ার, সিংহ পোল ও হাতি পোল পেরিয়ে বেলেপাথর ও শ্বেতপাথরের সমন্বয়ে তৈরি দেওয়ানি খাস। বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম রুপোর জলাধার দুটিও (প্রায় ৫ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট চওড়া) দেখার মত। দেওয়ানি খাসের পর দেওয়ানি আম। এটি তৈরি করেন মহারাজ সোয়াই সিংহ, ১৮ শতকে। সুন্দর সোনালী ও গাঢ় লাল রঙ – অলঙ্কৃত। এখানে মূল্যবান চিত্রের সংগ্রহ ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথির সম্ভার আছে। সংগ্রহের মধ্যে ভুর্জপত্রে বাংলায় লেখা মহাভারতও রয়েছে। অস্ত্র-শস্ত্র যে হলঘরে আছে, তা অনবদ্য হয়েছে সোনা ও বেলজিয়াম কাঁচের অলঙ্করণে। গণেশ পোলের পরে প্রিতম নিবাস চক, চকের দুধারে দুধের মত সাদা মার্বেল পাথরের সাততলা চন্দ্রমহল। চন্দ্রমহলের একতলায় অডিয়েন্স হল, দোতলায় ও তিনতলায় সুখনিবাস, চারতলায় রঙ মন্দির ও শোভা নিবাস, পাঁচ ও ছয় তলায় ছবি নিবাস – নানা আকারের আয়নায় সাজানো মিরর প্যালেসও খুব সুন্দর এবং সাততলার মার্বেল প্যাভিলিয়নও অনবদ্য। চন্দ্রমহলের পাশে জেনানা মহল ও আনন্দমহল।
এরপরে গেলাম যন্তর মন্তর-এ। এই যন্তর-মন্তরটি বিশ্বের বৃহত্তম, তৈরি হয়েছে ১৭২৮-৩৪-এ। যদিও বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য কিছুটা ম্লান, তবু আজও নিখুঁতভাবে স্থানীয় সময় (যার সঙ্গে ২৯ মিনিট যোগ করলে ভারতীয় সময় পাওয়া যাবে), সূর্যের অবস্থান, দ্রাঘিমাংশ, অক্ষাংশ, তারকা, উপগ্রহের গতিপথ ইত্যাদি জ্যোতির্বিজ্ঞানের বহু তথ্য, পাথরের তৈরি ১৮ টি জ্যামিতিক যন্ত্রে পাওয়া যায়। তবে গাইডের সাহায্য দরকার। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হাওয়া মহল। সিটি প্যালেস থেকে বেরিয়েই বড় রাস্তার ওপর ত্রিপোলিয়া বাজার, আর তার পাশেই এই হাওয়া মহল বা প্যালেস অফ উইন্ডস। উঁচু ভিতের ওপর গোলাপি রঙের বেলেপাথরের, অনেকটা মোচাকৃতি বা পিরামিডের মত, পাঁচতলা এই প্রাসাদটি জয়পুরের অন্যতম আকর্ষণ। এটি ১৭৯৯-এ মহারাজা সোয়াই প্রতাপ সিংহ তৈরি করান। মূলতঃ রাজমহিষীদের, রাজকীয় শোভাযাত্রা ও জনসাধারণের নিত্য নৈমিত্তিক জীবনযাত্রা দেখার জন্য তৈরি। এটি ৩৬০ টি অর্ধ অষ্টভুজাকার ঝোলানো গবাক্ষ ও ৫৯৩ টি পাথরের পর্দা বিশিষ্ট। একেবারে অন্যরকম গঠনশৈলী, এর জালির কাজ, ছাদ, গম্বুজ সবই বৈচিত্রময়। এতগুলি জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে, যন্ত্র ছাড়াই বাতানুকুল ব্যবস্থা রয়েছে। এবার আজকের শেষ দ্রষ্টব্যস্থল অ্যালবার্ট হল। এটির নাম রামনিবাস বাগ বা আলবার্ট হল বা যাদুঘর। রামনিবাস উদ্যানে ৩৬ একর জমিতে তৈরি ১৮৭৬-এ প্রিন্স অ্যালবার্টের জয়পুর ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখতে, মহারাজা সোয়াই রাম সিংহ ও মহারাজা সোয়াই সিংহের সময়ে তৈরি হয়। বেলেপাথর ও শ্বেতপাথরের বৈচিত্র্যময় ছাদ, গম্বুজ ও অলিন্দ নিয়ে তৈরি – স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। এখানে আছে মহারাজাদের তৈলচিত্র, নানা চিত্রকলা, বসন-ভূষণ, স্টাফড জীবজন্তু, রাজস্থানী সমাজজীবনের ছবি, হাতির দাঁতের নানা শিল্প, বিশ্বে প্রাচীনতম কার্পেট (১৬৩২ খ্রী), পেতলের কাজের সংগ্রহ। সব দেখে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে নামল। মহারাজাদের সমাধিস্থল, ইন্দোলজি মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, আর্ট গ্যালারি, ডলস্ মিউজিয়াম, বিড়লা মন্দির, জয়গড় ফোর্ট, শিশোদিয়া বাগ ও প্রাসাদ এমন অনেককিছুই এযাত্রায় দেখা সম্ভব হল না।
১৭ তারিখ সকাল সকাল জয়পুর থেকে বেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ১৫৭ কিমি দূরবর্তী সোয়াই মাধোপুরে। পরেরদিন এখান থেকেই ১৪ কিমি দূরে রণথম্বর জাতীয় উদ্যানে জঙ্গল সাফারি। এদিনটা সেইসব ব্যবস্থা ঠিক করে আর ছোট্ট শহরটায় ঘুরে বেড়িয়েই কেটে গেল। পরদিন ভোরে উঠে ফরেস্ট অফিসের নির্দেশ মত আগের দিন ঠিক করে রাখা অটোয় চড়ে ফরেস্ট অফিসে পৌঁছলাম। সেখানকার নিয়মকানুন মিটিয়ে ছাদ আর চারপাশখোলা একটা বাস – স্থানীয় নাম ক্যান্টর-এ চেপে বসলাম। ক্যান্টরের মোট চোদ্দ জন যাত্রীর মধ্যে আমরা ছাড়া সকলেই বিদেশি। এই রকম অনেকগুলো ক্যান্টর ছাড়াও ছ'জন যাত্রীর জিপও ছিল বেশ কয়েকটা। যাইহোক সকাল ছ'টা নাগাদ বাস ছাড়ল। মিনিট পনের-কুড়ি বাদে আমাদের ক্যান্টর একটা জিপের পাশে গিয়ে থামল। চারিদিকে ফিসফিস – নাকি বাঘ দেখা যাচ্ছে – আমরাও বেশ উত্তেজিত। জিপের গাইড ইশারায় বাঁদিকে দেখতে বললেন। আমরাও প্রাণপণে চোখগুলোকে ফোকাস করার চেষ্টা করলাম। কেউ দেখতে পেল কেউবা পেলনা। ওরই মধ্যে একজন একটু জোরে বলে উঠলেন, 'কই বাঘ?' আরেকজন বললেন, "ওই তো সোজা ওয়াই-এর মত যে গাছটা দেখা যাচ্ছে তার নীচে বসে আছে"। আর একজন বললেন, "ওই তো বাঘ মাথা নাড়ল।" তারপর এক সহযাত্রী তাঁর দূরবীন দিয়ে দেখে বাঘের উপস্থিতি নিশ্চিত করলে সকলে চুপ করলেন। দূরবীনটা হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। দূরে হোক তবু তো বাঘ দেখা – এতেই অনেকে খুশি। খানিকবাদে বাঘ উঠে জঙ্গলের অন্যদিকে ঢুকে গেলে আমাদের গাড়িও পিছু পিছু চলতে লাগল যদি আবার তাকে দেখা যায় সেই আশায়। কিন্তু তার আর দেখা না মিললেও হরিণ ও নীলগাই দেখতে পেলাম। অরণ্যে নানা ধরণের পাখিও ছিল। একজায়গায় অনেক পাখির দেখা মিলল একসঙ্গে। সাদা-খয়েরি রঙের মাঝারি মাপের একটা পাখি বারবার উড়ে এসে আমাদের হাত থেকে খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। সেটা বেশ মজাই লাগছিল!
অনেক দেখা আর না দেখায় রাজস্থান ভ্রমণ শেষ হল। রয়ে গেল অপূর্ব সব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়।
~ রাজস্থানের তথ্য ~ রাজস্থানের আরও ছবি ~
রেলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দীর্ঘদিন পরও ঊনআশি বছরের তরুণ দেবাশিস বোসের একটা বড় সময় কাটে ভ্রমণেই।