জয়পুর (Jaipur) - রাজপ্রাসাদ, উদ্যান, লোককাহিনী, সংগীত, নৃত্য, বর্ণময় উৎসব, কেনাকাটার হরেক পসরা, স্থানীয় খাবার আর প্রাচীন মন্দির নিয়ে বৈচিত্র্যময় জয়পুর শহর- রাজস্থানি সংস্কৃতির এক অপরূপ প্রতিচ্ছবি।
এক সময়ের জেপুর আজকের জয়পুর। ১৭৪৭ সালে মহারাজা দ্বিতীয় সোয়াই জয় সিং শহরের পত্তন করেন। রাজার নাম থেকেই শহরের নাম হয় জয়পুর। ভারতবর্ষের প্রথম যে কয়েকটি শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল জয়পুর তাদের মধ্যে অন্যতম। শহরের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, বাগিচা, তোরণ এসবের নকশা করেছিলেন বাঙালি স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। ১৮৫৩ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর জয়পুর সফরকে স্বাগত জানাতে আতিথ্যের নিদর্শন স্বরূপ শহরের সব বাড়িঘর গোলাপি রঙ করা হয় । সেই থেকে জয়পুরের আর এক নাম 'গোলাপি শহর' (Pink City)। রাজারাজড়া না থাক, বিশাল সৌধ, মন্দির, বাগিচা, দুর্গ এসব মিলিয়ে জয়পুরের রাজকীয়তা আজও বর্তমান।
মূল শহরের এক সপ্তমাংশ জুড়ে রাজস্থানি ও মুঘল স্থাপত্যের অপরূপ মেলবন্ধনে গড়ে উঠেছে সিটি প্যালেস। সাদা মার্বেলে গড়া সাততলা চন্দ্রমহলে থাকতেন রাজা-মহারাজারা। এখন সেখানে হয়েছে আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়াম। রয়েছে ঘোড়ায় টানা রথ, পালকি, রাজপোশাক, গয়নাগাটি, অস্ত্রশস্ত্র এমন অনেক কিছু। মহারাজা সোয়াই মাধো সিং কী বিশালাকৃতি ছিলেন তা মিউজিয়ামে রাখা তাঁর পোশাকআশাক দেখলেই বোঝা যায়। চন্দ্রমহল ছাড়াও প্রাসাদের অন্যান্য অংশে রয়েছে মুবারক মহল, দেওয়ান-ই-খাস ও দেওয়ান-ই-আম। বাইরে বিশ্বের বৃহত্তম রুপোর জলাধার দুটিও (প্রায় ৫ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট চওড়া) দেখার মত।
সিটি প্যালেস থেকে বেরিয়ে পাশেই যন্তর-মন্তর - বিশ্বের বৃহত্তম মানমন্দির। জয়সিংহের জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম নিদর্শন এই মানমন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৭২৭-১৭৩৩ সালের মধ্যে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সূর্যঘড়ি রয়েছে এখানে-মোটামুটি ২ সেকেণ্ডের এদিক-ওদিক সঠিক সময় দেয়।
সিটি প্যালেস যাওয়ার পথে বড় রাস্তার বাঁদিকে জালি কাজের ঝরোখাসমৃদ্ধ আকাশছোঁয়া হাওয়ামহল (Hawamahal)। বেলেপাথরের জালি পর্দার ৯৫৯টি জানালার আড়াল থেকে পর্দানসীন রাজমহিষীরা বাইরের দুনিয়া দেখতেন। রাজা সোয়াই প্রতাপ সিং ১৭৯৯ সালে এই অপরূপ প্রাসাদটি নির্মাণ করান।
জয়পুর শহর থেকে ১২কিমি দূরে কড়োয়া রাজপুত রাজাদের এককালের রাজধানী আমের। মাওটা লেকের পাড়ে আরাবল্লি পর্বতের ঢালে এক পাহাড় চূড়ায় অম্বর প্যালেস রাজকীয় স্বপ্নের অপরূপ বহিঃপ্রকাশ। সুরয পোল দিয়ে ঢুকে ডানদিকে জালেব চক, কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে সিংহ পোল-এর পরে দোতলায় ডানদিকে পাথরের মন্দিরে শিলা মাতা যশোরেশ্বরী বা বাংলার দেবী কালী। এই দেবী সম্পর্কে প্রচলিত ছড়া –
শিলাদেবী নামে
ছিলা তাঁর ধামে
অভয়া যশোরেশ্বরী।
মথুরাতে রাজা কংস, দৈববাণীতে ভীত, দেবকীর সন্তানদের একটি শিলাখণ্ডে আছড়ে মারতেন। সেই শিলাখণ্ডে যোগমায়াকে বধ করলে, অষ্টভূজারূপে দেবীর আবির্ভাব হয়। বাংলার রাজা প্রতাপাদিত্য সেই শিলা থেকে দেবী মূর্তি গড়ে যশোরে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬০৪ সালে মান সিংহ বাংলা জয় করলে, দেবীকে অম্বরে নিয়ে আসেন। পুরোহিতও আসেন বাংলা থেকে। এই দেবী শক্তি সাধনার প্রতীক। সেই সময় দেবীর সামনে মোষ, ছাগল, ভেড়া এমনকী নরবলিও হত। শোনা যায়, রাজা সোয়াই জয় সিংহ নরবলি বন্ধ করায় দেবী রুষ্ট হয়ে বামে মুখ ফিরিয়ে নেন। এখনও সেই রকম আছে। যদিও প্রচলিত কালী মূর্তি থেকে কিছুটা আলাদা – মূর্তির জিভ মুখের বাইরে নেই, পদতলে শিবও নেই, শ্বেতপাথরের এই অষ্টভুজা দেবী মূর্তি কিন্তু খুবই সুন্দর। রুপোর দরজা ও মন্দির কারুকার্যময়। রাজদরবার বা দেওয়ানি আম-এর পুরো হলটাই রাজপুত স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব সমাবেশ। সম্রাট জাহাঙ্গীর নাকি ঈর্ষান্বিত হয়ে এই কারুশিল্পের ওপর আস্তরণ লাগিয়ে দেন। ছাদ দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশটি সূক্ষ্ম কারুকার্যময় শ্বে্ত পাথরের স্তম্ভের ওপর। গণেশ পোলের গেটটি মোজায়েকের অল্পঙ্করণ ও সুন্দর চিত্রে সাজানো। ওপরে গণেশের মূর্তি। ভেতরে সুন্দর জাফরি দিয়ে তৈরি জেনানা মহল। মাঝে সুন্দর বাগিচার চারপাশ ঘিরে রয়েছে জয় মন্দির, শিশ মহল, যশ মন্দির, সোহাগ মন্দির ও সুখ মন্দির। এরমধ্যে জয় মন্দির হল দেওয়ানি খাস বা রাজার নিজস্ব মন্ত্রণা সভা। এটি মূল্যবান পাথর ও মণি-মানিক্য দিয়ে সাজান, কাঁচের অভিনব মোজাইকও আছে। শিশ মহলের দেওয়াল, ছাদ ও মাঝে বিভিন্ন রঙের কাঁচ ও আয়না দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। এটি রাজা প্রথম জয়সিংহের তৈরি। গণেশ পোলের ওপরে সোহাগ মন্দিরের জানালায় সূক্ষ্ম ও সুন্দর জালির কাজ আছে। এই জানলা দিয়েই রানিরা উৎসবাদি দেখতেন। সুখনিবাসের দরজায় হাতির দাঁত ও চন্দন কাঠের সূক্ষ্ম কারুকার্য। এখানে জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, তেমনই মেঝেতে খাঁজ করে শীতল জলপ্রবাহের অভিনব বাতানুকুল ব্যবস্থা। এরপরে রয়েছে প্রথম মান সিংহের মহল, এটিও অনবদ্য। এখানে আছে হাতির দাঁতের কাজ, পাথরের কাজ ও পাথরের ওপর পেন্সিলে আঁকা ছবির অভিনব সংগ্রহ। খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে অনেক তীর্থস্থানের ছবি আঁকা আছে। সব শিল্পকর্মই অপূর্ব সুন্দর। এখানে আরও আছে, জগৎ শিরোমণি বা কৃষ্ণ মন্দির ও গরুড় মন্দির। রয়েছে রাজপরিবারের কারুকার্যময় স্মৃতিস্তম্ভ।
জয়পুর শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে নাহারগড় ও জয়গড়কেল্লা, জলমহল, কনক বৃন্দাবন, শিশোদিয়া রানিবাগ, বিদ্যাধরবাগ, ডল মিউজিয়াম, বিড়লা প্লানেটোরিয়াম। শহরের ৬.৫ কিমি উ-পূবে ১৮০০ মি উঁচু পাহাড়ের মাথায় ১৭৩৪ সালে রাজা জয়সিং-এর তৈরি দুর্গ নাহারগড় বা সুন্দরগড় দুর্গ বা টাইগার ফোর্ট। একে শহরের প্রহরীও বলা হয়। এর দুটি তলা মাটির নীচে। ১৭৯৯ সালে মানসাগর হ্রদের মাঝখানে পাঁচতলা জলমহল গ্রীষ্মাবাসটির নির্মাণ করান রাণা প্রতাপ সিং। বর্তমানে এটি একটি বিলাসবহুল হোটেল।
৩২ কিলোমিটার দূরে রামগড় লেক। ৪০ কিলোমিটার দূরে সামোদে প্রাচীন একটি প্রাসাদ আছে।
জয়পুর থেকে ১৩১ কিলোমিটার দূরে মুসলিম তীর্থস্থান আজমির (Azmer)। আর আজমির থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মেরই তীর্থস্থান পুষ্কর (Pushkar)। প্রাচীন অজয়মেরুই আজকের আজমির। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা অজয়পালের হাতে গোড়াপত্তন হলেও পরে মুসলিমদের দখলে চলে যায় অজয়মেরু। এখানকার প্রধান আকর্ষণ খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগা। প্রবেশপথে সুন্দর কারুকার্যময় দরজা। মাথায় ঢাকা দিয়ে দরগায় প্রবেশ করতে হবে। মইনুদ্দিন চিস্তির সমাধিটি রুপোর পাতে মোড়া। এছাড়াও এখানে আরও দুটি মসজিদ আছে। দরগার পাশের জমজমাট রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আড়াই-দিন-কা-ঝোপড়া। অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে তারাগড় দুর্গ, নাসিয়ান জৈনমন্দির, আমাসাগর সরোবর। আজমির থেকে নাগপাহাড় পেরিয়ে পুষ্কর। দরগার পাশাপাশি এখানের প্রধান আকর্ষণ হ্রদ ও ব্রহ্মামন্দির। বিরাট তোরণদ্বার, যার ওপরে ব্রহ্মার বাহন হাঁসের মূর্তি। তেতাল্লিশ ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দির চত্ত্বর। শ্বেতপাথরের মন্দিরটির চূড়া লাল রঙের, অনেকটা মোচাকৃতি । গর্ভমন্দিরে রুপোর সিংহাসনে শ্বেতপাথরের চতুরানন হংসবাহন ব্রহ্মা, বাম পাশে গায়ত্রী দেবী। শাস্ত্রমতে সকল তীর্থের সেরা হিন্দুতীর্থ পুষ্কর। ব্রহ্মার কিন্তু পুজো হয় না। এই নিয়ে পদ্মপুরাণে একটি কাহিনি আছে। কলির প্রভাব থেকে জগৎ সংসারকে বাঁচাতে, স্বর্গের পবিত্র পুষ্করকে মর্ত্যে পাঠাবার মানসে ব্রহ্মা পৃথিবীর উদ্দেশ্যে কলিহীন জায়গার সন্ধানে পদ্মফুল নিক্ষেপ করেন। সেই ফুল পৃথিবী ভ্রমণ করে পুষ্করে তিনজায়গা স্পর্শ করে। সেই তিন জায়গায় জল বেরিয়ে সরোবর তৈরি হয় – বুড়া বা ব্রহ্মা পুষ্কর, মধ্যম বা বিষ্ণু পুষ্কর ও কনিষ্ঠ বা রুদ্র পুষ্কর। ব্রহ্মার মনোস্কামনা পূরণ হল বলে তিনি যজ্ঞ করতে বসেন। বিধিমতে স্ত্রী সহ যজ্ঞ করার প্রথা। স্বর্গের দেবীদের আনতে গিয়ে সাবিত্রীদেবীর দেরী হয়ে যায়। লগ্ন প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পুত্র নারদের পরামর্শে গোপবালাকে গরুর দুধে শোধন করে, নামান্তরিত গায়ত্রীদেবীকে গান্ধর্বমতে বিবাহ করে ব্রহ্মা কনিষ্ঠ পুষ্করে যজ্ঞে বসেন। আর ঠিক তখনই সাবিত্রীদেবী যজ্ঞস্থলে এসে পৌঁছান। সব দেখেশুনে, হ্মুব্ধ ও অপমানিত বোধে তিনি শাপ দিলেন যে এরপর থেকে ব্রহ্মাকে কেউ পুজো করবে না। সেই থেকে কোথাও ব্রহ্মার পুজো হয় না। এমনকী আর কোথাও ব্রহ্মার মন্দিরও নেই। অন্যান্য দেবতাদেরও ব্রহ্মাকে মদত দেওয়ার জন্য অভিশাপ দেন সাবিত্রীদেবী। তারপর শোকে-দুঃখে নিজে পাহাড় চূড়ায় ঠাঁই নিলেন। পাহাড়ের নামও সেই থেকে হয় সাবিত্রী পাহাড়।
হ্রদের চারপাশ ঘিরে ৫২টি ঘাট আছে। পুষ্কর জুড়ে অসংখ্য মন্দির আছে – পাতালেশ্বর, মহাদেব, নারদ, গণেশ, কুবের, সূর্যদেব, সপ্তঋষি ইত্যাদি। হ্রদের পাশে দুই পাহাড়ের মাথায় সাবিত্রী ও গায়ত্রীদেবীর মন্দির।
যাওয়া- শহরের কেন্দ্র থেকে ১৫ কিমি দূরে সঙ্গানের বিমানবন্দর। দিল্লি, যোধপুর, উদয়পুর, মুম্বই, কলকাতা সহ আরও অনেক জায়গা থেকে সরাসরি উড়ান রয়েছে জয়পুরে। বিমানবন্দর থেকে শহরের যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি, অটো সবই পাওয়া যায়। শহরের মাঝখানে রেলস্টেশন। জয়পুরের সঙ্গে রাজস্থানের অন্যান্য শহরের এবং ভারতের প্রধান প্রধান শহরগুলির যোগাযোগ রয়েছে। দিল্লি থেকে ৮নং জাতীয় সড়ক ধরে সরাসরি জয়পুর পৌঁছনো যায়। ২৬০ কিমি পথ পেরোতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা। জয়পুর থেকে যোধপুর আর উদয়পুরের দূরত্ব যথাক্রমে ৩৩২কিমি ও ৩৭৪কিমি।
থাকা-জয়পুরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের তিনটি হোটেল আছে- হোটেল গাঙ্গুর, হোটেল তাজ ও হোটেল স্বাগতম। এছাড়া বেসরকারি হোটেলও প্রচুর আছে। জয়পুরের এস টি ডি কোডঃ ০১৪১।
খাওয়া - চিরাচরিত রাজস্থানি খাবার – আমিষ ও নিরামিষ -সবই মিলবে জয়পুরে। চেখে দেখা যায় ডাল বাটি চুরমা, শুলে, গাট্টে কি সবজি, লালা মাস এমন সব স্থানীয় খাবার। স্থানীয় সুরার স্বাদ নিতে চুমুক দিতে হবে কেশর কস্তুরি বা জগমোহনে।
কেনাকেটা- কেনাকাটার স্বর্গরাজ্য জয়পুর। উটের চামড়ার জুতো থেকে শুরু করে কার্পেট, হাতের কাজের নানান সম্ভার, গয়নাগাটি, সুগন্ধী-আরও রকমারী সব জিনিস। জুয়েলারির মধ্যে সংগ্রহে রাখার মতো হল খাঁটি মণিরত্ন আর কুন্দনকাজের গয়না। মিলবে হাওয়ামহলের ডাইনে জহুরি বাজারে।
উৎসব- উৎসবের মরশুমে আলো আর রঙের বন্যায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে জয়পুর। মার্চ মাসে হোলির দিনে হয় হাতি উৎসব। চৌগান স্টেডিয়ামে ঝলমলে সাজে সজ্জিত আবিরে রাঙা হাতির দলের মধ্যে চলে পোলো, দড়ি টানাটানি আর দৌড় প্রতিযোগিতা। বর্ষাকে স্বাগত জানানোর উৎসব তীজ (Teez)। জুলাই-আগষ্ট মাসে এক বা দু'দিন ধরে এই উৎসব চলে। কুমারী মেয়েরা নাচে-গানে এই উৎসব পালন করে। হোলির পরদিন থেকে শুরু হয় গাঙ্গুর উৎসব (Gangaur)। ১৬দিন ব্যাপী এই উৎসবে মেতে ওঠে গোটা রাজস্থান। শিবজায়া দেবী গৌরী পিতৃগৃহ থেকে পতিগৃহে যাত্রা করেছেন-এটাই উৎসবের গল্পকথা। শেষদিনে ত্রিপোলিয়া গেট থেকে এক বিশাল মিছিল পথে নামে। গৌরী এখানে সদাচার, একনিষ্ঠতা, উর্বরতা আর পরিপূর্ণ বিবাহিতা নারীর প্রতীক। জানুয়ারী মাসের মকরসংক্রান্তির আকর্ষণ ঘুড়ি উৎসব, স্থানীয় মানুষ থেকে পর্যটক সকলেই মেতে ওঠেন এই উৎসবে। আজমিরে প্রধান উৎসব উরস আর প্রতিবছর কার্তিক পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে পুষ্কর মেতে ওঠে পশুমেলায়।
মরসুম -খুব গরম বাদে যেকোন মরশুমেই চলে যাওয়া যায় জয়পুর।
রণথম্বোর (Ranthambore) - জয়পুর থেকে ১৫৭ কিমি দূরবর্তী সোয়াই মাধোপুর। এখান থেকে ১২ কিমি দূরে রণথম্বোর জাতীয় উদ্যান। প্রাচীন অরণ্য, ভেঙে যাওয়া দুর্গের দ্বংসাবশেষ নিয়ে রোমাঞ্চকর রণথম্বোর। আরাবল্লি ও বিন্ধ্য পর্বতের মাঝে ৩৯২ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত রণথম্বোর জাতীয় উদ্যান। উদ্যান খোলা থাকে ১ অক্টোবর থেকে ৩০ জুন। জঙ্গলে ঘোরার সময় প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ১০টা এবং বেলা আড়াইটে থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। জঙ্গলসাফারির জন্য বনদপ্তরের অফিস থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। গরমের সময় বাঘ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ট্রিপ শুরুর একঘন্টা আগে পারমিট দেওয়া হয়। জিপে ছজন যেতে পারেন। কুড়ি সিটের ক্যান্টারও আছে। ক্যান্টারে মাথাপিছু খরচ কম পড়লেও জঙ্গল ভালো করে উপভোগ করার জন্য জিপে যাওয়া ভালো। সাফারির ৯০ দিন আগে থেকে বুক করা যায়। একেবারে প্রথমদিকে বুক করলে তবেই জিপ পাওয়া সম্ভব। তার জন্য অনলাইন বুকিং করে নেওয়াই ভালো। যার নামে বুকিং হচ্ছে তার আইডেন্টিটি প্রুফ অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। সাফারি অনলাইন বুকিং করা যাবে www.rajasthanwildlife.com এই ওয়েবসাইট থেকে। স্টিল ক্যামেরায় ছবি তোলার আলাদা কোন খরচ লাগেনা।
জঙ্গলে ঢোকার মূল গেটের কাছে প্রাচীন এক বৃদ্ধ বটগাছ তার অজস্র ঝুরি নামিয়ে স্বাগত জানায় পর্যটকদের। রণথম্বোর দুর্গের ভাঙা প্রাকার আর বিশাল দরজা পেরিয়ে অরণ্যে ঢোকা। এ অরণ্য রুক্ষ। শুরুর দিকে বট-পিপুলের প্রাচুর্য থাকলেও মূলত ঘাসজঙ্গল। মাঝারি উচ্চতার কুশঘাস মাথা তুলেছে সর্বত্র। তারই ফাঁকে ফাঁকে অজস্র ধোক (Dhok) গাছ ছোট ছোট লালচে পাতা আর কাঁটাভরা ডাল নিয়ে মাথা নুইয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে খেজুর, বের, চিলা, আম, খয়ের – চেনা-অচেনা নানা গাছ। জঙ্গলে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় বারাশিঙা বা সোয়াম্প ডিয়ার, চিতল বা স্পটেড ডিয়ার, চিঙ্কারা – এমন নানা জাতের হরিণ, ময়ূর, নীলগাই, বুনো শুয়োর, হায়না, শেয়াল ইত্যাদি জীবজন্তু। চোরাশিকারীদের দৌলতে জঙ্গলে কমছে বাঘের সংখ্যা, তাদের দেখা মেলা ভাগ্যের ব্যাপার। খালের ধারে রোদ পোয়ায় কুমীর। জঙ্গলের মধ্যেই একজায়গায় অজস্র পাখির দেখা মেলে। রণথম্বোরের জঙ্গলে তিনটি বিশাল পুষ্করিণী বা তালাও আছে। দুর্গের কাছেই পদম তালাও ও রাজবাগ তালাও। জঙ্গলের গভীরে মিলাক তালাও।
এই দুর্গ শাকম্ভরীর চাহমানা সাম্রাজ্যের একটা বড় অংশ ছিল। আনুমানিক পঞ্চাশ শতকে মহারাজা জয়ন্ত এই দুর্গ নির্মাণ করান। দ্বাদশ শতকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে হেরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দুর্গটি যাদবদের দখলে ছিল। এই দুর্গের সবচেয়ে শক্তিশালী অধিপতি ছিলেন হাম্বির দেও (১২৮২-১৩০১ খ্রি)। এরপর এই দুর্গ দিল্লির সুলতানদের হস্তগত হয়। পরবর্তীকালে রানা সংঘ (১৫০৯-১৫২৭ খ্রি) দুর্গের পুনরুদ্ধার করলেও শেষপর্যন্ত তা মুঘলদের করায়ত্ব হয়। রণথম্বোর দুর্গের মোট সাতটা দরজা ছিল – নওলাখা পোল, হাতিয়া পোল, আন্ধেরি পোল, সূরজ পোল, দিল্লি পোল এবং সাত পোল। একসময় সৈন্যদের হাতি-ঘোড়াও উঠত এই সিঁড়ি দিয়ে। স্বয়ং রাজা হাতির পিঠে চেপে যে দরজা দিয়ে দুর্গে প্রবেশ করতেন তারই নাম হয়েছিল হাতিয়া পোল। দুর্গের ভিতরে রয়েছে হাম্বিরের প্রাসাদ, রানির প্রাসাদ, হাম্বিরের বড় ও ছোট কাছারি, বাদলমহল, বত্রিশখাম্বা ছত্রি, ঝানওয়ারা-ভানওয়ারা (শস্যগুদাম), মসজিদ ও দরগা, হিন্দু ও জৈনমন্দির সহ বেশ কিছু দ্রষ্টব্য। যদিও অধিকাংশই ভেঙ্গে গেছে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন সোয়াই মাধোপুর। দিল্লি-মুম্বই রেলপথে জয়পুর থেকে সোয়াই মাধোপুরের দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার। প্যাসেঞ্জার ট্রেনসহ সারাদিনে বেশ কয়েকটা এক্সপ্রেস ট্রেনও আছে এই পথে। সড়কপথে জয়পুর থেকে সোয়াই মাধোপুরের দূরত্ব টংক হয়ে ১৮০ কিলোমিটার আর দৌসা হয়ে ১৬০ কিলোমিটার। সোয়াই মাধোপুর থেকে রণথম্বোর জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার।
থাকা- রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল বিনায়ক ও হোটেল ঝুমুর বাওরি। দেওয়ালি এবং ক্রিসমাস-নিউইয়ারের সময় দুটো হোটেলেরই ভাড়া একসপ্তাহের জন্য তিনগুণ হয়ে যায়। এছাড়া অনেক বেসরকারি হোটেল আছে।
কেনাকাটাঃ- বিদেশি পর্যটকদের কাছে রণথম্বোর স্কুল অফ আর্টের কদর খুব। হাতে আঁকা বাঘের ছবিগুলি সত্যিই যেন জীবন্ত মনে হয়।
ভরতপুর (Bharatpur) – ভরতপুরের প্রধান আকর্ষণ ২৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত কেওলাদেও ঘানা পক্ষীনিবাস। ১৯৮১ সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি এবং ১৯৮৪ সালে WWF এর হেরিটেজ সাইটের তকমা পেয়েছে জলাময় এই অরণ্যভূমি। স্থানীয় পাখির পাশাপাশি সুদূর সাইবেরিয়া, তিব্বত, চিন থেকে এসে ভিড় জমায় পরিযায়ী পাখির দল। সিলভার মুনিয়া, গ্রে পেট্রিজ, পেন্টেড স্টর্ক, লং টেলড স্রাইক, ইন্ডিয়ান রবিন, টিয়া পাখি, গ্রিন পিজিয়ন, ব্যাবলার বা ছাতারে, ইগ্রেটস, রোজ রিংগড প্যারাকিট, বুচার বার্ড, স্পট বিলড ডাক, লেসার হুইস্লিং ডাক, হোয়াইট চিক বুলবুল, পিন টেলড ডাক, লাফিং ডাভ বা ঘুঘু পাখি, ময়ূর, ব্লু জে বা নীলকণ্ঠ, ব্রাহ্মণী স্টার্লিং, ইন্ডিয়ান রোলার, গ্রে হর্ণবিল, স্পটেড আউল, ব্ল্যাক-রেড স্টার্ক, রেড ভেন্টেড বুলবুল, ইন্ডিয়ান ডার্টার, সার্পেন্ট ঈগল, কমন কুট, স্নেক বার্ড, টাইগার বার্ড, বিগ মুনিয়া, পার্পল হেরণ, কর্মোরেন্টস, গ্রে হেরণ, মুর হেন,পন্ড হেরণ, নাইট হেরণ, ইন্ডিয়ান মো হেড, রোজি পেলিকান, পার্পল মুর হেন, হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন এমন অজস্র পাখি চোখে পড়ে। পাখি ছাড়াও এই অরণ্য চিতল হরিণ, শম্বর, নীলগাই প্রভৃতি জীবজন্তুরও বাসস্থান।
১৭৩০ সালে জাঠ নেতা সূরযমল ভরতপুর শহর গড়ে তোলেন। ১৭৩৩ সালে নির্মাণ করা হয় লৌহগড় দুর্গটি। দুর্গের দুটি প্রবেশপথ – উত্তরে অষ্টপতি ও দক্ষিণে লোহিয়া পোল। বর্তমানে দুর্গের অভ্যন্তরে সরকারি কার্যালয় এবং মিউজিয়াম করা হয়েছে।
বেড়ানোর মরসুম অক্টোবর থেকে মার্চ মাস হলেও পাখি দেখার ভালো সময় ডিসেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির শুরু।
যাওয়াঃ- নিকটতম বিমানবন্দর আগ্রা। আগ্রা (৫৫ কিমি) ও মথুরা (৩৪ কিমি) থেকে নিয়মিত বাস আসে ভরতপুরে। নিকটতম রেলস্টেশন মুম্বই-দিল্লি ব্রডগেজ লাইনে ভরতপুর স্টেশন।
থাকা- পক্ষীনিবাসের কাছেই আই টি ডি সি-র ভরতপুর ফরেস্ট লজ। এছাড়াও বেসরকারি হোটেল আছে বেশ কিছু।
উদয়পুর(Udaipur)- উদয়পুরের আকর্ষণ সুন্দরী পিছোলা লেক (Pichhola Lake) আর লেকের মাঝে দ্বীপের মধ্যে রূপকথার কাহিনির মতো এক প্রাসাদ। এই লেককে ঘিরেই উদয়পুরের প্রাণস্পন্দন ।
বিন্ধ্য আর আরাবল্লির পর্বতমালার সংযোগস্থলে উদয়পুরের অবস্থান। ১৪ শতকের শেষভাগে বানজারা উপজাতির মানুষেরা পিছোলা গ্রামে ১০০০ বর্গকিমি ব্যাপ্ত এক কৃত্রিম সরোবর খনন করে। উদয়পুর শহর পওনের সময় মহারানা উদয় সিং সরোবরটিকে প্রসারিত করেন। সেইসময়েই লেকের গর্ভে হারিয়ে যায় পিছোলা গ্রাম। শহর প্রসারের আর আধুনিক শিল্পপ্রসারের চাপ সত্ত্বেও উদয়পুরের প্রাচীন ঐতিহ্য আজও অক্ষুন্ন। সংকীর্ণ গলিপথের দুপাশে বাড়িঘর, দোকানপাট, হস্তশিল্পীদের ঘর -চারপাশ দেখতে দেখতে পায়ে পায়ে হেঁটেই কেটে যাবে সময়।
মনোহর হ্রদ, মর্মর প্রাসাদ, সুসজ্জিত উদ্যান আর প্রাচীন মন্দির নিয়ে 'ভেনিস অফ দ্য ইস্ট' উদয়পুর শহর। এখানে প্রাসাদ আছে মোট পাঁচটি – সিটি প্যালেস, জগনিবাস, জগমন্দির, লক্ষ্মীবিলাস ও মনসুন প্যালেস। প্রতিটি প্রাসাদের নির্মাণশৈলী ও অলঙ্করণ ভিন্ন ভিন্ন।
অনুচ্চ পাহাড়ে ঘেরা টলটলে জলের হ্রদ পিছোলা। লেকের বুকে মাঝে মাঝেই জেগে রয়েছে দ্বীপ। দ্বীপগুলিতে রয়েছে প্রাসাদ আর মন্দির। হ্রদের ঠিক মাঝখানে দুটি দ্বীপ জগনিবাস ও জগমন্দির। জগনিবাসেই রয়েছে অপরূপ লেক প্যালেস -বর্তমানে ভারতের অন্যতম বিলাসবহুল হেরিটেজ হোটেল। উদয়পুর রাজপরিবারের বর্তমান উত্তরাধিকারীও এখানেই থাকেন। প্রতিদিন সিটি প্যালেসের জেটি (বংশীঘাট) থেকে বোট যাচ্ছে জলবিহারে। সৌরচালিত বোটেও লেকে ঘোরা যায়।
রাজস্থানের বৃহত্তম রাজপ্রাসাদ মহারানার শীতকালীন আবাস সিটি প্যালেস - গ্রানাইট আর মার্বেলে গড়া এক অপরূপ স্থাপত্য। প্রথম বড়ি পোল হয়ে ত্রিপোলিয়া গেট, যাতে তিনটি খিলান ও আটটি তোরণ আছে। বংশীঘাটের কাছে ত্রিপোলিয়া গেট পেরিয়ে প্রাসাদ চত্বর। সেকালে মহারানাদের জন্মদিনে মহারানার সম ওজনের সোনা-রুপো বিতরণ করা হত দরিদ্র প্রজাদের। আজ সেখানেই টিকিট কাউন্টার। ত্রিপোলিয়ার পিছনে গণেশ দেউরি-পথ গিয়েছে দক্ষিণে রাজ অঙ্গনে। এরপর শিশমহল, কৃষ্ণা ভিলা, ভীম ভিলা, ছোট চিত্রশালি, দিলখুসমহল, মানকমহল, মোতি মহল, বড়ি মহল আর ১৬৭৬ সালে তৈরি কাঁচ কি বুরুজ। ৩০মি উঁচু আর ২৪৪মি দীর্ঘ এই প্রাসাদে এগারটি মহল আছে। প্রতিটি মহলই সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত। মোরচকে ১৯ শতকে নির্মিত পাঁচহাজার টুকরো রঙবেরঙের কাঁচ বসিয়ে ময়ূরের প্রতিকৃতি এককথায় অপূর্ব – সূর্যের আলোয় প্রতিফলন হয় নীল, সবুজ, সোনা রঙে। অন্য এক ঘরে সূর্যমূর্তি, মানক বা রুবিমহলে কাচ ও পোর্সিলিনের সুন্দর সুন্দর মূর্তি। কৃষ্ণকুমারীর মহল কৃষ্ণবিলাসে রাজস্থানী মিনিয়েচার চিত্র, করণ সিং-এর তৈরি জানালা বিহীন জেনানা মহলে ফ্রেস্কোচিত্রে আঁকা কৃষ্ণগাথা, চোরকুঠুরি, ঝুলবারান্দা, রঙীন দেওয়াল মেঝে, রংবেরং-এর কাচের জানালা – সবই খুব সুন্দর আর দৃষ্টিনন্দন। আর রানিমহলে আছে রানিদের ব্যবহৃত নানাধরণের পালকি, হাওদা, ও ঘোড়ার গাড়ি। মোতিমহলে কাচের সুন্দর কারুকার্য, চিনি কি চিত্রমহলে চীনা ও ডাচ শিল্পীদের করা অলঙ্করণও মনোমুগ্ধকর। কারুকার্যময় শিখরে বিষ্ণু-কৃষ্ণ ও অপ্সরাদের নানা আখ্যান খোদাই করা আছে। প্রাসাদের এক অংশে সরকারি মিউজিয়াম। আরেক অংশে হোটেল। অন্য এক অংশে রাজপরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন। প্রাসাদের গায়েই ১৪ শতকে তৈরি ১০ বর্গ কিমি জুড়ে পিছলা লেক। চারদিকে পাহাড় ঘেরা, জল আসছে ১৬০ কিমি দূর থেকে। জলাশয়ের মাঝে মাঝে দ্বীপ, দ্বীপের মাঝে প্রাসাদ আর মন্দির। একদিকে সুন্দর বাগান আর অন্যদিকে ঘাটের পর ঘাট। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থাও আছে। পূর্ণিমা রাতে এই লেকের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। এই লেককে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানান গল্পকথা। প্রচলিত কথা, পিছোলার জল পান করলে তাকে আবার এখানে ফিরে আসতেই হবে। লেকের মাঝে এক দ্বীপে রয়েছে এক নর্তকীর স্মৃতিস্তম্ভ। জনশ্রুতি, মহারাণার সঙ্গে এক নর্তকীর এই শর্ত হয় যে, সে যদি, দড়ির ওপর নাচতে নাচতে এপার ওপার করতে পারে পুরস্কারস্বরূপ অর্দ্ধেক রাজত্ব পাবে। সে প্রায় অন্য পাড়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেখে প্রধান মন্ত্রী দড়িটি কেটে দিলে নর্তকীর সলিল সমাধি হয়।
সিটি প্যালেসের কাছেই ফতে প্রকাশ প্যালেস এখন হোটেল। এরই এক অংশে রয়েছে ক্রিস্টাল গ্যালারি-উদয়পুরের আর এক আকর্ষণ। ১৮৭৭ সালে মহারানা সজ্জন সিং-এর অর্ডারে বার্মিংহাম থেকে আসে ক্রিস্টালে তৈরি ছ'শোরও বেশি অভিনব সামগ্রী।
সিটি প্যালেসের প্রবেশপথের ডানদিকে মহারানা জগৎসিংহের তৈরি জগদীশ মন্দির। আরাধ্য দেবতা বিষ্ণু। তৈরি হয়েছিল ১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে। আর রয়েছে বাগোর কি হাভেলি এবং বিখ্যাত গাঙ্গৌর ঘাট। মার্চ মাসে গাঙ্গৌর উৎসবের মিছিল এখানেই শেষ হয়। সন্ধেবেলায় বসে লোক নৃত্যগীতের আসর।
সিটি প্যালেস থেকে ২কিমি দূরে ভিনটেজ কার মিউজিয়ামে রয়েছে রাজা-মহারাজাদের ব্যবহৃত চারচাকার গাড়ির এক অতুলনীয় সংগ্রহ।
ভারতীয় লোক কলামন্ডলের রাজস্থানি শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্যের আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম আর পুতুলের সম্ভারে চেনা যাবে অতীত ইতিহাসকে। ফতেহ সাগরের পাড়ে, চারটি পদ্মপুকুরেরে মাঝে ফোয়ারা দিয়ে সাজানো অভিনব বাগিচা সহেলিয়াঁদের বাড়ি। বাগিচার মধ্যস্থলে রয়েছে কালো পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত ছত্রি। এই ছত্রিগুলি রাজস্থানী স্থাপত্যের অন্যতম সুন্দর নমুনা। সাধারণতঃ ৫/৬ ফুট চৌকোকার। চারকোণে চারটি থাম, শিখরযুক্ত গম্বুজাকৃতি ছাদ। মধ্যস্থলের ছত্রির ছাদের চারদিক দিয়ে বর্ষার জলের মত ঝরনার জল পড়ছে, আর তাতে বৃষ্টির মত আওয়াজ হচ্ছে। তাই একে 'বিন বাদল বরসাত/বারিশ' বলা হয়। এই বাড়ি নিয়ে দুটি জনশ্রুতি আছে। একমতে এটি রাজপরিবারের মহিলাদের বেড়াবার জায়গা ছিল। অন্যমতে মুঘল দরবার থেকে ভেট পাওয়া মুসলিম নর্তকীদের বাসস্থান।
পিছোলা লেকের ঠিক পাশেই একশ একর জায়গা জুড়ে গুলাব বাগ বা সজ্জননিবাস প্রাসাদ কমপ্লেক্সটি ১৮৫৯-৭৪ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন মহারাণা সজ্জন সিং। এখানে রয়েছে নওলাক্ষা ভবন, ভিক্টোরিয়া হল বা সরস্বতী ভবন, কমল তালাও আর ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য মিনি ট্রেন, অল্পদূরেই চিড়িয়াখানা। গোলাপ বাগে দেশি-বিদেশি দুষ্প্রাপ্য সব গোলাপ আছে।
মোতিমাগরতে রয়েছে রানা প্রতাপের স্মৃতিতে নির্মিত প্রতাপ মেমোরিয়াল। হল অফ ফেম মিউজিয়ামে সন্ধ্যায় আলো ও ধ্বনির মাধ্যমে রানা প্রতাপের জীবনকাহিনী তুলে ধরা হয়।
উদয়পুর থেকে উত্তরে ৮৪ কিমি দূরে কুম্ভলগড়। ১৪৫৮ সালে পাহাড়ের ওপর ১০৮৭ মি উচ্চতায় এই দুর্গটি গড়ে তোলেন রানা কুম্ভ। এই কুম্ভলগড়েই সেই ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটেছিল – ধাত্রী পান্না বাঈ, রানা উদয় সিং-এর শৈশবাবস্থায় ঘাতকের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য নিজের সন্তানকে ঘাতকের হাতে তুলে দেন। এই বিশাল দুর্গকে ঘিরে আছে ৩৬ কিমি লম্বা ও ৪ কিমি চওড়া প্রাচীর। প্রাচীরটি সাতটি বুরুজ ও তোরণে সজ্জিত। রাজস্থানের দুর্গের ইতিহাসে প্রাচীনত্বে্র দিক দিয়ে চিতরের পরেই এর স্থান। দুর্গের ভিতর মহলের পর মহল তালাবন্ধ। যেটুকু দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে অনবদ্য দরবার হল বা মেঘ দরবার। অভিনবত্ব আছে জেনানা মহল ও মর্দানা মহলে। রাম পোলের কাছে মন্দিরগুলিও দর্শনীয়। নীচে দ্বিতীয় শতকের কিছু জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। দুর্গের অভ্যন্তরে রানা কুম্ভের ছত্রী বা সমাধি ছাড়া, কালী, নীলকন্ঠ, কুম্ভস্বামী ও মহাদেব মন্দির আছে। দুর্গের ছাদ থেকে দৃশ্যমান কুম্ভলগড় স্যাংচুয়ারি।
উদয়পুর থেকে সারাদিনের বেড়ানোয় ঘুরে নেওয়া যায় হলদিঘাট। ১৫৭৬ সালের ২১ জুন এই হলদিঘাটের প্রান্তরেই রানা প্রতাপের সঙ্গে আকবরের যুদ্ধ হয়েছিল, যা হলদিঘাটের যুদ্ধ বলে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। এখানকার মিউজিয়ামে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-তে দেখে নেওয়া যায় রানা প্রতাপের জীবনের নানা ঘটনা। মিউজিয়ামে রানা প্রতাপ ও তার প্রিয় ঘোড়া চেতকের অনেক মূর্তি আছে। আছে চেতকের স্মৃতি সৌধ। রানা প্রতাপের সেনাপ্রধান হাকিম খান সুরীর সমাধি। আর বেশ বড় গোলাপবাগ। এখানে গোলাপফুলজাত নানা টুকিটাকি দ্রব্যাদি কিনতে পাওয়া যায়।
একযাত্রাতেই দেখে নেওয়া যায় প্রাচীন মন্দির নাথদ্বারা ও একলিঙ্গজি।
শহরের উপকন্ঠে উদয়পুরের আর এক আকর্ষণ শিল্পীগ্রাম। রাজস্থান, গুজরাট, গোয়া ও মহারাষ্ট্র থেকে নানা উপজাতির লোকশিল্পীরা এসে ৮০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বসবাস করছেন। এই জীবন্ত এথনিক মিউজিয়ামে রয়েছে হস্তশিল্পের নানা নিদর্শন খরিদের সুযোগ।
শহর থেকে ৩ কিমি দূরে ছোট্ট নদী আহার-এর তীরে শিশোদিয়া রাজাদের প্রাচীন রাজধানী পাহাড়ে ঘেরা আহার। উদয়পুরের মহারানাদের সমাধি রয়েছে এখানে। আরবল্লির এক পাহাড়ের মাথায় সজ্জনগড় তথা মনসুন প্যালেস-রানাদের বর্ষাকালীন নিবাস।
উদয়পুর থেকে ১১০কিলোমটার দূরে ঐতিহাসিক চিতোরগড় (Chitorgarh)। এই সেই ঐতিহাসিক দুর্গ – রানি পদ্মিনীর রূপে আকৃষ্ট হয়ে চিতোর আক্রমণ করে ধ্বংস করেন আলাউদ্দিন খিলজি। আর রানি পদ্মিনী সম্মান বাঁচানোর জন্য দুর্গের সব নারীদের নিয়ে জহর ব্রত পালন করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেনট১৫০ মি উঁচু এক পাহাড়চূড়ায় ৭০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রাচীন এই দুর্গ ৫ কিমি দীর্ঘ প্রাকারে ঘেরা। দুর্গে মোট সাতটি পোল বা ফটক আছে। প্রথম বাদল পোল। সূক্ষ্ম ভাস্কর্যমন্ডিত এই পোলটি রাজকুমার বাঘ সিং-এর স্মৃতিস্মারক। দ্বিতীয় ভৈঁরো বা টুটা পোল, তৃতীয় হনুমান পোল, চতুর্থ গণেশ পোল, পঞ্চম জোড়লা পোল, ষষ্ঠ লক্ষণ ও সপ্তম রামপোল। দুর্গের অন্দরে রয়েছে ১১ শতকে তৈরি কারুকার্যময় জৈন মন্দির। মন্দিরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও আছে। পূর্বদিকে সুরয পোল-এ নীলকান্ত মহাদেবের মন্দির। এখানে ১২ শতকে জিজা নামে এক জৈন ব্যবসায়ীর গড়া কীর্তিস্তম্ভ আছে। ২২ মি উচ্চ এই স্তম্ভটি নানা ভাস্কর্যে অলঙ্কৃত এবং জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথের নামে উৎসর্গীকৃত। রানা কুম্ভ মালোয়ার সুলতান মামুদকে হারিয়ে চিতোর পুনরুদ্ধারের পর এই জয়ের স্মৃতিস্বরূপ একটি জয়স্তম্ভ গড়ে তোলেন। এই স্তম্ভ ১৪ মি বর্গাকার, ৩ মি উঁচু বেদীতে স্থাপিত ৩৭ মি উচ্চ এবং ন'টি তল বিশিষ্ট। একেকটি তলার বেড় ৯ মি। এর গঠনশৈলী ও কারুকাজ ভারি সুন্দর। এতে পৌরানিক আখ্যান যেমন আছে তেমনই রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, আর আরবী ভাষায় খোদিত আল্লার বাণী। এছাড়াও অলঙ্করণে রয়েছে হিন্দু দেবদেবী, হাতি সিংহ ও অন্যান্য বিভিন্ন পশুর মূর্তি প্রভৃতি। ১৫৭টি সিঁড়ি বেয়ে স্তম্ভের ওপরে উঠলে পাখির চোখে পুরো চিতোরগড় দেখে নেওয়া যায়। এখন বন্ধ আছে। বত্রিশ ধাপ উঠে অষ্টম শতকে তৈরি চিতোরেশ্বরী কালীকামাতার মন্দির। কষ্টি পাথরের মূর্তি। মন্দির তৈরির সময় পুজো হত সূর্যদেবের। আকবরের চিতোর আক্রমনের পর, ১৫৬৮ সালে মন্দির সংস্কারের সঙ্গে দেবতার পরিবর্তন। বাইরের দেওয়ালে দেবতা ও দানবদের সমুদ্র মন্থন, সূর্যদেবতার মূর্তি খোদিত আছে। বড়ী ও ত্রিপোলিয়া গেট পেরিয়ে রানাকুম্ভের প্রাসাদ। যদিও অষ্টম শতকে এটির নির্মাণ করেন বাপ্পাদিত্য, পরে ১৪৩৩ সালে। রাজপুত স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন এই প্রাসাদ। হাতি, ঘোড়ার আস্তাবল ছাড়া শিব মন্দিরও আছে। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর, নও লক্ষা ভান্ডার ও মিউজিয়াম রয়েছে।
কেল্লার উত্তরে ১৫৩০ সালে পাথরে তৈরি, রত্নেশ্বর লেকের পাড়ে, রানা রতন সিং-এর প্রাসাদ। মিউজিয়াম লাগোয়া ১৪৪৮ সালে তৈরি রানা কুম্ভ-র তৈরি কুম্ভশ্যামজীর মন্দির। দেবতা বরাহ অবতাররূপী বিষ্ণু। মন্দিরটি কারুকার্যময়, ছাদ অনেকটা পিরামিডের মতো। কাছেই ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি মীরাবাঈ-এর কৃষ্ণমন্দির। দেবতার কোন মূর্তি নেই। নাটমন্দির, জগমোহন ও মূলমন্দির নিয়ে পুরো মন্দির চত্ত্বর। মন্দিরটি যেন কৃষ্ণসাধিকা মীরাবাঈ-এর সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১২ শতকে তৈরি জৈন মন্দির শৃঙ্গার চৌরি-র কারুকার্যও খুব সুন্দর। দেবতা ১৬ তম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথ।
যাওয়াঃ- শহর থেকে ২১১ কিমি দূরে মহারানা প্রতাপ বিমানবন্দর। দিল্লি, মুম্বই, জয়পুর ও যোধপুর থেকে প্রতিদিন উড়ান পৌঁছচ্ছে উদয়পুরে। বিমানবন্দর থেকে শহর যাতায়াতের ট্যাক্সি মেলে। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৪ কিমি দূরে রেলস্টেশন। দিল্লি, জয়পুর, আমেদাবাদ থেকে সরাসরি ট্রেন রয়েছে। মুম্বই থেকে ট্রেন আসছে আমেদাবাদ হয়ে। দিল্লি থেকে মুম্বইয়ের পথে ৮ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর উদয়পুরের অবস্থান। স্থানীয় ঘোরাঘুরির জন্য ট্যাক্সি, অটো আর রিকশা রয়েছে।
থাকা-উদয়পুরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল কাজরী। এছাড়া বেসরকারি হোটেল প্রচুর আছে। উদয়পুরের এস টি ডি কোডঃ ০২৯৪।
উৎসবঃ- শিল্পকলাকে ঘিরে শিল্পীগ্রাম উৎসব বসে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। গাঙ্গৌর উৎসব চলাকালীনই মার্চ-এপ্রিল মাসে দুদিনের মেবার উৎসব (Mewar Festival) পালিত হয়। উৎসবের রঙিন মিছিলে লোকশিল্পীদের সঙ্গে পা মেলায় হাতি, ঘোড়া, উটের দল।
কেনাকাটাঃ- রাজস্থানি রুপোর গয়না কেনার জন্য ভালো জায়গা ক্লক টাওয়ার। এর আশেপাশেই মিলবে রাজস্থানী চুড়ি, লেহরিয়া শাড়ি, ব্লকপ্রিন্টের কাপড় ও অন্যান্য পশরা। হাতিপোলে শাড়ি, রাজস্থানি জুতি, হস্তশিল্প দ্রব্য, কাঠের সামগ্রী, উটের চামড়ার জিনিসপত্র, মিষ্টি ও অন্যান্য নানাকিছু পাওয়া যায়। রাজস্থান এম্পোরিয়াম কাজরি থেকে মিনিয়েচার পেন্টিং কেনা যায়। আর টুকটাক নানাকিছু কিনতে যেতে হবে বাপু বাজার।
যোধপুর(Jodhpur) - ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাঠোর রাজা রাও যোধা যোধপুর শহরের পত্তন করেন। বিখ্যাত মেহরণগড় দুর্গ থেকে শহরের দিকে তাকালে দেখা যায় অধিকাংশ বাড়ির রঙই নীল। তাই 'ব্লু সিটি' নামেও সমধিক পরিচিত এই শহর। রোদ ঝলমলে এই শহরের আর এক নাম 'সান সিটি'। শহরের সংকীর্ণ গলিঘুঁজি, গোলকধাঁধা, বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টার পর ঘন্টা নিমেষে কেটে যায় মুগ্ধতার আবেশে।
শহর থেকে ৫কিমি দূরে ১৫০ মি উচুঁ টিলার মাথায় যোধপুরের প্রধান আকর্ষণ মেহরণগড় (Mehrangarh)। রাজস্থানের দুর্গগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাও যোধা এই দুর্গের পত্তন করেন। মেহরণগড়ের দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রাচীর শহরকে কেল্লা থেকে আলাদা করেছে। কোথাও গোল কোথাওবা চারকোনা গম্বুজ রয়েছে দুর্গ প্রাচীরের গায়ে। দুর্গে ঢোকার সাতটি পোল রয়েছে – ফতে পোল বা গেটওয়ে অফ ভিকট্রি মুঘলদের যুদ্ধে পরাজিত করবার স্মারকরূপে গড়ে তোলা হয়েছিল, গোপাল পোল, ভৈরোঁ পোল, টোটি পোল, দোধকাংড়া পোল, ১৮০৬-এ মহারাজ মানসিংহের তৈরি বিজয়স্মারক স্বরূপ নির্মিত জয় পোল,সূরয পোল ইত্যাদি। প্রাসাদ,সৈন্যাবাস, মন্দির, ঘরবাড়ি নিয়ে একসময় জমজমাট এই দুর্গ মুঘলদের কাছেও অজেয় ছিল। মহলের পর মহল রাজকীয় বৈবভ আর নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। মোতিমহল বা দেওয়ান-ই-আম-এ শ্বেতপাথরের করোনেসন থ্রোন। মহারাজা অভয় সিংহের তৈরি ৮০ কেজি সোনার সুন্দর কারুকার্য্যময় ফুলমহল বা দরবার হলের যেদিকেই চোখ যায় সোনালী কারুকাজ। সোনালী রঙের থাম, খিলানে আর ছাদে সোনালী নকসা কাটা ফুল। শিলেখানায় রয়েছে রণসাজ ও অস্ত্রশস্ত্রের প্রদর্শনী, প্রচুর ছবি। আর রয়েছে সাড়ে সতেরো কিলো ওজনের তালা,কিংখাবে মোড়া নানা রকম হাওদা, দোলনা ইত্যাদি। জেনানা মহল বা রাজার হারেমে জাফরির অভিনবত্ব, চন্দনকাঠের সিলিং, আয়নাখচিত দেওয়াল নজর কাড়ে। র্যামপার্টে রয়েছে কামানের সংগ্রহ। দুর্গের মিউজিয়ামে মিনিয়েচার পেন্টিং, নানান বাদ্যযন্ত্র, আসবাব, শিল্পসামগ্রী, রাজা-রাজড়াদের পোশাক, কারুকার্য করা হাওদা ইত্যাদি সাজানো রয়েছে। দুর্গের ভেতরে দুটি তালাও – রানী সাগর ও গুলাব সাগর। মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেল্লার আরাধ্যা দেবী চামুন্ডার মন্দির। যোধপুরের রাজবংশের সঙ্গে মিত্রতাও গড়ে উঠেছিল মুঘলদের। আকবরের প্রধানা মহিষী যোধাবাঈ ছিলেন উদয়পুরের রাজকন্যা, রাও উদয়সিংহের ভগ্নি। উদয়সিংহ জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দেন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে উদয় সিংহকে রাজা খেতাব দেন সম্রাট আকবর। দুর্গের পাদদেশে যশবন্ত থাডা। ১৮৯৯ সালে মহারাজা দ্বিতীয় যশোবন্ত সিংহের স্মৃতি রক্ষার্থে শ্বেতপাথরের এই স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। রাঠোরের অতীত রানাদের প্রতিকৃতি রয়েছে অভ্যন্তরে।
ঔপনিবেশিক ও ভারতীয় স্থাপত্যবিদ্যার অপরূপ মেলবন্ধনের সাক্ষী উমেদভবন প্যালেস (Umaid bhawan Palace)। যোধপুর শহরের একপ্রান্তে ইতালীয় শৈলীতে গোলাপী মার্বেল পাথর আর লাল বেলে পাথরের প্রাসাদ উমেদ ভবন। এটি অবশ্য তেমন প্রাচীন নয়। এর নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালে। যোধপুরের মহারাজা যশোবন্ত উমেদ সিংহ বাগানঘেরা ৩৪৭ ঘরের সুউচ্চ এই প্রাসাদটি নির্মান করান। প্রাসাদের একাংশে আজও রাজপরিবারের সদস্যরা বসবাস করেন। অন্য একটি অংশ এখন এক অভিজাত হেরিটেজ হোটেল। বাকি অংশে রয়েছে মিউজিয়াম ও আর্ট গ্যালারি। এখানে আছে সোনায় মোড়া পৌরানিক আখ্যান চিত্রিত দেওয়ানি খাস, দেওয়ানি আম, থ্রোন রুম, পাঠাগার ভবন, মহারাজ উমেদ সিং-এর বিমান, নানারকম অস্ত্রশস্ত্র আর বিচিত্র সব ঘড়ি – আংটিতে ঘড়ি, টিকলিতে ঘড়ি, ঘড়ির আওয়াজে পাখির গান এমন নানারকম।
লঙ্কার রাজা রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর দেশ ছিল নাকি মন্দোর বা মান্ডোর। এখানে সুসজ্জিত উদ্যানে লাল বেলে পাথরের সুন্দর ভাস্কর্যের ছত্তিশ বা মন্দির আছে। মিউজিয়াম ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ১৮ শতকে একটি মাত্র পাথর কুঁদে তৈরি ৩৩ কোটি দেবদেবী শোভিত 'হল অফ হিরোজ'।
যোধপুর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মন্দিরময় মরুশহর ওশিয়াঁ। জিপ বা উটে ডেজার্ট সাফারি করা যায়। এখানে মাতাজির মন্দির আছে, মা দুর্গারই আরেক রূপ। দুর-দুরান্তর থেকে মহিলারা সন্তান কামনায় এখানে পুজো দিতে আসেন। এছাড়া ষোলটি সুন্দর স্থাপত্য শিল্পের জৈন মন্দির রয়েছে।
যাওয়াঃ- শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫কিমি দূরে বিমানবন্দর। দিল্লি, উদয়পুর ও মুম্বই থেকে সরাসরি উড়ান আছে। বিমানবন্দর থেকে শহর যাতায়াতের জন্য ট্যাক্সি ও অটো পাওয়া যাবে। দেশের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোধপুরের রেল যোগাযোগ রয়েছে। দেশের অন্যান্য জায়গার সঙ্গে যোধপুরের সড়ক যোগাযোগ খুবই ভালো। ৬৫ নম্বর জাতীয় সড়ক হরিয়ানা ও গুজরাটের সঙ্গে যোধপুরকে যুক্ত করেছে। স্থানীয় ঘোরাঘুরির জন্য ট্যাক্সি, অটো আর রিকশা পাওয়া যাবে।
থাকা- যোধপুরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল ঘুমার। এছাড়া বেসরকারি হোটেল আছে। যোধপুরের এস টি ডি কোডঃ ০২৯১।
উৎসবঃ- প্রতিবছর অক্টোবরে মাড়োয়ার উৎসব (Marwar Festival) জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। পূর্ণিমা রাতে মাণ্ডঘরানার লোকশিল্পীদের সংগীতে অতীতের উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। মেহেরনগড় দুর্গে রাজস্থান আন্তর্জাতিক লোক উৎসবের আসরও বসে এই অক্টোবর মাসেই । রাজস্থানি লোকগান থেকে আধুনিক জ্যাজ সব স্বাদেরই সংগীত এই আসরে পরিবেশিত হয়।
কেনাকাটাঃ- রাজস্থানি হস্তশিল্পের অন্যতম কেন্দ্র যোধপুর। বান্ধনি পোশাক, শাড়ি-ঘাঘরা, মিনিয়েচার পেন্টিং, অলংকার, ধাতব গহনা, উটের চামড়ার জুতো, কাঠের আসবাব আর অ্যান্টিক হল কেনাকাটার প্রধান আকর্ষণ। ত্রিপোলিয়া বাজার, সর্দার মার্কেট, সর্ফা বাজার, স্টেশন গেট, স্টেশন রোড, নয়া সড়ক ও প্রতাপনগর কেনাকাটার জন্য ভালো জায়গা।
রণকপুর - এখানে জনবসতি নেই। আছে শুধু ১২ থেকে ১৫ শতকে তৈরি জৈন মন্দিরগুলি - সবই যেন একেকটি শ্বেতপাথরের কাব্য! মন্দির আছে আদিনাথের, নেমিনাথের ও পার্শ্বনাথের। আদিনাথের মন্দির বিশেষ উল্লেখযোগ্য – শিল্প সুষমায় উজ্জ্বল চারটি প্রবেশপথ প্রথমেই নজরে পড়ে। সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত ১৪৪৪টি স্তম্ভ আর মন্দিরগাত্রের অপরূপ ভাস্কর্যশৈলী। এছাড়া সূর্যনারায়ণ ও অম্বামাতার মন্দির রয়েছে। চারপাশে প্রচুর হনুমান আর ময়ূর নজরে পড়বে।
যাওয়াঃ- আজমের-আবু রোড রেলপথে যোধপুর থেকে ১৬০ কিমি দূরে রণকপুর। রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাসও মেলে।
থাকা- রণকপুরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল শিল্পী বাসস্ট্যান্ডের কাছে। এছাড়া বেসরকারি হোটেল ও জৈন ধর্মশালা আছে।
বিকানীর - বিকানী্র শহরের ঠিক মাঝখানে জুনাগড় দুর্গ। ১৫৮৭-১৫৯৩ খ্রীস্টাব্দে আকবরের প্রাক্তন সেনাপতি রায়সিং লাল ও গোলাপি বেলেপাথরে এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। বর্গাকার এই দুর্গ ৩০ ফুট গভীর পরিখায় ঘেরা। মূল প্রবেশপথ সূরয পোল। দুর্গ চত্ত্বরের ভিতরে অজস্র দ্রষ্টব্য - লাল নিবাস, চন্দ্রমহল, ফুলমহলের রঙিন কাঁচের কারুকার্য, ইতালীয় মোজাইক, জাফরির অপূর্ব কাজ, বাদলমহল, বর্ণাঢ্য সূর্যনিবাস বা দরবার হল, গঙ্গানিবাস, দুর্গানিবাস, মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকে যুদ্ধে হারানোর স্মারক করণমহল, শিশমহল, ছত্তরমহল, বিজলিমহল, রাজপরিবারের গৃহদেবতা শিবঠাকুরের মন্দির,হাজারি দরোয়াজা, মিউজিয়াম,মিনিয়েচার পেন্টিং,চিনি বুরুজ বা সবুজ-সাদা রঙের চিনা টাওয়ার ইত্যাদি।
দুর্গের কাছে গঙ্গা গোল্ডেন জুবিলি মিউজিয়ামে রয়েছে গুপ্ত রাজাদের সময়কার টেরাকোটার কাজ,প্রাক্ হরপ্পাকালের নানান সংগ্রহ,রাজা রাজসিংহকে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের দেওয়া নজরানা সিল্কের পোষাক,সাদা মার্বেল পাথরের অপরূপ সুন্দর দেবী সরস্বতীর মূর্তি,রাজকীয় আবরণ-আভরণ,অস্ত্র-শস্ত্র, প্রচুর মূর্তি ও ছবি।
শহর থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে মহারাজ গঙ্গা সিং তাঁর পিতা মহারাজ লালসিং-এর স্মারকরূপে,স্যার স্যুইনটন জ্যাকবের নক্সায়,গেরুয়া রঙের বেলেপাথরে লালগড় প্রাসাদ তৈরি করেন। প্রাসাদের স্থাপত্যে পাশ্চাত্যের শিল্প জৌলুসের সঙ্গে মিশেছে প্রাচ্যের কল্পনার জগত – বেলজিয়ামের ঝাড়লন্ঠন, কাট-গ্লাসের অলঙ্করণ, অপরূপ জালির কাজ, সুন্দর সুন্দর কার্ভিং, নকশাকাটা কারুকার্য, প্রচুর ছবি, স্টাফড্ জীবজন্তু নিয়ে সাজানো প্রাসাদ। প্রাসাদ চত্ত্বরে রয়েছে ফুলবাগান,বিকানির স্টেট রেলওয়ের বগি আর চিড়িয়াখানা। প্রাসাদের এক অংশ এখন বিলাসবহুল হোটেল। অন্য একটি অংশে বাস করেন রাজপরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। দ্বিতলে রয়েছে রাজপরিবারের নানা সংগ্রহ নিয়ে শার্দূল সিং মিউজিয়াম ও অমূল্য দুষ্প্রাপ্য সংস্কৃত বইয়ের অনূপ লাইব্রেরি।
রাজস্থানের হাভেলিগুলি অতীতের বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের তৈরি। সরু গলিতে চার-পাঁচতলা বিশেষ ধরণের বাড়ি। পাথরের জাফরিতে,ঝুলন্ত জানলায়,খিলানে দক্ষ শিল্পীর হাতের কাজ। এই বাড়িগুলো নাকি গরমে ঠাণ্ডা আর শীতে গরম থাকে। বিকানীরে উল্লেখযোগ্য রামপুরিয়া হাভেলি।
শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ১৪ শতকের তৈরি জৈন মন্দির কমপ্লেক্স। মন্দির নির্মাতা দুই ভাইয়ের নাম ভাণ্ডেশ্বর আর ষ্ণডেশ্বর। ভাণ্ডেশ্বরের মন্দির সাজানো কাচ আর ফ্রেস্কোর কাজে আর ষণ্ডেশ্বরের বৈশিষ্ট্য এনামেল আর সোনায় মোড়া কারুকার্য। লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরটিও বেশ বড় আর সুন্দর।
৩২ কিলোমিটার দূরে কর্ণি মাতার মন্দির। দেবী দুর্গারই এক রূপ এই কর্ণিমাতা। ছ'শো বছরের প্রাচীন বেশ বড় মন্দির। ১৭ শতকে তৈরি মন্দিরটির চুড়ায় সোনার ছাতা। বিশাল গেটে রুপোর পাতে সূক্ষ্ম কারুকাজ। মন্দিরের মার্বেলের কারুকার্যও দেখার মত। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল বিরাট চত্ত্বরে অনেক ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে,এরা দেবীর কাছে উৎসর্গীকৃত,গায়ে চড়লে পুন্য কিন্তু পায়ের চাপে মরে গেলেই পাপ,তাই খুব সাবধানে হাঁটতে হবে। ইঁদুরকে দুধ খাওয়ানোও এখানে পুন্যের কাজ।
অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে শহর থেকে ৮ কিমি দক্ষিণে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার বৃহত্তম (২০০০ একর) ক্যামেল ব্রিডিং ফার্ম। এখানে উট প্রজনন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য নানা রকম ব্যবস্থা আছে। রাজস্থানে উট মুখ্যতঃ চার প্রজাতির – বিকানেরী,জয়সলমেরী,মেয়ারী ও কচ্ছি। ৮ কিমি পশ্চিমে বিকানীর শাসকদের সমাধিক্ষেত্র দেবীকুণ্ড সাগর। শ্বে্তমর্মরে গড়া ছত্তিশগুলি অনবদ্য।
বিকানির থেকে জয়সলমির যাওয়ার পথে ৩১ কিমি দূরে মহারাজা গঙ্গা সিং-এর নির্মিত গজনের প্রাসাদ। প্রাসাদের এক অংশ এখন মিউজিয়াম, অন্য এক অংশে হোটেল গড়ে উঠেছে। কৃ্ত্রিম লেককে ঘিরে গজনের ওয়াল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিটি গড়ে উঠেছে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন বিকানীর জংশন। বিকানীর থেকে পোখরান ২১৯ কিমি, জয়সলমীর ৩৩০ কিমি, যোধপুর ২৪৫ কিমি, জয়পুর ৩২১ কিমি দূরে।
থাকা- বিকানিরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল ধোলা মারু, যাত্রিকা, দেশনক। এছাড়া বেসরকারি হোটেল আছে। জয়সলমিরের এস টি ডি কোডঃ ৩৩৪০০১।
কেনাকাটাঃ- হাতে ছাপা কটন টেক্সটাইল, ফ্রেস্কোশিল্প, উটের চামড়ার জুতো, পার্স, কুশন সংগ্রহে রাখা যায়। মহাত্মা গান্ধী রোড বা স্টেশন রোডে প্রচুর দোকান আছে।
উৎসব – জানুয়ারি মাসের শেষে ক্যামেল ফেস্টিভাল বা 'ঢোলা মারু' এবং হোলির ঠিকপরে গাঙ্গুর এখানকার উল্লেখযোগ্য উৎসব।
জয়সলমির (Jaisalmer) - দিগন্তবিস্তৃত সোনালি বালিয়াড়ি, উটের সারি, 'সোনার কেল্লা' আর স্থানীয় মানুষজন-এইসব নিয়ে জয়সলমিরের আকর্ষণ চিরন্তন। প্রাচীন আভিজাত্যের নীরব সাক্ষী হলুদ বেলেপাথরে গড়া হাভেলি আর প্রাসাদ।
শহরের প্রধান আকর্ষণ হলুদ বেলেপাথরের 'সোনার কেল্লা'। প্রায় ৮০০ বছর আগে যাদব বংশীয় ভাটি রাজপুত রাজা রাওয়াল জয়সওয়াল মরুভূমির মধ্যে অনুচ্চ ত্রিকুট পাহাড়ের মাথায় এই দুর্গটি গড়েন। দৈর্ঘে প্রায় ৪৬০ মি, প্রস্থে ২৩০ মি। প্রাচীনত্বে্র দিক দিয়ে চিতোরের পরেই এর স্থান। বৃত্তাকার প্রাচীর ঘেরা এই দুর্গে মোট ৯৯ টি বুরুজ আছে। দুর্গের চারটি প্রধান প্রবেশদ্বার-অক্ষয় পোল, সূরয পোল, গণেশ পোল ও হাওয়া পোল। প্রথমেই পাঁচ মহলা, সাত তলা মহরাওয়াল বা সিটি প্রাসাদ। জুনা মহলের জালির কাজ খুব সুন্দর। সাধাসিধে জেনানা মহলের পর চৌহাটা পেরিয়ে মর্দানা মহল। হাওয়া পোলের ওপরে আছে কাচ ও ম্যুরাল চিত্রে ভরা রঙমহল। সর্বোত্তম বিলাস-এ নীল টালি আর মোজাইকের সুন্দর কাজ। পাশেই গজবিলাসে পাথরের সুন্দর অলঙ্করণে মোতি মহল। সামনে আম দরবার। আর এক আকর্ষণ মহারাজ বারিসালের গড়া বাদলবিলাস বা মেঘ দরবার বা টাওয়ার অফ ক্লাউডস্। এর শীর্ষে মুঘল স্থাপত্যের তাজিয়া মিনার আছে। দেওয়ান-ই-আম-এর পাথরের সিংহাসনও অনবদ্য। কাছেই নারায়ণ ও শক্তি স্তম্ভ আছে।
দুর্গের প্রাসাদে মিউজিয়াম আছে। কেল্লা শহরকে দুটো ভাগে ভাগ করেছে। কেল্লার প্রাচীরের চার দেওয়ালের মধ্যেই শহরের এক চতুর্থাংশ নাগরিকের বাস। দুর্গচত্বরে রয়েছে দ্বাদশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে তৈরি সাতটি জৈনমন্দির।
মরুশহর জয়সলমিরে জলসরবরাহের জন্য ত্রিকূট পাহাড়ের নীচে বালি খুঁড়ে জলাশয় তৈরি করান মহারাজ গড়সি সিং। রাজার নামেই জলাশয়ের নামকরণ হয় গদিসর (Gadisar Lake)। দিঘিকে বেড় দিয়ে রয়েছে মন্দিরের সারি। ১১৫৬ সালে এই মন্দিরগুলি তৈরি হলেও ১৩৬৭ সালে মহারাজ গড়সি সিং মন্দির গুলির পুননির্মাণ করান। শীতের দিনে লেকের জলে দেখা মিলবে নানা প্রজাতির পাখিরও। গদিসর লেকের প্রবেশ পথেই রয়েছে ফোক-লোর মিউজিয়াম (Folk-lore Museum)। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থা-ও রয়েছে।
শহর থেকে ৫ কিমি দূরে বাগানঘেরা অমর সাগর। দিঘির পাড়ে কারুকার্যময় জৈনমন্দির। ৮ কিমি দূরে মরুভূমির বুকে উদ্যান, সবুজ গাছগাছালি আর ফুলে ঘেরা রাজপরিবারের বিশ্রামস্থল মূল সাগর। জয়সলমির থেকে ৬কিমি উত্তরে বালিয়াড়ির মধ্যে মরূদ্যান বড়াবাগ। ফল বাগিচায় ঘেরা কৃত্রিম জলাশয়। বালিয়াড়ির মাথায় জয়সওয়াল পরিবারের একাধিক সমাধিসৌধ রয়েছে।
জয়সলমিরের অন্যতম আকর্ষণ অতীতের স্মৃতি ঘেরা পাথরের হাভেলিগুলি। পাথর কুঁদে তৈরি সূক্ষ্ম জাফরির এই কারুকার্য রাজস্থানি শিল্পকলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। দুর্গ থেকে বেরিয়ে শহরের পথে চলতে চলতে দেখা মিলবে একেকটা হাভেলি। এরমধ্যে ঝরোখা সমৃদ্ধ ভাস্কর্যময় সোনালি পাথরের পাঁচতলা উঁচু পাটোয়াঁ-কি-হাভেলির জাফরির উৎকর্ষ অতুলনীয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি জয়সলমিরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান নাথমলজি-কি-হাভেলি দুই শিল্পী ভাইয়ের দক্ষতার অনবদ্য নিদর্শন। নকশাকাটা প্রবেশপথের মুখে পাথরের দুই হাতি। ঝরোখা-জালির কারুকার্যময় এই হাভেলির কক্ষগুলির দেওয়াল অপূর্ব রাজস্থানি মিনিয়েচার শিল্পকলায় অলংকৃত। অজস্র ঝরোখা শোভিত, আর্চবিশিষ্ট সেলিম সিং কি হাভেলির গঠনশৈলিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাফরির কাজেও অভিনবত্ব আছে।
জয়সলমির থেকে ৪৫কিমি দূরে মরুগ্রাম খুরি (Khuri Village)। খুরির বালিয়াড়ি, আলপনা আঁকা গ্রামের বাড়িঘর, হস্তশিল্পীদের বাসস্থান ভারি সুন্দর। খুরি থেকে আরও ১৬কিমি দূরে ডেজার্ট ন্যাশনাল পার্ক(Desert National Park)। মরুভূমির গাছপালা আর প্রাণীদের আবাস এই রুক্ষ প্রান্তর। জয়সলমির থেকে ৭৫কিমি দূরে সুদশ্রী ফরেস্ট পার্ক -মরুভূমির প্রাণীজগৎ দেখার আর এক ঠিকানা। পার্কে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয় জয়সলমির থেকেই।
জয়সলমিরের ৪০ কিমি পশ্চিমে সাম বালিয়াড়ি (Sam Dunes)। থর মরুভূমির দিগন্তবিস্তৃত বালিয়াড়ি আর টিলার সারি। ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণিমায় মরু উৎসবে এখানে লোক সংস্কৃতির আসর বসে। সাম থেকে ক্যামেল সাফারিতে মরুভ্রমণ করা যায়। জিপ বা গাড়ির ব্যবস্থাও রয়েছে। সকাল বা বিকেলের ট্রিপের জন্য ট্যুরিস্ট রিসেপশন সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে। অসাধারণ একটা সূর্যাস্ত দেখতে বৈকালিক সফরই বেশি আকর্ষণীয়। স্থানীয় গ্রামে বেড়াতেও খুব ভালো লাগবে। জয়সলমির থেকে ১৭কিমি দূরে আকাল-এ টিলার পাথরের গায়ে রয়েছে ১৮কোটি বছরের প্রাচীন বৃক্ষের ফসিল। মরুশহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের কাছে তানোটে তানোটমাতার মন্দির।
উটের পিঠে চড়ে মরুসফর-সেও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। স্থানীয় বিভিন্ন এজেন্সিই 'ক্যামেল সাফারি'-র ব্যবস্থা করে দেন। ভাড়ার মধ্যে খাওয়া খরচ ও গাইড খরচ ধরা থাকে। বেশি সময়ের সাফারিতে ক্যাম্পিং খরচও দিতে হবে। মরুসফরেই দেখে নেওয়া যায় প্রাচীন রাজধানী লোধুর্বা, হেরিটেজ ভিলেজ কুলদেহরার মতো দ্রষ্টব্যগুলি।
যাওয়াঃ- রাজস্থানের অন্যান্য অংশের চেয়ে জয়সলমির খানিক দূরে হলেও এখানে আসা কিন্তু বেশ সহজই। অনিয়মিত বিমানবন্দরটি শহর থেকে ৫কিমি দূরে। জয়পুর ও যোধপুর থেকে উড়ান রয়েছে। দিল্লি এবং যোধপুর থেকে ট্রেনে সরাসরি জয়সলমির যাওয়া যায়। সবচেয়ে কাছের বড় শহর যোধপুর ২৮৫কিমি দূরে। উদয়পুর, জয়পুর ও দিল্লি থেকে দুরত্ব যথাক্রমে ৫৪৫কিমি, ৬২১কিমি এবং ৮৮২কিমি।
থাকা- জয়সলমিরে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল মুমল ও সাম বালিয়াড়িতে আরেকটি হোটেল সামধানি। টেন্টেও থাকা যায়। এছাড়া বেসরকারি হোটেল আছে। জয়সলমিরের এস টি ডি কোডঃ ০২৯৯২।
কেনাকাটাঃ- উটের চামড়ার জিনিসপত্র, রুপোর অলংকার, পাথর খোদাই প্যানেল, রঙিন কম্বল, কাচ বসানো রং-বেরঙের ঘাঘরা-উড়নি-শাড়ি-চুড়িদার এমন নানা সওদা মিলবে। কেনাকাটার জন্য ভালো জায়গা মানকচক,গান্ধীচক, সদর বাজার সোনারোঁকা বাস আর সরকারি এম্পোরিয়াম।
মাউন্ট আবু (Mount Abu)- রাজস্থানের একমাত্র হিল স্টেশন মাউন্ট আবু। এর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ গুরুশিখরের উচ্চতা মাত্র ৫৬৭৬ ফুট হলেও মরুভূমির অন্দরে একমাত্র হিল স্টেশন হিসেবে এর পর্যটক আকর্ষণ অপরিসীম। এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। তীর্থস্থান হিসেবেও মাউন্ট আবু যথেষ্ট পরিচিত।
মাউন্ট আবুকে ঘিরে নানা গল্পকথা ছড়িয়ে আছে। শোনা যায়, প্রাচীনকালে এখানেই ছিল মুনি-ঋষিদের সাধনাস্থল। এই আবু পাহাড়েই হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর বাসভূমি ছিল বলে কিংবদন্তি রয়েছে। পুরাকালে কোনও এক সংকটের সময় ঋষি বশিষ্ঠ এখানে যজ্ঞ করেন। সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে উঠে আসা ৩৬টি উপজাতির রাজপুত সেনা বিপদ থেকে রক্ষা করেন সকলকে। গোমুখ ঝরনার কাছে সেই যজ্ঞস্থল। গোরুর মুখাকৃতি পাথর থেকে নেমে এসেছে এই ঝরনা, বয়ে চলেছে গোমুখ মন্দিরের পাশ দিয়ে। গোমুখ মন্দিরের পিছনে অর্বুদা সর্পমন্দির। এই সাপটিই শিবের ষাঁড় নন্দীকে একবার বাঁচিয়েছিল। নন্দীর এক বিশাল মার্বেলের মূর্তিও রয়েছে এখানে।
শোনা যায়, অর্বুদা থেকেই 'আবু' নামের উৎপত্তি। অন্যমতে, হিমালয়ের পুত্র 'আবু' বা 'আর-বুদা' অর্থাৎ 'জ্ঞানের পাহাড়'। পরবর্তীকালে মেবারের মহারাজ রানা কুম্ভ পাহাড় দখল করে দুর্গ বানিয়ে এই অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ শতকে মাউন্ট আবু জৈন ধর্মের এক অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর পরের দুই শতাব্দীতে এখানে অসাধারণ কয়েকটি জৈন মন্দির তৈরি হয়।
মন্দিরের দেশ আবু। আর সবচেয়ে সুন্দর জৈন মন্দিরগুলি। শহর থেকে ৫ কিমি দূরে আবুর অন্যতম আকর্ষণ পাহাড়ের বুকে শ্বেতপাথরের অপরূপ সৃষ্টি দিলওয়ারা মন্দির (Dilwara Temple)। মোট পাঁচটি মন্দির – আদিনাথ, নেমিনাথ, মহাবীর, ঋষভদেব ও পার্শ্বনাথ। ১১ থেকে ১৩ শতকের মধ্যে গড়ে ওঠা এই মন্দিরগুলির স্থাপত্য কৌশল ও অপরূপ সৌন্দর্য তাজমহলের সঙ্গে তুলনীয়। দিলওয়ারা মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতম বিমল বাসাহি মন্দির। গুজরাতের প্রথম সোলাঙ্কি রাজা ভীম দেবের মন্ত্রী বিমল শাহ ১০৩১ সালে ১৮ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে,১৫০০ শিল্পী ও ১২০০ শ্রমিকের শ্রমে ১৪ বছর ধরে গড়ে তোলেন বিমল বাসাহি। এই মন্দিরে প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের সূক্ষ্ম অলঙ্করণে আছে হাতির যূথ সারি, ফলমূল, জীবজন্তু শোভিত অষ্টভূজাকার গম্বুজ, আটচল্লিশটি থামসহ অলিন্দের স্থাপত্য, দেবদেবীর মূর্তি সম্বলিত ৫২ টি কুঠুরি, শ্বে্তপাথরের কার্ভিং ও সিলিং-এর সুন্দর ও সূক্ষ্ম কারুকার্য। গুজরাতরাজ বীর ধাওয়ানের সময় ১২৩০ সালে তাঁর দুই মন্ত্রী বাস্তুপাল ও তেজপাল আদিনাথ মন্দিরের উত্তরে দুটি মন্দির – লুনা বাসাহি ও তেজপাল মন্দির তৈরি করান ১২ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে। লুনা বাসাহিতেও শ্বে্তপাথরের সুন্দর ভাস্কর্য্যমন্ডিত স্তম্ভ, ঝালর, নাচের মুদ্রা, যেন জল থেকে তুলে আনা পদ্ম,তোরণ,চেন,জীন আখ্যান,রাজকীয় মিছিল – দক্ষ শিল্পীদের করা অপূর্ব সুন্দর কাজ। এখানে রয়েছেন ২২ তম জৈন তীর্থঙ্কর নেমিনাথ। মূল মন্দিরের দুপাশে দেওরাণী-জেঠাণী মন্দিরের কারুকার্যেও নূতনত্ব আছে। লুনা বাসাহির বিশেষ আকর্ষণ রঙ্গমন্ডপ। ষোলটি দেবদেবীর মূর্তি,গম্বুজের চারপাশে বাহাত্তর জন তির্থঙ্কর সহ তিনশ ষাট জন জৈন সন্ন্যাসীর মূর্তি আছে। শোনা যায়, খোদিত পাথরের সমপরিমাণ সোনা ও রুপো পেয়েছিলেন শিল্পীরা।
শহর থেকে ৩ কিমি দূরে অধরাদেবীর মন্দির। বিশাল এক পাহাড় কেটে মন্দিরটি তৈরি। ৩৬০ ধাপ খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরে পৌঁছতে হয়। দেবী এখানে পূজিত হন দুর্গারূপে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে পাহাড় ঘেরা কৃত্রিম লেক নাক্কি। পাশেই টোডরক। প্রবাদ, রাক্ষসদের অত্যাচারে জর্জরিত দেবতারা ব্রহ্মার পরামর্শে আবু পাহাড়ে আসেন যজ্ঞ করতে। যজ্ঞের জলের জন্য দেবতারা নখ দিয়ে এই লেক খনন করেন। তার থেকেই নাম নাক্কি লেক। লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। লেকের কাছেই ১৪ শতকের তৈরি রঘুনাথজির মন্দির।
আরাবল্লি পর্বতে দুর্ভেদ্য কেল্লা অচলগড় নির্মাণ করান রানা কুম্ভ। দুর্গে ১৫ শতকের এক শিবমন্দির সহ বহু প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। ভেঙ্গে পড়া দুর্গের নীচে ৮১৩ শতকে তৈরি অচলেশ্বর মন্দির। এখানে শিবের প্রতিভূ পাথরের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। দেওয়ালে পার্বতী ও গণেশ মূর্তি আছে। ধাতুর তৈরি নন্দীমূর্তিও রয়েছে। পাশের মন্দিরে অধিষ্ঠান করছেন দশাবতাররূপী বিষ্ণু। দুর্গ থেকে ৩ কিমি দূরে রাজস্থানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ (৫৬৭৬ ফুট) গুরুশিখর। মীরা আর চামুণ্ডি মন্দির রয়েছে এখানে। হানিমুন পয়েন্ট ও সানসেট পয়েন্ট থেকে প্যানোরামিক ভিউ অপূর্ব
শহর থেকে ৫ কিমি দূরে ট্রেভর'স ট্যাঙ্ক লেক। নির্মাতা ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের নামেই নাম। পিকনিক করার জন্য খুব ভালো। এখানে পায়রা, ময়ূর ও আরও নানারকম পাখির দেখা মিলবে।
যাওয়াঃ- নিকটতম বিমানবন্দর ১৮৫ কিমি দূরবর্তী উদয়পুর। উদয়পুর থেকে যাতায়াতের জন্য বাস ও ট্যাক্সি পাওয়া যায়। রেলস্টেশন আবু রোড ২৮ কিমি দূরে। জয়পুর, যোধপুর, উদয়পুর ও আমেদাবাদ থেকে সরাসরি ট্রেন আছে। উদয়পুর (১৮৫ কিমি), যোধপুর (২৬৭ কিমি), জয়পুর (৪৯০ কিমি)। আমেদাবাদ (২৫০ কিমি) এবং দিল্লি (৭৫২ কিমি)-এর সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে। স্থানীয় ঘোরাঘুরির জন্য ট্যাক্সি, অটো ও টাঙ্গা পাওয়া যাবে। ঘোড়ায় সওয়ার হয়েও ঘুরে নিতে পারেন। তবে যেকোনও হিল স্টেশনের মতোই নিজের পায়ে ঘুরে বেড়ানোর মজাই সবচেয়ে বেশি।
থাকা- মাউন্ট আবুতে রাজস্থান পর্যটন দপ্তরের হোটেল শিখর। এছাড়া বেশকিছু বেসরকারি হোটেল আছে। মাউন্ট আবুর এস টি ডি কোডঃ ০২৯৭৪।
উৎসবঃ- গরমের সময় লোকনৃত্যগীতের তিনদিনব্যাপী জমজমাট আসর বসে। নাচেগানে মুখর হয়ে ওঠে আবু পাহাড়।
কেনাকাটাঃ- জুয়েলারি ও অন্যান্য স্মারক কেনার ভালো জায়গা রাজস্থান এম্পোরিয়ামে।
ভ্রমণ কাহিনি – || রঙবাহারি রাজস্থান || ইতিহাসের মেবারে || সোনায় মোড়া দেশ || রাজ কাহিনি ||