দেবতাদের রাজ্যে দুর্যোগে
দেবাশিস বসু
কিন্নরের তথ্য ~ কিন্নরের আরও ছবি ~ লাহুল-স্পিতির আরও ছবি
সুন্দর ঝকঝকে সকাল। চারদিকে সাদা বরফ শরীরে মেখে হিমালয় পর্বতশ্রেণী, যেন, স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব বিরাজমান। নীচে দীর্ঘ ঝাউয়ের সারি - মহাদেবের ভক্তদল। আরও নীচে ছড়ানো ছিটানো আপেল গাছ, যেন, শিশুরা খেলা করছে। দক্ষিণ-পূর্বে ৬০৫০ মিটার উঁচু বিখ্যাত কিন্নর কৈলাস শিখর দৃশ্যমান। সূর্য সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যার রঙ বদলে বদলে যাচ্ছে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, স্নিগ্ধ প্রশান্ত পরিবেশ।
১২ জুন, ২০১৩। গত পরশু কালকা মেলে সিমলা এসে পৌঁছেছি। সেখান থেকে গতকাল কল্পায়। আমাদের এবারের হিমাচল ভ্রমণ পর্ব শুরুতেই একটু ধাক্কা খেয়েছে। সিমলা পৌঁছে জানতে পারি কুনজুম-লা (গিরিপথ) বন্ধ। তাই আমাদের বেড়ানোর পথটা একটু অদল-বদল করে নিতে হয়েছে। ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল সিমলা থেকে, কল্পা-নাকো-টাবো-কাজা-কিব্বের হয়ে, সাংলা বা রামপুর ফিরে এসে, কুলু-মানালি-কেলং-উদয়পুর-ত্রিলোকিনাথ ঘুরে আবার কালকায় ফিরে কালকা মেল ধরব। এবারে আমরা দলে এক মহিলা সহ মোট সাতজন।
ভ্রমণের শুরুতেই কিন্নর-লাহুল-স্পিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দিয়ে নিই – শুনেছি হিমাচলের এই কিন্নর দেশকে বলা হয়, ধরাধামে ইন্দ্রকানন আর কিন্নরবাসীদের দেবতাদের উত্তরপুরুষ। এখানকার নারী-পুরুষদের গায়ের রঙ ফরসা, সুন্দর মুখশ্রী। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে কুর্তা-পায়জামা ধরণের পোষাক সঙ্গে গরম কোট জাতীয় কিছু এবং মাথায় কিন্নরী টুপি পরেন। ইতিহাস বলে, এঁরা মঙ্গোলীয়, খ্রীস্ট জন্মেরও সহস্র বছর আগে এখানে আসেন। সমাজজীবন গড়ে উঠেছে হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিলনে। সহজ সরল অতিথিপরায়ণ। সঙ্গীত ও নৃত্য এঁদের অতি প্রিয়। শতদ্রু ও স্পিতি দুই মুখ্য নদী, এছাড়াও অন্যান্য ছোট নদী এবং সাংলা-রূপা-লিংটি-পিন ইত্যাদি উপত্যকা নিয়ে কিন্নরদেশ। এখানকার পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে শিবালিক, জাঁসকর প্রভৃতি প্রধান হলেও মুখ্য আকর্ষণ কিন্নর-কৈলাস। লাহুল ও স্পিতির বিশেষ খ্যাতি তার নৈসর্গিক শোভা – বরফ আচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী, গ্লেসিয়ার, লেক, সুদৃশ্য উপত্যকা ও গুম্ফা বা মনাস্ট্রির জন্য। সূর্যের কিরণ যেমন প্রখর, বাতাসও তেমনই কনকনে।
কল্পার থেকে পায়ে পায়ে পৌঁছলাম রোঘি গ্রামে। আশপাশে আপেল গাছের সারি, এখন সবে আপেল ধরেছে। গ্রামে তিব্বতীয় শৈলীতে তৈরি একটি মন্দির ছাড়া অল্পসংখ্যক স্থানীয় মানুষের বাসস্থান রয়েছে। এর আগে যখন সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে এসেছিলাম, তখন, সবুজ পাতার থেকেও বেশি লালচে খয়েরি রঙের বা কোথাও কোথাও হাল্কা সবুজে সাদায় মেশানো টসটসে আপেলে গাছগুলো ভর্তি ছিল। সে এক মনোহর দৃশ্য। ঘুরে নিলাম ৯৫০ থেকে ১০৫৫ খ্রীস্টাব্দে তৈরি হু-বু-লান-কার গুম্ফা আর চিনি বাংলো গুম্ফা। কোন একসময় কল্পার নাম ছিল 'চিনি'।
পরদিন ১৩ জুন সকালে কল্পা থেকে বেরিয়ে নাকো পৌঁছলাম। উইলো ও পপলারে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর লেককে ঘিরে এই গ্রাম। নৈসর্গিক শোভা নয়নাভিরাম। লেকের উত্তরে চারটি বৌদ্ধ মন্দির আছে, যার বিগ্রহ ও ম্যুরাল চিত্র অনবদ্য। প্রাচীন এক গুম্ফাও আছে এখানে। নাকোতে ঘন্টাখানেক থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে টাবোর দিকে রওনা দিলাম। স্পিতি নদীর পাড়ে এই গ্রাম। গ্রামে প্রায় শ'চারেক লোকের বাস। মূল আকর্ষণ ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বৌদ্ধ গুম্ফাটিতে তিব্বতীয় শৈলীতে তৈরি। চমৎকার ফ্রেস্কো, স্টাকো শৈলীর মূর্তি ও বর্ণময় ছবির সম্ভার দেখে মুগ্ধ হতে হয়। একে হিমালয়ের 'অজন্তা'-ও বলা হয়। তিব্বতের 'থোলিং' আর 'হেমিস' গুম্ফার পরেই এর স্থান। রয়েছে ইউনেস্কোর হেরিটেজ সম্মানও। দেওয়ালে বুদ্ধের জীবনকথা তথা জাতক কাহিনি আঁকা। দশ শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা মাটির প্রাচীরে ঘেরা ৬৩০০ বর্গ মিটার ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এই মনাস্ট্রিতে রয়েছে ৯ টি মন্দির, ২৩টি চোর্তেন বা স্তূপ, ৩০টি থাঙ্কা ও সহস্র মুদ্রায় বুদ্ধের মৃন্ময় মূর্তি। আর আছে পালি ও ভোট ভাষার নানা পুঁথি, প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি। গুম্ফার চত্ত্বরে মঠ, বিহার, অ্যাসেম্বলি হল ও দুটি বিদ্যালয়ও আছে। মূল গর্ভগৃহে বুদ্ধের জ্যোতির্ময় ধ্যানমগ্ন বিশালাকার সুন্দর মূর্তি। শেষ বিকেলে টাবো থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ কাজা পৌঁছলাম। স্পিতি নদীর ধারে সাব-ডিভিসনাল শহর কাজা। অতুলনীয় নৈসর্গিক শোভা। ওল্ড কাজায় পুরোনো বসতি, নিউ কাজায় সরকারি অফিস, বাস স্ট্যান্ড, বাজার, হোটেল ইত্যাদি।
১৪ জুন সকালে কাজা থেকে বেরিয়ে ৮ কিলোমিটার দূরে কিব্বের গ্রামে পৌঁছলাম। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যও খুব সুন্দর। জানা গেল, গ্রামের পরে ১,৪০০ বর্গ কিমি ব্যাপী যে স্যাংচুয়ারিটি আছে সেখানে নীল গাই এবং একটি বিশেষ প্রজাতির হরিণ আইবেক্স দেখতে পাওয়া যায়। এখান থেকে ১০ কিমি দূরে গেট্টে গ্রাম, ৪২৭০ মি উচ্চতায়, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বসতি। কিব্বের থেকে বেশ কয়েকটি হাই অল্টিচুড ট্রেকিং রুট রয়েছে।
কিব্বের থেকে বেরিয়ে ১২ কিমি দূরে ক্যাসলরূপী কি গুম্ফায় পৌঁছলাম। স্পিতি নদীর বাঁ পাড়ে, ৪১১৬ মি উচ্চতায় অবস্থিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর আগেকার এই গুম্ফাটি বিভিন্ন সময়ে টুকরো টুকরোভাবে তৈরি হয়েছিল। যার জন্য ঘরগুলো সব বিচিত্র আঁকা-বাঁকা গলি দিয়ে জোড়া। এখানে বহু দুর্লভ থাঙ্কা চিত্র, অতীতের অনেক বাদ্যযন্ত্র, বহু পুরোনো পুঁথি ইত্যাদি সুরক্ষিত আছে। একজন অল্পবয়সী লামা আমাদের লিকার চা খাওয়ালেন। গর্ভগৃহ খুলে খুব সুন্দর, শান্ত সমাহিত বুদ্ধ মূর্তি দেখালেন।
রাতে আবার কল্পায় ফিরে এলাম।
১৫ জুন সকালে কল্পা থেকে বেরিয়ে পথে স্পিলো গ্রামে লাঞ্চ সেরে বিকেল নাগাদ সাংলা পৌঁছলাম। দূরত্ব ৫১ কিমি হলেও রাস্তা খারাপ থাকায় এই দেরি। সন্ধে থেকেই লাগাতার হালকা বৃষ্টি চলল।
১৬ জুন সকালের দিকে আকাশ একটু পরিষ্কার হলেও একটু বেলায় সেই যে বৃষ্টি শুরু হল তার আর থামার নাম নেই, চলল সারা দিন-রাত। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় ধ্বস নামার খবর আসতে লাগল।
১৭ জুন সকাল থেকেই ঝকঝকে নীল আকাশ। অল্পস্বল্প মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বরফ পড়ে পাহাড়ের কালো অংশ সব ঢাকা পড়ে গিয়ে শ্বেতশুভ্র তুষারমণ্ডিত হিমালয়। কিন্তু এদিকে বিদ্যুৎ, বি এস এন এল মোবাইলের সিগনাল কিছুই নেই। একটু বেলা হতেই আবার বৃষ্টি চলল রাত দশটা পর্যন্ত। আমাদের চোখের সামনেই হোটেলের কাছের পাহাড় খানিকটা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল। তবে বৃষ্টির মধ্যেই চলল ধ্বসের পর রাস্তা মেরামতির কাজ। আমাদেরও আশঙ্কা বাড়তে লাগল।
১৮ জুন সকালে বৃষ্টি থেমে আকাশ ঝকঝকে হলেও চা জুটল না। বাজার থেকে চিনি উধাও। ক্রমশ খবর পেলাম মুরগির ডিম, তরিতরকারি আর মোমবাতিও পাওয়া যাচ্ছেনা। দুপুরে খাওয়া ভাত, ডাল, আলুভাতে। বিকেল থেকে আবার রাত দশটা অবধি টানা বৃষ্টি।
১৯ জুন সকালে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার কিন্তু আমাদের মন ভার। ২২ তারিখে ফেরার ট্রেন কীকরে ধরব বুঝতে পারছি না। না ধরতে পারলে নতুন করে রিজার্ভেশন কীকরে পাব কে জানে! ঈশ্বরকে স্মরণ করছি, তিনিই যা করার করবেন। তবু অস্থির হয়ে যাচ্ছি। এদিন আমাদের দলের একজনের জন্মদিন ছিল। তাই কিছুটা সময় একটু আনন্দ করে দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার চেষ্টা করা গেল।
২০ জুন সকাল আটটার পর থেকে দু'তিনবার হেলিকপ্টারের আসা-যাওয়া দেখে, আমাদের মনেও আশার আলো দেখা দিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই এলাকার তহশিলদার অফিসে হেলিকপ্টারে যারা যাবে তাদের নামের তালিকা তৈরি হচ্ছে। ওখানে গিয়ে জানা গেল সব হোটেল থেকেই বোর্ডারদের নামের তালিকা পাঠানো হচ্ছে। হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে পাঠানোর তালিকায় প্রথমে অসুস্থ ব্যক্তিরা, তারপরে ভোটের কাজে যেসব রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা এসেছেন তাঁরা, এরপরে বিদেশি পর্যটকেরা এবং সবশেষে ভারতীয় পর্যটক আর স্থানীয় লোকজনের পালা। কে বা কারা কবে যাবেন, তার খবর হোটেলের ম্যানেজার জানিয়ে দেবেন।
২১ জুন সকাল থেকে প্রকৃতি শান্ত, সুন্দর। পাহাড়ে বরফ গলে অল্পস্বল্প কালো পাথর দেখা যাচ্ছে। শুধু প্রহরবিহীন প্রতীক্ষা। সকালে দু-তিনবার হেলিকপ্টার দেখা গেলেও পরে তা অদৃশ্য হয়ে গেল। জানা গেল রামপুরে মেঘ জমেছে। মেঘ জমে আমাদের মনেও। ভোডাফোনের সিগনালও নেই।
২২জুন। আজও সুন্দর ঝকঝকে সকাল। সাংলা উপত্যকার সৌন্দর্যের এত খ্যাতি কেন, তা বুঝতে পারছি। তবে মনের অবস্থা যা, কোন দৃশ্যই আর মনে ছাপ ফেলছেনা। আজকের তালিকায় আমাদের নাম না থাকলেও একবার হেলিপ্যাড থেকে ঘুরে এলাম। গত দু'দিন ধরেই অনেক পর্যটক পরিবার হেলিপ্যাডে গিয়ে সারাদিন অপেক্ষা করছেন যদি কোন সুযোগ এসে যায়। শুনলাম স্থানীয় স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মীরা এই দুদিন ধরেই হেলিপ্যাডে জমায়েত সবাইকে জলখাবার, চা, ফ্রুট জুস, দুপুরে খিচুড়ি-ডিমভাজা খাইয়েছেন। তাঁদের এই নিঃস্বার্থ সহানুভূতি আর সেবা মন ভরে দিল।
২৩ জুন, সুন্দর সকাল। বেলা এগারটায় সুখবর এল – বিকেল চারটের সময় আমাদের পালা হেলিকপ্টারে। অনেক আগেই হেলিপ্যাডে পৌঁছে গেলাম। মিলিটারি হেলিকপ্টার আমাদের নিয়ে সাংলা ছাড়ল বিকেল ৪.৫২ য়। রামপুর পৌঁছলাম ৫.৩৩-এ। আক্ষরিক অর্থেই আমরা 'উদ্ধার' হলাম। ট্যুর অপারেটরের ব্যবস্থায় সিমলা পৌঁছলাম রাত এগারটা নাগাদ। আঃ কী শান্তি।
২৪ জুন। মাথায় এখন একটাই চিন্তা – ফেরার টিকিটের। ট্যুর অপারেটরই ব্যবস্থা করে ফেললেন ২৫ তারিখের কালকা মেল। তৎকালে সাতটা টিকিট পাওয়া গেছে স্লিপার ক্লাসে। মনমেজাজ প্রায় স্বাভাবিক হওয়ায় কয়েকজন মার্কেটিং-ও সেরে ফেললেন।
২৫ জুন। সারাদিন বেশ হাল্কা মেজাজে ঘোরাঘুরির পর দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে কালকা পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যে সাতটার সময়। ট্রেন রাত ১১.৫৫।
২৬ জুন। এসি থ্রি টায়ারের বদলে স্লিপার ক্লাস। সর্বত্র থিক থিক করছে মানুষ। তাও বাড়ি ফেরার এই যাত্রাটা যেন এবার একটু বেশিই আনন্দের মনে হচ্ছে।
২৮ জুন। হোম সুইট হোম।
কিন্নরের তথ্য ~ কিন্নরের আরও ছবি ~ লাহুল-স্পিতির আরও ছবি
রেলের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দীর্ঘদিন পরও ঊনআশি বছরের তরুণ দেবাশিস বোসের একটা বড় সময় কাটে ভ্রমণেই।