কাজিরাঙা জঙ্গল ক্যাম্পে তিনদিন
শ্রাবণী দাশগুপ্ত
~ কাজিরাঙ্গার তথ্য ~ কাজিরাঙ্গার আরও ছবি ~
(১)
গুয়াহাটি থেকে কাজিরাঙা। প্রায় সাত ঘন্টার সফর। লম্বা পথ, চওড়া নিরেট হাইওয়ে। কোথাও কোথাও অবশ্য বড় বাহনের ভিড়। মেঘালয়ের কিছু জায়গা পেরোতে হল। শিলঙের পথে বাঁক নিয়েছে যে রাস্তা, তাতে নাকি খুব যানজট হয়, ড্রাইভার বললেন। গাড়িতে অসমিয়া গানের সিডি বাজছিল। ঝিমুনি আসছিল সহজে, মাদকতা-মাখানো সুরের নেশায়। দূরে দূরে বাড়ি, বিস্তীর্ণ মাঠঘাট। আমাদের যাত্রা অবশেষে গন্তব্যে। কাজিরাঙা গ্রামে ঢুকে পড়েছি। চোখের সামনে কাজিরাঙা ন্যাশন্যাল পার্ক-এর হোর্ডিং, দিকনিদের্শ, আরও কিছু আবশ্যিক সূচনা।
যেখানে উঠব, সেটি গুয়াহাটির নামজাদা পেশাদার হোটেলেরই ব্যবস্থাপনা। গাড়ি চলছিল যে চওড়া পাকা রাস্তা ধরে, তার পাশে গ্রাম উঁকি মারে, মৃদু জঙ্গল, জলাভূমি। হঠাৎ কী সৌভাগ্য! দুটো গণ্ডার, বনের ভেতর থেকে কী কারণে বেরিয়ে, প্রায় পথের ওপরেই জল খাচ্ছে নিশ্চিন্তে। আরেকটু এগিয়ে ডানদিকে বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা হোর্ডিং-এ 'কাজিরাঙা জঙ্গল ক্যাম্প'। কাঁচা পথ। ধুলো উড়িয়ে বেঁকেচুরে ঢুকে পড়ল গাড়িটা। বেলা প্রায় দেড়টা, তেলতেলে রোদে ভাসা দুপুর। ডিসেম্বর মাস। অথচ, গায়ের গরম জামাগুলো অবাঞ্ছিত বোঝার মত বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। এখানে শীত পড়ে না নাকি?
গাড়ি যেখানে নামাল, সেই চারপাশটা থমকে দিল এক্কেবারে। আপাদমস্তক! এরকমটা ভাবি নি, মাথাতেই আসে নি। ইন্টারনেট খুলে ছবি দেখেছিলাম, তবু...। কী অসম্ভব অন্যরকম। গুয়াহাটির হোটেলটির একটা এক্সটেনশন, বলেছিলেন ওঁরা। তবে পরীক্ষামূলক সূচনা। আমাদের অসুবিধে হতে পারে। ভবিষ্যতে বৃহত্তর পরিকল্পনা আছে। সে থাক। তবে আমাদের ভাগ্যে যেটুকু, সেটুকু পরের পর্যটকদের থাকবে না! অসাধারণ অনুভূতি! আপাতত ভণিতা বাদ। চারপাশ খোলা বিস্তৃত মাঠে এসে দাঁড়াল গাড়িটা। একদিকে 'কাজিরাঙা কলেজ'। লম্বাটে একতলা, বাঁশের বেড়া, খানিকটা পাকা। বন্ধ, ছুটি চলছিল। মাঠের মাঝখানে মস্ত আটচালার মত। মাথায় পাতার ছাউনি। বাঁশের খুঁটি। দুদিক ঘিরে গোটাদশেক ছোট্ট কটেজ, মানে, আক্ষরিক অর্থেই কুটীর। বাঁশের খুঁটি। ছ্যাঁচা-বেড়ার দেওয়ালে মাটি লেপা, সাদা চুনকাম। ছাদ বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে। খুব শ্রীপূর্ণ। পেছনে ভীড় করে আছে মস্ত মস্ত গাছ। সামনে বেড়া দিয়ে ঘেরা ছোট্ট জায়গা। 'পঞ্চবটী বনে সেই গোদাবরী তীরে', শৈশবে শোনা গানের কলি কেন মনে পড়ে! আহা বেশ। এমন যদি বরাবর থাকতে পেতাম! ভোজনালয় সেই মস্ত আটচালা! প্লাস্টিকের টেবিল চেয়ার। সিমেন্টের মেঝে। গরমাগরম দুপুরের আহার।
বাউণ্ডারি ওয়ালের বালাই নেই। ছোট নীচু প্রাকৃতিক বাউণ্ডারি ডিঙোতেই ওধারে আহা হা... যতদূর চোখ ছড়াই চা বাগান। ঘন সবুজ চুপ করে আছে মাইলের পর মাইল। সিঁথির মত সরু মাটির পথ ধরে হাঁটি আমরা। কেউ কোত্থাও নেই। খানিকটা দূরে, সম্ভবত পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বাংলোবাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। অফিস হতে পারে, বা কোয়াটার্স। বেশি দূর এগোই না আর। শহুরে মানুষ, সবেতেই নিরাপত্তাহীনতার ভয় পাই। যদিও রিসর্টের কর্মীরা অভয় দিয়েছেন, এমন কী বন্য পশুরাও এখানে এসে বিরক্ত করে না। চেয়ার পেতে নীরবে বসে থাকি ঘরের সামনে। নিবিড় নির্জন চারিপাশ। পায়ের পাতায় মাটি লাগে। এখানে কোথাও বাঁধানো কিছু চোখে পড়ে না। ঘরের ভেতরে বাঁশের চৌকি, আলনা, আরশি। মেঝে অবশ্য সিমেন্টের। কখন যেন সন্ধ্যে নামে। সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু মুছে যায়। লাইট জ্বলে ওঠে। ভারী হয়ে অন্ধকার থমথম করে, ভয় ভয় রোমাঞ্চ। একপাশে লম্বাটে রান্নাবাড়ি, কমর্চারীদের বাসস্থানও বটে। দেখি, ওঁরা ব্যস্ত ভোজনালয়ের সামনে। বড় গাছের গুঁড়ি নিয়ে কী যেন...। গোল করে চেয়ার বিছিয়ে আমাদের ডাকেন। ততক্ষণে এসেছেন আরও কয়েকজন পর্যটক, কোত্থেকে যেন ফিরেছেন। আমরা গিয়ে বসি। মস্ত গর্তে গাছের মোটা গুঁড়িতে আগুন, ক্যাম্প ফায়ার। আগুন পোহাই। শীত মালুম হচ্ছে হাড়ে হাড়ে। বাকীরা সকালে গিয়েছিলেন জঙ্গলে। তার বিবরণ শুনি বসে বসে। গল্প জমে ক্ষীর। কটা গণ্ডার দেখা দিল, কিম্বা হস্তীপরিবার, বন্য বরা, পাখপাখালি। কেউ বললেন, বাঘের আঁচড় দেখে এসেছেন গাছের গায়ে। কাদের হাতির পাল পথ অবরোধে ধেয়ে এসেছিল। শুনি সব, জমা করি। আমরা যাব পরদিন সকালে। রাতের আহার একসঙ্গে। বৈচিত্রের খামতি যত্ন আর আন্তরিকতায় ভরে থাকে। ভোজনকক্ষই কমনরুম। এককোণে ক্যারাম-বোর্ড। খেলা চলে খানিকটা। আবছায়াতে ব্যাডমিণ্টন খেলেন দু'একজনা।
(২)
কুঁড়ে ঘরে শুয়ে সারারাত কেঁপেছি। সোয়েটার পরে, লেপ মুড়ি দিয়ে। দিনের বেলার শৌখিন রোম্যান্টিকতা উধাও। কী মারাত্মক ঠাণ্ডা! মনকে প্রবোধ দিই, এদেশের কত গরীব মানুষের মাথার ওপরে ছাউনিটুকুও থাকে না। জানা গেল স্নান করার গরম জল পাওয়া যায়, তবে সময় নির্দিষ্ট। গিজার নেই। জল গরম করার অভিনব পদ্ধতি দেখে মজা লাগল। মাটিতে বিছানো জল সরবরাহের ধাতব পাইপ-লাইন কাঠকুটো জ্বালিয়ে গরম করা হচ্ছে। যতক্ষণ আগুণ জ্বলে, ততক্ষণ গরম। স্নান সারা হল। সকালের চা-কফি। ধড়াচূড়ো পরে আমরা সুসজ্জিত। জঙ্গল দেখতে এতো সরঞ্জাম না লাগাই শ্রেয়, তবু সানগ্লাস, বাইনোকুলার, ক্যামেরা। আজকাল চোখে দেখার চেয়ে ঠুলিতে দেখায় বেশি ভরসা করি। গাড়ি তার গন্তব্যে এসে আমাদের নামাল। ওখান থেকে হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে গণ্ডার দেখতে যাব, আর হরিণ। এই অভিজ্ঞতা মনে হয় আছে অনেকেরই, আমাদের সেবার প্রথম।
গাঢ় বেগুনি রঙের ভোর। দু'পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে দহ, জঙ্গলকে ঘিরে রেখেছে। গা যে শিরশির করছে, তা শুধু শীতে নয়। একখানা উঁচু বাঁশের মাচা। নীচে হাতির পিঠে ওঠার সারি বেঁধে অপেক্ষা। প্রত্যেক হাতিতে মাহুত ছাড়া আর আটজন। উঠলাম। সত্যিকারের গজেন্দ্রগমন এবারে, খুব লম্বা ঘন ঘাসের ভেতর দিয়ে। উলুখাগড়া বনের মতো, নাম - এলিফ্যান্ট গ্র্যাস্। হাতি লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে পাওয়া যায় না সহজে। নিদের্শানুযায়ী মুখ বন্ধ রেখেছি, চরম উত্তেজনা দমন করে। সক্কাল সক্কাল নাকি গণ্ডার আর বন্য হরিণের পাল দর্শনার্থীদের কৃপা করেন। এই অভিজ্ঞতার কোনও উপমা নেই। স্বপ্নের মতো ভোরে আদিগন্ত সবুজ-সোনালি মেশানো জড়ানো ঘাস। দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোথায় ওদের দেখা পাই? মাহুতের হাতে শক্তপোক্ত লাঠি। হাতিবাবাজীর পিঠে দরকার মতো দু'চার ঘা...। আসলে, ওঁরা নাড়িনক্ষত্র জানেন। বারবার আমাদের সাবধান করছেন নড়াচড়া না করতে। কাঠ হয়ে আছি, নীচে ঘাসের ভেতরে পড়ে গেলে কী হতে পারে, ভাবার সাহসটুকুও পাচ্ছি না। হাতের লাঠি দিয়ে কোথাও কোথাও ঘাসের বন ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন, 'এই দেখুন, এই!' বিস্ময়ে শ্বাসরোধ করে দেখছি - জায়গায় জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে আছে তারা, একা বা অনেকে একসঙ্গে। কোথাও শক্তিমান একশৃঙ্গ গম্ভীর গণ্ডার দুনিয়াকে অগ্রাহ্য করে, কোথাও ভীরু চঞ্চল পলায়নোন্মুখ হরিণ! এভাবে থেমে থেমে, এক কিলোমিটার পরিধি হস্তীপৃষ্ঠে আমাদের পরিব্রাজন। রাজকীয় প্রকৃতির সেকী অপার ঐশ্বর্য! অথচ, দেখার আগেই একগুচ্ছ ক্যামেরার ক্লিক্ ক্লিক্, যদি পালিয়ে যায়! পালায় না ওরা, লুকিয়ে থাকে। জানে, মানুষের মত আদেখলা, হ্যাংলা, নিষ্ঠুর, লোভী প্রাণী জগতে নেই। ফিরে আসছিলাম। ওদিকটায় বড় ও প্রবীন গাছের জঙ্গল। মোটা মোটা দোদুল লতা হঠাৎ সাপ বলে ভুল হয়ে যায়। অবশ্য, শীতে তাঁরা ঘুমোতে গেছেন, জানালেন মাহুত। বর্ষায় রঙবেরঙে ঝুলে থাকেন গাছে গাছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, কল্পনায় সবটা দেখতে চেষ্টা করি। কোথাও কোথাও দুর্ভেদ্য ডালপালার জটিল নকশা। গাছের গায়ে জড়ানো মাকড়সার হিজিবিজি জাল। পাখিদের আমি চিনি না। বড্ড যেন ছটফটে। তারাও এগাছ ওগাছ করে। আমাদের জঙ্গল দেখার প্রথম ভাগের ইতি হয়। গেটের কাছে ফিরে আসি।
এবারে গাড়ি নিয়ে যায় আমাদের পার্কের অন্য একপ্রান্তের প্রবেশ দরজায়। এখানে হাতির পিঠ নয়, খোলা জিপে জঙ্গলের আরও খানিক গভীরে যাওয়া। জঙ্গলে ঢোকার আগে বোধহয় মনে রাখা ভাল, জঙ্গল চিড়িয়াখানা বা খাঁচাবন্দী পরাধীন জন্তুদের অনাথ-আশ্রম নয়। জঙ্গল মহলে ওরা শাহেনশা। অতএব আপনার বা আমার ইচ্ছেমত, নিরীহ ভদ্রভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে, এটা দুরাশা। অনধিকার চর্চাও! সে যাই হোক, আমাদের জিপ জঙ্গলে প্রবেশ করতে থাকে। (অবশ্যই তত গভীরে যেতে পারে না, যেখানে বনবাসিন্দাদের খাস তালুক।)
জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে চলেছি। কিছুক্ষণ পিচের সরু পথ ছিল, পেরিয়ে গিয়ে কাঁচা রাস্তা। সার সার জিপে উদ্গ্রীব মানুষ। ছায়ামাখা মসৃণ বনপথ। কোথাও আবার ভীষণ এবড়ো-খেবড়ো। জায়গায় জায়গায় জল জমে আছে। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ি প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। কেউ ভয় পান, কেউ যেন কোনও সাজানো পার্কের ফান-রাইডে চেপেছেন... তেমন উত্তেজনায় চেঁচিয়ে ওঠেন। জিপচালক বলেন, 'চুপ, চুপ। ওই দেখুন দূরে...!' দেখি, মা আর বাচ্চা হাতি। আমরা ঘাড় উঁচু করি, ক্যামেরা তাক করি... ওই যে! আর একদল এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় পথের ওপরে। একটা দুটো তিনটে... গুণতে থাকি সবাই! ওহো, কী দারুণ! ফিরে গিয়ে বলতে হবে না, ক'জনকে দেখতে পেয়েছি? জিপ এগোয় ধীর গতিতে, কোথাও কিছু বাদ না পড়ে যায়। এক জায়গায় বুনো মোষের খুলি, কঙ্কাল। কাছাকাছি একটা গাছ। জিপ চালক চিনিয়ে দেন বাঘের আঁচড়, গাছের গুঁড়ির গায়ে। সন্দিহান হই। একটু দূরে মাটিতে মস্ত থাবার দাগ। দেখে হিম হয়ে যাই, অথচ পুরোটা বিশ্বাস হয় না। রাতের দিকে নাকি এখানে ঘোরাফেরা করে রাজাসাহেবরা।
আমাদের চলার পথের একপাশে অন্তহীন উদার মাঠ। বাইনোকুলারের সাহায্যে দেখা যায় বুনো মোষ আর বরা। অন্যদিকে গাঢ় বনানী আর দীর্ঘ দহ ঘিরে আছে। জলে সবজে রঙের আভাস। পাড় ধরে ঘন গাছে মিলেমিশে অন্ধকার। অপার বিস্ময়! একী! অদূরে সেই দহে, চোখের সামনে শুঁড় দিয়ে জল ছিটিয়ে রাজসিক অবগাহন করছে একলা এক বিরাট হাতি। সাথর্ক আমার এই আসা! লক্ষ বছরের প্রাপ্তি। পারিপাশ্বির্ক ভুলে, আমি তখন দক্ষিণারঞ্জন-বণির্ত রূপকথার দেশে! আমার চোখ আর বন্যপ্রাণী খোঁজে না... আমি সমস্ত অন্তর থেকে অনুভব করি বন্যেরা বনে সুন্দর। তাদের এই অনাবিল যাপন, এই নন্দিত পরিবেশ, খোলা আকাশ, সবুজের গায়ে সবুজ লেগে থাকা রহস্যময়তা, আমাকে বিমূঢ় করে রাখে। যা চোখে দেখি, তা দেখি। বাকিটা গোপন কল্পনায়। আরও অনেক গভীরে কী আছে, ভেবে গা ছমছম। ভাবি, রাত্তিরে এখানে এলে কেমন লাগে? দূরে দূরে ওয়াচ টাওয়ার বানানো আছে, নীচে জলপানের ব্যবস্থা। টঙে চড়ে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছেন অনেকেই... অদূরে অসংখ্য হরিণ, হাতি, বরা, বুনো মোষ, পাখি। মন চায় না আমার। চোখ ভরে আছে নীলে, সবুজে, সোনালিতে, ধূসর ধুলোয়। সন্ধ্যের একটু আগে ফিরে যাই ক্যাম্পে।
(৩)
দিন শেষ হয়ে এলে, এখানে আর কিছু করার থাকে না। ভয়ানক ঠাণ্ডা। জঙ্গল দেখা হয়ে গেছে। আরও একটা দিন এখানে কী করে কাটবে, ভেবে পান না অনেকে। আমার স্বামী-কন্যাও একটু খুঁতখুঁত করেন। অথচ, বড্ড ভালো লাগায় আমি বিভোর হয়ে থাকি। এই চা-বাগিচা, নিরিবিলি কাঁচা পথ, অবারিত প্রকৃতি দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ভালো থাক্। সন্ধ্যেবেলায় ঝিমঝিমে অন্ধকার মেখে আগুণ সেঁকা... ভারতের নানান প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণার্থীদের সঙ্গে গল্প। সঙ্গতে কাঠ ফাটার ক্রমাগত আওয়াজ। পরদিন সারা সকালটা ঘুরে বেড়াই এদিক থেকে ওদিক, পায়ে হেঁটে। রোদের তাত প্রচণ্ড। গাছের ছায়ায় বসে পড়ি, দোল খাই। যেমন ইচ্ছে, তেমন করি। বড় রাস্তার ওপরে গিয়ে দাঁড়াই, যদি আবার কপালগুণে কোনও...! কিচ্ছু না। রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে যায় গাড়ি, ট্রাক - ঘন ঘন নয় অবশ্য। বড় রাস্তার ওপাশে বসতি আছে। দেখা যায় গ্রামের মানুষজন।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলে, ঢুকে পড়ি গ্রামের মধ্যে। ছোট ছোট একতলা, পাকা নয়। খামারের মত জায়গা। পোষা গরু, শুয়োর, হাঁস। বাড়ির মানুষদের সাথে আলাপ করার চেষ্টা করি। এঁরা ভাঙা ভাঙা বাংলা বোঝেন, একটু একটু হিন্দি। অসমিয়া মন দিয়ে শুনলে, আমরা বুঝতে পারি। সংযোগে অসুবিধে হয় না। দেখি গোবর জমিয়ে গ্যাস বানানোর চৌবাচ্চা। তা থেকে দু'একটা লাইট জ্বলে। নিজেরাই নিজেদের মতো করে নিয়েছেন। সরকারি অনুদানও আছে। যাতায়াত করার জন্যে সাইকেল। ঘুরে ঘুরে দেখি। কী জানি কেন মনে হয়, কোথায় যেন দেখেছি! হয়তো স্বপ্নে কিংবা কল্পনায়।
ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে, হাড়ে কাঁপুনি ধরে। আগুন জ্বালা হয় যথারীতি। আমরা সেদিন অনুরোধ করেছি, রাতের খাবারে বিশেষ কোনও আঞ্চলিক পদ বানানোর। ওঁরা সানন্দে যোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন। ব্যাম্বু চিকেন আর বিশেষ কী এক চালের ভাত। আমরা সাগ্রহে দেখি বানানোর পদ্ধতি। নুন-তেল, পেঁয়াজ-রসুন, লেবু-লঙ্কা দিয়ে ম্যারিনেট করা চিকেন ভরে দিয়েছেন কাঁচা বাঁশের খোদলে। তার মুখ বন্ধ করা এ্যালুমিনিয়ম ফয়েলে। চাল ধুয়ে জল আর সামান্য ঘি দিয়ে ওভাবেই। যেখানে বসে আগুন পোহাই আমরা সকলে, ওখানে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে মুখ-বন্ধ বাঁশের নলচেগুলো। বিচিত্র সমস্ত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, শুঁশুঁ-বুঁবুঁ, ফটাস-ফট্... কাঠ ফাটার শব্দ। মাথার ওপরে কালো কিংখাবের ঢাকনা, তারার চুমকি। মস্ত ছাউনি-দেওয়া খাবার ঘরটায়, খাওয়ার টেবিলে আকাঙ্ক্ষিত খাদ্য পরিবেশিত হল... স্বাদের তুলনা নেই। আড়ম্বর নেই, আন্তরিকতায় মাখামাখি।
পরদিন সকালে ফিরে যাওয়া। মন কেমন করে। যা দেখতে এসেছিলাম, তার অনেক বেশি পেয়েছি। মনে হচ্ছে, 'এমনি করে যায় যদি দিন, যাক্ না'। তাও কি হয়? ঠাণ্ডা লেগে খানিক জ্বর এসেছে আমার। আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বের হই। ঘড়িতে সকাল হয়েছে, অথচ সূর্য উধাও। এমন মোটা কুয়াশার চাদর? মেঘ নেমে এসেছে না কি? কটেজের সামনের ঘেরা জায়গাটিতে হাতের নাগালে দাঁড়ানো লম্বা গাছটি অবধি দেখা যাচ্ছে না। খাওয়ার ঘরটিকে অতি সামান্য আভাস অনুভবে বোঝা যাচ্ছে। ছবি তুলি...। কী আশ্চর্য, কী বিস্ময়। এমন হয় কী করে! অবশ্য জায়গাটা সমতলে হলেও, মেঘালয় তো এরাজ্যেই। এমন যাদুকরী কাণ্ডকারখানা অস্বাভাবিক নয় মোটে। ভাবতে ভাবতে, হাতে গরম চায়ের কাপ, আর প্রাতরাশও সেরে নিই। খানিক পরেই বেরোব, বাহন প্রস্তুত।
হঠাৎ দেখি, কুয়াশার পাড় ধরে উঁকিঝুঁকি মারছে সূর্য।
বিদায় কাজিরাঙা, গুড বাই, অলভিদা!
~ কাজিরাঙ্গার তথ্য ~ কাজিরাঙ্গার আরও ছবি ~
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শ্রাবণী দাশগুপ্ত বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে রাঁচিতে থাকেন। কিছুদিন স্কুলে চাকরির পর বাড়িতে থিতু হয়ে এখন লেখালেখিই আর বই পড়াই ভাললাগার বিষয়। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন এবং ই-ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে ছোট গল্প। পাহাড় আর জঙ্গল খুব প্রিয়। বেড়াতে ভালোবাসলেও ভ্রমণ কাহিনি লেখায় হাত পাকানো অল্পদিন।