গুয়াহাটি(Guahati) - উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রধান প্রবেশদ্বার ব্রক্ষ্মপুত্রের তীরবর্তী গুয়াহাটি। মন্দিরময় গুয়াহাটির পরিচিতি কামাখ্যা মন্দিরকে কেন্দ্র করে। শহর থেকে ১০কিমি দূরে নীলাচল পাহাড়ে ৫২৫ফুট উচ্চতায় প্রসিদ্ধ কামাখ্যা মন্দির (Kamakhya Temple)- ৫১ পীঠের এক পীঠ। মূল মন্দিরটি ১৫৫৩ সালে কালাপাহাড়ের আক্রমনে ধ্বংস হওয়ার পর নতুন করে গড়ে তোলেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ। অপরূপ ভাস্কর্য আর কারুকার্যমন্ডিত মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী অষ্টধাতুর দেবী কামাখ্যা। এই মন্দিরের কাছে ভুবনেশ্বরী মন্দির। গুয়াহাটি শহরের কেন্দ্রস্থলে ছোট্ট পাহাড়ি দ্বীপ পিকক আইল্যান্ডে টিলার উপরে উমানন্দ মন্দির। দেবী কামাখ্যার ভৈরব এই উমানন্দ। এই মন্দিরের পাশে চন্দ্রশেখর মন্দির। শুকলেশ্বর ঘাটের কাছে জনার্দন মন্দির ও শুক্লেশ্বর শিবমন্দির। পান্ণ্ডুনাথের মন্দির দর্শন করতে যেতে হবে পাণ্ডু। জনশ্রুতি, বনবাসের সময় পাণ্ডবেরা কিছুকাল এখানে ছিলেন। উজানবাজারের কাছে চিত্রাচল পাহাড়ে নবগ্রহ মন্দির। শহর থেকে ১২কিমি দূরে সন্ধ্যাচল পাহাড়ে বশিষ্ঠ আশ্রম।
অসমের খাজুরাহো মদনকামদেব মন্দির (Madan Kamdev Temple) শহর থেকে ৪০কিমি দূরে। একাদশ-দ্বাদশ শতকে নির্মিত মন্দিরটির অসাধারণ ভাস্কর্যগুলি আজ অবহেলায় অনেকাংশই নষ্ট। তবু যেটুকু অক্ষত আছে তা শিল্পরসিক দর্শককে মুগ্ধ করে।
ট্যুরিস্ট লজ লাগোয়া অসম স্টেট মিউজিয়াম। দিঘালিপুখুরে রয়েছে অসম রাজ্য সংগ্রহশালা। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৫কিমি দূরে অসম স্টেট জু ও বটানিকাল গার্ডেন। শুক্রবার চিড়িয়াখানা বন্ধ থাকে।
গুয়াহাটি থেকে ৩০ কিমি দূরে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ - তিনধর্মের পবিত্র তীর্থ হাজো (Hajo)। হয়গ্রীব মাধব মন্দিরের দেবমূর্তি হিন্দুদের কাছে নারায়ণ এবং বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধরূপে পূজিত হন। মুসলিমদের পবিত্রস্থল পোয়া মক্কা মসজিদ। হাজো থেকে ২০ কিমি দূরে তাঁতিদের গ্রাম শুয়ালকুচি রেশম,মুগা আর পাটশিল্পের জন্য খ্যাত।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর গুয়াহাটি। গুয়াহাটির সঙ্গে বাসে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
থাকাঃ- রেলস্টেশনের কাছেই অসম পর্যটনের প্রশান্তি ট্যুরিস্ট লজ। এছাড়া শহর জুড়ে নানা মান ও দামের বেসরকারি হোটেল রয়েছে।
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান (Kaziranga National Park) - উত্তরে পূর্ব হিমালয় আর দক্ষিনে গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া ও মিকির, কাহাড়, বারৈল পাহাড়ের মাঝখানে ৪৩০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান। নওগাঁ, গোলাঘাট ও কার্বি আংলং – অসমের এই তিনটি জেলায় ছড়িয়ে আছে এই বনাঞ্চল। ১৯০৪ সালে সংরক্ষিত এই অরণ্যের জন্ম হলেও ১৯২৬ সালে গেম স্যাংচুয়ারি ১৯৪০ সালে ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালে জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায় কাজিরাঙ্গা। ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা লাভ করে এই অরণ্য। কাজিরাঙ্গা অরণ্যের চারটি রেঞ্জ- কোহরা, বাগোরি, আগরাতোলি ও বুড়াপাহাড়। এই অরণ্যে রয়েছে পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক এক শৃঙ্গ গন্ডার, বুনো মোষ, ইস্টার্ন সোয়াম্প ডিয়ার আর বর্গ কিলোমিটার পিছু সর্বাধিক সংখ্যক বাঘ। এছাড়াও আছে ৩৮ প্রজাতির স্তণ্যপায়ী ও প্রায় ৫০০ প্রজাতির পাখি। প্রায় ৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও অসংখ্য কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থল এই বনভূমি। ব্রক্ষ্মপুত্র, জিয়াডিফালু, মরাডিফালু এবং কোহোরা – এই চার নদী বয়ে চলেছে অরণ্যের বুক চিরে।
মে থেকে অক্টোবর জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকে।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন গুয়াহাটি। বিমানে করে পৌঁছানো যায় গুয়াহাটি, জোড়হাট বা তেজপুরে। গুয়াহাটি থেকে কাজিরাঙ্গা ২১৭কিমি দূরে। জোড়হাট থেকে দূরত্ব ৯০কিমি, তেজপুর থেকে দূরত্ব ৭৫কিমি। বাসে বা ভাড়া গাড়িতে এই রাস্তা যাওয়া যায়।
থাকাঃ- কাজিরাঙ্গায় অসম পর্যটনের অরণ্য, বনানী, বনশ্রী ও প্রশান্তি টুরিস্ট লজ আছে। প্রধান রেঞ্জ কোহরা এবং আগরাতোলিতে সরকারি লজ রয়েছে। এছাড়াও কাজিরাঙ্গায় বিভিন্ন মান ও দামের কয়েকটি প্রাইভেট হোটেল আছে। কাজিরাঙ্গার এস টি ডি কোডঃ ০৩৭৭৬ ।
উৎসবঃ- ২৯-৩১শে জানুয়ারি কাজিরাঙ্গায় এলিফ্যান্ট ফেস্টিভাল হয়। অসমের জাতীয় উৎসব বিহু (Bihu)। চৈত্র সংক্রান্তিতে ৩ দিন ধরে চলে ফসল বোনার উৎসব রঙ্গালি বিহু, আশ্বিন-কার্তিক জুড়ে চলে ফসল কাটার উৎসব কাটি বিহু আর আশ্বিন সংক্রান্তিতে দু’দিন ধরে চলে ফসল তোলার উৎসব ভোগালি বিহু।
কেনাকাটাঃ- অসমের চা বিখ্যাত। চা বাগিচা গুলি সংলগ্ন বিক্রয়কেন্দ্র থেকে কেনা যায়। সংগ্রহ করা যায় স্থানীয় পোশাক মেখলা বা বাঁশ, বেত, কাঠ, প্রভৃতির তৈরি হস্তশিল্পজাত দ্রব্যাদি।
|| ভ্রমণ কাহিনি - কাজিরাঙ্গা জঙ্গল ক্যাম্পে তিনদিন ||
মানস অভয়ারণ্য(Manas Sanctuary)- গুয়াহাটি থেকে ১৭৬ কিমি দূরে ভূটান সীমান্তে মানস নদীর তীরে মানস অভয়ারণ্য। ১৯৭৪ সালে, সংরক্ষিত এই বনাঞ্চল টাইগার রিজার্ভের তকমা পায়। ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি মেলে। ১৯৯০ সালে ন্যাশনাল পার্ক। ২৮৩৭ বর্গ কিমি ব্যপী এই বনাঞ্চলের ৫৪০ বর্গ কিমি ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায়। মানসের দুই শাখা বেঁকি ও হাকোয়া ভারত ও ভূটানের মধ্যে অরণ্যসীমানা নির্দেশ করে। শিমূল, অর্জুন, খয়ের, বহেড়া, কাঞ্চন গাছে ছাওয়া এই বনভূমিতে লুপ্তপ্রায় পিগমি হগ ও গোল্ডেন লাঙ্গুরের দেখা মিলবে। এছাড়া এক শৃঙ্গ গন্ডার,হাতি,বুনো মোষ, লেপার্ড ক্যাট, লার্জ ইন্ডিয়ান সিভেট, নানান প্রজাতির হরিণ, শম্বর,শুয়োর, বাইসন, ক্লাউডেড লেপার্ড, স্নো লোরিস, নানান সরীসৃপ, পাখি ও প্রজাপতির বাসভূমি এই অরণ্য। নদীর জলে বোটিং, মাছধরা এবং হাতির পিঠে অরণ্যভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। বেড়াবার মরসুম নভেম্ভর থেকে এপ্রিল।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন বরপেটা। গুয়াহাটি থেকে বাসেও ৪-৫ ঘন্টায় বরপেটা পৌছাঁনো যায়। বরপেটা থেকে বাস যাচ্ছে ২০ কিমি দূরে মানস অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার বাঁশবাড়ি। ফরেস্ট বাংলো আর মানস বন্যজন্তু সংগ্রহশালা ৪০ কিমি দূরে মাথানগুড়িতে। এপথে জিপ বা ট্যাক্সি ভরসা।
থাকাঃ<-মাথানগুড়িতে দুটি ফরেস্ট বাংলো আছে। বাঁশবাড়িতে রয়েছে সরকারি ট্যুরিস্ট লজ ও প্রাইভেট হোটেল।
নামেরি জাতীয় উদ্যান(Nameri National Park) >-অসম-অরুণাচল সীমান্তে শোনিতপুর জেলায় ২০০ কিমি ব্যপী নামেরি জাতীয় উদ্যান ও টাইগার রিজার্ভ। পাখির স্বর্গ নামেরিতে দেখা মিলবে হর্নবিল, মারগানজার, হোয়াইট উইঙ্গড উড ডাক,ফিশিং ঈগল, লেসার অ্যাডজুটেন্ট স্টর্ক, টার্ন প্রভৃতি প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির। বাঘ, লেপার্ড, ক্লাউডেড লেপার্ড, হাতি, গাউর,নানান প্রজাতির হরিণ, শম্বর, স্নো লোরিস, স্লথ বিয়ার, কচ্ছপ,সাপেদের মত অরণ্যচারীদের বাসস্থল এই বনাঞ্চল। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা জিয়াভরলি নদীতে রাফটিং করতে পারেন।। বেড়াবার মরসুম নভেম্ভর থেকে এপ্রিল।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন গুয়াহাটি ২২০ কিমি দূরে। ৩৪ কিমি দূরেই তেজপুর বিমানবন্দর ।
থাকাঃ- তেজপুরে থেকেই নামেরি ঘুরে নেওয়া সুবিধাজনক। তেজপুরে অসম ট্যুরিজমের লজ আছে। নামেরিতে থাকতে হবে ইকো ক্যাম্পে।
পবিতোরা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি(Pabitora Wildlife Sanctuary)- গুয়াহাটি থেকে ৫৩ কিমি দূরে মোরিগাঁও জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের কোলে ৩৮.৮১ বর্গ কিমি ব্যপী পবিতোরা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। বর্গ কিমি পিছু গন্ডারের ঘনত্বের বিচারে পবিতোরার স্থান বিশ্বে একনম্বরে। এক শৃঙ্গ গন্ডার ছাড়াও লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, সিভেট ক্যাট, বুনো শুয়োর, এশিয়াটিক বাফেলো, চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, সরীসৃপ,পাখি,পতঙ্গ, প্রজাপতি প্রভৃতি এই অরণ্যের সম্পদ।
যাওয়াঃ- নিকটতম রেলস্টেশন গুয়াহাটি। গুয়াহাটি থেকে জোরহাট, চন্দ্রপুর বা সোনাপুর হয়ে পবিতোরা পৌঁছানো যায়।
থাকাঃ-মায়াং-এ সরকারি ট্যুরিস্ট লজ ও ফরেস্ট বাংলো আছে।
মাজুলি দ্বীপ (Majuli Island) – ব্রহ্মপুত্র, সুবনসিরি ও খ্যারকুটিয়া নদীর বুকে ৮৭৫ বর্গ কিলোমিটার ব্যপী বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপ মাজুলি। দেওরি উপজাতিদের ২৪৩টি গ্রাম রয়েছে দ্বীপজুড়ে। বৈষ্ণবতীর্থ মাজুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণবাচার্য শঙ্করদেব আর মাধবদেবের নাম। নানান মঠ ও আখড়া রয়েছে। জন্মাষ্টমী, রাসযাত্রা, বিহু উৎসবে মেতে ওঠে মাজুলি।
যাওয়াঃ-নিকটতম রেলস্টেশন ও বিমানবন্দর জোড়হাট। জোড়হাট থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে নিয়ামতিঘাট থেকে ফেরিতে মাজুলির কেন্দ্রস্থল কমলাবাড়ি।
থাকাঃ-মাজুলিতে সার্কিট হাউস ও পি ডব্লু ডি বাংলো আছে। জোড়হাটে থেকেও মাজুলি ঘুরে নেওয়া যায়। জোড়হাটে পিডব্লু ডি রেস্টহাউস ছাড়াও অনেক হোটেল আছে।