তাজমহল – প্রেমে অপ্রেমে

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

~ আগ্রার তথ্য ~ আগ্রার আরও ছবি ~

"Did you ever build a castle in the air? Here is one, brought down to earth, and fixed for the wonder of ages; yet so light it seems, so airy, and when seen from a distance, so like a fabric of mist and sunbeams, with its great dome soaring up, a silvery bubble about to burst..." – Bayard Taylor (1855)

প্রথম দর্শনে

প্রবল কুয়াশায় চব্বিশ ঘন্টা লেট করে ট্রেন যখন কনকনে শীতের এক সন্ধ্যায় আগ্রা পৌঁছাল তখন মনে হল এ বড় সঠিক সময় হয়নি। আবার পরদিন সকালে যখন কুয়াশা পেরিয়ে শেষপর্যন্ত তাজ-এর সামনে দাঁড়ালাম তখন মনে হল, কিচ্ছু যায় আসেনা – আমি তো বেঁচে আছি, আর এই জীবনেই দাঁড়িয়ে আছি 'তাজমহল'-এর সামনে। হয়তো রৌদ্র ঝলমলে শ্বেতশুভ্র আলোমাখা তাজ নয়, কিন্তু কুয়াশা এক অদ্ভুত মায়া সৃষ্টি করেছে তাজকে ঘিরে, যে মায়া বুকের ভেতর মোচড় দেয়।
তাজের গেট থেকে অনেকটা হেঁটে এসে কারুকার্য করা লাল বেলেপাথরের বড় ফটকটার সামনে পৌঁছেও তাজ অধরা। প্রতি মুহূর্তেই তাই বুকের মধ্যে স্পন্দন বাড়ে, প্রথম দেখার অপেক্ষায়।...
ফটক পেরিয়ে প্রথম প্ল্যাটফর্ম – প্রথম দর্শনের শিহরণ অথবা মুগ্ধতা...
অনেকক্ষণ চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকি। হয়তো মুগ্ধতাতেই। একশো বছরেরও বেশি আগে হয়তো ঠিক এখানে দাঁড়িয়েই প্রসন্নময়ীর একই অনুভব হয়েছিল – আমি রোমাঞ্চিত হই। (প্রসন্নময়ী – প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি ভারতভ্রমণ নিয়ে পুস্তক লেখেন, ১৮৮৮ সাল নাগাদ।)
আমারও তো সেই ছেলেবেলায় ইতিহাসে পড়া তাজ, বড় হয়ে বইয়ে, টিভিতে, ইন্টারনেটে দেখা – যেন বহুপরিচিত আপনজন কেউ। তবু সামনাসামনি প্রথম দেখায় মনের মধ্যে একটা অপূর্ব আবেশের সৃষ্টি হয় যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ব্যক্তি আমিকে যেন বিস্মৃত হই কিছুক্ষণের জন্য।
প্রসন্নময়ীর মত সুন্দর করে লেখার ভাষাতো নেই আমার কাছে, তাই অনুভূতিগুলো যখন মিশে যায় একশো বছর আগের এক লেখিকার সঙ্গে তখন সেই অনুভবে ডুবে যেতে যেতে তারই পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগে। এ যেন প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়া, তারপর তাকে একটু একটু করে জানা-চেনা। যতটুকু জানা যায়, চেনা যায় মাত্র দু'দিনের ভ্রমণে। সত্যি কতটুকুইবা। তবুতো ইচ্ছে করে। আর তাই নেমে লাল বেলেপাথরে বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি সাজানো বাগিচা আর জলাশয়ের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
সবুজ বাগান। দুপাশে গাছের সারির মাঝে নীল জলাশয়ে তাজের মুখচ্ছবি – সেই চেনা পিকচার পোস্টকার্ড। শুধু শীত ঠাণ্ডার কুয়াশায় মোড়া চাদরে তাজ যেন বড়ই বিষণ্ণ।
ক্রমশঃ কাছে এগিয়ে আসছে তাজ – বদলে যাচ্ছে পার্সপেক্টিভ। দূর থেকে দেখা সামগ্রিক দ্বিমাত্রিক ফ্রেম ভেঙে এখন আলাদা আলাদা করে দৃশ্যমান বা চোখের আড়াল হচ্ছে একেকটা অংশ। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে উত্তরণ ঘটছে দর্শকের চেতনারও।

"দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে
তিমির আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে
বুকে দোলে তার বিরহ ব্যথার মালা
গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা..."

বিরহ ব্যথার মালাখানি কী করে গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা হয় এখানে দাঁড়িয়ে তা যেন সত্যিই অনুভব করা যায়...।

দেখা না দেখার পালা

তাজমহলে ঢোকার সময় সিকিউরিটির অসম্ভব চেকিং। আপাদমস্তক বাঙালি আমাদের তিনজনকেই কোন দেশের মানুষ তা বারবার জবাব দিতে হয়েছিল, তারপরেও সন্দেহের দৃষ্টিতে বডি চেকিং হল। দীপের মন্তব্য বোধহয় আমার দাড়ি আর কালো জ্যাকেট দেখে উগ্রপন্থী ভেবেছে। তাহলে আমাকে? গম্ভীর মুখে গালে হাত বোলাই। নাহ্। লম্বা লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি চেকিং-এর বিস্তর ঝামেলা পোহানোর পর মস্ত গেট পেরিয়ে ঢোকা। চারটে দিক থেকে তাজমহলে ঢোকা যায়। মাঝের খোলা জায়গাটা পেরিয়ে লাল বেলেপাথরের প্রধান ফটক। ফটক পেরিয়ে সামনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে তাজ দেখার প্রথম রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। ভিডিও ক্যামেরাতেও এইপর্যন্তই ছবি তোলা যায়।
বিস্তীর্ণ খোলা সবুজ বাগিচার পশ্চাৎপটে শান্ত-স্নিগ্ধ তাজ। কুয়াশার চাদর তাকে ঘিরে রয়েছে আলতো করে। হাঁটতে হাঁটতে মাঝের প্ল্যাটফর্মগুলোয় বসে মুগ্ধ হয়ে দেখি। কুয়াশায় মোড়া শীতের সকালে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেশ কম। টিকিট কাটার সময়েই টিস্যু পেপারের জুতোঢাকা নেওয়া হয়েছিল। সমাধি সৌধের কাছে পৌঁছে জুতোর ওপর দিয়ে পরে নিই। শ্বেতপাথরে বাঁধানো সিঁড়ির ওপর পা রাখতেও রোমাঞ্চ লাগে। উঠে এলাম মূল চত্ত্বরে। এখানে দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত শান্ত অনুভূতি হয়। সামনে বিশাল জোড়া আর্চ। সাদা মার্বেলে ইনলে করা রঙিন পাথরে ফুল লতাপাতায় পিয়েত্রা দুরা কারুকাজ। যেন হাতির দাঁতের গয়নায় মিনাকারি। সাদা-কালো আর গেরুয়া রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে কারুকার্যে ব্যবহৃত মূল্যবান মণিমুক্তা-পাথর আর কিছুই নেই। নকশার পাড় দেওয়া কোরানের বাণী। নিঁখুত জ্যামিতির কায়দায় ওপর নীচের হরফের আকার চোখে সমান লাগে। মার্বেল কেটে তৈরি জানলায় জাফরির কাজ। মুগ্ধ হই।
তাজের দুপাশে মোটামুটি একশো গজ দূরত্বে লাল বেলেপাথরের দুটি ইমারত রয়েছে। ওপরের তিনটি করে গম্বুজ এবং সামনের কারুকার্যে এখানেও সাদা মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। পশ্চিমেরটি মসজিদ এবং অন্য পাশেরটি জামাত খানা, যেটি মসজিদের সাযুজ্য রাখতে তৈরি করা 'জবাব'।
সৌধের ভেতরে পা রাখি। কুয়াশার অন্ধকার আরও ঘন হয়। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছে সমাধির রেপ্লিকাদুটি। মূল সমাধিদুটি নীচের তলার কোন আঁধার কক্ষে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে। মমতাজের সমাধিটি মাঝখানে। বাঁপাশে অপেক্ষাকৃত বড়টি শাহজাহানের। সিমেট্রি ভেঙ্গে যাওয়াটা চোখে পীড়া দেয়। ইতিহাস বলছে এটা পরে তৈরি। সমাধিদুটিকে ঘিরে অষ্টভুজাকৃতি শ্বেতপাথরের জাফরির বেড়া। হয়তো রোদ থাকলে, গবাক্ষের জালিকার ফাঁক দিয়ে রোদের ছটা এসে সমাধিকে ছুঁয়ে গেলে আরও একটু ভালো লাগত ভেতরটা। কে জানে! কক্ষের দেওয়াল আর সমাধির গায়ে মার্বেলের ওপর ফুল-লতাপাতার মোটিফ। সমাধিদুটিতে ব্যবহৃত মার্বেল এতই উচ্চমানের যে প্রায় স্বচ্ছ বলে মনে হয়। চল্লিশ রকমের দামী পাথর আর মণিমুক্তায় খচিত সমাধির কারুকার্য। মমতাজের সমাধিতে কোরানের বাণী উৎকীর্ণ করা আছে। সিলিং-এ অপরূপ নকশা। সিলিং থেকে কবরের ওপরে ঝোলানো রয়েছে মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে তৈরি একটি বাতিদান – লর্ড কার্জনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। রুপোর দুটি দরজাও ছিল প্রথমে। জাঠেরা লুট করে নিয়ে যায়। তাজমহলের অন্দরে সব জায়গায় মার্বেল নেই। ভেতরের অন্য কক্ষে সিমেন্টের কারুকাজ।
বাইরে বেরিয়ে আসি। কী যেন একটা অতৃপ্তি রয়ে যায় মনের মধ্যে। যাকে হয়তো বহু বছরেও ঠিক চেনা যায় না তাকে কয়েক ঘন্টায় সত্যি দেখা হয় কি? তারপরতো একবছর কেটে গেছে। লিখতে পারছিলাম না তাজ কাহিনি। আজও লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে ওকেতো ভালো করে দেখা হল না, চেনা হল না আদৌ, কী লিখব! বেলা বাড়ছে, একটু একটু করে ভিড় জমছে তাজ চত্ত্বরে। ভিড়ের আঁচ এড়িয়ে তাজের পেছনের বারান্দায় দাঁড়াই, ফটিকচাঁদের দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। সামনে নীল যমুনা। দূরে একটা নৌকা চোখে পড়ে। ওপাড়ে না হওয়া কালো তাজ-এর কাঠামোর ভগ্নস্তুপ। কুয়াশায় খুব দূরে চোখ যায় না।...

তারপর...

তাজমহলের স্থাপত্য সৌন্দর্যকে অনেকটাই বুঝতে হয় অনুভবে। হয়তো ইতিহাস, গল্পকথা, ভাস্কর্য গড়ে তোলার কাহিনি অথবা ভাস্কর্যের জ্যামিতিক বিন্যাস সবই তখন কাজ করে মাথার মধ্যে।

ইতিহাস অথবা গল্পকথা

হয়তোবা পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য তাজমহল। হিন্দু, পারসিক, ইন্দো-ইসলামিক নানা স্থাপত্যের মেলবন্ধনে তিলোত্তমা সে। তাজমহলের প্রধান আবেদন শাহজাহানের প্রেম কাহিনি। কিন্তু সত্যি ইহজীবনে কতটা সুখ পেয়েছিলেন মমতাজ? তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়েও এ প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছিল। শাহজাহানের তিন স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয় (হারেমের অন্য মহিলাদের কথা বাদই দিচ্ছি) মমতাজ উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে চৌদ্দটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। এই কি সম্রাটের ভালোবাসা?
মমতাজ ওরফে আর্জুবানু মীর্জা গিয়াস বেগের নাতনি, আসফ আলির কন্যা, নূরজাহানের ভাইঝি। মমতাজ আর শাহজাহানের প্রথম দেখা হয়েছিল জমজমাট বাজারের মধ্যে। মমতাজ বিক্রেতা আর শাহজাহান ক্রেতা। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ যুবরাজ খুররম। আর্জুবানুর কথার চতুরতায় রীতিমত পর্যুদস্তও।

সময়টা ১৬০৭ সাল। আকবরের মৃত্যুর পর সদ্য ক্ষমতায় এসেছেন জাহাঙ্গির। বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগান নিহত হয়েছেন। মেহেরউন্নিসা তখনও জাহাঙ্গিরকে নিকাহ করেননি, অবশ্য রয়েছেন তাঁর হারেমেই। জাহাঙ্গিরের কাছে আর্জুবানুকে বিবাহ করার আবেদন জানালেন খুররম। মেহেরউন্নিসার কাছ থেকে তার আগেই খবর পেয়েছিলেন সম্রাট। রাজি হয়ে গেলেন পুত্রের আবেদনে, কিন্তু এক শর্তে - তার আগে মেহেরউন্নিসাকে নিকা করতে হবে শাহেনশাহকে। মেহেরউন্নিসা মনস্থির করতে পারলেন না। পিছিয়ে গেল খুররম আর আর্জুবানুর মিলনও। ইতিমধ্যে পারস্যের রাজকুমারীকে বিবাহ করলেন খুররম। অবশেষে নূরজাহানের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের বিয়ে হল ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে। আর তার একবছর পর মমতাজ আর শাহজাহানের।
১৬৩১ সাল। দাক্ষিণাত্য বিজয়ে বেরিয়েছেন শাহজাহান। সঙ্গে রয়েছেন মমতাজ। বুর্হানপুর কেল্লায় জন্ম হল তাঁদের চৌদ্দতম সন্তানের। শাহজাহানের অন্য দুই স্ত্রীর গর্ভের সন্তান সংখ্যাও ততদিনে অনেক। এর আগের তিন সন্তানই মারা গেছে প্রসবের পরই। ঊনচল্লিশ বসন্ত পার করা মমতাজও তখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল। সন্তান প্রসবের ধকল সইতে পারলেন না আর। মমতাজের মৃত্যুর পর সাতদিন নিজের কক্ষ থেকে বেরোননি শাহজাহান। যেদিন বেরোলেন সবাই বিস্মিত হয়ে দেখল বৃদ্ধ, কুব্জ সম্রাটকে, এই সাত দিনেই অনেক বছর যেন পেরিয়ে গেছে তাঁর জীবনে। পুরো দুবছর সারা হিন্দুস্থানে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল আমোদ-উৎসব। পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেল তাজমহলের। আর সেই মেয়েটি, যে জন্মেই হারিয়েছিল তার মাকে, সেই গৌহান-আরা-র খবর কে রাখে?

ভাস্কর অথবা ভাস্কর্যের কাহিনি

তাজ পরিকল্পনা কার এ বিষয়টি আজও তর্কমূলক। কারণ শাহজাহান চেয়েছিলেন তাজের সঙ্গে একমাত্র তাঁর নামটিই উল্লিখিত হোক। তাই লোকগাথা বলে, তাজ সৃষ্টির শেষে প্রধান বাস্তুবিদের দুটো হাত কেটে দেওয়া হয়, অন্ধ করে দেওয়া হয় লিপিকারদের, মুখ্য স্থপতিবিদের তো গর্দানই নেওয়া হয়। যাতে আর দ্বিতীয় তাজ কেউ সৃষ্টি করতে না পারে। একে সত্যি নয়, গল্পকথা বলেই ভাবতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যা রটে তার কিছুটাতো বটে।

মমতাজের মৃত্যুর ছমাস পর তাঁর দেহ যখন আগ্রায় নিয়ে আসা হয় ততদিনে সমাধির জায়গা বেছে ফেলেছেন শাহজাহান। যমুনার তীরে, আগ্রা কেল্লা থেকে দেখা যাবে, আবার একেবারে বাজারের লাগোয়া। তাজগঞ্জের ঘিঞ্জি বাজারটা কিন্তু তখনও ছিল। তখন তার নাম ছিল তাসিমাকান। টাভার্নিয়ারের বর্ণনায় পাই, সেই বাজারে হাজির হতেন সারা পৃথিবীর বণিকরা। নিজের শিল্পকীর্তির প্রচারের এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কি হতে পারে? বিজ্ঞাপন এবং প্রচারের ব্যাপারটা সে যুগেই সম্রাট শাহজাহান বেশ ভালো বুঝেছিলেন। জায়গাটা মহারাজ মান সিংহের বংশধর রাজা জয়সিংহের দখলদারিতে ছিল। সমমূল্যের খাসজমির বদলে জায়গাটির দখল নিলেন সম্রাট। স্থান নির্বাচন হলে দেশ-বিদেশের স্থপতিদের কাছে নকশা পেশ করার আবেদন রাখা হল। সেরা নকশা দিয়ে তৈরি হবে শাহজাহানের স্বপ্নের সৌধটি। হয়তবা ততদিনে মমতাজ উপলক্ষ মাত্র।
তাজ পরিকল্পনা রূপায়ণে অর্থব্যয়ে কোন কার্পণ্য করেননি শাহজাহান। সব মিলিয়ে সাড়ে আঠেরো কোটি শাহজাহানী টাকা ব্যয় হয়ছিল যা ছিল লাল কেল্লার নির্মাণ ব্যয়ের ঠিক দ্বিগুণ। জয়পুর থেকে এসেছিল সেরা জাতের মার্বেল আর দেশ-বিদেশ থেকে হিরে, মুক্তো, মণি-মানিক্য। দামী পাথরের অঙ্গসজ্জাতেই খরচ হয়েছিল আঠেরো কোটি। এর কিছুই প্রায় আজ আর অবশিষ্ট নেই।

টাভার্নিয়ারের লেখা থেকে জানা যায় কুড়ি হাজার মানুষের বাইশ বছরের পরিশ্রমে তৈরি হয় তাজ। এই বাইশ বছরে তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল ভালোবাসা, প্রেম, সংসার, সন্তান সবকিছুই, হয়তোবা কারোর কারোর গোটা জীবনটাই।
শ্বেতশুভ্র তাজের শরীরে শুধু ভালোবাসা নয়, অনেক দীর্ঘশ্বাস, অশ্রু, রক্ত, ঘামও লেগে রয়েছে।
শাহজাহানের সময়ের ঐতিহাসিক মীর মুগল বেগের লেখা থেকে শিল্পী এবং কর্মীরা কে কত মাইনে পেতেন তাও জানা যায়। তিনি উল্লেখ করেছিলেন হাজারো নকশা থেকে শাহজাহান বেছেছিলেন একটিমাত্র নকশা। কিন্তু কে সেই নকশাকার সে বিষয়ে তিনি একেবারেই নীরব। যদিও ১৯৩০ সালে খুঁজে পাওয়া ১৭ শতকের একটি কবিতার পুঁথির পাণ্ডুলিপিতে রচয়িতা লুফৎ আহমেদ জানাচ্ছেন তাঁর পিতা উস্তাদ আহমেদই তাজমহল এবং লাল কেল্লার রচয়িতা, সে কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সে সন্দেহ রয়েই যায়। কারণ স্থাপত্যের দিক থেকে তাজমহল এবং লাল কেল্লা একেবারে আলাদা। উস্তাদ ঈশা আফান্দি বিদেশি ছিলেন, তাঁর প্রকৃত পরিচয় রহস্যাবৃত। হাজরির খাতার প্রতি পৃষ্ঠায় তাঁর নাম রয়েছে সবার ওপরে মূল পরিকল্পনাকার হিসেবে। তাজমহলের পরিকল্পনা তাঁরই ছিল এমনটা বিশ্বাস করেন অনেক গবেষক এবং ঐতিহাসিকও।
তবে পরিকল্পনা যারই হোক না কেন তাঁর কর্মের মধ্যে দিয়েই স্বাক্ষর রেখে গেছেন এই স্থপতি। এখানে শাহজাহানের অন্যান্য কীর্তির চিরাচরিত ভঙ্গিমাগুলি প্রায় বর্জন করা হয়েছে। উপরের চারটি ছোট চবুতরা ছাড়া নয় বাঁকওয়ালা খিলান নেই, ছত্রীবর্জিত সমতল ছাদ নেই। তাজমহলে হিন্দু শৈলীর আশ্চর্য সংমিশ্রণ দেখা যায় পঞ্চরত্ন-দেউল বাস্তু নকশায়, তাঞ্জোরি গম্বুজে, মহা-পদ্ম-ঘন্টা-আমলক-কলসের ব্যবহারে, যা শাহজাহানকৃত অন্যান্য স্থাপত্যে অনুপস্থিত। পার্সপেক্টিভ বা পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান এবং অপটিক্স বা আলোক বিজ্ঞানের প্রয়োগের অসাধারণ উদাহরণ তাজমহল, যা ভারতীয় অন্যান্য স্থাপত্যে এর আগে সেভাবে দেখা যায়না। ফলে এর থেকেও বোঝা যায় যে এই কীর্তি কোন ভারতীয়ের নয়।

তাজমহলের ভূমির পরিকল্পনা পারস্য শৈলীর বৃত্তকেন্দ্রিক। ভূমির একেবারে কেন্দ্রে একটি বৃত্ত, যার মধ্যে রয়েছে সমাধিদুটি। এই বৃত্তের চারদিকে চারটি বৃত্ত। প্রত্যেকটি বৃত্ত মাঝের বৃত্তকে ছুঁয়ে আছে কিন্তু কেউ কাউকে চ্ছেদ করেনি। হিন্দু শৈলীর পঞ্চরত্ন-দেউল মন্দিরেও কিন্তু আমরা এই একই রীতি অনুসরণ করতে দেখি। কাজেই এর কোনটি যে তাজমহলের উৎস তা বলা কঠিন।
তাজমহলের বাগানের ছকটাও সামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্গক্ষেত্রাকার জমির ঠিক মাঝখানে একটা বর্গাকার জলাধার। এই জলাধার থেকে পরস্পরের সমকোণে চারদিকে চারটে নালা মূল বাগানকে চারটে সমান ভাগ করেছে। প্রত্যেক ভাগই একটা করে বর্গক্ষেত্র। আবার এই প্রত্যেকটা বর্গক্ষেত্রকে একজোড়া করে পথ সমান চারটে বর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। মোট ষোলোটা টুকরো জমি। পথের দুপাশে পাইন, পাম, পপলার এমন সব বড় গাছ। আর জমিগুলির ভেতরে নানান ফুলের গাছ।
তাজমহলের স্থাপত্যে যে দুটি জিনিস সবথেকে চোখে পড়ে তা হল গম্বুজ ও মিনার চারটি। আর যা চোখে পড়ে না অথচ যার ওপরে ভিত্তি করে পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে তা হল তাজমহলের ভূমি নকশা। যার সামগ্রিক মূল্যায়ন করা সহজ হত যমুনার ওপারে কৃষ্ণ তাজটি গড়ে উঠলে। তবেই কাঠামোটি সম্পূর্ণ হত। খুব সম্ভব গম্বুজের পরিকল্পনা করেছিলেন উস্তাদ আহমেদ। যার জন্য তাঁর পুত্র পিতাকে পুরো তাজেরই পরিকল্পনাকার বলে ধরে নিয়েছিলেন। যদিও সেই পরিকল্পনাও আদ্যন্ত তাঁর নিজের কল্পনাপ্রসূত নয়, তাঞ্জোর দেউলের গম্বুজের প্রায় হুবহু নকল। শুধু গম্বুজের শীর্ষে থাকা ত্রিশূল বদলে গিয়ে ঈদের চাঁদ হয়েছে। তাজের মিনারগুলির বৈশিষ্ট্য হল পরিকল্পনা করেই প্রত্যেকটিকে সিমেট্রিকালি বাইরের দিকে হেলিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে কোনদিন যদি কোনটি ভেঙ্গেও পড়ে তাহলেও মূল স্থাপত্যের কোন ক্ষতি হবে না।

অন্যদিকে শাহজাহানের সমসাময়িক ভ্রমণকারী টাভার্নিয়ার, যিনি তাজমহল নির্মাণের সূচনা ও শেষ দেখেছেন বলে দাবি করেন এবং তাজমহল নির্মাণের পাঁচ বছর পর তা দেখার অভিজ্ঞতা থেকে ভ্রমণকারী বার্নিয়ার রোমের সেন্ট পিটার্স-এর আদলে তৈরি ভাল-দে-গ্রেস-এর গম্বুজের সঙ্গে তাজের তুলনা করেছেন। অর্থাৎ এখানেও ইউরোপীয় না ভারতীয় কোন বৈশিষ্ট্য এর উৎস ছিল সে বিষয়ে সংশয় রয়েই যায়।
অপটিক্স বিজ্ঞানের প্রয়োগকৌশল সামগ্রিকভাবে পুরো তাজমহলেই রয়েছে, তবে তার সর্ব্বোত্তম ব্যবহার হয়েছে তুঘরা হরফে কোরাণ-শরিফের বাণীর ক্যালিগ্রাফিক লেখনীতে। প্রয়োগকৌশলে ওপরে-নীচে সর্বত্র লেখার হরফ সমান মাপের দেখায়। তাজমহলের আগে ভারতীয় স্থাপত্যে এর ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। ইউরোপে রেনেসাঁর সময়ে এই trompe l'oeil বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন ভাস্কর্যে ব্যবহার হতে দেখা গেছে। এর লিপিকার ছিলেন আমানৎ খান শিরাজী, যিনি গম্বুজের অনেক ওপরে খুব ক্ষুদ্র অক্ষরে সাহসভরে নিজের নাম লিখে গেছেন। যে সাহস বা সুযোগ মূল স্থপতির হয়নি।
তবে তার সামগ্রিক সৌন্দর্যেই যে তাজ তিলোত্তমা তা স্বীকার করেছেন সকলেই।

আবার ভ্রমণে

... তারপর বারবার ফিরে আসি। সকালবেলার তীব্র কুয়াশার চাদর সরিয়ে জেগে ওঠা তাজমহল ঠিক যেন মানুষের কোন সৃষ্টির মত নয় ("a house not made with hands")। দুপুরের নরম রোদ তার ত্বকে তারুণ্য এনে দেয়। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে মনখারাপের মতই রহস্যময়ী সে। জ্যোৎস্নারাতে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যখন সমস্ত দর্শনার্থীর হৃদয়ে দীর্ঘশ্বাস জমে ওঠে তখনই একঝলক তার হালকা অবয়ব ধরা দেয় ক্যামেরার ফ্রেমে।
"তুমি নব নব রূপে এস প্রাণে...।"

ইতমৎ-উদ-দৌলা, জামা মসজিদ দেখে অটো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই যমুনার ওপারে, তাজমহলের পেছনে। মেহতাব বাগের ভেতর দিয়ে রাস্তাটা এসে পড়ে যেখানে কৃষ্ণ তাজের পরিকল্পনা করেছিলেন শাহজাহান। তারই ভিতের ভাঙ্গা ইঁটপাথরের ওপর বসে তাজকে দেখি যেখান থেকে দেখতে চেয়েছিলেন শাহজাহান মরণের পরে। সামনেই ক্ষীণকায়া যমুনা। শীতে তার জল কমে গেছে। দুপুরের হালকা রোদ্দুরে খানিক উজ্জ্বল আর মোহময় হয়ে উঠেছে তাজ। টুসি হয়তোবা একটু আবেগদীপ্তই হয়ে পড়েছিল কিম্বা মজা করেই বলল বীরেন যদি কথা দেয় এমন একটা বানাবে তাহলে ও এক্ষুনি মরতে রাজি আছে। বললাম, তাজমহল নিয়ে তুই করবিটা কী, তখনতো দেখতেও আসবিনা, তার চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভালো। পরে পড়তে গিয়ে দেখি একথা অনেকেই এমনকী প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের স্ত্রীও তাঁর স্বামীকে নাকি টুসির মত এই কথাই বলেছিলেন। বোঝ!
আগ্রার কেল্লাও ঘুরে এসেছি ইতিমধ্যে। বন্দী শাহজাহান যে কক্ষ থেকে তাজমহল দেখতেন সেই কক্ষে এখন প্রবেশ নিষিদ্ধ। তার পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু চেষ্টা করেও কুয়াশা ভেদ করে তাজ দেখা যায়নি। কেন জানি মনে হল অনেক বছর আগে বৃদ্ধ শাহজাহান এখানে বসে এমন কোন দিনে হয়তোবা এরকমই কুয়াশার দিকে নিষ্ফল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। মমতাজের প্রয়াণের পর আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন শাহজাহান যার মধ্যে শেষ আটবছর ছিলেন পুত্রের হাতে বন্দী। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে শাহজাহানের দেহ তাজমহলে মমতাজের সমাধির পাশে কবরস্থ করা হয়।
আবারও তাজমহলের কাছে ফিরে আসি। দূর থেকে, কাছ থেকে দেখি। নরম রোদ্দুরের আঁচল জড়িয়ে কুয়াশার ঘুম ভাঙা তাজকে আরও সুন্দর লাগে। হিন্দু-পারসিক-ইসলামিক, রোমের সেন্ট পিটার্স কিম্বা দাক্ষিণাত্যের মন্দির - শেষপর্যন্ত কোন তুলনারই প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
"তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনো বহু ব্যবহার করা কোন উপমায়"

একটু রোদ্দুর উঠতেই তাজে দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। ফটক পেরিয়ে প্রথম প্ল্যাটফর্ম থেকেই থিকথিকে ভিড়। নানা সংস্কৃতির ভারতীয়, বিদেশি মুখ – ব্যাকগ্রাউন্ডে তাজ না থাকলে মনে হত অন্য কোন দেশেই আছি যেন। বাগানের দৈর্ঘ্যের মাঝখানে আরও দুটো প্ল্যাটফর্ম আছে যেখান থেকে দাঁড়িয়ে বা বসে তাজ দেখা যায়। সর্বত্র ক্যামেরা, মোবাইল হাতে উৎসাহী জনতা – তাজমহলের সঙ্গে একটি নয়, অনেক মূহুর্ত। কেউবা একা, যুগলে অথবা সপরিবারে। কেউ হাতের আঙুলে তুলছেন তাজ, অত্যুৎসাহীরা শূন্যে ঝাঁপ দিচ্ছেন তাজকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে। আমরাও ক্যামেরাবন্দী করি কিছু স্মৃতির টুকরো।
ভিড়ের ঠেলায় দ্বিতীয়দিন আর সমাধিকক্ষের ভেতরে ঢোকার সুযোগ ঘটেনা। লম্বা লাইন এঁকেবেঁকে চলে গেছে নীচ থেকে ভেতর পর্যন্ত। ঘুরে বেড়াই নীচের চত্ত্বরেই। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে নানান দিক থেকে তাজকে দেখি ছোট বড় গাছের ফাঁক দিয়ে। ফুলগুলো বাতাসে মাথা দোলায়। খানিক বিশ্রাম নিতে জুতো খুলে বসে পড়ি মসজিদের মেঝেতে। সূর্য অস্ত যায় তাজের পশ্চাৎপটে। ধোঁয়া ধোঁয়া মনকেমনের আঁধার নেমে আসে।
বাইরে বেরিয়ে এসে ছোট একটা দোকানে বসে অনেকটা চিনি দেওয়া পনেরো টাকার এক গ্লাস চা খাই। নানা আকারের নানা জিনিসের তাজের ভাণ্ডার নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা। ছোট ছোট তাজমহল কিনে নিই চেনাপরিচিতদের উপহার দেওয়ার জন্য।
তাজমহলের দক্ষিণে খুব কাছেই তাজগঞ্জের জমজমাট বাজার। এখানে নানা মানের আর দামের অজস্র হোটেল আছে। প্রায় সবারই আকর্ষণ রুফটপ রেস্টুরেন্টে তাজ ভিউ – খেতে খেতে তাজ দেখা যাবে। এই বাজার নাকি শাহজাহানের সময়েও ছিল, আর সেই জন্যই এখানে তাজমহলের তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল যাতে ভিনদেশি বণিকের মুখে-মুখে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে তাজের কাহিনি। পুবদিকে উত্তরপ্রদেশ পর্যটনের হোটেল তাজ খেমা। এদিকেই আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে আমাদের ঠিকানা।

জ্যোৎস্না রাতের তাজ দেখতে পাব কী পাব না একটা দোটানা মনের মধ্যে ছিলই। তাও সকালে টিকিট কেটে রেখে রাত্তিরে নির্দিষ্ট সময়ে একদফা চেকিং শেষে চেপে বসেছিলাম পর্যটনের বাসে। রাতের তাজমহল দর্শনার্থীদের তো কলম ম্যয় হোটেল ঘরের চাবি পর্যন্ত জমা রেখে যেতে হবে এমনই নিয়মের কড়াকড়ি। তখন রাত দশটা বেজে গেছে। নিঝুম হয়ে গেছে গোটা শহর। তাজের বাইরেও অন্ধকারে সব থমথম করছে। শুধু বেশ কয়েকটা বাস বোঝাই দর্শনার্থী আর সিকিউরিটি তাজের দোরগোড়ায়। মোটামুটি আধঘন্টার একেকটা দলের জন্য বরাদ্দ। আগের দলটা বেরিয়ে এলে আমাদের ঢোকার পালা। আমরা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাই, দেখতে পেলেন? রহস্যময় মুখে কেউ কেউ উত্তর দেন, দেখুননা ভিতরে গিয়ে। রাতের দর্শনে প্রথম প্ল্যাটফর্ম পর্যন্তই যাওয়া যাবে। কুয়াশা সরিয়ে বড় থালার মত লাল রঙের চাঁদ উঠেছে। দেখে আশা হয়। যেকোনো সময় মুগ্ধ হতে পারি এমন একটা অনুভবের উত্তেজনা মাথার মধ্যে কাজ করে। নাহ। সাদা কুয়াশারা প্রাণপনে জড়িয়ে রেখেছে তাজকে। যেন নিরেট পাথরের সাদা দেওয়াল। চাঁদের আলো আর কুয়াশার ধোঁয়ায় কেমন অপার্থিব হয়ে উঠেছে চারপাশ। মাঝে মাঝে দূরের সার দেওয়া গাছ আরও কয়েকটা দেখা যায়, পরমূহুর্তেই কুয়াশা এসে ঢেকে দেয়। হঠাৎ যেন একঝলক তাকে দেখতে পাই মনে হয়। পর মূহুর্তেই আবার ঢেকে যায়। ওই আলোতেই ছবি তোলা হয়। ছবির ফ্রেমে তাকিয়ে দেখি পেছনে আবছা অবয়বে যেন ধরা দিয়েছে সুন্দরী।

শেষপর্যন্ত

রোদ ঝলমলে তাজ দেখা হল না। নীল আকাশের পশ্চাৎপটে, শুভ্র জ্যোৎস্নায় অথবা যমুনার নীল জলের প্রতিচ্ছবিতে দেখা হল না এই শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে। মনের মধ্যে একটা আফশোস রয়েই গেল। শেষবেলায় মায়াবী তাজের চোখে চোখ রেখে স্তব্ধ হয়ে যাই। কই শেষপর্যন্ত প্রসন্নময়ীর মত বলতে পারি নাতো যে শাহজাহান তাজ না বানিয়ে সেই অর্থে কোন পতিতাশ্রম, পান্থশালা কিম্বা স্কুল-কলেজ নির্মাণ করলেই ভালো করতেন। আসলে তাজ নেই একথাটা ভাবতেই বুকের মধ্যে অনেকটা যেন ফাঁকা হয়ে যায়। তাজ – সে কি শুধুই শাহজাহানের নাকি আমাদের সবারই, আমরা যারা তাকে দেখে কোন না কোন একবার মুগ্ধ হয়েছি প্রথম প্রেমের মত। তাজের সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা, না ভালোবাসার টানাপোড়েনে দ্বিখণ্ডিত হতে হতে মনে হয় আর কি কোনদিনও আসব এ জীবনে? শেষপর্যন্ত তবে ভালোবাসারই জয় হল কি – নিজেকেই প্রশ্ন করি।

নাহলে, যাবার বেলায় এত পিছুডাকে কেন?

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
নারায়ণ সান্যাল – লা জবাব দেহলী অপরূপা আগ্রা
প্রসন্নময়ী দেবী – আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা, নব্যভারত, ভাদ্র ১২৯৪
Francois Bernier - Travels in the Mogul Empire (A.D.1656-1663) [Translated and Annoted by Archibald Constable (1891)] 2nd Edition
Ganesh Saili – Taj Mahal (Golden India)

~ আগ্রার তথ্য ~ আগ্রার আরও ছবি ~

'আমাদের ছুটি' –র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দময়ন্তী দাশগুপ্ত, বর্তমানে অন্য কোন নামী বা অনামী পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত নন। চাকরি বা ব্যবসা কোনটাই তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি, গৃহকর্মনিপুণাও নন। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি লেখার পর এখন নিজের আনন্দে মেতে আছেন গবেষণায়। প্রাণীবিজ্ঞানের স্নাতক এবং ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতোকোত্তর হবার পর বাংলায় ভ্রমণ সাহিত্যের চর্চা করছেন। এরপরে কী করবেন তা নিজেও জানেন না। তাঁর কথায় নিজের পরিচয় 'ঘরেও নাহি পারেও নাহি যে জন আছে মাঝখানে'। ২০১৫ সালের কলকাতা বইমেলায় 'পরশপাথর' প্রকাশনা থেকে তাঁর সংকলিত এবং সম্পাদিত 'অবলা বসুর ভ্রমণকথা' বইটি প্রকাশিত হচ্ছে।

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher