বেড়িয়ে এসে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যেমনভাবে শেয়ার করতে চান কাছের মানুষদের সাথে - ঠিক তেমনি করেই সেই কথাগুলো ছোট্ট করে লিখে পাঠিয়ে দিন ছুটির আড্ডায়। ছয় থেকে ছেষট্টি আমরা সবাই এই ছুটির আড্ডার বন্ধু। লেখা ডাকে বা নির্দিষ্ট ফর্মে মেল করে পাঠালেই চলবে। লেখা পাঠাতে কোনরকম অসুবিধা হলে ই-মেল করুন - admin@amaderchhuti.com

 

চিনাইবিলের সন্ধানে

এ.এস.এম. জিয়াউল হক


ছবির হাটে বসে বিকেলে আড্ডা দিচ্ছিলাম সবাই, এমন সময় জায়েদের ঘোষণা, "আগামীকাল সকালে ঢাকার বাইরে কোথাও থাকতে চাই", "কোথায়"? আমাদের সবার প্রশ্ন? "সিরাজীবাজার", জায়েদের ছোট্ট উত্তর। "সেটা আবার কোথায়"? ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে ছোট্ট একটি রেলওয়ে জাংশন, আশপাশে অনেক জঙ্গল এবং ছোট ছোট টিলা আছে। আগেরবার রেমা-কালেঙ্গা থেকে আসার পথে ওর নাকি চোখে পড়েছিল।
ব্যস, নতুন একটা জায়গা দেখার লোভ আমাদের পেয়ে বসল। তখনই ছবির হাট থেকে উঠে যার যার বাসায় রওনা হলাম রাতের ট্রেন ধরব বলে। সেই সূত্র ধরেই গত ২০ জুন চিনাইবিল থেকে ঘুরে এলাম আমরা ছ'জন।
৯:৫০ -এ ট্রেন, সবাই সময়মতো এলেও সম্রাট ভাই পারল না, শাহবাগের জ্যামে আটকা পড়ে গেছে। কী আর করা, আমরা পাঁচ জন : আমি, ফাহিম, জায়েদ, শান্তনু এবং ইমরান ট্রেনে উঠে পড়লাম। সম্রাট ভাই ফোনে জানাল, বাসে রওনা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে ট্রেনে বসে আমরা আবিষ্কার করলাম, জায়গাটার নাম আসলে শাহজীবাজার এবং ট্রেন এই জংশনে থামে না। কিছুদূর গিয়ে শায়েস্তাগঞ্জ স্টেশনে নামতে হবে।
রাত ৩:১০ -এ ট্রেন আমাদের শায়েস্তাগঞ্জ নামিয়ে দিল। ইতিমধ্যে সম্রাট ভাই পৌঁছে গেলেন। ভোরের আলো একটু ফুটে উঠলে আমরা একটা টেম্পু ঠিক করলাম শাহজীবাজার, ওয়াবদার মোড় পর্যন্ত। ছোট ছোট টিলার পাশ দিয়ে রাস্তাটা খুবই সুন্দর। ভোর ৫:২৪ -এ পৌঁছে কাঙ্খিত শাহজীবাজার। সকালের নাস্তা করে একটু সামনে এগোতেই দেখলাম রেললাইনের সঙ্গেই রয়েছে ৩৬০ আউলিয়ার এক জন, হজরত শাহ্‌ সোলেমান ফতেহ আলী (রহঃ) এর মাজার।

ভোর ৭:২৪ এ আমরা হাঁটা শুরু করলাম মাজারের উল্টো দিকের বাগানের রাস্তা ধরে। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ এবং আগের রাতের বৃষ্টিতে জংলা জায়গায় জোঁক এবং সাপের ভয় থাকলেও আমরা হাঁটতে লাগলাম। ভোরের স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতায় এবং আশপাশের সবুজ পরিবেশে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল। কিছুক্ষণ পর আমরা একটা বড় ইঁটের রাস্তায় পড়লাম। দু'পাশে জঙ্গল এবং বাগানের এই রাস্তায় এত সকালে খুব কমই মানুষ দেখা যাচ্ছিল। অনেক পাখিরও দেখা পেলাম। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধে হাঁটার পর হঠাৎ ডানদিকে গাছের ওপরে শব্দ শুনে দেখি বেশ কয়েকটি বন মোরগ। জঙ্গলের এই বাসিন্দারা এত সকালে আমাদের দেখে হয়ত একটু বিরক্তই হয়েছে। আরও কিছুদূর হাঁটতেই বাগানের এক শ্রমিককে দেখতে পেলাম অনেকগুলো কাঠ পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারলাম চিনাইবিলের কথা।
আসলে এই অঞ্চলটিতে মূলত অনেকগুলো বাগান আছে। এর মধ্যে রয়েছে টী-স্টেট, রাবার বাগান, ইউক্যালিপটাস বাগান ইত্যাদি। তার ভিতরে ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে মানুষের বসতি। কিছুদূর সামনে এগোলেই আমরা পড়ব লালচান টি-এস্টেট এর সীমানায়। লালচান টি-এস্টেট বাংলাদেশের অনেক পুরনো একটি চা বাগান এবং এর উৎপাদিত অধিকাংশ চা পাতা রপ্তানি হয় যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। প্রায় ২০০০ একর জায়গা জুড়ে এই টি-এস্টেট অবস্থিত। এখানকার ম্যানেজারের নাম ইস্কান্দার হাসান চৌধুরী, ভদ্রলোক খুবই মিশুকে। এই লালচান টি-এস্টেট-এর সীমানার মধ্যেই রয়েছে প্রাকৃতিক লেক, চিনাইবিল।
যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম লালচান টি-এস্টেট এর ফ্যাক্টরিতে। এখানে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম চিনাইবিল এর উদ্দেশ্যে।
আশপাশের পরিবেশ এবং মানুষের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারছিলাম, এখানে পর্যটকরা খুব একটা ঘুরতে আসে না। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে এই জায়গাটি কিন্তু সুন্দর। এর মাঝে আমরা ছোট্ট একটি গ্রামে পৌঁছলে শুরু হোল তুমুল বৃষ্টি। সবাই ক্যামেরা বাঁচানোর জন্য পলিথিন প্যাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি আর সম্রাট ভাই সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। তীব্র রোদের ভিতরে মুষলধারে বৃষ্টি, এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক খেলা। ছোট্ট একটি টিলার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম চিনাইবিলের পাড়ে। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড় আর তার মাঝে অপরূপ চিনাইবিল। একটি ছোট বাঁধ তৈরি করে বিলের পানিকে সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়। শীতকালে এই বিলের পানিতে অনেক অতিথি পাখিও দেখা যায়।
গোসল করার জন্য বাঁধের পানিতে নেমে পড়লাম। প্রায় ঘণ্টা দুই পানিতে থাকার পর দুপুর বারোটার দিকে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার যে পথে এসেছি সেই পথে না গিয়ে "গুচ্ছগ্রাম" এর দিকে এগোলাম। সেখান থেকে আরেকটু এগোতেই দুপুর ১:৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম তেমুলিয়া বাজার। এখান থেকে টেম্পু এবং সিএনজি ছাড়ে শায়েস্তাগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে। পথে লেকের আরও একটি শাখা চোখে পড়ল।
তেমুলিয়া বাজারে একটি ছোট্ট খাবারের হোটেলে বিশ্রাম নিলাম আমরা। সবাই ক্ষুধার্ত, কিন্তূ ভাতের কোন ব্যবস্থা নেই। অতঃপর সিঙ্গারা, নিমকি এবং চা দিয়েই পেটপুজা করতে হোল। এরপর ব্যাকপ্যাক মাথায় দিয়ে সবার ক্লান্তি নেমে এল ঘুমের রাজ্যে।
দুপুর ২:৩০ নাগাদ আমরা টেম্পু নিয়ে রওনা হলাম শায়েস্তাগঞ্জ এর দিকে। রাস্তা খুবই বাজে। শায়েস্তাগঞ্জ নেমে ভাগ্যক্রমে ট্রেনে সিটও পেয়ে গেলাম। যথারীতি ট্রেনের সিটে বসা মাত্র আবার ঘুম এবং একেবারে ঢাকা।

চমৎকার একটি ডে-ট্রিপ এর জন্য চিনাইবিল সত্যিই খুব ভালো জায়গা। বিশেষ করে বার্ড ওয়াচারদের জন্য এটি আদর্শ। তবে অবশ্যই হাঁটার মানসিকতা নিয়ে যেতে হবে। বাগানের ভিতরে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। কিছু শুকনো খাবার এবং পানি সঙ্গে রাখতে হবে। ম্যানেজারের অনুমতি সাপেক্ষে রাতে ক্যাম্পফায়ারও করা যাবে।
ঢাকা থেকে ট্রেনে অথবা বাসে করে চলে যাবেন শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে টেম্পু বা সিএনজি নিয়ে শাহজীবাজার। উল্টোভাবে তেমুলিয়া বাজার দিয়েও যেতে পারেন। তবে শাহজীবাজার যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর। শাহজীবাজার নেমে বামের রাস্তা ধরে হাঁটলে একসময় একটি গেট পাবেন। সেটার ডান পাশ থেকেই জংলা ট্রেইল চলে গেছে বাগানের ভিতরে। বড় রাস্তায় পড়লে বাগানের যে কাউকে লালচান টী-এস্টেট অথবা চিনাইবিল-এর কথা জিজ্ঞেস করলেই রাস্তা দেখিয়ে দেবে।

 

ভ্রমণপ্রেমী জিয়াউলের স্বপ্ন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে প্রকৃতি আর বিভিন্ন ধরনের মানুষের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

একটুকরো ডুয়ার্স

ঔরব দে

পুজোর ছুটিতে দশমীর দিন বেরিয়ে পড়েছিলাম ডুয়ার্সের উদ্দেশে। সকালে শান্তিনিকেতন থেকে ব্যাণ্ডেল পৌঁছে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে পরেরদিন আলিপুরদুয়ার। স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে ৩৮ কিমি দূরে রাজাভাতখাওয়া পৌঁছলাম। আমাদের রাতের বাসস্থান সংলগ্ন মামনি ট্রেকারস হাট। দুপুরে নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার ঘুরে রসিকবিল পাখিরালয়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবটা চোখে বেশ পীড়া দিল। ব্রিজ পেরোতে গিয়ে চোখে পড়ল নদীর জলে আবর্জনা ভাসছে। আগে এখানে বোটিং-এর ব্যবস্থা ছিল, এখন বন্ধ আছে। মিনি চিড়িয়াখানায় দেখা মিলল হরিণ আর চিতাবাঘের। রসিকবিল থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে এল। ফেরার পথে অরণ্যের মধ্যে গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। হেডলাইটের আলোয় দেখি রাস্তা পার হচ্ছে একদল হাতি!
পরদিনের গন্তব্য জয়ন্তী। জয়ন্তী যাওয়ার পথেও চোখে পড়ল হাতির দল গাছের ডাল ভেঙে পাতা চিবোচ্ছে। ভুটান পাহাড়ের নীচ দিয়ে জয়ন্তী নদী বয়ে চলেছে। নদীতে জল ছিল না। শুকনো খাতে নানা আকারের নুড়ি পাথরের মেলা। জয়ন্তী থেকে গেলাম বক্সা ফোর্ট দেখতে। সান্তারাবাড়ি পর্যন্ত গাড়ি। পোর্টারের কাছে মালপত্র দিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টার শব্দের মত এক ধরনের পোকার আওয়াজ শুনতে পেলাম। চার কিলোমিটার চড়াই পেরিয়ে পৌঁছলাম রোভার্স ইন-এ। এখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে আরও এক কিলোমিটার রাস্তা উঠে বক্সা ফোর্ট। ফোর্টের ভাঙাচোরা কয়েকটা দেওয়াল এখনও পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহণ করছে। ভেতরে গাছের ডালে বসে রয়েছে একজোড়া ধনেশ পাখি। ফোর্টের বিপরীতে সবুজ পাহাড় চোখ টানল অনেকক্ষণ।
সন্ধ্যেবেলা নেমে এলাম হোটেলে। মালিক ইন্দ্রশঙ্কর থাপা আমাদের নিয়ে গেলেন হোটেলের পিছনে তাঁর নিজের হাতে তৈরি ভিউপয়েন্টে। সেখানে অনেক রাত অবধি চলল আড্ডা। নিজেই গান গেয়ে, নেচে, গল্প শুনিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুললেন রীতিমতো।
পরদিন সকালে বক্সা পাহাড় থেকে নেমে রওনা দিলাম জলদাপাড়ার দিকে। পথে রায়মাটাং নদী দেখে জলদাপাড়া পৌঁছতে দুপুর হয়ে গেল। সেদিন আর কোথাও যাওয়া গেল না। প্রায় তিনঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে জিপ সাফারির টিকিট পেলাম। সকাল সাতটায় জিপ সাফারি শুরু হল। হলং বাংলোর সামনে দুটো গন্ডার চোখে পড়ল। আরও এগিয়ে একটা হরিণ আর একটা ময়ূর ছাড়া পুরো সাফারিতে আর কোন জন্তু চোখে পড়ল না।

হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম খয়েরবাড়ি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের দিকে। খাঁচার ভেতরে বাঘ-চিতাবাঘ দেখে গরুমারা অভয়ারণ্যের পথে পাড়ি দিলাম। রাস্তায় চোখে পড়ল নানান চা বাগান। দুপুর একটা নাগাদ গরুমারা পৌঁছালাম। এখানে আমাদের ঠিকানা লেক ভিউ রিসর্ট। দুপুর তিনটে নাগাদ জিপ সাফারি শুরু হল - একটা গাড়িতে ছ'জন করে ধরে। ধীরে ধীরে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলাম। কিন্তু দু'ঘন্টা অরণ্য সফর করেও এক ময়ূর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।
পরদিন সকালে মূর্তি নদীর ধারে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে চললাম শিলিগুড়ির দিকে।

 

~ ডুয়ার্সের তথ্য ~ ডুয়ার্সের আরও ছবি ~

 

ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ঔরব দে ভালোবাসেন বেড়াতে।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher