নীল দ্বীপান্তরে

দেবপ্রসাদ মজুমদার

~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~

এতকাল জন্মভূমির রূপ দেখেছি মাটির ওপর দাঁড়িয়ে। এই প্রথম আন্দামান যাওয়ার পথে সুযোগ হল নীল আকাশের পেঁজা তুলোর ফাঁক দিয়ে আমার সবুজে সাজানো জন্মভূমি দেখা। ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছলাম বীর সাভারকর বিমান বন্দরে। ঘড়িতে তখন সকাল সোয়া আটটা মতো।
বেরিয়ে দেখি আমার নাম লেখা কাগজ নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে। কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। জানলাম ওঁর নাম দীনেশ – আমাদের আগামী কয়েক দিনের গাড়িচালক তথা সফর সঞ্চালক। ফোন নম্বরটা না চাইতেই দিয়ে বললেন - প্রয়োজন হলেই জানাবেন। আমার সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে মোট দশজনের দল। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছলাম রামকৃষ্ণ মিশনে। একেবারে সমুদ্রের ধারে। এখানে একটা আবাসিক স্কুল আছে। তাছাড়া বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হয়। এখানকার বেশ কয়েকটা রুম পর্যটকদের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। চার বেডের ঘর। রুমগুলো বেশ বড়৷ সংযুক্ত না থাকলেও প্রত্যেক ঘরের জন্য আলাদা বাথরুম আছে৷ জলের ব্যবস্থাও ভালো।
ফ্রেস হয়ে নিয়ে দীনেশ ভায়াকে ফোন - আমরা তৈরি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির। বাইরে চড়া রোদ। আমাদের মাথায় টুপি, চোখে রোদচশমা আর হাত-মুখে সানস্কিন লোশনের আবরণ। যথেষ্ট পরিমাণে জল নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম - সেলুলার জেলের উদ্দেশে।
মিনিট দশেক পর পৌঁছলাম সেলুলার জেলের সামনে। দুটি বিশাল হলুদ থামের মাঝে ভিতরে ঢোকার গেট। ইংরেজ অত্যাচারের এই স্মৃতি সৌধ দেখে প্রথম দর্শনে একটা শিহরণ অনুভব করলাম। কত বীরকে যে নির্বিচারে বলি দেওয়া হয়েছে এখানে তার কি আর হিসাব আছে? দীনেশের ইশারাতে ঢুকে গেলাম জেলের ভিতরে। ঢুকেই বাঁদিকের সিড়ি দিয়ে উঠে যে ঘরে প্রবেশ করলাম সেখানে সুন্দর ভাবে সাজানো আছে বীর দেশপ্রেমীদের ছবি, যাঁরা এই জেলে বন্দী ছিলেন। বাইরে দিনরাত জ্ব্বলছে মশাল, যার গ্যাস সরবরাহ করে ইন্ডিয়ান অয়েল। মাঠের এক ধারে কয়েকশ চেয়ার পাতা। এখানে সোমবার বাদে প্রতি সন্ধ্যায় দুটি করে আলো ও ধ্বনির অনুষ্ঠান হয়। এই জেলের মাঝে একটা টাওয়ার থেকে বের হয়েছে সাতটি উইং। যেখানে সবমিলিয়ে ৬৯৮টি খুপরি বা সেল ছিল। বর্তমানে তিনটি উইং-এর ২৯৬ টি খুপরি বর্তমান। দুটি ভেঙ্গে গেছে, আর দুটি গোবিন্দবল্লভ পন্থ হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে। প্রত্যেক খুপরির সামনে মোটা লোহার রেলিং, পিছনে বেশ উঁচুতে একটা আলো আসার গর্ত। সূর্যের আলো ছাড়া অন্য কোনও আলোর ব্যবস্থা ছিল বলে মনে হলনা। খুপরিগুলো এমন ভাবে তৈরি যে বাসিন্দারা একে অন্যের মুখ দেখতে পেতনা। মাঠের এক কোণে ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি দেওয়ার আগে ঘন্টা বাজানো হত, যাতে সকলে জানতে পারে। ফাঁসিঘরের সামনে দু-কামরার বেড়ার বাড়ি, সেখানে একটি মূর্তি রাখা আছে বন্দীদের দিয়ে কী ভাবে নারকেল থেকে তেল বের করানো হত তা বোঝানোর জন্য। এক কোণে রাখা আছে ডেয়ার সাহেবের সেই কুখ্যাত কাঠের চেয়ার। যাতে বসে সাহেব তীক্ষ্ম তত্ত্বাবধান করতেন। কাজে একটু অবহেলা হলেই জুটত অকথ্য অত্যাচার। এখানে আরও দেখানো আছে শাস্তির মাত্রা অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের লোহার বেড়ি। খড়-খড়ে গা চুলকানো জামা। অপর ঘরে বিভিন্ন নেতাদের ছবি। তিন তলায় অবস্থিত বীর সাভারকার-এর কুঠুরিটা বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত আছে। টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ওপরে ওঠা যায়। দেওয়ালে মার্বেল পাথরে খোদাই করা বীর সেনানীদের নাম। কাঠের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে রস-স্মিথ-নর্থ বে সহ বিভিন্ন দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজ আমলের বন্দী-স্মৃতি আজও এখানকার মজ্জায় মজ্জায়, যা স্বদেশবাসী হিসেবে বেদনা দেয়।
পরের গন্তব্য ফিশারিজ মিউজিয়াম তথা অ্যাকোয়ারিয়াম। এখানে রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের জীবিত ও মৃত সাড়ে তিনশোরও বেশি সামুদ্রিক প্রাণী। ঢুকেই মেঝের ওপর রাখা কালো হাঙর দেখলে বেশ অবাক লাগে। পাশে রাখা বিশাল ঝিনুক।
চোখের খিদে মিটলেও পেটের খিদে তখন চরম পর্যায়ে। দীনেশ আমাদের নিয়ে গেলেন আদি বাঙালি হোটেলে। এখানে ভাত ডাল সব্জির সাথে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছও।
খাওয়া সেরে এলাম জোনাল অ্যানথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম দেখতে। মিউজিয়ামের টিকিটটা সংগ্রহ করে রাখার মত সুন্দর। এখানকার বিভিন্ন গ্যালারিতে রাখা আছে আন্দামান ও নিকোবরের নানা উপজাতির ব্যবহৃত হাতিয়ারের নিদর্শন, নানারকম বাদ্যযন্ত্র, টুপি, ছাতা, পাখা ও বিভিন্ন ধরনের গয়না। কুঁড়ে ঘরের মডেল। প্রায় তিরিশটি মডেলের মাধ্যমে জারোয়া ও অন্ন্যান্য উপজাতীয় মানুষের জীবনযাত্রার বিভিন্ন মুহূর্ত তথা মানুষ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক সহাবস্থানের ছবি। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা যাবে নানা ধরনের নৌকো ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে ঝোলানো।

বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে বিশালাকৃতির ডাব বিক্রি হচ্ছে, কুড়ি টাকা করে। ডাবের জল খেতে খেতে পি সি সরকারের সেই ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার কথা মনে পড়ছিল, জল যেন শেষই হচ্ছেনা। উপরি পাওনা নরম শাঁস। ডাবের জলে ডুব দিয়ে আমরা চললাম করবিনস কোভ বীচের দিকে। বীচ বলতেই আমাদের চোখে দীঘা -পুরী বা ভাইজ্যাগ-এর কথা মনে পরে। কিন্তু এই বীচ সেই চেনা চিত্র থেকে আলাদা, বিশেষত ঢেউ এর তাণ্ডব খুবই কম আর পরিষ্কার নীল জল। জলে নামার উপযুক্ত পোশাক থাকলে নির্দ্বিধায় নেমে পড়া যায়। করা যায় স্কুবা ড্রাইভও। কাঠের ছোট্ট টাওয়ারের ওপর উঠলে সমস্ত বীচটা সুন্দর দেখা যায়। সুনামি থেকে শিক্ষা নিয়ে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটের দেওয়াল, যার ওপর সারি দিয়ে রাখা নীল কাঠের আরাম কেদারা, কুড়ি টাকা প্রতি ঘন্টা। নারকেল বাগানের ফাঁক দিয়ে নরম রোদ পিঠে করে ঘন্টা দুয়েক যে কীভাবে কেটে যাবে বোঝাই যাবে না। যেন আনমনে মন দিয়ে ফেলা সমুদ্রকে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই দীনেশ পৌঁছে দিল রাজীব গান্ধী ওয়াটার কমপ্লেক্সে। এখানে ছোটদের বিনোদনের জন্য স্থলে এবং বড়োদের জন্য জলে নানা ধরনের ক্রীড়ার ব্যবস্থা আছে। সমস্ত অঞ্চলটা আলো দিয়ে সাজানো। আছে রাজীব গান্ধীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি – মনে হয় হাতের মালাটা যেন আমাদের দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছেন। ঘন্টাখানেক পর দীনেশভায়া ফোন করে জানাল, দাদা আপনারা গেটের বাইরে চলে আসুন লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর সময় হয়ে গেছে। দেরি না করে সবাই গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সেলুলার জেলের গেটের সামনে। দিনের আলোয় যে জেল দেখতে ভয় লেগেছিল - নিয়নের আলোয় তাতে যেন একটা মায়ার প্রলেপ পড়েছে। সন্ধ্যের প্রথম শো তখনও শেষ হয়নি। আমরা গেটের সামনে লাইনে দাঁড়ালাম, দীনেশ প্রত্যেকের হাতে টিকিট ধরিয়ে দিল। আগের শো শেষ হলে ভিতরে পাতা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আলো-আঁধারির মধ্যে বসে দিন রাতের হিসেব মেলাতে লাগলাম। সেই মশালটার অনির্বাণ দীপশিখা মনের সুপ্ত দেশাত্মবোধকে উদ্দীপ্ত করছিল। পঞ্চাশ মিনিটের এই অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হল ইংরেজ অত্যাচারের করুণ কাহিনি।
আদি বাঙালি হোটেল থেকে মাছ-ভাত খেয়ে মিশনে ফিরলাম। আগামী কাল যাব বারাটাং। এই অঞ্চলেই বাস করে আন্দামানের সেই আদিম উপজাতি - জারোয়া। বারাটাং-এ ঢুকতে বিশেষ অনুমতি লাগে।
সকাল ছ'টার মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পোর্ট-ব্লেয়ার ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল বারাটাং চেকপোস্ট-এর দিকে। রাস্তার দুধারে জনবসতিহীন অঞ্চলে সুনামির বীভৎসতা চোখে পড়ে। মাথাহীন নারকেল গাছের বাগান, ছাদহীন বাড়ি, ওল্টানো ভাঙ্গা নৌকা। আধা বন্য অঞ্চল পেরিয়ে বেলা আটটা নাগাদ পৌঁছলাম বারাটাং চেকপোস্টে। আমাদের আগে মাত্র একটি গাড়ি। বারাটাং চেকপোস্ট খুলবে ন'টায়। দিনে চার বার ৬টা, ৯টা, ১২টা ও ১৪-৩০-এ বারাটাং এর কনভয় ছাড়া হয়। গাড়ি থেকে নেমে ডান দিকে গোটা তিনেক খাবারের গুমটি তাতে ইডলি-ধোসা-কচুরি ইত্যাদি পাওয়া যায়। পাশেই রয়েছে একটা অশ্বত্থ গাছ, তার নিচে নানা ঠাকুরের মূর্তি - আর গাছে বাঁধা ছোট ছোট দোলনা। তারই পাশে একটা ঢিবির ওপর ছোট্ট মন্দির। ভিতরে কালো উজ্ব্বল পাথরের শীতলা মূর্তি। মন্দিরের সামনে ঝুলছে বেশ বড় একটা ঘন্টা। দেখতে দেখতে গাড়ির লাইন বেশ লম্বা হয়ে গেছে। আঁকা বাঁকা রাস্তার বাঁদিক ঘেঁসে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। চেকপোস্ট অফিসের সামনে লাগানো কনভয় ছাড়ার সময় সারণী আর কী কী করা যাবে না তার নাতিদীর্ঘ একটা তালিকা। ন'টা বাজতেই মাইকে সেসব ঘোষনা করা শুরু হল। একটু পরেই গার্ড-পোস্টটা উঠে গেল- আমাদের যাত্রা শুরু। একজন পুলিশ মোটর সাইকেলে চড়ে আমাদের আগে আগে চললেন। ভালো-খারাপ রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে তীর বেগে। আর আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জঙ্গলের দিকে। অবশেষে ক্ষণিকের দেখা পেলাম, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক আর তিন শিশু। গোটা শরীর সাদা ছাই মাখা, বড়োদের হাতে অস্ত্র, বাচ্চাদের হাতে লাঠি। পরে জঙ্গলের মধ্যে আরো দুজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। দীনেশের কাছে জানলাম বর্তমানে দুশো চল্লিশ জনের মতো জারোয়া আছেন। ওরা আমাদের খাবার খাননা, তবে নাকি পান খেতে ভালোবাসেন। ।

কয়েক ঘন্টা পর পৌঁছলাম জেটিতে। দেখি বড় বড় ভেসেলে মানুষ-গাড়ি সবাই উঠছে। নীল জলের ওপর সাদা ফেনার বিলি কাটতে কাটতে আধঘন্টা পরে পৌঁছলাম মিডল আন্দামানের উত্তরা জেটিতে। দীনেশ ভায়া কালুভাই-এর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে বললেন উনি আমাদের লাইমস্টোন কেভ নিয়ে যাবেন। জেটির ওপর বিক্রি হচ্ছে কুড়ি টাকা করে বড় বড় ডাব। চড়া রোদে ঠান্ডা জল ভালোই লাগলো। আরো ঠান্ডার পরশ পেতে হাত পাতলাম কুলপিওয়ালার কাছে। বোট চলে এসেছে। কুড়িজন বসা যায়। সবার লাইফ জ্যাকেট পড়া হলে নৌকা চলা শুরু করল। প্রখর দহন থেকে বাঁচতে ভরসা ছাতা বা টুপি। প্রচন্ড হাওয়ায় তাও উড়ে যাচ্ছে প্রায়। নীল জলের দুই পাড়ে ঘন ম্যানগ্রোভ গাছ। এত ঘন যে মনে হচ্ছে কেউ সবুজ কার্পেট শুকোতে দিয়েছে।
নীল জলে দোলা খেতে খেতে নৌকা অপেক্ষাকৃত কম চওড়া নালার মধ্যে প্রবেশ করল। এখানে দুটি নৌকা পাশাপাশি আসা যাওয়া করতে পারে। এই রাস্তাটি বেশ মায়াময়। দু'ধারে ম্যানগ্রোভ গাছের জঙ্গল - একটা শীর্ণ কাণ্ড থেকে অনেকগুলি সরু সরু শিকড় বেরিয়ে মাটিতে প্রবেশ করেছে, লম্বা কাণ্ডের মাথা থেকে প্রচুর শাখা প্রশাখা বের হয়ে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে। পাতার ফাঁকে ঝুলছে লম্বা লম্বা সজনে ডাঁটার মত ফল। আলো-ছায়ায় মেশানো পাতার সামিয়ানার তলা দিয়ে মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর একটা কাঠের জেটিতে উঠলাম। একজন দেখি চার্জার লাইট হাতে বললেন আপনারা কালুদার গ্রুপের লোক? আমাকে অনুসরণ করুন। বুঝলাম উনি আমাদের গাইড। রোদের মধ্যে আন্দামানের বুকে গ্রামবাংলার মাঠ - ধান চাষ হওয়া জমির আল রাস্তা, কয়েকটা কুঁড়ে ঘর পেরিয়ে প্রবেশ করলাম লাইমস্টোন কেভে। কেভের ভিতরটা বেশ অন্ধকার - গাইডের আলোই এক মাত্র ভরসা। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে মাথা তুললেই দেখা যাচ্ছে – চুনাপাথরের গা বেয়ে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে কী অপূর্ব নকসা তৈরি হয়েছে। কোনোটা পদ্মের মতো, কোনোটা শঙ্খের মতো দেখতে। ওদের কথায় ভিজে অংশ গুলো জীবিত। একটা জায়গায় দেখলাম ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে স্তম্ভের আকার ধারণ করেছে। এটা দেখতে দেখতে ভাইজ্যাগের বোরা কেভের সঙ্গে গঠনগত মিল পাচ্ছিলাম। অমিল শুধু ব্যবস্থাপনায়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আঁকা বাঁকা কাঠের সাঁকো ওপর দিয়ে হেঁটে যেখানে পৌঁছলাম, দেখি আমাদের নৌকা দাঁড়িয়ে। লাইফ জ্যাকেট বেঁধে একই পথ দিয়ে পৌঁছলাম উত্তরা জেটিতে। ঘড়িতে তখন বেলা পৌনে দুটো।

খাওয়া দাওয়া সেরে চললাম চুয়ান্ন কিমি দূরে আমকুঞ্জ বীচের দিকে। জনশূণ্য বীচে তিনটি গুমটি আর গোটা কতক কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু আছে সফেন সমুদ্রের মৃদু গর্জন আর পাড়ে পড়ে আছে বিভিন্ন ধরনের নানা আকারের কোরাল। পোর্টব্লেয়ারের মিউজিয়ামের কাঁচের আড়ালে যাদের ছোঁয়ার ছিল মানা, এখানে তাদের দুহাতে নিয়ে সেই ইচ্ছা মেটালাম। পড়ে আছে নানা আকারের ঝিনুক, কড়ি ও শঙ্খনাভি। মনে হয় সবই সংগ্রহ করি, কিন্তু কড়া নিষেধ রয়েছে আন্দামান থেকে কোরাল নিয়ে আসাতে। পাড়ে একটু জলা জায়গায় দেখলাম নানা রঙের ছোট ছোট ঝিনুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখ বুঝলে এখনও সেই দৃশ্য দেখতে পাই। একটু আওয়াজ হলেই সবাই স্থির। আবার একটু নীরবতার পর ঝিনুকগুলোর চলাফেরা শুরু। দীনেশভায়াও তাগাদা দিতে শুরু করেছে। ঘড়িতে বিকেল পৌনে পাঁচটা, আরও ঘন্টা দুয়েকের পথ বাকি।
গাড়ি মিনিট কুড়ি মত চলার পর, রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানের সামনে থামল। দীনেশ বললেন এই বীচটা দেখে আসুন। ক্লান্ত শরীরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও নামলাম। কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা - বালুডেরা বীচ। একটা গাছের গুঁড়িকে কেটে চেয়ার বানানো হয়েছে তার পাশে রাখা বিশাল একটা কোরাল - দেখতে অনেকটা তালগাছের গোড়ার মত। সমুদ্রের ধারে তীক্ষ্ণধার পাথরের ছোট্ট পাহাড়। কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি করা রাস্তা পাহাড়ের ওপর ছোট্টো কাঠের চাতালে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওখানে বসার জায়গাও আছে। সেখানে বসে সায়াহ্নের সমীরণে সমুদ্রের অশান্ত রূপ না দেখলে, সত্যিই মিস্ করতাম। পাথরে আছড়ে পড়ছে ঢেউ, জলের ছিটে লাগছে চোখে মুখে। সারাদিনের ক্লান্তি যেন সাগর মুছে দিল এক নিমেষেই। এখানেও পড়ে আছে নানা আকারের কোরাল।
মন না চাইলেও গাড়িতে উঠতে হল। সন্ধে নেমে আসছে। ডানদিকে সমুদ্রকে সঙ্গে করে আমাদের গাড়ি ছুটছে। হালকা চাঁদনি আলোয় - উত্তাল সমুদ্রের গর্জন আর তার শীতল হাওয়া চোখে ঘুমের আবেশ আনলেও দেখার ইচ্ছে চোখকে বুজতে দিলনা। সেই মায়াময় মুহূর্তকে আরও উপভোগ করতে দীনেশভায়াকে বললাম গাড়ির স্টিরিও-র গান বন্ধ করে দিন। জলের শব্দ পাড়ের নীরবতাকে গ্রাস করতে লাগল। ঘন্টখানেক ছোটার পর মায়াবন্দরের সম্রাট হোটেলে ঢুকলাম। থাকার ব্যবস্থা খুব ভালো। তবে খাওয়া দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তার ওপারেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, সেখানে সব কিছু পাওয়া যায়। দীনেশ ভায়া বলল সকাল সাতটায় গাড়ি ছাড়বে। রাতে সমুদ্রের হালকা গর্জন শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকাল সাতটায় গাড়ি ছাড়ল। মিনিট দশ পর পৌঁছলাম কারমাটাং-এর টার্টল বীচে, এটা মায়াবন্দরের বনবিভাগের অন্তর্গত। বীচের গায়ে নারকেলের বাগান। কয়েকটি এক-কামরার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কটেজ, সরকারি অফিসাররা এলে থাকার জন্য। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ঝুনো নারকেল। একজন কেয়ারটেকারকে অনুরোধ করতেই গোটাদুয়েক নারকেল ছাড়িয়ে দিলেন, খেতে খুব ভালো। মায়াবন্দরের এই সৈকতে আগে নাকি নানা রঙের মাছের ঝাঁক দেখা যেত। সুনামির পর আর তাদের দেখা যায় না। কোরালহীন বালির বীচে হাঁটু জলে নামতে ভালোই লাগল। ঘন্টাআধেক পরে গাড়ি সেই আগের রাস্তা দিয়ে ফিরে হোটেলকে বাঁহাতে রেখে নতুন রাস্তা ধরল নর্থ আন্দামান - দিগলিপুরের উদ্দেশ্যে। ঘন্টা তিনেকের পথ পাড়ি দিয়ে এগারটায় পৌঁছলাম এরিয়াল বে জেটি। এই রাস্তায় ভালো কলা পাওয়া যায়। অনুমতি ও টিকিট যোগাড় করে আমাদের দশজনের দলটা একটা ছোট্ট বোটে উঠলাম। স্বচ্ছ্ব নীল জলে সাদা আলপনা আঁকতে আঁকতে এগিয়ে চললাম রস ও স্মিথ দুই যমজ দ্বীপের দিকে। সমুদ্রের জল যে এত স্বচ্ছ হতে পারে এখানে না এলে তা বোঝা যাবে না। অনেক গভীর জলের নীচেও সূর্যের আলোয় দেখা যাচ্ছে সাদা বালি। বালির ওপর জলতরঙ্গের ছবি দেখার মত। দুই দ্বীপ সাদা বালি দিয়ে যোগ করা। ছোট্ট ছোট্ট নানা রঙের শামুকের খোল মাথায় করে কাঁকড়াগুলো চলে বেড়াচ্ছে, হাত দিলেই চুপ। বালির বাঁধের দু'দিকে একই সমুদ্র কিন্তু দুই রঙ দুই রূপ। এক দিক স্বচ্ছ শান্ত, অন্যদিকে যেন কে নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে তেমনি অশান্ত। এই নীল জলে নাইতে নেমে পড়লাম সবাই মিলে। সমুদ্র থেকে উঠে পাড়ে এসে আবার মিষ্টি জলে স্নান। ছোট ছোট পাতার ঘরে জামা কাপড় ছাড়ার সুব্যবস্থা আছে।
২-২০ তে গাড়ি ছাড়ল রঙ্গতের উদ্দেশ্যে। রঙ্গতের বাজারে কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে ভাত খেলাম। বড় বড় নারকেল বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা করে, ডাব কিন্তু ২০ টাকা করে। আমার মেয়ের হিসাব মত ১০৫টি সিঁড়ি বেয়ে সন্ধ্যায় দর্শন করলাম মা কালী। আরো মিনিট চল্লিশ যাওয়ার পর হোটেলে পৌঁছলাম।

দীনেশ জাহাজের টিকিট হাতে দিয়ে বললেন সকাল সোয়া ছটায় জাহাজ ছাড়বে। ভোরে উঠে গাড়িতে একেবারে জেটির মধ্যে ঢুকে গেলাম। সকালে সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় স্থলযান ছেড়ে জলযানের দিকে পা বাড়ালাম। দীনেশের সঙ্গে আবার দেখা হবে দু'দিন পর পোর্টব্লেয়ারে। জাহাজে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। ক্যাপ্টেন নাম ও পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে তবেই জাহাজে ওঠার অনুমতি দিচ্ছেন। জাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নেমে শীততাপনিয়ন্ত্রিত সংরক্ষিত চেয়ারে বসলাম। উত্তর আন্দামান থেকে পোর্টব্লেয়ার ফিরব জল পথে। এখন যাচ্ছি হ্যাভলক দ্বীপে। জাহাজ চলতে শুরু করলে বসে থাকতে আর ইচ্ছে করল না। উঠে এলাম ছাদে। রঙ্গতের জেটি নীল সাগরের বুকে মিলিয়ে যেতে লাগল। জাহাজের পিছনে তৈরি হচ্ছে দুগ্ধফেননিভ ক্ষণিকের রাস্তা। ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে যেখান থেকে জাহাজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সেই কেবিনটা দেখলাম। দেখলাম কিভাবে কম্পাসের সাহায্যে দিগন্তবিহীন জলরাশির মধ্যে দিগভ্রান্ত না হয়ে গন্তব্যের দিকে চলেছে। প্রায় তিন ঘন্টা যাওয়ার পর জাহাজ একটা দ্বীপের কাছে গিয়ে থামলে মাইকে ঘোষণা হল কেউ ছবি তুলবেন না। কিছুক্ষণ পরে একটা নৌকা করে পুলিশ সহ কয়েক জন উপজাতীয় লোক এসে দুই শিশুসহ এক মহিলাকে জাহাজে তুলে দিলেন। সকলেই সভ্য পোশাকে। এরা ওঙ্গি প্রজাতির। জাহাজে এদের বসার জায়গাও আলাদা। জাহাজ আবার চলতে শুরু করল। কৌতুহল চাপতে না পেরে সিঁড়ি বেয়ে ওদের দেখে এলাম। দেখি বাঙলাতে কথা বলছে। এরপর উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক দেখতে দেখতে চার ঘন্টার পথ যেন এক পলকে পাড়ি দিলাম। পৌঁছলাম হ্যাভলক - সূর্যোদয়ের দ্বীপে। প্রকৃতি যেন কোরালের কোলাজ করা নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে আমাদের করছে আহ্বান।
দীনেশের কথা মত গেটের বাইরে কেশব দাঁড়িয়ে। দুটো ছোট গাড়িতে চেপে পৌঁছলাম রাধাকৃষ্ণ রিসর্টে। নারকেল বাগানের মধ্যে কুঁড়ে ঘর। ভিতরে কিন্তু চেহারা আলাদা। রাস্তা পার হয়ে সিসেল রিসর্টের ভিতর দিয়ে বীচে যাওয়া যায়। গাছের নিচে কাঠের আরামকেদারায় বসে সমুদ্র দেখা - কচি কলাপাতার মত সবুজ কোথাও নীল জলের কোলাজ। সেই জলের ওপর কোথাও একপায়ে কোথাও একসঙ্গে শুয়ে বসে আছে ম্যানগ্রোভ গাছ। যেন সুন্দরীর কপোলে অলক পড়ে রচনা করেছে আলোক-সুন্দর। সন্ধ্যায় হেঁটে ঘুরে এলাম হ্যাভলক বাজার। এখানে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালিদের বাস।
পরদিন সকালে হ্যাভলক জেটির কাছে একটা বোট ভাড়া করে চললাম এলিফ্যান্টা। এখানে নীল জলে ছোট-বড় নানা নৌকা একটা ক্যালেন্ডারের মত ছবি তৈরি করেছে। কোথাও না গিয়ে এখানে বসেই সময় কেটে যায়। হাতির শুঁড়ের মত একটা পাহাড়কে বাঁ হাতে রেখে পৌঁছলাম এলিফ্যান্টায়। জলের যে এত সুন্দর রঙ হতে পারে এখানে না এলে বোঝা যাবেনা। সুনামিতে উপড়ে যাওয়া শুকনো গাছে লাগছে ঢেউ। জাল ফেললেই উঠে আসছে নানা রকমের ছোটো ছোটো মাছ। এখানে গ্লাসবটম বোট ভাড়া করে আধঘন্টা ধরে দেখলাম জীবন্ত-মৃত নানা রঙের কোরাল। ছোট ছোট রংবেরঙের মাছের ঝাঁক, নাম না-জানা বড় মাছ। এ যেন ঈশ্বরের অ্যাকোয়ারিয়াম। ফেরার সময় জোয়ার এসেছে, তাই বোট চালক ঠিক করে লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিতে বললেন সবাইকে। ছোট বোটে বড় ঢেউয়ের তান্ডব ভয় পাবার মতই বটে। জলের ঝাপটায় সবাই কাকভেজা হয়ে গেলাম।

চলে এলাম সাদা বালির রাধানগর বীচে। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে জনসমাগম ভালোই। স্বচ্ছ জলে সাগর স্নান উপভোগ করার মত। পাড়ে ১০ টাকা দিয়ে মিষ্টি জলে স্নানের ব্যবস্থা আছে। রাধাকৃষ্ণ রিসর্টে মাছ ভাত খেয়ে ফিরে এলাম জেটিতে। কেশবকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লাম কোস্টাল ক্রুইজে। ছাড়বে সাড়ে তিনটায়। এর ভিতরটা অনেকটা বিমানের মত। একটু দাম বেশি হলেও পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের খাবার। দু-একটা চেখে দেখাও হল। নীল জলে ফেনার সাদা আলপনা কাটতে কাটতে পাঁচটায় পৌঁছলাম নীল দ্বীপে।
ছোট্ট একটা জেটি, বাইরে এসে ফোন করে এখানকার গাইড হেমন্তকে পাওয়া গেল। উনি বাজারের মধ্যে একটা লজে আমাদের নিয়ে গেলেন। ঘরগুলো বড় হলেও তেমন গোছানো নয়। সন্ধ্যায় বিবেকানন্দ মেলা দেখলাম।
পরদিন সকালে গেলাম ভরতপুর বীচে। পাড়ে বিক্রি হচ্ছে আন্দামান লেখা গেঞ্জি, প্রবাল, মুক্তো ও নানা ধরনের সৌখিন সামগ্রী। এখানকার কোরাল আর রঙিন মাছ নাকি দেখার মত। দাম-দর করে গ্লাসবোট ভাড়া করা হল। এলিফ্যান্টার মতই সব কিছু, তবে ভাঙ্গা লাইট হাউস এর নিচে মাছের যে ঝাঁক দেখলাম সে যেন ঈশ্বরের ঐশ্বর্য। এখান থেকে গেলাম ন্যাচারাল ব্রিজ দেখতে। বড় একটা পাথরের মাঝখানটা ক্ষয়ে গিয়ে ব্রিজের আকার ধারণ করেছে। গাইড আমাদের স্পর্শ করালেন জ্যান্ত কোরাল, হাতে দিয়ে দেখালেন স্টারফিস। আমরা দোষীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, আমরণ দীপান্তরের কথা শুনেছি, কিন্তু সুন্দর প্রকৃতির বুকে বড় বড় ঝিনুকের আমরণ বন্দীদশা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঝিনুকগুলোর চার ধার পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে। মুখ যখন খুলছে তখন ময়ূরকন্ঠী নীল রঙের মাংসল অংশ দিনের আলোয় মুক্তোর দানার মত চক চক করছে। গাইড বললেন ওর মধ্যে মুক্তো পাওয়া যায়। এখানে দেখলাম নানা ধরনের কাঁকড়া আর বিভিন্ন ধরনের মাছ যাদের গভীর জলে দেখেছিলাম বিভিন্ন জায়গায়। এখন ওরা ক্ষণিকের বন্দী পাথরের গর্তে। আবার বড়ো ঢেউ এলে মিশে যাবে বৃহতের ঝাঁকে। চারটেয় জাহাজ। আজ ফিরব পোর্টব্লেয়ারে। হেমন্তদা টিকিট দিয়ে আমাদের জাহাজে তুলে দিলেন। উড়ুক্কু মাছ দেখতে দেখতে সূর্য তলিয়ে গেল দিগন্ত রেখায়। সন্ধ্যে ছটায় পৌঁছলাম পোর্টব্লেয়ারে। গেটের বাইরে গাড়ি নিয়ে দীনেশ দাঁড়িয়ে।
পরদিন প্রথমেই দেখলাম ন্যাভাল মেরিন মিউজিয়াম- সামুদ্রিকা। এই মিউজিয়ামের প্রায় সাড়ে তিনশো রকমের জীবিত ও মৃত মাছ আর কোরালের এক অনবদ্য সংগ্রহ এই ক'দিনের গভীর জলে দেখার ক্ষণিক স্মৃতিকে আরও সমৃদ্ধ করে। তারপরে গেলাম চ্যাথাম স মিল - এশিয়ার প্রাচীনতম কাঠের মিল। এককামরার সংগ্রহশালায় কাঠের তৈরি নানান শিল্প সামগ্রী দেখার মত। দুপুর তিনটেয় গাড়ি ছাড়ল মুণ্ডাপাহাড়ের দিকে। এক ঘন্টারও বেশি পথ। রাস্তার দুধারে কাজু বাদামের গাছ। পনেরটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে জাতীয় উদ্যান। বিশাল জলাশয়ের গায়ে পাহাড়, তার চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখা সূর্যাস্ত স্মৃতির সরণীতে রেখে দেওয়ার মত।
পরদিন সকালে গাড়ি ছাড়ল সাড়ে ছটায়, যাওয়া হবে জলিবয়। ঘন্টা দেড়েক যাওয়ার পর গাড়ি থামল গান্ধী জাতীয় উদ্যানের বিশাল বটগাছের তলায়। দীনেশ দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি পত্র নিয়ে টিকিট কাটতে গেলেন। এখানে প্লাস্টিক সামগ্রী নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। পানীয় জল নেওয়ার জন্যও ফ্লাস্ক ভাড়া করতে হয়। ব্যাগ ভালো ভাবে চেক করে লঞ্চে উঠতে দেওয়া হচ্ছে। পঁচিশ-তিরিশ জনকে নিয়ে লঞ্চ ছাড়ল। দু'পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল আর নীল জলের ওপর দিয়ে লঞ্চ ধীরে ধীরে চলল। চল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ পড়ে। এই অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের বুকে প্রায় ৫৭২ টির মত দ্বীপ আছে। তার মধ্যে ১৩০টিতে মানুষের যাতায়াত আছে এবং মাত্র ৩৬ টিতে গড়ে উঠেছে জনবসতি। এই জলিবয়ও এই রকমই একটা দ্বীপ যাতে কোনও বসতি নেই। পর্যটকরা যান শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে। জলের এত বর্ণময় রূপ হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। যেন ঈশ্বর রঙের পাত্রে বিভিন্নরকমের নীল নিয়ে বসেছেন ছবি আঁকতে। আর জলের নিচে বিভিন্ন রঙের কোরাল, স্টার ফিস, সী কিউকাম্বার - সারিবদ্ধ ঝাঁক ঝাঁক মাছ। গ্লাস বটম বোটে করে মাছ- কোরাল দেখছি, এমন সময় গায়ে কালো-হলুদে ডোরাকাটা এক ঝাঁক টাইগার ফিস জলকে হলুদ করে আবার মিলিয়ে গেল। যেন এক পলকের পুলক জাগিয়ে পালিয়ে গেল অতল জলে। এখানে নিখরচায় স্নর্কেলিং করা যায়। কিন্তু কোনো মিষ্টি জলে স্নানের ব্যবস্থা নেই। সাদা বালির ওপর পড়ে আছে অজস্র কড়ি-ছোট শঙ্খ।
ফিরে যখন এলাম বেলা দুটো বেজে গেছে। হোটেলে খেলাম মাছের টক দিয়ে ভাত। পাশের ছোট্ট দোকানে পাওয়া যাচ্ছে আন্দামানবাসীদের হস্তশিল্পের নমুনা নানা সৌখিন সামগ্রী। নারকেল খোলের কাপ দেখার মত। এখান থেকে গেলাম ওয়ান্ডুর - দিনমণির দহনে এই বীচ নির্জন। গাছের ছায়ায় বিক্রি হচ্ছে ডাব। বেশিক্ষণ না থেকে চলে এলাম মংলুটন রাবার প্ল্যান্টেশনে। রাস্তার এক দিকে রাবার গাছের বাগান ও নীল বাক্সে মৌমাছির চাষ। অন্য দিকে নানা মশলা ও ওষধি গাছ। খাবার পাতে যাদের স্বাদ পাই, গাছে তাদের দেখতে পেয়ে ভালোই লাগলো। পাশে দুধ-সাদা তরল থেকে তৈরি হচ্ছে রাবারের চাদর। কয়েক জন মহিলা সুপারি ছাড়াতে ব্যস্ত। অফিসের শোরুম থেকে পাওয়া যায় মশলা, টাটকা মধু। এবার সকলের অনুরোধে দীনেশ নিয়ে চললেন মার্কেটিং-এ।
শেষ দিনে আমরা যাব তিন দ্বীপ। অশান্ত সমুদ্রে লঞ্চ ছাড়ল সাড়ে ন'টায়। প্রথমে গেলাম ভাইপার - এখানে বন্দীদের আমরণ দীপান্তর, ফাঁসি দেওয়া হত। মিনিট পনেরো থাকার পর এলাম রস আইল্যান্ডে। ইংরেজদের বিলাসিতায় পূর্ণ, বর্তমানে বসতিহীন এই দ্বীপে চার্চ, মুক্ত চিড়িয়াখানা দেখার মত। শেষ গন্তব্য নর্থ-বে দ্বীপ। কোরালে ভরা পাথুরে বীচে জল-ক্রীড়ার সমস্ত সামগ্রী বর্তমান। পাহাড়ের টিলায় আছে লাইট হাউস। ফেরার পথে প্রচণ্ড দোলা খেতে খেতে মনও দুলে উঠছিল আন্দামানকে ছেড়ে যাওয়ার দুঃখে। মনে মনে বলি, আবার ফিরে আসব।


~ আন্দামানের তথ্য ~ আন্দামানের আরও ছবি ~

রামকৃষ্ণ মিশন, বেলুড় বিদ্যা মন্দিরে গণিতে স্নাতক পাঠক্রমের সময় সত্যব্রত মহারাজের হাত ধরে ঘরের বাইরে যাওয়া শুরু হয় দেবপ্রসাদ মজুমদারের। IIEST, Shibpur, এর Ph.D. গাইড সেই নেশায় আরও উৎসাহ দেন। বর্তমানে ভ্রমণ নিয়ে লেখার নেশায় মেতে উঠেছেন। 'আমাদের ছুটি' ভ্রমণ পত্রিকার হাত ধরে পূরণ হল সেই ইচ্ছে। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা।

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher