রাজার দেশে কয়েকদিন

শ্রীতমা বিশ্বাস

~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~

তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে রবিকিরণের এক অপূর্ব মেলবন্ধনে উদ্ভাসিত চারিদিক। পর্বতশিখর থেকে বয়ে আসা এক ঝলক সতেজ হিমেল হাওয়া মুহূর্তেই ঝরিয়ে দিল পথের সব ক্লান্তি। প্রায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় দোচু লা – গিরিপথ। বৌদ্ধ স্থাপত্যের গভীর নৈঃশব্দ্য, পাহাড়ের এক আশ্চর্য নির্জনতা আর প্রকৃতির অনবদ্য সৌন্দর্য মনকে ধীরে ধীরে যেন গ্রাস করে।
রুটিনমাফিক নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝেও ভ্রমণ পিপাসু মন বেরিয়ে পড়েছিল প্রকৃতির হাতছানিতে। গন্তব্য ভুটান। ভারত-ভুটান সীমান্ত শহর জয়গাঁও-ফুন্টসোলিং পেরিয়ে পারমিট করে সোজা ভুটানের রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশে যাত্রা শুরু হল। রাজার দেশে পা রাখলাম আমরা। যদিও সে দেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিক সরকার, রাজার উপস্থিতি এখনও ভালোভাবেই অনুভব করা যায় সর্বত্রই।
পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। উচ্চতা যত বাড়ছে, ঠাণ্ডাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে, বদলাচ্ছে প্রকৃতিও। রাস্তার দুপাশে পাইন গাছের সমারোহ, নাম না জানা রঙবেরঙের বনফুল আর ঝরনাধারার ঝিরিঝিরি। প্রকৃতি যেন দু'হাত ভরে সাজিয়েছে দেশটাকে। পাহাড়, নদী, ঝরনা আর অরণ্যে মোড়া সে যেন এক অবাক রূপসী। চলতে চলতে মাঝে মধ্যেই একরাশ মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে আশেপাশের দৃশ্যপট। ঘন কুয়াশার জাল কেটে সাবধানে আঁকা বাঁকা পথে চলেছে গাড়ি। দিনের শেষে প্রায় ১৮০ কিমি পথ পেরিয়ে থিম্পুতে পৌঁছলাম।

পরেরদিন থিম্পু শহর সফরে বেরোলাম। পাহাড়ের চূড়ায় বিশালকায় এক স্বর্ণাভ বুদ্ধমূর্তি আর তার সন্নিকটে নজরকাড়া ভিউপয়েন্ট। এখান থেকে নীচে পাহাড় ঘেরা শহরটাকে ছবির মত সুন্দর দেখায়। এরপর সারাদিন ধরে ঘুরে ঘুরে থিম্পু মিউজিয়াম, পেন্টিং স্কুল, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, চিড়িয়াখানায় জাতীয় পশু 'টাকিন' এসব দেখা হল।
এর পরের গন্তব্য পারো। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন, কোলাহলমুক্ত ছোট্ট পাহাড়ি শহর। অপূর্ব কারুকার্যময় ঘরবাড়ি আর বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান। পথের ধারে চোখে পড়ল ছককাটা ধানক্ষেত, সবুজ আপেল বাগানে গাছে গাছে ঝুলছে লাল টুকটুকে আপেল। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট পারো এয়ারপোর্টটি দেখার মতন। পারো মিউজিয়ামে সাজানো ভুটান রাজাদের বংশ পরম্পরায় ব্যবহৃত রণবেশ, যুদ্ধাস্ত্র ও দৈনন্দিন সাজসরঞ্জাম অতীতের ভুটান সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করছে। এখানকার অসাধারণ এক বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন পুনাখা জং। সামনেই দুই নদী – ফো-চু আর মো-চু-র সঙ্গমস্থল বনভোজনের এক মনোরম পরিবেশ।

আমাদের শেষ গন্তব্য প্রায় ১৫০০০ ফুট উঁচ্চতায় চেলা লা গিরিপথ ও চিন সীমান্তে ভুটানের শেষ গ্রাম হা। পথ পেরোতেই পাহাড়ের ঢালে শ্বেতশুভ্র বরফাবৃত চিরহরিৎ পাইনের সারি। হা ভ্যালিতে পৌঁছে যেন ফিরে গেলাম হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দিনগুলিতে। বরফের মধ্যে লুটোপাটি, বরফ ছোঁড়াছুঁড়িতেই কেটে গেল কয়েকঘন্টা। যেন এক বাঁধনহারা আনন্দ। ফিরে আসতে ইচ্ছে করে না।
পারোতে এক পাহাড়ের ঢালে আমাদের ছোট্ট কটেজ। একদিকে বইছে পারো-চু নদী আর তাকে ঘিরে সবুজের সান্নিধ্য। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে এল। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট বাড়িগুলো জোনাকির মত ঝিকমিক করছে। নিসর্গের এক নিরাভরণ, অদ্ভুত মাদকতায় ভরা পারোর অনির্বচনীয় নির্জন সৌন্দর্য। নিস্তব্ধতারও যে একটা মিস্টি শব্দ আছে তার থেকে ব্যস্ত কোলাহলময় শহুরে জীবন চিরকালের জন্য বঞ্চিত। আর সেই 'সাউন্ড অফ সাইলেন্স'-এর মায়াবী আবেশে আমরা তখন সকলেই আচ্ছন্ন।
কাল ফিরে যাওয়া হবে শহরের কোলাহলে। শুরু হয়েছে মনকেমনের পালা।


~ ভুটানের তথ্য ~ ভুটানের আরও ছবি ~

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কল্যাণী, নদীয়া) কৃষিবিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রী শ্রীতমা সুযোগ পেলেই পরিজনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন প্রকৃতির হাতছানিতে, তাঁর অবসর বিনোদন ছবি তোলা, বই পড়া, গান শোনা আর শখের লেখালেখি।

 

 

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher