ঘরের কাছের সাজানো গোছানো বিদেশ ভুটান। হিমালয় পর্বতের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই দেশের একপাশে ভারত এবং অন্যপ্রান্তে চিন। পাহাড়-পর্বতে সমৃদ্ধ এই দেশটি ছোট ছোট নদীগুলিরও উৎপত্তিস্থল। হিমেল হাওয়ার পরশ, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, পাহাড়ি ফুল, ঝোরা – সবমিলিয়ে অনবদ্য এই রাজা-রানির দেশের স্থানীয় নামটিও যেন উঠে এসেছে রূপকথার থেকেই – ‘দ্রুক গিয়াল’ অর্থাৎ বজ্রড্রাগনের দেশ।
ফুন্টশোলিং (Phuntsholing) - ভারতের সীমান্ত শহর জয়গাঁও পেরিয়ে বজ্রড্রাগন আঁকা বিশাল তোরণদ্বারের ওপারে সাজানো গোছানো ঝকঝকে শহর ফুন্টশোলিং - ভুটানের এন্ট্রিপয়েন্ট। চুখা ডিস্ট্রিক্টের অন্তর্বর্তী এই জায়গাটি ভুটানের একটি অন্যতম প্রশাসনকেন্দ্র। দোকানপাট-বাজারহাট নিয়ে বেশ জমজমাট শহর। ৪ কিলোমিটার দূরে খারবন্দি পাহাড়ে গাছপালায় ঘেরা শান্ত নির্জন পরিবেশে বৌদ্ধগুম্ফাটি ঘুরে দেখতে ভালোলাগে। ওপর থেকে নীচে ছড়ানো উপত্যকায় ভারতের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ছবির মতো দেখায়। প্রথম ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট রিনচেনডিং।
থিম্পু (Thimpu) - প্রাচীন এই নগর দেশের রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। ভুটানের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র এই শহর কিন্তু মূলতঃ কৃষিনির্ভর। ক্লকটাওয়ারকে কেন্দ্র করে বাড়িঘর, দোকানপাট, হোটেল -রেস্তোঁরা নিয়ে থিম্পু শহর। থিম্পু বেড়িয়ে নিতে একটা দিন লেগে যাবে। শহরের মাঝে ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্তেন। আকাশছোঁয়া শ্বেতসৌধের শরীরে সোনালী কারুকাজ। সোনায় মোড়া চোর্তেনের চুড়ো ঝলমল করে সকালের রোদ্দুরে। বর্তমান রাজা জিগমে খেসর নামগিয়াল ওয়াংচুকের ঠাকুরদাদা প্রয়াত রাজা জিগমে দোরজি ওয়াংচুকের স্মরণে চোর্তেনটি ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। ১২ শতকে তৈরি ভুটানের প্রাচীনতম মনাস্ট্রি চাংঘাংখা। পাহাড়ের মাথায় আর এক নির্জন মনাস্ট্রি ফোদং। এই মনাস্ট্রির ভিতরে ছবি তোলা বারণ।
থিম্পু চিড়িয়াখানায় দেখতে হবে ভুটানের জাতীয় পশু টাকিন - এযেন সুকুমার রায়ের কল্পনায় ব্যাকরণ না মেনে তৈরি হওয়া ছাগরু – ছাগলের মতো মাথা আর গরুর মতো শরীর নিয়ে এক অদ্ভুত চেহারার প্রাণী। লুপ্তপ্রায় এই প্রাণীটি শুধুমাত্র ভুটান, নেপাল, চিন ও মায়ানমারে দেখতে পাওয়া যায়। চিড়িয়াখানার একটু ওপরে ভিউপয়েন্ট।
থিম্পুর প্রধান আকর্ষণ তাশিহো জং আর লাগোয়া সার্ক বিল্ডিং। তাশিহো জং-এর অভ্যন্তরেই ভুটানের রাজদরবার ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলি রয়েছে। একমাত্র উৎসবের সময় সকলের জন্য প্রবেশ অবাধ করা হয়। অন্যান্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে রাজবাটি, মহিলা পরিচালিত মনাস্ট্রি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি, হ্যান্ডিক্রাফট সেন্টার, মিউজিয়াম, আর্ট স্কুল প্রভৃতি। সার্ক বিল্ডিংটি থিম্পু নদীর ওপারে। প্রত্যেক শনিবারে থিম্পুতে সাপ্তাহিক বাজার বসে।
পুনাখা (Punakha) - ৪,৩০০ ফুট উচ্চতায় ভুটানের প্রাচীন রাজধানী পুনাখা। থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার পথে পড়বে ১৬২৯ সালে তৈরি ভুটানের সবচেয়ে প্রাচীন সিমতোখা জং। বর্তমানে এটি জোংখা ভাষার মহাবিদ্যালয়। থিম্পু থেকে হোংসুগোয়েম্বা ছুঁয়ে ২৭ কিলোমিটার দূরে ১০,০০০ ফুট উচ্চতার দোচু লা। দোচু লা পেরিয়ে ওয়াদিং ফোদরং উপত্যকার কোলঘেঁষে পথ নেমেছে পুনাখায়। ১০৮টি চোর্তেন আছে দোচু লায়।
থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার জন্য পারমিট লাগে। শহরের মাঝে বিশালাকার মনাস্ট্রি। দূর থেকেই রঙিন রঙিন প্রেয়ারফ্ল্যাগগুলো চোখে পড়ে। পুনাখার প্রধান দ্রষ্টব্য ফোচু আর মোচু নদীর সঙ্গমে গড়ে ওঠা সুবিশাল এই পুনাখা জং। ১৬৩৭ সালে তৈরি এই জং-এর অপর নাম ফুলতাং দেছেং ফোদং। ঢুকেই বিশাল চত্ত্বরে সাদা রঙের বেদি, পাশেই সাদা রঙের চোর্তেন। বৌদ্ধিক শিল্পরীতির ঘর-দালান পেরিয়ে স্কুল, মনাস্ট্রি।
পুনাখায় রাত্রিবাস না করে থিম্পু থেকে সারাদিনের সফরে দোচু লা, পুনাখা ও ওয়াংডু ফোদরাং জং ঘুরে আসা যায়। ওয়াংডু থেকে বুমথাং হয়ে আগ্রহীরা রওনা দেন থোলে লা-র উদ্দেশে - ‘গাংকর পুনসুম’ ট্রেকপথে। ২৪,৮৩৭ ফুট উঁচু ‘গাংকর পুনসুম’ ভুটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ –পৃথিবীর সবথেকে উঁচু স্থান-ও যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি।
পারো(Paro) - থিম্পু থেকে একঘন্টার দূরত্বে ৭,৫০০ ফুট উচ্চতায় পারো নদীর কোল ঘিরে পারো উপত্যকা। পারো আশপাশে বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান পেয়েছে। এখানের রিমপু জংটি আগের জংগুলির মতো অত বড় না হলেও ঘুরে দেখতে বেশ ভালো লাগে। কিছুটা ওপরে উঠে পারো মিউজিয়াম। একসময়ের তাজং দুর্গটিই বর্তমানে জাতীয় মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ডাকটিকিট ও প্রাচীন মুদ্রার সংগ্রহ বেশ চমকপ্রদ। এখান থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে তিব্বত সীমান্তে ড্রুকগিয়াল জং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। দুর্গ থেকে নেমে পৌঁছতে হবে কিচু মনাস্ট্রি। মনাস্ট্রির ভিতরের কমলালেবুর গাছগুলিতে সারাবছরই ফল ধরে। মনাস্ট্রির মূল কক্ষে গুরু পদ্মসম্ভবের বিশালকায় একটি মূর্তি আছে। হাতে সময় থাকলে ট্রেক করে আসা যায় পাহাড়ের মাথায় তাকসাং গুম্ফা থেকে – কষ্টসাধ্য পথের জন্য এই গুম্ফার প্রচলিত নাম –‘বাঘের বাসা’ –‘টাইগার’স নেস্ট’! পারোতে রবিবারে থাকলে সাপ্তাহিক বাজারটি ঘুরে দেখতেও ভালোলাগবে। আবহাওয়া ভাল থাকলে পারোর পথে চলতে ফিরতে চোখে পড়বে ভুটান ও তিব্বতের বাসিন্দাদের কাছে অতি পবিত্র পর্বতমালা ‘চোমো লহরি’ (২৪,০৩৫ ফুট) - পারো থেকেই ট্রেক পথ গিয়েছে ‘ভোন্টে লা’ –চোমো লহরি বেস ক্যাম্পে।
যাওয়াঃ- সড়কপথে গেলে ভুটানের এন্ট্রিপয়েন্ট তিনটি – সামদ্রুপ জোংখার (দক্ষিণ-পূর্ব ভুটান), গেলেফু (দক্ষিণ ভুটান) ও ফুন্টশোলিং (দক্ষিণ-পশ্চিম ভুটান)। একমাত্র বিমানবন্দর পারো শহরে। সাধারণভাবে সড়কপথে গেলে ফুন্টশোলিং হয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক। ট্রেনে নিউজলপাইগুড়ি অথবা আলিপুরদুয়ার পৌঁছতে হবে। স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস বা ভাড়া গাড়িতে ফুন্টশোলিং পৌঁছান যাবে। ফুন্টশোলিং থেকে আবার বাসে বা ভাড়ার গাড়িতে থিম্পু বা পারো যাওয়া যায়।
থাকাঃ- থিম্পুতে প্রচুর ভালো হোটেল আছে। পারো ও পুনাখায় হোটেল সংখ্যা তুলনায় কম।
উৎসবঃ- সারাবছরই ভুটানের বিভিন্ন স্থানে উৎসব লেগে থাকে। এপ্রিল মাসে পারোতে শেচু উৎসব, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভুটানে ভ্রুপচেন উৎসব, অক্টোবরে থিম্পুতে শেচু উৎসব ও মার্চে পুনাখায় ভমচে উৎসব হয়।
মরসুমঃ- অক্টোবর থেকে এপ্রিল ভুটান বেড়ানোর ভালো সময়। এখানে বর্ষায় খুব বৃষ্টি হয়। শীতেও ঠান্ডার প্রকোপ বেশ বেশি।
কেনাকাটাঃ- ভুটানের হস্তশিল্পের খ্যাতি আছে। থাঙ্কা ও মুখোশ সংগ্রহ করা যায়। তবে দাম বেশ চড়া। থিম্পু জি.পি.ও. থেকে ভুটানের রঙচঙে পোস্টাল স্ট্যাম্পও সংগ্রহ করা যায়।
কিছু টুকিটাকিঃ- ভারতীয়দের ভুটানে যেতে ভিসা লাগেনা - তবে পারমিট লাগে। সঙ্গে পরিচয়পত্র হিসেবে ভোটার আই.ডি. কার্ড বা পাসপোর্ট রাখুন। সড়কপথে ভুটানে প্রবেশ করলে এন্ট্রিপয়েন্টগুলিতে এবং আকাশপথে এলে পারোতে পারমিট করাতে হবে। শনি ও রবিবার ইমিগ্রেশন অফিস বন্ধ থাকে। পারমিটের জন্য সড়কপথের ক্ষেত্রে চারটি এবং পারোতে করলে দুটি পাসপোর্ট মাপের ছবি লাগবে। প্রাথমিকভাবে ভারতীয় নাগরিকদের ১৪ দিনের পারমিট দেওয়া হয়। প্রয়োজনে থিম্পু থেকে সেটি বাড়িয়ে নেওয়া যায়। কলকাতায় রয়েল ভুটান কনসুলেট থেকে শুধু থিম্পু এবং পারো-র পারমিট দেওয়া হয়। যোগাযোগঃ রয়েল ভুটান কন্স্যুলেট অফিস, টিভোলি কোর্ট, ১ এ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, কলকাতা - ৭০০০১৯। সোম থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে পারমিটের আবেদন জমা নেওয়া হয়। ভারত, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ ব্যতীত অন্যান্য দেশের নাগরিকদের ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য কেবলমাত্র কোনও ভুটানি ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদন মঞ্জুর হলেও ভিসা হাতে পাওয়া যাবে সশরীরে পারো বা ফুন্টশোলিং পৌঁছানোর পরই।
ভুটানের সর্বত্র ভারতীয় টাকা গৃহীত হয়। স্থানীয় কারেন্সি নগুলত্রাম ও টাকার বিনিময় মূল্য সমান। তবে ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট নিয়ে অনেক সময় মুশকিল হতে পারে। ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করাও অসুবিধাজনক হতে পারে। ভুটানে বেড়ানোর কয়েক দিনের জন্য সাময়িকভাবে স্থানীয় মোবাইল ফোনের সংযোগ নিয়ে নিলে ইন্টারন্যাশনাল কল করার খরচ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। থিম্পুর দোকানগুলিতে পরিচয়পত্র ও এন্ট্রি পারমিটের কপি জমা দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করে খুব সহজেই সিম কার্ড পাওয়া যায়।
সারা ভুটানেই ধূমপান ও প্লাস্টিক প্যাকেটের ব্যবহার একেবারে নিষিদ্ধ।
ভ্রমণ কাহিনি - || রাজার দেশে কয়েকদিন || এবার ভুটান || দিন তিনেকের ভুটান ||