ভ্রমণ তো বানিয়ে তোলা গল্পকথা নয়, মানুষের সত্যিকারের জীবনকাহিনি। আর তাই ভ্রমণ কাহিনি মনে শুধু আনন্দই এনে দেয় না, চোখের জল অথবা প্রতিবাদের ভাষাও জাগিয়ে দিতে পারে। ট্যুরিজম ইন্ড্রাস্ট্রির সহায়ক বিজ্ঞাপনী প্রচারমাধ্যম ছাড়াও ভ্রমণ কাহিনির বড় পরিচয় বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপেও। তেমনই কিছু 'অন্য ভ্রমণ' কথা।

 

ভয়ঙ্কর পেরিয়ে ভূস্বর্গে

অরূপ চৌধুরী


ডাল লেকের ধারে হাতে গোনা কয়েকজন পর্যটক...তাও সবার চোখেই সতর্ক দৃষ্টি – প্রকৃতির রূপে নজর নেই কারও।
আমি অবশ্য অন্য কথা ভাবছিলাম। ডাল লেকের বারো নম্বর গেটের কাছে লাল শেভ্রোলে গাড়িটা যে তাগড়াই দেখতে কাশ্মিরী যুবকটি ধুচ্ছিলেন, তাঁর কাছে গিয়ে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, 'যুশমার্গ যাবেন?' উনি আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আপাদমস্তক জরিপ করলেন যেন আমি সদ্য নেপচুন কি প্লুটো থেকে পৃথিবীতে এলাম... আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে।
অন্য দিনের মতো গাড়ির ভিড় নেই – সবেধন নীলমণি একটা চালকহীন সাদা ইন্ডিগো দাঁড়িয়ে। আনমনে ভাড়ার চার্ট দেখছিলাম – যুশমার্গ ১৮০০ টাকা – 'কাঁহা যায়েগা বেটা?' পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন ষাটোর্দ্ধ এক ব্যক্তি – গালে সাদা দাড়ি – মাথায় সাদা টুপি – পরণে একটি ধূসর ফিরহান। যুশমার্গ যাব শুনে জোরে মাথা নেড়ে জানালেন আজ সম্ভব নয় – এরকম দিনে নির্জন পথে অনেক বিপদ – রাস্তায় আটকে দিতে পারে জওয়ানেরা, গাড়িতে পাথর পড়াও অস্বাভাবিক নয়। দু-একবার তাও অনুরোধ করলাম – মৃদু হেসে 'না' বলে হাতের উর্দূ কাগজের পাতা ওল্টাতে শুরু করলেন।
আগের দিন হাউসবোটের মুজফ্ফর ভাই বলেই দিয়েছিল, আজ গাড়ি পাওয়া অসম্ভব। তাও আমার জেদ দেখে ফারুকজী সকালে ন' নম্বর ডাল গেটে পৌঁছে দিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলেন, ৯ টার মধ্যে ফেরত আসতে – ব্রেকফাস্টে পোহা বানাবেন। পাশের হাউসবোটের সরকারি কর্মচারি বাঙালি কর্তাবাবুটি বেরোবার সময় চায়ের পেয়ালার আড়াল দিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। এইসবে জেদটা আরও চেপে গিয়েছিল – কিন্তু যাওয়ার কোন উপায় দেখছিনা এখনও – ডাল লেকের ধার দিয়ে বুলেভার্ড রোড বরাবর অজানার উদ্দেশ্যে আনমনে হাঁটছি...।
১৫ মার্চ, ২০১৩। দুদিন আগেই শ্রীনগরে উগ্রপন্থী হামলা হয়েছে। তখন পহেলগাঁও-এ ছিলাম। তারপর থেকেই বনধ্ - কারফিউ। শ্রীনগরে ফিরে এসেছিলাম বেশ দুঃসাহসিকভাবেই। কিন্তু এখানে এসে এভাবে আটকা পড়ব ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিনা। অথচ কোন গাড়িই নেই। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে মনের দুঃখে রাস্তায় একটা ইঁটে লাথি মারার পর বেশ খানিকক্ষণ খুঁড়িয়ে হঠাৎ দেখি একটা ফাঁকা অটো। উঠে পড়লাম থামিয়ে। কোথায় যাব এই প্রশ্নের উত্তরে নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল - নিশাত বাগ। 'পঞ্চাশ টাকা লাগবে' – এককথাতেই রাজি হয়ে গেলাম – আসলে তখন আমার একটা গন্তব্য চাই।
শ্রীনগরে এসে প্রথমদিনই মুঘল গার্ডেনগুলো দেখে নিয়েছিলাম। আজকের দিনটা একেবারে অন্যরকম। একটিমাত্র পর্যটকদের বাস। বাস থেকে নেমে সন্ত্রস্ত মুখে নিশাতবাগে ঢুকছে একদল বিদেশি পর্যটক – যেন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। পাখির ডাক চাপা পড়েছে ভারি বুটের পদচালনার আওয়াজে। একা পর্যটক দেখে বার দুয়েক তল্লাশি হল – জবাবদিহি, পরিচয়পত্র দেখানোর পরও ভারতীয় বীর সেনানির সন্দেহের দৃষ্টি রইল আমার ওপর। আগের দিন নিশাতবাগ থেকে ডাল লেকের মাঝে তোরণ আকৃতির একটি স্থাপত্য নজর কেড়েছিল – নিশাতবাগের দিকে না গিয়ে শিকারায় ভেসে সেখানে যাব স্থির করলাম।
শিকারা ঘাটে জনাচারেক প্রবীণ শিকারাওয়ালা অবশ্য আমেজের সঙ্গে গড়গড়ি টানছেন – আজকের দিনে পর্যটকদের আশা তাঁরাও রাখেন না। আমাকে দেখে যেন খানিক চমকেই উঠলেন। দূরের ওই পাথরের গেটটায় যেতে চাই শিকারায় ভেসে – শুনে অবাক হয়ে একজন প্রশ্নই করে ফেললেন, 'বেটা, তু শায়র হ্যায় ইয়া ফির কুছ অউর?' আজকের দিনে একা পর্যটকের এমন অদ্ভুত বায়না শুনে অবশ্য পাগল ভাবাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। দরাদরির দরকার হলনা, ২০০ টাকা দস্তুরে প্রবীন নাসির চাচার শিকারায় চেপে বসলাম। ভেসে পড়লাম প্রকৃতির অনির্বচনীয় ক্যানভাসে।

ভূস্বর্গকে ভয়ঙ্কর বানানোর গুরুদায়িত্ব মানুষের – প্রকৃতি কিন্তু খুব যত্ন করেই তাকে সাজিয়ে রাখে। শ্রীনগরের ডাউনটাউন যখন কালো ধোঁয়ায় ঢাকা আজ, ডাল লেকের এই প্রান্তে কিন্তু প্রকৃতির জাদুর ছোঁয়া – নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলাদের আনাগোনা – শান্ত, স্থির ডাল লেকের জলে তার নিখুঁত প্রতিফলন – ক্যালেন্ডারে এরকম ছবি দেখেছিলাম কোনোদিন। জলের মাঝে মেঘের প্রতিফলনের বুক চিরে হলুদ শিকারা চলেছে – এগিয়ে আসছে আমার গন্তব্য। একটু পিছনে হরি পাহাড়ের ওপরে আকবরের কেল্লা। নাসির চাচা অবশ্য ডাল লেকের মাঝের এই তোরণটি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। জানালেন, কখনও এখানে একটা রাস্তা ছিল আর কেল্লাতে প্রবেশের তোরণ। বর্তমানে সবই কালের গ্রাসে থুড়ি ডালের গ্রাসে। মাথা উঁচু করে আছে শুধু আর্চ আকৃতির প্রবেশপথটি – তার মধ্যে দিয়েই শিকারাটি ভেসে গেল। আর্চের গায়ে মার্বেল ফলকে উর্দুতে কিছু লেখা। নাসির চাচা পড়তে পারলেন না – চোখের জোর কমে আসছে যে – ছবি তুলে নিলাম। আকবরী কেল্লা এখনও অনেকটা দূরে। শিকারা এবার ইউ-টার্ন নিল। ডাল লেকের জলে নিশাত বাগের প্রতিচ্ছবি। বুলেভার্ড রোড আজ বড়ই শান্ত। ফিরে এলাম শিকারা ঘাটে। এত সুন্দর প্রকৃতির মাঝে বিচরণ করে মনটাও আজ খুব শান্ত, প্রসন্ন আরও বেশি।
স্নিগ্ধ, শান্ত প্রকৃতি যেন ভূস্বর্গের আতঙ্ককে হারিয়ে দেওয়ার জন্য আমার জেদটা আরও বাড়িয়ে দিল। একটা অটো যাচ্ছিল, হাত দেখিয়ে উঠে বসলাম – হাউসবোটের দিকটায় ফেরার জন্য। অপ্রত্যাশিত সওয়ারি পেয়ে যুবক অটোওয়ালা মিনিট দশেকের পথেই বেশ গল্প জুড়ল – ঠিক গল্প নয় অবশ্য, ভয়ঙ্কর ভূ-স্বর্গের সত্যিকারের কাহিনি – মানুষের হারিয়ে যাওয়ার – বুটের আওয়াজের বিভীষিকার – রাতবিরেতে তল্লাসির...। সেই কাহিনিতে আমার যুশমার্গ যাওয়ার কোনো আশার আলোর দিশা নেই – আছে শুধু অন্ধকারের কথা – যে অন্ধকারে বারুদের গন্ধ লেগে থাকে – লেখা থাকে আফস্পা-র নিয়মকানুন, রূপকথার প্রবেশ নিষেধ সেখানে। কাশ্মীরের রূপকথা বরাদ্দ শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্যে – তাও আজকের মতো দিনে নয় – ১৫ মার্চ, ২০১৩।
৯ নম্বর ডাল গেটে নেমে দেখি একা সেই সাদা ইন্ডিগো গাড়িটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। পায়ে পায়ে এগোলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের অফিসটার দিকে। কালো কাঁচের দরজা খুলে সেই প্রবীণ কাশ্মিরীটি – আব্দুল কাদির – আব্দুল চাচা – ভিতরে ডাকলেন। হাতে ধরালেন ধোঁয়া ওঠা কাশ্মিরী চা কাওয়া-র পাত্র – আড্ডা জমে উঠল। এমন কর্মহীন দিনে যেন গল্পদাদুর আসর বসালেন। ৩৫ বছর ধরে শ্রীনগরে গাড়ি চালাচ্ছেন, এরকম কত আগুন জ্বলা কারফিউ দেখেছেন – বলতে বলতে গলাটা উদাস হয়ে আসে। প্রসঙ্গ বদলে আমার কথা, আমার বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলেন। শুনলেন কাশ্মীরে গত ন'দিনে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। ক্যামেরাতে তোলা ছবিও দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। হয়তোবা আমার ভ্রমণ পাগল সত্ত্বাটাকেও খানিকটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সুযোগ বুঝে হাতের শেষ তাসটা ফেললাম – ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলের – যুশমার্গ না গেলে কাশ্মীর দেখা যে অপূর্ণ রয়ে যাবে – জয়ী হবে কাশ্মীরের আতঙ্কই! খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকলাম। চশমা খুলে চোখটা মুছলেন প্রবীণ চাচা। উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কী বিড়বিড় করলেন। এবার আমার দিকে ফিরে বললেন – তুই কলকাতা থেকে এসে ভয় কাটিয়ে ঘোরার সাহস দেখাতে পারলে একজন কাশ্মিরী ভয় পাবে কেন? ইনশাল্লাহ্‌ - উপরওয়ালা ভরসা – বেরিয়ে পড়ি। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু আনন্দ থমকে গেল পরমুহূর্তেই – নাহ্‌, যুশমার্গ পর্যন্ত যাবেন না আব্দুল চাচা, অবন্তীপুরা পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনবেন। গতকাল থমথমে পরিবেশে পহেলগাঁও থেকে ফেরার পথে অবন্তীপুরায় নামতে পারিনি যে। যুশমার্গ যাওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। যাইহোক মন্দের ভালো। কোথাও তো যাওয়া যাক, তারপরে দেখা যাবে।
আব্দুলচাচার পাশে বসে পড়লাম। ১৫ মার্চ শ্রীনগর ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একমাত্র গাড়িটি বেরোল।
শ্রীনগরের সীমানা পেরোতেই বেশ বেগ পেতে হল – কারফিউ-এর শ্রীনগরের কঠিন বেষ্টনী – যে রাস্তাতেই গাড়ি যেতে চায়, সেখানেই কাঁটাতারের বাঁধন – নো এন্ট্রি। শ্রীনগর শহর – যাকে হাতের তালুর থেকেও ভালো চেনেন আব্দুল চাচা, তাঁর কাছে সেও তখন ভুলভুলাইয়া। এরমধ্যেই চারবার সেনাদের চিরুনি তল্লাশিও হয়ে গেল – দরজা খুলে, পিছনের ডিকি খুলে, গাড়ির নীচে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে খোঁজ – পরিচয়পত্র দেখানো – কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি – সন্তোষজনক উত্তর খুঁজতে আমি নিজেও দিশাহারা। তবে শ্রীনগর মন্দের ভালো, পর্যটকদের জন্য বিশেষ ছাড় আছে সেনাদের। মরণাপন্ন রোগীর অ্যাম্বুলেন্স হয়তো সেদিন শ্রীনগরের বাইরে যেতে পারতো না, তবে পর্যটকের গাড়ি হোঁচট খেতে খেতে পেরিয়ে এল কারফিউ-র সব বেড়াজাল। শ্রীনগর শহর পেরিয়ে হাইওয়েতে পড়ে আব্দুল চাচার মুখে একটাই কথা – 'আল্‌হামদুল্লাহ্‌'।

এই হাইওয়ে ধরে সোজা রাস্তায় অনন্তনাগ। গতকালই ফিরেছি, রাস্তাটা চেনা লাগছে তাই। তবে শুনশান হাইওয়েতেও স্পিডোমিটারের কাঁটা চল্লিশের ওপরে উঠছে না। বেশ দুলকি চালে বাইরে সতর্ক দৃষ্টি রেখে গাড়ি চালাচ্ছেন আব্দুল চাচা। অবশ্য গল্প-কথা চলছে অবিরত – এই সাদা ইন্ডিগো গাড়িটি তাঁর পুত্রসম। ছ'বছরের পুরোনো হলেও আদরে-যত্নে বছরখানেকের বেশি বলে মনেও হয়না দেখে। বাম্পার, খানাখন্দ দেখে সাবধানে সস্নেহে গাড়ি চালিয়ে যান। আব্দুল চাচার দুই ছেলে। বড়জনের বয়স ছত্রিশ বছর, কেশর-এর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ছোটজন আঠাশ, গাইডের কাজ করে। আমি হয়ে গেলাম আব্দুল চাচার 'মাজলা বেটা'। বাকী সময়টুকু বেটা বলে স্নেহের আশ্রয়েই টেনে নিলেন আমাকে।
হাইওয়ের দুপাশে পাতা ঝরা চিনার গাছের সারি পিছনে রেখে, দূরের নীল আকাশের নীচে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ছায়াতে ঘেরা বাদামি পাহাড়কে রেখে মিস্টি হাওয়া মেখে চলেছে আমাদের গাড়ি। এবারে দুপাশ জোড়া বিস্তৃত ক্ষেত দেখা যাচ্ছে – আব্দুল চাচা বললেন কেশর চাষ হয় এখানে – পৃথিবীর সেরা কেশর – সোনার চেয়েও দামি। এখন যদিও মরসুম নয়, কিন্তু ক্ষেতের পরিচর্যা চলছে। শরৎকালে কেশর গাছে ফুল আসে। সেই ফুল থেকে বহু যত্নে কেশর বার করা হয়। কাশ্মীর ছাড়াও স্পেন আর গ্রীসে কেশরের চাষ হয়। তবে কাশ্মীরের কেশরই বিশ্বখ্যাত। কেশর এত দামী হয় কেন? প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরেই মাথার মধ্যে ঘুরছিল, এবার করেই ফেললাম চাচাকে। সতর্ক চোখে গাড়ি চালাতে চালাতেই কেশরকথা শোনাচ্ছিলেন আব্দুল চাচা। যদিও ফাঁকা রাস্তায় কোনো ভয় নেই বলেই আমার মনে হচ্ছিল। মাঝেমধ্যে জনপদ এলেই দোকানের বন্ধ শাটার, আর্মি ট্রাক, ইনসাস- এস এল আর নিয়ে টহলরত জওয়ান – তালটা যেন কেটে যাচ্ছে। জনপদগুলো পেরোনোর সময় বুঝতে পারছি মনে মনে আল্লাহ্‌-র নাম নিচ্ছেন আব্দুল চাচা, আবার ফাঁকা রাস্তাতে পড়লে কেশরকথা।
একেকটা কেশর গাছে মাত্র দু-চারটে ফুল হয়। প্রত্যেকটা ফুলেই ঘিয়ে রঙের তিনটি গর্ভমুণ্ড বা স্টিগমা থাকে। তার থেকেই প্রস্তুত হয় বহুমূল্য কেশর। প্রয়োজনীয় সার আর বিস্তর পরিচর্যা তো বটেই, পরিমিত বৃষ্টিপাত, টানা নরম সূর্যালোক – এতসবকিছু জরুরি বলে কাশ্মীরের আবহাওয়াই এর উপযুক্ত। দেড়শো ফুল থেকে মাত্র এক গ্রাম কেশর হয়। তাই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মশলা কেশর।
কেশরের গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এসেছি, পৌঁছে গেছি অবন্তীপুরা। প্রথমে গেলাম অবন্তীশ্বরা মন্দিরে। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা, জুম্মার নামাজের সময় হয়েছে। ধর্মপ্রাণ আব্দুল চাচা সাদা কাপড় পেতে রাস্তার পাশেই নামাজে বসলেন – সামনেই অবন্তীশ্বরা শিব মন্দির। প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তুপের দিকে মুখ করে (পশ্চিম দিক বলে) এক বৃদ্ধ কাশ্মীরি নামাজ পড়ছেন। অসাধারণ এই ছবির ফ্রেমটিকে ক্যামেরায় নয়, মনের মধ্যেই ধরে রাখলাম।

নবম শতাব্দীতে রাজা অবন্তীবর্মণ নির্মিত শিবের এই মন্দিরটির এখন ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। চত্ত্বরে ঢুকলে প্রথমেই নজরে আসে কালো পাথরের গায়ে কারুকার্য করা বিশাল প্রবেশদ্বার। সেটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চারদিকে ছড়ানো অতীতকালের টুকরো স্মৃতি – ভাস্কর্য, পাথর খোদাই মূর্তি – আর ঠিক মাঝখানে কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে উঠে একটা প্রাঙ্গণ – বোঝা যায় এটাই ছিল মূল মন্দির – তবে এখন শুধু ইতস্তত ছড়ানো কিছু পাথরের চাঁইয়ের গায়ের নক্সাই জানান দেয় হাজার বছর আগের ইতিহাসকে। মাঝ দুপুরের রোদের ঝকঝকে আলোয় দূর পাহাড় আর নীল আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে, কয়েকজন বন্দুকধারীর প্রহরায়, পাতাঝরা চিনারের মাঝে পাথরে যেন প্রাণের খোঁজ পেলাম – হাজার বছরের পুরনো গল্পকথা তারা যেন শোনাচ্ছে কানে কানে – একসময় এখানেও নিয়মিত পুজো হত – জনসমাগমে ভরে উঠত মন্দির প্রাঙ্গণ। সময়ের কালচক্রে সবই আজ ইতিহাস। ধ্বংসস্তুপে বসে প্রাণের অস্তিত্বের কল্পনা - বড় অদ্ভুত এই অনুভব মনের মধ্যে জারণ করতে ভাললাগে আমার। মূক পাথরের চাঁইগুলির বুকের গভীরে জমে থাকা কথা কেউ শুনতে পায়না অথবা শুনতে চায়না।
ডাক শুনে সম্বিত ফিরল। দুই পাঞ্জাবী ট্রাক ড্রাইভার, কারফিউতে চারদিন ধরে এখানেই আটকা পড়ে রয়েছেন। দুজনের একসঙ্গে মোবাইলে ছবি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। ছবি তুলে ওদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। কিন্তু ইতিহাসের গল্পে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, অপেক্ষা শুধু কারফিউ ওঠার। মোবাইলে পাঞ্জাবী গান বেজে ওঠে, আমিও হাঁটা দিলাম ফেরার পথে।
আব্দুল চাচা গাড়িতে বসে উর্দূ কাগজ পড়ছিলেন একমনে, আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, "ক্যায়সা লাগা বেটা? পাথরমে জান কো মেহসুস কিয়া?" বললেন, সামনেই আরেকটি মন্দির আছে, সেটা আরও বড়। গাড়ি চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেলাম পরবর্তী মন্দির প্রাঙ্গণে – অবন্তীস্বামী মন্দির।

এটিও নবম শতাব্দীতে রাজা অবন্তীবর্মণ নির্মিত - বিষ্ণুর মন্দির। এখন শুধু পাথরের ভগ্নস্তুপ। তবে প্রথমেই চোখে পড়ল কালো পাথরের ধ্বংসস্তুপের পাশেই একটি ধবধবে সাদা মসজিদের সহাবস্থান – মনটা ভালো হয়ে গেল। অবন্তীস্বামী মন্দির চত্ত্বরটি আগের মন্দিরটির থেকে অনেকটাই বড়। পাথরের তৈরি বিশাল প্রবেশপথ। চারপাশে পাথরের বেষ্টনী। ভেতরে ঢোকার আগে বেষ্টনীটি ধরেই প্রথমে একবার মন্দির প্রদক্ষিণ করলাম। মন্দিরের গায়ের কারুকাজ এখনও অক্ষত রয়েছে অনেকটাই। কোথাও ভাঙা পাথরের টুকরো বসানো রয়েছে। এখানেও যেন পাথরে প্রাণের পরশ। মন্দিরের গায়ে পাথরের ভাস্কর্য। কিন্তু ভেতরটা যেন খণ্ডহর – ইতস্তত ছড়ানো পাথরের স্তুপ। মাঝের মূল মন্দিরটি বুঝে নিতে অবশ্য অসুবিধা হল না – সামনে বড় একটা পাথরের বেদী – আর তার কিছু স্মৃতির কণা রূপে পাথরের টুকরো রোদে-জলে ভিজে টিঁকে আছে। হাজার বছর পুরনো ইতিহাসের পাতায় ডুব দিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ঘুরতে লাগলাম। হঠাৎ ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ, বাড়তি ব্যাটারি গাড়িতে। আপনমনেই বলে ফেললাম – এখানেই ছবির ইতি। পাশ থেকে এক জওয়ান বলে উঠলেন, 'বাঙালি নাকি?' সেও আসলে বাঙালি। আসামের সেই জওয়ানটি সুদূর ভূস্বর্গ কাশ্মীরের প্রহরার গুরুদায়িত্ব পালন করছে। হাল্কা দু-একটা কথা হল – অন ডিউটিতে অচেনা মানুষের সঙ্গে মুখে কথা বলা বারণ – কথা বলে শুধু বন্দুক।
মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে আবদুল চাচা রাস্তার ওপারে যেতে বললেন। ওপারে রাস্তার গা ঘেঁষে বইছে ঝিলাম। ঝিলামের ধারে বসে রয়েছেন কয়েকজন জওয়ান – এরকম দিনে ট্যুরিস্ট দেখে অবাক – আবার আরেকপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ – তবে কথা বলার পর উৎসাহ দিলেন সাহসের জন্য।
সেনা ছাউনির ছবি তোলা নিষেধ তাই ক্যামেরা ঝিলমের দিকে ফেরালাম। কিন্তু থমকে গেলাম আবদুল চাচার কথায় – "ঝিলম মে আজ সির্ফ লহু বহতা হ্যায়।" – শাটার টিপতে পারলাম না। ফিরে এলাম গাড়িতে। স্বর্গের খোঁজে এসে আজ অনেককিছুই বুঝলাম – স্বর্গ যেন হারিয়ে গেছে – আফস্পার চক্রব্যূহে – রাজনীতিবিদদের স্বার্থের ছায়াতে – প্রতিবেশী দুই ভাইয়ের নিত্য বিবাদে।
কিছুটা পথ চলার পর চোখে পড়ল পথের পাশে পাহাড়ের কোলে সবুজ মাঠে হলুদ ফুলের মেলা – গাড়ির থেকে নেমে দাঁড়ালাম। রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসে পড়লাম, ভারী ভালোলাগল। আবদুল চাচা পাশে এসে বসলেন। আপন মনেই বলতে শুরু করলেন ভূস্বর্গের দুঃখের কথা। গাড়ি নিয়ে বেরোনোর সবচেয়ে বড় সমস্যা পাথর ছোঁড়া। এই বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে বর্তমান যুব সম্প্রদায়ের একাংশ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুল পথে তাদের চালনা করে কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতা, কোথাওবা প্রশাসনের কোনো উচ্চপদস্থ আমলা। এইসব যুবকেরাই হয় কূটনীতিয় দাবার ঘুঁটি – পাথর ছোঁড়া, তারপর পুলিশের খাতায় নাম ওঠা, তারপর পুলিশের চরবৃত্তি করার লোভনীয় প্রস্তাব – জ্বলবে কাশ্মীর। এর লোভে স্কুল ছেড়ে দিয়ে দলে দলে ছেলেরা এই পথে আসছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাড়ি, আরোহীদের জীবনহানির আশঙ্কা থাকছে, পর্যটকেরাও বাদ পড়ে না এই আক্রমণ থেকে। এক এক করে পর্যটকেরাও আর ভূস্বর্গে ফিরে আসে না – বুলবুল গান গায় না – ঝিলমের জলে রক্তের রঙ – ভূ-স্বর্গের আকাশের সূর্য মুখ ঢেকেছে কালো ধোঁয়ায়, কাঁটাতারে বিছানো স্বর্গের রাস্তা, কারফিউ আর বন্ধের জেরে মার খায় পর্যটন – হাজার হাজার কাশ্মিরীদের রুটিরুজি।
শুনতে শুনতে বিষাদ বাড়ছিল মনের গভীরে – কে যেন আমার ভিতর থেকে বলে উঠল চাচাজানকে – আজ একটা চেষ্টা করে দেখা যায় না, যদি এই কারফিউতে বেরিয়ে যুশমার্গ ঘুরে আসি। সেটা শুনে কাল হয়তো পাঁচটা গাড়ি বের হবে, পরশু পঞ্চাশটা – তার পরেরদিন হয়তো কারফিউ প্রত্যাহারই হয়ে যাবে। একটা শুরু করেই দেখা যাক না...।
কথাটা শোনার পর পুরো এক মিনিট চুপ করে থাকলেন আবদুল চাচা। তারপর ধীরে সুস্থে উঠলেন। চল বেটা, এই সৎ ইচ্ছাকে আল্লাহ্‌ পুরা করবেন আজকে। চল বেটা, যাব যুশমার্গ, যা হয় হবে, যদি আল্লাহ্‌ কাশ্মীরকে জন্নত দেখতে চান, আজ আমরা পারব। আবেগে চোখে জল চলে আসে চাচাজানের, আমারও। আজ আমরা পারলে কাশ্মীর জিতবে। আতঙ্কের ওপর জিতবে ভূস্বর্গের সৌন্দর্যের টান। গাড়ি চালু হল। পাশের পেট্রোল পাম্পে গিয়ে ট্যাঙ্ক ভর্ত্তি করলেন চাচা। একটু এগিয়ে আবার গাড়ি দাঁড় করালেন। বললেন, যাওয়ার পথে দুটো জায়গায় সমস্যা হতে পারে – পাখর পোরা – ওখান একটা বড় দরগা আছে, আর চারার-এ-শরিফ। পাখর পোরায় অনেক লোকের জমায়েত হবে, বিরোধী দলের উগ্র মনোভাবাপন্ন লোকেরাও থাকবে – আজকের মতো বন্‌ধের দিনে সেটা একটা বিপদের জায়গা। বন্‌ধের দিনে চারার-এ-শরিফ জায়গাটাও বিশেষ সুবিধার নয়। তবে মুশকিল আসানও চাচাই করলেন। বললেন, কেউ গাড়ি দাঁড় করালে যেন যুশমার্গের কথা না বলি, বলি দরগায় যাব, কলকাতা থেকে দরগা দেখতে এসেছি বললে কেউ আটকাবে না। এটুকু মিথ্যে তো বলাই যায় – নেক্‌ কাজে এটুকু ছলনা আল্লাহ্‌ পাক নিশ্চয়ই মাফি দেবেন। এবারে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। আমার উৎসাহে এই বনধের দিনেও এত বড় একটা ঝুঁকি নিতে শুধু যে এককথায় রাজি হয়ে গেলেন তাই না তার ওপর এই অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা – শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এল। বললাম, মিথ্যা নয়, সত্যিই আমি ওই দুটি দরগাতেই যাব মাথা ঠেকাতে। আল্লাহ্‌র নাম করে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিলেন আবদুল চাচা।

বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের একটা রাস্তা ধরলেন এবার। ঘুরপথে পাখর পোরা, চারার-ই-শরিফ হয়ে যুশমার্গ পৌঁছান যায়। তবে আবদুল চাচা এই পথে অনেক বছর পরে এলেন। তাই একটু খেয়াল রাখতে বললেন সাইন বোর্ডের দিকে। ইংরেজি পড়তে পারেন না চাচা। শুনশান রাস্তা – একপাশে রুক্ষ্ম পাহাড় – অন্যদিকে পাতাঝরা রুক্ষ্ম গাছের ডাল – টানা আপেলের বাগান। সূর্য তখন রাস্তার ডানদিকের পাহাড়ের আড়ালে – ছায়া নেমে এসেছে পথে। চশমা ঠিক করতে করতে আবদুল চাচা বললেন, বেটা আমার চোখের দৃষ্টি কিছুটা ঝাপসা – রাস্তার দিকে খেয়াল রাখনা। কোনো খানাখন্দ বা স্পিড ব্রেকার এলে জানাতে – গাড়িটাকে নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করেন যে। শুনসান রাস্তা – কোনো গাড়ি চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে ছোট দু-চারটি ঘরের বসতি, কিন্তু পথে জনপ্রাণী নেই। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ আর হয়তো তার নাতি লাঠিহাতে ভেড়ার পাল নিয়ে চলেছেন। আবদুল চাচা জিজ্ঞাসা করে এবার নিশ্চিত হলেন যে এটাই পাখর পোরা যাওয়ার রাস্তা। কিন্তু উল্টোদিক থেকে যেহেতু কোন গাড়িই আসছেনা তাই চিন্তার রেখা বাড়ছে চাচাজানের মুখে – পাখর পোরার অবস্থা ঠিক কী সেটা আন্দাজ করতে পারছেন না। এরপর শুরু হল চড়াই পথ ওঠা। রুক্ষ্ম হলেও অসামান্য সুন্দর এই পথ। একপাশে আপেল – আখরোটের গাছ। আখরোট গাছে ফুল ধরেছে – সোনালি – অপরূপ তার শোভা। ঠিক এইসময় দুধের ক্যান বহনকারী ম্যাটাডোর দেখা গেল উল্টোদিকে। রাস্তার হাল মোটামুটি নিরাপদ খবর পেয়ে এবার গাড়ি ছোটালেন চাচা। আমি কিন্তু নজর রেখেছি রাস্তার দিকে – খানাখন্দ দেখলেই আগাম সতর্ক করছি। একই সঙ্গে চোখ যাচ্ছে চারপাশের প্রকৃতির দিকে – বাদাম গাছে আসা নতুন গোলাপি ফুল যেন নতুন আশার আশ্বাস জাগাচ্ছে। একটু এগিয়ে একটা মোড় পড়ল। সাইনবোর্ড দেখে ডানদিকে বাঁক নিল গাড়ি। খানিক পরে একটা আধা শহর শুরু হল। কিছু লোকজনও চোখে পড়ল। পৌঁছে গেছি পাথর পোরা। সামনেই বেশ বড় একটা দরগা। সদ্য নামাজ পড়া শেষ করে দল বেঁধে মানুষ বেরিয়ে আসছে – একেবারে গ্রাম্য কাশ্মীরের রূপ। গাড়ি থেকে নেমে দরগার দরজায় মাথা ঠেকিয়ে আবার ফিরে এলাম। পাখর পোরার কাশ্মীরিদের দল নামাজ পড়ার পর পতাকা আর উর্দূতে লেখা কিছু কাগজ নিয়ে মিছিল শুরু করেছে। সামনে দু-তিনজন পাখতুন ভাষাতে কিছু স্লোগান দিচ্ছে। বাকিরা গলা মেলাচ্ছে যে কথাটায় তার মানে অন্তত জানি – 'আজাদি'।
কালো ফিরহান পরিহিত, জনা পঞ্চাশেক গ্রাম্য কাশ্মীরি নামাজ পড়ার পর রাস্তা জুড়ে মিছিলে সামিল হয়েছে আজাদির দাবীতে। আমার মতো ভিনদেশীকে দেখে যেন তাদের যোশ আরও বাড়ল। আবদুল চাচা জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে হাত ধরে টেনে আমাকে গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। গাড়ি স্টার্ট করল। কিন্তু সামনে যে আজাদ কাশ্মীরের দাবিতে বড় মিছিল। হয়তো একটু অপেক্ষা করলেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত, কিন্তু প্রবীণ, বিচক্ষণ আবদুল চাচাও ভুল করে ফেললেন। রাস্তা ফাঁকা করবার জন্য দুবার হর্ণ বাজিয়ে। মুহূর্তের জন্য স্লোগান থেমে গেল – কয়েকজন তেড়েও এল। কয়েকজন স্থানীয় ভাষায় তীব্র সুর চড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করল। মনে হল দেখলাম জনা দুয়েক রাস্তা থেকে ঢিল কুড়াচ্ছে। হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হল শেষে কি তবে আজ ভয়েরই জিত হবে? আবদুল চাচা গাড়ির দরজা খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে ওখানকার ভাষায় কী যেন চেঁচিয়ে বললেন। যতদূর বুঝলাম বলছেন, সুদূর কলকাতা থেকে এক খুদা কী বান্দা এসেছে দরগা দেখতে, খুদা কে বাস্তে শান্ত হতে। গুপি-বাঘার গান শোনার মতো সকলে পলকে যেন স্থবির হয়ে গেল। সামনে থেকে নেতাগোছের দুজন এগিয়ে এসে সবাইকে সরিয়ে পথ খালি করে দিলেন। কুর্নিশ জানালাম সবাইকে – সরল মানুষ, ধর্মপ্রাণ মানুষ – আজাদি হয়তো দাবি – ঠিক বা ভুল যাই হোক তাঁরা মানুষ – তাঁদের হৃদয় মানুষেরই – এঁরা কেউ উগ্রপন্থী নন। এগিয়ে চলল গাড়ি।

পাথরপোরা পেরিয়ে দুজনেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। দুজনেই একসঙ্গে কপালের ঘাম মুছলাম। আর সাময়িক উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে হঠাৎ দুজনেরই মনে পড়ল সকাল থেকে কিছু না খেয়েই দৌড়ে যাচ্ছি। খিদেতে পেটে ছুঁচো নয়, আস্ত খরগোশ লাফাচ্ছে। কিন্তু খাবার পাব কোথায়? শুনশান রাস্তা, মাঝে খুব ফাঁকায় ফাঁকায় দু'চারটে বাড়ি। অনেকটা দূরে গিয়ে একটা ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানও চোখে পড়ল। আরও বেশ কিছুটা গিয়ে চারার-ই-শরিফ পৌঁছনোর ঠিক আগে একটা খোলা দোকান চোখে পড়ল – আমিই খেয়াল করে চাচাকে গাড়ি থামাতে বললাম। দোকানে ঢুকে দেখি এক বৃদ্ধ কাশ্মীরি তাঁর নাতনির সঙ্গে খেলা করছেন। এমন দিনে এমন সময় ভিনদেশি খরিদ্দার দেখে বিস্মিত হলেন। সামান্যই জিনিস। মুদিখানার দোকান। দু'প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে নিলাম। দুটো আপেল। ওদের অনুরোধে কিছু আখরোটও। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার ধারে বসে এক প্রবীণ কাশ্মীরি ও কলকাতার যুবক একসঙ্গে আপেল, আখরোট খাচ্ছে এটা যেকোন ছবিশিকারীর কাছে হয়তো ভালো বিষয়বস্তু হতে পারত। অথচ এখানে যুবকদের হাতে ক্যামেরার বদলে পাথর থাকে। সৌন্দর্য বোঝার দৃষ্টির পুরস্কারের বদলে এরা আফস্পার কাছে দাবী করে 'আজাদি'।
আবার চলা শুরু হল – সামনেই চারার-ই-শরিফের মোড়। যেখানে হয়তো আবার মিছিলের মুখে পড়তে হতে পারে এ আশঙ্কা ছিল। কিন্তু দেখলাম বেশ শুনশানই রয়েছে, পেরিয়ে এলাম নির্ঝঞ্ঝাটেই। রাস্তার দুপাশে এখন বরফের চিহ্ন। যত এগোচ্ছি রাস্তার দুপাশের শুভ্র আবরণ আরও পুরু হচ্ছে। অবশেষে বরফে ঢাকা যুশমার্গ উপত্যকায় পৌঁছলাম। চারিদিক শুনশান। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। চারপাশ তুষারশুভ্র। জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমের সবুজ রঙের বাংলো। হাওয়ায় বাংলোর সামনের পতাকা উড়ছে। কিন্তু বরফ প্রান্তর একেবারে নিষ্প্রাণ। শুনেছিলাম এখান থেকে ঘোড়ায় সওয়ারি হয়ে দুধগঙ্গা যাওয়া যায়। কিন্তু কোথায় কী! রিসর্টের দরজায় তালা। আশেপাশে একটু ডাকাডাকি করে কারোর সাড়া না পেয়ে বরফ ডিঙিয়ে কিছুটা ভিতরে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি একটা কটেজের সামনে এক কাশ্মীরি বৃদ্ধ ও এক যুবক পাতা জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন, চলছে হুঁকোয় টানও। আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন। পুরো যুশমার্গে কোনো ট্যুরিস্ট নেই – কারফিউয়ের দিনে বিকেলে ট্যুরিস্ট আসা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। তাঁরা এগিয়ে এলেন। যুশমার্গের বরফ উপত্যকা ঘুরে দেখব – দুধগঙ্গা নদী, নীলনাগ লেক দেখতে চাই, ঘোড়া হলে ভালো হয়। হেসে ফেললেন প্রৌঢ় কাশ্মীরি, আফজল চাচা তাঁর নাম। এই বরফের দিনে, এই অশান্তির দিনে পর্যটকের অভাবে ধুঁকছে নিরালা উপত্যকা। বড়ই নির্জন এই বরফ উপত্যকা – ঘোড়া থাকবে কী করে? কোনো গাইডও নেই। তবে তিনিই আমাকে আজকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারেন। বিকেল হয়ে এসেছে আজ যুশমার্গের বরফ উপত্যকা ঘুরে দুধগঙ্গা অবধি গিয়ে ফিরে আসতে পারি। কিন্তু আজ নীলনাগ লেক যাওয়া সম্ভব নয়। তারজন্য এখানে একদিন থাকতে হবে। ঘরতো সবই খালি – কাতর নিমন্ত্রণ যেন। মনখারাপ লাগলেও বাস্তবে তা সম্ভব নয়, কালকের ফ্লাইটেই ফেরার টিকিট রয়েছে। অগত্যা দুধগঙ্গা ঘুরে আসাই ঠিক হল। টাকার কথা জিজ্ঞাসা করতেই আফজল চাচা হেসে ফেললেন – পর্যটকের পায়ের ছাপ পড়াটাই কিসমত – টাকা? তা যা ইচ্ছা দিলেই হবে।

আফজল চাচা একটা গাছের ডাল নিলেন আর একটা আমার হাতে দিলেন। দুজনে পা বাড়ালাম বরফ উপত্যকায়। আবদুল চাচা এবার আগুন পোহাতে আর হুঁকোতে আয়েশের টান দিতে বসলেন। আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে তাঁর মুখের সেই পরিতৃপ্তির রেখা আমার মনে থাকবে আজীবন। আজকে আমরা কারফিউকে হারিয়েছি – আতঙ্কের ওপর জয় হয়েছে ভালোলাগার, ভালোবাসার। এইসবই যেন ভূস্বর্গে প্রাণের স্পন্দন ফেরার ঈঙ্গিত – নতুন পাতা আসার অপেক্ষা শুকনো চিনারের ডালে।
বরফের চাদর বেশ পুরু, ঝুরঝুরেও। মাত্র দুদিন আগেই তুষারপাত হয়েছে। লাঠিটাকে বরফে গেঁথে তার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করতে করতে আফজল চাচার পিছু পিছু চললাম, তুষাররাজ্যে পাড়ি দিলাম। প্রথমেই হল পদস্খলন – নরম বরফে বাঁ পায়ের প্রায় সবটাই ঢুকে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়লাম। চাচা হাত বাড়ালেন, উঠে দাঁড়ালাম সেই হাত ধরে। উনি এবার বললেন ওনার পায়ের ছাপে পা রেখে এগোতে। সেইমতোই এবার পা ফেলে এগোলাম। বরফে মোড়া সোনমার্গ আর গুলমার্গ তো ইতিমধ্যেই দেখে এসেছি, তবে এই যুশমার্গ যেন একটু আলাদা। গল্পকথায় বলে যিশু খ্রিস্টের পায়ের ছাপ পড়েছিল এখানে। তাই বোধহয় এত শান্ত, এত পবিত্র। আপাতত অবশ্য প্রভু যিশু নয়, আমি পদচিহ্ন অনুসরণ করছি আফজল চাচার। উপত্যকার যত গভীরে যাচ্ছি বরফ ততো বাড়ছে – আফজল চাচা বললেন, আকাশের অবস্থা বলছে আজও শেষ বিকেলে তুষারপাত হতে পারে। এরকম চলবে আরও হপ্তাদুয়েক। শুনশান বরফ উপত্যকায় মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঈগলের ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সাদা বরফের মাঝে মাঝে সবুজ রঙের ট্যুরিস্ট কটেজ। যেতে যেতে চোখে পড়ছে বরফের মাঝে বাগান, জমাট বাধা নদীর ওপর বাহারি সাঁকো। কোথাও ক্যাফেটেরিয়া, কোথাওবা স্মারক বিক্রির দোকান – সবই অর্ধেক বরফের নীচে। দূরে নজরে আসছে পাথর-কাঠের জিপসিদের ঘর। ফুলের মরসুমে তাদের দল আবার ফিরবে ঘোড়া নিয়ে। পর্যটকদের যুশমার্গে ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন আফজল চাচা। মিঃ নটবরলাল সিনেমাতে শুটিং-এর সময় গানের এক অংশে নাকি তাঁকেও দেখা যায়। কত জমজমাট ছিল সেই দিনগুলি – অমিতাভ দাঁড়িয়ে ছিল দু'হাত দূরেই – তাঁর গলায় রোমাঞ্চ – তা আবার অবসাদে ফিরে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখন পর্যটকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কেন কে জানে! মরসুমে এক রাতের জন্য কিছু পর্যটক আসে, বিদেশিরা এলে হয়তো কিছুদিন কাটিয়ে যান। কিন্তু যুশমার্গ যেন কাশ্মীরের দুয়োরানি – কথা বলতে বলতে বরফ প্রান্তর পেরিয়ে এলাম পাইন-বার্চের জঙ্গলের মধ্যে – পাশে বেশ গভীর খাদ – সেখান দিয়েই জল বয়ে যায় – খরস্রোতা এখন হিমেল – খুব সাবধানে ডানপাশের খাদের অস্তিত্ব খেয়াল রেখে অজানা বরফের আস্তরণে পা ফেলতে হচ্ছে – বেসামাল হলেই সমূহ বিপদ – এভাবে হাঁটুর ওপরে বরফের আবরণ ডিঙোতে হাঁফ ধরছে – তবে রোমাঞ্চ পুরোদম। একটা সময় চোখে পড়ল দুধগঙ্গার চারপাশে পাথরে বরফের ছাপ। মাঝখানে ক্ষীণস্রোতে বইছে সে – কাছে গিয়ে তাকে ছুঁয়ে দেখার বড় ইচ্ছে করছিল। কিন্তু এখানে বরফ প্রায় তিন-চার ফুট গভীর। আলগা পাথরে পা পড়লে মচকে যেতে পারে। আবার অনেক জায়গা দিয়েই জলের ধারা বইছে। দুধগঙ্গায় মিশেছে তারা – এখন তাদের ওপর বরফ আস্তরণ। পায়ের চাপে তা ভেঙে গেলে অনিবার্য বিপদ। তা সত্ত্বেও আমার উৎসাহ দেখে আফজল চাচা এগোতে লাগলেন। একটা জায়গায় দ্রুত লাফিয়ে চিহ্ন দেখালেন – দূর থেকে দেখলাম বরফের পাতলা আস্তরণের নীচ দিয়ে জল বইছে। প্রায় লাফিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পায়ের চাপে বরফের আস্তরণ ভেঙে সেই বিপদ ঘটল। বাঁ পাটা নীচে চলে গেল জলের ভেতর, ডান পা দিয়ে প্রাণপণে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছি। তবে আওয়াজে বুঝতে পারছি পায়ের তলায় বরফে ফাটল ধরছে। আফজল চাচা দ্রুত আমার হাত ধরে টেনে তুলেই এক ধাক্কায় সামনে ফেলে দিলেন। বরফের চাঙড় থেকে বেশ কিছুটা দূরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। বরফে গড়াগড়ি খেয়ে আমার সারা শরীর বরফ সাদা। আর হাঁটু অবধি বরফ, জুতোর ভিতর জল থই থই, প্যান্ট পুরো ভিজে। বেশ করুণ অবস্থাই। একটা উঁচু পাথরে বসে জুতো খুলে উলটে জল ঝরতে দিলাম। পা ঝাড়ছি, ভিজে জিনস, শরীর ঝাড়ছি। ঠাণ্ডায় সব অবশ হয়ে আসছে। তবে এই সফেদ উপত্যকায় সবুজ ঘন পাইন-বার্চের মাঝে খরস্রোতা দুধগঙ্গার বয়ে চলা – পড়ন্ত বিকেলের আলোর আভায় – যেন স্বপ্নলোক নেমে এসেছে।

পাথরের ওপরে বসেই আফজল চাচার সঙ্গে গল্প জুড়লাম – শুনতে লাগলাম কাশ্মীরের কথা – যুশমার্গের কথা – আশার কথা – চিনারের নতুন পাতার আশা – বুলবুলের ফেরার আশা – পর্যটকদের কলরবে নিরালা উপত্যকা মুখরিত হওয়ার আশার কথা। হঠাৎ শুনি গুরুগম্ভীর আওয়াজ – ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। খেয়াল করে দেখি আকাশে মেঘ কালো করে এসেছে – এ যেন সাবধান বাণী – ফিরে যেতে বলার ঈঙ্গিত। উঠে পড়লাম। ক্ষণিকের আলাপেও যুশমার্গের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল। ভিজে জুতোয় পা গলিয়ে হাঁটুর ওপর অবধি বরফে চলা বড়ই কঠিন। লাঠিটা বেশ কাজে লাগছে এবার। আর অবিরত নির্দেশ দিয়ে চলেছেন আফজল চাচা। খাড়া চড়াইয়ের সময় হাত ধরে টেনে তুলছেন। পথ চলতে চলতে জঙ্গল থেকে গাছের পাতা ছিঁড়ে ফিরহানের পকেটে পুড়ছেন। আমাকেও দু'এক ধরণের পাতা দিলেন। ইউনানি চিকিৎসার মূলমন্ত্র এই পাতাগুলো। ঔষধি গুণ সম্পন্ন এইসব পাতা যুশমার্গ থেকে সংগ্রহ করতে আসেন ইউনানি চিকিৎসকেরা। আমার ভিজে বেড়াল হালত দেখে চাচা আমাকে সর্দিজ্বর সারানোর আর গা গরম রাখার ঔষধি দিলেন। কীভাবে খেতে হবে তাও বলে দিলেন। কথায় কথায় জঙ্গল পেরিয়ে আবার ফিরে এলাম বরফ উপত্যকায়। গাঢ় রঙের আকাশের ছায়া বরফের ওপর পড়ে রহস্যময় এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। কালো আকাশ, সফেদ যুশমার্গ, দুপাশে ঘন সবুজ পাইনের সারি, সবুজ রিসর্টগুলোর পাশ দিয়ে রঙিন পতাকাগুলো উড়ছে।

আমার সামনে সামনে হেঁটে চলেছেন কালো ফিরহান পরিহিত এক প্রবীণ কাশ্মিরী। মনের ক্যানভাসে এ ছবি চিরকালীন হয়ে থাকল। আকাশের গর্জন বাড়ছে। অবশ পা দুটোকে যত তাড়াতাড়ি পারি টেনে নিয়ে চলেছি। দৌড়তেই হচ্ছে রীতিমতো। বৃষ্টি থামলেই তুষারপাত শুরু হবে। আর এই নির্জন প্রান্তরে সেটা খুব উপভোগ্য হয়তো হবে না। আফজল চাচার কটেজে পৌঁছে দেখি আবদুল চাচা কাঠের আগুনে হাত সেঁকছেন। ভেজা জুতো খুলে খালি পায়ে আগুনের গরম সেঁক নিয়ে তাতে সাড়া এল। আবদুল চাচা বেরোনোর তাড়া লাগালেন - বরফ পড়া শুরু হলেই আটকে পড়ব। অগত্যা হাঁটু অবধি ভিজে প্যান্ট গুটিয়ে, হাতে জুতো নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে গাড়িতে। বিদায় নিলাম আফজল চাচার কাছে। তাঁর হাতে দুশো টাকা দিতেই মুখে যেন আলো জ্বলে উঠল – মন ভরে গেল আমার। আবার আসতে বললেন আমায় – হাতে কয়েকদিন সময় নিয়ে – অনেককিছু দেখা বাকী রয়ে গেল যে – নীলনাগ লেক, ফ্রেশনাগ, হালজান, বরগাহ্‌, লিডর মাড, ত্রিপুর, সঙ্গ-সফেদ কত ট্রেক রুট...। আবার ফিরে আসব - কথা দিয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
হিটার অন করে গাড়ি স্টার্ট দিলেন আবদুল চাচা। ঝমঝম বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে উইন্ডস্ক্রিনে। 'ইনশাল্লাহ্‌' বলে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ছোটালেন চাচা – যেন অন্য এক মানুষ এখন। সকালের সাবধানী প্রবীণ মানুষটি সারাদিনের সব বাধা-বিঘ্ন পেরিয়ে সবশেষে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে যেন ফিরে গেছেন তাঁর যৌবনকালে। স্পিডোমিটারের কাঁটা নড়াচড়া করছে ষাটের আশেপাশে। ওয়াইপারের আঘাতে উইন্ডস্ক্রিন থেকে ছিটকে যাচ্ছে বরফের টুকরো। সফেদ যুশমার্গে নেমে আসছে তুষারের নতুন পরশ। যেন সত্যিই প্রভু যিশুর উপত্যকা – নির্জন, শান্ত, স্বপ্নসুন্দর। স্বপ্নরাজ্য এখন শুধু রিয়র ভিউ মিররে ছুটে চলেছে পিছনের দিকে।
দিনের বেলায় যে প্রবীণকে আমি রাস্তার খানাখন্দ সম্পর্কে সতর্ক করছিলাম সন্ধ্যার প্রায় অন্ধকারে তুষারপাতের ভিতর দিয়ে তার এরকম গতিতে দক্ষ ড্রাইভিং দেখে স্তম্ভিত আমি। ওনাকে কথাটা বলতে, স্মিত হেসে বললেন, 'তাজুর্বা'। তারপর তুষারপাতের সঙ্গে দৌড়ের এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সওয়ার হলাম – নির্জন পাহাড়ি সর্পিল রাস্তা – পাশের সাদা বাগিচায় পাতাহীন গাছ – শেষ বেলায় গোধূলির আভা, আলো-আঁধারি, সাদা চাদরে মুড়ি দিয়ে রাতঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি – আর তারই মাঝখান দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে আমাদের সফেদ বাহনটি।
চারার-ই-শরীফে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি কমে এল, তুষারপাতও থেমে গেল। দরগায় যাওয়ার আন্তরিক ইচ্ছে থাকলেও সন্ধ্যে নেমে এসেছে, আর কারফিউ-এর এই থমথমে পরিবেশে বারনই করলেন চাচা। তোলা রইল পরের বারের জন্য। গাড়িতে বসেই দুজনে মাথা নত করে প্রার্থনা সেরে নিলাম। গাড়ি আবার ছুটতে শুরু করল।
রাস্তা আরও শুনশান – বৃষ্টি থেমে আকাশও পরিষ্কার হচ্ছে। আকাশ জুড়ে সূর্য ডোবার পালা দেখতে দেখতে গোধূলির রঙ মেখে নামছি আমরা। দূরের বরফ সাদা পাহাড় আর রাস্তার কোলঘেঁষা গাছে গোলাপি বাদামের ফুল যেন আমাদের এই যাত্রার সঙ্গী। আবদুল চাচা এবার হাইওয়ে ধরলেন না। বসতির ভেতর দিয়ে পাড়ার রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললেন। বললেন, হাইওয়েতে তো আর্মি চেকিং, প্রাণের স্পন্দন কাঁটাতার সেখানে সরিয়ে রেখেছে। লোকালয় দিয়ে গেলে কাশ্মীরের প্রাণের স্পন্দন বুকের গভীরে অনুভব করা যায়।
সন্ধ্যে নেমে এসেছে, রাস্তায় লোকজনের ভিড় বাড়ছে, দোকানপাটও অনেক খোলা। খালি চোখে দেখে সব স্বাভাবিকই লাগছে। আবদুল চাচা বলেন, এটাই কাশ্মীর। সবাই মূল স্রোতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। কিন্তু উগ্রপন্থা তা হতে দেয় না। ভায়ে ভায়ে ঝগড়া – রাজনীতির কূটচাল – আফস্পা – সবাই যেন কাশ্মীরের টুঁটি টিপে ধরেছে – একটু স্বাভাবিক হলেই নেমে আসে চরম আঘাত। ভূস্বর্গে এসেও ঘরবন্দী পর্যটক – ঝিলমের জল লাল – বুলবুল ঘরে এসে বসে না। অথচ চিনারের নতুন পাতার মতন শান্ত স্বাভাবিক কাশ্মীরের অপেক্ষায় আশার দিন গোনেন আবদুল চাচারা। যেখানে কেউ ঢিল ছুঁড়ে ক্ষোভ জানাবে না, জানবে 'আজাদি'র প্রকৃত অর্থ।
গন্তব্যে পৌঁছে চাচার হাতে টাকা দিলাম। না গুনে পকেটে ঢুকিয়ে আমার হাতদুটো ধরে বললেন, আজ ভয়ের হার হয়েছে, কারফিউও আজ হেরেছে ভূস্বর্গের সৌন্দর্য প্রেমী এক পাগলের কাছে, কাল আবার হারবে, পরশু কারফিউ রদ হবে, ভূস্বর্গে ভয়ঙ্কর বলে কিছু থাকবে না, আজ আমরা জিতেছি, বেটা খুশ রহেনা, আল্লাহ্‌ হামেশা তুমহে সলামত রাখনা।
চোখ ভিজে উঠল – এমন দিন জীবনে রোজ রোজ আসেনা। পা বাড়ালাম ডাল গেটের দিকে। আমার সঙ্গীরা নিশ্চয় খুব চিন্তা করছে। আমার ঝুলিতে আজ অনেক কাহিনি – আবদুল চাচার গল্প, ভূস্বর্গে স্বর্গের সন্ধানের গল্প। হাঁটতে হাঁটতে কানে আসে ভারি বুটের আওয়াজ - ডাল গেটে বন্দুক নিয়ে টহল দিচ্ছে জওয়ানেরা। ...

~ কাশ্মীরের তথ্য ~ কাশ্মীরের আরও ছবি ~

অরূপ চৌধুরীর কথায় – মাইক্রোবায়োলজিতে ডিগ্রি ছিল, কিন্তু চার দেওয়ালে আটকে থেকে গবেষণা নয়, প্রকৃতির থেকেই শিক্ষা পেতে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া, অপরিচিত জায়গাতে গিয়ে নতুনকে চেনা, আবার খুব পরিচিত জায়গাতে গিয়েও অজানা কিছুকে খুঁজে পাওয়া হল নেশা। নতুন জায়গাতে গিয়ে সেই জায়গাটা চেনা, সেখানকার মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো – এটাই যেন বেড়ানোর মূল উদ্দেশ্য। নতুন ভাষা, নতুন গান, নতুন খাবার – সব কিছুর আস্বাদ নেওয়া। পাশাপাশি ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দী করা। এটাই আমি। এভাবেই আমি পথ চলছি বেড়ানোকে ভালোবেসে, বেড়ানোর জন্য ছুটি খুঁজে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে।

SocialTwist Tell-a-Friend

To view this site correctly, please click here to download the Bangla Font and copy it to your c:\windows\Fonts directory.

For any queries/complaints, please contact admin@amaderchhuti.com
Best viewed in FF or IE at a resolution of 1024x768 or higher