ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি (চতুর্থ পর্ব)
আগের পর্ব – বদ্রীনারায়ণ থেকে মানা ও বসুধারা
এবার কাহিনি কেদারনাথের
সুবীর কুমার রায়
পূর্বপ্রকাশিতের পর -
বাইশে আগষ্ট। ঘুম ভাঙল বেশ সকালে। দাঁত মেজে, একতলায় সকালের কাজ সেরে, একবারে সব মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পাশের ঘরের সেই মোটা যুবক ও তার বৃদ্ধ সঙ্গীও আমাদের সঙ্গে পথে নামলেন। পঞ্চভাই-এর দক্ষিণা ও ঘরভাড়া বাবদ কুড়ি টাকা, গতকাল রাতেই দিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যাবেলা শোনপ্রয়াগ পৌঁছবার কথা। আগামীকাল কেদারনাথ দর্শন। আগে কেদার গেলে, ধ্বসে আটকে হয়তো ফিরে আসতে হত। আমাদের ভাগ্য ভাল বলেই মনে হল। বাস স্ট্যান্ডে এলাম। কোন বাস যাবে এখনও ঠিক হয়নি। প্যাসেঞ্জার হলে বাসের টিকিট দেওয়া হবে। কথায় কথায় যুবকটি গতকালের বসুধারা যাবার কথা তুলে বলল, "কালকের চায়ের দোকানের চা-টা কী সুন্দর করেছিল বলুন, এখনও মুখে লেগে আছে। ব্যাটাকে গড়তে বললাম ভগবান, গড়ে আনলো হনুমান। বলুন তাই নয়? আচ্ছা, ওই পথটা কি সত্যিই মহাভারতের মহাপ্রস্থানের পথ? সত্যিই কি ভীম ওই পুলটা তৈরি করেছিল"? আমি আর কী বলব, বললাম লোকে তো তাই বলে। যুবকটি বলল, "গতকাল আমরা তাহলে একপ্রকার পঞ্চপান্ডবের ভূমিকায় ছিলাম বলুন"। আমি (তার প্রস্থের দিকে একবার লক্ষ্য করে নিয়ে) বললাম, "অবশ্যই, আপনি দ্বিতীয় পান্ডব ছিলেন"। যুবকটি চুপ করে গম্ভীর হয়ে গেল।
এতক্ষণে কোন বাসটা যাবে জানা গেল। ড্রাইভারের বাঁ পাশে সিঙ্গল সিট ও তার ঠিক পিছনের দু'জনের বসার চেয়ার সিট দখল করে, রাস্তায় নেমে বাসের ছাদে মালপত্র গুছিয়ে রাখলাম। দু'জনে বসার আমাদের চেয়ার সিটটার পিছনের সিটটা, যুবক ও তার বৃদ্ধ সঙ্গীটি দখল করল। এতক্ষণ চারদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা ছিল। ধীরে ধীরে আকাশ পরিস্কার হচ্ছে। বাস স্ট্যান্ডের পিছনে, অর্থাৎ মন্দিরের বাঁপাশে বরফমন্ডিত শৃঙ্গ সূর্যালোকে নিজেকে প্রকাশ করল। এক দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ, কয়েকজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ও একজন যুবতীকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাসের ছাদ থেকে নেমে আসতে, ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি কোথায়, কোথা থেকে এখানে এসেছি, এখান থেকে আর কোথায় কোথায় যাব, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করলে, আমরা সব উত্তর দিলাম। বৃদ্ধের কথায় জানতে পারলাম, তাঁরা সোজা বদ্রীনারায়ণ এসেছিলেন। এখান থেকে এই বাসেই কেদারনাথ যাচ্ছেন। সেখান থেকে দেরাদুন ও মুসৌরী যাবেন। তিনি আরও জানালেন যে, এই নিয়ে তাঁর দু'-তিনবার কেদারনাথ যাওয়া হবে। যদিও দু'বার না তিনবার, স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। তাঁর মধ্যে একটু সবজান্তা সবজান্তা ভাব। যাহোক একটু পরে টিকিট কাউন্টার খুলল। আটষট্টি টাকা নব্বই পয়সা দিয়ে আমরা তিনটে শোনপ্রয়াগের টিকিট কাটলাম। রাস্তার ধারে একটা দোকান থেকে চা-জলখাবার খেয়ে নিয়ে বাসের কাছে অপেক্ষা করছি। বাসও ইতিমধ্যে বাসস্ট্যান্ডের মাঠ মতো ফাঁকা জায়গা থেকে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে একটু পরেই বাস ছাড়বে বললেও, ছাড়ার কোন লক্ষণ চোখে পড়ছে না। টাটার বেশ বড় ও নতুন বাস। কাল সময় করে বদ্রীনারায়ণ মন্দিরের পূর্ণাঙ্গ ছবি নেওয়া হয়ে ওঠেনি। এখন বেশ ভাল রোদ ওঠায়, ভাবলাম মন্দিরের একটা ছবি তুলে আনি। এখান থেকে মন্দির অনেকটা পথ। দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে প্রায় ছুটেই মন্দিরের সামনে, ব্রিজের ওপর গেলাম। খুশিমতো ছবি তুলে খুব দ্রুত বাসের কাছে ফিরে এসে দেখলাম, সেই একই ভাবে ড্রাইভারহীন বাস দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম ওয়ান ওয়ে, অর্থাৎ যোশীমঠে যেরকম দেখেছিলাম, সেইরকম ওদিক থেকে আজ বাস প্রথমে আসবে। যাহোক, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই লাইন দিয়ে বেশ কয়েকটা বাস, ট্রাক ইত্যাদি এসে হাজির হল। আমাদের বাসও আর সময় নষ্ট না করে ছেড়ে দিল।
খুব ভাল লাগছে, মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে চলেছি। হনুমান চটি যমুনোত্রীর পথে পড়ে জানতাম, এপথেও দেখি আছে। একজন পুরোহিত গোছের লোক, বাসের সবার কপালে লাল রঙের ফোঁটা পড়িয়ে দিয়ে গেল। গোবিন্দঘাটের ঠিক আগের স্টপেজে এসে বাস থামলে নেমে পড়লাম। তীরথের সঙ্গে গোবিন্দঘাট থেকে বদ্রীনারায়ণ যাবার দিনও বাস এখানে অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিল। এখানে একটা আপেল গাছে, হালকা লাল রঙের একটা আপেল দেখে গেছিলাম। আজও একটু খুঁজতেই সেটা চোখে পড়ল। রাস্তার পাশে একটু সমতল জমি, ধান চাষ হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়েই আছি, বাস আর ছাড়ে না। খবর নিয়ে জানা গেল, এখান থেকে এই বাসে মেল যাবে। চিঠিপত্র সম্ভবত সর্টিং করা হচ্ছে। বাসের সব যাত্রীদের সঙ্গে আমরাও চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। সব বাসই ছেড়ে গেছে কেবল আমাদেরটাই দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারও বিরক্ত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ডাক না নিয়েই বাস ছেড়ে দিল। বাসটা নতুন, কিন্তু গতি সব সময় সীমিত। আমাদের পিছনের সিটের যুবকটি জানাল, ধ্বস নামার জন্য কেদারনাথ যেতে না পেরে বদ্রীনারায়ণ-এ চলে আসার সময়ও "গৌচর" নামে একটা জায়গায় তাদের বাস ধ্বসে বেশ কয়েক ঘন্টা আটকে ছিল। একসময় আমরা সেই অভিশপ্ত হেলং শহরের কাছে এসে পৌঁছলাম। আশ্চর্য, এখানে কিছু হয়েছিল বলে মনে হ'ল না। এখানকার পাথরে বোধহয় চুনের ভাগ খুব বেশি। ধ্বসের জায়গায় রাস্তাটাও দেখলাম সাদা হয়ে আছে। তবে এখন সেটা বেশ চওড়া আর পরিস্কারও। গৌচরে বাস আসলে যুবকটি, কোনখানে ধ্বস নেমেছিল দেখাল। শুনলাম গৌচরে নাকি দেখার মতো মেলা বসে। এখানে এসে শুনলাম, বদ্রীনারায়ণে আর কিছুদিন পরেই বিষ্ণুযজ্ঞ হবে। প্রচুর সাধুসন্ত, ভক্ত ও সাধারণ মানুষের আগমন হবে সেই সময়। আমরা ফাঁকায় ফাঁকায় ভালই ঘুরেছি।
একসময় বাস এসে "পিপলকোঠি"তে থামলো। সেই পিপলকোঠি, যেখানে শ্রীনগর থেকে যাবার সময়, দুপুরের খাওয়া সেরেছিলাম। এবারেও বাস থামার সেই একই উদ্দেশ্য, দুপুরের আহার এখানেই সেরে নিতে হবে। আশ্চর্য, জায়গাটা আগে চিনতেই পারি নি। গতবারের বাস ড্রাইভারের সঙ্গে বোধহয় ওই ছোট হোটেলগুলোর কোন কমিশনের ব্যাপার ছিল। তা নাহলে এত বড় বড় দোকানপাট থাকতে, ছোট ছোট দুটো দোকানের কাছেই বা বাস দাঁড় করাবে কেন? এখন দেখছি বেশ বড় শহর, বেশ বড় বড় দোকান আছে। একটা হোটেলে দিব্বি মনের সুখে গরম গরম মাংস আর রুটি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিলাম। কী ভাল যে লাগল কী বলব। মনে হ'ল যেন অমৃত খেলাম। ড্রাইভার বলেছিল, একটু তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে, নাহলে আজ শোনপ্রয়াগ পৌঁছনো যাবে না। গুপ্তকাশীর পর থেকে ওদিকের রাস্তা একবারে কাঁচা। তার ওপর অনবরত ধ্বসে, রাস্তার অবস্থাও খুবই খারাপ। নিজেদের স্বার্থে আমাদের বাসের যতগুলো যাত্রীকে কাছাকাছি দেখতে পেলাম, ড্রাইভারের কথা বলে বাসে উঠতে বললাম। সেই দাড়িওয়ালা বূদ্ধের দু'একজন সঙ্গীর জন্য, বাস আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ড্রাইভার আবার বললো, বিকেল চারটে-সাড়ে চারটের মধ্যে গুপ্তকাশী পৌঁছতে না পারলে, এখানকার ট্রাফিক-রুল মতো, আজ আর শোনপ্রয়াগ যেতে দেওয়া হবে না। যাহোক কিছুক্ষণ পর সবাই ফিরে আসায়, বাস আবার এগিয়ে চলল।
অনেকটা রাস্তা পার হয়ে আবার আমরা রুদ্রপ্রয়াগ এসে পৌঁছলাম। এই জায়গাটাকে জংশন বলা যেতে পারে। এখান থেকে কেদারনাথ ও বদ্রীনারায়ণ যাওয়ার রাস্তা ভাগ হয়ে দু'দিকে বেঁকে গেছে। এখন প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে। আকাশে অবশ্য যথেষ্ট রোদ আছে। কেবল বিকেল হয়েছেও বলা যায়। কিন্তু এখানকার ট্রাফিক আইন অনুযায়ী, আজ আর শোনপ্রয়াগ যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। বাস কিছুক্ষণের জন্য এখানে দাঁড়াবে। বাস থেকে নেমে চা খেয়ে নিয়ে, জায়গাটা একটু ঘুরে দেখলাম। দেখা হয়ে গেল সেই অমরনাথ, কেদারনাথ ফেরৎ দু'জন যুবকের সঙ্গে। বলল বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তাদের পক্ষে এবার আর নন্দন কানন, হেমকুণ্ড যাওয়া সম্ভব হল না। এদের বাকী সঙ্গীদের দেখলাম না। তারা বোধহয় হেমকুণ্ডের দিকে গিয়ে থাকবে। যাওয়ার সময়ও এই জায়গাটা এক চক্কর ঘুরে দেখেছিলাম। সত্যিই খুব সুন্দর। এখানে দাঁড়িয়ে আবার সেই একই কথা মনে হচ্ছে। ভাবছিলাম জিম করবেট যেসময়ে এখানে চিতা মেরেছিলেন, তখন এখানকার অবস্থা কীরকম ছিল? চিতাটাকে উনি মারলেন কী ভাবে? চিতাটা নিশ্চই প্রাণ দেওয়ার জন্য খাদ থেকে রাস্তার ওপর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল না। যাহোক, বাস ছেড়ে দিল। গন্তব্য স্থান, এখান থেকে সম্ভবত আটষট্টি কিলোমিটার দূরের শোনপ্রয়াগ। একবার মনে হচ্ছে আজই হয়তো শোনপ্রয়াগ পৌঁছে যাব। আবার মনে হচ্ছে এতটা পথ যাওয়ার মতো হাতে সময় কোথায়? এদিকের রাস্তা কিন্তু বেশ ভাল। ড্রাইভার জানাল, গুপ্তকাশীর পর থেকে রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। আজ বাস নিয়ে শোনপ্রয়াগ যাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। নীচে রাস্তার বাঁপাশে বিরাট একটা সমতল মাঠ। অনেক ছেলে সেখানে সাইকেল চালাচ্ছে। একধারে ভলিবল খেলা হচ্ছে। অনেকদিন পরে সমতল জমি দেখলাম।
গুপ্তকাশী যখন পৌঁছলাম, তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তার এদিক থেকে ওদিক, লেভেল ক্রসিং এর গেটের মতো, একটা কাঠের গেট ফেলা। আজ আর এদিক ওদিক, কোন দিকেরই বাস যাতায়াত করবে না। ড্রাইভার জানাল, এখানে হোটেল, ধর্মশালা, পাওয়া যাবে। কাল সকালে আবার বাস ছাড়বে। কিন্তু বাসের কিছু যাত্রী আজই শোনপ্রয়াগ যাওয়ার জন্য, ড্রাইভারকে জোর করতে লাগল। দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ এদের নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন। তিনি বলছিলেন, এপথে অনেকবার এসেছেন। রাস্তা এমন কিছু খারাপ নয়, যে আজ যাওয়া যাবে না। এতক্ষণ বাসের সামনের সিঙ্গল সিটে বসে ঘুম আসছিল। মাধব আমাকে পেছন থেকে ডেকে দিল। ড্রাইভারের পাশের ও ঠিক পেছনের দু'দিকের সিটে বসে ঘুমানো নিষেধ। ঠিক হয়ে বসলাম। ড্রাইভার বলল, সামনের রাস্তা একেবারে কাঁচা। একটু এদিক ওদিক হলে, বাস গভীর খাদে গড়িয়ে যেতে পারে। সবজান্তা বৃদ্ধও নাছোড়-বান্দা। আমরা বললাম ড্রাইভার যখন বাস নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে, তখন নাহয় আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে যাই। বৃদ্ধ আবারও বললেন, তিনি এপথে অনেকবার এসেছেন। ধ্বস নামলেও কোন ক্ষতি হবে না, বাস ঠিক চলে যাবে। আমাদের অবশ্য ঠিক মত ছিলনা। বললাম, প্রত্যেকবার তো রাস্তা একই রকম থাকে না। ড্রাইভার যখন চাইছে না, কী দরকার অযথা ঝুঁকি নেবার। বৃদ্ধ সেই একই কথা আবার বললেন যে, তিনি আগে এপথে অনেকবার এসেছেন। ভয় পেলে এপথে যাওয়া যায় না। বিরক্ত হয়ে বললাম, বাস খাদে পড়লে, তাদের ও আমাদের একই দশা হবে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় বাস কোন কারণে যেতে না পারলে, বিপদ বা ঝুঁকি তাদেরই বেশি, সঙ্গে বয়স্ক লোক ও একজন যুবতী আছে। আমরা একটা রাত অন্ধকারে বাসে বসে কাটিয়ে দিতে পারবো। এখনও প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পথ যেতে বাকী। অচেনা অজানা রাস্তায়, অন্ধকার বাসে বসে রাত কাটানো, তাদের পক্ষে ঠিক বা নিরাপদ হবে তো? শেষে ড্রাইভার বেচারা অনেকের চাপে পড়ে জানাল, সবাই যদি এই অন্ধকারে যেতে চায়, তবে স্পেশাল পারমিশান নিয়ে সে যেতে রাজী আছে। তবে আজ না গেলেই বোধহয় সবাই ভাল করতো। সবজান্তা বৃদ্ধ জয়ের হাসি হাসলেন। যাহোক, ড্রাইভার নেমে গিয়ে কী ভাবে ব্যবস্থা করে, ফিরে এসে বাসের স্টিয়ারিং -এর ওপর হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কী সব বলে, বারকতক নমস্কার করে, আবার একবার রাস্তা খুব খারাপ, আজ না গেলেই ভাল করতেন বলে, বাস ছেড়ে দিল।
চারিদিক ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সামনের জোরালো হেডলাইটের আলোয় বাস এগিয়ে চলেছে। ড্রাইভার বাসের গতিও অসম্ভব বাড়িয়ে দিয়েছে। খানিকটা পথ এগোতেই, একটা বেড়াল রাস্তার একদিক থেকে অপরদিকে চলে গেল। ব্যস, বিল্লি রাস্তা কাট্ দিয়া বলে ড্রাইভার বাস থামিয়ে, ইঞ্জিন বন্ধ করে, সব আলো নিভিয়ে দিল। উঃ, বাসের একবারে সামনে ড্রাইভারের বাঁপাশে বসে দেখতে পাচ্ছি চারদিকে কী ঘন অন্ধকার। কিছুক্ষণ সময় এইভাবে থেকে, বারবার বিল্লি রাস্তা কাট্ দিয়া, বিল্লি রাস্তা কাট্ দিয়া বলতে বলতে, ইঞ্জিন চালু করে, ড্রাইভার আবার বাস এগিয়ে নিয়ে চলল। মনে পড়ে গেল, গত বছরের কথা। আমরা দিল্লি থেকে বাসে হরিদ্বার যাচ্ছি। অসম্ভব গতিতে বাস ছুটছে, হঠাৎ ড্রাইভার প্রচন্ড জোরে ব্রেক কষে, দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা একে অপরের গায়ে গিয়ে পড়লাম। অনেকে বেশ গুরুতর আঘাতও পেল। কী ব্যাপার, না বিল্লি রাস্তা কাট্ দিয়া। এটা সমস্ত রাজ্যে, সমস্ত গাড়ির ড্রাইভারের কাছে একটা অশুভ ইঙ্গিত। বাসের চল্লিশ পঞ্চাশজন যাত্রী আহত হোক ক্ষতি নেই, তবু বাস না দাঁড় করিয়ে, একটু না থেমে, এক ইঞ্চিও বাস এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। অনেকে আবার বলে বিল্লিকে চাপা দিয়ে চলে যেতে পারলে নাকি আর কোন বিপদের সম্ভাবনাই থাকে না। যাহোক্, সেই বিল্লি আবার এবারেও রাস্তা কেটে দিল। তা আবার অন্ধকার রাতে এরকম দুর্গম পথে।
ড্রাইভার একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছে বলে মনে হ'ল। ওকে একটা সিগারেট দিলাম। দুশ্চিন্তা থেকে ওর মনটাকে যদি ফিরিয়ে আনা যায় এই আশায়। প্রথমে নেবে না বলে, পরমুহূর্তেই হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিল। এবার একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ওই গতিতেই বাস নিয়ে এগিয়ে চলল। চোখ যদিও সামনের দিকে, তবু এটা বিপজ্জনক তো বটে। তাই আমরা কথা বন্ধ করলাম। রাস্তার অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। রাস্তার ওপর দিয়ে দু'এক জায়গায় বড়সড় ঝরনাও বয়ে যেতে দেখলাম। কেদারের পথ বিশেষজ্ঞ বৃদ্ধও বোধহয় এবার একটু ভয় পেয়ে চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। বেশ কিছুটা দূরে দেখলাম, রাস্তার ওপর কী যেন রাখা আছে। বাস আরও কাছে আসতে বুঝলাম রাস্তার ওপর গাছের বেশ বড় বড় গুড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। ড্রাইভার ব্রেক কষে বাস দাঁড় করিয়ে, আমাদের নামতে বারণ করল। সম্ভবত এই পথে এত রাতে বাস বা অন্যান্য গাড়ি চলাচল করে না বলেই, সকালে সরিয়ে নিয়ে যাবে ভেবে কেউ গাছ কেটে রাস্তায় রেখেছে। ড্রাইভার তো সেই অদৃশ্য ব্যক্তির উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে শুরু করে দিল। কন্ডাক্টার নিশব্দে বাস থেকে নেমে একপাশে গুঁড়িগুলো ঠেলে সরিয়ে দিতে লাগল। ড্রাইভার চিৎকার করে গাছের গুড়িগুলো খাদে ফেলে দিতে বলল। কন্ডাক্টার কথা না শোনায়, সে তাকেও গালিগালাজ করতে লাগল। যাহোক, শেষ পর্যন্ত বাস আবার ছেড়ে দিল। মধ্যে মধ্যে রাস্তার পাশে গ্রাম পড়লে, সেখানে বাচ্চা-বুড়ো সবাই দেখি দাঁড়িয়ে, অবাক হয়ে বাসের দিকে তাকিয়ে দেখছে। বোধহয় এত রাতে এ রাস্তায় বাস দেখে, তারাও অবাক না হয়ে পারছে না। শেষ পর্যন্ত রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা অক্ষত অবস্থায় শোনপ্রয়াগ এসে পৌঁছলাম। একটা উদ্বেগ ও বিপদ কেটে গেল।
নেমে শুনলাম, এখানে ইলেকট্রিক লাইন থাকলেও, যেকোন কারণে গত দু'দিন ধরে আলো জ্বলছে না। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে দূরে কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছে। কোনদিকে হোটেল বা ধর্মশালা পাওয়া যাবে ভেবে পেলাম না। অন্ধকারেও খেয়াল করলাম প্রচুর বাস দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল জায়গাটা বেশ বড়, নিশ্চয় অনেক হোটেল পাওয়া যাবে। অন্ধকারে বাসের ছাদে উঠে হাতড়ে হাতড়ে মালপত্র নামালাম। দিলীপ একজনের সঙ্গে রাতে থাকবার জায়গা নিয়ে কথা বলছে। এত রাতে এপথে বাস আসে না। তাই বোধহয় অনেক কৌতূহলী লোকের ভীড় বাসটার কাছে। খোঁজ পাওয়া গেল বাসগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে পোষ্ট অফিসে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে। একে অন্ধকার, তার ওপর রাত প্রায় ন'টা বাজে। তাই কথা না বাড়িয়ে, নিজেরাই মালপত্র হাতে নিয়ে পোষ্ট অফিসের খোঁজে পা বাড়ালাম। বাড়িটা খুব কাছেই। একটা পোষ্ট অফিসের সঙ্গে লাগোয়া তিনটে ঘর। দশ টাকা ভাড়া। এখানে আবার মালপত্র রেখে যাবার, অর্থাৎ ক্লোক রুমের ব্যবস্থাও আছে। তার ভাড়া মাত্র ছ'টাকা। যুবকটিও আমাদের পিছন পিছন এসেছে। ইচ্ছা, তারা দু'জনেও আমাদের সঙ্গে এক ঘরে থাকে। আমাদের এটা মোটেই ইচ্ছা নয়। দিলীপের ওপর ওদের আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করার ভারটা দেওয়া হল। ও বেশ সহজেই দু'দলের দু'ঘরে আলাদা থাকার ব্যবস্থা পাকা করে ফেললো।
এ বাড়ির মালিকই বোধহয় পোষ্টমাষ্টার বা পোষ্ট অফিসের কোন কর্মচারী। পাণ্ডার কাজও করেন। কথায় কথায় জানালেন, দশ টাকা দিলে তিনি নিজে বা অন্য কোন পাণ্ডাকে আমাদের সঙ্গে ত্রিযুগীনারায়ণ পাঠিয়ে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। মাধব কী করা উচিত জিজ্ঞাসা করলে বললাম, পাণ্ডার কোন প্রয়োজন নেই। নিজেরাই যাব, পুজো দিতে চাইলে, ওখান থেকেই কোন পাণ্ডা ঠিক করে নেওয়া যাবে। তাই ঠিক হল। যুবকটি বলল তারা ত্রিযুগীনারায়ণ যাবে না, কাল সকালে এখান থেকে সোজা কেদারনাথ চলে যাবে। ঠিক করলাম কাল খুব ভোরে ত্রিযুগীনারায়ণ চলে যাব। ওখান থেকে ফিরে ট্যাক্সিতে গৌরীকুণ্ড, এবং সম্ভব হলে হেঁটে কেদারনাথ। শুনলাম এখান থেকে ত্রিযুগীনারায়ণ মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার পথ। এই ব্যবস্থা পাকা করে, আমরা রাতের খাবার খেতে রাস্তায় এলাম। কোন হোটেল দেখলাম না। দুটো দোকানে বলল, অর্ডার দিলে রুটি তরকারি বানিয়ে দেবে। বাধ্য হয়ে তাই অর্ডার দিয়ে বসে রইলাম। দেখলাম, অনেকটা আটামাখা হাতে নিয়ে, দু'চার বার চাপড় মেরে এক ইঞ্চি মোটা রুটির আকারে পরিণত করে, কাঠের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। রুটির যে অংশটা আগুনের দিকে রয়েছে, সেদিকটা পুড়ে কালো হয়ে গেল, কিন্তু অপর দিকটা যেমনকার কাঁচা, প্রায় সেরকমই রয়ে গেল। আমরা সঙ্গে করে মাখন নিয়ে এসেছি। ছোট ছোট আলুর তরকারিতে একটু মাখন ফেলে, তাই দিয়ে দুটো করে রুটি খেয়ে, দাম মিটিয়ে নিজেদের ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। কাল ভোরে আবার উঠতে হবে।
তেইশে আগষ্ট। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমরা তৈরি। পোষ্ট অফিসের মালিক এসে উপস্থিত হলেন। দশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। কাঁধের তিনটে ব্যাগে টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে, ওয়াটার বটল, হোল্ড-অল আর সুটকেসগুলো ভদ্রলোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে, মাল রাখা বাবদ ছ'টাকা ভাড়া দিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম। শোনপ্রয়াগে মন্দাকিনী ও শোনগঙ্গা মিলিত হয়েছে। এখান থেকে বাঁদিকে ত্রিযুগীনারায়ণ যাবার পথ বেঁকে গেছে। ব্রিজ পার হয়ে ডানদিকে কেদারনাথ যাওয়ার পথ। এখান থেকে গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত ট্যাক্সি পাওয়া যায়। গৌরীকুণ্ড থেকে পায়ে হেঁটে কেদারধাম যেতে হবে। ব্রিজের ঠিক আগেই আমরা বাঁদিকে ত্রিযুগীনারায়ণ যাওয়ার পথ ধরলাম। বোর্ডে লেখা— ত্রিযুগীনারায়ণ ৩.৬ কিলোমিটার। গোবিন্দঘাট যাওয়ার পথে ধ্বসে আটকে থাকার সময় দেখেছি বহু লোক পাহাড়ের গা থেকে এক প্রকার গাছের সরু সরু পাতা ছিঁড়ে নিচ্ছে। জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম ওগুলো সিদ্ধি গাছ। সিদ্ধি গাছের কাঁচা পাতা খেলে নেশা হয় কী না তারাই বলতে পারবে। এখানেও দেখলাম ঐ সিদ্ধি গাছের জঙ্গল। অনেকে আবার এগুলোকে গাঁজা গাছ বলল। তা গাঁজাই হোক আর সিদ্ধিই হোক, এপথে এই গাছ না থাকাটাই অস্বাভাবিক, কারণ এখানে বামে ত্রিযুগীনারায়ণ ডানে কেদারনাথ। গোটা এলাকাটাই ভোলে বাবার রাজত্ব! অনেক ওপরে দেখলাম বেশ কয়েকজন লাইন দিয়ে উঠছে। মধ্যে মধ্যে ইলেকট্রিকের তার নিয়ে যাবার জন্য মোটা মোটা ইস্পাতের পোষ্ট। পোষ্ট লক্ষ্য করে সোজা রাস্তা ও বাইপাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। পায়ে হাঁটার রাস্তা হিসেবে খারাপ নয়। মধ্যে মধ্যে ওপর থেকে রাস্তার ওপর দিয়ে ঝরনা নেমে এসেছে। মূল ঝরনা বা এই ঝরনাগুলোর উৎস কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না। রাস্তা বেশ খাড়াই। ঝরনার জলে জুতো মোজা ভিজে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে, তবে সংখ্যায় বড় অল্প। সমস্ত রাস্তার পাশে পাশেই সিদ্ধি গাছের জঙ্গল। রাস্তার ওপর বেশ কয়েক জায়গায় কয়েকটা সজারুর কাঁটা কুড়িয়ে পেলাম। এখানে সজারু আছে, না এপথে যাওয়ার সময় কেউ এগুলো ফেলে গেছে, বুঝতে পারলাম না। প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সাধারণ। ফলে হাঁটতে ভালও লাগছে না, কষ্টও হচ্ছে। আরও আধঘন্টা কী পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর, উল্টো দিক থেকে আগত একজন স্থানীয় মানুষকে জিজ্ঞাসা করলাম— আর কত দূর? উত্তর পেলাম, তিন মিল। অর্থাৎ এখনও তিন মাইল রাস্তা। কী করে এতটা পথ হাঁটার পরও তিন মাইল রাস্তা বাকী থাকে, স্বয়ং ত্রিযুগীনারায়ণই বলতে পারবেন। বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলার একটা দল দেখলাম রাস্তার ওপর বসে আছে। এখনও অনেকটা পথ বাকী আছে শুনে তারা কেমন মুষড়ে পড়ল। আমরা এগিয়ে চললাম।
হাঁটতে আর ভাল লাগছে না। বেশ কষ্টকর রাস্তা। এবার আমরা একটা ছোট মন্দির, ও মন্দির সংলগ্ন খানিকটা ঘেরা জায়গা দেখতে পেলাম। খুব খুশি হলাম শিবদুর্গার বিবাহ স্থানে এসে গেছি ভেবে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ওখানে পৌঁছলাম। অবাক হয়ে গেলাম যখন শুনলাম, এটা মোটেই ত্রিযুগীনারায়ণ মন্দির নয়। আরও অবাক হলাম যখন শুনলাম, এখান থেকেও মন্দির মাত্র তিন মিল রাস্তা। এটা "শাকোম্বরী" মন্দির। ইনি স্বর্গের কোন বিভাগের ভারপ্রাপ্তা জানি না। জানার ইচ্ছাও এখন আর নেই। খোলা ঘেরা জায়গাটায় দেখলাম একজন বৃদ্ধ সাধু গোছের লোক একটা বই পাঠ করছেন, এবং রাস্তায় দেখা সেই দলটার মতো অনেক ভক্ত, মন দিয়ে তাঁর পাঠ শুনছে। যতদূর মনে হ'ল, রামায়ণ পাঠ হচ্ছে। সামনে একটা বোর্ড লাগানো। তাতে লেখা আছে— ত্রিযুগীনারায়ণ ৩.৬ কিলোমিটার পথ। একবারে নীচে ব্রিজের কাছে যত দূরত্ব দেখেছিলাম, সকাল থেকে এতটা পথ হেঁটে এসে, এখানেও দেখি সেই একই দূরত্বই লেখা আছে। সত্যি সত্যি আরও ৩.৬ কিলোমিটার পথ যেতে বাকী আছে কী না কে জানে! এখানে সবই সম্ভব। আমরা আবার এগিয়ে চললাম।
রাস্তার পাশে একটা ঝরনার জলে জাঁতা ঘুরিয়ে সম্ভবত গম ভাঙ্গা হচ্ছে। কোন লোকজনকে অবশ্য দেখলাম না। হঠাৎ কানে তালা লাগানো আওয়াজ। প্রথমে একটু ভয় পেলেও, পরে হেলং-এর কথা মনে পড়ল। বুঝলাম কোথাও ব্লাষ্টিং হচ্ছে। সকালে সামান্য চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছি। খিদেও পেয়েছে খুব। সঙ্গে গতকালের কেনা কিছুটা ঝুড়িভাজা ছিল। নরম হয়ে গেলেও, তাই সামান্য করে খেয়ে, আবার এগিয়ে চললাম। উল্টোদিক থেকে একজন স্থানীয় যুবককে কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে আসতে দেখলাম। তাকে আর কত দূর জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলাম, "দুই-ঢাই মিল্ হোগা"। যাক, তবু আধ কিলোমিটার পথ অন্তত কমানো গেছে। আবার এগিয়ে চলা। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে দূরে, বহু দূরে, একটা মন্দিরের সাদা পতাকা নজরে এল। দেখে বেশ আনন্দ হলেও ভয় হ'ল, কাছে গিয়ে হয়তো দেখব কোন কাদম্বরী বা ধন্বন্তরী দেবীর মন্দির। আজই আমাদের কেদারনাথ যাওয়ার ইচ্ছা, তাই সময় নষ্ট না করে গতি বৃদ্ধি করলাম। অবশেষে ওদের কথামতো ৩.৬ কিলোমিটার পথ পার হয়ে মন্দিরে এসে পৌঁছলাম।
উড়িষ্যার পুরী বা আশেপাশের অন্যান্য মন্দিরগুলোর মতো অনেকটা দেখতে হলেও, মনে হয় যেন সিমেন্টের তৈরি। আসলে যদিও পাথরেরই। মন্দিরের বাইরে উঁচু চাতালে গোটা দু'-তিন চায়ের দোকান। বাদবাকী, দোকানের মতো অনেকগুলো ঘর। তবে সবকটা ঘরেই পাণ্ডার ভিড়। একটা কল থেকে একভাবে জল পড়ে যাচ্ছে। যদিও তার চারপাশে ভীষণ নোংরা, তবু খানিকটা করে জল খেয়ে, মন্দিরে যাবার জন্য তৈরি হলাম। মোটা মোটা লাল কাপড়ে বাঁধানো চিত্রগুপ্তের খাতা হাতে পাণ্ডারা এসে হাজির হ'ল। তাদের প্রয়োজন আমাদের নাম, ধাম, বাবার নাম ইত্যাদি। আমরা পুজো দিতে আসিনি, কাজেই এ সবের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই, ইত্যাদি বলতে বলতে, আমরা সিঁড়ি দিয়ে নীচে মন্দিরের চাতালে এলাম। মন্দিরে ঢুকবার আগে জুতো মোজা খুলে, ব্যাগ তিনটে ও লাঠিগুলো এক জায়গায় রেখে গেলাম। মন্দিরের ভিতর সব সময় একটা প্রদীপ জ্বলে। শিবদুর্গার বিবাহের সাক্ষী হিসাবে, নারায়ণ তিন যুগ ধরে এখানে অবস্থান করছেন বলে শুনলাম। নারায়ণের কী অন্য কোন কাজ নেই, না শিবের বিয়ের সময় ভাল বিয়ে বাড়ি পাওয়া যেত না জানি না! ডানপাশে বাঁধানো চৌবাচ্চা মতো। সেখানে স্নান সেরে বহু হিন্দুস্থানী পুণ্যার্থী, গোল হয়ে বসে আছে। পান্ডারা তাদের লাল খাতা খুলে, নাম ধাম ইত্যাদি খুঁজে বার করে, মন্ত্র পাঠ করাচ্ছে। আকাশে বেশ মেঘ করেছে। রোদের জন্য ক্যামেরা হাতে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে রোদের আশা ছেড়ে দিয়ে মেঘের মধ্যেই বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এবার ফেরার পালা। জুতো মোজা পরে, ব্যাগ ও লাঠি নিয়ে বাইরে এলাম। আবার সেই কান ফাটানো ব্লাষ্টিং-এর আওয়াজ - শোনপ্রয়াগ থেকে ত্রিযুগীনারায়ণ, বাস রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। সামনের চায়ের দোকানে বসে তিনজনে চা খাচ্ছি, দু'জন পান্ডা এসে বললো পুজো না দেবেন তো কী হয়েছে, প্রসাদ নিন। তারা সামান্য প্রসাদ দিয়ে গেল। কথা না বাড়িয়ে প্রসাদগুলো ব্যাগে রেখে দিলাম। এবার সত্যিই ওঠার পালা। আমরা পুরানো রাস্তা ধরে নামতে শুরু করলাম। আমাদের কাছে ইউ.পি.হিলস্ এর যে গাইড ম্যাপ ছিল, তাতে দেখলাম শোনপ্রয়াগ থেকে ত্রিযুগীনারায়ণের দূরত্ব, মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ। মনে হয় এ ম্যাপটাই ঠিক। এর আগেও অনেক হেঁটেছি। ৩.৬ কিলোমিটার পথ এটা যে নয়, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আসবার সময় যে বাইপাসগুলো ব্যবহার করিনি, এবার সেগুলো দিয়ে নেমে আসায়, খুব দ্রুত নীচে নেমে আসতে শুরু করলাম। সেই ঝরনা, গাঁজা বা সিদ্ধির জঙ্গল পেরিয়ে, একসময় আমরা নীচের ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছলাম।
গতকাল রাতে যেখানে খাবার খেয়েছিলাম, সেই দোকানেই খাবার খেতে গেলাম। মাখনের প্যাকেটটা নিয়ে আসা হয় নি। তাছাড়া মাধবের পায়ে ব্যথার জন্য নী-ক্যাপটাও আনা প্রয়োজন। মাধব ও দিলীপ আমাদের আস্তানায় গিয়ে ওগুলো নিয়ে ফিরে এল। রুটি আর আলুর তরকারি খেয়ে, আমরা গৌরীকুণ্ড যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ঠিক করলাম। এখানে প্রচুর ট্যাক্সি শোনপ্রয়াগ-গৌরীকুণ্ড যাতায়াত করে। দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। তিনজনের ভাড়া পড়ল বার টাকা। গৌরীকুণ্ড জায়গাটা দেখে মনে হ'ল, শোনপ্রয়াগের থেকে ছোট হলেও অনেক উন্নত। এখানেও ইলেকট্রিক আলো আছে, তবে কোথাও কিছু খারাপ হওয়ায় শোনপ্রয়াগের মতোই জ্বলছে না। শোনপ্রয়াগে শুনেছিলাম, গৌরীকুণ্ডে মন্দির কমিটির বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা নাকি ভাল। গৌরী দেবীর মন্দির ছেড়ে একটু এগিয়ে রাস্তার ডানপাশে মন্দির কমিটির ঘর। আজই কেদারনাথ চলে যাবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু স্থানীয় লোকেদের উপদেশ, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আজ আর কেদারনাথ যাওয়া ঠিক হবে না। এখান থেকে চোদ্দ কিলোমিটার হাঁটা পথ। ঠিক করলাম আজ গৌরীকুণ্ডে থেকে, কাল সকালে কেদারনাথ যাব। মন্দির কমিটির একটা ঘর ষোল টাকা দিয়ে ভাড়া নিলাম। কাঠের মেঝে। কম্বল ও লেপ পাওয়া গেল। আমরা সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসি নি। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে একটু বিশ্রাম নেব ভাবলাম।
মাধব শুয়ে পড়ল। আমি আর দিলীপ ক্যামেরা হাতে জায়গাটা এক চক্কর ঘুরে দেখতে বেরোলাম। গৌরীদেবীর মন্দিরের সামনে একটা চৌবাচ্চা মতো আছে। তাতে অবশ্য ঠাণ্ডা জল। সামনেই গৌরীকুণ্ড, গরম জলের কুণ্ড। এখানেই পূজা, তর্পণ, পিন্ডদান ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। এখানেই একটা দোকানে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে ঘরে ফিরে এসে, আমরাও লেপ চাপা দিয়ে পরম আরামে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল বেশ বিকেলে। দুপুরে ঘুমিয়ে শরীরটা খারাপ লাগছে। মাধবের ইচ্ছা কেদারনাথে একদিন থাকার। আমরা ভেবেছিলাম যেদিন যাব, সেইদিনই সন্ধ্যায় ফিরে আসবো। শেষ পর্যন্ত কেদারনাথে রাতে থাকার ব্যবস্থাই পাকা হ'ল। দুপুরের দিকে খুব হাল্কা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তা এখনও অল্প অল্প ভিজে আছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল।
আটটা নাগাদ আমরা রাতের খাবার খেতে নির্দিষ্ট দোকানে গেলাম। দোকানদার ভদ্রলোক খুব ভাল মানুষ, নাম প্রতাপ সিং। বললেন, তাঁর দোকানের ওপরে দোতলায় থাকার ব্যবস্থা আছে। সিজনের সময় ভাড়া বাবদ সামান্য কিছু টাকা নেন। এখন অফ্-সিজন এর সময়, থাকার জন্য কোন চার্জ লাগে না। এরকম প্রস্তাব যে কেউ, কোথাও, কোনদিন দিতে পারে, স্বপ্নেও ভাবিনি। এখানে থাকলে আমাদের সুবিধাও হ'ত। টপ্ করে দোতলা থেকে এক তলায় নেমে রাতের খাবার খাওয়াও যেত, ঠান্ডায় এতটা আসার প্রয়োজনও হ'ত না। আর ষোল টাকা ভাড়া তো বেঁচে যেতই। যাহোক, পুরী, তরকারী খেয়ে, পরের দিন সকালের জন্য জলখাবারের অর্ডার দিয়ে, আমরা ঘরে ফিরে এলাম। রাতে খুব আরামে লেপের তলায় ঘুমালাম।
চব্বিশে আগষ্ট। ঘুম ভাঙ্গল খুব সকালে। হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে ঘরের ভাড়া মিটিয়ে, কাঁধের ঝোলাব্যাগ সঙ্গে নিয়ে, আমরা সেই দোকানে খাবার খেতে গেলাম। গরম গরম পুরী, তরকারি আর লাড্ডু দিয়ে প্রাতরাশ সেরে, হাঁটার জন্য প্রস্তুত হলাম। দোকানদার বললেন, ফেরার সময় গৌরীকুণ্ডে রাত কাটালে, তাঁর ওখানে থাকলে খুশি হবেন। সম্মতি জানিয়ে কেদারনাথের রাস্তা ধরলাম। আকাশ পরিস্কার। একদিন অনেকটা সময় বিশ্রাম পাওয়ায়, শরীরও বেশ চাঙ্গা। হাঁটতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। পাশ দিয়ে ঘোড়া ও কান্ডিতে বুড়োবুড়ি এমন কী যুবক যুবতীদেরও, কেদারনাথের দিকে যেতে দেখলাম। বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে, বদ্রীনারায়ণের সেই যুবক ও তার বৃদ্ধ সঙ্গীটিকে ফিরতে দেখলাম। তারা বলল, কেদারনাথে বিড়লা গেষ্ট হাউসে গতকাল রাতে ছিল। পথে একটা বিরাট ঝরনা পেলাম। প্রাণভরে ঠান্ডা জল খেয়ে আবার এগোলাম। সামনেই "রামওয়াড়া" চটি। এখানে রাত কাটাবার ভাল ব্যবস্থা আছে। পৌঁছে দেখি, বেশ কিছু লোক শোনপ্রয়াগ যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। গতকাল রাতে তারা এখানেই ছিল। দূরে বরফ ঢাকা শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। ঝুড়িভাজা ও চা খেয়ে, সামনের রাস্তা ধরলাম। প্রাকৃতিক দৃশ্য বেশ সুন্দর। রাস্তাও বেশ চওড়া ও ভাল। ফলে মনের আনন্দে চলেছি। আর কিছুটা পথ এসে, "গরুড়" চটিতে হাজির হলাম। এখানে আলাপ হ'ল হাওড়া কদমতলার চারজনের সঙ্গে। একজন একটা স্কুলের শিক্ষক, বাকী সবাই ব্যবসা করে। চেনাশোনা অনেকের কথাই তারা জিজ্ঞাসা করল। বলল, হাওড়া থেকে মোটরে গৌরীকুণ্ডে এসে, ওখানে গাড়ি রেখে, হেঁটে কেদারনাথ এসেছে। এখন আবার ফিরে যাবে গৌরীকুণ্ডে। হাতে কেদারনাথের পূজার ব্রহ্মকমল। বললাম, আমরা ব্রহ্মকমলের রাজত্ব পার হয়ে এসেছি। সব শুনে তারাও হেমকুণ্ড-নন্দন কানন যাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠল। বললাম, অনেক হাঁটতে হবে। বলল, সঙ্গে গাড়ি আছে। মনে মনে ভাবলাম সঙ্গে গাড়িই থাক আর টাকাই থাক, সৌন্দর্য কুড়োতে গেলে, হাঁটতে তোমাদের হবেই। অবশ্য ঘোড়া বা কান্ডি নিতে পার।
কেদারনাথের উচ্চতা ৩৫৮৪ মিটার। গৌরীকুণ্ড মাত্র ১৯৮১ মিটার। কিন্তু কেদারনাথের রাস্তা খুব ধীরে ধীরে ওপর দিকে ওঠায়, হাঁটার কষ্ট বেশ কম। বহুদূরে বরফ ঢাকা শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। শুনলাম ওই শৃঙ্গের পাদদেশেই কেদারনাথ মন্দির। অনেকক্ষণ হাঁটছি, পথের যেন আর শেষ নেই। ডান্ডি বা কান্ডিগুলোকে পিছনে ফেলে, জোর কদমে আমরা এগিয়ে চলেছি। অবশেষে বহু্দূরে ছোট্ট মন্দির চোখে পড়লো। মনে হ'ল যেন ছাই-এর গাদার উপর একটা ছোট্ট মন্দির, নির্জন পরিত্যক্ত একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। পরে শুনলাম এই জায়গা থেকে মন্দিরটা প্রথম দেখা যায়, তাই এই জায়গাটাকে "দেওদেখনি" বলা হয়। একসময় আমরা উত্তর প্রদেশ সরকারের ট্রাভেলার্স লজের কাছে এসে পৌঁছলাম। পাশেই হোটেল "হিমলোক"। এখানে খাওয়ার ব্যবস্থাও বেশ ভাল। সম্ভবত এটাও উত্তর প্রদেশ সরকার দ্বারাই পরিচালিত। সামনে সামান্য দূরেই, কেদারনাথ মন্দির। দূর থেকে যেটাকে ছাইয়ের গাদা ভেবেছিলাম, সেটা আসলে হাল্কা কুয়াশা। মন্দিরের পেছনে কিন্তু কোন বরফ ঢাকা পাহাড় দেখলাম না। চারদিক মেঘ আর কুয়াশায় ঢেকে গেছে। এই মুহূর্তে বরফ দূরে থাক, মন্দিরের পেছনে যে পাহাড় আছে, তাও বুঝবার উপায় নেই। ট্রাভেলার্স লজে একটা ঘর, আঠের টাকা ভাড়ায় বুক করলাম। ভাল বিছানা, প্রত্যেকের জন্য তিনটে করে মোটা ভাল কম্বল। ঘরে ব্যাগ রেখে, দরজা বন্ধ করে, মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মন্দিরের একটু আগে একটা ব্রিজ পার হতে হয়। এখানে দুধগঙ্গা, মধুগঙ্গা, স্বর্গদুয়ারী, সরস্বতী, ও মন্দাকিনী, বোধহয় এই পাঁচটা নদী এসে মিশেছে। মন্দিরের সামনে রাস্তার দু'পাশে পরপর দোকান। মন্দির এখন বন্ধ, সন্ধ্যা নাগাদ খুলবে। কয়েকটা ছবি তুলে, কিছু খাওয়ার ধান্দায় একটা দোকানে গেলাম। রাস্তার দু'পাশে দু'টো মিষ্টির দোকান মতো আছে। একমাত্র এখানেই কিছু খাবার মিলতে পারে। একটা দোকানে একটা ছেলে বসে আছে। সে জানালো, লুচি, তরকারি ও মিষ্টি পাওয়া যাবে, তবে লালাজী না আসলে হবে না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও লালাজীর দর্শন পেলাম না। বাধ্য হয়ে অপর দিকের দোকানটায় গেলাম। এটা অপেক্ষাকৃত অপরিস্কার। এই দোকানের মালিকের বেশ গরম মেজাজ। সে জানাল, লুচি হবে না, পুরীও হবে না। আগের থেকে অর্ডার না দিলে পাওয়া যায় না। বললাম আমরা এইমাত্র এখানে এসে পৌঁছলাম, আগের থেকে অর্ডার দেব কী ভাবে? আমাদের কথায় তার মন গললো না। সে বলল, নিমকি আছে খেতে পারেন, লুচি এখন পাওয়া যাবে না। অপরদিকে তখনও লালাজীহীন দোকানে, তুলনামুলক ভাবে একটু ভাল মিষ্টি ও অন্যান্য খাবার শোভা পাচ্ছে। শেষে বাধ্য হয়ে কবেকার ভাজা কে জানে, ঠান্ডা নিমকি, গরম মেজাজের দোকানদারের থেকে পয়সা দিয়ে কিনে ধন্য হলাম। সঙ্গে লাড্ডু আর চা। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে ঘরে ফিরে এলাম।
ট্রাভেলার্স লজের সামনে অনেকটা ফাঁকা মাঠের মতো জায়গা, রেলিং দিয়ে ঘেরা। সামনের খোলা জায়গাটায়, কয়েকটা চেয়ার ও একটা বেতের টেবিল পাতা আছে। লজে আমাদের অপর দিকের ঘরে একটা মাদ্রাজী পরিবার আছে তারা সমস্ত চেয়ারগুলো দখল করে বসে, আরামে চা খাচ্ছে। বাইরে বেশ ঠান্ডা। আমরাও চায়ের অর্ডার দিলাম। রেলিং এর কাছে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে, গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিলাম। মনটা বেশ খুশি খুশি। হেমকুণ্ড, নন্দন কানন, বদ্রীনারায়ণ, ত্রিযুগীনারায়ণ দেখা হয়েছে। কেদারনাথও দেখা হ'ল। আগামীকাল বাসুকীতাল দেখতে যাবার ইচ্ছা আছে। হিমলোক হোটেলের ছেলেগুলো জানালো, বাসুকীতাল মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পথ। এই সামান্য রাস্তা হাঁটার ভয় এখন আর নেই। মনে শুধু একটাই চিন্তা, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, যমুনোত্রী যাওয়া হবে তো? আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে এল। ঘরে এসে দেখলাম, পাশের ঘরে মিটমিট করে ইলেকট্রিক লাইটগুলো জ্বলছে। আমাদের ঘরের বালবটা বোধহয় কেটে গেছে। কেয়ারটেকারকে বালবটা বদলে দেবার কথা বলে, আমরা মন্দিরে গেলাম। চা জলখাবার খেয়ে কিছুক্ষণ মন্দিরের চাতালে ঘুরে, ঘরে ফিরবার কথা বললাম। দিলীপের খুব ইচ্ছা সন্ধ্যা আরতি দেখে যাবার। আমার কিন্তু ঘরে ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল, কারণ আমরা হাওয়াই চটি পরে ঘর থেকে মন্দিরে এসেছি। অনেকটাই পথ, তার ওপর অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। আমার সঙ্গী দু'জনেরই আবার একটু ঠান্ডার বাতিক আছে। ফলে ওদের শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। কিন্তু মাধবও দিলীপের সাথে যোগ দিয়ে, আরতি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করল। এরপর আর আমার না বলার কোন জায়গা নেই। তাই তিনজনে একটা দোকানে আরতি আরম্ভ হবার অপেক্ষায় বসে থাকলাম।
এখানে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে বাসুকীতাল সম্বন্ধে খোঁজখবর নিলাম। বাসুকীতালের দূরত্ব সম্বন্ধে এক একজনের এক একরকম বক্তব্য। কেউ বলে বার মাইল, কেউ বলে ছয় মাইল, কেউবা আবার অনেক বেশি বলে জানাল। তবে সকলেই কিন্তু একটা কথা বলল, ওখানে পর্বতারোহণের অ্যাডভান্সড ট্রেনিং হয়। কাজেই যাওয়াটা সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজসাধ্য নয়। তার ওপর যাওয়ার কোন নির্দিষ্ট রাস্তাও নেই। একটু মেঘলা করে এলে, রাস্তা চিনে ফিরে আসা খুব সহজ কাজ নয়। ভাল গাইড সঙ্গে নিলে অবশ্য আলাদা কথা। শুনলাম ওখানকার লেকের আয়তন নাকি এখনও হিসাব করা যায় নি। বাসুকীতাল সম্বন্ধে বিশেষ জানাও ছিল না, আসার আগে খোঁজখবরও নিয়ে আসা হয় নি। ফলে একটা কথা বেশ বুঝতে পারছি যে, আগামীকাল শোনপ্রয়াগ ফিরতে হলে, এবার আর বাসুকীতাল দেখা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। সন্ধ্যা আরতি শুরু হল প্রায় রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ। ঠান্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এই ঠান্ডাতেও অনেক লোকই মন্দিরে এসে হাজির হয়েছে। লাইন দিয়ে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে, ডান পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়। আস্তে আস্তে হাঁটার ফলে যেটুকু দেখা যায়। দর্শনার্থীর সংখ্যা যত কম হবে, তত বেশি সময় নিয়ে ভালভাবে দেখা যাবে। অবশ্য পুজো দেওয়ার সময় মূর্তি স্পর্শ করতে দেওয়া হয়, যেটা বদ্রীনারায়ণে করা যায়না। তবে এখানে আবার বদ্রীনারায়ণের মতো ঘটা করে আরতি হয় না, অন্তত এখন তো হতে দেখলাম না। খালিপায়ে এইটুকু পথ হাঁটতে হয়। আমরা মন্দিরের বাইরে এসে চটি পরে ঘরের পথে পা বাড়ালাম। এখানকার স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী সম্বন্ধে কোন ধারণা পাওয়া গেল না, পাওয়া যাবে বলেও মনে হল না। ওদের হাবভাব দেখে বরং মনে হল, যেন এখানকার কেউ কোনদিন এদিক থেকে ওপথে যায়ও নি। একটা ধারণা পেলে যদিও সুবিধাই হত। যাহোক, ফিরে দেখলাম ঘরে নতুন বালব লাগায়নি। পাশের হিমলোক হোটেলে রাতের খাবার খেতে গেলাম। আধা ভাত, আধা রুটি, দু'রকম তরকারি, বেশ ভাল ডাল ও পাঁপড় ভাজা দিয়ে গেল। কায়দা কানুনও আধুনিক হোটেলের মতো। দাম লাগলো মাথাপিছু চার টাকা পঞ্চাশ পয়সা। বালবের কথা জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল বালব আনতে গেছে, আপাতত মোমবাতি দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস হল না। ঘরে ফিরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। বালব বা মোমবাতি কোন কিছুই দিয়ে না যাওয়ায়, বাইরে মেন সুইচের কাছ থেকে একটা বালব খুলে এনে নিজেদের ঘরে লাগিয়ে নিয়ে, দরজা বন্ধ করে, আলো জ্বেলেই শুয়ে পড়লাম। মনে হচ্ছিল বিছানা যেন ভিজে গেছে। তিনটে কম্বলও যথেষ্ট বলে মনে হ'ল না।
পঁচিশে আগষ্ট। বেশ ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাড়ির পিছন দিকে হাত, মুখ ধুতে গিয়ে প্রথম নজরে পড়ল একবারে হাতের কাছে সূর্যালোকে লাল-হলদে রঙের বরফের চুড়া। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে তৈরি হয়ে মন্দিরে গেলাম। ভোরের মন্দিরের রূপ একেবারে অন্যরকম। মন্দিরের ঠিক পিছন থেকে বরফের চাদর ঢাকা পাহাড় উঠেছে। প্রাণভরে ছবি তুললাম। মাধব ও দিলীপ পি. শুক্লা নামে এক পাণ্ডার খোঁজ করে পুজো দিতে গেল। আমি মন্দিরের পিছনে শঙ্করাচার্যের সমাধি দেখতে গেলাম। একপাশে শ্বেত পাথরের শঙ্করাচার্যের দণ্ড। একটা সাদা পাথরের হাত, দণ্ডটা ধরে আছে। সমাধিটা বাঁপাশে। একটা ছোট মন্দিরের মতো ঘরে, শঙ্করাচার্যের মূর্তিটা রাখা আছে। চারপাশের দেওয়ালে শ্বেত পাথরের ফলকে, সম্ভবত তাঁরই বাণী লেখা। ঘুরে ফিরে ছবি নিয়ে ফিরে এলাম। বন্ধুরাও তৈরি। এবার ফেরার পালা। হোটেলে এসে, বিল মিটিয়ে, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, ফেরার রাস্তা ধরলাম। আমাদের সাথে বদ্রীনারায়ণ থেকে এক বাসে আসা সেই সবজান্তা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধের দলের সাথে দেখা হল। তারাও আমাদের মতোই ফেরার পথে।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
আগের পর্ব – বদ্রীনারায়ণ থেকে মানা ও বসুধারা
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোনও পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো। 'আমাদের ছুটি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক, পাঠক, সমালোচক এখন নেমে পড়েছেন কীবোর্ডে-মাউসে সহযোগিতাতেও।