ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনি - হিমালয়ের ডায়েরি (পঞ্চম পর্ব)
আগের পর্ব – এবার কাহিনি কেদারনাথের
গঙ্গোত্রীর পথে
সুবীর কুমার রায়
পূর্বপ্রকাশিতের পর -
রাস্তায় একরকম ছোট ছোট ঝোপ হয়ে আছে। তাতে অজস্র ছোট ছোট, লাল লাল, করমচার মতো ফল ধরেছে। স্থানীয় লোকেরা দেখি টপাটপ ওই গাছ থেকে ফল ছিঁড়ে মুখে পুরছে। আমরাও কয়েকটা ফল তুলে খেলাম। বোধহয় পাহাড়ি করমচা। যত বাইপাস চোখে পড়ছে, ব্যবহার করে বেশ দ্রুত নেমে আসছি। গতকাল যাওয়ার সময় একটা গুহা মতো পাথরের খাঁজে, একটা উলঙ্গ সন্ন্যাসীকে বসে থাকতে দেখেছিলাম। সামনে কয়েকটা ঠাকুর-দেবতার ছবি টাঙিয়ে, গায়ে ছাই মেখে বসে ছিল। পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ পিটপিট করে দেখছিল। এখন ফেরার পথে তার কাছাকাছি আসতে, দিলীপ আর মাধবের কাছে পয়সা চাইল। ওরা কোন কথা না বলে এগিয়ে গেল। একটু পিছনেই আমি। আমার কাছেও পয়সা চাইল। আমিও কিছু না দেওয়াতে, বেশ কড়া সুরে অভিশাপ দেবার ভঙ্গিতে আমায় বলল —"তুই যেমন আছিস, তেমন থাকবি"।
ভীষণ রাগ হয়ে গেল। যাবার সময় কিছু বলে নি। ভেবেছিল এপথে ফিরতে তো হবেই, ট্যাক্সটা তখনই আদায় করা যাবে। দাঁড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম বেশ দু'ঘা দিয়ে ব্যাটাকে ওপর থেকে নীচে ফেলে দিই। মাধব এগিয়ে এসে কিছু বলতে বারণ করল। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। বাইপাস ব্যবহার করে বেশ দ্রুত ফিরছিলাম। কিন্তু আরও শর্টকাট করতে গিয়ে মহা বিপদে পড়লাম। বাইপাস নয়, এমন একটা পায়ে চলা রাস্তার মতো দাগকে বাইপাস ভেবে, হাত দিয়ে লতাপাতা সরিয়ে হাঁটতে গিয়ে, ডান হাতের কব্জির কাছ থেকে কনুই পর্যন্ত মোক্ষম বনবিছুটি লাগল। মনে হল ভীষণ জোরে ইলেকট্রিক শক্ খেলাম। অল্প সময়ের মধ্যে শক্ত হয়ে ফুলে উঠল। মনে হচ্ছে হাতের দু'দিক থেকে দু'জন যেন চামড়াটা দু'দিকে টানছে। গোটা জায়গাটা গরম হয়ে ভীষণ কষ্টকর যন্ত্রণা শুরু হল। একজন স্থানীয় বৃদ্ধ কাছেই একটা পাথরের ওপর বসেছিল। কী ভাবে জানিনা, সে কিন্তু বুঝে গেছে যে আমার বিচ্ছু লেগেছে। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম কী করব। সে বলল, হাতের ক্ষত জায়গায় পিসাব কর দেও। এখন এই মুহূর্তে সেটা করা সম্ভব নয়। তাই আস্তে আস্তে সাবধানে রাস্তায় ফিরে এসে, হাতে ভালভাবে বোরোলীন লাগালাম। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রামওয়াড়া চটিতে এসে উপস্থিত হলাম। স্থানীয় কী একটা উৎসবের জন্য, পুরুষ আর মহিলারা নেচে নেচে টাকা পয়সা, চাল, ডাল, আটা ইত্যাদি আদায় করছে। চা বিস্কুট খেয়ে, বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাতে বিছুটি লেগেছে কী করব? সে বললো কিছু হবে না। যা-ই লাগান না কেন, আজ যখন লেগেছে কাল সেই সময় কমে যাবে। অর্থাৎ পুরো একদিন যন্ত্রণা থাকবে। আঁতকে উঠে ভাবলাম পুরো চব্বিশ ঘন্টা এই যন্ত্রণা আমার সঙ্গী হলে হয়েছে আর কী। উঠে পড়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। দিলীপ অনেক এগিয়ে গেছে, মাধবের হাঁটুর ব্যথাটা বেশ বেড়েছে। ওর সঙ্গে তাল রেখে ধীরে ধীরে নামছি। ক্রমে ওর হাঁটার গতি এত কমে গেল যে, ইচ্ছা না থাকলেও এগিয়ে গেলাম। একটু এগিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করে, আবার ওর সঙ্গে একটু হাঁটলাম। আবার এগিয়ে গেলাম। এইভাবে একসময় গৌরীকুণ্ডে এসে, পরিচিত সেই দোকানে গিয়ে বসলাম। দিলীপ আগেই এসে গেছে। মাধব একটু পরেই এসে হাজির হল।
চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানদারকে বললাম, আমরা আজই উত্তরকাশী যাবার বাস ধরতে চাই, কখন পাব? দোকানদার জানালেন, বিকেল পাঁচটায় শেষ বাস পাওয়া যাবে। দাম মিটিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এলাম। আর কোনো প্যাসেঞ্জার না থাকায়, আমাদের তিনজনকে নিয়ে কোনো ট্যাক্সি যেতে রাজি হল না। আরও অন্তত দু'তিনজন প্যাসেঞ্জারের প্রয়োজন। কিন্তু কেউ আর আসে না। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে উত্তরকাশীর বাসের কথা জিজ্ঞাসা করতে সে জানাল, উত্তরকাশীগামী শেষ বাস শোনপ্রয়াগ থেকে বিকাল পাঁচটায় ছাড়ে। হাতে অনেক সময় আছে, তাই দু'তিনজন প্যাসেঞ্জারের আশায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে রইলাম। একজন টাকমাথা, বেঁটে, মোটা মতো মাঝবয়সী ভদ্রলোক শোনপ্রয়াগ যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে হাজির হলেন। কেদারনাথ থেকে আরও যদি কেউ আসে, সেই আশায় ট্যাক্সি ড্রাইভার তবু দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে নতুন কোন যাত্রী না পাওয়ায়, আমাদের চারজনকে নিয়েই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। মাধব আমার পাশে, তার পাশে ওই নতুন ভদ্রলোক। মাধব জানালো যে তার পায়ের ব্যথাটা বেশ বেড়েছে, সঙ্গে জ্বরও এসেছে বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম শোনপ্রয়াগ গিয়ে সঙ্গে আনা ওষুধ দেওয়া যাবে। ভদ্রলোক পাশ থেকে বললেন, আমায় বলুন না, ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। অনেকক্ষণ ব্যাগ হাতড়ে খুঁজেপেতে একটা ট্যাবলেট বার করে বললেন, চট করে গিলে ফেলুন। মাধব আমার দিকে আড়চোখে তাকাতে, চোখের ইশারায় ট্যাবলেটটা খেতে বারণ করলাম। ভদ্রলোকের আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত রকমের, তার ওপর ওষুধটার নামও আগে কখনও শুনিনি। মাধব তাঁকে বলল, খেয়ে নিয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, তিনি বদ্রীনারায়ণ যাবেন। আমরা তাঁকে কীভাবে বদ্রীনারায়ণ যেতে হবে, সেখানে কী কী দেখার আছে, সব জানালাম। ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, যদিও এই তাঁর প্রথম বাইরে বেড়াতে আসা, তবু তিনি কল্পনার চোখে সব দেখতে পাচ্ছেন, কারণ তিনি শিল্পী, ছবি আঁকেন। একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ তিনি প্রস্তাব দিলেন, শোনপ্রয়াগে আমাদের সঙ্গে তিনি একই জায়গায় থেকে যেতে চান। তাঁর সঙ্গে এক জায়গায় থাকার ইচ্ছা আমাদের মোটেই নেই। তার ওপর আজই আমরা উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে রওনা দেব। তাঁকে বললাম, আজই আমরা সন্ধ্যার বাসে চলে যাব, কাজেই একসঙ্গে থাকার কোন সুযোগ নেই। অবশেষে শোনপ্রয়াগে পূর্বপরিচিত জায়গায়, ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল।
বাসের টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। মাধব গেল মালপত্রগুলো পোষ্ট অফিস থেকে ছাড়াতে। হায়! কাউন্টারে এসে জানতে পারলাম, আজ কোনও বাস নেই। কাল সকাল পাঁচটায় প্রথম বাস ছাড়বে। সেই টেহেরি গাড়োয়ালের রাজধানী শ্রীনগর পর্যন্ত ওই বাসে গিয়ে, ওখান থেকে উত্তরকাশীর বাস পাওয়া যাবে। গত বছর বন্যার আগে এই সমস্ত রাস্তায় "যাত্রা বাস" বা ডিরেক্ট বাস সার্ভিস ছিল। এখন প্যাসেঞ্জারের অভাবে বাতিল হয়েছে। ফলে সময় ও খরচ দু'টোই অনেক বেড়ে গেছে। কষ্ট তো বেড়েইছে। কাউন্টারে জানালাম, গৌরীকুণ্ডে এবং ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে আমরা শুনেছি যে বিকাল পাঁচটায় লাষ্ট বাস পাওয়া যাবে। ভদ্রলোক বললেন, ওরা ভুল বলেছে, সকাল পাঁচটায় ফার্ষ্ট বাস পাওয়া যাবে। অহেতুক আজ শোনপ্রয়াগে এলাম। এখানে না পাওয়া যায় ভাল খাবার, না পাওয়া যায় ভাল থাকার জায়গা। গৌরীকুণ্ডে রাতে থাকলে, অনেক আরামে থাকা যেত।
টিকিট কাউন্টারের বাঁপাশে একটু ওপরে, একটা ভাল থাকার জায়গা পাওয়া গেল। কিন্তু এখানে আবার খাটিয়া পাওয়া গেলেও, আলাদা ঘর পাওয়া যাবে না। অগত্যা আবার সেই পোষ্ট অফিসের পুরাতন ঘরটায় রাতের আশ্রয় নিতে হল। আগেরবার যে ঘরটায় মোটা যুবক ও তার বৃদ্ধ সঙ্গীটি আশ্রয় নিয়েছিল, সেই ঘরটায় একটা দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার রয়েছে। এদের লোক সংখ্যা অনেক। সঙ্গে আবার একগাদা বাচ্চা। কান্নার আওয়াজ সব সময় লেগেই আছে। আমাদের পিছনে, মাঝখানে খানিকটা পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা যে ঘরটি আছে, সেখানে কয়েকজন যুবক এসে জায়গা নিয়েছে। এদের সঙ্গে ট্যাক্সির সেই আর্টিষ্ট ভদ্রলোক কিভাবে ম্যানেজ করে ঢুকে গেছেন। সবকটা যুবকই খুব আধুনিক ধরণের, এসেছে কলকাতা থেকে। আর্টিষ্ট ভদ্রলোক দেখলাম তাদের খুব বড় বড় কথা বলে চলেছেন। তারাও খুব চতুরতার সঙ্গে তাঁকে ব্যঙ্গ করছে, 'মুরগি' করছেও বলা যেতে পারে।
মাধবের গায়ে মোটামুটি ভালই জ্বর আছে। ওকে বেরোতে বারণ করে, আমি আর দিলীপ ঘরে মালপত্র ভালভাবে গুছিয়ে রেখে, বাইরে এলাম। এখানে ঠাণ্ডা খুব একটা বেশি নয়। আগের দোকানে রাতের সেই একই খাবার খেয়ে, অপর একটা দোকানে মগ নিয়ে গেলাম মাধবের জন্য দুধ কিনতে। দোকানদার জানালো দুধ নেই, পাওয়া যাবে না। বললাম, এক বন্ধুর বেশ জ্বর, একটু দুধ না পেলে সারারাত তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। সব শুনে দোকানদার কিন্তু এবারে অন্যরকম ব্যবহার করল। বলল, গায়ে জ্বর? তাহলে অসুবিধা হলেও একটু দুধ তো দিতেই হয়। দুধ গরম করতে করতে, কী কী ওষুধ খাওয়ানো প্রয়োজন, বা কী কী করা উচিত, নিজে থেকেই বলতে শুরু করে দিল। চায়ের জন্য রাখা সামান্য দুধ থেকেও, কিছুটা দুধ গরম করে আমাদের মগে ঢেলে দিল, শুধু একজন অসুস্থ লোক না খেয়ে থাকবে বলে। এদের সরলতা, আন্তরিকতা বা মনুষ্যত্ব দেখলে, নিজেদেরকে খুব ছোট মনে হয়। আমাদের এখানে শুধু লোক ঠকানো ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করা ছাড়া আর কিছুই শিখলাম না। যাহোক, ঘরে ফিরে এসে গরম দুধে কিছুটা বোর্নভিটা দিয়ে মাধবকে দিলাম। সঙ্গে নিয়ে আসা ওষুধ থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধও দিলাম। মাধব বলল, দুধটা খুব ভাল। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।
পাশের ঘরে তখনও আলো জ্বলছে। পার্টিশনের ফাঁক দিয়ে ঘরটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আমাদের ঘরটা অন্ধকার, তাই পাশের ঘর থেকে আমাদের দেখার কোন সুযোগ নেই। দেখলাম একটা মদের বোতল খুলে সবাই গোল হয়ে বসেছে। আর্টিষ্ট ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, তাঁর চলে কী না। আর্টিষ্ট বললেন, তাঁর অভ্যাস নেই। আরও বললেন যে, তাদেরও এত খাওয়া উচিত হচ্ছে না। কিন্তু বোতলটা নিয়ে কথা বলতে বলতে, বেশ কয়েকবার অনেকটা করে নিজের গ্লাসে ঢেলে, গ্লাস খালি করলেন। মাধব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘুম আসছে না। উপুড় হয়ে শুয়ে ওদের কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করতে লাগলাম। ভদ্রলোককে একজন জিজ্ঞাসা করল, এপথে তিনি আগে কখনও এসেছেন। উত্তরে আর্টিষ্ট বললেন, এপথে তিনি এই প্রথম, তবে কল্পনার চোখে তিনি এসব জায়গার ছবি অনেক স্কেচ করেছেন। এখন বাস্তবে দেখে বুঝছেন, যেরকম ছবি তিনি এঁকেছেন, জায়গাগুলো আসলে তত সুন্দর মোটেই নয়। তাঁর আঁকা কেদারের ছবি, যদিও কল্পনায় আঁকা, তবু হুবহু এক এবং অনেক প্রাণবন্ত। যুবকরা বলল, "আপনার মধ্যে এরকম প্রতিভা লুকিয়ে আছে, আর আপনি সেটা নষ্ট করছেন? আপনাকে দেখলে বোঝাই যায় না, আপনি এত গুণের অধিকারী"। তাদের ব্যঙ্গ গায়ে না মেখে, ভদ্রলোক আরেকবার কারণসুধা গলায় ঢেলে শুয়ে পড়লেন। যুবকরাও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। রাতের খাবার খেতে যাবার সময় কাল সকালে কোন বাস যাবে খোঁজ নিয়ে এসেছি। গাড়ির নম্বরও নোট করে এনেছি। ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপও হয়েছে। বলেছে, কাল সকালে বাসের সামনের দিকে তিনটে ভাল সিট আমাদের জন্য রেখে দেবে এবং ভোরে ঘুম থেকে ডেকে তুলেও দিয়ে যাবে। ফলে ঘুম না ভাঙার কোন চিন্তা আর নেই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হবে, ফলে ঘু্মোবার চেষ্টা করলাম।
ছাব্বিশে আগষ্ট। ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ, দিলীপের ডাকে ঘুম ভাঙল। আমাদের কথাবার্তায় পাশের ঘরের ওরাও উঠে পড়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার বোধহয় অনেক আগেই উঠেছে। বাইরে এলাম চায়ের খোঁজে। কোনো দোকান খোলেনি। বাসটাও দেখতে পেলাম না। ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা হল। বলল, "আপনারা উঠে পড়েছেন? আমি ঠিক ডেকে দিতাম। বাসে গিয়ে জায়গাটা বরং একটু রেখে আসুন।" খোঁজ নিয়ে বাসে গিয়ে দেখলাম বাস প্রায় ভর্তি। ব্যাটা ড্রাইভার জায়গা রাখেনি। পিছন দিকে তিনজন বসার সিটে জায়গা রেখে এসে দেখি, একটা চায়ের দোকান খুলেছে। অনেক লোকের ভিড়। তিনজনে চা খেয়ে, মুখ হাত ধুয়ে, বাথরুম সেরে, পোষ্টঅফিসের মালিককে ভাড়া মিটিয়ে, বাসে ফিরে এসে জায়গায় বসলাম। আমাদের ঠিক সামনের তিনজন বসার সিটে, একজন বৃদ্ধ ও একজন বৃদ্ধা পরম সুখে বসে আছেন। বাসে বেশ ভিড়, ফলে অনেকেই ওখানে বসতে চায়। কেউ ওখানে বসতে চাইলেই, বৃদ্ধ দম্পতি জানাচ্ছেন, এখানে একজনের জায়গা আছে। কার জায়গা আছে বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা গেল বাস ছাড়ার পরে, কন্ডাক্টর যখন একজনকে ওখানে বসাতে গেল। জানা গেল যে ওদের পায়ের কাছে, দুই সিটের মাঝে, একজন মহিলা শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙলে তাকে ওখানে বসানো হবে। বাসের সব লোক হেসে উঠতে, বৃদ্ধ বৃদ্ধা কিরকম বোকা বোকা মুখে বসে রইলেন। সত্যিই এরা অদ্ভুত মানুষ। আমরা একত্রিশ টাকা পঁচানব্বই পয়সা দিয়ে তিনটে শ্রীনগরের টিকিট কাটলাম। এসব জায়গায় যে কী হিসাবে ভাড়া নেওয়া হয়, স্বয়ং আইনস্টাইনও হিসাব করে বলতে পারবেন না। আজ আমরা কতদূর যেতে পারব জানিনা। বাস গুপ্তকাশী, অগস্ত্যমুনি হয়ে এক সময় আবার সেই রুদ্রপ্রয়াগ এসে পৌঁছাল। আজ যেন মনে হল, রুদ্রপ্রয়াগ নতুন রূপে সেজেছে। সত্যিই জায়গাটা কী অপূর্ব সুন্দর! বাসের ভিড় ক্রমশঃ বাড়ছে। তিনজনের বসার সিটে, চারজন করে বসছে। কোনরকমে কষ্ট করে শ্রীনগরে এসে পৌঁছলাম। বাস থেকে চটপট নেমে, ছাদে উঠে দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে মালপত্র রাস্তায় নামালাম। হৃষিকেশ থেকে যে জামাপ্যান্ট পরে বেরিয়েছি, সেই পোষাক পরেই আজও আছি। ওই পোষাক পরেই প্রয়োজনে রাস্তায় শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতেও হয়েছে। বাসের ধুলোয়, পথের ধুলোয়, তার আগের রঙ ঠিক কিরকম ছিল, মনে করতে পারছি না। গায়ের ধুলো ঝেড়ে দৌড়ে গেলাম টিকিট কাউন্টারে। মাধব একপাশে দাঁড়িয়ে মালপত্র পাহারা দিচ্ছে। ওর শরীর বেশ খারাপ, বিশ্রামের প্রয়োজন।
কাউন্টারে এসে গঙ্গোত্রী যাওয়ার বাসের খোঁজ করলাম। পথে শুনেছিলাম গঙ্গোত্রী যাওয়া যাচ্ছে না। এক বৃদ্ধা জানিয়েছিলেন, বন্ডে সই করে, তবে ওখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে। তাঁকে গঙ্গোত্রী যেতে দেওয়া হয়নি। মিলিটারিরা যেতে বারণ করেছিল। সব শুনে ঠিক করেছিলাম, সেরকম অসুবিধা বুঝলে, প্রথমে যমুণোত্রী চলে যাব। তারপর সম্ভব হলে, গঙ্গোত্রী, গোমুখ যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে। কাউন্টারের ভদ্রলোক জানালেন, গঙ্গোত্রী যাবার 'যাত্রা বাস' পাওয়া যাবে না। ভদ্রলোক একটা বাসের নম্বর দিয়ে বললেন, "এখনই এই বাসটা ছেড়ে দেবে। চটপট এই বাসে করে টেহেরি চলে যান। ওখান থেকে বাস পাবেন"। কোথা দিয়ে কিভাবে যেতে হবে, সত্যিই এভাবে যাওয়া যাবে কী না, আমাদের কোন ধারণাই নেই। খোঁজ নেওয়ার সময়ও নেই। একজনের মুখের কথার ওপর ভরসা করে, দৌড়ে গিয়ে, নির্দিষ্ট নাম্বারের বাসের ছাদে উঠে, মালপত্র গুছিয়ে রাখলাম। বাসে ড্রাইভার ইঞ্জিন চালু করে বসেই ছিল। ছাদ থেকে নেমে দেখলাম, মাধব একটা বসার জায়গা ম্যানেজ করে নিয়েছে। দিলীপও ওর পাশে একটা জায়গা পেয়ে গেল। বাসে খুব ভিড়, ফলে সবার পরে আমি বাসে ওঠায়, আমার বসার জায়গা মিলল না। বাসের অধিকাংশ যাত্রীই, স্থানীয় আদিবাসী বলে মনে হল। এদের দু'একজনকে অনুরোধ করলাম, একটু সরে বসে আমায় একটু বসার জায়গা করে দিতে। কিন্তু কেউ কোন আগ্রহ দেখালনা। সারাদিন খালিপেটে বাস জার্নির পর, দাঁড়িয়ে যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। খুব গরম লাগছে। বুক, পিঠ, মু্খ, ঘামে ভিজে গেছে। হাফহাতা সোয়েটারটা খুলে ফেললাম। গায়ের এক ইঞ্চি পুরু ময়লার ওপর ঘাম গড়িয়ে লেগে হাত, মুখ, গলা কালো হয়ে গেছে। নিজেকে এই মুহূর্তে নিজেরই ঘেন্না করছে। ভিড় ক্রমশঃ বাড়ছে। বাসের সামনের দিকে মাধব আর দিলীপের পাশেই আমি দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে কোনও সিট খালি হচ্ছে না। খালি হলেও সঙ্গে সঙ্গে জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে পিছনের দিকের সিটগুলোয়। কিন্তু ভিড় ঠেলে পেছনে যাওয়ারও কোনও উপায় নেই।
এইভাবে পঁচিশ কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর, পিছনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একেবারে পিছনের সিটে, একটা বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। এই ভিড়ে এখানে একসঙ্গে প্রায় সবাই বিড়ি খাচ্ছে। গরমে, ধোঁয়ায়, নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। তবু মনে একটাই আশা, গঙ্গোত্রীও তাহলে যাওয়া হচ্ছে। বন্ডে সই করে যেতে হবে শুনে রাস্তার বিপদ ও বন্ধুরতার কথা ভেবে, দিলীপ একটু মুষড়ে পড়েছিল, এখন ও কী চিন্তা করছে জানতে ইচ্ছা করছে। তিনটে টিকিট আঠারো টাকা পঁচাত্তর পয়সা দিয়ে কাটা হল। জলের মতো পয়সা খরচ হচ্ছে। তবু কপাল ভাল গোবিন্দঘাট, যোশীমঠ, ঘাংঘারিয়া, বা নন্দনকানন ও হেমকুণ্ডের পথে পাঞ্জাবীদের দয়ায়, থাকা-খাওয়ার কোন খরচ লাগে নি। অন্যান্য জায়গাতেও দু'তিন টাকার মধ্যে তিনজনের এক বেলার খাওয়া হয়ে গেছে। প্রচণ্ড খিদেয় পেট জ্বালা করছে। এর নামই বোধহয় তীর্থ। এই কষ্ট স্বীকার করলেই বোধহয়, ষোল আনা পুণ্য অর্জন করা যায়। সুন্দর রাস্তার ওপর দিয়ে এখন বাস ছুটছে। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম ধুলোয় ভরা মেঠো রাস্তা দেখছিলাম। এবার দেখছি প্রকৃতির সাজানো বাগানকে ভেদ করে, কী সুন্দর রাস্তাই না তৈরি করা হয়েছে। রাস্তা আরও চওড়া করার কাজও চলছে। বেশ দুপুর নাগাদ বাস টেহেরি পৌঁছাল।
আশ্চর্য, খিদেয় সেই পেট জ্বালা করা ভাবটা আর অনুভব করছি না। বাস থেকে মালপত্র নামিয়ে, দৌড়ে নতুন বাসের খোঁজে গেলাম। শুনলাম সন্ধ্যার আগে উত্তরকাশী যাওয়ার কোন বাস নেই। এদিকে মাধব যেন ক্রমশঃ কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। এত চিন্তার ওপর মাথার ওপর আর এক চিন্তা, বাড়িতে ওর বাবাকে অসুস্থ দেখে এসেছি, এখন আবার ওকে নিয়ে না এখানে কোনো বিপদে পড়তে হয়। একটা জায়গায় মালপত্র জড়ো করে রেখে, কোথায় খাওয়া যায় ভাবছি, এমন সময় খোঁজ পাওয়া গেল, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাস যাবে। একেবারে খালি একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে বাসের ছাদে গিয়ে চড়লাম। মালপত্র সাজিয়ে রেখে, একটা হোটেলে গেলাম। জায়গাটা বেশ বড়। একসময় এটা একটা স্বাধীন এস্টেট ছিল। বড় বড় অনেক হোটেল, দোকানপাট আছে। অনেক দিন পরে মনপ্রাণ ভরে মাংস রুটি খেলাম। জানিনা আবার কবে এ সুযোগ আসবে। দাম মিটিয়ে বাসে এসে বসলাম। একবারে সামনের সিটে আমি ও মাধব। ঠিক তার পেছনের সিটটাতে দিলীপ। নির্দিষ্ট সময়েই বাস ছাড়লো। মাধবের গা বেশ গরম, চোখও বেশ লাল। কথা বলার শক্তিও যেন অনেক কমে গেছে। এখনো পর্যন্ত নিজেরাই ডাক্তারি করেছি। জানালার কাচ টেনে দিয়ে, ওয়াটার বটল্ থেকে একটু জল দিলাম, সঙ্গে সেই নিজেদের বুদ্ধিমতো ওষুধ। তিনজনের বাস ভাড়া চব্বিশ টাকা পঁয়তাল্লিশ পয়সা মিটিয়ে দিলাম। রাস্তাও অনেকটাই। বাস বেশ জোরে ছুটছে। টেহেরি আসার পথে দেখলাম, একটা বাস গভীর খাদে পড়ে আছে। একটা মোটা শক্ত দড়ি দিয়ে বাসটাকে ওপরে একটা মোটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, যাতে বাসটা আর নীচে গড়িয়ে পড়তে না পারে। শুনলাম কেউ মারা যায় নি। ড্রাইভারও লাফিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। আমরাও আমাদের বাসের ড্রাইভারের হাতে নিজেদের প্রাণ সঁপে দিয়ে বসে থাকলাম। একসময় বাস ধরাসু পৌঁছাল। এখান থেকে যমুনোত্রী যাওয়ার রাস্তা বেঁকে গেছে। বাস থেকে নেমে, তিনজনে চা খেয়ে বাসে ফিরে এলাম। একটু পরেই বাস আবার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল। মনে মনে ভাবছি কখন উত্তরকাশী পৌঁছবে। ওখানে পৌঁছে প্রথম কাজ, মাধবকে ডাক্তার দেখানো। আরও বেশ কিছু পথ পার হয়ে, সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে নিরাপদে উত্তরকাশী পৌঁছালাম।
বাসের ছাদ থেকে মাল নামিয়ে, একটা বাচ্চা ছেলের হাতে মালপত্র দিয়ে, সামনের ট্রাভেলার্স লজে এসে হাজির হলাম। এখানেই একটা ঘর নেওয়া হল। আশ্চর্য, এতবড় বাড়িটাতে আমরাই একমাত্র বোর্ডার। এখানেও সেই আঠারো টাকা ভাড়া। যে ভদ্রলোক ভাড়া নিয়ে রসিদ দিলেন, তাঁকে গঙ্গোত্রী, গোমুখ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, গত বছরের বন্যায় গঙ্গোত্রীর রাস্তা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাঝখানে তের কিলোমিটার রাস্তা, একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। আগে বাস "লঙ্কা" পর্যন্ত সরাসরি যেত। এখন এখান থেকে বাসে "ভুখি" নামে একটা জায়গা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। ভুখি থেকে তের কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হবে "ডাবরানী" নামে একটা স্থানে। ডাবরানী থেকে আবার লঙ্কা পর্যন্ত বাস পাওয়া যাবে। তবে প্যাসেঞ্জার যথেষ্ট হলে তবেই বাস যাবে। অবশ্য জীপ পাওয়া যায়। এ খবর অনেক আগেই কলকাতায় আমাদের বাড়ির কাছে এক ভদ্রলোকের কাছে শুনে এসেছিলাম। উনি শুধু এই কারণেই গঙ্গোত্রী যেতে পারেন নি। কলকাতার ইউ.পি.ট্যুরিজম কিন্তু এ খবর জানেই না। আসবার আগে তাদের কাছে এই খবরের সত্যতা জিজ্ঞাসা করলে, তারা একটু ব্যঙ্গ করেই বলেছিল, "কী জানি মশাই, এত বড় একটা খবর আপনারা জানেন, আর আমরাই জানিনা!" যাহোক, মালপত্র রেখে, একটু মুখ হাত ধুয়ে পরিস্কার হয়ে, ট্রাভেলার্স লজের ভদ্রলোকের কাছে ভাল ডাক্তারের খোঁজ করলাম। ভদ্রলোক জানালেন, একটু এগিয়ে স্টেট ব্যাঙ্কের একতলায়, একজন ভাল ডাক্তার বসেন। মাধবকে সঙ্গে করে গেলাম সেই ডাক্তারের খোঁজে। আজ রবিবার, ওই ডাক্তার বসেন না। স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ট্রাভেলার্স লজের পিছন দিকে একটু এগিয়ে ডান দিকের রাস্তায়, ডাঃ শিব কুমার বসেন। তিনি খুব ভাল ডাক্তার। আমরা তাঁর কাছেই গেলাম। বাড়ির বাইরে নেমপ্লেটে দেখলাম, অনেক ফরেন ডিগ্রি আছে। তাছাড়া উনি কনসালট্যান্ট। অপর কোন ডাক্তারের মাধ্যমে ওঁকে দেখাতে হয়। দরজায় নক্ করলাম, কেউ সাড়া দিল না। দরজায় আবার নক্ করে, একটা বাচ্চা ছেলের কাছে জানা গেল, এখন উনি বাড়িতে নেই। শেষে ওঁর স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কখন এলে পাওয়া যাবে। স্ত্রীর কথামত রাত্রে আবার গেলাম। ডাক্তার সাহেব তখন রাতের খাবার খেতে বসেছেন। আমাদের একটু বসতে বললেন।
বিকেলবেলা মাধবকে ঘরে রেখে, আমি আর দিলীপ শহরটা একটু ঘুরে দেখে এসেছিলাম। খুব সুন্দর শহর। পাহাড়ের কোলে সবরকম সুযোগ সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে। স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল। ভদ্রলোক শিবপুর বি.গার্ডেনের কাছে দু'এক বছর ছিলেন। অদ্ভুত বাংলা বলেন। এখনও পর্যন্ত সব জায়গায় দেখলাম, এখানকার মানুষ মোটামুটি বাংলা বোঝে, অল্পবিস্তর বাংলা বলতেও অনেকেই পারে। শুধু তাই নয়, বাঙালিদের এরা বেশ খাতির ও সম্মান করে। যাহোক ডাক্তার সাহেব খাওয়া সেরে এসে, ডিসপেন্সারির দরজা খুলে, আমাদের ঘরের ভিতর নিয়ে গেলেন। সাজানো-গোছানো খুব সুন্দর দু'টো ঘর। সামনের ঘরে সোফাসেট আছে, ওখানে রোগী বা সঙ্গে আসা বাড়ির লোকেরা বসে। ভিতরের ঘরে রোগী দেখা হয়। মাধবকে একটা বেডে শুতে বলে, উনি অনেক রকম ভাবে পরীক্ষা করলেন, প্রেসারও মাপলেন। মাঝবয়সী এই ডাক্তারটিকে রাজপুত্রের মতো দেখতে। কথা বলার কায়দাও খুব। মাধবকে পরীক্ষা করে তিনি বললেন, প্যারাটাইফয়েড। দিলীপ অনেকক্ষণ থেকেই বলছে রিস্ক না নিয়ে ফিরে যেতে। আমি ভাবছিলাম ওকে একটু সুস্থ করে যদি গঙ্গোত্রীটা অন্তত ঘুরে আসা যায়। এত কাছে এসে ফিরে যাব? আমরা পাশেই বসে আছি। প্যারাটাইফয়েড শুনে আমি ও দিলীপ নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচায়ি করলাম। আমি খুব আস্তে আস্তে দিলীপকে বললাম, আমাদের ওখানকার ডাক্তারদেরও চট করে প্যারাটাইফয়েড বলার একটা স্বভাব আছে। ঘাবড়াবার কিছু নেই। ডাক্তার সাহেব এবার অনেকক্ষণ ধরে মাধবের চোখ ও জিভ পরীক্ষা করে বললেন, যদিও ন্যাচারাল আলো, অর্থাৎ সূর্যালোক ছাড়া সঠিক বলা সম্ভব নয়, তবু মনে হচ্ছে এর জন্ডিস হয়েছে। মরেছে, একেই বোধহয় জন্ডিস কেস বলে। ভয় হল এরপর ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া, কলেরা, ইত্যাদি আর পাঁচটা রোগের নাম না একে একে বলে বসেন। শেষে তিনি বললেন, "কাল সকাল পর্যন্ত ওষুধ আমি আমার কাছ থেকেই দিয়ে দিচ্ছি। এখন আর কোথায় ওষুধ কিনতে যাবেন? এগুলো খেলে খিদে হবে, জ্বরও কমে যাবে। কাল সকালে আবার একবার এসে দেখিয়ে নিয়ে যাবেন"। কাল সকালেই আমাদের ভুখি যাবার কথা। সকাল সাতটায় বাস। ওঁকে সব খুলে বললাম। সব শুনে উনি বললেন, আগামী কাল না যাওয়াই ভাল। কাল সকালে উনি যদি দেখে বোঝেন, তবে পরশু যাওয়া যেতে পারে। কত ফীজ দেব জিজ্ঞাসা করায়, উনি বললেন, আমি এইভাবে ডিরেক্টলি রোগী দেখি না। আপনারা ট্যুরিষ্ট, যাতে কোন অসুবিধায় না পড়েন, তাই দেখে দিলাম। যদিও রাতে আমার ফীজ কিছু বেশি, তবু আপনারা ওই সকালের চার্জ, অর্থাৎ পনের টাকাই দিন। আমরা তাঁকে কুড়ি টাকা দিতে, উনি দশ টাকা রেখে বললেন, খুচরো নেই, কাল সকালে দিয়ে দেবেন।
বাইরে এসে একটা হোটেলে খেয়ে নিয়ে, মাধবকে একটা দোকানে দুধ, পাঁউরুটি খাইয়ে, লজে ফিরে এলাম। মাধব শুয়ে পড়লো, আমি ও দিলীপ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে, চিঠি লিখলাম। আগামীকাল সকাল সকাল ওঠার কোন তাড়া নেই। মনে শুধু একটাই চিন্তা, তাহলে কী শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়েও হল না? আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। মাধবের গায়ে হাত দিয়ে মনে হল জ্বর নেই। মনে মনে ঠিক করলাম, ওকে উৎসাহ দিয়ে, সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েও, গঙ্গোত্রী-গোমুখ যাবই। দরকার হলে ওকে কান্ডি বা ডান্ডিতে নিয়ে যাওয়া যাবে। ভুখি থেকে ডাবরানী, এই তের কিলোমিটার পথ খচ্চরে করে নিয়ে যাব। রাতে ট্রাভেলার্স লজের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে মালপত্র রেখে যাওয়ার খরচ কী রকম? ভদ্রলোক বলেছিলেন, পার লাগেজ পার ডে, এক টাকা ভাড়া। কত টাকা লাগেজের জন্য খরচ হতে পারে, হিসেব করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
সাতাশে আগষ্ট। ঘুম ভাঙল যথারীতি বেশ সকালেই। মাধবের গায়ে জ্বর নেই, শরীরও অনেক সুস্থ। বাইরের ঘেরা জায়গায় এসে চা খেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সকাল ন'টায় একটা বাস আছে বটে, তবে সেটা "ভাটোয়ারী" নামে একটা জায়গা পর্যন্ত যাবে। ওখান থেকে ভুখি অল্প কয়েক কিলোমিটার পথ। এখান থেকে সকাল সাতটার বাসটাই একমাত্র সোজা ভুখি পর্যন্ত যায়। সাতটার বাস ধরার কোনও সুযোগ নেই। ন'টার বাসটা ধরতে গেলেও, তৈরি হওয়া দরকার। দিলীপকে পাঠালাম মাধবকে সঙ্গে করে ডাক্তারের কাছে। ওকে বললাম আজ সকাল ন'টার বাসটায় আমরা যেতে চাই জানিয়ে, প্রয়োজন মতো ওষুধপত্র নিয়ে আসতে। আমি একটা হোল্ডঅল-এ সব জিনিসপত্র সমেত অন্য হোল্ড-অল দু'টো ঢুকিয়ে বাঁধতে বসলাম। তাহলে তিনটের জায়গায় একটা লাগেজ হয়ে যাবে। সুটকেস তিনটেকে তো আর কিছু করার উপায় নেই। সব খুলে আস্তে আস্তে ভাঁজ করে একটা হোল্ডঅল-এ মালপত্র গুছিয়ে দেখলাম, তিনটে হোল্ড-অলকে দু'টো করা যেতে পারে। একটার মধ্যে সব কিছু ঢোকানো সম্ভব নয়। সেইভাবেই বেঁধে নিয়ে, কাঁধের ঝোলা ব্যাগগুলো গোছালাম। মাধবের ব্যাগটা যতটা সম্ভব হাল্কা করলাম। সঙ্গে নেওয়ার মধ্যে, তিনটে ওয়াটার প্রুফ, কিলোখানেক চিঁড়ে, এক প্যাকেট আমসত্ত্ব, এক প্যাকেট খেজুর, কিছু লজেন্স ও চিকলেটস, তিনটে গামছা আর সেই রামের বোতলটা। আসবার সময় তিনটে প্যাকেটে এক কিলোগ্রাম করে, তিন কিলোগ্রাম শুকনো চিঁড়ে নিয়ে এসেছিলাম। এখনও একটুও খরচ হয় নি। সুটকেসে বাকী দু'টো প্যাকেট রেখে দিলাম। সব কাজ শেষ হলে, ভালভাবে সাবান মেখে স্নান সারলাম। এই লজটায় অনেকগুলো বাথরুম পায়খানা থাকলেও, জলের বেশ অভাব। বিকেলবেলা বড় বড় ড্রামে জল ধরে রাখা হয়। দু'টো ড্রাম আছে, বোর্ডারের সংখ্যা বেশি হলে অসুবিধা হবেই। সকালে অবশ্য জল যথেষ্টই পাওয়া যায়। স্নান সেরে সেই পুরনো জামা প্যান্ট পরেই ট্রাভেলার্স লজের অফিস ঘরে গেলাম। এখানে ভালভাবে যাত্রাপথের খোঁজ খবর নিলাম। জানা গেল, গত বছরের ভয়াবহ বন্যার পর, এদিকের যাত্রাবাস ব্যবস্থা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। আরও জানা গেল যে, ডাবরানীতে বুদ্ধি সিং নামক এক ব্যক্তির কাছে ভাল থাকবার জায়গা পাওয়া যাবে।
দিলীপ আর মাধব ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে এল। ডাক্তার শিব কুমার ওদের জানিয়েছেন, অন্য কেউ হলে আজ এই বিপজ্জনক, ভাঙা, অনিশ্চিত রাস্তায় যেতে তিনি বারণ করতেন। কিন্তু যেহেতু আমরা ট্যুরিষ্ট, এবং ঝুঁকি নিয়েও গঙ্গোত্রী ও গোমুখ দেখবার জন্য এতটা পথ এসেছি, তাই তিনি ওখানে যাবার অনুমতি দিচ্ছেন। তবে সময়মত ওষুধগুলো যেন অবশ্যই খাওয়ানো হয়। বেশ কিছু ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ইত্যাদি তাঁর প্রেসক্রিপশন মতো ওরা কিনেও এনেছে। তবে সুখের কথা, ডাক্তার জানিয়েছেন যে, মাধবের জন্ডিস হয় নি। দিলীপ জানালো আজ তিনি কোন ফীজ নেন নি। গতকালের বাকী পাঁচ টাকা কেবল তাঁকে দেওয়া হয়েছে। দিলীপ স্নান সেরে নিল। মাধবকে খুব বেশি স্নান করতে বারণ করলাম। সাবধান থাকা ভাল।
ক্লোকরুমে তিনটে সুটকেস ও দু'টো হোল্ড-অল রেখে, তিনজনে তিনটে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ও তিনটে ওয়াটার বটল নিয়ে, লাঠি হাতে রাস্তায় এলাম। হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে, কাউন্টারে গেলাম টিকিট কাটতে। ভাটোয়ারী পর্যন্ত তিনটে টিকিটের দাম নিল ন'টাকা ত্রিশ পয়সা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার মতো রাস্তা। একটু পরে বাস ছেড়ে দিল। আমাদের পাশে এক বাঙালি ভদ্রলোক বসেছিলেন। তাঁর কাছে শুনলাম, একটু এগিয়ে এক বিরাট বাঁধের কাজ চলছে। গত বছর বাঁধের কাজ চলাকালীন বন্যায় গঙ্গার জল ঢুকে, সমস্ত নষ্ট হয়ে যায়। তিনি ওখানে কনট্র্যাকটারি করেন। যাহোক, এক সময় বাস এসে ভাটোয়ারী পৌঁছলো। বাসের দু'একজন মাত্র যাত্রী ভুখি যেতে চায়। আমরা তিনজন নিজেদের গরজে বাস থেকে নেমে, বাসের অফিসে গিয়ে, ভুখি পর্যন্ত বাস নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করলাম। প্রথমে ওরা এই প্রস্তাবে কানই দিল না। পরে আরও কিছু প্যাসেঞ্জারের অনুরোধে, ওরা জানালো কুড়ি-পঁচিশজন যাত্রী হলে, বাস ভুখি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ব্যস, আর সময় নষ্ট না করে, লেগে পড়লাম প্যাসেঞ্জারের সন্ধানে। ভুখিগামী যে কোনও লোককে দেখলেই আমরা তাকে ডেকে এনে, বাস এক্ষুণি ছাড়বে জানিয়ে বাসে বসতে বলছি। এইভাবে অনেক কষ্টে গোটা পনের লোক যোগাড় করা গেল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, ভুখি যাবার জনা কুড়ি-পঁচিশজন যাত্রী যোগাড় হল। কিন্তু বাস ছাড়ার কোন লক্ষণ কিন্তু দেখা গেল না। ফলে দু'চারজন আগ্রহী যাত্রী আবার বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। যাহোক, কর্তৃপক্ষের অশেষ কৃপা, শেষ পর্যন্ত এই রাস্তাটার জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে এক টাকা করে ভাড়া নিয়ে, বাস ছাড়ল। অল্পই রাস্তা, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস এসে ভুখি পৌঁছল।
আকাশটা আজ আবার বেশ মেঘে ঢেকে আছে, তবে এক্ষুণি বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এক যুবক আমাদের সাথে এই বাসেই এসেছে। সে নিজেই এসে আলাপ করলো। লখনৌতে বাড়ি, যাবে গরমকুণ্ডে। জিজ্ঞাসা করলাম, গরমকুণ্ডটা কোথায়? বলল, "গাংগানী" নামক জায়গাটার গঙ্গার অপর পারটার নাম গরমকুণ্ড। যুবকটি খুব সুন্দর কথাবার্তা বলে, দেখতেও বেশ সুন্দর। হাতে একটা ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে, কথা বলতে বলতে, একসঙ্গে হেঁটে চলেছে। আমরা কিছু কলা ও আপেল নিয়ে এসেছিলাম রাস্তায় প্রয়োজন হতে পারে ভেবে। খিদেও বেশ ভালই পেয়েছে। ভাবলাম কোথাও বসে সেগুলো খাওয়া যাবে। যুবকটি জানাল, সে গরমকুণ্ডে ওয়্যারলেসে কাজ করে। হাওড়া শিবপুরে রেমিংটন ব্যান্ডে তার বাবা কাজ করত। ফলে সে নিজেও হাওড়া কলকাতা ঘুরে এসেছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, মিলিটারিতে কাজ করে কী না। বলল, ওটা মিলিটারির আন্ডারে পড়ে না। ওদের কাজ গঙ্গার জল হ্রাসবৃদ্ধির খবর, ওয়্যারলেসে উত্তরকাশীকে জানানো, এবং ওই এলাকার ওপর লক্ষ্য রাখা। তাছাড়া রাস্তা মেরামতির জন্য পাহাড় ব্লাষ্টিং করলেও উত্তরকাশীকে খবর পাঠানো, যাতে সেই সময়ে কোন যাত্রীকে আসতে দেওয়া না হয়। আরও হয়তো কিছু কাজকর্ম আছে, বিশদভাবে জানতে চাইলাম না। যুবকটি সামনে একটা দোকানে আমাদের নিয়ে চা খেতে ঢুকলো। খুব হাল্কা এক পশলা বৃষ্টি শুরু হল, সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়া। চা খাওয়া হলে দাম দিতে গেলে, যুবকটি বাধা দিয়ে বলল, "তাই কখনও হয়? আমাদের জায়গায় এসে আপনারা দাম দেবেন কী? আপনাদের ওখানে গেলে, তখন আপনারা দাম দেবেন"। বললাম, এটাও তো আপনার এলাকা নয়, লখনৌ গেলে আপনি দাম দেবেন। যুবকটি বলল, ওখানে গেলে আমার খরচায় সমস্ত লখনৌ শহর ঘুরে দেখাবো। বললাম, আপনাদের লখনৌ শহর আমার দেখা, খুব ভাল জায়গা। বৃষ্টি আর পড়ছে না, আমরা উঠে পড়ে দোকান থেকে রাস্তায় নামলাম।
বাস থেকে নেমে যুবকটির সঙ্গে এতক্ষণ আমরা কিন্তু বাস রাস্তা ধরেই হেঁটে আসছি। এদিকে বাস কেন আসেনা, বুঝলাম না। আরও কিছুটা পথ হাঁটার পর অবশ্য কারণটা বোঝা গেল। শুধু বোঝা গেল তাই নয়, সঙ্গে গঙ্গোত্রী যাত্রার ভবিষ্যৎ নিয়েও আমাদের মনে সংশয় দেখা দিল। রাস্তা একেবারেই নেই। কোনওকালে ছিল বলেও বোঝার উপায় নেই। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। বড় বড় শাবলের মতো লোহার রড দিয়ে ড্রিল করে পাহাড়ের গায়ে গর্ত করা হচ্ছে। পরে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ভেঙে, রাস্তা তৈরি হবে। তখন লোক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে। এবড়ো-খেবড়ো ভাঙা পাথরের ওপর দিয়ে অনেকটা পথ পার হয়ে যেতে হল। পাশেই গভীর খাদ। অনেক নীচ দিয়ে গঙ্গা আপন মনে বয়ে চলেছ। সেই গঙ্গা, যার উৎস দেখতেই আমাদের এত কষ্ট করে যাওয়া। খুব সাবধানে এই পথটুকু পার হয়ে এলাম। একটু পা হড়কালেই গঙ্গা মাইকী জয় হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এ জায়গাটায় রাস্তা বলে কিছু নেই। কখনো নীচুতে নেমে, কখনোবা বড় পাথর টপকে একটু ওপরে উঠে, এগিয়ে যেতে হয়। বেশ কিছুটা পথ এইভাবে পার হয়ে, আবার বাস রাস্তায় পড়লাম। গল্প করতে করতে জোর কদমে এগিয়ে চলেছি। বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে ওয়াটার প্রুফ আছে বটে, কিন্তু যুবকটি ভিজে ভিজে আমাদের যাবে, আর আমরা বর্ষাতি গায়ে দিয়ে তার সঙ্গে যাব? তাই আমরাও ভিজে ভিজেই পথ চলেছি। কোথাও যে একটু দাঁড়াব, তারও উপায় নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজার থেকে, ভিজে ভিজে হাঁটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেদের জন্য যতটা না চিন্তা, তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা মাধবকে নিয়ে। যুবকটি জানাল, আমরা প্রায় গাংগানী এসে গেছি, আর সামান্যই পথ। একটু এগিয়েই একটা ঝোলা পোর্টেবল ব্রিজ পার হয়ে, গঙ্গার অপর পারে এলাম। পরপর দু'টো চায়ের দোকানের একটার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যুবকটি আমাদের একটা পাকা বড় ঘরে ছেড়ে দিয়ে বলল, এখানে রাতটা কাটাতে পারেন। আজ আর এগোবেন না, কারণ এখান থেকে আগেকার পাকা বাস রাস্তা আর নেই। বাস রাস্তা ছিল গঙ্গার অপর পার দিয়ে, যেদিক দিয়ে আমরা এতক্ষণ হেঁটে এলাম। এই ব্রিজের ঠিক পরেই আগেকার বাস রাস্তাটা গঙ্গার সঙ্গে মিশে গেছে। সে আরো বলল, গত বছর বন্যার পর পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে, এই ব্রিজটা তৈরি করা হয়েছে। গঙ্গার এপার থেকে ডাবরানী পর্যন্ত নতুন পায়ে হাঁটার পথ বানানো হয়েছে। আর এটা একেবারেই স্থানীয় লোকেদের প্রয়োজন মেটাতে, তাদের ঊপযুক্ত হাঁটাপথ তৈরি করা হয়েছে। এখন গঙ্গোত্রী যাবার যাত্রী নেই। তাছাড়া রাতে ওই রাস্তায় ভাল্লুকের উৎপাত হয়। সামনেই একটা পাকা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ওটাই তাদের অফিস, ওই বাড়িতেই মেস করে কয়েকজনে মিলে থাকে। সে তার নিজের আস্তানার দিকে এগিয়ে গেল।
আমাদের সর্বাঙ্গ বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। যুবকটির দেখানো বড় ঘরটায় রাত্রিবাস করার সিদ্ধান্ত পাকা করে, ঘরে ঢুকে নিজেদের জামাপ্যান্ট খুলে, দরজা, জানালা ও মাটিতে মেলে শুকোতে দিলাম, যদিও বুঝতে পারছি শুকানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই, তবু যদি কিছুটা শুকনো হয় এই আশায়। এতক্ষণে কলা, আপেলগুলো যথাস্থানে ঠাঁই পেল। খিদেটাও অনেকটাই কমল। ঘরটার সামনেই একটা বড় চৌবাচ্চা মতো। তার জল বেশ গরম। চারপাশ দিয়ে অল্প অল্প ধোঁয়াও উঠছে। ডানপাশে, ওপর থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝরনার ধারা নেমে এসেছে। শুনলাম ঝরনাটার জল গরম আর ওই জলই এ অঞ্চলে সর্বত্র ব্যবহার করা হয়। আমাদের ঘরটার ভিতরে একপাশে মুখোমুখি দু'টো করে, মোট চারটে বাথরুম বা পায়খানা কিছু একটা হবে। চারটের দরজাই তালা দেওয়া। কার কাছে চাবি থাকে জানিনা, তবে ওগুলোর দেওয়াল ছাদ থেকে বেশ খানিকটা নীচে শেষ হয়েছে। বন্ধুদের বললাম, প্রয়োজনে দেওয়াল টপকে ভিতরে নেমে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু সবার আগে রাতের খাবারের একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
নীচের দোকানী জানালো, চা ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না। ওপরের দোকানটায় দেখলাম কয়েকজন বসে চা খাচ্ছে। একপাশে পাঁচটা খাটিয়া পাতা। কিছু পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করায়, দোকানদার বললেন চা পাওয়া যাবে। এই দোকানের একমাত্র খাদ্যবস্তু চা আর বিড়ি। দেশলাই পর্যন্ত নেই। বললাম, রাতে এখানে থাকব, আমাদের খাওয়ার কিছু ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বৃদ্ধ দোকানদারকে লালাজী বলে সম্বোধন করায়, তিনি খুব খুশি হলেন। দোকানের বাইরে ডানপাশে, একটা নল থেকে ঝরনার গরম জল একভাবে পড়ে যাচ্ছে। তার পাশে কিছু ছোট ছোট শুকনো আলু পড়ে আছে, হয়তো বা রাখা হয়েছে। দেখে মনে হল পচে গেছে, তাই দোকানের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেল প্রত্যেকটা আলুর গা থেকে শিকড়ের মতো কল্ বার হয়েছে। এতক্ষণে লালাজী জানালেন যে, আমরা যেখানে উঠেছি, সেটা আসলে মহিলাদের গরমকুণ্ডে স্নান সেরে কাপড় ছাড়ার জায়গা। ওখানে রাত্রে থাকতে দেওয়া হয় না। বিশেষ করে পুরুষদের তো নয়ই। দিলীপ আর আমি পাশাপাশি বসে। হাতে এই দোকানের একমাত্র খাদ্য - চায়ের কাপ। শোচনীয় অবস্থা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বৃষ্টি পড়ছে, দারুণ শীত, চারপাশে কালো হিমালয় ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না, অনেক নীচু থেকে গঙ্গার বীভৎস আওয়াজ এক নাগাড়ে কানে বাজছে, এই অবস্থায় এখনও আমরা জানি না, রাত্রে কোথায় থাকব, কী খাব। এখানে কাছেপিঠে কোন মানুষ বাস করেনা, থাকা বা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই, এখানে কোন্ মহিলা পাহাড় ভেঙে রাতে কুণ্ডে স্নান সেরে কাপড় ছাড়তে আসবে ভগবান জানেন! অপরদিকে একটা খাটিয়ায়, একজন পায়জামা-সার্ট পরা লোক বসে আছে। তার দৃষ্টিটা কীরকম যেন সন্দেহজনক। দিলীপকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য বললাম, লোকটার চাউনি মোটেই সুবিধার নয়, রাতে সতর্ক থাকতে হবে। দিলীপও আমার কথায় সায় দিল। সঙ্গে এত টাকা - মাধবের ও আমার মানি ব্যাগে বেশ কিছু টাকা আছে। তবে বেশিরভাগ টাকাই অবশ্য রাখা আছে খালি একটা বিস্কুটের প্যাকেটে। এমন জায়গায় এসে হাজির হয়েছি যে, চিৎকার করে আমাদের সতর্ক করে তারপর ঢাক ঢোল পিটিয়ে খুন করে ফেললেও, কারো জানার উপায় নেই। মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি লোকটা একভাবে আমাদের লক্ষ্য করছে। আমরা যে ফাঁদে পড়েছি, বেশ বুঝে গেছে। লালাজী বললেন, ভাত, ডাল ও সবজি পাওয়া যাবে। আমরা বললাম, ভাত না করে চাপাটি বানানো যায় না? লালাজী বললেন, বাঙালি আদমি রুটি খাবে? বললাম, রুটিই আমরা ভালবাসি। বললেন, রুটি বানিয়ে দেবেন। একটা সমস্যা মিটল, অন্তত খালিপেটে লোকটার হাতে মরতে হবে না। বললাম রাতে তিনটে খাটিয়া চাই, সঙ্গে লেপ কম্বল। সামনের ওই ঘরে এক বন্ধু আছে, সে অসুস্থ। খাটিয়া লেপ ওখানে নিয়ে যাব। লালাজী বললেন, সব কিছুই মিলবে, তবে ওখানে রাতে থাকতে দেওয়া হয় না, কাজেই দোকানেই থাকতে হবে। আসলে ঘরটায় থাকতে চাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, দরজা আছে, এবং সেটা ভিতর থেকে বন্ধ করা যায়। আর এই দোকানটা একটা অতি সাধারণ চায়ের দোকান। সামনে তিনটে বাঁশের খুঁটি। সামনে ও ডানপাশটা পুরো খোলা। পিছন ও বাঁপাশটা খড়ের ও মাটির দেওয়াল মতো। খড়ের চাল। সঙ্গে এত টাকা পয়সা নিয়ে এখানে থাকা বেশ বিপজ্জনক বলেই মনে হয়। দিলীপ বলল, মাধবের সঙ্গে পরামর্শ করে, পরে এখানে আসা যাবে। রাজি হলাম না। পাঁচটাই মাত্র খাটিয়া আছে। তার মধ্যে একটা নিশ্চই লালাজীর। বাকী রইলো চারটে। তিনজন আছি। এর মধ্যে কেউ এসে হাজির হ'লে, জায়গা পাওয়া যাবে না। তখন সারারাত বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে রাস্তায় বসে কাটাতে হবে। আগে এসে খাটিয়া দখল করে, পরে অন্য চিন্তা করা যাবে।
ঘরটা থেকে দলা করে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে, দোকানে ফিরে চললাম। মাধবকে সন্দেহজনক লোকটার সম্বন্ধে সংক্ষেপে সব বললাম। দোকানে এসে তিনজনে তিনটে খাটিয়ায় সরাসরি উঠে বসে, লেপ-তোষক দিতে বললাম। পরপর তিনটে খাটিয়ায় আমরা তিনজন। আমার আর দিলীপের খাটিয়া দু'টোর মাথার দিকে, আর দু'টো খাটিয়া। স্থানাভাবে সবগুলো খাটিয়াই প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো। লালাজী জানালেন, একটু পরেই লেপ তোষক বার করে দেবেন। বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে। আমরা যে যার খাটিয়ায় চুপ করে বসে আছি। সন্দেহজনক লোকটা কিন্তু এখনও বসে আছে, আর মাঝেমাঝেই আমাদের লক্ষ্য করছে। ভুখি থেকে যে যুবকটির সঙ্গে এতটা পথ হেঁটে এলাম, তার থাকার ঘরটা যদিও এক মিনিটের পথ, তবু সে আর একবারও দেখা করতে এল না। ভেবে খুব আশ্চর্য লাগল যে, যে লোকটা এতটা পথ একসঙ্গে এল, চায়ের দাম পর্যন্ত দিতে দিল না, সে আমাদের এই বিপদের সময়, একবারও দেখা করতেও এল না!
এতক্ষণে সন্দেহজনক লোকটা উঠে চলে গেল। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে যে যার খাটিয়ায় শুয়ে, গল্পগুজব করতে লাগলাম। লালাজী বলল, খাটিয়া আর লেপ তোষকের ভাড়া, মাথাপিছু চার টাকা পঞ্চাশ পয়সা করে দিতে হবে। আজ রাতে আমরা যে জায়গায়, যে অবস্থায় এসে হাজির হয়েছি, তাতে চল্লিশ টাকা বললেও দিতে বাধ্য হতাম। আকাশ একেবারে পরিস্কার হয়ে, অসংখ্য তারা ফুটে গেছে। ঘরের খড়ের ছাদ দিয়েই নানা জায়গায় আকাশ দেখা যাচ্ছে। ভাল করে খুঁজলে হয়তো কালপুরুষ, সপ্তর্ষি মন্ডল-ও দেখা যেতে পারে। ভয় হল, রাতে জোরে বৃষ্টি এলে আমাদের কী অবস্থা হবে ভেবে। হাতে কোন কাজ নেই, সময় আর কাটে না। এক বান্ডিল বিড়ি নিয়ে, তিনজনে শেষ করতে বসলাম। কী করব, কিছু একটা তো করা চাই। লালাজী একটা থালায়, লাল, সবুজ, হলদে, কালো, নানা রঙের মেশানো ডাল নিয়ে একবার করে ফুঁ দিচ্ছেন, আর দোকান ঘরে একরাশ ধুলো উড়ে যাচ্ছে। এর থেকেও অনেক খারাপ খাবার খাওয়ার অভ্যাস আমাদের হয়ে গেছে। তাছাড়া খিদেও পেয়েছে যথেষ্ট। তাই খাবার তৈরির আশায় বসে রইলাম। সব শান্তির অবসান ঘটিয়ে, সেই সন্দেহজনক মক্কেল, আবার এসে হাজির হল। দিলীপ বললো ওর সাথে কথা বলে দেখলে হয়। আমরা বললাম, যেচে আলাপ করার দরকার নেই। কিন্তু দেখে মনে হল, সে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেই চায়। আমরাই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলাম—কোথায় থাকেন, কী করেন ইত্যাদি। লোকটা এবার এগিয়ে এসে আমাদের সামনে একটা খাটিয়ায় বসল। জানতে পারলাম, এখানে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বাড়ি মিরাটে। বছরে দু'একবার এর বেশি বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয় না। এখানে ওয়্যারলেস কর্মীদের সঙ্গে একই মেসে থাকে। শীতকালে এখানকার অনেকেই বাড়ি চলে যায়। তখন প্রায় একাই থাকেন। অথচ একা একা তাঁর একদম ভাল লাগে না। কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, লোকটা ভাল। একা একা থেকে কথা বলার অভ্যাস কমে গেছে, সুযোগও নেই। আমাদের সঙ্গে কথা বলতেই চাইছিলেন, তবে নিজে থেকে আগে কথা বলা ঠিক হবে কী না ভেবে, এতক্ষণ বলেনি। ওর কাছ থেকে গত বছরের বন্যার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম।
গত বছর পাঁচই আগষ্ট রাত্রিবেলা, এই গাংগানীর কিছুটা আগে ডাবরানীর দিকে পাহাড়ের একটা চূড়া গঙ্গার ওপর ভেঙে পড়ে। ওখানে গঙ্গা খুব সরু, ফলে জল চলাচল একবারে বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন সকালে সবাই দেখে গাংগানীতে গঙ্গা একবারে শুকিয়ে গেছে। দু'একটা ঝরনার জল, ও গঙ্গার যেটুকু জল চুঁইয়ে আসতে পারে, সেই জলই সামান্য ধারায় বয়ে যাচ্ছে। ছয় তারিখে প্রায় বিকেল নাগাদ, গঙ্গার জমে থাকা বিপুল জলের চাপে, ওই ভেঙে পড়া পাথরের একটা অংশ ঠেলে আরো ভেঙে ফেলে, প্রবল বেগে জল নীচের দিকে, অর্থাৎ গাংগানী, ভুখি, বা উত্তরকাশীর দিকে ধেয়ে আসে। বর্ষাকালের প্রায় বার-চোদ্দ ঘন্টার জমে থাকা জলের স্রোত, হঠাৎ মুক্ত হয়ে ভীষণ আকার ধারণ করে সমস্ত শহর ভেঙে, গুঁড়িয়ে দিয়ে বয়ে চলে যায়। এই গাংগানীতে, যেখানে আমরা এখন বসে আছি, তার অপর পারে দু'টো গেষ্ট হাউস, একটা আয়ুর্বেদিক কলেজ, একটা ইন্টার হাইস্কুল, কালীকম্বলীর ধর্মশালা ও বেশ কয়েকটা হোটেল ছিল। এক কথায় ওটা একটা বেশ বড় পাহাড়ি শহর ছিল। এখন এই মুহূর্তে আমরা যে জায়গাটায় আছি, তার নাম গরমকুণ্ড। গঙ্গার অপর পারটার নাম গাংগানী। এ দিকটায় খাড়া পাহাড়, অপর দিকে প্রায় গঙ্গার লেভেলেই ছিল গাংগানী শহর, বাস রাস্তা। ফলে গঙ্গার জল ওই বিশাল পাথর ঠেলে যেতে না পেরে, ডানদিকে বেঁকে গাংগানীর ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে, সমস্ত শহরটাকে ভেঙে নিয়ে যায়। আসবার সময় এত ঘটনা আমরা জানতাম না। তবে আমাদের বাড়ির কাছে যে ভদ্রলোক গঙ্গোত্রী যেতে না পেরে ফিরে এসেছিলেন, তাঁর কাছে এরই খবর শুনে, ইউ.পি. ট্যুরিজম অফিসে জিজ্ঞাসা করে আমরা হাসির খোরাক হয়েছিলাম তাতো বলেইছি। দোষটা তাদের নয়, তারা এ খবর জানতো না বা জানবার চেষ্টাও করে নি। আসবার সময় দেখেছিলাম, একটা ছোট মন্দির ও একটা ভাঙা বাড়ির দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই ওদিকে নেই। ভদ্রলোক জানালেন, পাঁচজন ট্যুরিষ্ট মারা যায়, তারা সবাই ছিল বাঙালি। স্থানীয় লোকেরা বিপদের আশঙ্কা করে আগেই বাড়িঘর, জিনিসপত্র ফেলে, ওপর দিকে পালিয়ে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে রক্ষা পায়। যাহোক, ভদ্রলোক এবার মেসে ফেরার জন্য উঠলেন। আমরা ডাবরানী আর কতটা রাস্তা, রাস্তায় দোকান পাব কী না, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করায়, ভদ্রলোক জানালেন ভুখি থেকে গাংগানী পাঁচ কিলোমিটার পথ। আবার এখান থেকে ডাবরানী আট কিলোমিটার পথ। পথে কোনও দোকান পাওয়া যাবে না। রাস্তাও খুবই কষ্টকর। এবার ভদ্রলোক বাসায় ফিরে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, কোন ভয় নেই। আপনারা ঠিক ভালভাবে পৌঁছে যাবেন, আমার শুভেচ্ছা রইল। ফিরবার পথে অবশ্যই দেখা হবে।
এদিকে লালাজীর রান্নাও শেষ। পাশের কাপড় ছাড়ার ঘরটা থেকে, চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। শুনলাম একদল পুরুষ ও মহিলা ওখানে এসে উঠেছে। আগেভাগে এখানে এসে জায়গা নিয়েছি বলে, নিজেদেরকে এখন ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। আমরা খাবার খেতে উঠতেই, লালাজী বললেন, ওখানে বসেই প্রেমসে খানা খাও। ডাল, সেই ছোট ছোট আলুর তরকারি, যার অধিকাংশই শক্ত এবং পচা, আর শোনপ্রয়াগের দোকানের পদ্ধতিতে তৈরী একপিঠ পোড়া অপর পিঠ কাঁচা সেই উপাদেয় রুটি। আলুর তরকারিতে একটু করে মাখন দিয়ে নিয়ে, মৌজ করে খাওয়া শুরু করলাম। এরকম একটা জায়গায় এই পরিবেশে বিনা পরিশ্রমে খাটিয়ায় বসে এই খাবার পেয়েই, লালাজীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আর সত্যি কথা বলতে, কী ভালই যে লাগল, মনে হল অমৃত খাচ্ছি। জানিনা একেই "খিদে পেলে বাঘে ধান খায়" বলে কী না। অসুস্থ মাধব পর্যন্ত তিনটে রুটি মেরে দিল। এখানকার মতো বড় বড় রুটি না হলেও, আমি বোধহয় খান ছয়-সাত উদরস্থ করে ফেললাম। তারপর দোকানের বাইরে একটু দাঁড়িয়ে, আকাশে অসংখ্য তারার মেলা ও নীচে গঙ্গার গর্জন উপভোগ করে, খাটিয়ায় ফিরে এসে শুয়ে পড়লাম। এর কাছে দিল্লির লালকেল্লার "লাইট অ্যান্ড সাউন্ড" তুচ্ছ মনে হল। আকাশে একসঙ্গে এত তারা আগে কখনও কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না। চারপাশে যে কী অন্ধকার বলে বোঝানো যাবে না। মনে হচ্ছে দরজা জানালাহীন একটা ঘরে, অমাবস্যার রাতে, আলো না জ্বেলে, আমরা শুয়ে আছি। মাধবের মানিব্যাগ, আমার মানিব্যাগ ও বিস্কুটের প্যাকেটটা আমার পিঠের তলায়, তোষকের ওপর রেখে, লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। উঁচু হয়ে থাকায় শুতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। লেপ-তোষকের সাদা রঙ বোধহয় বাইরের অন্ধকারের কালো রঙকেও হার মানাবে। তেমনি তার সুগন্ধ। ঘুম আসছে না। একটু পরেই নতুন বিপদ এসে হাজির হল। অসংখ্য ছাড়পোকার মতো এক রকম পোকা, সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিল। লালাজী আশ্বাস দিয়ে জানালেন, ও কিছু না, পিসু আছে। তাঁর বলার ধরণ দেখে মনে হল বাস্তু সাপের মতো এগুলো বাস্তু পিসু। পিসুকে একপ্রকার রক্তচোষা উকুন বলা যায়। হাওড়া-কলকাতায় এ জাতীয় এক প্রকার ছোট্ট, অতি পাতলা পোকাকে চামউকুন বলতে শুনেছি। লোমকূপে আটকে থেকে রক্ত চুষে খায়। নখ দিয়ে খুঁটেও তাদের লোমকূপ থেকে তুলে ফেলা যায় না। লালাজীর মুখে পিসুর কথা শুনে মনে হচ্ছে পাহাড়ি চামউকুনের খপ্পরে পড়েছি। রাতদুপুরে খাটিয়ায় উঠে বসে খস্ খস্ করে সারা শরীর চুলকাতে শুরু করলাম। এর আবার আর একটা অন্য যন্ত্রণাও আছে। গলা, কান, মুখ বা দেহের অন্য কোন অংশের চামড়ার ওপর দিয়ে এরা হেঁটে যাবার সময় একটা অস্বস্তি হয়। হাতের তেলো দিয়ে ঘষে ফেলে দেবার চেষ্টা করলে, এরা হাঁটা বন্ধ করে দেয়। মনে হবে শরীর থেকে পড়ে গেছে বা মরে গেছে। কিন্তু একটু পরেই আবার সেই পুরানো জায়গা থেকেই শরীর ভ্রমণ শুরু করে। মাধব ও দিলীপ ঘুমিয়ে পড়েছে। হতভাগ্য আমি একা জেগে বসে গা, হাত, পা চুলকে যাচ্ছি। এইভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা, হঠাৎ মনে হল মাথাটা কে যেন কিছু দিয়ে খুব জোরে ঘষে দিল। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি, মাথার কাছের খাটিয়াটায় কখন একজন এসে রাতের আশ্রয় নিয়েছে। ঘুম মাথায় উঠল। নতুন করে আবার গা চুলকাবার পালা শুরু হল। লোকটাকে মনে মনে অভিশাপ দিয়ে ফের ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। ঘরের ছাদের ফাঁক দিয়ে একটা জ্বলজ্বলে তারাকে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। ওটা শুকতারা না মঙ্গল গ্রহ ভাবতে বসলাম। মাধব আর দিলীপ ঐ নোংরা লেপই মাথা পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। আমার পেটটা আবার কেমন ব্যথা-ব্যথা করতে শুরু করল। একবার বাইরে যেতে পারলে হ'ত। আসবার সময় জায়গাটা ভালভাবে দেখবার সুযোগ হয় নি। টর্চ সঙ্গে থাকলেও, অন্ধকারে একা একা কোথায় যাব ভেবে পেলাম না। একবার ভাবলাম মাধবকে ডাকি, তারপর ওকে আর বিরক্ত না করে চুপচাপ শুয়ে থাকলাম।
আঠাশে আগষ্ট। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, এক কাপ চা পর্যন্ত না খেয়ে, লালাজীকে থাকা-খাওয়া বাবদ তেইশ টাকা পঞ্চান্ন পয়সা মিটিয়ে দিয়ে, ব্যাগ নিয়ে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বঁ হাতে রাস্তা। একটু ওপরে উঠে রাস্তায় পড়লাম। তিনজনে লাইন দিয়ে এক কাঁধে ব্যাগ, এক কাঁধে ওয়াটার বটল নিয়ে, লাঠি হাতে আস্তে আস্তে হেঁটে চললাম। সামান্য কিছু রাস্তা হাঁটার পরই, ডানপাশে একটা ঝরনা পাওয়া গেল। মাধব ও দিলীপকে বললাম, রাস্তায় আর ঝরনা পাওয়া যাবে কী না জানি না। কাজেই এখানেই সকালের কাজটা সেরে ফেলার ব্যবস্থা করা যাক। কিন্তু শেষ অবধি মস্ত বড় একটা ভুল করলাম, ওয়াটার বটলগুলোয় জল না ভরে নিয়ে। তারপর অনেকটা রাস্তা পার হয়ে এসেও, সত্যিই আর কোন ঝরনার দেখা পেলাম না। একে এরকম রাস্তার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। বোধহয় ৬৫-৭০ ডিগ্রি কোণে রাস্তা সোজা ওপর দিকে উঠেছে। মাঝে মাঝে স্থানীয় লোকেরা বেশ দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। আমাদের কিন্তু এর মধ্যেই দম বেরিয়ে যাবার উপক্রম। এখনও পর্যন্ত এত কষ্টকর রাস্তায় কখনও হাঁটতে হয় নি। স্থানীয় লোকেদের কাছে শুনেছিলাম, গাংগানী পর্যন্ত বাস রাস্তা হয়তো সামনের বছরেই তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু গাংগানী থেকে ডাবরানী বা ডাবরানী থেকে লঙ্কা পর্যন্ত রাস্তা কবে হবে, বলা খুব মুশকিল। ভুখি থেকে হেঁটে আসার সময় দেখলাম গাংগানী পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কাজও হচ্ছে। নদীর ওপার দিয়েই রাস্তা ছিল। কিন্তু এখন আর ওপারের পুরনো রাস্তা মেরামত করা সম্ভব নয়। নতুন করে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা সম্ভব কী না জানিনা। নদীর এপার দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করলেও, যে রাস্তা দিয়ে আমরা এখন হাঁটছি, সেটা কোনও কাজে আসবে বলে মনে হয় না। একে এটা একবারে কাঁচা পাহাড়, তার ওপর এ যা রাস্তা, জীপও উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। যাহোক, এক সময় আমাদের ওপরে ওঠার পালা শেষ হল। এবার ঠিক আগের মতই ৬০-৬৫ ডিগ্রি কোণে রাস্তা নীচে নামতে শুরু করল। রাস্তার পাশ দিয়ে ওয়্যারলেস বা টেলিগ্রাফের তার গেছে। নীচে, অনেক নীচে ভয়ঙ্কর-রূপিনী রূপালী গঙ্গা, আপন খেয়ালে নেচে নেচে বয়ে চলেছে। পায়ের আঙুলের ওপর চাপ দিয়ে ব্রেক কষার মতো করে নীচে নামার গতি রোধ করে করে, এগিয়ে চললাম। নীচে নামার সময় আমার কোন কষ্ট হয় না, তাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। মাধবের আবার ঠিক উল্টো। ওপরে ওঠার সময় ওর বিশেষ কোন কষ্ট হয় না। কিন্তু এবার এই ভাবে নীচে নামতে, ওর বেশ কষ্ট হচ্ছে। একভাবে নীচে নামতে নামতে, আমরা একবারে নীচে, প্রায় গঙ্গার কাছাকাছি নেমে এসে দেখলাম, রাস্তা আবার ওই আগের মতো একই ভাবে, ওপরে উঠতে শুরু করল। কোথাও কোন গ্রাম, দোকান, এমন কী লোকজনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে পাশ দিয়ে মালবোঝাই দু'একটা খচ্চর যাতয়াত করছে। হাঁটতে যে কী কষ্ট হচ্ছে বোঝাতে পারব না। রাস্তার ধারে বিশ্রাম নিতে বসলাম।
মাধবের খুব জল তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে ঝরনার অনেক খোঁজ করলাম, কিন্তু কোথাও কোন ঝরনা বা জলের সন্ধান করতে পারলাম না। গঙ্গার জল ঘোলাটে, তবু সে জলও যে একটু নিয়ে আসব, তারও উপায় নেই। ওখানে নামা আমাদের কর্ম নয়। সে চেষ্টা সুইসাইডের নামান্তর। রাস্তার একপাশে পাথরে বসে তিনজনে আমসত্ত্ব চুষে, লজেন্স খেয়ে, জল পিপাসা কমাতে ও বিশ্রাম নিতে লাগলাম। কিন্তু এর পরেও মাধব বলল, একটু জল না পেলে, ওর পক্ষে আর এক পাও হাঁটা সম্ভব নয়। বললাম, এখানে বসে থাকলেও তো জল পিপাসা কমবে না। কাজেই বাঁচতে গেলে কষ্ট হলেও এগিয়ে যেতে হবে। রাস্তায় জল পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু এখানে সে সম্ভাবনা মোটেই নেই। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। মধ্যে মধ্যে জলের আওয়াজ কানে আসছে বলে মনে হচ্ছে। খুব আশা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারছি ভুল শুনেছিলাম। কী রাস্তারে বাবা, আট কিলোমিটার পথে একটাও ঝরনা বা কোনো জলের দেখা নেই! আমরা যেন এক হিমালয়ান ডেজার্টের ওপর দিয়ে হাঁটছি। মরীচিকা তো দেখার ভুল বলেই জানতাম, শোনার ভুলের মরীচিকাও হয় বলে তো কখনো শুনিনি। এক জায়গায় গঙ্গা দেখলাম বেশ চওড়া, এবং আমাদের হাওড়া-কলকাতার গঙ্গার থেকেও স্রোতহীন। রাস্তার পাশে কোথাও কোথাও, বড় বড় পাথরের গায়ে সাদা রঙ করে, আলকাতরা দিয়ে কত রাস্তা বাকী আছে লেখা আছে। এগুলোই এপথের মাইলস্টোন। এবার রাস্তার পাশে একটা ঝরনার দেখা মিলল। মনে হচ্ছে আমরা প্রায় এসে গেছি। আর ভালোও লাগছে না। এতবড় রাস্তার শুরুতে আর শেষে দু'টো ঝরনা, আর এই কষ্টকর রাস্তা। তবু ভুললে চলবে কেন -"সব ভাল যার শেষ ভাল"। মাধব তো ঝরনা দেখে প্রায় লাফিয়েই উঠল। পারলে ছুটে গিয়ে সব জল খেয়ে নেয়। ওকে ঝরনার জল খুব বেশি না খেয়ে, শুধু গলা ভেজাতে বললাম। যদিও বাড়ি থেকে আসার সময় ভেবে এসেছিলাম, কোথাও ঝরনার জল খাব না। প্রয়োজনে খেতে হলে জিওলিন মিশিয়ে খাব। কিন্তু বাস্তবে একটু পরিস্কারভাবে জল তোলা যায় এমন জল দেখলেই আমরা দু'হাত ভরে নিয়ে পান করেছি। জিওলিনের কথা মনেও আসে নি। মাধবের শরীরটাও তো ভাল নয়, ওষুধ খেয়ে পথ চলছে। আমরাও অল্প অল্প জল খেলাম। জল ভর্তি কাঠি, খড়কুটো। তবু এবার কষ্টের পরিমাণ অনেকটাই লাঘব হল।
একটু এগিয়ে একটা ব্রিজ দেখলাম গঙ্গার মাঝখানে কাত হয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত বন্যার সময় ওটা জলের তোড়ে ভেঙে পড়েছিল। গঙ্গা এখানে এত চওড়া হয়ে গেছে যে, যে ব্রিজ আগে গঙ্গার ওপর এপার-ওপার করার জন্য ব্যবহৃত হ'ত, সেই ব্রিজ এখন নদীর মাঝখানে পড়ে আছে। ব্রিজের দু'দিকেই অনেকটা দূরে ডাঙা। যাহোক, রাস্তা এবার ভীষণভাবে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে। লাঠির ওপর ভর দিয়ে হাঁটলে কষ্ট অনেক কম হচ্ছে। পাথর ফেলা রাস্তা। এদিকে বোধহয় মাটিতে অভ্র মিশে থাকতে পারে। মনে হচ্ছে রাস্তা যেন অভ্রের পাত দিয়ে মোড়া। বড় বড় গাছের জন্য এতটা রাস্তার কোথাও একটু সূর্যের আলো পড়ে না। ফলে স্যাঁতস্যাঁতে, ভিজে ও বিপজ্জনকও। মাইলস্টোন অনুযায়ী, আর সামান্যই পথ বাকী আছে। অবশ্য যদি না এখানেও ত্রিযুগীনারায়ণের মতো রাস্তার মাপ হিসাব করা হয়ে থাকে। যতদূর দৃষ্টি যায়, কোথাও কিন্তু পাকা রাস্তা, বাস, দোকানপাট বা লোকজন চোখে পড়ছে না। এতটা পথ এলাম, একেবারে শুরুতে লালাজীর দোকানের একটু ওপরে সামান্য রাস্তা হেঁটে একটা চায়ের দোকান ছাড়া, সত্যিই আর কোনও দোকান নেই। এবার সামনে একটা ব্র্রীজ চোখে পড়ল। গাংগানী থেকে গরমকুণ্ড আসার জন্য যেমন পোর্টেবল ব্রিজ পার হতে হয়েছিল, সেরকমই একটা ব্রিজ। এই ব্রিজ পার হয়ে আবার গঙ্গার ওপারে, বাস রাস্তায় এসে উঠলাম। গাংগানী থেকে ডাবরানী, এই আট কিলোমিটার পথ, গঙ্গার ওপার দিয়ে হাঁটতে হয়। অর্থাৎ এই দু'টো জায়গার মধ্যে পুরনো বাসরাস্তার অবস্থা গত বছরের ঘটনায় এমন হয়েছে যে, বাস তো দূরের কথা, হেঁটেও যাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে এই নতুন রাস্তা দিয়েই হেঁটে আসতে হয়। আর সত্যিই এটা একেবারেই স্থানীয় লোকেদের হাঁটার পথই বটে। ব্রিজটা পার হয়ে, রাস্তা ধরে একটু এগিয়েই দেখলাম একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। লঙ্কা যাবে কী না জিজ্ঞাসা করায় উত্তর পেলাম, আরও এগিয়ে গেলে বাস পাওয়া যাবে। কথাটা শুনে মনে হল আমরা লঙ্কা প্রায় পৌঁছেই গেছি।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
আগের পর্ব – এবার কাহিনি কেদারনাথের
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সুবীর কুমার রায়ের নেশা ভ্রমণ ও লেখালেখি। ১৯৭৯ সালে প্রথম ট্রেকিং — হেমকুন্ড, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, বদ্রীনারায়ণ, মানা, বসুধারা, ত্রিযুগী নারায়ণ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী-গোমুখ ও যমুনোত্রী। সেখান থেকে ফিরে, প্রথম কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসা। ভ্রমণ কাহিনি ছাড়া গল্প, রম্য রচনা, স্মৃতিকথা নানা ধরণের লিখতে ভালো লাগলেও এই প্রথম কোনও পত্রিকায় নিজের লেখা পাঠানো। 'আমাদের ছুটি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক, পাঠক, সমালোচক এখন নেমে পড়েছেন কীবোর্ডে-মাউসে সহযোগিতাতেও।